বিদ্যাসাগর/অষ্টম অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম অধ্যায়।



প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তি, বাঙ্গালা চিঠি, শিক্ষা-বিভাগের পরিবর্তন,

পিতার কার্য্য-ত্যাগ, বাসার অবস্থা, সহৃদয়তার পরিচয়,

প্রতিশ্রুতি-পালন, চলচ্ছক্তির প্রমাণ, বীরসিংহে

কৌতুক, দুর্ব্বলে দয়া, মাতৃ-ভক্তি, সংস্কৃত-

রচনা, তেজস্বিতা, পদ-পরিবর্ত্তন

ও গুণগ্রাহিত।

 ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজে চাকুরি করিবার পূর্ব্বে পাঠ্যবস্থাতেও বিদ্যাসাগর মহাশয়, নিজ-গুণগ্রামে শিক্ষাবিভাগের কর্তৃপক্ষের প্রীতিপাত্র হইয়াছিলেন। তখনও তাঁহার অনেকটা প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তি হইয়াছিল। তাই, তিনি দর্শন-পাঠকালে অধ্যাপক পণ্ডিত নিমচাঁদ শিরোমণি মহাশয়ের মৃত্যু হওয়ায়, চেষ্টা করিয়া পণ্ডিত জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননকে তৎপদে অধিষ্ঠিত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজে তাঁহার প্রতিপত্তি অধিকতর পরিবর্দ্ধিত হইয়াছিল। মার্সেল সাহেব তাঁহাকে বড় শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় কোন বিষয়ের জন্য অনুরোধ করিলে তিনি তৎসাধনে কৃতকার্য্য না হইয়া ক্ষান্ত হইতেন না।

 এই সময় সংস্কৃত কলেজের দুই জন ব্যাকরণাধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। তখন বাবু রসময় দত্ত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। পণ্ডিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ঐ পদের প্রার্থী হইয়াছিলেন।[১] ইনি তখন কলেজের পাঠ সমাপ্ত করিয়াছিলেন। ঐ পদের জন্য কিন্তু একটা পরীক্ষা দিবার ব্যবস্থা হইয়াছিল। বিদ্যাভূষণ মহাশয় পরীক্ষা দিয়া প্রথম হইয়াছিলেন। কি কারণে বলা যায় না, রসময় দত্ত ইঁহাকে সেই পদটী না দিয়া তাড়াতাড়ি পুস্তকালয়ের অধ্যক্ষপদে নিয়োজিত করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, এ কথা মার্সেল্ সাহেবকে অবগত করান। মার্সেল্ সাহেব তদানীন্তন “এডুকেশন্ কৌন্সিলের” সেক্রেটরী ডাক্তার মৌয়েটকে ঐ কথা বলেন। মৌয়েট্ সাহেব রসময় বাবুর বন্দোবস্ত বিপর্য্যস্ত করিয়া দিয়া বিদ্যাভূষণ মহাশয়কে ঐ পদে নিযুক্ত করেন।[২]

 পণ্ডিতবর ৺রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয়, স্বীয় বাঙ্গালা ভাষার “সাহিত্য-বিষয়ক প্রস্তাব” নামক পুস্তকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রতিপত্তি-সম্বন্ধে এইরূপ লিখিয়াছেন,—

 “মার্সেল্ সাহেব বিদ্যাসাগরের সহিত যত ঘনিষ্ঠ হইতে আরম্ভ করিলেন, ততই তাঁহার বিদ্যা, বুদ্ধি, চরিত্র, তেজস্বিতা, উদারতা প্রভৃতি সন্দর্শনে যৎপরোনাস্তি প্রীত হইতে লাগিলেন। তদবধি সকল বিষয়েই বিদ্যাসাগরের কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতেন এবং তদীয় মত গ্রহণ ব্যতিরেকে প্রায় কোন কর্ম্ম করতেন না। ঐ সময়ে ডাক্তার মৌয়েট্, সাহেব এডুকেশন কৌন্সিলের সেক্রেটরী ছিলেন। তিনি সময়ে সময়ে সংস্কৃত বিদ্যা ও হিন্দুধর্ম্মসংক্রান্ত কোন কথা জানিবার প্রয়োজন হইলে মার্সেল্ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেন; মার্সেল্ সাহেব, বিদ্যাসাগর দ্বারা মৌয়েট্ সাহেবের জিজ্ঞাস্য বিষয়ের মীমাংসা করিয়া লইতেন। এই সূত্রে মৌয়েট্ সাহেবের সহিত বিদ্যাসাগরের পরিচয় হয়। তদবধি ইনি বিদ্যাসাগরের প্রতি অত্যন্ত সন্মান ও বিশ্বাস করিতেন। ক্রমে ক্রমে তাঁহার পরমাত্মীয় ও যারপর নাই হিতৈষী হইয়া উঠিয়াছিলেন।”

 মার্সেল্ সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট সংস্কৃত পড়িতেন। তিনি বেশ বাঙ্গলা শিথিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগব মহাশয়ের সঙ্গে বাঙ্গালায় কথাবার্ত্তা কহিতে ভলিবাসিতেন। আবশ্যক হইলে বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে বাঙ্গালায় চিঠিপত্র লিখিতেন। এক বার তাঁহার বাড়ীতে আত্মীয়ের অসুখ হওয়ায়, তিনি কার্য্যে উপস্থিত হইতে পাবেন নাই। এঁই কথা বলিয়া বাঙ্গলায় চিঠি লিখিয়া পাঠাইয়া দেন, চিঠিখানি এইখানে প্রকাশ করিলাম,—

শ্রীশ্রীদুৰ্গা

শবণং।

সবিনয় নিবেদনং—

 অদ্য আমার পিতৃব্যপুত্ত্রের প্রাতঃকালাবধি চারি বার ভেদ হইয়াছে ২০ ড্রপ্ লডেনম্ দেওয়াতে আপাততঃ প্রায় এক ঘণ্টা ভেদ বন্ধ রহিয়াছে কিন্তু একেবারে নিবৃত্ত হইয়াছে এমত বোধ হয় না অতএব তাঁহার নিকটে থাকা অত্যাবশ্যক। সুতরাং অদ্য যাইতে পারিলাম না ত্রুটিমার্জ্জনে আজ্ঞা হয়। কিমধিকমিতি

২৮ নবেম্বর ১৮৪৩
আজ্ঞাবর্ত্তিনঃ
শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মণঃ।

 এ পত্রের শিরোভাগে “শ্রীশ্রীদুৰ্গা শরণং” লেখা আছে। ইহা বিশ্বাস, কি অভ্যাসের ফল, ঠিক করিয়া তাহা বলিবার উপায় নাই। তবে তখনকার পক্ষে বিশ্বাসের ফল বলিয়া একেবারে অবিশ্বাস করাও যাইতে পারে না। তখনও ত তিনি অবিমিশ্র সংস্কৃত শিক্ষারই ফলভোগী ছিলেন। তবে ইহার পরবর্ত্তী কালে যখন তিনি ইংরেজী-বিদ্যায় বুৎপন্ন হইয়া ইংরেজী-ভাষাদৰ্শিত শিক্ষা-প্রণালীর পূর্ণমাত্রায় পোষকতা করিতেছিলেন, যখন হিন্দুচিত ক্রিয়ানুষ্ঠানে বিরত ছিলেন, তাঁহার কোন কোন চিঠিপত্রের শিরোনামেও “শ্রীদুৰ্গা শরণং” বা “শ্রীশ্রীহরি: সহায়ঃ” দেখা যায়। কোন সময়ে তিনি একবার সুকিয়াষ্ট্রীট নিবাসী ডাক্তার চন্দ্রমোহন ঘোধের বাড়ীতে বসিয়া পাইকপাড়ার রাজবাটীতে এক পত্র লিথিয়াছিলেন। পত্র লেখা হইলে পর চন্দ্রমোহন বাবু একবার পত্র খানি দেখিতে চাহিলেন। ইহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় হাস্য করিয়া বলিলেন,—“তুমি যাহা ভাবিতেছ, তাহা নহে; এই দেখ, 'শ্রীশ্রীহরিঃ সহায়ঃ লিখিয়াছি।” ইহাতে মনে হয়, তিনি ষে কারণে চটি জুতা পায়ে দিতেন, থান-ধুতি, মোট চাদর পরিতেন, ভট্টাচার্য্যের মতন মাথা কামাইতেন, সেই কারণেই পত্রের শিরোভাগে ঐরুপ লিখিতেন। ইহাকে হয় তো তিনি বাঙ্গালীর জাতীয়ত্বের একটা অঙ্গ মনে করিতেন।

 এ পত্রের আর একটা বিশেষত্ব আছে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গ্রন্থাদিতে অধুনা ভূরি ভুরি ইংরাজী মতানুযায়ী বিরামচিহ্নাদি দেখিতে পাওয়া যায়, এ পত্রে তাহার একটমাত্র নাই।

 ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজের চাকুরীতে প্রবৃত্ত হইবার পরই, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে তদানীন্তন শিক্ষাবিভাগের একটা বিশিষ্ট পরিবর্ত্তন দেখিতে হয়। শিক্ষাবিভাগের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ সংঘটিত হইয়াছিল। শিক্ষণবিভাগের অধীন হইয়া তন্মতানুসারে তাঁহাকে শিক্ষাপ্রণালীর অনেক প্রবর্ত্তন ও পরিবর্ত্তন করিতে হইয়াছিল। এরূপ অবস্থায় শিক্ষাবিভাগের কি ছিল, কি পরিবর্ত্তন হইয়াছিল, তাহার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ বলিয়া রাখা ভাল। পরিবর্ত্তনে শিক্ষণ-প্রণালীর কিরূপ তারতম্য হইয়াছিল, তাহাও কতকটা বুঝিয়া রাখা উচিত।

 ইতিপূর্ব্বে শিক্ষাবিভাগের পরিচালন-ভার, “কমিটী অব পবলিক ইনষ্ট্রকশন্” নাম্নী সভার হস্তে বিন্যস্ত ছিল। এই সভা ১৮২৩ খৃষ্টাব্দে বা ১২৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সভা প্রতিষ্ঠিত হইবার পর, ১২ বৎসর প্রাচ্যশিক্ষাপ্রচলনকারী এবং পাশ্চাত্যশিক্ষা প্রবর্ত্তন প্রয়াসীদের দ্বন্দ্ব চলিতেছিল। শেষে মেকলের মতামত প্রভাবে প্রথমোক্ত দলের পরাভব হয়। ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে বা ১২৪৬ সালে তদানীন্তন গবর্ণর লর্ড অকলণ্ডের এই মর্ম্মে এক “মিনিট” প্রকাশিত হয়,—“ইয়ুরোপীয় সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের শিক্ষা ইংরাজীতে হইবে বটে; তবে বর্ত্তমান প্রাচ্য বিদ্যালয়গুলিও পুরা দমে চলিবে। ইংরাজীতে ছাত্রদিগকে যেমন উৎসাহ দেওয়া যাইতে পারে, প্রাচ্য-বিদ্যার্থীদিগকেও সেইরূপ উৎসাহ দেওয়া হইবে; পরন্ত ইংরাজীর সঙ্গে এ দেশীয় ভাষার শিক্ষা চলিবে; যে যাহা পছন্দ করে সে তাহাই শিধিৰে।” অতঃপর “কমিটী অব্ পাবলিক্ ইন্‌ষ্ট্ৰকশন” এই শিক্ষা-প্রণালীর পর্য্যালোচনার প্রতি দৃষ্ট রাখিলেন। ইহার পর ইংরাজী শিক্ষার বেগ খরতর হইয়াছিল। ইতিপূর্ব্বে ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে বা ১২৪২ সালে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রদত্ত হয়। ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দে বা ১২৪৪ সালে আদালত হইতে পার্সী ভাষা উঠিয়া যায়। এদেশীয় বিচারকর্ত্তাদের উপর অধিকতর বিস্তৃত ভাবে কার্য্যভার অর্পিত হয়। সুতরাং নৃতন শিক্ষা-প্রণালীর কার্য্যও প্রশস্তত্তর হইতে থাকে। কমিটী বাঙ্গালাকে নয়টী সার্কেলে অর্থাৎ অংশে বিভক্ত করেন। প্রত্যেক ভাগে একটা করিয়া কলেজ বসান হইয়াছিল।[৩]প্রত্যেক ভাগের অন্তর্ভূত প্রত্যেক জেলায় একটা ইংরাজী-বাঙ্গাল স্কুল প্রতিষ্ঠিত করা হইয়াছিল। ১৮৫২ খৃষ্টাব্দে বা ১২৫৯ সালে কমিটী শিক্ষা-বিভাগের ভার অধিকতর শক্তিশালিনী সভা “কোঁন্সিল অব এডুকেশনের” উপর অর্পণ করেন। এই কৌন্সিলের অধীনে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অনেক কার্য্য করিতে হইয়াছিল। পরবর্ত্তী ঘটনায় কৌন্সিলের কার্য্যকলাপের ফল উদঘাটিত ও আলোচিত হইবে।

 ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কার্য্যকালে, ১৮৪৪ খৃষ্টাব্দে বা ১২৫১ সালে তদানীন্তন বড় লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ বাঙ্গালা ভাষা-শিক্ষার নিমিত্ত পাশ্চাত্য বিদ্যালয়ের আদর্শে গঠিত বাঙ্গালা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। চারি বৎসরের মধ্যে এইরূপ একশত একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এই সব বিদ্যালয়ের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সম্পর্ক ছিল। এই সকল বিদ্যালয় বাঙ্গালা ভাষার প্রসার-প্রবর্ত্তনের জন্য সৃষ্ট হয়; পরস্তু বাঙ্গালা পাঠ্যে বিজাতীয় ভাব-প্রণোদনের সম্পূর্ণ সহায় হইয়াছিল। সেইজন্য এই সমস্ত বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা-কথাটা এইখানে বলিয়া রাথিলাম।

 ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজের কার্য্যকালে একদিন পথে পিতা ঠাকুরদাসের কি একটা দুর্ঘটনা উপস্থিত হয়। কাহারও কাহারও মুখে শুনি, অশ্বের পদাঘাতে তিনি আহত হন; কিন্তু এ কথার সত্যতা সম্বন্ধে কেহই দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত নহেন। যাহা হউক, এই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় পিতাকে কর্ম্ম পরিত্যাগ করিতে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন,—“বাবা! এখন তো আমি মাসে ৫০৲ পঞ্চাশ টাকা পাইতেছি, স্বচ্ছন্দে সংসার চলিবে, আপনি আর কেন পরিশ্রম করেন? আপনি দেশে গিয়া থাকুন।”

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিতান্ত অনুরোধে পিতা ঠাকুরদাস কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া দেশে যাইয়া বিশ্রাম করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাকে মাসে মাসে ২০৲ কুড়ি টাকা পাঠাইয়া দিতেন এবং নিজের বাসায় ৩০৲ ত্রিশ টকা খরচ করিতেন। এই সময় বাসায় তাঁহার দুই সহোদর, দুই জন পিতৃব্যপুত্র,দুই জন পিসতুতো ভাই, এক জন মাসতুতে ভাই এবং অনুগত ভূত্য স্ত্রীরাম নাপিত, এই কয়জনের অবস্থিতি হইত।[৪]এতদ্ব্যতীত দুই চারি জন অতিরিক্ত লোক ও প্রায়ই দুই বেলা আহার পাইত। বাসার সকলকেই পর্যায়ক্রমে রন্ধন করিতে হইত। বিদ্যাসাগর মহাশয় ও রন্ধন করিতেন। তা না করিলে কি ৩০৲ ত্রিশ টাকায় এতগুলি লোকের অন্নসংস্থান হয়? বিদ্যাসাগরের নিকট কি শিথিবার বস্তু ছিল ও আছে, পাঠক! তাহা বুঝিতে কি এখনও বাকি রহিল? ৫০৲ পঞ্চাশ টাকা-বেতনভোগী বাঙ্গালীর মধ্যে এরূপ কৃচ্ছসাধ্য ব্যবস্থা কয় জনের দেখিতে পাও?

 এই সময়ে মার্সেল্ সাহেব সংস্কৃত কলেজের “জুনিয়র্” ও “সিনিয়র্” পরীক্ষার পরীক্ষক হন। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সংস্কৃত প্রশ্ন প্রস্তুত করিয়া সাহেবের সাহায্য করিতে হইত। ব্যাকরণ, কাব্য, স্মৃতি, বেদান্ত প্রভৃতি সকল প্রশ্ন তিনি নিজেই লিখিয়া দিতেন। ভাবি তাই একটা মানুষ এত কাজ কি করিয়া করিতেন? ভাবি, আর মুহুর্তে মুহুর্তে বিস্ময়বিমূঢ় হইয়া পড়ি। কিন্তু আবার যখন বিলাতের বিখ্যাত রাজনীতিজ্ঞ কবডেনের কথা মনে হয় —“আমি ঘোড়ার মতন এক মুহূর্ত্ত বিশ্রাম না করিয়া খাটিতেছি”; যখন ভাৰি,—“রোমক সম্রাট্ সীজর্ আল্পস্ হইতে সৈন্য সঞ্চালন করিবার সময় লাটীন অলঙ্কারশাস্ত্র সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিথিয়াছিলেন,”—তখনই মনকে প্রবোধ দিই, শক্তিশালী ব্যক্তির ইহ জগতে অসাধা কি? এই গুণে তো পগুর উপর মনুষ্যের রাজত্ব; সামান্যের উপর অসামান্যের প্রভুত্ব।

 পাঠ্যাবস্থায় যখন সামান্য বৃত্তি পাইতেন, তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহা হইতেও অন্নার্থী ও বস্ত্রার্থীকে সাধ্যানুসারে অন্ন-বস্ত্র দান করিতেন। এখন তিনি ৫০৲ পঞ্চাশ টাকা বেতনভোগী। ২০৲ কুড়ি টাকা পিতার নিকট পাঠাইতেন, আর ৩০৲ ত্রিশ টাকা মাত্র বাসা খরচের জন্য রাখিতেন। এই ৩০৲ ত্রিশ টাকার মধ্যেও তিনি বাসাখরচ চালাইয়া, আবশ্যকমত সাধ্যানুসারে অন্নবস্ত্রার্থী এবং পীড়িত ব্যক্তির সাহায্য করিতেন।

 ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দে বা ১২৫০ সালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক গঙ্গাধর তর্কবাগীশের বিসূচিকা পীড়া হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় সংবাদ পাইয়া, ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে সঙ্গে লইয়া তর্কবাগীশ মহাশয়ের বাসায় উপস্থিত হন। ডাক্তার তাঁহার চিকিৎসা করেন এবং বিদ্যাসাগর নিজ হস্তে মলমূত্র পরিষ্কার করিয়া দেন। তিনি নিজে ঔষধের মূল্য দিয়াছিলেন। কোন অনাথ দুঃস্থ লোক পীড়িত হইলে, তিনি স্বয়ং গিয়া তাহার সেবা-শুশ্রুষা করিতেন এবং তাহাকে বাঁচাইবার জন্য নিজের ব্যয়ে সাধ্যানুসারে ঔষধ-পথ্য যোগাইতেন।

 একবার নারিকেল-ডাঙ্গায় অধ্যাপক জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননের ভাগিনেয় ঈশানচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের ওলাউঠা হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় রাত্রিকালে তথায় উপস্থিত হইয়া তাহার চিকিৎসা করান। তিনি নিজের বাসা হইতে মাদুর-বিছানা লইয়া গিয়া রোগীর শয্যার ব্যবস্থা করিয়া দেন। রাজকৃষ্ণ বাবু বলেন, “তাঁহাকে প্রায়ই এইরূপ করিতে হইত। তাঁহার সে অকৃত্রিম দয়ার কার্য্য—কি সব আমার স্মরণ আছে? আর কতই বা বলিব মহাশয়, আর কতই বা শুনিবেন? সে সব কথা স্মরণ হইলে সেই দয়াবতারের সেই করুণ মূর্ত্তি হৃদয়ে জাগরূক হয়। তাঁহার কথা ভাবিলে বুক ফাটিয়া যায়! চক্ষের জল রাখিতে পারি না! আহা! তেমন দয়ালু দাতা কি আর এ জগতে দেখিব?”

 একবার বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাসার সম্মুখে কোন এক ব্যক্তির ভৃত্য ওলাউঠা-রোগাক্রান্ত হয়। যাঁহার ভৃত্য, তিনি তাহার হাত ধরিয়া তাহাকে রাস্তায় বাহির করিয়া দেন। আহা! সে অনাথ পীড়িতের এমন কেহই ছিল না যে, তাহার মুখে একটু জল দেয়। দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর সংবাদ পাইয়া তখনই গিয়া পীড়িত ভৃত্যকে বুকে করিয়া তুলিয়া আনিয়া, আপনার শয্যায় শয়ন করাইয়া দেন। তাঁহার অবিরাম যত্ন-শুশ্রুষায় এবং সুহৃদ্‌-চিকিৎসকের চিকিৎসায় রোগী দুই চারি দিনের মধ্যে আরোগ্য লাভ করে।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় সুবিধা পাইলেই আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব এবং গুণবান্ কৃতবিদ্য লোকের চাকুরি করিয়া দিতেন। কোন কোন সময়ে তিনি অপরের জন্য ক্ষতিস্বীকার করিতেও কুণ্ঠিত হইতেন না। এই সময় সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের প্রথম শ্রেণীর অধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। মার্সেল্ সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ঐ পদ গ্রহণ করিতে অনুরোধ করেন। ঐ পদের বেতন ৮০৲ আশী টাকা। পঞ্চাশ টাকার বেতনভোগী বিদ্যাসাগর ঐ পদ-গ্রহণে অসম্মত হন। তাহার কারণ এই—

 তিনি পূর্ব্বে তৎকালিক বহু-শাস্ত্রাধ্যাপক তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয়কে যেরূপেই হউক কোন একটি চাকুরি করিয়া দিব বলিয়া প্রতিশ্রুত ছিলেন এবং উপস্থিত পদে তর্কবাচস্পতি মহাশয় উপযুক্ত ব্যক্তি বলিয়া তাঁহার ধারণা ছিল। সুযোগ পাইয়া তিনি প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করিবার চেষ্টা পাইলেন। এই পদে তর্কবাচস্পতি মহাশয় যাহাতে নিযুক্ত হন, তাহার জন্য তিনি মার্সেল্ সাহেবকে অনুরোধ করেন। বিদ্যারত্ন মহাশয় লিখিয়াছেন, “যখন সাহেব, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এই পদ গ্রহণ করিবার জন্য অনুরোধ করেন, তখন তিনি বলেন, মহাশয়, টাকার প্রত্যাশা করি না, আপনার অনুগ্রহ থাকিলেই, আমি চরিতার্থ হইব।” বিদ্যাসাগর মহাশয় এরূপ চাটুবাক্য প্রয়োগ করিবেন, তাঁহার জীবন-সমালোচনা করিলে এরূপ সিদ্ধান্ত করিতে সাহস হয় না। কেহ কেহ বলিতে পারেন যে, প্রকৃত প্রতিশ্রুতির কথা বলিলে সাহেব হয়তো তাঁহাকে অহঙ্কারী মনে করিবেন, সুতরাং কথা রক্ষার সম্ভাবনা থাকিবে না, তাই তিনি সাহেবকে এইরূপ তুষ্টিকর কথা বলিয়াছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর আত্মগোপন করিয়া সাহেবের তুষ্টিকর কথা বলিবেন, এ কথায় বিশ্বাস করিতে কাহারও প্রবৃত্তি হইবে না; আর মার্সেল্ সাহেবও আত্মতুষ্টিকর কথায় বিমূঢ় হইয়া পড়িবেন, এ ধারণাও আমাদের নাই। যাহা হউক, মার্সেল্ সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথায় তর্কবাচস্পতি মহাশয়কেই উক্ত পদে নিযুক্ত করিতে চাহেন। যে দিক্ দিয়াই হউক, ইহা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্বার্থত্যাগের সজীব সঙ্কেত। এরূপ প্রলোভন পরিত্যাগ করিতে একটু হৃদয়-বলের প্রয়োজন। জর্ম্মণ পণ্ডিত হীনের জীবনী-পাঠে তদানীন্তন মনস্বী রঙ্কিনের এইরূপ স্বার্থত্যাগের পরিচয় পাওয়া যায়। রঙ্কিনকে একবার একটী উচ্চ পদ দিবার প্রস্তাব হয়, তিনি কিন্তু হীনকে ঐ পদের উপযুক্ত বিবেচনা করিয়া উক্ত পদ তাঁহাকেই দিবার জন্য অনুরোধ করেন। এই ব্যাপার কেবল বিদ্যাসাগরের স্বার্থত্যাগের পরিচয় নহে; প্রতিশ্রুতি-রক্ষা করিতে তাঁহাকে কিরূপ কঠোরতা সহ্য করিতে হইয়াছিল, তাহারও প্রমাণ পাইবেন।

 যে সময়ে তর্কবাচস্পতি মহাশয়কে নিযুক্ত করিবাব কথা হয়, সেই সময়ে তর্কবাচস্পতি মহাশয় অম্বিকা কাল্‌নায় অবস্থিতি করিয়া তেজারতীর “কারবার” করিতেছিলেন; এতদ্ব্যতীত তথায় তাঁহার একটী টোলও ছিল। তাঁহাকে সোমবারে প্রয়োজন; কিন্তু শনিবারে কথা হয়। পত্র পাঠাইলে সময়ে পত্র পৌঁছিবার সম্ভাবনা নাই; পৌঁছিলেও তর্কবাচস্পতি মহাশয় এ কার্য্য স্বীকার করিবেন কি না, তাহার স্থিরতা ছিল না। এই জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই দিনই একজন আত্মীয়কে সঙ্গে লইয়া কালনাভিমুখে যাত্রা করেন। কলিকাতা হইতে কালনা ২৪।২৫ ক্রোশ দূর। তিনি ও সেই সঙ্গী আত্মীয় সারারাত পদব্রজে চলিয়া পরদিন তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের বাটীতে উপস্থিত হন। তর্কবাচস্পতি ও তাঁহার পিতাঠাকুর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মুখে তাঁহার গমন কারণ জানিয়া চমৎকৃত হইলেন এবং শতবার ধন্যবাদ করিলেন। প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য বিদ্যাসাগর অনায়াসে ও অক্লেশে এত পথ শ্রম সহ্য করিয়াছেন এ কথা ভাবিয়া তাঁহারা বিস্ময়-বিহ্বলচিত্তে স্পষ্টাক্ষরে বলিলেন—“ধন্য বিদ্যাসাগর! তুমিই নরাকারে দেবতা।” যাহা হউক, শুনিয়াছি, এ পদগ্রহণে তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের কি একটা আপত্তি উপস্থিত হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় আপত্তি খণ্ডন করিয়া তাঁহাকে এ পদগ্রহণে সম্মত করান। পর দিন তিনি আবার সেই আত্মীয় সঙ্গে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হন। তর্কবাচস্পতি মহাশয় সঙ্গে আসেন নাই; প্রশংসাপত্রাদি বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং আনিয়া মার্সেল্ সাহেবকে প্রদান করেন। মার্সেল্ সাহেব তর্কবাচস্পতি মহাশয়কে নিযুক্ত করিবার জন্য গবর্ণমেণ্টকে অনুরোধ করেন। পরে তর্কবাচস্পতি মহাশয় কলিকাতায় আসিয়া পদপ্রাপ্ত হন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এ “পথ-চলা”র কথাটা কবি-কল্পনা বলিয়া যেন মনে হয়। সত্য সত্যই কিন্তু তাঁহার “পথ-চলা” শক্তি এমনই ছিল। তাঁহার “পথ-চলা” সম্বন্ধে কত কথাই শুনিয়াছি। উত্তরকালে তিনি রোগভগ্ন দেহে যেরূপ চলিতে পারিতেন, একজন ভীম কলেবর সুদৃঢ় দেহসম্পন্ন যুবকও তেমন চলিতে পারেন কি না, সন্দেহ। তাঁহার উত্তরকালেও কিরূপ হাঁটিবার শক্তি ছিল, প্রসঙ্গ ক্রমে তাহার এইখানে দুই একটী দৃষ্টান্ত দিলাম,—

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দৌহিত্র শ্রীযুক্ত সুরেশচন্দ্র সমাজপতি মহাশয় আমাদিগকে বলিয়াছেন,—“এক দিন কর্ম্মটাড়ে আমি, দাদা মহাশয় এবং আর কয়েক জন প্রাতর্ভ্রমণে বহির্গত হইবার উদ্‌যোগ করি। আমি বলিলাম, “দাদা মহাশয়। আজ আপনাকে দেখি, আপনি কেমন আমাদের অপেক্ষা হাঁটিয়া যাইতে পারেন।” দাদা মহাশয় ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন,—“ভাল, তাহাই হইবে।” এই বলিয়া আমরা সকলেই হাঁটিতে আরম্ভ করিলাম। আমাদের সঙ্গীরা পশ্চাতে পড়িয়া থাকিলেন; আমি কেবল তাঁহার সঙ্গে যাইতে লাগিলাম; কিয়দ্দূর যাইয়া দেখি, দাদা মহাশয় আমাকে পরিত্যাগ করিয়া চটি জুতা পায়ে চট্ চট্ করিতে করিতে অনেক দূর অগ্রসর হইয়া পড়িয়াছেন। আমি চেষ্টা করিয়াও তাঁহাকে ধরিতে পারিলাম না। দাদা মহাশয় দূর হইতে হাসিতে হাসিতে বলিলেন,—“হারাবি না?” আমি অবাক!

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুত্র শ্রীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলিয়াছেন,—“সংস্কৃত কলেজে চাকুরি করিবার সময় এক দিন বাবার বীরসিংহ হইতে কলিকাতায় এক দিনে আসিবার প্রয়োজন হয়। তিনি তাড়াতাড়ি বাহির হইবার উদ্‌যোগ করেন। সেই সময়ে মদন মণ্ডল নামে একজন পাইক বাবাকে বলিল,—‘দাদাঠাকুর, আমি তোমার সঙ্গে কলিকাতায় যাইব।’ বাবা বলিলেন,—‘তুমি আমার সহিত হাঁটিতে পারিবে?’ সে স্বীকার করিল। পরে উভয়েই হাঁটিতে লাগিলেন। চার ক্রোশ পথ আসিয়া মদন মণ্ডল দেখিল, বাবা তাহাকে ছাড়িয়া ৩।৪ রসি অগ্রসর হইয়াছেন। সে ‘হা রা রা’ করিয়া, লাঠি ঘুরাইয়া, আপনি দু-চার পাক ঘুরিয়া, দ্রুতপদে বাবাকে ধরিবার চেষ্টা করিল এবং ছুটিয়া বাবাকে ধরিল। উভয়ে আবার চলিতে আরম্ভ করিলেন। দশ বার ক্রোশ দূরে গিয়া মদন বাবাকে বলিল,—‘দেখ, আজ আর কলিকাতায় যাওয়া হইবে না, এই চটিতে থাকা যাক্।’ বাবা হাসিয়া বলিলেন, ‘আমাকে যাইতেই হইবে। তুমি এই পয়সা লইয়া চটিতে থাক; কাল তখন যাইও।’ মদন চটিতে রহিয়া গেল। বাবা কলিকাতায় আসিলেন।”

 বিদ্যাসাগর মহাশয় পূর্ব্বে এক দিনে হাঁটিয়া বাড়ী যাইতেন এক দিনে বাড়ী হইতে কলিকাতায় আসিতেন। বীরসিংহ গ্রাম হইতে ১০-১২ দশ বার ক্রোশ দূরে মসাট নামক স্থামে দাঁড়াইয়া একটী করিয়া ডাব খাইতেন মাত্র। যখন তিনি কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন, তখনও তিনি প্রায় হাঁটিয়া যাইতেন, এমন কি সঙ্গীদের মোট-বোঝা ভারি হইলে, তিনি তাহাদের মোট-বোঝা কতক নিজের মস্তকে লইয়া হাঁটিতেন। একবার পথে তিনি এইরূপ অবস্থায় যাইবার সময় কলেজের দুই জন দ্বারবানের সম্মুখে পতিত হন। দ্বারবানেরা তাঁহার তদবস্থা দেখিয়া তাঁহার মোট লইবার চেষ্টা করে, তিনি কিন্তু তাহাদিগকে মিষ্ট কথায় বিদায় দিয়া আপনি মোট বহিয়া চলিয়া যান।

 ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজে চাকুরি করিবার সময় বিদ্যাসাগরের বাড়ী যাইবার যেরূপ সুযোগ ঘটিত, সংস্কৃত কলেজের চাকুরির সময় সেরূপ ঘটিত না। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে চাকুরি করিবার সময় তিনি প্রায়ই বাড়ী যাইতেন। বাড়ী গিয়া প্রতিবেশীর তত্ত্ব লওয়া, আর্ত্তপীড়িতের শুশ্রূষা করা, তাঁহার কার্য্য ছিল। এতৎসম্বন্ধে দুই একটী দৃষ্টান্ত এইখানে প্রদত্ত হইল।

 বাড়ী যাইলেই বিদ্যাসাগর মহাশয় মধ্যে মধ্যে ভ্রাতা এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজন সঙ্গে মধ্যাহ্নে নিমন্ত্রণ খাইতে যাইতেন। পথে কৌতুক করিবার জন্য কোন নালা নর্দ্দমা দেখিলে তিনি লাফাইয়া পার হইতেন এবং মধ্যম ভ্রাতাকে সেই নালা নর্দ্দমা পার হইবার জন্য উপরোধ করিতেন। মধ্যম ভ্রাতা বাহাদুরী দেখাইবার জন্য কখন কখন লাফাইতে গিয়া পড়িয়া যাইতেন। সেই সঙ্গে হো হো হাসি রব হইত। তিনি মধ্যম ভ্রাতাকে লইয়া এইরূপ কৌতুক প্রায়ই করিতেন।

 এক বার তিনি বীরসিংহ গ্রাম হইতে হাঁটিয়া আসিতেছিলেন। এক মাঠের মাঝে তিনি দেখিলেন, একটী অতি বৃদ্ধ কৃষক মোট মাথায় করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন, লোকটীর বাড়ী সেখান হইতে ২/৩ দুই তিন ক্রোশ দূরে। তাহার যুবক-পুত্ত্র, তাহার মস্তকে বোঝা চাপাইয়া দিয়া তাহাকে বাড়ী পাঠাইয়াছে। বৃদ্ধ এখন চলচ্ছক্তিহীন। বৃদ্ধের অবস্থা দেখিয়া এবং পুত্ত্রের ব্যবহারের কথা শুনিয়া, চক্ষের জলে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বক্ষঃস্থল ভাসিয়া গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ বৃদ্ধের মস্তক হইতে সেই বোঝা আপন মস্তকে তুলিয়া লইলেন এবং বৃদ্ধকে সঙ্গে করিয়া তাহার বাড়ী পর্য্যন্ত গেলেন। তিনি সেই মোট বৃদ্ধের বাড়ীতে পৌঁছিয়া দিয়া, আবার হাঁটিয়া কলিকাতায় আসেন।

 এমন অনেক শুনিয়াছি, সব কথা বলিবার স্থান হইবে না। পাঠক ইহাতেই অবশ্য বুঝিয়াছেন, বিদ্যাসাগরের চলচ্ছক্তি কিরূপ অসামান্য। বল দেখি, মস্তিষ্ক ও দেহের এরূপ শক্তি-সমবায় ইহ সংসারে অতি বিরল কি না? আর কোন বাঙ্গালীর এমন দেখিয়াছ কি? কেবল কি তাই? এমন অনাত্মপরতা বা কয় জনের আছে বল দেখি? বল, বুদ্ধি, দয়া,—তিনটীর একত্র সমাবেশ, বড় ভাগ্যবান্ না হইলে কাহারও হয় কি? একধারে যে ত্রিবেণীর ত্রিধারা, ইহার উপর আবার মাতৃভক্তির মন্দাকিনীধারা পূর্ণোচ্ছ্বাসে প্রবাহিত। এই খানে তাহারও একটু পরিচয় দিব। ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজে কার্য্য করিবার সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তৃতীয় ভ্রাতার বিবাহ সম্বন্ধ হইয়াছিল। বীরসিংহ গ্রাম হইতে জননী পত্র লিখিয়া পাঠাইলেন,—“তুমি অতি অবশ্য আসিবে।” মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগর আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। তিনি তখন মার্সেল্ সাহেবের নিকট ছুটীর জন্য প্রার্থনা করিলেন; ছুটী কিন্তু পাইলেন না। তখন তিনি ভাবিলেন,—আমাকে না দেখিয়া মা মরিবেন! অত্যন্ত কৃতঘ্ন আমি, মাতৃ-আজ্ঞা পালন করিতে পারিলাম না। হা ধিক! শত ধিক্।” সকলেই বাড়ী গিয়াছেন; বিদ্যাসাগর মহাশয় শূন্য প্রাণে ও উদাস মনে সারারাত্রি কাঁদিয়া কাঁদিয়া কাটাইলেন। পর দিন প্রাতঃকালে তিনি প্রতিজ্ঞ করিলেন,—“ছুটী না পাই, কর্ম্ম পরিত্যাগ করিব, অদ্য কিন্তু বাড়ী নিশ্চিতই যাইব।” তিনি মার্সেল্ সাহেবকে গিয়া বলিলেন,—“ছুটী না দেন, কর্ম্ম পরিত্যাগ করিলাম,— মঞ্জুর করুন; চাকুরীর জন্য জননীর অশ্রু-জল সহ্য করিতে পারিব না।” সাহেব স্তম্ভিত হইলেন! ভাবিলেন,—“কি এ অদ্ভুত মাতৃভক্তি!” তিনি আর দ্বিরুক্তি না করিয়া প্রসন্নচিত্তে তখনই ছুটী মঞ্জুর করিলেন। ছুটী পাইয়াই বিদ্যাসাগর মহাশয় বাসায় অসিলেন এবং বেলা তিনটার সময় ভৃত্যকে সঙ্গে লইয়া যাত্রা করিলেন। আষাঢ় মাস —আকাশ ঘনঘটায় আচ্ছন্ন,—মুহুর্মুহুঃ কড় কড় বজ্রধ্বনি, চকিতে বিদ্যুৎ-চমকানি-অবিরাম বাত্যা প্রবাহিনী,—মূষলধারে বৃষ্টি,—পথ ঘাট কদমাক্ত। বিদ্যাসাগর কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ না করিয়া, মাতৃ-উদ্দেশে উৰ্দ্ধশ্বাসে চলিতে লাগিলেন। সন্ধ্যার সময় ভূত্য শ্রীরামের অনুরোধে তাঁহাকে সে রাত্রি, কৃষ্ণরামপুরের এক দোকানে অবস্থিতি করিতে হয়। তখনও ১২।১৩ বার তের ক্রোশ পথ অবশিষ্ট। পরদিন প্রত্যুষে তিনি আবার চলিতে লাগিলেন। শ্রীরাম ক্লান্ত হইয়া পড়িয়ছিল। তাহার বাড়ী নিকটস্থ কোন গ্রামে। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাকে বাড়ী. যাইতে বলিলেন। শ্রীরাম কিন্তু প্রভুর বিপদাশঙ্কায় সঙ্গ ছাড়িল না। সে ধীরে ধীরে প্রভূর পদানুসরণ করিতে লাগিল। কিয়দ্দুর গিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় ক্ষুধার্ত্ত ও ক্লান্ত শ্রীরামকে একটা দোকানে ফলারে বসাইয়া বলিলেন,—“শ্রীরাম এই পয়সা লও,– বাড়ী বাড়ী যাও।” এই কথা বলিয়া তিনি দ্রুতপদে তীরবেগে চলিতে আরম্ভ করিলেন। শ্রীরাম সঙ্গ লইতে পারিল না। ক্রমে বিদ্যাসাগর মহাশয় দামোদর নদের তীরে উপস্থিত হইলেন। বিষম বর্ষায় দামোদরে খরতর একটানা স্রোত,—‘দুকুল-ভরা',—‘কানে কান জল!'

 গ্রীষ্মকালে দামোদরে সামান্য-মাত্র জল থাকে; এমন কি হাঁটিয়াই পার হওয়া যায়। বর্ষাকালে কিন্তু ইহা প্রলয়ঙ্করী সংহারমুর্তি ধারণ করে। আজ সেই দামোদর বাত্যাবিক্ষোভিত বারিধিবৎ ভীষণ সংহারমূর্ত্তি ধারণ করিয়াছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় দেখিলেন,— পারাপারের নৌকা অন্য পারে। তাঁহার বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পিতা, ভ্রাতা, ভগিনী, যুবতী বনিতা[৫]—সবই আছে; আজ কিন্তু বিদ্যাসাগর ভাবিতেছেন,—“তাঁহার কেহই নাই –আছেন কেবল,—“জননী”। বিদ্যাসাগর বাহ্যজ্ঞান শূন্য;— অন্তরে বাহিরে কেবল সেই অন্নপূর্ণা মাতৃ মূর্ত্তি! অনন্ত বিশ্ব-ব্যোম ব্যাপিনী মাতৃ-মূর্ত্তি। তিনি আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। নৌকার অপেক্ষা না করিয়া, তিনি উচ্চকণ্ঠে ‘মা, মা' বলিয়া ডাকিয়া দামোদরের জলে ঝাঁপ দিলেন।

 দেখিতে দেখিতে বিদ্যাসাগর সাঁতার দিয়া দামোদর পার হইয়া গেলেন। বিদ্যাসাগর কি নিজ-বলে সে দুর্জ্জয় দামোদর পার হইলেন? মানুষের শক্তিতে কি তাহা কুলায়? এ ব্যাপার দেখিয়া মনে হয়, মাতৃভক্তের কাতর ক্রন্দনে স্থির থাকিতে না পারিয়া, স্বয়ং মাতৃরূপিণী মহামায়া বিদ্যাসাগরকে বুকের ভিতর করিয়া লইয়া, সেই দুরন্ত দামোদর পার করিয়া দিয়াছিলেন। পার হইয়া বিদ্যাসাগর আবার চলিতে আরম্ভ করিলেন। পথে তাঁহাকে দ্বারকেশ্বর নদ সাঁতরাইয়া পার হইতে হয়। মাঠের মাঝে ‘কুড়ান খালের' নিকট সন্ধ্যা উপস্থিত হয়। এই খানে ভয়ানক দস্যুর ভয় ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় অকুতোভয়ে মাতৃপদ স্মরণ করিয়া চলিতে লাগিলেন। রাত্রি ৯ নয়টার সময় তিনি বাড়ীতে উপস্থিত হন। উপস্থিত হইযা দেখেন, বর বিবাহ করিতে গিয়াছে; মা কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ করিষা, অনাহারে পড়িয়া আছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় এক বার উচ্চ কণ্ঠে ডাকিলেন,—“মা! মা! আমি এসেছি।” বিদ্যাসাগরের কণ্ঠস্বর বুঝিয়া মা ঘরের বাহিরে আসিয়া ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। তখন মা ও কাঁদেন, পুত্র ও কাঁদেন। উভয়েই অনাহারে ছিলেন। উচ্ছ্বাস-বেগের হ্রাস হইলে পর, মাতা ও পুত্র একত্র আহার করিতে বসেন।

 বহুতর বিদেশীয়-গ্রন্থ পাঠক বহুতর মাতৃভক্ত বিদেশীয় পুরুষের নাম,শুনিয়া থাকেন। জনসন্, জেনারল্ ওযাশিংটন্ প্রভূতির মাতৃভক্তি অতুলনীয় বলিয়া পরিকীর্ত্তিত; কিন্তু বল দেখি, বাঙ্গালী বিদ্যাসাগবের এ মাতৃভক্তির তুলনা হয কি? গুনিয়াছি, রোমক-বীর সম্রাট্ সিজর্, যখন ইংলণ্ড-বিজয়-মানসে সাগর পর হইবার উপক্রম করেন, তখন ভয়ানক ঝড়-বৃষ্টি উপস্থিত হইয়াছিল। তাঁহাকে জাহাজে উঠিতে অনেকেই নিষেধ করেন; কিন্তু তিনি কাহারও নিষেধ শুনেন নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন দামোদরে ঝাঁপ দিবার উপক্রম করেন, তখন নিকটস্থ জনকয়েক লোক তাঁহাকে পাগল ভাবিয়া, সে দুষ্কর কার্য্যে বাধা দেয়; বিদ্যাসাগর কোন বাধা মানেন নাই। বাহ্য জগতে উভয়ের অবস্থা এইরূপ; অন্তর্জগতের ক্রিয়া নিশ্চিতই ভিন্নরূপ। এক জনের বিঞ্জয়বাসনা; অপরের মাতৃপূজা। বল দেখি, পাঠক! কাহার সাহস প্রশংসনীয়? এ জগতে কোন্ বীর স্মরণীয়? বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির এই একটা মাত্র দৃষ্টান্ত পাইলেন; পরে আরও বহু প্রকার পাইবেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়, বাল্য-রচনায় যেমন সুন্দর সুপাঠ্য কবিতা রচনা করিতে পারিতেন, যৌবনেও তাঁহার সেইরূপ কবিতা রচনা করিবাৰ শক্তি ছিল। তিনি যখন ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজের পণ্ডিত, তখন কষ্ট-নামে এক সিবিলিয়ন সাহেব তাঁহাকে নিজের নামে একটী কবিতা রচনা করিতে অনুরোধ করেন। অনুরোধের বশে নিম্নলিখিত কবিতাটা রচিত হইযাছিল,—

“শ্রীমান্ রবর্টকষ্টোহদ্য বিদ্যালয়মুপাগতঃ।
সৌজন্যপূর্ণৈরালাপৈর্নিতিরাং মামতোষয়ৎ॥
সহিষ্পদ গুণসম্পন্নঃ সদাচাররতঃ সদা।
প্রসন্নবদনো নিত্যং জীবত্বব্দশতং সুখী॥”

 কষ্ট সাহেব সন্তুষ্ট হইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ২০০৲ দুই শত টাকা পুরস্কার দিতে প্রস্তুত হন। তিনি তাহা গ্রহণ না করিয়া কলেজে জমা দিতে বলেন। সাহেব তাহাই করেন। যে ছাত্র সংস্কৃত রচনায় প্রথম হইতেন, তিনি এই টাকা হইতে ৫০৲ পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার পাইতেন। ৪ চারি বৎসর ৪ চারিটী ছাত্র এই পুরস্কার পাইয়াছিলেন। ইহার নাম হইয়াছিল, “কষ্ট-পুরস্কার”। বিদ্যাসাগর মহাশয নিজে টাকা না লইয়া সংস্কৃত চর্চ্চার শুভোদ্দেশে ৪ চারিটী স্বদেশীয় পণ্ডিতাকে প্রকারান্তরে এই টাকা দেওয়াইলেন। কষ্ট সাহেবের দ্বিতীয় অনুরোধে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিম্নলিখিত শ্লোক রচনা করিয়াছিলেন;—

“দোষৈর্ব্বিনাকৃতঃ সর্ব্বৈঃ সর্ব্বৈরাসেবিতো গুণৈঃ।
কৃতী সর্ব্বাসু বিদ্যাসু জীয়াৎ কষ্টো মহামতিঃ॥
দয়াদাক্ষিণ্যমাধুর্য্যগাম্ভীর্য্যপ্রমুখাঃ গুণাঃ।
নরবর্ত্মরতে নূনং রমস্তেহস্মিন্ নিরন্তরম্॥
সদাসদালাপরতেনিত্যং সৎপথবর্ত্তিনঃ।
সর্ব্বলোকপ্রিয়স্যাস্য সম্পদস্ত সদা স্থিরাঃ॥
অস্য প্রশান্তচিত্তস্য সর্ব্বত্র সমদর্শিনঃ।
সর্ব্বধর্ম্মপ্রবীণস্য কীর্ত্তিরায়ুশ্চ বৰ্দ্ধতাম্॥
বিদ্যাবিবেকবিনয়াদিগুণৈরুদারৈঃ।
নিঃশেষলোকপরিতোষকরশ্চিবায়॥
দূরং নিরস্তখলদুর্ব্বচনাবকাশঃ।
শ্রীমান্ সদা বিজয়তাং নু রবর্ট কষ্টঃ॥”

 কষ্ট সাহেব যখন এই কবিতা রচনা করিতে অনুরোধ করেন, তখন তিনি পঞ্জারের সবিলিয়ান্ পদ হইতে চির-বিদায় লইয়া বিলাত যাইবার উপক্রম করিতেছিলেন।

 অতঃপর উত্তর-চরিত, শকুন্তলা ও মেঘদূতের সংক্ষিপ্ত টীকা ভিন্ন বিদ্যাসাগর মহাশয় এ ভাবে আর কোন শ্লোকাদি রচনা করিয়াছিলেন কি না, তাহার বিশিষ্ট প্রমাণ নাই। তিনি যে এ ভাবে আর সংস্কৃত গদ্য বা পদ্য রচনা করিয়াছিলেন, এমন বোধও হয় না। সংস্কৃত-রচনায় তাঁহার প্রবৃত্তি ছিল না। আধুনিক লোকে প্রকৃত বিশুদ্ধ সংস্কৃত রচনা করিতে পারে, এ বিশ্বাস তাঁহার ছিল না। একদিন মেঘদূতের স্বরচিত টীকা দেখিয়া তিনি স্বীয় দৌহিত্রের নিকট একটু হাসিয়া বলিয়ছিলেন,—“ওরে আমি বেশ সংস্কৃত লিখেছি তো।”

 ফোর্ট উইলিয়ম্ কলেজে অধ্যাপনার কালে বিদ্যাসাগর মহাশয় সাহেবদের পরীক্ষক হইতেন। তদুপলক্ষে বিদ্যারত্ন মহাশয় লিথিয়াছেন,—“পরীক্ষায় পাস না হইলে, কোন কোন সিবিলিযনকে দেশে ফিরিয়া যাইতে হইত। এ কারণ মার্সেল সাহেব দয়া করিয়া ঐ সিবিলিয়নদের কাগজে নম্বর বাড়াইয়া দিতে বলিতেন। অধ্যক্ষের কথা না শুনিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় ন্যায়ানুসারে কার্য্য করিতেন। উপরোধ করিলে ঘাড় বাঁকাইয়া বলিতেন, অন্যায় দেখিলে কার্য্য পরিত্যাগ করিব। এ কারণ সিবিলিয়ন্‌ ছাত্রগণ ও অধ্যক্ষ মার্সেল সাহেব তাহাকে আন্তরিক ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিতেন।”

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এরূপ ন্যায়পরতা অসম্ভব নয়; কিন্তু রাজকৃষ্ণ বাবুর মুখে মার্সেল সাহেবের যেরূপ সদাশয়তা ও সৎসাহসিকতার কথা শুনি, তাহাতে তিনি বিদ্যাসাগরকে এরূপ প্রস্তাব করিয়াছিলেন, এ কথা হঠাৎ স্বীকার করিতে যেন মন চাহে না। তবে স্বজাতি-প্রেমের কথা স্বতন্ত্র।

  1. ১৭৪২ শকে বা ১৮২০ খৃষ্টাব্দে ইনি ২৪ পরগণার অন্তর্গত চাঙড়িপোতা গ্রামে জন্ম গহণ করেন। ইনি ১২ বৎসর সংস্কৃত কলেজে পড়িয়াছিলেন। উত্তর কালে ইনি সোমপ্রকাশের সম্পাদক হন। ইঁহার সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সবিশেষ সৌহার্দ্য ছিল।
  2. নববার্ষিকী, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় কর্ত্তৃক সংগৃহীত, ২২৮ পৃষ্ঠ
  3. এই কমিটীর কার্য্যকালেও ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে বা ১২৪২ সালে হিসাব করিয়া দেখা হইয়াছিল, বাঙ্গালার এক লক্ষ গ্রাম্য স্কুল ও পাঠশালা ছিল। ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দে বা ১২৬২ সালের পূর্ব্বে ইহাদের উন্নতি পক্ষে কোন চেষ্টা হয় নাই।
  4. বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুত্র শ্রীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের মুখে শুনিয়াছি, যখন সুকিয়া ষ্ট্রীটে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাসা ছিল, তখন কতকগুলি আত্মীয় লোক তাঁহার প্রাণনাশকল্পে ভয়ানক ষড়যন্ত্র করিয়াছিল। তখন ঐ অনুগত ভৃত্য শ্রীরামের কল্যাণেই তিনি আত্মরক্ষায় সমর্থ হন।
  5. ১৮৩৬ কি ৩৭ খৃষ্টাব্দে বা ১৮৪৪ কি ১৮৪৩ সালের ফাল্গুন মাসে বিদ্যাসাগরের বিবাহ হইয়াছিল।