বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ/স্বাধীন কর্ম্মক্ষেত্রে

উইকিসংকলন থেকে

স্বাধীন কর্ম্মক্ষেত্রে

 বিদ্যাসাগরের সরকারী কর্ম্ম হইতে অবসরগ্রহণ দেশ ও দশের পক্ষে প্রভূত কল্যাণকর হইয়াছিল। তাঁহার একটা মোটা রকমের আয় কমিয়া গেল বটে, কিন্তু তিনি মোটেই বিচলিত হইলেন না—তাঁহার স্বরচিত পুস্তক বিক্রয়ের আয়ই তখন মাসিক তিন-চার হাজার টাকা।[১] তিনি এইবার স্বাধীনভাবে কর্ম্মক্ষেত্রে অগ্রসর হইবার সুযোগ পাইলেন।

মেট্রোপলিটান্ ইনষ্টিটিউশন

 মেট্রোপলিটান কলেজের প্রতিষ্ঠা তাঁহার অতুলনীয় কীর্ত্তি। ইহাই বাঙালীর নিজের চেষ্টায় নিজের অধীনে স্থাপিত উচ্চতর শিক্ষার প্রথম কলেজ। মেট্রোপলিটানের নাম এখন বিদ্যাসাগর কলেজ হইয়াছে। পুর্ব্বে ইহার নাম মেট্রোপলিটান ছিল না। ১৮৫৯ খৃষ্টাব্দে কয়েকজন প্রতিষ্ঠাপন্ন ভদ্রলোক মিলিয়া শঙ্কর ঘোষের লেনে ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল’ নামে এক ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সরকারী স্কুল অপেক্ষা অল্প বেতনে মধ্যবিত্ত ঘরের হিন্দু-বালকগণকে ইংরেজী শিক্ষা দান করাই এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল। মিশরীদের স্কুলে মাহিনা কম ছিল বটে, কিন্তু খৃষ্টধর্ম্ম প্রচারিত হইত বলিয়া হিন্দুরা সেখানে ছেলেদের পাঠাইতে চাহিত না। প্রথম কয়েক মাস প্রতিষ্ঠাতারাই স্কুল পরিচালনা করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর সরকারী চাকরি ছাড়িয়া দিয়াছেন জানিতে পারিয়া তাঁহারা বিদ্যাসাগরকে ও তাঁহার বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্কুল-পরিচালনে সহায়তা করিতে আহ্বান করিলেন। তাঁহারা স্বীকৃত হইলে এক পরিচালক সমিতি গঠিত হইল। ১৮৬১, মার্চ মাস পর্য্যন্ত স্কুলটি এই সমিতি কর্ত্তৃক পরিচালিত হইয়াছিল। পরিচালকবর্গের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতান্তর উপস্থিত হওয়াতে এই বৎসরে দুইজন প্রতিষ্ঠাতা পদত্যাগ করিয়া এক প্রতিদ্বন্দ্বী বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন।

 শিক্ষাপ্রচার এবং বিদ্যালয় পরিচালনে বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব অসাধারণ। তা ছাড়া তিনি নিঃস্বার্থভাবে সাধারণের কার্য করিতেন। ইহা বুঝিয়াই অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতারা বিদ্যাসাগর এবং রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, রামগোপাল ঘোষ, রায় হরচন্দ্র ঘোষ বাহাদুর, রমানাথ ঠাকুর ও হীরালাল শীলের হাতে বিদ্যালয় পরিচালনের ভার দিয়া অবসরগ্রহণ করিলেন। নূতন কমিটি গঠিত হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় সেক্রেটারি নিযুক্ত হইলেন। স্কুলের নানারূপ সংস্কারে হাত দিয়া বিদ্যালয়ের সুপরিচালনার জন্য তিনি কতকগুলি নিয়ম প্রণয়ন করিলেন। বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য—হিন্দু-বালকগণকে ইংরেজী এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে সম্যকরূপে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা। ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দের গোড়া হইতে বিদ্যালয়টির নূতন নাম হয়—হিন্দু মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউশন। ইতিমধ্যেই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরিচালনার গুণে ছাত্রগণ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অপূর্ব্ব কৃতিত্ব দেখাইতে লাগিল। রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ (১৮৬৬) এবং হরচন্দ্র ধোষের (১৮৬৮) মৃত্যুতে এবং তৎপুর্ব্বে অপর তিনজন সদস্যের পদত্যাগে বিদ্যালয় পরিচালনের সম্পূর্ণ ভার বিদ্যাসাগরের উপর পড়িল। ১৮৭২, জানুয়ারি মাসে দ্বারকানাথ মিত্র ও কৃষ্ণদাস পালকে লইয়া তিনি এক কমিটি গঠন করিলেন এবং বিদ্যালয়ে যাহাতে বি. এ. পর্যন্ত পড়া যায় তদ্বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করিলেন। বি. এ. পড়াইবার অধিকার না পাইলেও ইহাতে ফার্ষ্ট আর্টস্ পর্য্যন্ত পড়িতে পারা যাইবে, ইহা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুর করিলেন। ১৮৭৪ সালে ফার্ষ্ট আর্টস্ পরীক্ষায় মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউশন গুণানুসারে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিল। দেশীয় লোকের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের এই সাফল্য দেখিয়া সকলেই বিস্ময়ান্বিত হইয়াছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার সাট্‌ক্লিফ সাহেব বলিয়াছিলেন,—“পণ্ডিত তাক্ লাগাইয়া দিয়াছেন!” ১৮৭৯ খৃষ্টাব্দে মেট্রোপলিটান ফার্ষ্ট গ্রেড কলেজে পরিণত হইল, এবং ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে এখান হইতে ছাত্রেরা বি. এ. পরীক্ষা দিতে প্রেরিত হইল। পত্মীক্ষার ফল ভালই হইল।

 ইউরোপীয় শিক্ষকের সাহায্য ব্যতীত কোনো কলেজ যে ভাল চলিতে পারে অথবা অধ্যাপনা ভাল হইতে পারে, ইহা লোকের ধারণার অতীত ছিল। বিদ্যোগর নিজের কলেজে ভারতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত করিয়া দেখাইলেন, কলেজের অধ্যাপনায় বিলাতী অধ্যাপকেরাই সর্বশ্রেষ্ঠ নয়, ভারতীয় শিক্ষকের দ্বারা অনুরূপ, এমন কি কোনো কোনো বিষয়ে উৎকৃষ্টতর শিক্ষার ব্যবস্থা প্রবর্ত্তিত করা যাইতে পারে। মেট্রোপলিটানের সাফল্য দেখিয়া অন্যান্য কলেজ হইতে অনেক ছাত্র এই কলেজে ভর্তি হইতে লাগিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় শিক্ষা বিস্তারের এক নূতন দিক খুলিয়া দিলেন। সত্য কথা বলিতে কি, বে-সরকারী কলেজ প্রতিষ্ঠার তিনিই প্রবর্তক। তিনি যখন যে-কাজে হাত দিতেন, সে-কাজ সার্থক না করিয়া ক্ষান্ত হইতেন না। তা ছাড়া শিক্ষা-বিষয়ে তাঁহার অভিজ্ঞতা ছিল বিপুল। সারা বাংলার শিক্ষা বিস্তারে যে-প্রতিভা নিযুক্ত ছিল, তাহা একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীভূত হওয়াতে, সেই প্রতিষ্ঠান অতুলনীয় সফলতা লাভ করিল।

 বিদ্যাসাগরের আর একটি বড় গুণ ছিল। তিনি পরের উপর নির্ভর করিয়া থাকিতেন না, সকল কাজ নিজে দেখিতেন। তিনি অনেক সময় বিদ্যালয়ে হঠাৎ উপস্থিত হইয়া দেখিতেন নিয়ম-মত কাজ চলিতেছে কি-না। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আদেশ ছিল, শিক্ষকেরা কখনও বালকদের উপর শারীরিক শাস্তি বিধান করিতে পারিবেন না। তিনি বলিতেন, শান্ত সদয় ব্যবহারের দ্বারা ছাত্রদের দোষ সংশোধন করিতে চেষ্টা করা উচিত। যাহাকে সংশোধনের অতীত বলিয়া বোধ হইত, তেমন ছাত্রকে তিনি বিদ্যালয় হইতে বিতাড়িত করিতেন।

 বাক্‌ল্যাণ্ড সাহেব ভারত-সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারী ছিলেন। তিনি তাঁহার পুস্তকে লিখিয়াছেন,—

“১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা শহরে মেট্রোপলিটান ইনষ্টিটিউশনের প্রতিষ্ঠা বঙ্গদেশে শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে এক সুপরিচিত ঘটনা। এই ধরণের পরবর্ত্তী বহু বিদ্যালয়ের ইহা আদর্শস্থানীয়। মেট্রোপলিটান কলেজের সংশ্লিষ্ট স্কুলে আট শত ছাত্র অধ্যয়ন করিত; এতদ্ব্যতীত কলিকাতাতেই এই বিদ্যালয়ের চার-পাঁচটি শাখা বিদ্যমান ছিল।”

 যে জমির উপর এখন কলেজটি অবস্থিত, ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে তাহা কেনা হয়। সুবৃহৎ বিদ্যালয়-গৃহ নির্মাণ করিতে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা বায় হইয়াছে। ১৮৮৭ সালের গোড়া হইতেই এখানে বিদ্যালয়টি স্থানান্তরিত হয়।

গ্রন্থ-রচনা

 বিদ্যাসাগর অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। তাহার মধ্যে দু-চারখানির কথা বাদ দিলে বাকী সমস্তই অনুবাদ, অনুসৃতি বা পাঠ্যপুস্তক। অবশ্য একথা অস্বীকার করিলে চলিবে না যে তখনকার দিনে এরূপ উত্তম পাঠ্যপুস্তকের বিলক্ষণ অভাব ছিল। বিদ্যাসাগরের পূর্ব্বে বাংলা-গদ্যের অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তকগুলি তাহার নিদর্শন। বিদ্যাসাগরের গদ্য কিঞ্চিৎ সংস্কৃতানুসারী হইলেও অতি সুললিত। বঙ্কিমচন্দ্রের যশোবিস্তারের পূর্ব্বে সাহিত্যিক হিসাবে ঈশ্বরচন্দ্র অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছেন,—

“প্রবাদ আছে যে, রাজা রামমোহন রায় সে সময়ের প্রথম গদ্য-লেখক। তাঁহার পর যে গদ্যের সৃষ্টি হইল, তাহা লৌকিক বাঙ্গালা ভাষা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমন কি, বাঙ্গালা ভাষা দুইটি স্বতন্ত্র বা ভিন্ন ভাষায় পরিণত হইয়াছিল। একটীর নাম সাধুভাষা অর্থাৎ সাধুজনের ব্যবহার্য্য ভাষা, আর একটীর নাম অপর ভাষা অর্থাৎ সাধু ভিন্ন অপর ব্যক্তিদিগের ব্যবহার্য্য ভাষা। এস্থলে সাধু অর্থে পণ্ডিত বুঝিতে হইবে।...
“এই সংস্কৃতানুসারিণী ভাষা প্রথম মহাত্মা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তের হাতে কিছু সংস্কার প্রাপ্ত হইল। ইহাদিগের ভাষা সংস্কৃতানুসারিণী হইলেও তত দুর্ব্বোধ্য নহে। বিশেষতঃ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর। তাঁহার পূর্ব্বে কেহই এরূপ সুমধুর বাঙ্গালা গদ্য লিখিতে পারেন নাই, এবং তাঁহার পরেও কেহ পারে নাই।”[২]
 বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ একটি অতুলনীয় প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছেন। বিদ্যাসাগরের ভাষা সম্বন্ধে তিনি লিখিয়াছেন,—
“তাঁহার প্রধান কীর্ত্তি বঙ্গভাষা। যদি এই ভাষা কখনও সাহিত্যসম্পদে ঐশ্বর্য্যশালিনী হইয়া উঠে, যদি এই ভাষা অক্ষয় ভাবজননীরূপে মানব-সভ্যতার ধাতৃগণের ও মাতৃগণের মধ্যে গণ্য হয়... তবেই তাঁহার এই কীর্ত্তি তাঁহার উপযুক্ত গৌরব লাভ করিতে পারিবে।...
“বিদ্যাসাগর বাঙ্গলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্ব্বে বাঙ্গলায় গদ্য-সাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল কিন্তু তিনিই সর্ব্বপ্রথমে বাঙ্গলা-গদ্যে কলা-নৈপুণ্যের অবতারণা করেন।...বিদ্যাসাগর বাঙ্গলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজ গতি এবং কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন—এখন তাহার দ্বারা অনেক সেনাপতি ভাবপ্রকাশের কঠিন বাধাসকল পরাহত করিয়া নব নব ক্ষেত্র আবিষ্কার ও অধিকার করিয়া লইতে পারেন—কিন্তু যিনি এই সেনানীর রচনাকর্তা, যুদ্ধজয়ের যশোভাগ সর্ব্বপ্রথমে তাঁহাকেই দিতে হয়।...
“বিদ্যাসাগর বাঙ্গলা লেখায় সর্ব্বপ্রথমে কমা, সেমিকোলন্ প্রভৃতি ছেদচিহ্নগুলি প্রচলিত করেন।...বাস্তবিক একাকার সমভূম বাঙ্গলা রচনার মধ্যে এই ছেদ আনয়ন একটা নবযুগের প্রবর্ত্তন। এতদ্দ্বারা, যাহা জড় ছিল তাহা গতিপ্রাপ্ত হইয়াছে।...
“বাঙ্গলা ভাষাকে পূর্ব্বপ্রচলিত অনাবশ্যক সমাসাড়ম্বর ভার হইতে মুক্ত করিয়া তাহার পদগুলির মধ্যে অংশযোজনার সুনিয়ম স্থাপন করিয়া বিদ্যাসাগর যে বাঙ্গলা-গদ্যকে কেবলমাত্র সর্ব্বপ্রকার ব্যবহারযোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন তাহা নহে, তিনি তাহাকে শোভন করিবার জন্যও সর্ব্বদা সচেষ্ট ছিলেন। গদ্যের পদগুলির মধ্যে একটা ধ্বনিসামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া, তাহার গতির মধ্যে একটি অনতিলক্ষ্য ছন্দস্রোত রক্ষা করিয়া, সৌম্য এবং সরল শব্দগুলি নির্ব্বাচন করিয়া বিদ্যাসাগর বাঙ্গলা-গদ্যকে সৌন্দর্য্য ও পরিপুর্ণতা দান করিয়াছেন। গ্রাম্য পাণ্ডিত্য এবং গ্রাম্য বর্ব্বরতা উভয়ের হস্ত হইতেই উদ্ধার করিয়া তিনি ইহাকে পৃথিবীর ভদ্রসভার উপযোগী আর্য্য ভাষা রূপে গঠিত করিয়া গিয়াছেন। তৎপূর্ব্বে বাঙ্গলা-গদ্যের যে অবস্থা ছিল তাহ আলোচনা করিয়া দেখিলে এই ভাষাগঠনে বিদ্যাসাগরের শিল্পপ্রতিভা ও সৃজনক্ষমতার প্রচুর পরিচয় পাওয়া যায়।”[৩]

 বিদ্যাসাগরের রচনা কিরূপ আবেগময়ী, ওজস্বী ও প্রাঞ্জল ছিল তাহা ‘বিধবাবিবাহ’ পুস্তকের নিম্নোদ্ধৃত অংশ পাঠ করিলেই প্রতীয়মান হইবে:—

“ধন্য রে দেশাচার! তোর কি অনির্ব্বচনীয় মহিমা! তুই তোর অনুগত ভক্তদিগকে, দুর্ভেদ্য দাসত্বশৃঙ্খলে বন্ধ রাখিয়া, কি আধিপত্য করিতেছিস। তুই, ক্রমে ক্রমে আপন একাধিপত্য বিস্তার করিয়া, শাস্ত্রের মস্তকে পদার্পণ করিয়াছিস, ধর্ম্মের মর্ম্মভেদ করিয়াছিস, হিতাহিতবোধের গতিরোধ করিয়াছিস, ন্যায় অন্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ করিয়াছিস। তোর প্রভাবে, শাস্ত্রও অশাস্ত্র বলিয়া গণ্য হইতেছে, অশাস্ত্রও শাস্ত্র বলিয়া মান্য হইতেছে; ধর্ম্মও অধর্ম্ম বলিয়া গণ্য হইতেছে, অধর্ম্মও ধর্ম্ম বলিয়া মান্য হইতেছে। সর্ব্বধর্ম্মবহিষ্কৃত, যথেচ্ছাচারী দুরাচারেরাও, তোর অনুগত থাকিয়া, কেবল লৌকিকরক্ষাগুণে, সর্বত্র সাধু বলিয়া গণনীয় ও আদরণীয় হইতেছে; আর, দোষস্পর্শশূন্য প্রকৃত সাধু পুরুষেরাও, তোর অনুগত না হইয়া, কেবল লৌকিকরক্ষায় অযত্নপ্রকাশ ও অনাদরপ্রদর্শন করিলেই, সর্ব্বত্র নাস্তিকের শেষ, অধার্ম্মিকের শেষ, সর্ব্বদোষে দোষীর শেষ বলিয়া গণনীয় ও নিন্দনীয় হইতেছেন। তোর অধিকারে, যাহারা, জ্ঞাতিভ্রংশকর, ধর্ম্মলোপকর কর্ম্মের অনুষ্ঠানে সতত রত হইয়া, কালাতিপাত করে, কিন্তু লৌকিক রক্ষায় যত্নশীল হয়, তাহাদের সহিত আহার ব্যবহার ও আদান প্রদানাদি করিলে ধর্ম্মলোপ হয় না; কিন্তু যদি কেহ, সতত সৎকর্মের অনুষ্ঠানে রত হইয়াও, কেবল লৌকিক রক্ষায় তাদৃশ যত্নবান্ না হয়, তাহার সহিত আহার, ব্যবহার ও আদান প্রদানাদি দূরে থাকুক, সম্ভাষণ মাত্র করিলে, এক কালে সকল ধর্ম্মের লোপ হইয়া যায়।...
“হা ভারতবর্ষ! তুমি কি হতভাগ্য! তুমি তোমার পুর্ব্বতন সন্তানগণের আচারগুণে, পুণ্যভূমি বলিয়া সর্ব্বত্র পরিচিত হইয়াছিলে; কিন্তু, তোমার ইদানীন্তন সন্তানেরা, স্বেচ্ছানুরূপ আচার অবলম্বন করিয়া, তোমাকে যেরূপ পুণ্যভূমি করিয়া তুলিয়াছেন, তাহা ভাবিয়া দেখিলে, সর্ব্ব শরীরের শোণিত শুষ্ক হইয়া যায়। কত কালে তোমার দুরবস্থাবিমোচন হইবেক, তোমার বর্ত্তমান অবস্থা দেখিয়া, ভাবিয়া স্থির করা যায় না।...
“তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়। দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না; যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা বলিয়া বোধ হয় না; দুর্জয় রিপুবর্গ এক কালে নির্ম্মূল হইয়া যায়। কিন্তু, তোমাদের এই সিদ্ধান্ত যে নিতান্ত ভ্রান্তি মূলক, পদে পদে তাহার উদাহরণ প্রাপ্ত হইতেছ। ভাবিয়া দেখ, এই অনবধানদোষে সংসারতরুর কি বিষময় ফল করিতেছ। হায় কি পরিতাপের বিষয়! যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম্ম নাই, ন্যায় অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদসদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিকরক্ষাই প্রধান কর্ম্ম ও পরম ধর্ম্ম; আর যেন সে দেশে হতভাগা.. অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে।
“হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্ম গ্রহণ কর, বলিতে পারি না!”

 যাঁহারা বাল্যকালে বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ পাঠ করিয়াছেন তাঁহারা কখনও ইহার ভাষার লালিত্য ও মাধুর্য্য বিস্মৃত হইতে পারিবেন না। নিম্ন-উদ্ধৃত অংশের মত সীতার বনবাসের বহু স্থলই তাঁহাদের স্মৃতিপথে জাগরিত থাকিবে।—

“সীতা অন্য দিকে অঙ্গুলিনির্দ্দেশ করিয়া বলিলেন, নাথ, দেখুন দেখুন, এ দিকে আমাদের দক্ষিণারণ্যপ্রবেশ কেমন সুন্দর চিত্রিত হইয়াছে। আমার স্মরণ হইতেছে, এই স্থানে আমি সূর্য্যের প্রচণ্ড উত্তাপে নিতান্ত ক্লান্ত হইলে, আপনি, হস্তস্থিত তালবৃন্তু আমার মস্তকের উপর ধরিয়া, আতপনিবারণ করিয়াছিলেন। রাম বলিলেন, প্রিয়ে, এই সেই সকল গিরিতরঙ্গিণীতীরবর্তী তপোবন; গৃহস্থগণ, বানপ্রস্থধর্ম্ম অবলম্বনপুর্ব্বক, সেই সেই তপোবনের তরুতলে বিশ্রামসুখসেবায় সময়াতিপাত করিতেছেন। লক্ষ্মণ বলিলেন, আর্য্য, এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি। এই গিরির শিখরদেশ, আকাশপথে সতত সঞ্চরমান জলধরমণ্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত; অধিত্যকা প্রদেশ ঘন সন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল, ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী, তরঙ্গবিস্তার করিয়া, প্রবল বেগে গমন করিতেছে। রাম বলিলেন, প্রিয়ে, তোমার স্মরণ হয়, এই স্থানে কেমন মনের সুখে, ছিলাম। আমরা কুটীরে থাকিতাম; লক্ষ্মণ, ইতস্ততঃ পর্য্যটন করিয়া আহারোপযোগী ফল মূল প্রভৃতির আহরণ করিতেন; গোদাবরীতীরে মৃদু মন্দ গমনে ভ্রমণ করিয়া, আমরা, প্রাহ্ণে ও অপরাহ্ণে, শীতল সুগন্ধ গন্ধবহের সেবন করিতাম। হায়! তেমন অবস্থায় থাকিয়াও, কেমন সুখে সময় অতিবাহিত হইয়াছিল!”
 বিদ্যাসাগরের “প্রভাবতী সম্ভাষণ”ও একটি আবেগপূর্ণ রচনা। তাঁহার প্রিয়পাত্র রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিশুকন্যা প্রভাবতীর মৃত্যুতে ইহা রচিত।—
“বৎসে প্রভাবতি! তুমি, দয়া, মমতা ও বিবেচনায় বিসর্জ্জন দিয়া, এ জন্মের মত, সহসা, সকলের দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইয়াছ; কিন্তু আমি, অনন্যচিত্ত হইয়া, অবিচলিত স্নেহভরে তোমার চিন্তায় নিরন্তর এরূপ নিবিষ্ট থাকি যে, তুমি, এক মুহূর্ত্তের নিমিত্ত, আমার দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইতে পার নাই।...
“আমি, সর্ব্ব ক্ষণ, তোমার অদ্ভুত মনোহর মূর্তি ও নিরতিশয় প্রীতিপদ অনুষ্ঠান সকল অবিকল প্রত্যক্ষ করিতেছি; কেবল, তোমায় কোলে লইয়া, তোমার লাবণ্যপূর্ণ কোমল কলেবর পরিস্পর্শে, শরীর অমৃতরসে অভিষিক্ত করিতে পারিতেছি না।...
“বৎসে! তোমার কিছুমাত্র দয়া ও মমতা নাই। যখন, তুমি, এত সত্বর চলিয়া যাইবে বলিয়া, স্থির করিয়া রাখিয়াছিলে, তখন তোমার সংসারে না আসাই সর্ব্বাংশে উচিত ছিল। তুমি স্বল্প সময়ের জন্য আসিয়া, সকলকে কেবল মর্ম্মান্তিক বেদনা দিয়া গিয়াছ। আমি যে তোমার অদর্শনে, কত যাতনাভোগ করিতেছি, তাহা তুমি একবারও ভাবিতেছ না।...
“একমাত্র তোমায় অবলম্বন করিয়া, এই বিষময় সংসার অমৃতময় বোধ করিতেছিলাম। যখন, চিত্ত বিষম অসুখে ও উৎকট বিরাগে পরিপূর্ণ হইয়া, সংসার নিরবচ্ছিন্ন যন্ত্রণাভবন বলিয়া প্রতীয়মান হইত সে সময়ে, তোমায় কোলে লইলে, ও তোমার মুখচুম্বন করিলে, আমার সর্ব্ব শরীর, তৎক্ষণাৎ, যেন অমৃতরসে অভিষিক্ত হইত। বৎস! তোমার কি অদ্ভুত মোহিনী শক্তি ছিল, বলিতে পারি না। তুমি অন্ধতমসাচ্ছন্ন গৃহে প্রদীপ্ত প্রদীপের, এবং চিরশুষ্ক মরুভূমিতে প্রভূত প্রস্রবণের, কার্য্য করিতেছিলে।...
“তুমি, স্বল্প কালে নরলোক হইতে অপসৃত হইয়া, আমার বোধে, অতি সুবোধের কার্য্য করিয়াছ। অধিক কাল থাকিলে, আর কি অধিক সুখভোগ করিতে; হয়ত, অদৃষ্টবৈগুণ্যবশতঃ, অশেষবিধ যাতনাভোগের একশেষ ঘটিত। সংসার যেরূপ বিরুদ্ধ স্থান, তাহাতে, তুমি, দীর্ঘজীবিনী হইলে, কখনই, সুখে ও সচ্ছন্দে, জীবনযাত্রার সমাধান করিতে পারিতে না।
“কিন্তু, এক বিষয়ে, আমার হৃদয়ে নিরতিশয় ক্ষোভ জন্মিয়া রহিয়াছে। অন্তিম পীড়াকালে, তুমি, পিপাসায় আকুল হইয়া, জলপানের নিমিত্ত, নিতান্ত লালায়িত হইয়াছিলে। কিন্তু, অধিক জল দেওয়া চিকিৎসকের মতানুযায়ী নয় বলিয়া, তোমার ইচ্ছানুরূপ জল দিতে পারি নাই।...
“তোমার অদ্ভুত মনোহর মূর্তি, চিরদিনের নিমিত্ত, আমার চিত্রপটে চিত্রিত থাকিবেক। কালক্রমে পাছে তোমায় বিস্মৃত হই, এই আশঙ্কায়, তোমার যারপরনাই চিত্তহারিণী ও চমৎকারিণী লীলা সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করিলাম।...
“বৎসে! তোমায় আর অধিক বিরক্ত করিব না; একমাত্র বাসনা ব্যক্ত করিয়া বিরত হই—যদি তুমি পুনরায় নরলোকে আবির্ভূত হও, দোহাই ধর্ম্মের এইটি করিও, যাঁহারা তোমার স্নেহপাশে বদ্ধ হইবেন, যেন তাঁহাদিগকে, আমাদের মত, অবিরত, দুঃসহ শোকদহনে দগ্ধ হইয়া, যাবজ্জীবন যাতনাভোগ করিতে না হয়।”[৪]

দয়া-দাক্ষিণ্য

 দরিদ্র এবং আর্ত্তের সহায়, দয়ালু দাতা এবং জনহিতৈষী রূপে বিদ্যাসাগরের তুলনা নাই। এই মহদ্‌গুণের জন্য আজ তিনি প্রাতঃস্মরণীয়। কাহাকেও বিপন্ন দেখিলেই তাঁহার প্রাণ কাঁদিয়া উঠিত এবং লোকের দুঃখ দুর করিবার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করিতেন। আজও তিনি দেশবাসীর নিকট “দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর” নামে পরিচিত। দুঃস্থ এবং অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করিতে তাঁহার আয়ের অধিকাংশই ব্যয়িত হইত। তাঁহার সাহায্যেই বহু দরিদ্র বিধবার সংসার চলিত। শত শত অনাথ বালকের প্রতিপালন ও শিক্ষার ভার তিনি নিজের স্কন্ধে গ্রহণ করিয়াছিলেন। গৃহে গৃহে তাঁহার নাম শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হইত। ধনী দরিদ্র নির্ব্বিশেষে সকলেই তাঁহাকে ভালবাসিত। শুধু বন্ধু এবং সহকৰ্মীরাই নয় তাঁহার রিরুদ্ধবাদীরাও তাঁহাকে শ্রদ্ধা করিত। তাঁহার সাহস ছিল অতুলনীয় এবং দাক্ষিণ্য অপূর্ব্ব। অথচ তিনি নিজে নিতান্ত সরল জীবন যাপন করিতেন। এই তেজস্বী দানবীর সরল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের কাছে বড় বড় জমিদারের মাথা আপনি নত হইয়া পড়িত। বাংলার তদানীন্তন ছোটলাট স্যর সিসিল বীডন এই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষাব্রতীর সহিত প্রায়ই পরামর্শ করিতেন, এবং তাঁহার সঙ্গে আলাপ করিতে বড়ই আনন্দ পাইতেন।

রাজসম্মান

 অবসরগ্রহণের বিশ বৎসর পরে ১৮৮০ সালে নববর্ষের প্রথম দিনে ভারত-গভর্ন্মেণ্ট তাঁহাকে সি. আই. ই. উপাধিতে ভূষিত করেন। এই উপাধিদানে বিদ্যাসাগর ন’ন সরকার নিজেই সম্মানিত হইয়াছিলেন। তৎপূর্ব্বে (১৮৬৪, ৪ জুলাই) বিদ্যাসাগর বিলাতের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির অনারারি মেম্বর—সম্মানিত সভ্য—নির্ব্বাচিত হন।[৫] এই উচ্চসম্মান লাভ এযাবৎকালের মধ্যে মুষ্টিমেয় বাঙালীর ভাগ্যেই ঘটিয়াছে। ছোটলাট স্যর রিচার্ড টেম্পলের আমলে তাঁহাকে এই সম্মান-লিপি প্রদান করা হয়—

“বিধবা বিবাহ আন্দোলনের[৬] নেতারূপে তাঁহার আন্তরিকতার এবং ভারতবর্ষীয় সমাজের অগ্রগামী দলের নায়করূপে তাঁহার মর্য্যাদা স্বীকার করিয়া পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ইহা প্রদত্ত হইল।” (১ জানুয়ারি, ১৮৭৭)।

মৃত্যু

 তাঁহার শরীর পূর্ব্বেই ভাঙিয়া গিয়াছিল। ক্রমেই তিনি বিশেষরূপে অসুস্থ হইয়া পড়িতে লাগিলেন। বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজনের বিয়োগ-ব্যথা এবং কয়েক বৎসরব্যাপী রোগভোগে দেহ সম্পূর্ণরূপে বিকল হইয়া গেল। তিনি কঙ্কালসার হইয়া পড়িলেন। একে একে শ্রমসাধ্য সকল কার্য্যই তাঁহাকে পরিত্যাগ করিতে হইল। নগরের কলকোলাহল তাঁহার আর সহ্য হইত না। তিনি নানা স্বাস্থ্যকর স্থানে যাইতে লাগিলেন। কার্ম্মাটারের বাড়িতেই তিনি বেশী যাইতেন।

 শরীর আর বহিল না। ১৮৯১, ২৯এ জুলাই পূর্ণ ৭০ বৎসর বয়সে বাংলার শ্রেষ্ঠ মনীষী ইহলোক হইতে অপসৃত হইয়া গেলেন।

 ১৮৯১, ২৭ আগষ্ট ছোটলাট স্যর চার্লস এলিয়টের সভাপতিত্বে কলিকাতার টাউনহলে এক বিরাট অধিবেশন হয়। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্মৃতি চিরস্থায়ী করিবার জন্য কি উপায় অবলম্বন করা যায়, ইহাই ছিল সভার আলোচ্য বিষয়। সভার ফলে সেই বিরাট ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ সংস্কৃত কলেজের প্রথম অধ্যক্ষের এক প্রস্তরমূর্ত্তি কলেজ-ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয়।

পরিশিষ্ট

বিদ্যাসাগরের গ্রন্থাবলী

প্রচারকাল নাম বিষয়
(১৮৪২-৪৭) বাসুদেব-চরিত (অপ্রকাশিত) শ্রীমদ্ভাগবতের ১০ম স্কন্ধ অবলম্বনে রচিত। ইহাই বিদ্যাসাগরের সর্ব্বপ্রথম গদ্যগ্রন্থ বলিয়া পরিচিত।
১৮৪৬[৭]
১৯০৩ সংবৎ
বেতালপঞ্চবিংশতি ‘বৈতালপঁচীসী’ নামক প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বনে রচিত।
১৮৪৮
১৯০৪ সংবৎ
বাঙ্গালার ইতিহাস,
২য় ভাগ[৮]
মার্শম্যান সাহেবের History of Bengal—এর শেষ নয় অধ্যায় অবলম্বনে রচিত। সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসন-আরোহণ হইতে বেণ্টিঙ্কের রাজত্বকাল পর্য্যন্ত ইতিহাস।
১৮৪৯, সেপ্টেম্বর ১১
১৭৭১ শক, ২৭ ভাদ্র
জীবনচরিত চেম্বার্স বায়োগ্রাফি পুস্তকের অনুবাদ। গালিলিও, নিউটন, হর্শেল, ডুবাল, জোন্স প্রভৃতি কয়েকজন মহানুভব ব্যক্তির জীবনচরিত।
১৮৫১, এপ্রিল ৬
১৯০৭ সংবৎ, ২৫ চৈত্র
শিশুশিক্ষা, ৪র্থ ভাগ
(বোধাদয়)
নানা ইংরেজী পুস্তক হইতে সঙ্কলিত।
১৮৫১, নভেম্বর ১৬
১৯০৮ সংবৎ, ১ অগ্রহায়ণ
সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা
১৮০১, নভেম্বর ১৬
১৯০৮ সংবৎ, ১ অগ্রহায়ণ
ঋজুপাঠ, ১ম ভাগ পঞ্চতন্ত্রের কয়েকটি উপাখ্যান।
১৮৫২, মার্চ্চ ৪
১৯০৮ সংবৎ, ২২ ফাল্গুন
ঋজুপাঠ, ২য় ভাগ
১৮৫১, ডিসেম্বর ৩০
১৯০৮ সংবৎ, ১৬ পৌষ
ঋজুপাঠ, ৩য় ভাগ
১৮৫৩, মার্চ্চ ১০
১৯০৯ সংবৎ, ২৮ ফাল্গুন
সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব ১৮৫১, ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত, কলিকাতাস্থ বীটন সোসাইটি নামক সমাজে এই প্রস্তাব প্রথমে পঠিত হয়। অনেকের সবিশেষ অনুরোধে বিদ্যাসাগর মহাশয় দুই শত পুস্তক মুদ্রিত করিয়া বিতরণ করেন। সংবৎ ১৯১৩, ১৪ চৈত্র এই প্রস্তাব পুনর্মুদ্রিত হয়।
১৮৫৩ ব্যাকরণ কৌমুদী, ১ম ও ২য় ভাগ
১৮৫৪ ব্যাকরণ কৌমুদী, ৩য় ভাগ
১৮৫৪, ডিসেম্বর ৯
১৯১১ সংবৎ, ২৫ অগ্রহায়ণ
শকুন্তলা কালিদাস-রচিত ‘অভিজ্ঞানশকুন্তল’ নাটকের উপাখ্যান-ভাগ।
১৮৫৫, জানুয়ারি ২৮
১৯১১ সংবৎ ১৬ মাঘ
বিধবাবিবাহ, প্রথম পুস্তিকা বিধবা-বিবাহের সপক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ।
১৮৫৫, এপ্রিল ১৩
১৯১২ সংবৎ, ১ বৈশাখ
বর্ণপরিচয়, ১ম ভাগ
১৮৫৫, জুন ১৪
১৯১২ সংবৎ, ১ আষাঢ়
বর্ণপরিচয়, ২য় ভাগ
১৮৫৫, অক্টোবর ২০
১৯১২ সংবৎ, ৪ কার্ত্তিক
বিধবাবিবাহ দ্বিতীয় পুস্তক[৯] বিধবা-বিবাহ প্রস্তাবের প্রতিবাদকারীদের প্রতি উত্তর।
১৮৫৬ কথামালা Aesop’s Fables পুস্তকের অংশবিশেষের বঙ্গানুবাদ।
১৮৫৬, জুলাই ১৫
১৯১৩ সংবৎ, ১ শ্রাবণ
চরিতাবলী ডুবাল, রস্কো প্রভৃতি স্বনামধন্য লোকের জীবনচরিত।
১৮৫৯, জানুয়ারি ১৩
১৯১৫ সংবৎ, ১ মাঘ
পাঠমালা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশার্থি বিদার্থিগণের ব্যবহারার্থ জীবনচরিত, শকুন্তলা ও মহাভারতের অংশবিশেষ লইয়া এই পুস্তক সঙ্কলিত।
১৮৬০, জানুয়ারি ১৩
১৯১৬ সংবৎ, ১ মাঘ
মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ) উপরিচর রাজার উপাখ্যান অবধি মহাভারতের প্রকৃত আরম্ভ ধরিলে, তাহার পূর্ব্ববর্তী অধ্যয়গুলি উহার উপক্রণিকা-স্বরূপ। পুস্তকাকারে প্রচারিত করিবার পূর্ব্বে, মহাভারতের উপক্রমণিকাভাগের এই অনুবাদ ‘তত্ত্ববোধিনী। পত্রিকা’য় ক্রমশ প্রকাশিত হয়।
১৮৬১, এপ্রিল ১২
১৯১৮ সংবৎ, ১ বৈশাখ
সীতার বনবাস ইহার প্রথম দুই পরিচেছদ ভবভূতিরচিত ‘উত্তরচরিত’ নাটকের প্রথম অঙ্ক হইতে গৃহীত। অবশিষ্ট পরিচ্ছেদগুলি রামায়ণের উত্তরকাণ্ড অবলম্বনে সঙ্কলিত।
১৮৬২, ফেব্রুয়ারি ১
১৯১৮ সংবৎ, ২০ মাঘ
ব্যাকরণ কৌমুদী, ৪র্থ ভাগ
১৮৬৩, নভেম্বর ১৬
১৯২০ সংবৎ, ১অগ্রহায়ণ
আখ্যানমঞ্জরী, ১ম ভাগ[১০] কতকগুলি ইংরেজী পুস্তক অবলম্বনে আখ্যানগুলি রচিত।
১৮৬৪, এপ্রিল ১২
১৮৭৬ শক, ১ বৈশাখ
প্রভাবতী সম্ভাষণ বিদ্যাসাগরের পরম প্রিয়পাত্র রাজ-কৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়ের শিশুকন্যা প্রভাবতীর মুত্যুতে এই পুস্তিকা রচিত। ১২১৯ সালের বৈশাখ মাসের ‘সাহিত্যে’ ইহা প্রথম প্রকাশিত হয়।
১৮৬৮ ফেব্রুয়ারি ১২
১৯২৪ সংবৎ, ১ফাল্গুন
আখ্যানমঞ্জরী, ২য় ভাগ
১৮৬৮ আখ্যানমঞ্জরী, ৩য় ভাগ
১৮৬৯ রামের রাজ্যাভিষেক ইহার মাত্র ছয় ফর্ম্মা মুদ্রিত হইয়াছিল।
১৮৬৯, অক্টোবর ১
১৯২৬ সংবৎ, ৩০ আশ্বিন
ভ্রান্তিবিলাস শেক্সপীয়ারের Comedy of Errors-এর উপাখ্যান-ভাগ।
১৮৭১, জুলাই ১৬
১৯২৮ সংবৎ, শ্রাবণ
বহুবিবাহ, ১ম পুস্তক বহুবিবাহ-প্রথার বিরুদ্ধে শাস্ত্রীয় প্রমাণ।
১৮৭২, মার্চ্চ
১৯২৯ সংবৎ, ১ চৈত্র
বহুবিবাহ, ২য় পুস্তক[১১] বহুবিবাহ সমর্থনকারীদের মতখণ্ডন।
১৮৭৩
১৭৯৫ শক
বামনাখ্যানম্ মধুসূদন তর্কপঞ্চানন ১১৭টি সংস্কৃত শ্লোক সুচনা করেন। কিন্তু ‘ভাষারচনায় তাদৃশ অভ্যাস’ না থাকায় ‘শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নিকট প্রার্থনা করাতে, তিনি শ্লোকগুলি বাঙ্গালা ভাষায় অনুবাদিত ও ব্যায়স্বীকার-পুর্ব্বক পুস্তকখানি মুদ্রিত করিয়া দেন।
১৮৮৫
১২৯২ সাল, ১অগ্রহায়ণ
সংস্কৃত-রচনা বাল্যকালের কতকগুলি সংস্কৃত-রচনা।
১৮৮৮, এপ্রিল ১২
১২৯৫ সাল, ১ বৈশাখ
নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ তাঁহার শ্বশুর মদনমোহন তর্কালঙ্কারের রচিত শিশুশিক্ষা, ১ম—৩য় ভাগের অধিকার লইয়া বিদ্যাসাগর-চরিত্রে কলঙ্কারোপ করেন। সেই কলঙ্ক অপনোদনের জন্য বিদ্যাসাগর এই ক্ষুদ্র পুস্তকখানি প্রকাশ করিয়াছিলেন।
১৮৯০, মে ১৪
১২৯৭ সাল, ১ জ্যৈষ্ঠ
শ্লোকমঞ্জরী কতকগুলি উদ্ভট শ্লোক-সংগ্রহ।
১৮৯১, সেপ্টেম্বর ২৫
১৯৪৮ সংবৎ, ৯ আশ্বিন
বিদ্যাসাগর-চরিত (স্বরচিত) এই আত্মজীবনীতে বিদ্যাসাগয় কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করিবার পূর্ব্ববর্তী ঘটনাগুলি বিবৃত করিয়াছেন। তাঁহার মৃত্যুর পর পুত্র নারায়ণচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ইহা প্রকাশিত করেন।
১৮৯২, এপ্রিল ২৬
১২৯৯ সাল, ১৫ বৈশাখ
ভুগোলখগোলবর্ণনম্ ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দে, জন্ মিয়র নামে পশ্চিম অঞ্চলের এক সিবিলিয়ানের প্রস্তাবে বিদ্যাসাগর পুরাণ সূর্য্যসিদ্ধান্ত ও ইউরোপীয় মতের অনুযায়ী ভূগোল ও খগোল বিষয়ে ১০০ শ্লোক রচনা করিয়া একশত টাকা পুরস্কার পাইয়াছিলেন। শ্লোকগুলি বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় পুস্তকাকারে মুদ্রিত হইতেছিল। তাঁহার মৃত্যুর পর ইহা প্রকাশিত হয়। ইহাতে এখন ৪০৮টি শ্লোক দেখা যায়।
বাল্মীকির রামায়ণ টীকাটিপ্পনী সমেত।

 ১৮৫১, জুলাই ১৬ (১৯০৮ সংবৎ, ১ শ্রাবণ) তারিখে প্রকাশিত রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীতিবোধ’ পুস্তকের অনেকাংশ বিদ্যাসাগরের রচিত। তিনিই প্রথমে এই পুস্তক লিখিতে সুরু করেন; অবকাশ-অভাবে শেষে রাজকৃষ্ণবাবুকেই পুস্তকখানি সম্পূর্ণ করিবার ভার দেন। পুত্রগণের প্রতি ব্যবহার, পরিবারের প্রতি ব্যবহার, পরিশ্রম, স্বচিন্তা ও স্বাবলম্বন, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, বিনয়,—এই কয়টি প্রস্তাব তাঁহারই রচিত।

 ‘শব্দ-সংগ্রহ’—বিদ্যাসাগর মহাশয় জীবদ্দশায় বহু খাঁটি বাংলা শব্দ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর এই শব্দ-সংগ্রহ ১৩০৮ সনের সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকায় (২য় সংখা, পৃ, ৭৪-১৩০) প্রকাশিত হয়।

 বিদ্যাসাগর অনেকগুলি সংস্কৃত গ্রন্থের বিশুদ্ধ সংস্করণ প্রকাশ করেন:—

১৮৪৮ সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ
১৮৫৩ কিরাতার্জ্জুনীয়
১৮৫৩ রঘুবংশ ... মল্লীনাথের টীকা সমেত
১৮৫৭ শিশুপাল-বধ
১৮৬১ কুমারসম্ভব ... মল্লীনাথের টীকা সমেত
১৮৬৯
১২৯৫ সংবৎ, ৩০ চৈত্র
মেঘদূত ... মল্লীনাথের টীকা সমেত
১৮৭০, আগষ্ট ২২
১৯২৭ সংবৎ ৭ ভাদ্র
উত্তরচরিত
১৮৭১, জুন ১৪
১৯২৮ সংবৎ, ১ আষাঢ়
অভিজ্ঞানশকুন্তলম
১৮৮২, নভেম্বর ১৬
১৯৩৯ সংবৎ, ১ অগ্রহায়ণ
হর্ষচরিত
কাদম্বরী

 বিদ্যাসাগর কৃষ্ণনগর রাজবাটীর ‘মূলপুস্তক’ দেখিয়া ভারতচন্দ্র রায়ের এই কয়খানি গ্রন্থের পরিশোধিত সংস্করণ প্রকাশ করেন:—

১৮৪৭
১৭৬৯ শক
অন্নদামঙ্গল ১ম খণ্ড
১৮৪৭
১৭৬৯ শক
অন্নদামঙ্গল [মানসিংহ] ২য় খণ্ড
... বিদ্যাসুন্দর—দ্বিতীয় মুদ্রণের তারিখ ১৭৭৫ শক (১৮৫৩)

 ইহা ছাড়া বিদ্যাসাগর এই তিনখানি সঙ্কলন-গ্রন্থও মুক্তিত করিয়াছিলেন:—

Selections from the Writings of Goldsmith
Selections from English Literature
Poetical Selections

  1. ১৮৪৮-৪৯ সালে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত প্রেস স্থাপন করিয়াছিলেন; সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারীও চালাইতে থাকেন। সংস্কৃত প্রেস হইতে মুদ্রিত সকল পুস্তক বিক্রয়ের জন্য ডিপজিটারীতে মজুত থাকিত। ব্যবসায়টি দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত হইয়াছিল এবং বহু বৎসর ধরিয়া ইহা হইতে রীতিমত লাভ হইত।
  2. “বাঙ্গালা সাহিত্যে ৺প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান”—বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (প্যারীচাঁদ মিত্রের গ্রন্থাবলী, ১২৯৯)
  3. “বিদ্যাসাগর চরিত”-সাধনা, ভাদ্র, ১৩০২, পৃ. ৩০৩-০৫।
  4. সাহিত্য, ৩য় বর্ষ, বৈশাখ, ১২৯৯।
  5. Journal of the Royal Asiatic Society, 1865, p. 15.
  6. যাঁহারা বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের বিস্তৃত বিবরণ জানিতে ইচ্ছুক তাঁহাদিগকে এই পুস্তকখানি পাঠ করিতে অসুবোধ করি —"A collection containing the Proceedings which led to the passing of Act xv. of 1856." Compiled by Narayan Keshav Vaidya (Bombay, 1885). বইখানি আমি প্রথমে ব্রাহ্মসমাজ লাইব্রেরীতে দেখি। সুবলচন্দ্র মিত্রের পুস্তকেও বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের বিবরণ আছে।
  7. বৃটিশ মিউজিয়মের বাংলা পুস্তকের তালিকায় এই তারিখ দেওয়া আছে।
  8. রামগতি ন্যায়রত্নের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস, ১ম ভাগ’ বিদ্যাসাগর কর্ত্তৃক পরিবর্দ্ধিত হইয়া প্রকাশিত হইয়াছিল।
  9. ১৮৫৬ সালে বিদ্যাসাগর তাঁহার ‘বিধবাবিবাহ’ পুস্তক দুইখানির ইংরেজী অনুবাদ Marriage of Hindu Widows নামে প্রকাশ করেন। ১৮৬৫, জানুয়ারি মাসে ইহা বিষ্ণু পরশুরাম শাস্ত্রী কর্ত্তৃক মারাঠীতেও অনূদিত হয়।
  10. চারি বৎসর পরে (১৯২৪ সংবৎ, ১ ফাল্গুন) আখ্যানমঞ্জরী প্রথম ভাগের মাত্র ছয়টি আখ্যান লইয়া এবং সরল ভাষায় সঙ্কলিত কতকগুলি নূতন আখ্যা দিয়া, ‘আখ্যানমঞ্জরী, প্রথম ভাগ’ প্রচারিত হয়। প্রথম ভাগের পরিত্যক্ত বাকী আখ্যানগুলির সহিত সাতটি নূতন আখ্যান যোগ করিয়া নামকরণ করা হয়—‘আখ্যানমঞ্জরী, দ্বিতীয় ভাগ।’
  11. বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ-সংক্রান্ত পুস্তকখানি ইংরেজীতে অনুবাদ করিয়াছিলেন। কিন্তু পুস্তকাকারে দেখিয়া যাইতে পারেন নাই; তাঁহার জীবদ্দশায় অল্প অংশই ছাপা হইয়াছিল।