বিষয়বস্তুতে চলুন

বিচিন্তা/জাতিচরিত্র

উইকিসংকলন থেকে

জাতিচরিত্র

ভাইকাউণ্ট স্যামুএল একজন বিখ্যাত দার্শনিক ও রাজনীতিক। এককালে সার হারবার্ট স্যামুএল নামে ইনি ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলেন। সম্প্রতি তিরাশি বৎসরে পদার্পণ করে ইনি পার্লামেণ্টে হাউস অভ লর্ডসে নিজ দেশের নৈতিক অবস্থা (The State of Britain's Morals) সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দিয়েছেন। তার ভাবার্থ এই—

 ব্রিটেনের রাজনীতিক আর্থনীতিক আন্তর্জাতিক প্রভৃতি নানা সমস্যা আছে, কিন্তু সব চেয়ে চিন্তার বিষয়—আমাদের জাতীয় চরিত্র। যাঁরা এ সম্বন্ধে খবর রাখেন তাঁদের অনেকে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। ব্রিটিশ জাতির সাহস ও দেশপ্রেম পূর্ণমাত্রায় আছে। আমাদের নির্বাচক মণ্ডলে যে তিন কোটি ভোটদাতা আছে তাদের বুদ্ধি ও কর্তব্যনিষ্ঠা পূর্বের তুলনায় বেড়েছে ছাড়া কমে নি। কিন্তু দেশবাসীর এক অংশের যে চারিত্রিক অবনতি দেখা যাচ্ছে তা মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। আমাদের বড় বড় শহরে যেসব দুষ্ক্রিয়ার আড্ডা আছে তা ব্রিটিশ সভ্যতার কলঙ্ক। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে কিছু কাল এদেশে অপরাধীর সংখ্যা এত কমে গিয়েছিল যে অর্ধেক জেলখানা বন্ধ রাখলেও চলত। কিন্তু এখন তার উল্‌টো হয়েছে, বিশেষত অল্পবয়স্ক অপরাধীর সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে। খবরের কাগজে প্রতিদিন যেসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিবরণ ছাপা হয় তা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত লজ্জা ও ক্ষোভের বিষয়। পূর্বের তুলনায় লাম্পট্য খুব বেড়ে গেছে, ব্যভিচার তুচ্ছ পরিহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিবাহভঙ্গ এখন একটা নিত্যনৈমিত্তিক সামান্য ঘটনা বলে গণ্য হয়। আরও ভয়ানক কথা—the vices of Sodom and Gomorrah appear to be rife among us। বাইবেলে আছে, ভূমিকম্প আর অগ্ন্যুৎপাতে এর প্রায়শ্চিত্ত হয়েছিল। এখন তা হবার নয়, কিন্তু বর্তমান সমাজে এই পাপের পরিণাম আরও মারাত্মক ভাবে দেখা দেবে, আমাদের ধর্মবুদ্ধি বিষাক্রান্ত হবে। অনেকে মনে করেন এসব কথা সাধারণের আলোচ্য নয়। কিন্তু ধর্মনীতি যদি ক্ষুণ্ন হয় তবে সমগ্র জাতিকে তার ফলভোগ করতে হবে। স্বর্গ নরক সম্বন্ধে জনসাধারণের পূর্বে যে ধারণা ছিল তা এখন নেই, দুই মহাযুদ্ধের ফলে বিধাতার মঙ্গলময় বিধানেও লোকের আর আস্থা নেই। শারীরবিদ্যা আর মনোবিদ্যার নূতন নূতন মতবাদের ফলে আমাদের ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ কমে গেছে। এখন শোনা যায়, প্রত্যেক মানুষের আচরণ তার জন্মগত gene সমূহের (আদিম জন্মকোষের কতকগুলি অতি সূক্ষ্ম উপাদানের) ফল, অতএব বেশী দোষ ধরা ঠিক নয়, মানুষের ব্যক্তিগত ত্রুটি উদার ভাবে বিচার করাই উচিত।

 পরিশেষে স্যামুএল বলেছেন, আমাদের সদাচার বা কদাচারের মূলে আছে ব্যক্তিগত আদিম জন্মকোষের বৈশিষ্ট্য—এইটেই সব কথা নয়। যে সামাজিক পরিবেশে আমরা জন্মগ্রহণ করি তার রীতিনীতি এবং লোকমত অনুসারেই আমাদের চরিত্র প্রধানত গঠিত হয়। সকল দেশের মানবসমাজের বহু যুগের চিন্তার ফলে যা উদ্ভূত হয়েছে সেই সর্বজনীন ধর্মনীতি অবলম্বন করাই শ্রেয়স্কর—এই সহজ বুদ্ধি আমাদের ফিরে আসা আবশ্যক।

 ফরাসী আর মার্কিন জাতির দোষও অনেক পত্রিকায় আলোচিত হয়। ফ্রান্সের মন্ত্রিসভা স্থায়ী হয় না তার কারণ ফরাসী জাতি অব্যবস্থিতচিত্ত। শাসকবর্গের অসাধুতা লাম্পট্য আর অকর্মণ্যতার জন্যই গত যুদ্ধে পরাজয় ঘটেছিল। সম্প্রতি Ernest Raynaud নামক একজন ফরাসী সম্পাদক New York Times পত্রিকায় লিখেছেন―সুরাসক্তিতে ফরাসী জাতি অদ্বিতীয়, মেয়ে পুরুষ ছেলে বুড়ো মিলে প্রতি বৎসরে যা উদরস্থ করে তাতে খাঁটী অ্যালকোহলের পরিমাণ দাঁড়ায় জন পিছু গড়ে সাত গ্যালন (প্রায় ৮৪ বোতল ব্রাণ্ডি বা হুইস্কির সমান)। ফ্রান্সের একপঞ্চমাংশ লোক মদ তৈরি বা বিক্রি ক’রে জীবিকা নির্বাহ করে। এই দেশব্যাপী সুরাপ্লাবন রোধ করবার চেষ্টা মাঝে মাঝে হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রপরিষদে শৌণ্ডিকরাই সর্বেসর্বা, তাদের অমতে কিছু করা সরকারের অসাধ্য। খবরের কাগজ নীরব, কারণ অপ্রিয় সত্য লিখলেই বিজ্ঞাপনের আয় বন্ধ হবে। সম্প্রতি একজন মন্ত্রী মদ্যপতিদের দমন করতে গিয়ে পদচ্যুত হয়েছেন।

 কয়েক মাস পূর্বে Times Literary Supplement-এ আমেরিকার নাগরিক জীবনের কঠোর সমালোচনা ছাপা হয়েছে। জুয়া জুলুম আর ধনবাহুল্য―এই হচ্ছে মার্কিন সভ্যতার অঙ্গ। ধনীরা আত্মরক্ষার জন্য গ্যাংস্টার বা গুণ্ডাদের টাকা দিয়ে ঠাণ্ডা রাখে। রাষ্ট্রচালনার সকল ক্ষেত্রে ঘুষ চলে, সেনেটার জজ মেয়র শেরিফ সেনাপতি কেউ বাদ যান না। ধনী অপরাধীরা অনায়াসে আইনকে ফাঁকি দিতে পারে।...ইত্যাদি।

 বড় বড় পাশ্চাত্ত্য জাতির দোষের ফর্দ শুনে আমাদের উৎফুল্ল হবার কারণ নেই। আমরা শান্ত শিষ্ট সোনার চাঁদ, নৃশংসতা ব্যভিচার লাম্পট্য সুরাসক্তি আমাদের মধ্যে কম, অতএব আমাদের ভবিষ্যৎ অতি উজ্জ্বল—এমন মনে করা ঘোর মূর্খতা। বৃহৎ রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের জন্য জওহরলাল আছেন, বিধান রায় আছেন, তাঁদের শায়েস্তা রাখবার জন্য কমিউনিস্ট প্রজা-সোশালিস্ট প্রভৃতি দল আছে, দুর্মুখ খবরের কাগজ আছে, অতএব আমরা রাম-শ্যাম-যদুর দল নিশ্চিন্ত হয়ে যা পারি রোজগার করব আর অবসর কালে সিনেমা ফুটবল নাচ গান গল্প উপন্যাস সর্বজনীন পূজো প্রভৃতি সংস্কৃতিচর্চায় মেতে থাকব―এই মনোবৃত্তি অনর্থকর। যে স্বাধীনতা আমরা সাত শ বছর পরে অতি কষ্টে পেয়েছি তা বজায় রাখতে পারব কিনা, ব্রিটিশ ভারতের চাইতে সমৃদ্ধতর ভারত গড়তে পারব কিনা―এসব প্রশ্নের উত্তর এখনও দেওয়া যায় না। আমরা, অর্থাৎ দেশের জনসাধারণ যদি নিজের অসংখ্য ত্রুটি শোধনের চেষ্টা না করি এবং প্রজার কর্তব্যে অবহেলা করি তবে কোনও রাষ্ট্রনেতা বা রাজনীতিক দল আমাদের রক্ষা করতে পারবেন না।

 ভারতবাসী মোটের উপর শান্তিপ্রিয় অহিংস। এ দেশেও নেশাখোর, জুয়াড়ী, সাধারণ আর অসাধারণ লম্পট আছে, চোর ডাকাত খুনে ঘুষখোর আছে, যুদ্ধের পর তাদের উপদ্রব বেড়েও গেছে, কিন্তু জনসংখ্যায় এইসব অপরাধীর অনুপাত বেশী নয়। ব্যভিচার খুব কম, ভবিষ্যতে হয়তো কিছু বাড়বে, কিন্তু স্ত্রীস্বাধীনতার অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে তা সইতে হবে। কয়েকটি বিষয়ে আমরা পাশ্চাত্ত্য জাতির তুলনায় ভাল, কিন্তু অন্যান্য বহু বিষয়ে অতি মন্দ। সমগ্র ভারতের অবস্থা আলোচনা না করে শুধু বাংলা দেশের (পশ্চিম বাংলার) কথাই ধরা যাক।

 স্যামুএল বলেছেন, ব্রিটিশ জাতির সাহস ও দেশপ্রেম পূর্ণমাত্রায় আছে। দেশরক্ষার জন্য অপরিহার্য এই দুই গুণ আমাদের কতটা আছে? অনেক বাঙালী ছেলে মেয়ে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে তা সত্য, কিন্তু যে পদ্ধতিতে এদেশের বিপ্লবীরা বহু বৎসরে ব্রিটিশ সরকারকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, সে পদ্ধতিতে আক্রামক শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করা চলবে না। বর্তমান সরকারকে জব্দ করবার উদ্দেশ্যে পুলিসের সঙ্গে লড়াই, ট্রাম-বাস পোড়ানো, বোমা ছোড়া, দোকান লুঠ, ইত্যাদি কর্মের জন্য বীরপুরুষ ঢের আছে তা ঠিক। কিন্তু আজ যদি কোনও বক্তিয়ার খিলজি সতরো বা সাত হাজার সৈন্য নিয়ে দেশ আক্রমণ করে তবে ক জন বাঙালী তাদের বাধা দেবে? যাদের প্ররোচনায় আমাদের ছেলেরা ‘চলবে না চলবে না, মানতে হবে মানতে হবে’ বলে গর্জন করে, সেই অন্তরালস্থ নেতারা তখন কি করবে? শত্রুর দলে যোগ দেবে না তো? তখন কি শুধুই গোর্খা-শিখ-গাঢ়োআলী পল্টন আমাদের হয়ে লড়বে আর আমরা ঘরের দরজা বন্ধ করে দুর্গানাম জপ করব?

 হুজুগে মেতে বা দেশদ্রোহীর প্ররোচনায় গুণ্ডামি করা আর দেশরক্ষার জন্য যুদ্ধ করা এক নয়। মাতৃভূমি রক্ষার জন্য শুধু সাহস নয়, শিক্ষাও আবশ্যক। দেশরক্ষার জন্য যে সৈন্যবাহিনী গঠিত হচ্ছে তাতে যদি দলে দলে বাঙালীর ছেলে সাগ্রহে যোগ দেয় তবেই তাদের এবং তাদের পিতামাতার সাহস আর দেশপ্রেম প্রমাণিত হবে। এককালে ইংরেজ আমাদের রক্ষা করত, এখন অবাঙালী ভারতবাসী রক্ষা করবে―এ কথা ভাবতেও লজ্জা হওয়া উচিত।

 দেশের উপর একটা প্রচ্ছন্ন আতঙ্কের জাল ছড়িয়ে আছে, প্রজা বা শাসক কেউ তা থেকে মুক্ত নয়। শিক্ষকরা ছাত্রদের ভয় করেন, পরীক্ষার সময় যারা নকল করে তাদের বাধা দিলে প্রাণহানির সম্ভাবনা আছে। পিতামাতা সন্তানকে শাসন করতে সাহস করেন না, পাছে সে আত্মহত্যা করে অথবা তার সঙ্গীরা সদলে এসে প্রতিশোধ নেয়। ব্রিটিশ আমলে পুলিস বেপরোয়া ছিল, তার এই ভরসা ছিল যে প্রবলপ্রতাপ মনিব পিছনে আছেন। কিন্তু এখন পুলিস দ্বিধায় পড়েছে, কোন্ ক্ষেত্রে কতটা বলপ্রয়োগ চলবে তা তার বর্তমান মনিবরা স্থির করতে পারেন না। চোর ডাকাত প্রভৃতি

মামুলী অপরাধীদের বেলায় ঝঞ্ঝাট নেই, কিন্তু আজকাল যেসব নূতন নূতন বেআইনী ব্যাপার হচ্ছে তার বেলায় নির্ভয়ে কর্তব্য পালন অসম্ভব। অফিস ও কারখানার কর্মীরা মনিবদের আটকে রাখে, ধর্মঘটীরা রাজপথে লোকের যাতায়াতে বাধা দেয়, স্কুল কলেজ বা অফিস প্রভৃতি কর্মস্থান অবরোধ করে, গুণ্ডারা ট্রাম-বাস পোড়ায়। এসব ক্ষেত্রে পুলিস উভয় সংকটে পড়ে। নিষ্ক্রিয় থাকলে তাকে অকর্মণ্য বলা হবে, কর্তব্য পালন করলে নিষ্ঠুর অত্যাচারী বলা হবে। অধিকাংশ খবরের কাগজ অপক্ষপাতে কিছু লিখতে সাহস করে না, পাছে কোনও দল চটে। তারা দুই দিক বজায় রাখার চেষ্টা করে, ফলে পাঠকরা বিভ্রান্ত হয়। দশ-বারো বছরের ছেলে যখন বলে, নেমে যান মশাইরা, এ গাড়ি পোড়ানো হবে, তখন যাত্রীরা সুবোধ শিশুর মতন আজ্ঞা পালন করে। নাগরিক কর্তব্যবুদ্ধি এবং অন্যায় কর্মে বাধা দেবার বিন্দুমাত্র সাহস কারও নেই। ঝঞ্ঝাটে দরকার কি বাপু―এই হচ্ছে জনসাধারণের নীতি। পাশ্চাত্ত্য পানদোষ আর ইন্দ্রিয়দোষের তুলনায় এই ক্লীবতা আর কর্তব্যবিমুখতা অনেক বড় অপরাধ।

 শাসকবর্গ যদি ঘোর অত্যাচারী হয় এবং প্রতিকারের অন্য উপায় না থাকে তবে রাষ্ট্রবিপ্লব ছাড়া গতি নেই। কিন্তু কোনও দলের অসন্তোষের কারণ ঘটলেই যদি সেই দল উপদ্রব করে তবে অরাজকতা উপস্থিত হয় এবং তার ফলে জনসাধারণ সংকটে পড়ে। লোকে শান্তি চায়, অধিকাংশ লোকের এ বুদ্ধিও আছে যে দুষ্টদমনের জন্য বলপ্রয়োগ আবশ্যক এবং মাঝে মাঝে তা মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে, তার ফলে নির্দোষেরও অপঘাত হতে পারে, যেমন যুদ্ধকালে অনেক অযোদ্ধাও মারা যায়। আমাদের শাসকবর্গ এবং তাঁদের সমর্থকগণও তা বোঝেন, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কর্তব্যপালনে ভয় পান। বোধ হয় ভবিষ্যৎ নির্বাচনের কথা ভেবেই তাঁরা মতি স্থির করতে পারেন না। জনসাধারণের যদি ধারণা হয় যে কংগ্রেসী সরকার অত্যাচারী তবে তাঁদের ভোট দেবে কে? যে ছোকরার দল আজ হইহই করে উপদ্রব করছে, নির্বাচনের সময় তাদেরই তো সাহায্য নিতে হবে, তারাই তো ‘ভোট ফর অমুক’ বলে চেঁচাবে। অতএব তাদের চটানো ঠিক নয়। খবরের কাগজকেও উপেক্ষা করা চলবে না, তারা জনসাধারণকে খেপিয়ে দিতে পারে। শাসকবর্গ এবং তাঁদের সমর্থকগণ যদি নিজ দলের লাভ-অলাভ জয়-পরাজয় সমজ্ঞান করে নির্ভয়ে কর্তব্যপালন করেন তবেই বর্তমান অবস্থার প্রতিকার হবে। জনকতক নেতা না হয় নির্বাচনে পরাস্ত হবেন, কিন্তু জনসাধারণ যদি সুশাসনের ফল উপলব্ধি করে তবে ভবিষ্যতে তারা উপযুক্ত প্রতিনিধি নির্বাচনে ভুল করবে না।

 যেমন অন্য দেশে তেমনি এদেশেও অধিকাংশ লোকের কোনও নির্দিষ্ট রাজনীতিক মত নেই। রাস্তার পোস্টার, প্রচারকদের বুলি, আর দলীয় খবরের কাগজের দ্বারাই তারা সাময়িক ভাবে প্রভাবিত হয়। বাঁধাধরা রাজনীতিক মত না থাকলে কোনও ক্ষতি হয় না, রাজনীতির চাইতে ঢের বেশী দরকার প্রজার যথার্থ স্বার্থবুদ্ধি এবং বিভিন্ন দলের উক্তি-প্রত্যুক্তি বিচার করবার ক্ষমতা। যে কিষান-মজদুর-রাজের কথা অনেক নেতা বলে থাকেন তার মানে কি? কিষান-মজদুর সেক্রেটারিয়েটে বসে রাজ্য চালাবে, না জনকতক নেতা তাদের প্রতিনিধি সেজে কর্তৃত্ব করবেন? সাম্যবাদের জয় হলেও তো দেশে মূর্খ অকর্মণ্য ধূর্ত আর স্বার্থপর লোক থাকবে, রাজ্যচালনের ভার কারা নেবে তা স্থির করবে কে? বিদেশী গুরুর আজ্ঞাবহ শিষ্যরা? কমিউনিস্টরা ব্রিটেন-আমেরিকার বিস্তর দোষ ধরে, কিন্তু রাশিয়ার তিলমাত্র দোষের কথা বলে না কেন? কংগ্রেসের পন্থা কি? বার বার গান্ধীজীর নাম নিলে আর মাঝে মাঝে খাদি পরলেই কি কংগ্রেসী হওয়া যায়?

 সাত বৎসর আগেও কংগ্রেসের প্রবল প্রতিপত্তি ছিল, জনসাধারণ কিছু বুঝুক না বুঝুক কংগ্রেসের বশে চলত। কিন্তু এখন অন্তত পশ্চিম বাংলায় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা কমে গেছে, লোকে মনে করে কংগ্রেসী সরকার রাজস্বের অপব্যয় করেন, স্বজন পোষণ করেন, ধনপতিদের বশে চলেন। এই ধারণার উচ্ছেদ না হলে কংগ্রেসী সরকারের শীঘ্রই পতন হবে।

 প্রবাদ আছে―প্রজা যেমন, তার ভাগ্যে শাসনও তেমনি জোটে। আমাদের জনসাধারণের কর্তব্যজ্ঞান না বাড়লে শাসনের উৎকর্ষ হবে না। দেশে শিক্ষিত জনের সংখ্যা যতই অল্প হ’ক, তাঁরাই উদ্‌যোগী হয়ে জনসাধারণকে সুবুদ্ধি দিতে পারেন, যাতে তারা প্রজার অধিকার আর কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন হয়। কিন্তু শিক্ষিত সম্প্রদায় উদাসীন, তাঁদের অধিকাংশ নিজের ধান্দা বা শখ নিয়ে ব্যস্ত। যারা অল্পবয়স্ক তারা নিত্য নব নব বর্বরতায় মেতে আছে―বাগ্‌দেবীর বাৎসরিক শ্রাদ্ধ, হোলির উন্মত্ত হুল্লোড়, যে-কোনও পর্ব উপলক্ষ্যে লাউড স্পীকারের অপপ্রয়োগ আর পটকার আওয়াজ। এদের সুরুচি আর সংযম শেখাবার গরজ কারও নেই।

 আমরা পাশ্চাত্ত্য দেশের মতন নেশাখোর নই, কিন্তু একটা প্রবল মানসিক মাদক এদেশের জনসাধারণকে অভিভূত করে রেখেছে, শিক্ষিত সম্প্রদায়ও তার কবল থেকে মুক্ত নয়। আমরা ধর্মপ্রাণ জাতি বলে গর্ব করি, কিন্তু আমাদের ধর্মের অর্থ প্রধানত বাহ্য অনুষ্ঠান, নানা রকম অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস, এবং ভক্তির চর্চা। অর্থাৎ পুরোহিত মারফত পূজা, কবচ-মাদুলি, আর যদি ভক্তি থাকে তবে ইষ্টদেবের আরাধনা। পৃথিবীর অনেক দেশেই ধর্মচর্চা এই রকম। কিন্তু যদি সাধারণ জীবনযাত্রাও অন্ধ সংস্কারের বশে চলে তবে জাতির অধোগতি অবশ্যম্ভাবী।

 নানা বিষয়ে এদেশের লোকের বুদ্ধি মোহগ্রস্ত হয়ে আছে। নেপালবাবার দৈব ঔষধের লোভে অসংখ্য লোকের কষ্টভোগ আর কুম্ভস্নানপুণ্যের দুর্বার আকর্ষণে বহু লোকের প্রাণহানি এই মোহের ফল। ফলিত জ্যোতিষ একটি প্রাচীন সংস্কার, যেমন মারণ উচ্চাটন বশীকরণ। কিছুমাত্র বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই তবুও লোক মনে করে এ একটা বিজ্ঞানসম্মত বিদ্যা। ভাগ্যগণনা কত ক্ষেত্রে সফল হয় আর কত ক্ষেত্রে বিফল হয় কেউ তা বিচার করে না। অনেক খবরের কাগজে প্রতি সপ্তাহে জ্যোতিষিক ভবিষ্যদ্‌বাণী প্রকাশ করে সাধারণের অন্ধবিশ্বাসে ইন্ধন যোগানো হয়। আমাদের যেটুকু পুরুষকার আছে দৈবের উপর নির্ভর করে তাও বিনষ্ট হচ্ছে।

 মহাভারতে কৃষ্ণ ধর্মের এই অর্থ বলেছেন—ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহু ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ―ধারণ (রক্ষণ বা পালন) করে এজন্যই ধর্ম বলা হয়, ধর্ম প্রজাগণকে ধারণ করে। অর্থাৎ সমাজহিতকর বিধিসমূহই ধর্ম। প্রজার যা সর্বাঙ্গীণ হিত তাই সমাজের হিত। প্রজা বলবান বিদ্যাবান বুদ্ধিমান নীতিমান বিনয়ী (disciplined) হবে, আত্মরক্ষায় ও দেশরক্ষায় প্রস্তুত থাকবে, দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করবে, সর্বপ্রকারে জনহিত চেষ্টা করবে―এই হল ধর্ম, এতেই লোকের কর্মপ্রবৃত্তি চরিতার্থ হয়। অধিকন্তু যে লোক ঈশ্বরপরায়ণ হয়, অর্থাৎ বিশ্ববিধানের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে শান্তি ও আনন্দ লাভ করতে পারে, মানুষের স্বাভাবিক ভাববৃত্তি বা emotion তৃপ্ত করতে পারে, তার ধর্মাচরণ সর্বতোভাবে সার্থক হয়। যিনি কর্মবিমুখ হয়ে শুধু ভক্তিরসে ডুবে থাকেন তিনি ধর্মাত্মা বা মুক্তপুরুষ হলেও একদেশদর্শী, তাঁর ধর্মসাধনা পূর্ণাঙ্গ নয়, সাধারণের পক্ষে আদর্শস্বরূপও নয়। যিনি শুধু দেহচর্চা বা বিদ্যাচর্চা নিয়ে থাকেন তিনিও ধর্মের অংশমাত্র চর্চা করেন। বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সকলের জন্য নয়, প্রত্যেকে নিজের রুচি আর প্রবৃত্তি অনুসারেই ধর্মাচরণ করতে পারে এবং তাতেই সিদ্ধিলাভ করে ধন্য হতে পারে। কিন্তু জনসাধারণ যদি কেবল বাহ্য অনুষ্ঠান পালন করে এবং ধর্মের অন্যান্য অঙ্গ উপেক্ষা করে কেবল ভক্তির চর্চা করে, তবে তার সর্বাঙ্গীণ উন্নতি হতে পারে না।

 বঙ্কিমচন্দ্র ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে ‘অনুশীলন’ প্রসঙ্গে সর্বাঙ্গীণ ধর্মের ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁর পরেও বহু মনীষী অনুরূপ উপদেশ দিয়েছেন। আধুনিক যুগে বোধ হয় বিবেকানন্দই একমাত্র সন্ন্যাসী যিনি সর্ব ভারতে কালোপযোগী বলিষ্ঠ ধর্মের প্রচার করেছেন। এদেশে সম্প্রতি বহু ধর্মোপদেষ্টা সাধুর আবির্ভাব হয়েছে, তাঁদের ভক্তও অসংখ্য। তাঁরা প্রধানত ভক্তিতত্ত্ব এবং ভগবানের লীলাই প্রচার করেন। বহু ভক্ত তাঁদের কথায় শোকে শান্তি পায়, দয়া ক্ষমা অলোভ প্রভৃতি সদ্‌গুণের প্রেরণা পায়। কিন্তু তাঁদের ধর্মব্যাখ্যান এমন নয় যাতে আমাদের জাতিচরিত্রের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি হতে পারে। ভক্তগণের মতে তাঁদের কেউ কেউ অলৌকিক শক্তির প্রভাবে অনুগত জনের আর্থিক উন্নতি করতে পারেন, রোগ সারাতে পারেন, মকদ্দমা জেতাতে পারেন, নানা রকম ভেলকি দেখাতেও পারেন। কয়েক জনের শিষ্যরা প্রচার করে থাকেন যে তাঁদের ইষ্টগুরু ভগবানের অবতার বা পূর্ণ ভগবান। গুরু তা অস্বীকার করেন না, blasphemyর জন্য শিষ্যকে ধমকও দেন না। আমাদের অন্য অভাব যতই থাকুক অবতারের অভাব নেই। সাধুদের পরিত্রাণ আর দুষ্কৃতদের বিনাশ―এই হল অবতারের আসল কাজ। তার দিকে এঁরা একটু দৃষ্টি দেন না কেন?

 বিদ্যালয়ে ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত―এ কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়। যে ধর্ম সমাজ ও রাষ্ট্রের হিতকর এবং জাতিচরিত্রের উন্নতিসাধক, সেই সর্বসম্মত সর্বাঙ্গীণ ধর্মই আমাদের লোকায়ত (secular) রাষ্ট্রের বিদ্যালয়ে শেখানো যেতে পারে। শিক্ষকরাই এই ভার নেবেন, ছাত্রের বাল্যকাল থেকেই তাকে বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক আর রাষ্ট্রিক কর্তব্য শেখাবেন। এখন যারা অল্পবয়স্ক, ভবিষ্যতে তারাই রাষ্ট্র চালাবে, তাদের শিক্ষা আর চরিত্রগঠনের ব্যবস্থায় বিলম্ব করা চলবে না। যখন শ্রমিকের দল ধর্মঘট করে তখন উপস্থিত সংকট থেকে উদ্ধার পাবার জন্য সরকার বা কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে রফা করেন, অনিচ্ছায় বহু অর্থ ব্যয় করেন। এই অর্থের হয়তো আরও সংপ্রয়োগ হতে পারত। কিন্তু শিক্ষকদের কর্মের ফল সদ্য দেখা যায় না, সে কারণে সরকার বোঝেন না যে রাষ্ট্রের অন্যান্য বহু শাখাকে বঞ্চিত করেও শিক্ষককে তুষ্ট রাখতে হবে, যাতে তাঁর অভাব না থাকে এবং শিক্ষার কার্যে তিনি পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করতে পারেন।

 ১৩৬০