বিদ্যাসাগর/অবতরণিকা

উইকিসংকলন থেকে

বিদ্যাসাগর

অবতরণিকা।

 দ্বিতীয় দাতা- কর্ণ এবং দয়ার সাগর অনাথ-বান্ধব বঙ্গের “বিদ্যাসাগর", ১৮৯১ খৃঃ অব্দে ২৯শে জুলাই বা ১২৯৮ সালে ১৩ই শ্রাবণ, মঙ্গলবার রাত্রি ২টা ১৮ মিনিটে ইহলোক ত্যাগ করিয়াছেন।

 বলা বাহুল্য,—“বিদ্যাসাগর’ বলিলে, ঈশ্বরচন্দ্র বিস্তাসাগরকেই বুঝায়। সেই বিশ্ব-বিশ্রুত “বিদ্যাসাগর” ত্রিংশৎ বৎসর হইল, অমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। এ কর্ম্মক্ষেত্রে সেই কর্ম্ম-শূর আপন কর্ম্ম সাধন.করিয়া, অপেক্ষাকৃত অল্পতর ভাগ্যহীন ব্যক্তিবর্গকে কর্ম্মের শিক্ষা-দীক্ষা দিয়া, স্বস্থানে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছেন। জীবমাত্রের এই অবস্থা সেই আদ্যা শক্তি মূলা প্রকৃতির এই ব্যবস্থা। অবোধ মায়াময় জীব আমরা, মায়া-মুগ্ধ হইয়া, এ সব তত্ত্ব বুঝিয়াও, বুঝিতে পারি না। এ অনিত্য সংসারে কেবল বিয়োগবিলাপে অধীর হইয়া পড়ি। তাই বিদ্যাসাগরের স্মৃতিতে এখনও বিয়োগ-ঝড়বানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠে। যে যায়, সে ত আর আসে না। যায়, কিন্তু স্মৃতি যে জাগে! স্মৃতি ত নয়, সে যে জালাময়ী জাল। সে জ্বালা জুড়াইব কিসে?  যাহার করুণীয় শত শত নিরন্ন নিরাশ্রম, অন্নাশ্রয় পাইত; যাঁহার আশ্রয়ে থাকিয়া, অগণিত অনাথ আতুর দীন হীন দুঃস্থ দরিদ্র অসহায় আত্মীয়-নির্ব্বিশেষে প্রতিপালিত হইত; যাঁহার অপার দয়া-দাক্ষিণ্যে কপর্দকহীন অধমণ, উত্তমর্ণের নিদারুণ নিপীড়ন হইতে রক্ষা পাইত; যাঁহার সহৃদয়তাগুণে মল-মূত্রপুরিত পরিত্যক্ত রুগ্ন পথিক, গৃহে আনীত হইয়া যথাযোগ্য ঔষধ-পথ্য পাইত; যাঁহার জলন্ত জীবন্ত দৃষ্টান্তে অতিবড় কু-পুত্রও অতুল মাতৃভক্তি শিক্ষা পাইত; যাঁহার অসাধারণ অব্যবসায়, অদম্য উদ্যম-উৎসাহ, অকুষ্ঠিত নির্ভীকতা, অলৌকিক শ্রমাকুষ্ঠিতা, অসীম কর্তব্য-পরায়ণতা, অমানুষিক সরলতা দেখিয়া বিদেশী প্রবাসী লোকেও সবিস্ময়ে সহস্ৰ বার মস্তক অবনত করিত, সেই ক্ষণজন্ম ভাগ্যবান পুরুষ লোকান্তরিত! বল দেখি, তাঁহার স্থতি পাসরি কিসে?

 এখনও চারি দিকে কত কাঙালের পর্ণ-কুটীরে পূর্ণ হাহাকার! এখনও কত অনাথাশ্রমে আকুল প্রাণের মর্ম্মভেদী গভীর চীৎকার! সে সব কথা ভাবিলে চক্ষু ফাটিয়া রক্ত বাহির হয়! সেই করুণপ্রতিম অনুপম করুণাময়ের কথা স্মরণ হইলে হৃদয়ের শোক-সাগর উথলিয়া উঠে।

 বিদ্যা-বুদ্ধিতে “বিদ্যাসাগর” অপেক্ষা বড় অনেক থাকিতে পারেন; কিন্তু দয়া-দক্ষিণ্যে তাঁহা অপেক্ষা বড় অতি অল্প লোক দেখিতে পাই। এমন নিরন্নের অন্নদাতা, ভয়ার্তের ভয়ত্রাতা, বিপক্ষের উদ্ধারকর্তা এবং দীন-হীনের দয়াল পালক পিতা, এ কলিযুগে, এ সংসারে বড় বিরল। তিনি যে দয়ার অপূর্ব্ব অবতার! তিনি যে মুক্তিমতী দয়ার পূর্ণ পুরুষকার। হৃদয়-রলে-“বিদ্যাসাগর” বঙ্গের বিরাট পুরুষ।

 এক জন বড় লোক হইলে, সমগ্র দেশ বা জাতি বড় বলিয়া সম্মানিত হয়। মার্কিণ গ্রন্থকার দার্শনিক এমারসন বড় লোকদের কথায় বলিয়াছেন,—

“The race goes with us on their credit.”

  কলুষময় কলিকালে, দানে পুর্ণ “সারিকতা” সুদুর্লভ; বিদ্যাসাগরের দানে কিন্তু সাত্ত্বিকতার পূর্ণ বিকাশ। তাঁহার “বিধবা-বিবাহ” প্রচলন-প্রক্রিয়া সম্বন্ধে হিন্দু-সাধারণে একমত হইতে পারে নাই সত্য, কিন্তু তাঁহার দয়া-প্রণোদিত দানের সাত্ত্বিকতা কেহ অস্বীকার করিতে পারিবেন না। দানে বিদ্যাসাগর শাস্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করিয়াছেন। শাস্ত্রে আছে,—

“দাতব্যমিতি যদ্দানং দীয়তেছনুপকারিণে।
দেশে কালে চ পাত্রে তদানং সাত্ত্বিকং স্মৃতম্।”

— গীতা ১৭।২০।

 দান করিতে হইবে, ইহা মনে করিয়া দেশ কাল পত্র বিবেচনায়, “অপকারীকেও যে দান করা যায, তাহাকে সাত্ত্বিক দান কহে।”

 এরূপ সাত্ত্বিকভাবাপন্ন দানের পরিচয় বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্তে পুনঃ পুনঃ পাইবেন। বিদ্যাসাগর দান করিতেন, জানিতেন কেবল দাতা ও গ্রহীতা। দানের পৌরুষ-প্রকাশে তাঁহার প্রবৃত্তি ছিল না। তিনি দান করিতেন, নামের জন্য নহে। দরিদ্রের সেবা এবং রুগ্নের শুশ্রুষা কেবলমাত্র তাহার অকাম-কল্পিত, নিত্য ক্রিয়া ছিল। দেনার দায়ে ঋণী জেলে যাইতে যাইতে পথে বিদ্যাসাগবকে দেখিয়া, বাষ্পাকুললোচনে 'কাতরভাবে তাহার পানে একবাব তাকাইলে, চক্ষের জলে তাঁহার বুক ভাসিয়া যাইত। কপর্দক হস্তে না থাকিলেও, তদণ্ডে তিনি ঋণ করিয়া ঋণীর ঋণ পরিশোধ করিতেন।

 এরূপ দান অবশ্য সংসারের পক্ষে সকল সময় সর্ব্বথা অনু, করণীয় ও প্রবর্ত্তনীয় নয। ইহাতে অনেক সময় বিপদগ্রস্ত হইতে হয়। বিলাতী কবি গোল্ডস্মিথ কতকটা এইরূপ দানশীলতার মধ্যে মধ্যে বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অবগু কখন সেরূপ হইতে হয় নাই। হইলেও ইহা যে স্বাভাবিকী সহৃদয়তার পরিচায়ক, তাঙ্গতে সন্দেহ কি?

 প্রাসাদ-বিহারী কোটিপতি হইতে “কন্মটাড়ে"র পর্ণকুটির বাসী অশিক্ষিত দীন হীন সাওতাল পর্য্যন্ত জানিত,—“বিদ্যাসাগক দয়ার অবতার।” এই জন্য তিনি হিন্দু, ৰৌদ্ধ, খৃষ্টান, মুসলমান, শিখ, পারসিক, সর্ব্ব দেশের সর্ব্ব জাতির সমান বরণীয় এবং মাননীয়। তাঁহার বিধবা-বিবাহ-প্রচলনের কার্য্যাষ্ঠান সম্বন্ধে যাঁঁহার বিরুদ্ধ বাণী ছিলেন, তাহারাও ঐ কার্য অতিমাত্র দয়া প্রবক্তার ফল বুঝিতে পারিয়া তাহার প্রতি ভক্তিহীন হন “নাই। সে দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর কোথায়। সে দানীর সর্বজনসমাদৃত বিদ্যাসাগর কোথায়!

 যখন শোকের দারুণ শক্তিশেল বুকের উপব, যখন যাতনব অগ্নিস্তুপ মর্ম্মের ভিতর, তখন “জন্মভূমি” পত্রিকায় এ অধম লেখকের উপর বিদ্যাসাগরের জীবনী লিথিবীর ভাব পড়িযাছিল। মনে করিাছিলাম, জালা জুড়াইলে, সম্পূর্ণ উপকরণ সংগ্রহ করিয়া, জীবনী লিপিতে প্রবৃত্ত হইল। জ্বালা জুড়াইল না; পাঠকগণ কিন্তু,অধীর;কাজেই জীবনীর অসম্পূর্ণ উপকরণ লইয়া “জন্মভূমি”তে জীবনী লিখিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। যে কারণে জন্মভূমিতে জীবনী লিখিতে বাধ্য হইয়াছিলাম, সেই কারণে জীবনী পুস্তকাকারে প্রকাশ করি।

 পুস্তকের উপকরণ সম্পূর্ণ না হউক, অপেক্ষাকৃত অনেক বেশী। সে বিরাট পুরুষের জীবনীর সম্পূর্ণ উপকরণ সংগ্রহ একরূপ সাধ্যাতীত। তবে ইহাতে যথাজ্ঞাতব্য বিষয়ের অভাব যাহাতে না হয়, তাহার জন্য সাধ্যানুসারে প্রয়াস পাইয়াছি।

 জীবনী, লেখা হইয়াছে বটে; কিন্তু একেবারে নির্দোষ হইবার সম্ভাবনা কম। কাহারও জীবনী লিখিতে হইলে, গুণাধিক্যের সঙ্গে দোষেরও সম্যক্র সমালোচনায় সমদৰ্শিতার সম্মান সংরক্ষিত হয়। মৃত ব্যক্তির গুণ ভালবাসার জিনিষ; দোষ নিন্দার্হ। কবি সাদে বলিয়াছেন,—

“Their virtues love, their faults condemn.”

 বিদ্যাসাগর মহাশয় বহুগুণান্বিত হইলেও কেহ কেহ তাহার কোনও কোনও কার্য্যে দোষারোপ করিতেন এবং অনেকেরই বিশ্বাস যে, দোষ তাহার ভ্রান্তবিশ্বাস-মূলক। কিন্তু তাহা সত্য হইলেও বহুগুণের সমাবেশে তাহার গুণের গরিমাই উজ্জ্বল হইয়া উঠে। যাহাই হউক এ সময়ে দোষের সম্যক সমালোচনা করা নানা কারণে অমুচিত। ডাক্তার জনসন বলিয়াছেন যে, “যাহার জীবনী লিখিতে হয়, কেবল তাঁহার চরিত্রের উজ্জ্বল ভাগই সমালোচনা করা উচিত নহে; তাহা হইলে তাঁহার অনুকরণ অসম্ভব হইয়া উঠে।” তাহারও কিন্তু সে সাহসে কুলায় নাই। তাঁহার সময়ে যে সব কবি ছিলেন, তাঁহাদের অনেকের অনেক কথা বলিতে তিনি কুণ্ঠিত হইয়াছিলেন। তাঁহার কথা এই ছিল,—

 “Walking ashes under which the fire was not extinguished.”

“অনলাভ্যন্তর ভষ্মস্তূপে বিচরণ করিতেছি।”

 সকল দোষত্রুটির সমালোচনা করা অসম্ভব হইলেও, আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোন কোন কার্য্যের জনমত কিরূপ ছিল, তাহা প্রকাশ করিতে সাহসী হইয়াছি। যাহার অনুকরণে সম্প্রদায়বিশেষের মহতী ক্ষতি হইয়াছে বলিয়া অনেকে দৃঢ় মত পোষণ করেন, তাহা প্রদর্শন না করিলে প্রত্যবায়ভাগী হইতে ইহবে। গুণরাশির সমালোচনা ত অবশ্য কর্ত্তব্য; যেহেতু তাহা একান্ত অণুকরণীয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় দরিদ্র ব্রাহ্মণের সন্তান হইয়াও, কি গুণে সম্রাট-মুকুট-লাঞ্ছন কীর্ত্তির অপুর্ব্ব জ্যোতিমন শিরস্ত্রাণ মস্তকে ধারণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহা বর্তমান কালে অনেকে অবগত নহেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনী সমালোচনায় তাহা উদঘাটিত হইবে, সেই হেতু এ জীবনী বোধ হয় বর্তমান ও ভবিষ্যৎ লোকসমূহের কথঞ্চিৎ উপকারক ও উপাদেয় হইতে পারিবে।

 যে গুণসংঘাত জন্য লোকের জীবনী লেখা আবশ্যক হয়, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সে গুণ অনেক ছিল। যে গুণ থাকিলে, মানুষ মানুষকে ভালবাসিতে চাহে এবং যে গুণ থাকিলে, মানুষ বাহ্য জগৎ ভুলিয়া, সেই গুণবানের সম্পূর্ণ সত্তায় হৃদয় পূর্ণ করিয়া ফেলে, সে গুণ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনেক ছিল। যিনি এক উদ্ভাবনায় চিন্তরাজ্যের সহজ পথ উন্মুক্ত করিয়া দেন, তাঁহার জীবনী লেখা আবশ্যক হয়। পাঠক! বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উদ্ভাবনাশক্তির পরিচয়, পাইবেন। যিনি প্রতিভাবলে প্রকৃতির উচ্চ স্তরে দণ্ডায়মান হইয়া ইঙ্গিতে উন্নতির সহস্র পথের যে কোন পথ দেখাইয়া থাকেন, আর নিম্ন স্তরের লোকসমূহ তাঁহাকে ধরিবার জন্য স্তর বাহিয়া উঠিতে চেষ্টা করে, তাঁহার জীবনীর প্রয়োজন আছে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনীপীঠে এ কথার সার্থকতা সম্যকরূপে প্রতিপন্ন হইবে। প্রকৃত প্রতিভায় “চৌম্বক” আকর্ষণের অসীম শক্তি। মানুষ যেখানে যত দূরেই থাকুক, আকর্ষণ এড়াইবার যো নাই। যেখানে এরূপ একটি “চুম্বক” থাকিবে, সেইখানে কোটি জীব আকৃষ্ট হইবে।

 প্রতিভা স্বর্গের দেবতা। প্রতিভা পূজক সর্ব্বস্ব দিয়া প্রতিভার পূজা করিয়া থাকেন। চিন্তাশীল এমারসন বলিয়াছেন,—“তুমি বল,—ইংরাজ কাজের লোক —জর্ম্মাণ সহৃদয় অতিথি-সেবক;— ভালেনসিয়ার জলবায়ু অতি মনোরম—সক্রোমেণ্টে পাহাড়ে প্রচুর সোণা পাওয়া যায়; কথা ঠিক বটে; কিন্তু আমি-এ সব সুখশালী, ধনী এবং অতিথি সেবক লোকদিগকে দেখিতে বা নির্ম্মল জলবায়ুর সেবন করিতে অথবা বহুব্যয়ে স্বর্ণ সংগ্রহ করিতে চাহি না। তবে প্রকৃত জ্ঞানশালী ও শক্তিমান ব্যক্তিবর্গের আবাসভূমি দেখাইয্যা দিতে পারে, এমন যদি কোন চুম্বক-প্রস্তর প্রাপ্ত হই, তাহা হইলে সর্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়া তাহা ক্রয় করি এবং অদ্যই পথে বাহির হইয়া পড়ি।”

 প্রকৃত শক্তিশালী এবং গৌরবান্বিত প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি সর্ব্বত্রই পূজনীয়। তাঁহারা মানুষের আদর্শ। তাঁহারা প্রকৃতির সূক্ষ্ম শক্তির পরিচায়ক। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তাঁহাদের শক্তি বিসর্পিত। তাঁহাদের সহবাসে মানুষ সন্তুষ্ট ও শক্তিসম্পন্ন হয়। ভাবে বা কার্যে মানুষ তাহদের সঙ্গে থাকিতে চাহে। আমাদের সন্তানসন্ততি বা নগর গ্রামের নামকরণ, তাঁহাদের নামে হইয়া থাকে। ভাষায় তাঁহাদের নামের ভূরি ভূরি প্রয়োগ পাইবে। তাঁহাদেব প্রতিকৃতি বা গ্রন্থাদিরূপ কার্য্যাবলী আমাদের ঘরে ঘরে দেখিবে। আমাদের নৈতিক কার্যে তাঁহাদের প্রত্যেক কার্য স্মৃতিপথে জাগিয়া উঠে। তাঁহাদিগের অন্বেষণ যুবার স্বপ্ন এবং বর্ষিয়ানের জাগরণ কার্য্য। যতদূরে থাকি না, তাহাদিগের কার্য্যকলাপ এবং সম্ভবপর হইলে, তাহাদিগকে দেখিবার জন্য মন স্বতঃই বাকুল হইয় উঠে।

 এইরূপ প্রতিভাশালী ব্যক্তির জীবনী প্রয়োজনীয়। এই জন্য এমারসন বলিয়াছেন,—

 “The genius of humanity is the real subject whose biography is written in our annals."

 প্রতিভা মানবের প্রকৃত পদার্থ। প্রতিভাশালীর জীবন ইতিহাসে লিখিত হইয়া থাকে।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনে এমন প্রতিভার বহু পরিচয় পাইবেন। এক একট প্রতিভাশালী ব্যক্তি যেমন এক একটা বিভাগ অধিকার করিয়া থাকেন, তেমনই বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রকৃতির এক বিশাল বিভাগ লইয়া ব্যাপৃত ছিলেন। মনোবৃত্তির উচ্চ ক্রিয়ানিবন্ধন প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন ব্যক্তি ধ্যানমাত্রে কল্পনায় অন্য সাধারণের অলক্ষ্যে প্রকৃতির সূক্ষ্ম তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করিয়া লন। এই জন্য প্লেটো, সেক্সপিয়র, সুইনবর্ণ, গেটে প্রভৃতির এত প্রতিষ্ঠা।

 মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের কার্য্যফল অব্যর্থ। জ্ঞান ও ভাবের শক্তি চিরন্তন ধ্রুব সুখদায়িনী। এ শক্তির তেজ পরীক্ষা করিতে হইলে শক্তিশালী পুরুষের জীবনী পড়িতে হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বহু কার্যে এ শক্তির প্রমাণ আছে। বিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা স্যার ওয়ালটর র‍্যালের সম্বন্ধে ইংলণ্ডেশ্বরী এলিজাবেথের সচিব লর্ড সিসিল বালে বলিয়ছিলেন,—

 “I know he can toil terribly.”

 ওয়ালটর ভয়ানক পরিশ্রম করিতে পারেন। এ কথা শুনিলে যেন বৈদ্যুতিক প্রভাবে সর্ব্বাঙ্গ আলোড়িত হইয় উঠে। পাঠক! বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনী পাঠ করিলে বুঝিতে পরিবেন, বার্লের এই কথা বিদ্যাসাগর মহাশয়ে খাটে কি না। হামডেন সম্বন্ধে বিখ্যাত বিলাতী ইতিহাস-লেখক ক্লারেনডন বলিয়াছেন,—

 “Who was of an industry and vigilance not to be tired out or wearied by the most laborious; and of parts not to be imposed on by the most subtle and sharp, and of a personal courage equal to his best parts.”

 হামডেন্‌ অকাতরে পরিশ্রম করিতেন; তাঁহার সংপ্রবুদ্ধা তীক্ষুদর্শিতা বিলক্ষণ ছিল। তিনি অতি পরিশ্রমে কাতর ও ক্লান্ত হইতেন না। চতুর তীক্ষবুদ্ধি লোক যাহাকে বিচলিত করিতে পারিতেন না। তাঁহার বুদ্ধিমত্তা ও উদ্যমশীলতা, শারীরিক সাহস ও মানসিক বল সমান ছিল।

 ইংলণ্ডের প্রথম চারঈলসের ভক্ত অনুচর ফকল্যাণ্ড সম্বন্ধেও ক্লারেনডন বলিয়াছেন, —

 “Who was so severe an adorer of truth, that he can as easily have given himself leave to steal, as to dissemblę“

 ফকল্যাণ্ড এমন সুদৃঢ় সত্যপরায়ণ ছিলেন যে, চুরি করা তাহার পক্ষে যেমন অসম্ভব, আত্মগোপন করাও তদ্রূপ অসম্ভব।

 চীন দার্শনিক লু সম্বন্ধে চীন দার্শনিক মেনসয়াস বলিয়া ছিলেন,—

 “লুর ব্যবহারের কথা শুনিলে অতি নির্ব্বোধেরও বোধের সঞ্চার হয় এবং অস্থিরচিত্তেরও একাগ্রতা উপস্থিত হয়।”

 বিদ্যাসাগর-জীবনে একাধারে এই হামডেন, ফকল্যাণ্ড এবং লুর চরিত্র সমাবেশিত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনী হইতে এই সকলের শিক্ষা হয়। ইহা জীবনীর নৈতিক সার। এই জন্যই কালাইল বলিয়াছেন,—

 “Not only in the common speech of men, but in all art too-which is or should be concentrated and conserved essence of what men speak and show —Biography is almost the one thing needful.”

 কেবল যে মানুষের সাধারণ কথাবার্ত্তার জন্য জীবনী আবশ্যক হয়, তহা নহে; মানুষ যাহা কথায় বলে এবং কার্য্যে দেখায়, সেই সকল বিষয়ের সার অংশটুকুর জন্য ন্জীবনী অত্যন্ত আবশ্যক।

 এই জন্য বিদ্যাসাগরের জীবনী প্রয়োজনীয়। আধুনিক জীবনী-লিখন-প্রথা বিদেশীয় অনুকরণ। বিদেশীয় শক্তিশালী বড়লোকমাত্র, বিদ্যাসাগরের প্রতিপাত্র ছিলেন; অতএব বিদেশীয় শক্তিশালী ব্যক্তিদিগের সহিত তাঁহার তুলনা অযৌক্তিক নহে। কোন না কোন বিদেশীয় শক্তিসম্পন্ন, ব্যক্তির কোন না কোন গুণ তাঁহাতে পরিলক্ষিত হইত।

 “বিদ্যাসাগর চরিত” নামে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্বরচিত অসম্পূর্ণ জীবনী তদীয় পুত্র শ্রীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়। কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করিবার পূর্ববর্ত্তী ঘটনাগুলি লইয়া ইহা রচিত। নারায়ণ বাবু লিখিয়াছেন,–“যদি তাঁহার ছাত্রজীবনের ইতিহাস নিজে লিখিয়া যাইতে পারিতেন, তাহা হইলেও তাহার জীবন-চরিত সম্পূর্ণ করা সহজ হইত।” নিজের জীবনী নিজে লিখিলে জীবনবিবরণ যে সম্পূর্ণ হয়, তাহাতে আর সন্দেহ কি? এতদ্ব্যতীত জীবনীর বিষয়ীভূত ব্যক্তির ভাষা, মনোবৃত্তি, ধর্ম্মপ্রবৃত্তি, রীতি, নীতিপ্রভৃতির অনেক আভাস পাইবার সুবিধা ও সুযোগ হয়। জনসনের জীবনী লিখিতে বসিয়া জীবনীলেখক বসওয়েল বলিয়াছেন,—

 “Had Dr. Johnson written his own life in conformity with the opinion which he has given, that every man's life may be best written by himself; had he employed in the preservation of his own history, that clearness of narration and elegance of language in which he has embalmed so many eminent persons, the world would probably have had the most perfect example of biography that was ever exhibited.”

ডাক্তার জনসন বলিতেন,—“নিজের জীবন-বৃত্তাস্তু,মানুষ নিজে উত্তম লিখিতে পারেন।” তিনি যে বিশদ বর্ণনায় এবং সুন্দর রচনায়, বহু সংখ্যক, কীর্ত্তিকুশল ব্যক্তির বিষয় লিপিবদ্ধ করিয়। তাঁহাদিগকে সঞ্জীবিত করিয়াছেন, তাহাতে তিনি যদি স্বয়ং নিজের ইতিহাস লিখিতেন, তাহা হইলে জগৎ তাহার নিকটে সর্ব্বব্যবসম্পন্ন জীবনীর উত্তম দৃষ্টান্ত লাভ করিতে পারিত।

 কথাটা ঠিক বটে; কিন্তু আত্মকথার স্বক্ষ সমালোচনা হওয়া দুষ্কর। সে ভার বাহিরের লোককে লইতে হয়। আত্মদোষের উদঘাটনে সাহস কয় জনের হইয়া থাকে? রুসোর “কনফেশন্‌” অর্থাৎ ক্রটী-স্বীকার, দুরন্ত দুঃসাহসিকতার কাজ ভলটয়ার ঠিকই বলিয়াছেন,—

 “There is no man, who has not something hateful in him—no man who has not some of the wild beast in him. But there are few who will honestly tell” us how they manage their wild beast.”

 জগতে এমন কোন মানুষ নাই, যাহাব কিছু দোষ নাই, এমন মানুষ নাই, যাঁহাতে ঘৃণার্হ কিছুই একেবারেই নাই বা যাঁহার পাশবসবৃত্তি নাই; কিন্তু সেই প্রবল পাশববৃত্তি জীবনে কেমন করিয়া আয়ত্ত করিয়া রাখিয়াছে, কয়জন লোকে তাহা অকপটে বলিতে পারে?

 মানুষের এমন দোষ ও ত্রুটী থাকিতে পারে যে, তাহা বন্ধুর নিকট প্রকাশ করিতে দ্বিধা হয়। বিখ্যাত ফরাসী গ্রন্থকার শ্যামফোঁ বলিয়াছেন, —

 “It seems to me impossible. in the actual state of society, for any man to exhibit his secret heart, the details of his character as known to himself, and above all, his weaknesses and his vices, to even his best friend.”

 ইহার ভাব এই—

 সমাজের যে অবস্থা, তাহাতে আমার মনে হয়, মানুষ নিজের হৃদয়ের গূঢ় কথা, অথবা যাহা কেবল অন্তরাত্মাই জানেন, আপনার সেই প্রকৃত চরিত্রের গুপ্ত কথা, আপনার মানসিক দুর্ব্বলতা এবং পাপের কথা তাহার অন্তরঙ্গ অভিন্নহৃদয় বন্ধুর নিকটে ও বলিতে পারে না।

  জন্ম ষ্টুয়াট মিলের আত্মজীবনীতে সকল সন্দেহ দূর হয় না। রুট, মুর এবং সাদে আত্মজীবনী লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন; কিন্তু নানাবিধ সঙ্কোচ উপস্থিত হওয়ায়, তাহারা তাহা পরিত্যাগ করেন। তবে বিদ্যাসাগর মহাশয় যেরূপ সত্ত্বাপরায়ণ ছিলেন তাহাতে তিনি সত্যপ্রকাশে যে অকুণ্ঠিত হইতেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।