বিদ্যাসাগর/অষ্টাবিংশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টাবিংশ অধ্যায়।

ভ্রাতার অভিমান, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, রাজা রাধাকান্ত, হিন্দু-

পেট্‌রিয়টে পত্র, জ্যেষ্ঠ কন্যার বিবাহ, রামগোপাল

ঘোষ, সারদাপ্রসাদ, ঘাটাল-স্কুল, রাণী

কাত্যায়নী, ইন্‌কম্ ট্যাক্স ও

হরচন্দ্র ঘোষ।

 নারায়ণ বাবুর মুখে শুনিয়াছি, ভ্রাতারা মধ্যে মধ্যে জ্যেষ্ঠের উপর অভিমান করিয়া মাসহরা লইতেন না। এজন্য সময় সময় তাঁহাদের কষ্ট হইত। সে কষ্টের কথা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কর্ণগোচর হইলে, তিনি বাটী গিয়া গোপনে গোপনে ভ্রাতৃবধুদের অঞ্চলে টাকা বাঁধিয়া দেওয়াইতেন।

 ১৮৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বহুবিবাহ বহিত করণসম্বন্ধে আইনের প্রত্যাশায় গবর্ণমেণ্টে আবেদন হইয়াছিল। ফল হয় নাই।

 ১২৭৩ সালের ১৮ই পৌষ বা ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দের ৬ই জানুয়ারি বৃহস্পতিবার হাইকোটের ভূতপুর্ব্ব জজ অনারেবল শম্ভুনাথ পণ্ডিতের মৃত্যু হয়। বেথুন স্কুলের সম্পর্কে ইহাঁর সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সবিশেষ ঘনিষ্ঠতা হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় যেবার বেথুন স্কুলে চিক পুরস্কার দেন, সেইবার ইনি সোনার বালা পুরস্কার দিয়াছিলেন।

 ১২৭৪ সালের ১লা বৈশাখ বা ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দের ১০ই এপ্রেল স্যর রাজা রাধাকান্ত দেবের মৃত্যু হয়। ইনি বিধবা-বিবাহের বিপক্ষবাদী ছিলেন; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তেজস্বিতা ও বুদ্ধিমত্তা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতেন।

 এই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনেক দেনা ছিল বলিয়া হিন্দু-পেট্রিয়ট, এডুকেশন গেজেট প্রভৃতি সংবাদপত্রে সাধারণের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিয়া এক বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন বীরসিংহ গ্রামে ছিলেন। ফিরিয়া আসিয়া যখন তিনি এই কথা শুনেন, তখন তাঁহার সেই প্রশান্ত বারিধিবৎ হৃদয়ে যেন মুহূর্তে বিষম বাড়াবানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠে। তিনি তখনই তাহার একটা প্রতিবাদ করিয়া হিন্দু পেট্রিয়টে এক পত্র লিখেন। পত্রের মর্ম্ম এই,—

 “বহু দিনের পর আমি বাড়ী হইতে কলিকাতায় আসিলাম। আসিয়া শুনিলাম, বিধবা-বিবাহ-সংস্কারের জন্য অনেকগুলি টাকার ঋণ হইয়াছে বলিয়া চাঁদা তুলিয়া সেই ঋণশোধের নিমিত্ত একটা ফণ্ড-স্থাপনের প্রস্তাব হইয়াছে; বলা হইয়াছে, আমি সেই ঋণ করিয়াছি। শুনিয়া আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। দেশী ইংরেজী সকল সংবাদপত্রেই এ কথা ব্যক্ত হইতেছে; লোকের মুখে মুখে এ কথা ঘুরিতেছে; তথাকথিত ঋণের একটা তালিকাও দেওয়া হইয়াছে।

 কাজেই, যত শীঘ্র সম্ভব, আমাকে প্রতিবাদ করিতে হইল। বলিতে হইল, আমার সম্মতি লওয়া ত দুরের কথা, এ প্রস্তাব করিবার পূর্ব্বে আমাকে একবার জানানও হয় নাই। আমি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। বলিতে হইল, না জানিয়া শুনিয়া যে ৪৫ হাজার টাকা ঋণের কথা কথিত হইয়াছে, প্রকৃতপক্ষে ঋণ তাহার অর্দ্ধাংশেরও অনেক অল্প, আর এই ঋণশোধের নিমিত্ত সাধারণের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিবার ইচ্ছা আমার কখনই নাই। বিধবা-বিবাহ-সংস্কারের অনেক হিতৈষী অতি যৎসামান্য অর্থসাহায্য করিয়াছেন; কিন্তু স্বেচ্ছায় আমি সেই স্বেচ্ছাদত্ত অর্থসাহায্যে কখনও প্রত্যাখ্যান করি নাই, কিন্তু তাই বলিযা ইহার জন্য ব্যক্তিবিশেষকে পীড়াপীড়ি করা আমার নীতিবিরুদ্ধ। কয়েকটী বন্ধুর অর্থসাহায্যে এবং যত অল্পই হউক আমার নিজ আয়ের উপর নির্ভর করিয়াই আমি এতাবৎ এই সংস্কারের পথে চলিয়া আসিতেছি; এবং আশা আছে, এখনও এইরূপ চলিতে পারি। উল্লিখিত কয়েকটী বন্ধু এবং স্বেচ্ছায় যাঁহারা অর্থসাহায্য করিতেছেন, এমন কতকগুলি ব্যক্তি এ পক্ষে আমার সহায়। অনেক স্থলে ইঁহারা কথার মত কাজ করিয়াছেন এবং এখনও সাহায্যাদি করিতেছেন।

 ৬০টী বিধবা-বিবাহে ৮২ হাজার টাকা খরচ হইয়াছে। শুনিলাম এজন্য কেহ কেহ বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছেন; কিন্তু যাঁহারা হিন্দুসমাজের অবস্থা জানেন, এক দলাদলির জন্যই এ পক্ষে কত অধিক টাকার ব্যয় হইতে পারে, তাহা বোধ করি, তাঁহারা অজ্ঞাত নহেন। মফঃস্বলের যে সকল গ্রামে বিধবা-বিবাহ অনুষ্ঠিত হইয়াছে, তাহার অনেক স্থলেই এইরূপ দলাদলি; সুতরাং সহজেই প্রতীত হইতেছে, এরূপ স্থলের বিবাহ অবশ্যই কিছু ব্যয়সাপেক্ষ।

 প্রথম বিধবা-বিবাহের অনুষ্ঠান হয়,—কলিকাতা শহরে। এই প্রথম বিবাহে একটু ধূমধাম করা এবং পণ্ডিত কুলীনাদির বিদায়াদি দেওয়া সংস্কার-সমিতির সভ্যগণের মতে প্রয়োজনীয় বোধ হয়। তাই বহু কুলীন ব্রাহ্মণাদি এ বিবাহে আহুত হইয়াছিলেন এবং বিদায়াদিও তাঁহাদিগকে দেওয়া হইয়াছিল। শুদ্ধ এই একটা বিবাহেই দশ সহস্র টাকা ব্যয়িত হইয়াছিল, কিন্তু অতিব্যয়ের শুদ্ধ ইহাই কারণ নহে; মফঃস্বলে যাঁহারা এ সংস্কারের জন্য—বিধবা-বিবাহের জন্য চেষ্টা করিতেছিলেন, তাঁহাদিগকে নানারূপ অন্য বিপদে পড়িতে হইয়াছে। নানারূপ দেওয়ানী ফৌজদারী মামলায় তাঁহাদিগকে জড়িত হইতে হইতেছে; আহত প্রহৃত হইতে হইতেছে; কোথাও কোথাও দাঙ্গা-হাঙ্গামাদিতেও লিপ্ত হইতে হইতেছে, ইহার প্রতিবিধান আদালত হইতেই করিতে হইতেছে। বলা বাহুল্য এ কার্য্য কখনই অনল্প-ব্যয়সাপেক্ষ নহে।

 আমার সম্বন্ধে লোকে কিছু ভাবিবে বা আমাকে শোকে কেহ কিছু বলিবে,— এ ভয়ে আমি এই সকল কথা বলিতেছি না— বলিতেছি, এই বিধবা-বিবাহ-সংস্কারকার্য্যে ইহা অনুকূল হইবে বলিয়া; তবে এতৎসম্বন্ধে ভাল ভাবিয়া কোন কাজ করিতে গিয়া যদি মন্দ করিয়া ফেলি, তাহা হইলে অবশ্যই আমাকে দুঃখিত হইতে হইবে। যাহারা এই চাঁদা তুলিবার প্রস্তাব করিয়াছেন এবং বিধবা বিবাহ-ফণ্ড খুলিবার সংকল্প করিয়াছেন, তাঁহারা যদি আমার এই ঋণের কখা না পাড়িতেন, তাহা হইলে আমি প্রতিবাদ করা আবশ্যক বলিয়া বোধ করিতাম না। কেন না পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আমি যাহা ঋণ করিয়াছি, তাহা শোধ করিবার জন্য সাধারণ সমীপে আবেদন করিবার ইচ্ছা আমার লেশমাত্রও নাই। যে জাতীয় অনুষ্ঠান লইয়া আমি এখন যুঝিতেছি, তাহা আমার নিজ ব্যক্তিত্ব লইয়া বড়ই জড়িত। তাই আমি উক্ত প্রচারিত প্রস্তাবের প্রতিবাদ করিতেছি এবং যে সকল ভদ্রলোক এই প্রস্তাবে স্বাক্ষর করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে সরিয়া দাড়াইতে অনুরোধ করিতেছি।

ইতি ২৬শে জুন, ১৮৬৭ খৃঃ।
(স্বাঃ) ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা।

 ১২৭৩ সালের শ্রাবণ ১৮১৭ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জোষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী হেমলতা দেবীর সহিত নদীয়া জেলার আইসমালী গ্রামবাসী ৺গোপালচন্দ্র সমাজপতির বিবাহ হয়। কন্যা হেমলতা অতি বুদ্ধিমতী ও কর্ম্মিষ্ঠা। জামাতা সমাজপতি মহাশয়ও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মনোমত হইয়াছিলেন।

 ১২৭৩-৭৪ সালে বা ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনেক গুলি বন্ধু-বিয়োগ ঘটিয়াছিল। ১২৭৩ সালের ৯ই মাঘ বা ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দের ২১শে জানুয়ারি বেলা ১১॥ টার সময় রামগোপাল ঘোষের[১] মৃত্যু হয়। ইনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সুহৃদ্ ও সহায় ছিলেন। বিধবা বিবাহ-ব্যাপারে ইঁহার বেশ সহানুভূতি ছিল। নিমতলার কলে শবদাহ করিবার যে প্রস্তাব হইয়াছিল, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উত্তেজনায় রামগোপাল বাবু তাহার প্রতিবাদ করিয়াছিলেন।

 এই শবদাহ ব্যাপার সম্বন্ধে নিম্নলিখিত গল্পটীর প্রচার আছে, “কলে মৃত দেহের সৎকার হইবে শুনিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় মর্ম্মাহত হন। ইহা যাহাতে না হয়, তাহাই করিবার জন্য তাঁহার প্রাণান্ত পণ হইল। সহরের অনেক বড় বড় লোক কিন্তু ইহার পক্ষে মত দিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় ঠিক করিলেন, এক রামগোপাল ঘোষই এই প্রস্তাবের প্রতি বাদ করিবার উপযুক্ত লোক। তিনি তৎক্ষণাৎ রামগোপাল ঘোষের নিকট যাইয়া উপস্থিত হন। রামগোপাল প্রতিবাদ করিতে সম্মত হন নাই। তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় চিন্তা করিয়া সিদ্ধান্ত করিলেন, রামগোপাল বড় মাতৃভক্ত; মায়ের কথা ঠেলিতে পারিবেন না; অতএব এ সম্বন্ধে তাঁহার মাকে দিয়া অনুরোধ করিতে হইবে। এই ভাবিয়া পরদিন প্রাতঃকালে বিদ্যাসাগর মহাশয় রামগোপালের বাড়ীতে যাইয়া তাঁহার ঠাকুরদালানে বসিয়া থাকেন। সেই সময় রামগোপালের জননী গঙ্গাস্নান করিরা বাড়ী আসেন। তিনি বিদ্যাসাগরকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,—"ঈশ্বর! তুমি যে এখানে ব’সে?” বিদ্যাসাগর বলিলেন,—“মা! কলে মড়া পোড়াইবার ব্যবস্থা হইতেছে।” রামগোপালের জননী শুনি অবাক্! বলিলেন,—“বাবা! এ ব্যবস্থা যাহাতে না হয়, তাহার উপায় কি নাই?” বিদ্যাসাগর বলিলেন, “এক উপায় আছে। কাল টাউনহলে সভা করিয়া ইহার মীমাংসা হইবে। আপনার ছেলে যদি সভায় যাইয়া ইহাতে আপত্তি করে, তাহা হইলে এ ব্যবস্থা বন্ধ হইতে পারে।” রামগোপালের জননী বলেন,—“তা যদি হয়, আমি এখনই রামগোপালকে বলবো।” পরে তিনি বাড়ীর ভিতর গিয়া রামগোপালকে অনুরোধ করেন। রামগোপাল বাহিরে আসিয়া বিদ্যাসাগরকে বলেন,—“মাকে বলেছ কি ব’লবো, মার কথা ঠেলিবার নহে। ভাল, কাল তিনটার সময় এস, সভায় যাইব।” পরদিন বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সঙ্গে লইয়া রামগোপাল টাউন হলের সভায় গিয়া কলে শবদাহ করিবার প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাঁহার প্রতিবাদে প্রস্তাব রদ হইয়া যায়।”

 ১২৭৪ সালের ১৯ শে ফাল্গুন বা ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দের ১৮ই মার্চ্চ বুধবার বর্দ্ধমান-চকদিঘীর জমীদার সারদাপ্রসাদ রায়ের মৃত্যু হয়। সারদা বাবুর সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঘনিষ্ঠতা ছিল। সারদা বাবু কোন বিষয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মত না লইয়া চলিতেন না। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। পোষ্যপুত্র গ্রহণ করা উচিত কি না, একবার এ বিষয়ে তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে পোষ্যপুত্র লইতে নিষেধ কবিয়া স্কুলস্থাপন, ডিস্পোনসারি প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি হিতকর কার্য্যানুষ্ঠানের পরামর্শ দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরামর্শানুসারে সারদা বাবু ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে চকদিঘীতে একটা ডাক্তারখানা এবং ১২৬৮ সালর ১৮ই শ্রাবণ বা ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে ১লা আগষ্ট একটা অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই চকদিঘীতে এক দরিদ্র পরিবারকে বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৫৲ টাকা করিয়া মাসহারা দিতেন। সারদা বাবুর মৃত্যুর পর তদীয় উইল সম্বন্ধে এক মোকদ্দমা হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাতে সাক্ষী ছিলেন। সে কথা যথাস্থানে বিবৃত হইবে।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় দারুণ ঋণভারগ্রস্ত, তবুও কিন্তু কাহাকে অর্থসাহায্য করা একান্ত আবশ্যক বিবেচনা করিলে, যেখান হইতে হউক তিনি অর্থ সংগ্রহ করিয়া সাহায্য করিতেন। এই সময় মেদিনীপুর-ঘাটাল অঞ্চলে একটী এণ্ট্রান্স পরীক্ষার উপযোগী স্কুল-স্থাপনের সাহায্য প্রার্থনায় বিদ্যাসাগর মহাশয়কে নিম্নলিখিত পত্র লিখিত হয়,—

ঘাটাল, ১৯শে জৈষ্ঠ, ১২৭৫ সাল।

সবিনয় সম্মানপুরঃসর নিবেদনমিদং—

 অত্রস্থলে একটী এণ্ট্রান্স পরীক্ষার পাঠোপযোগী সংস্কৃত সহিত ইংরেজী স্কুল স্থাপিত হওয়া একান্ত আবশ্যক বিবেচনায় তদনুষ্ঠানে প্রবৃত্তি হইয়াছি বটে; কিন্তু এতদ্দেশবাসী সম্ভ্রান্ত মহাশয়েরা এই মহৎ কার্য্যে সাহায্য না করায় সুতরাং সম্যক্‌ প্রেষিত ব্যক্তিণের আনুকূল্যের উপর নির্ভর করিয়া আমরা সম্পূর্ণ কৃতকার্য্য হইতে পারিতেছি না। এই স্কুলগৃহটী প্রস্তুত করিতে অন্ততঃ চারি হাজার টাকার আবশ্যক। স্কুল-ইন্‌স্পেক্টর শ্রীযুক্ত মাটিন মহোদয় অনুমতি করিয়াছেন অগ্রে স্কুলবাটী প্রস্তুত করিয়া দিলে পশ্চাৎ গবর্ণমেণ্ট দুই হাজার টাকা দিবেন। কিন্তু এক্ষণে এককালীন দানের যেরূপ ফল দেখা যাইতেছে, ইহা সম্যক্ সংগ্রহ হইলেও প্রায় পনর শত টাকা মাত্র সংস্থান হইতে পারে। যদিও আমরা গবর্ণমেণ্টের ভাবী আনুকূল্যের প্রত্যাশায় ঋণের দ্বারায় দুই হাজার টাকা সংগ্রহের উপায় করিয়াছি, কিন্তু এ দিকে ঐ পনর শত ব্যতীত আর প্রতাশা নাই; কাজেই এখন এ কাজটি নির্ব্বাহপক্ষে পাঁচ শত টাকার অনাটন ঘটনা দেখা যাইতেছে। এই সঙ্কল্পিত কার্য্যটী সংসাধিত করিবার পক্ষে আমরা স্বতঃপরত সাহায্যের ত্রুটী করি নাই। কিন্তু ঐ অনটন নিবারণ করা আমাদিগের নিতান্ত সাধ্যাতীত হওয়ায় সুতরাং এক্ষণে একমাত্র ঈশ্বর ব্যতীত উপায়ান্তর উপলব্ধি হইতেছে না, অধুনা অস্মদীয় কামনা এই যে, সেই মহাপুরুষ প্রসন্ননেত্রে এ দেশের প্রতি কটাক্ষ করতঃ উল্লিখিত অনটন বিমোচন করিয়া স্বীয় নাম ও গুণের মাহাত্ম্য প্রকাশ করুন, নিবেদন ইতি।

(স্বাঃ) শ্রীতারিণীচরণ মুখোপাধ্যায় ও শ্রীকেদারনাথ হালদার।

 ইংরেজি-শিক্ষা-বিস্তারে ব্রতী বিদ্যাসাগর মহাশয় এ সাহায্যদানে কি অসম্মত হইতে পারেন? হাত পাতিয়া কেহ ত প্রায় রিক্তহস্তে ফিরিত না; বিশেষ ইংরেজী শিক্ষার প্রসারকল্পে। বিদ্যাসাগর মহাশয়, নিম্নলিখিত পত্র লিখিয়া সাহায্যদানে সম্মতি প্রকাশ করেন,—

সবিনয়ং সবহুমানং নিবেদনম্

 আপনার অনুগ্রহপ্রদর্শনপূর্ব্বক আমায় যে পত্র লিখিয়াছেন তদ্দারা সমস্ত অবগত হইলাম আপনাদিগের উদ্যোগে ঘাটালে যে বিদ্যালয় স্থাপিত হইতেছে উহার গৃহনির্ম্মাণ সম্বন্ধে ৫০০৲ পাঁচ শত টাকার অনাটন আছে আমি স্বতঃপরতঃ তাহা সমাধা করিয়া দিব সে বিষয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকিবেন তজ্জন্য অন্য চেষ্টা দেখিবার আর প্রয়োজন নাই কিন্তু আগামী শারদীয় পূজার পূর্ব্বে এই টাকা আপনাদিগের হস্তগত হইবার সম্ভাবনা অতি অল্প বোধ করি এই বিলম্ব বিশেষ ক্ষতিকর বা অসুবিধাজনক হইবেক না শ্রাবণ মাসের শেষভাগে আমার বাটী যাইবার কামনা আছে। যদি যাওয়া হয় সাক্ষাতে সবিশেষ নিবেদন করিব কিমধিকমিতি
২৪ আষাঢ় ১২৭৫ সাল[২]

অনুগ্রহাকাঙ্ক্ষিণঃ
(স্বাঃ) শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মণঃ।

মাননীয় শ্রীযুক্ত এল এস উরনবুল স্কোয়ার
শ্রীযুক্ত বাবু তারিণীচরণ মুখোপাধ্যায়
শ্রীযুক্ত বাবু কেদারনাথ হালদার
 মহাশয় মদনুগ্রাহকেষু—
 ঘাটাল।

 ইহার পর যখসময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় সাহায্য-দান করিয়াছিলেন।

 ১২৭৫ সালের ৩রা ভাদ্র বা ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দের ১৭ই আগষ্ট পাইকপাড়ার বৃদ্ধ রাণী কাত্যায়নী দেহ ত্যাগ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বারা ইনি কিরূপ উপকার পাইয়াছিলেন, তার পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে।

 ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দের শীতকালে ইন্কম্ ট্যাক্‌সের অসহ্য কর নির্দ্ধারণে প্রপীড়িত হইয়া অনেকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরণাগত হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় সে কথা লেপ্টেনাণ্ট গবর্নরকে বিদিত করেন। তাঁহার অনুরোধে লেপ্টেনাণ্ট গবর্ণর বৰ্দ্ধমানের তদানীন্তন কমিশনর হারিসন সাহেবকে ইনকম্ ট্যাক্‌সের তথ্যানুসন্ধানে নিযুক্ত করেন। তথ্যানুসন্ধানে নির্মীত হয় যে, প্রকৃত পক্ষে অন্যায়রূপে কর নির্দ্ধারিত হইতেছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় দুই মাস কাল অন্য কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া এ তদন্ত-ব্যাপারে ব্যাপৃত ছিলেন। ইহাতে তাঁহার প্রায় তিন সহস্র টাকার ব্যয় হইয়াছিল।

 ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ আখ্যানমঞ্জরী প্রণীত, মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। ইহাতেও বৈদেশিক চরিত্রের সমাবেশ। ভাষা বাঙ্গালী স্কুল-পাঠকের সম্পূর্ণ উপযোগী।

 ১২৭৬ সালের ২০ শে অগ্রহায়ণ বা ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর কলকাতার ছোট আদালতের ভূতপূর্ব্ব জজ হরচন্দ্র ঘোষের মৃত্যু হয়। ইনিও বিদ্যাসাগব মহাশয়ের মত স্ত্রী-শিক্ষা- বিস্তারের সম্পূর্ণ পক্ষপাতী ছিলেন। ১২৭৬ সালের ২১শে পৌষ বা ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারী ৺হরচন্দ্র ঘোষের মৃত্যু জন্য শোকচিহ্ন প্রকাশার্থ একটী সভা হইয়াছিল। তাঁহার স্মরণ-চিহ্ন নির্দ্ধারণার্থ এই সভাতে যে ‘কমিটী’ হয়, বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই কমিটিতে ছিলেন।

  1. He was a warm advocate of widow marriage and assisted the noble cause with money as well as personal labour.
    Hindu Patriot, 27th January, 1868.
  2. শুনিতে পাই, বিদ্যাসাগর মহাশয়, বাঙ্গালায়, প্রভৃতি বিরামচিহ্নের প্রবর্ত্তন করিয়াছিলেন। তাঁহার সকল পুস্তকেই ইহার ব্যবহার দেখিতে পাই; কিন্তু পত্রাদিতে প্রায় দেখা যায় না। এ পত্রেও আদৌ কোন চিহ্ন নাই।