বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/স্বাধীনতার মূল্য

উইকিসংকলন থেকে

স্বাধীনতার মূল্য
“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী”

 রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুরেন্দ্রনাথ ও বিপিনচন্দ্র এবং ধর্ম্মনীতি প্রচারে কেশবচন্দ্র ও স্বামী বিবেকানন্দ প্রভৃতি মনীষীগণ বাঙ্গালাদেশের অলঙ্কার, একথা শুধু আমাদের দেশে নয়, সুদূর পাশ্চাত্যদেশের বিদ্যম্মুণ্ডলীও স্বীকার করিয়া থাকেন। সুভাষবাবুর বক্তৃতায় আমরা সুরেন্দ্রনাথ বা বিপিনচন্দ্রের eloquence বা বাক্‌পটুতা দেখিতে পাই না একথা সত্য বটে, কিন্তু তাহার বক্তৃতায় যে মাদকতার সঞ্চার হয়, তাহা অন্য কোথাও দেখিতে পাই না। শব্দসম্পদে নেতাজী সুরেন্দ্রনাথ বা বিপিন চন্দ্রের তুল্য না হইলেও তাঁহার সরল বাক্যবিন্যাসে এমন মোহিনী শক্তি আছে, যাহা শ্রোতৃগণকে আত্মহারা করিয়া ফেলে। তাহারা যেন কোন এক অজানা রাজ্যে গিয়া পড়েন। যিনি মানব মনের উপরে এরূপ প্রভাব বিস্তার করিতে পারেন, তিনি অসাধ্য সাধন করিতে পারেন। শাস্ত্র বলেন ‘শব্দ ব্রহ্ম'। এক একটি শব্দে এক একটি অক্ষরের মধ্যে সাধারণ মানবের জ্ঞানরাজ্যের অতীত যে কত শক্তি নিহিত আছে, তাহা ভাষায় প্রকাশ করা সহজ নহে।

 সুরেন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ বা সুভাষচন্দ্র ক্ষণজন্মা পুরুষ। বাঙ্গালী জাতির পুণ্যফলে এরূপ অসাধারণ ধীশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি বাঙ্গালা দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। সুরেন্দ্র নাথের বক্তৃতা শুনিয়া আমাদের দেশের দরিদ্র জনসাধারণের মধ্য হইতে অল্পদিনের মধ্যেই ‘ফেডারেশন হল’ এর জন্য লক্ষ টাকা চাঁদা সংগৃহীত হইয়াছিল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে এই বিশ্ববিত বক্তাই বড়লাট লর্ড কার্জনের ‘বঙ্গবিভাগ’ (Partition of Bengal) রূপ নির্দ্ধারিত বিষয়কে (Settled fact) রহিত (Unsettled) করিয়া দিয়াছিলেন। আবার দেখিতে পাই, স্বামী বিবেকানন্দের এক একটি বক্তৃতা শুনিয়া আমেরিকার কোটিপতিগণ। তাঁহাদের যুগযুগান্তরের সঞ্চিত অর্থরাশি তাঁহার পদতলে অর্ঘ্য দিয়া তাহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন।

 নেতাজী সুভাষচন্দ্রের বক্তৃতায় এই মাদকতা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান আছে। বক্তৃতামঞ্চে উঠিলে তাঁহার বীরত্ব ব্যঞ্জক অথচ সৌম্যমূত্তি দেখিয়া শ্রোতৃগণ মনে মনে তাহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়েন এবং তাঁহার বক্তৃতা শুনিয়া বুঝিতে পারেন, স্বাধীনতাই মানবের সনাতন ধর্ম্ম—শুধু মানবের কেন সমগ্র জীবজগতে আমরা কি দেখিতে পাই? বনের পশু হইতে আকাশচারি বিহঙ্গমগণও স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করিতে সর্বদাই উৎসুক।

 এই অপার্থিব সুখের নিকট কুবেরের ধনভাণ্ডার অতি তুচ্ছ বলিয়া প্রতিপন্ন হয়। তাই স্বাধীনতা-যজ্ঞের এই ঋষি যখন উদাত্তস্বরে এই মহান্ সত্য প্রচার করিতে আরম্ভ করেন লোকে তখন তাঁহার পদতলে যথাসর্বস্ব বিসর্জন দিতে কুষ্ঠিত হয় না। এক একটি সভার সভাপতিরূপে সুভাষবাবু যে পুষ্পমাল্য পাইয়াছেন, লক্ষ লক্ষ টাকায় সেই সকল মাল্য বিক্রীত হইয়াছে। ‘আজাদ হিন্দ’ ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর শ্রীযুক্ত দীননাথের বর্ণিত বিবরণ হইতে জানা গিয়াছে যে পূর্ব এশিয়ায় কয়েকটি রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়া তিনি যে পুষ্পমাল্য পাইয়াছিলেন, বার লক্ষ টাকা দিয়া তাঁহার ভক্তগণ সেইগুলি ক্রয় করিয়াছে।

 সুভাষবাবুর এই বক্তৃতা সুদূর ব্রহ্ম, মালয় প্রভৃতি দেশে কিরূপ ফলপ্রসূ হইয়াছিল তাহা তাহার জাতীয় বাহিনী গঠনের ইতিহাস পাঠ করিলেই বুঝিতে পারা যায়। নেতাজীর উদ্দীপনাময়ী কয়েকটী বক্তৃতা শুনিয়াই প্রবাসী ভারতীয়গণ তাঁহাদের ধনভাণ্ডার এই আজন্ম ঋষির পদতলে উপহার দিয়াছিলেন। ইহার ফলে অনতিকালমধ্যে ২০ কোটী টাকা সংগৃহীত হইয়া আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক স্থাপিত হইয়াছিল।

 চারণ কবি রঙ্গলাল গাহিয়াছিলেন—

কোটা কল্পদাস থাকা নরকের প্রায় হে
নরকের প্রায়।
দিনেকের স্বাধীনতা স্বর্গসুখ তায় হে
স্বর্গসুখ তায়।।

 রঙ্গলালের এই সমর-সঙ্গীত সুভাষচন্দ্রই শুনিয়াছিলেন। এই নিনাদ “কানের ভিতর দিয়া তাহার মরমে পশিয়াছিল।” তাই স্বপ্নবিষ্টের ন্যায়-উন্মাদের ন্যায় তিনি একদিন তাহার সাধের জন্মভূমি ত্যাগ করিয়া নিরুদ্দেশ যাত্রা করিলেন—যদি দেশমাতৃবাকে দাসত্ব-শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিতে পারেন। স্বাধীনতা মন্তের উপাসক ইটালির উদ্ধারকর্ত্তা ম্যাটসিনি বলিয়াছিলেন, “আত্মনির্ভরশীল না হইলে কোনও জাতিই স্বাধীন হইতে পারে না।” সুভাষচন্দ্র দেখাইয়াছেন, আত্মনির্ভরশীল হইয়া একজন মানুষ কিরূপ অসাধ্য সাধন করিতে পারে। জন্মভূমি ত্যাগ করিবার সময়ে তিনি লোকবল বা অর্থবলের প্রত্যাশা করেন নাই, অথচ বিদেশে গিয়া স্বীয় প্রতিভাবলে সৈন্যবল ও অর্থবল উভয়ই সংগ্রহ করিয়াছিলেন, এবং পরিশেষে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়া কবি রঙ্গলালের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করিয়াছিলেন। তিনি তাঁহার সদ্যগঠিত ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর সাহায্যে আসামের একটি অংশ জয় করিয়া সত্য সত্যই “দিনেকের স্বাধীনতা” অর্জন করিয়া স্বর্গসুখ উপভোগ করিয়াছিলেন।