বিদ্যাসাগর/ঊনত্রিংশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

ঊনত্রিংশ অধ্যায়।

ছাপাখানার সত্ত্ব, মনোবেদনা, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা,

বর্দ্ধমানে বিদ্যাসাগর, ঋণের জন্য ঋণ ও

বিধবা-বিবাহে

লাঞ্ছনা।

 একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুত্র নারায়ণ বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বলেন, “বাবা! মেজখুড়ো ছাপাখানার বখরা চাহিতেছেন।” বিদ্যাসাগর মহাশয় শুনিয়া অবাক হইলেন। পরে তিনি মধ্যম ভ্রাতাকে ডাকাইয়া বলিলেন,—“ভাই! শুনিয়াছি, তুমি ছাপাখানার ভাগ চাহিতেছ। ভাল তাহাই হইবে। দেনা পাওনা দেখ, মধ্যস্থ মান।” অতঃপর বিদ্যাসাগর মহাশয় ৺দ্বারকানাথ মিত্রকে এবং দুর্গামোহন দাসকে মধ্যস্থ মানিলেন।

 এ সালিসিতে রাজকৃষ্ণ বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তৃতীয়ানুজ শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং তদীয় পিতৃব্যপুত্র পীতাম্বর বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে সাক্ষী মানা হইয়াছিল। বিদ্যারত্ন মহাশয় এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ষষ্ঠানুজ ঈশানচন্দ্র ছাপাখানার অংশে দাবী করেন নাই। সাক্ষ্য দিতে হইবে বলিয়া বিদ্যারত্ন মহাশয় ন্যায়রত্ন মহাশয়কে ছাপাখানার দাবী পরিত্যাগ করিতে অনুরোধ করেন।[১] ন্যায়রত্ন মহাশয় বিদ্যারত্নের অনুরোধে দাবী পরিত্যাগ করেন। ন্যায়রত্ন মহাশয় যখন ছাপাখানার অংশে দাবী পরিত্যাগ করেন, তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় আপনাকে লইয়া চারি ভাই ও পিতা মাতা এই কয়জনের নামে ছয়ভাগে ছাপাখানার অংশ করিতে চাহিয়াছিলেন। পরে সালিসীতে ধার্য্য হয়, ছাপাখানায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ই সম্পূর্ণ সত্ববান্। এই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তিন ভ্রাতা বিদ্যমান ছিলেন,—দ্বিতীয় দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন, তৃতীয় শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং ষষ্ঠ ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিপূর্ব্বে চতুর্থ, পঞ্চম ও সপ্তম ভ্রাতা ইহলীলা সংবরণ করিয়াছিলেন। ইহার পর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবদ্দশায় ন্যায়রত্ন মহাশয়ের দেহান্তর হয়। ইনি পণ্ডিত ও পরোপকারী ছিলেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় ভ্রাতৃবর্গ ও অন্যান্য আত্মীয়ের সতত শুভ কামনা করিতেন। তাঁহাদের মঙ্গল চেষ্টায় তাঁহার অনেক অর্থ ব্যয় হইত। সকলকেই তিনি সাধ্যানুসারে সন্তুষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেন; কিন্তু তিনি প্রায়ই দীর্ঘশ্বাসে চক্ষের জল ফেলিতে ফেলিতে বলিতেন—“সন্তুষ্ট কাহাকেও করিতে পারিলাম না। আমার কথামালায় যে বৃদ্ধ ও ঘোটকের গল্প আছে, আমি সেই বৃদ্ধ।”

 এই সময় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রীতি ও প্রবৃত্তি জন্মিয়াছিল। ইহার পূর্বে ইনি এই চিকিৎসার উপর বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। ১৮৬৬ সালে বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিদ বেরিণী সাহেব কলিকাতায় আসিয়া হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় প্রবৃত্ত হন। কলিকাতার বহুবাজারনিবাসী ডাক্তার রাজেন্দ্রনাথ দত্তের সহিত বেরিণী সাহেবের বেশ সংপ্রীতি হইয়াছিল। রাজেন্দ্র বাবু ইতিপূর্ব্বে হোমিওপ্যাথিক শিক্ষানুশীলনে কতকটা মনোযোগী হয়াছিলেন। বেরিণী সাহেবের সহায়তায় তিনি এ বিষয়ে সবিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। চিকিৎসাতেও তাঁহার যথেষ্ট প্রতিপত্তি হইয়াছিল। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসামতে রাজেন্দ্র বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শিরঃপীড়া আরাম করিয়াছিলেন। রাজেন্দ্র বাবুর হোমিওপ্যাথিক ঔষধসেবনে রাজকৃষ্ণু বাবু নিদারুণ মলকৃচ্ছতা পীড়া হইতে আরোগ্য লাভ করিয়াছিলেন। রাজকৃষ্ণ বাবুকে মলত্যাগ করিবার সময় ফিচকারী ব্যবহার করিতে হইত। ফিচকারী ব্যবহারে কঠোর মল অতিকষ্টে নির্গত হইত; এবং তাঁহার দুই জানুদ্বয় রক্তস্রাবে ভাসিয়া যাইত। এ হেন রোগ কেবল হোমিওপ্যাথিকের বিন্দুপানে আরাম হইল দেখিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় বিস্মিত হইয়াছিলেন। অতঃপর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিষয়ে তিনি সবিশেষ মনঃসংযোগ করেন। ইহাতে কতকটা ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়া তিনি অনেকের চিকিৎসা করিতেন। তাঁহার পরামর্শে তদীয় মধ্যম ভ্রাতা দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন মহাশয় একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হইয়াছিলেন। বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার মহেন্দ্রনাথ সরকার মহাশয় তখন এলোপ্যাথিক মতে চিকিৎসা করিতেন। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার উপর তাঁহার বিষম বিদ্বেষ ছিল। তিনি প্রায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার নিন্দা করিতেন। একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয় এবং মহেন্দ্র বাবু হাইকোর্টের জজ পীড়িত অনারেবল দ্বারকানাথ মিত্রকে দেখিতে গিয়াছিলেন। প্রত্যাবর্তনের সময় গাড়ীতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সম্বন্ধে মহেন্দ্র বাবুর ঘোরতর বাদানুবাদ হইয়াছিল। শেষে মহেন্দ্র বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথা শিরোধার্য্য করিয়া বলেন,—“আমি এক্ষণে আর হোমিওপ্যাথির নিন্দা করিব না; তবে পরীক্ষা করিয়া দেখিব, ইহার কি গুণ।” পরীক্ষায় তিনি হোমিওপ্যাথির পক্ষপাতী হইয়াছিলেন। ক্রমে অল্প দিনের মধ্যে ঐ চিকিৎসায় তিনি যশস্বী হইয়া উঠেন। তাঁহার যশঃপ্রভায় বেরিণীর প্রতিপত্তি কমিয়া গিয়াছিল। এ দেশের লোক প্রায় বেরিণীকে না ডাকিয়া মহেন্দ্র বাবুকেই ডাকিতেন। মহেন্দ্র বাবুরই উপর সকলের বিশ্বাস জন্মিয়াছিল। ১৮৬৯ সালে বেরিণী সাহেবকে শূন্য পকেটে ঘরে ফিরিয়া যাইতে হইয়াছিল। তাঁহাকে বিদায় দিবার সময় ডাক্তার রাজেন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন,—“কত সাহেব এ দেশে আসিয়া ফিরিয়া যাইবার সময পকেট ভরিয়া টাকা লইয়া যান, আপনি কিন্তু রিক্ত পকেটে ফিরিতেছেন।” এতদুত্তরে বেরিণী সাহেব বলিয়াছিলেন,—

 “আমি পাঁচ হাজার টাকা পকেটে পূরিয়া লইয়া যাইতেছি।”

 রাজেন্দ্র বাবু বিস্মিত হইয়া বলিলেন,—“সে কিরূপ?”

 উত্তর হইল—

 “মহেন্দ্র যে হোমিওপ্যাথিকের পক্ষপাতী হইয়াছে, ইহারই মূল্য পাঁচ সহস্র টাকা।”

 এই সময় গোবরডাঙ্গার জমিদার ৺সরদাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, উত্তরপাড়ার জমীদার ৺জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এবং কলিকাতার ঝামাপুকুরনিবাসী রাজা দিগম্বর মিত্র হোমিওপ্যাথিকের পক্ষপাতী ছিলেন।

 ইহার ৬।৭ বৎসর পরে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কনিষ্ঠ কন্যার অতি উৎকট পীড়া হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় আরাম হইয়াছিল। এলোপ্যাথিক চিকিৎসা হার মানিয়াছিল। ইহাতে হোমিওপ্যাথিকের উপর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অধিকতর ভক্তি হইয়াছিল। তিনি এই সময় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা-বিদ্যা শিক্ষা করিবার জন্য পুর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর যত্নশীল হন। শববিচ্ছেদ শিক্ষা ভিন্ন চিকিৎসাবিদ্যা ব্যর্থ হয় বলিয়া, তিনি কতকগুলি নরকঙ্কাল ক্রয় করিয়াছিলেন। সুকিয়া স্ট্রীটনিবাসী ডাক্তার চন্দ্রমোহন ঘোষ তাঁহাকে এতদ্বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় পরে এই সব নরকঙ্কাল রাজকৃষ্ণ বাবুর পুত্রকে দিয়াছিলেন। এই সময় তিনি বহুসংখ্যক হোমিওপ্যাথিক পুস্তক ক্রয় করিয়াছিলেন। এই সব পুস্তক তাঁহার লাইব্রেরীতে আছে। এই লাইব্রেরীতে হোমিওপ্যাথিক পুস্তক ব্যতীত প্রায় লক্ষাধিক টাকার অন্য পুস্তক আছে। তেমন সুন্দর বিলাতী বাঁধান পুস্তক আর কোন পুস্তকালয়ে আছে কি না সন্দেহ। পুস্তকালয় তাঁহার জীবনাবলম্বন বলিলেও বোধ হয় অত্যুক্তি হয় না। অধ্যয়ন তাঁহার জীবনের ব্রত ছিল। এক মুহূর্ত তিনি পুস্তক ব্যতীত থাকিতেন না। এমন কি একবার তাঁহার প্রিয়পাত্র স্নেহভাজন শ্রীযুক্ত নীলাম্বর মুখোপাধ্যায় মহাশয় ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখিবেন বলিয়া তাঁহার নিকট হইতে কতকগুলি পুস্তক চাহেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে লাইব্রেরীর পুস্তক না দিয়া নূতন পুস্তক কিনিয়া আনিয়া দেন।[২] একবার তাঁহার একটী ধনাঢ্য বন্ধু লাইব্রেরীর বাঁধান পুস্তক দেখিয়া বলিয়াছিলেন, —“আপনি পাগল। এত টাকা খরচ করিয়া বিলাত হইতে এ সব পুস্তক বাঁধাইয়া আনিয়া রাখিবার প্রয়োজন কি?” বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহার উত্তরে বলেন,—“এক গাছি দড়ি দিয়া আপন ঘড়িটী বাঁধিয়া রাখিতে পারেন; তবে এত টাকার সোনার চেইনের প্রয়োজন কি? কম্বল গায়ে দিতে পারেন; শাল গায়ে দিয়েছেন কেন? পাগল আপনিও ত।”

 উত্তরপাড়ায় পড়িয়া যাইবার পর স্বাস্থ্যলাভার্থ বিদ্যাসাগর মহাশয় ফরাশডাঙ্গায় যাত্রা করেন। সেখানে কিন্তু সুবিধা না হওয়ায় তাঁহাকে বর্দ্ধমানে যাইতে হয়। বর্দ্ধমানে যাইয়া তিনি পরম মিত্র প্যারিচাঁদ মিত্রের বাড়ীতে থাকিতেন। প্যারিচাঁদ মিত্র জজ আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন।[৩] প্রণয়-সদ্ভাবে বিদ্যাসাগর মহাশয় ও প্যারিচাঁদ বাবু হরি-হর-আত্মা। উভয়েই যেন এক পরিবারভুক্ত। বর্দ্ধমানেও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দান ও দয়ার কার্য্য অবিশ্রান্তভাবে চলিত। তাঁহার নাম শুনিলে অনেক দীন-দরিদ্র তাঁহার নিকট আগমন করিত। তিনি যাহার যেরূপ অভাব বুঝিতেন, তাহাকে সেইরূপ দান করিতেন। দানে তাঁহার জাতিবিচার ছিল না। অনেক দরিদ্র মুসলমান তাঁহার নিকট সাহায্য পাইয়া গুরুতর দায় হইতে মুক্ত হইত। বর্দ্ধমান হইতে বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রায় বীরসিংহ গ্রামে যাতায়াত করিতেন। সেই সময় যত দীন-দরিদ্র বালক, তাঁহার পাল্কী ধরিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইত। তিনি কাহাকেও মিঠাই, কাহাকেও পয়সা, আর কাহাকেও বস্ত্র দান করিতেন। দয়ালু বিদ্যাসাগর যাইতেছেন শুনিলে, সাহায্য-কামনা না থাকিলেও তাঁহাকে একবার দেখিবার জন্য শত শত লোক উদ্‌গ্রীব হইয়া থাকিত।

 ঋণ-পরিশোধ একান্ত প্রয়োজনীয় হইয়াছিল। হিন্দু পেট্‌রিয়টে বিদ্যাসাগর মহাশয়, যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতে প্রকাশ পায়, তাঁহার দেনা ২০।২২ হাজার টাকা। দেনা হইয়াছিল, প্রকৃত অর্দ্ধলক্ষাধিক টাকা। পত্র লিখিবার পূর্ব্বে বিদ্যাসাগর মহাশয় অনেক দেনা শুধিয়াছিলেন।[৪] এক্ষণে অবশিষ্ট ঋণ-পরিশোধের গত্যন্তর না দেখিয়া, তিনি মুরশিদাবাদের মহারাণী স্বর্ণময়ীর সরকার হইতে ঋণ চাহিয়া পাঠাইয়াছিলেন। মহারাণীর পরিবারের সহিত ইতিপূর্ব্বে তাঁহার বেশ ঘনিষ্ঠতা হইয়াছিল। এ কথা পূর্ব্বে প্রকাশিত হইয়াছে। মহারাণী মধ্যে মধ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আবশ্যকমত টাকা ধার দিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও যথাসময়ে পরিশোধ করিতেন। ১২৮৬ সালের ২০শে কার্তিক বা ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দের ৪ঠা নবেম্বর বিদ্যাসাগর মহাশয় নিম্নলিখিত পত্র লিখিয়া মহারাণীর সরকার হইতে টাকা ধার চাহিয়াছিলেন,—

 শুভাশিযঃসন্তু—
 সাদরসম্ভাষণমাদনম্—
 আপনি অবগত আছেন বিধবা বিবাহ কার্য্যোপলক্ষে আমি বিলক্ষণ ঋণগ্রস্ত হইয়াছি ঐ ঋণের ক্রমে পরিশোধ করিতেছি। দুই ব্যক্তির নিকট কিছু অধিক ঋণ আছে তাঁহারা ক্রমে লইতে সম্মত নহেন এককালে টাকা পাইবার জন্য ব্যস্ত করিতেছেন এককালে তাঁহাদের ঋণ পরিশোধ করি তাহার সুযোগ নাই। কিন্তু তাহা না করিলেও কোন ক্রমে চলিতেছে না। উপায়ান্তর না দেখিয়া অবশেষে শ্রীমতী রাণী মহোদয়ার নিকট প্রার্থনা করিতেছি। তিনি দয়া করিয়া আমাকে ৭৫০০ সাত হাজার পাঁচশত টাকা ধার দেন। একখানি হ্যাণ্ডনোট লিখিয়া দিব এবং তিন বৎসরে পরিশোধ করিব। এই ঋণ নিয়মিত সময়ে পরিশোধ করিতে পারিব সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সন্দেহ নাই; সন্দেহ থাকিলে কখন আমি এরূপে ধার চাহিতাম না। আপনার সহাষ্য ব্যতিরেকে আমার এই প্রার্থনা সফল হইবার সম্ভাবনা নাই। আপনি অসন্দিগ্ধচিত্তে সহায়তা করিবেন। এই সহায়তা করিয়া আপনাকে কখনও অপ্রস্তুত হইতে হইবেক না; আমি এত অসম্ভ্রান্ত ও অপদার্থ লোক নহি যে পরিশোধ করিবার সম্ভাবনা নাই, তথাপি ঋণ করিতেছি অথচ পরিশোধ বিষয়ে অযত্ন করিব কিংবা নিশ্চিন্ত থাকিব আপনি এক মুহূর্তের জন্যও এরূপ অশঙ্কা করিবেন না। রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ যতদিন জীবিত ও সহজ অবস্থায় ছিলেন, তাঁহার নিকট মধ্যে মধ্যে এইরূপ ধার পাইতাম এবং ক্রমে ক্রমে পরিশোধ করিতাম। এক্ষণে এখানকার কোন ধনীর সহিত আমার এরূপ আত্মীয়তা নাই যে টাকা ধার চাহিতে পারি। আপনি না থাকিলে শ্রীমতী রাণী মহোদয়ার নিকটে ধার চাহিতে পারিতাম না। এক্ষণে যাহাতে আমার প্রার্থনা সফল হয় দয়া করিয়া তাহা করিতে হইবেক। না করিলে আমি অপমানিত ও অপদস্থ হইব এই বিবেচনায় যাহা উচিত তাহা করিবেন। অত্যন্ত অসুবিধায় না পড়িলে আমি কদাচ শ্রীমতীকে ও আপনাকে এরূপে বিবক্ত করিতে উদ্যত হইতাম না জানিবেন; অগ্রহায়ণ মাসে আমার টাকার প্রয়োজন। এই টাকা ধার করিয়া দিলে আর পূর্ব্ববৎ বার্ষিক সাহায্য করিতে হইবে না। শ্রীমতী আমার যথেষ্ট উপকার করিয়াছেন। ঐ সকল উপকার আমার অন্তঃকরণে নিরন্তর জাগরূক রহিয়াছে। আমি যে তাঁহার যথার্থ গুণগ্রাহী ও আশীর্ব্বাদক অনতিবিলম্বে তাহার পরিচয় দিব।

 আমি এক্ষণে কিছু ভাল আছি। আপনার নিজের ও রাজধানীর সর্বাঙ্গীন মঙ্গল সংবাদ দ্বারা পরিতৃপ্ত করিতে আজ্ঞা হয়। কিমধিকমিতি ২০শে কার্তিক ১২৭৬ সাল।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় এই পত্র লিখিয়া টাকা পাইয়াছিলেন এবং যথাসময়ে তাহার পরিশোধ করিয়াছিলেন।

 কেবল মহারাণী স্বর্ণময়ীর নিকট হইতে কেন, আরও অন্যান্য অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির নিকট হইতেও ঋণ করিতে হইয়াছিল। পাইকপাড়ার রাজপরিবারের কোন স্ত্রীলোকের নিকট হইতে বিদ্যাসাগর মহাশয় ২৫০০০৲ টাকা ঋণ লইয়া ছিলেন। ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে চকদীঘির উইল সংক্রান্ত মোকদ্দমায় বিদ্যাসাগর মহাশয় যে সাক্ষ্য দিয়াছিলেন, তিনি তাহাতে এই কথা স্বীকার করিয়াছেন।

 মফঃস্বলে বিধবা বিবাহ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জন্য ব্যয় অধিক হইত। সেই জন্য ঋণটা বেশী হইয়াছিল। হিন্দু-পেট্রিয়টে বিদ্যাসাগর মহাশয় এ কথা লিখিয়াছিলেন। কেবল অর্থব্যয় নহে; প্রকৃতই মফস্বলের জন্য তাঁহাকে নানাপ্রকারে ব্যাতি ব্যস্ত হইতে হইত। মফস্বলে বিধবা বিবাহের পক্ষপাতীদিগের তাড়না ও লাঞ্ছনার সীমা ছিল না। জাহানাবাদ মহকুমার চন্দ্রকোণা থানার অন্তবর্ত্তী কুমারগঞ্জে বিধবা-বিবাহের পক্ষ ও বিপক্ষদের এক সময় খুব সংঘর্ষণ চলিয়াছিল। এতৎসম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বহস্তে ইংরেজীতে এক বিস্তৃত বিবরণ লিখিয়াছিলেন। তাহার মর্ম্ম এই,—

 “কুমারগঞ্জে বিধবা-বিবাহের, পক্ষপাতী দলকে চড়ক পূজায় শিবের মন্দিরে প্রবেশ করিতে দেওয়া হয় নাই। এতৎসম্বন্ধে পক্ষপাতীদের পক্ষ হইতে জাহানাবাদের ডিপুটী মাজিষ্টরকে আবেদন করা হইয়াছিল। তিনি তদন্তের হুকুম দেন। তদন্ত হইয়াছিল, উৎসব সাঙ্গ হইবার পর। জমীদার বিধবাবিবাহে পক্ষপাতীদিগকে প্রহার করিয়া জরিমানা আদায় করিয়াছিলেন। অনেকেই সপরিবারে গ্রাম ত্যাগ করে। পুলিসে সংবাদ দিলেও, পুলিশ তদন্তে ঔদাসীন্য প্রকাশ করিতেন।

 এই ঘটনায় বিদ্যাসাগর মহাশয় স্পষ্টতঃই লিখিয়াছিলেন,—

 “যদি উৎপীড়ন নিবারণ না হয়, যদি অত্যাচারী দণ্ডিত না হয়, তাহা হইলে আমার এ পৃথিবীতে থাকিবার প্রয়োজন নাই। তাহা হইলে আমার জীবন-ব্রতের উদ্যাপন হিবে কিসে? এ ব্রতসাধনেই তো আমি আত্মসমর্পণ করিয়াছি। যদি ব্রত সিদ্ধ না হইল, তাহা হইলে জীবন বৃথা।”

  1. ৺শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন প্রণীত ‘প্রেমনিবাস’ নামক পুস্তকে এই কথার উল্লেখ আছে।
  2. এই কথাটী ডাক্তার ৺অমূল্যচরণ বসু মহাশয়ের নিকট শুনিয়াছি।
  3. প্যারিচাঁদ বাবু কলিকাতা-পটলডাঙ্গায় শ্যামাচরণ দে মহাশয়ের ভগিনীপতি ছিলেন। শ্যামাচরণ বাবুর ভগিনী অকালে প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন। প্যারী বাবুকে দ্বিতীয় বার দারপরিগ্রহ করিতে হয়। প্রথম পত্নী গত হইলেও প্যারী বাবু শ্যামাচরণ বাবুর সহিত পূর্ব্ববৎ সুদ্ভাব রাখিয়াছিলেন। প্যারী বাবুর দ্বিতীয় পত্নীও শ্যামাচরশ বাবুকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মত মনে করিতেন। শ্যামাচরণ বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হৃদয়-বন্ধু। এই সূত্রে প্যারী বাবুর সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধুত্ব হয়।
  4. শ্রীযুক্ত শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন এ কথা বলিয়াছেন।