বিদ্যাসাগর/তৃতীয় অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে




তৃতীয় অধ্যায়

সংস্কৃত কলেজে ভর্ত্তি, সংস্কৃত কলেজের উদ্দেশ্য ও প্রতিষ্ঠা,
 তাৎকালিক শিক্ষার অবস্থা, ভবিষ্যৎ আভাস, ব্যাকরণ-
শিক্ষা, কলেজের অধ্যাপক, বেতন-ব্যবস্থার ফল,
 পিতার শাসন, ব্যাকরণে প্রতিপত্তি ও পুরস্কার,
একগুঁয়েমি , অধ্যয়ন ও অধ্যবসায, কাব্যের
 শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠা, দাবিদ্র্য-কঠোরতা
এবং ব্যাকরণ ও কাব্য
শিক্ষার ফল।

 ১২৩৬ সালে ২০শে জ্যৈষ্ঠ বা ১৮২৯ খৃষ্টাব্দে ১লা জুন সোমবার ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে ভর্ত্তি হন।

 ঈশ্বরচন্দ্র যখন সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করেন, তখন সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত শিক্ষারই প্রচলন ছিল। ইংরেজি শিক্ষার অতি সামানন্য মাত্র স্বতন্ত্র ব্যবস্থা ছিল। তখনকার সংস্কৃতাধ্যাণী ছাত্রগণ ইংরেজি পড়িতে বাধ্য ছিলেন না। কেহ ইচ্ছা করিলে ইংরেজি পড়িতেন মাত্র।

 সংস্কৃত কলেজে প্রথমে যে শিক্ষাপ্রণালী প্রবর্তিত হইয়াছিল, তাহার আলোচনা করিলে আদৌ মনে হয় না, সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি শিক্ষা চালাইবার কর্তৃপক্ষের কোনরূপ সঙ্কল্প ছিল। তখন কেবল দ্বিজসস্তানেরই সংস্কৃত কলেজে প্রবেশাধিকার ছিল। তাহারা ঘরের মেজের বিছানার উপর বসিয়া টোলের ধরণে অধ্যয়ন করিতেন; আর অধ্যাপকগণ স্বতন্ত্র আসনে, বসিয়া তাকিয়। ঠেসান দিয়া অধ্যাপনা করিতেন।

 কর্তৃপক্ষের অন্তরের উদ্দ্যেশ্য হউক বা না হউক, আমাদিগের দুরদৃষ্টে সে শিক্ষাপ্রণালী সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। সেই পরিবর্তনের সুত্রপাত বিদ্যাসাগরের পাঠ্যাবস্থায়; পরিপুষ্ট তাঁহার কার্য্যাবস্থায়।

 ১৮২৪ খৃষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কলেজের প্রতিষ্ঠা-প্রস্তাবে রাজা রামমোহন রায়-প্রমুখ বঙ্গের তাৎকালিক অনেক শক্তিশালী মনীষী ব্যক্তি আপত্তি তুলিয়াছিলেন।

  রাজা রামমোহন রায় সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা-কল্পে প্রকৃতপক্ষে মনস্তাপ পাইয়াছিলেন। ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে যে শিক্ষাকমিশনের অধিবেশন হইয়াছিল, তাহার রিপোর্টে রামমোহন রায়ের সে মনস্তাপের পরিচয় পাওয়া যায়। বিপোর্টে এইরূপ লেখা আছে;—

 “Ram Mohan Ray, the ablest representative of the more advanced members of the Hindu community, expressed deep disappointment, or the part of himself and his countrymen at the resolution of Government to establish a new Sanskrit College instead of a seminary designed to impart instruction in the Arts; Sciences and Philosophy of Europe.”

 রাজা রামমোহন রায় বলিয়ছিলেন -টোলে যেরূপ সংস্কৃত শিক্ষা হইতেছে, তাহাউ হউক; বরং তাহার উৎকর্ষসাধনের ব্যবস্থা হউক; কিন্তু সংস্কৃত শিখাইবার জন্য স্বতন্ত্র কলেজের প্রয়োজন নাই। যাহাতে পাশ্চাত্য সাহিত্য, বিজ্ঞানপ্রভৃতির শিক্ষাপ্রসারের জন্য স্বতন্ত্র কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, তদর্থে কর্ত্তৃপক্ষের যত্নশীল হওয়া কর্ত্তব্য। টোলের শিক্ষা অব্যাহত রাখিবার পরামর্শ দেওয়া সাধু কল্পনা সন্দেহ নাই; তবে পাশ্চাত্যশিক্ষাপ্রসারের পরামর্শ দিয়া তিনি ভবিষ্যদ্দর্শিতার পরিচয় দেন নাই। তাৎকালিক ইংরেজী শিক্ষার ফলাফল আলোচনা করিলে আমাদের এ কথার সার্থকতা হৃদয়ঙ্গম হইবে।

 হিন্দু কলেজের প্রসাদে তখন কলিকাতা সহরে উচ্ছৃঙ্খল ইংরেজী শিক্ষার আবর্তে পড়িয়া অনেক হিন্দুসন্তান বিপথগামী ও সমাজদ্রোহী হইয়া পড়িয়াছিলেন। আকস্মিক ইংরেজী শিক্ষার প্রবাহ হিন্দুসমাজকে তখন অনেকটা উদ্বেলিত করিয়াছিল। সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হইবার সাত বৎসর পূর্ব্বে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।

 ঈশ্বরচন্দ্র যখন সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করেন, তখন হিন্দু কলেজের অনেক ছাত্র বিজাতীয় বিদেশীয় শিক্ষকের বিজাতীয় শিক্ষাভাব-প্রণোদনে এবং ইংরেজী শিক্ষার বিষময় ফলে বিজাতীয় ভাবাপন্ন হুইয়। হিন্দুসমাজে একটা বিষম বিপ্লব ঘটাইবার উপক্রম করিয়াছিলেন। তাহাদের পূর্ব্বে যাঁহার কলেজের শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া সংসারক্ষেত্রে বিচরণ করিতেছিলেন, তাঁঁহাদের অনেকের অসদাদর্শে হিন্দু কলেজের তৎকালিক অনেক ছাত্রের মতি-গতি বিকৃত হইয়াছিল। প্রসিদ্ধ অধ্যাপক রাজনারায়ণ বসু হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি স্বরচিত চরিতে যে আত্মকথা লিখিয়াছেন, তাহা আমাদের এই মন্তব্যের একটী প্রমাণ হইবে। তিনি লিখিয়াছেন—

 “তখন হিন্দু কলেজেব ছাত্রেরা মনে করিতেন যে, মদ্যপান করা সভ্যতার চিহ্ন, উহাতে দোষ নাই। * * তাঁহারা কথনই পানাসক্ত হইতেন না, যদ্যপি তাহা সভ্যতার চিহ্ন মনে না করিতেন। আমাদিগের বাসা তখন পটলডাঙ্গায় ছিল। আমি * *  *  *  প্রভৃতির সহিত কলেজের গোলদীঘিতে মদ খাইতাম এবং এখন যেখানে সেনেট হাউস হইয়াছে, সেখানে কতকগুলি শিক কাবাবের দোকান ছিল, তথ। হইতে গোলদীঘিব বেল টপকাইয়া, ফটক দিয়া বাহির হইবার বিলম্ব সহিত না, উক্ত কাবাব কিনিয়া আনিয়া আমরা আহার করিতাম। আমি ও আমার সহচরেরা এইরূপ মাংস ও জলস্পর্শশুন্য ব্রাণ্ডি খাওয়া সভ্যতা ও সমাজ-সংস্কারের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শক কার্য্য মনে করিতাম। একদা আমি গোলদীঘিতে মদ খাইয়। টুপভূজঙ্গ হইয়া রাত্রিতে বাটীতে আসিলে, মাতাঠাকুরাণী অতিশয় বিরক্ত হইয় বলেন,—“আমি আর কলিকাতার বাসায় থাকিব না, বোড়ালে গিয়া থাকিব।” পিতাঠাকুর আমার আচরণের বিষয় অবগত হই। আমাকে পরিমিত ম্যপায়ী করিবার জন্য একটা কৌশল অবলম্বন করিলেন। * * সেকালে মুন্সি আমীর আলী সদর দেওয়ানী আদালতে একজন প্রধান উকীল ছিলেন। * * পিতাঠাকুরের সহিত মুন্সি আমীর আলীর অন্তরিক বন্ধুতা জন্মিায়াছিল। মুন্সি সাহেব আমার পিতাঠাকুরকে রাজদার দোস্ত' বলিতেন। যে বন্ধুকে গোপনীয় কথা বলা যাইতে পারে, পার্শিতে তাহাকে রাজদার দোস্ত বলে। প্রতিদিন মুন্সি আমীর আলীর বাটী হইতে আমাদিগের বাসায় একটী টিনের বাক্স অসিত। আমি মনে করিতাম যে, মুন্সি আমীর আলী পিতাঠাকুরকে তরজমার জনয় সদর দেওয়নীর কাগজপত্র পাঠাইয়া দিয়া থাকেন। * * এক দিন সন্ধ্যার পর আমাকে পিতাঠাকুর তাঁহার লিখিবার ঘরে ডাকিলেন। ডাকিয়া ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। আমি বুঝিতে পারিলাম না যে ব্যাপারটা কি? তাহার পর দেখিলাম, তিনি একটী দেরাজ খুলিয়া একটি কর্কস্ক্রুপ ও একটি সেরীর বোতল ও একটি গুয়াইন গ্লাস বাহির করিলেন। তৎপরে প্রকাণ্ড টিনের বাক্স খোলা হইলে আমি দেখিলাম যে, তাহাতে সদর দেওয়ানীর কাগজ নাই, পোলাও, কোপ্তা রহিয়াছে। পিতাঠাকুর আমাকে বলিলেন,—“তুমি প্রত্যহ সন্ধ্যার পর আমার সঙ্গে এই সকল দ্রব্য আহার করিবে; কিন্তু সেরী মদ দুই গ্লাসের অধিক পাইরে না; যখনই শুনিব, অন্যত্র মদ খাও, সেই দিন অবধি এই খাওয়া বন্ধ করিয়া দিব। কিন্তু আমি এইরূপ পরিমিত পানে সন্তুষ্ট হইতাম না। অন্যত্র পান করিতাম। এইরূপ অপরিমিত মদ্যপানে আমার একটি পীড়া জন্মিল।”

 হিন্দু কলেজে পড়িয়া অনেক হিন্দুসন্তান পাশ্চাত্য সাহিত্য বিজ্ঞানে পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন সন্দেহ নাই, কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষায় তাহদের অনেকের কিরূপ মতিগতি ঘটিয়াছিল, তাৎকালিক অধ্যাপক হোরেশ হেমান উইলসন সাহেবের রিপোর্টে তাহা প্রকাশ পাইয়াছে। তাঁহার কথা এইখানে উদ্ধৃত করিলাম;–

 “An impatience of the restrictions of Hinduism and a disregard of its ceremonies are openly avowed by many young men of respectable birth and talents,” Report of the India Education Commission, P. 257.

 উহার তো ইহাই ভাবার্থ,—অনেক ভদ্রবংশজাত এবং বুদ্ধিমান হিন্দুসস্তান প্রস্কাশ্যভাবে স্বধর্ম্মে আস্থাশূন্য হইয়াছিলেন।অতঃপর পাঠকের বোধ হয়,আর কোনও সন্দেহ রহিল না।

 তাৎকালিক অনেক ইংরেজি-শিক্ষিত হিন্দুসন্তান ইংরেজের গুণানুকরণে অক্ষম হইয়া দোষাবলীর সম্পূর্ণ অনুকরণ করিয়া বসিয়াছিলেন। ইংরেজ রাজা; ইংরেজ জগতে প্রভূত শক্তিশালী, ইংরেজ সমুন্নত সভ্যজাতি বলিয়া সমগ্র পৃথিবীতে পরিগণিত। সত্য ইংরেজ যাহা যাহা করিয়া থাকেন,তদানীন্তন ইংরেজি-শিক্ষিত অনেক কৃতী ব্যক্তি তাহা সভ্যতানুমোদিত বলিয়া মনে করিয়াছিলেন।

 প্রকৃত গুণের অনুকরণ বড় সোজা কথা নহে। গুণানুকরণ তাঁহাদের সাধ্যাতীত হইয়াছিল। যাহা সহজসাধ্য এবং অকষ্টকল্প, তাহাই তাঁহাদের অনুকরণীয় হইল। ইংরেজ গরু খান, ইংরেজ মদ খান, ইংরেজ ক কোটপেণ্টুলেন পরেন, ইংরেজ ঘাড়ের চুল ছাঁটিয়া মস্তকের সন্মুখ ভাগে লম্বা লম্বা চুল বাখেন। এই সব অনায়াসসাধ্য কার্য্যগুলিকে সভ্যতার অঙ্গ ভাবিয়া অনেক ইংরেজিশিক্ষিত হিন্দুসন্তান তদনুকরণে পূর্ণমাত্রায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। এমন কি তখন হিন্দু কলেজের অনেক ছাত্র, কলেজের সম্মুখে, গোলদীঘির অনাবৃত প্রাঙ্গণে বসিয়া সুরাপান করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। অনেকে গোমাংস ভক্ষণ করিয়া ভূক্তবিশেষ অস্থিমাংস প্রতিবেশী গৃহস্থের বাড়ীতে নিক্ষেপ করিয়া পরম আনন্দ অনুভব করিতেন। তাঁহারা ভাবিতেন, এরূপ না করিলে, ইহাদের বর্ব্বরতার কলঙ্ক অপনীত হইবে না।

 ইংরেজি শিক্ষার এতাদৃশ বিষময় ফল-সন্দর্শনে সমগ্র হিন্দু-সমাজ সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। এক হিন্দু কলেজে রক্ষা ছিল না, তাহার উপর সংস্কৃত কলেজটা ইংরেজী কলেজ হইলে, বোধ হয় ঘরে ঘরে নরক-দৃশ্য দেখিতে হইত। সে সময় সংস্কৃত কলেজ ইংরেজী কলেজের অনুকরণে গঠিত হইলেও, সংস্কৃত শিক্ষার প্রচলন থাকায় উহা হিন্দু-সন্তান ব্রাহ্মণগণের তবুও কতক আশ্রয়স্থল হইয়াছিল।

  তদানীন্তন ইংরেজী শিক্ষার কুফলসন্দর্শনে ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা, বোধ হয় ঈশ্বরচন্দ্রকে সংস্কৃত কলেজে প্রেরণ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র ইংরেজী পড়িয়া, তদানীন্তন ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের ন্যায় বিকৃত হইয়া না পড়েন, ইহাই ঠাকুরদাসের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ঠাকুরদাস মনে মনে এই উচ্চাকাঙ্খা পোষণ কলিতেন যে, বংশের সকলে যেমন অধ্যাপকমণ্ডলীর মধ্যে অগ্রণী হইয়া আসিতেছেন, দারিদ্র্যনিবন্ধন তিনি নিজে সেই সুখে বঞ্চিত হইলে ও যদি তাঁহার পুত্র সেই প্রকার অধ্যাপকমণ্ডলীল শীর্ষ স্থান অধিকার করিতে পারেন, তাহা হইলে তাঁহার পক্ষে পরম গৌরবের বিষয় হইবে। সুতরাং পুর্ব্ব হইতেই তিনি ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত শিক্ষা করিয়া যাহাতে স্বীয় বাটীতে চতুস্পষ্ঠী স্থাপনপূর্বক নানাস্থানের বালককে সংস্কৃত বিদ্যা দান দ্বারা যশস্বী হইতে পারেন, তজ্জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন; সুতরাং স্বজনগণের পরামর্শমতে তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে ইংরেজী শিক্ষায় ব্রতী করিতে রাজী হইলেন না। তিনি পুত্রকে সংস্কত কলেজে ভর্ত্তি করিয়া দিলেন। গদাধর তর্কবাগীশ মহাশয় সেই সময়ে সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করিতেন। তিনিও ঈশ্বরচন্দ্রকে সংস্কৃত কলেজে ভর্ত্তি করাইবার জন্য ঠাকুরদাসকে বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করিয়াছিলেন।

 ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে শিক্ষিত হইলেও, ইংরেজী শিক্ষার ব্যুহবেষ্টনে আবদ্ধ ছিলেন। এক দিকে হিন্দু কলেজের উন্মদিনী শিক্ষা, অপর দিকে মিশনরী কলেজের মোহিনী মায়া; তদুপরি শক্তিশালী সাহেব সিবিলিয়নদের গাঢ় ঘনিষ্ঠতা। যে বৎসর ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করেন, তাহার পর বৎসরে পাদরী ডফ সাহেবের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৭ খৃষ্টাব্দে খৃষ্টানী স্কুল “বিসস্প কলেজ” প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। ইংরেজী শিক্ষার অপ্রতিহত ঘাত প্রতিঘাতে হৃদয়বান, মনস্বী ও তেজস্ব ঈশ্বরচন্দ্র ও বিচলিত হইয়াছিলেন। অবিমিশ্র সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করিয়া ও ঈশ্বরচন্দ্র ভাবিছিলেন, ইংরেজ না শিখিলে বর্ত্তমান যুগে সংসারের শ্রীবৃদ্ধিসাধন দুঃসাধ্য। তাই তিনিও সংস্কৃতপাঠসমাপনান্তে কার্যাবস্থায় ইংরেজী শিক্ষায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। যখন ফোট উইলিয়ম কলেজে কাজ করেন, তখন ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতিভাদর্শনে প্রীত হইয়া অধ্যক্ষ মেজর মার্শেল সাহেব বলেন, ঈশ্বরচন্দ্র, তুমি ইংরেজী পড়িতে আরম্ভ কর। তাহাতে তুমি জগতে বিশেষ যশস্বী হইবে। তাহার পর বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথমতঃ ডাঃ নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের নিকট ইংরেজী শিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন, তাহার পর ডাঃ দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (বিখ্যাত বাগী শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় মহাশয়ের পিতা) মহাশয়ের নিকট শিক্ষা লাভ করেন; পরে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য শিক্ষক নিযুক্ত করিয়া তিনি ইংরেজী ভাষায় বিশেষ বুৎপন্ন হইয়াছিলেন।

 সংস্কৃত শিক্ষার ফলেই হউক,আর তাঁহার অলৌকিক দৃঢ়চিত্ততা ও আত্মসম্মানবোধের জন্য হউক, তিনি সর্ব্বতোভাবে দেশীয় ভাব সংরক্ষণে সমর্থ হইয়াছিলেন এবং ইংরেজী শিক্ষার তাৎকালীন ফল কতকটা তাঁহাতেও সংক্রমিত হইয়াছিল কি না, সে সম্বন্ধে তাঁহার ভবিষ্যৎ কার্যাবলি হইতে যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যাইবে।

 ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণ শ্রেণীর তৃতীয় বিভাগে ভর্ত্তি হইয়া সন্ধিসুত্র পাঠ করেন।

 সংস্কৃত ব্যাকরণ-শিক্ষা, সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার সম্পূর্ণ সাহায্যকারিণী। এই জন্য ভারতে চিরকাল সংস্কৃতশিক্ষার্থীদিগকে সর্ব্বাগ্রে কয়েক বৎসর ধরিয়া ব্যাকরণ অধ্যয়ন করিয়া কণ্ঠস্থ করিতে হয। মুগ্ধবোধ, পাণিনি, সংক্ষিপ্তসার, কলাপ প্রভৃতিবাকরণ পাঠ্য॥ এই সব ব্যাকরণ সহজে আয়ক্ত করিবাব জন্য অনেকে সক্ষিপ্ত সারের “কড়চা” অভ্যাস করিয়া থাকেন।

 ব্যাকরণ শিক্ষার অনুপাতে সংস্কৃত শিক্ষার ব্যুৎপত্তি বিকাশ। সংস্কৃত ব্যাকরণে ব্যুৎপত্তি লাভ করিলে, সংস্কৃত শিক্ষা যেরূপ তলস্পর্শিনী হইয়া থাকে, অধুনা উপক্রমণিকা, কৌমুদী পড়িয়া সেরূপ হয় না। টোলে ব্যাকরণ শিক্ষার যে প্রথা প্রচলিত, প্রথমতঃ সংস্কৃত কলেজে সেই প্রথা প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল। পরে এ প্রথার কিরূপ পরিবর্তন ঘটিয়াছিল, পাঠক পরে তাহা বুঝিতে পরিবেন।

 ঈশ্বরচন্দ্র যখন ব্যাকরণ শ্রেণীতে ভর্ত্তি হন, তখন কুমারহট্টনিবাসী পণ্ডিতপ্রবর গঙ্গাধর তর্কবাগীশ মহাশয় ব্যাকরণের অধ্যাপক ছিলেন। সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠাকালে অধ্যাপক উইলসন সাহেব বঙ্গের কৃতবিদ্য বিচক্ষণ পণ্ডিতগণকে নির্ব্বাচিত করিয়া কলেজের অধ্যাপনাকার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। নিম্নলিখিত অধ্যাপক নিম্নলিখিত বিষযে অধ্যাপনাকার্য্যে ব্রতী হইযছিলেন,— নিমচাঁদ শিরোমণি —দর্শন, শম্ভুচন্দ্র বাচপতি,—বেদান্ত; রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ,—স্মৃতি; ক্ষুদিরাম বিশারদ,—আয়ুর্ব্বেদ, নাথুরাম শাস্ত্রী,— অলঙ্কার; জয়গোপাল তর্কালঙ্কার,—সাহিত্য; গঙ্গাধর তর্কবাগীশ,—ব্যাকরণ; হরিপ্রসাদ তর্কালঙ্কার,—ঐ; হরনাথ তর্কভূষণ, -ঐ; যোগধ্যান মিশ্র,—জ্যোতিষ।

 ঈশ্বরচন্দ্র কলেজে ভর্তি হইলে পিতা ঠাকুরদাস প্রত্যহ নয় টার সময় ঈশ্বরচন্দ্রকে কলেজে দিয়া আসিতেন; আবার স্বয়ং অপরাহ্ন চারিটার সময় লইয়া যাইতেন। ছয় মাস কাল এইরূপ করিতে হইয়াছিল। তাহার পর ঈশ্বরচন্দ্র স্বয়ং কলেজে যাতায়াত করিতেন। ছয় মাস পরে ঈশ্বরচন্দ্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয পাঁচ টাকা বৃত্তি পান।

 ঈশ্বরচন্দ্র বাল্যকালে “বাঁটুল” ছিলেন। ছাতা মাথায় দিয়া যাইলে মনে হইত, যেন একটা ছাতা যাইতেছে। তাঁহাব মাথাটা দেহের অনুপাতে একটু বড় ছিল। এই জন্য বালকেরা তাহাকে ‘যশুরে কৈ' বলিয়া ক্ষেপাইত। বালক ঈশ্বরচন্দ্র সমবয়স্কদের বিদ্রুপোক্তিতে বড় বিরক্ত হইতেন। অনেক সমষ তিনি রাগে রক্তমুখ হইয়া উঠতেন; কিন্তু কথা কহিতে গিয়া আরও হাস্যম্পদ হইয়া পড়িতেন। তিনি তখন বড় 'তোতলা’ ছিলেন। সেই জন্য সহজে সকল কথা উচ্চারিত হইত না এবং এক একটা কথা উচ্চারণ করিতে কাল-বিলম্ব হইত; সুতরাং তাঁহাতে সমবয়স্ক বালকেরা হাসির মাত্র চড়াইয়া বিদ্রুপের মাত্রা ও বাড়াইয়া দিত। ক্রমে যশুরে কৈ’ নামটা “কশুরে যৈ’ শব্দে পরিণত হইয়াছিল। বালকেরা তখন কি বুঝিত,—এই মাথা-মোটা 'যশুরে কৈ’ কালে কত বড় লোক হইবে? তাহারা কি তখন বুঝিত, মাথা অপেক্ষা বালক ঈশ্বরচন্দের হৃদয়টা কত বৃহৎ?

 বালক বিদ্যাসাগব কলেজে যাহা শিখিয়া আসিতেন, রাত্রিকালে প্রত্যন্ত পিতার নিকট তাঁহার আবৃত্তি করিতেন। তাঁহার জনক মহাশয় সংক্ষিপ্তসার ব্যাকরণ সম্পূর্ণ না হউক, তাহার অধিকাংশ যে জানিতেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহা আত্ম-জীবনীর একাংশে স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। তিনি যে ব্যাকরণ পাঠ করিয়া আয়ত্ত করিতে পারিয়াছিলেন, তাঁঁহার নিদর্শনও পাইয়াছি। তাঁহার নিকটে যিনি ব্যাকরণ পড়িয়াছিলেন, তিনি রীতিমত ভট্টাচার্য্য হইয়া অধ্যাপকতা করিয়াছেন। প্রত্যহ পুত্রের আবৃত্তি শুনিয়া ব্যাকরণে ঠাকুরদাসের অভিজ্ঞতা বৰ্দ্ধিত হইয়াছিল। পুত্র কোন কথা বিস্মৃত হইলে পিতা তাহা স্মরণ করাইয়া দিতেন। পুত্র বুঝিতেন, তাহার পিতা ব্যাকরণে সবিশেষ বুৎপন্ন। পুত্রের নিকট পিতার প্রকারান্তরে কৌশলে অনুশীলন এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল।

 পুত্রের বিদ্যানুরাগিতা-সম্বৰ্দ্ধনসম্বন্ধে পর-সেবা-নিরত হইয়াও পিতা এক মুহূর্ত্তের জন্য কোনরূপ ত্রুটি করিতেন না। কার্য্যস্থানের কঠোর পরিশ্রমেও তিনি ক্লান্তি বোধ করিতেন না। বাত্রি নয়টার পর বাসায় ফিরিয়া তিনি রন্ধনাদি করিতেন এবং পুত্রকে আহার করাইয়া আপনি আহার করিতেন। তাহার পর পিতা-পুত্রে একত্র শয়ন করিতেন। শেষ রীত্রিতে পিতা, পুত্রের পঠিত বিদ্যার পর্য্যালোচনায় ব্যাপৃত থাকিতেন। মধ্যে মধ্যে তিনি পর-মুখ-শ্রুত নিজের অভ্যস্ত নানাবিধ উদ্ভট শ্লোক পুত্রকে শিখাইতেন।

 ঠাকুরদাস কঠোর-শাসনের পক্ষপাতী ছিলেন। যে দিন তিনি দেখিতেন, ঈশ্বরচন্দ্র ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন, সে দিন তাঁহাকে নিদারুণ প্রহার করিতেন। এক দিন ঈশ্বরচন্দ্র পিতার নিকট চালাকাঠের মার খাইয়া কলেজের তদানীন্তন কেরাণী রামধন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ীতে পলায়ন করিয়াছিলেন। রামধন বাবু তাঁহাকে অতি যত্নের সহিত বাড়ীতে রাখিয়া অহারাদি করান। পরে তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া বাসায় পৌছাইয়া দেন। সময়ে সময়ে পিতার নিকট মার খাইয়া, ঈশ্বরচন্দ্র এমনই আর্ত্তনাদ করিতেন যে, তাহাতে সিংহ-পরিবার উত্যক্ত হইয়া উঠতেন এবং ঠাকুরদাসকে বলিতেন,—“এরূপ প্রহারে হয় তো বালক কোন দিন মারা যাইবে; অতএব যদি এরূপ প্রহার কর, তাহা হইলে এখান হইতে তোমাকে স্থানান্তরে যাইতে হইবে।” ইহাতে প্রহারের মাত্র কিছু কম হইত। ঈশ্বরচন্দ্রও অনেকটা সাবধান হইয়া চলিতেন। পাছে নিদ্রা আসে বলিয়া, তিনি আপনার চক্ষে সরিষা তেল দিতেন। তেলের জ্বালায় নিদ্রা পলায়ন করিত। বর্ত্তমান যশস্বী খ্যাতনাম কোন কোন ব্যক্তি ঘুম ভাঙ্গাইবার জন্য বাল্যকালে এইরূপ ও অন্যরূপ উপায় অবলম্বন করিতেন, ইহাও আমরা জানি। লেখকের কোন বন্ধু বাল্যকালে ঘুমাইবার পূর্ব্বে পায়ে দড়ি বাঁধিয়া রাখিতেন। দড়ির টানে নিদ্রা ভঙ্গ হইলে, তিনি পাঠাভ্যাসে রত হইতেন। ইনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছিলেন এবং এক্ষণে এক জন অধিক বেতন-ভোগী উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারী।

 বুদ্ধিমান ও প্রতিভাশালী বালকদিগের জনয় প্রচণ্ড প্রহার পীড়ন বা কঠোর দণ্ড-শাসনের প্রয়োজন হয় না; বরং এ ব্যবস্থায় অনেক সময় বিপরীত ফল ফলিয়া থাকে যাহারা স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিহীন বা বিদ্যার্জনে অমনোযোগী, তাহাদের তো কিছুতেই 'কিছু হয় না; পরন্তু এমনও দেখিয়াছি, কঠোর শাসন-পীড়নে অনেক স্বাভাবিক বুদ্ধিমান বালক বিভিন্ন মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছে। আমাদের এক জন আত্মীয়ের একটা বুদ্ধিমান পুত্র ছিল। পিতা ভাবিতেন, নিয়ত কঠোর শাসনে রাখিতে পারিলে, পুত্রের বিদ্যাবুদ্ধির মাত্রা বাড়িবে। এই বিশ্বাসে পুত্রের সামানয় দোষ দেখিলেই পিতা পুত্রের প্রতি কঠোর প্রচার-পীড়নের ব্যবস্থা করিতেন। ফলে পুত্রের হৃদয়ে পিতৃশাসনের বিভীষিকা এতদূর ঘনীভূত হইয়া দাড়াইয়াছিল যে, পুত্র পিতাকে দেখিলেই দূরে পলায়ন করিত। তখন বহু সাধ্য-সাধনায়ও তাহাকে সমীপবর্ত্তী করা দুঃসাধ্য হইত; সুতরাং যাহার জন্য শাসন, তাহাই ঘুচিয়া গেল। এইরূপ শাসনবিভীষিকার্য পুত্র্রের ভবিষ্যৎ জীবনের উন্নতি-পথ রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল। প্রহার-পীড়ন-ফলে বুদ্ধিমান ঈশ্বরচন্দ্রের অবশ্য সেরূপ হয় নাই। স্বর্গীয় ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের জীবনেও এরূপ শাসন-পীড়নের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁহার পিতাও ঠাকুরদাসের ন্যায় কঠোর শাসনের পক্ষপাতী ছিলেন। আবার ইহাও দেখা যায়, এক জনের বুদ্ধিহীন পুত্র পিতার প্রচার পীড়নেও নির্বুদ্ধিতার সীমা অতিক্রম করিতে না পারিয়া অধ:পাতে গিয়াছে; অপর বুদ্ধিমান পুত্র অক্ষত-পৃষ্ঠে জীবনের পথ উজ্জ্বল করিয়াছে। এ সব দৃষ্টান্তের আলেচনায় অদৃষ্টবাদিত্বের পক্ষপাতিত্ব আসিয়া পড়ে না কি?

 ব্যকরণ শ্রেণীতে বালক ঈশ্ববচন্দ্র অন্য ছাত্র অপেক্ষা অধ্যাপকের প্রীতিপাত্র হইয়াছিলেন। অন্যান্য ছাত্রাপেক্ষা ব্যাকরণ বিদ্যায় তাঁহার অসম্ভাবিত ব্যুৎপত্তি দেখিয়া অধ্যাপক তাঁহার উপর বড় সস্তুষ্ট থাকিতেন। তিনি পাঠান্তে ঈশ্বরচন্দ্রকে আপনার নিকট বসাইয়া উদ্ভট শ্লোক শিখাইতেন। পিতা ও অধ্যাপকের নিকট ঈশ্বরচন্দ্র প্রায় চারি পাঁচ শত উদ্ভট শ্লোক শিখিয়াছিলেন।[১]

 ব্যাকরণ শ্রেণীতে পড়িয়া তিন বৎসরের মধ্যে তিনি দুই বৎসর প্রচুর পারিতোষিক পাইয়াছিলেন; এক বৎসর পান নাই। সেই বৎসর তিনি মনঃসংক্ষোভে ও অভিমানে সংস্কৃত কলেজ পরিত্যাগ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন; কিন্তু পিতা ও অধ্যাপকের অনুজ্ঞায় পারেন নাই। সে বৎসর যে তিনি থারিতোষিক পান নাই, তৎসম্বন্ধে কাহারও কাহারও মত এইরূপ,— “ঐ বৎসর প্রাইস্ সাহেব পরীক্ষক ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র যাহা উত্তর করিতেন, তাহা ভালরূপ বিবেচনাপূর্ব্বক করিতেন; সুতরাং উত্তর দিতে বিলম্ব হইত; কিন্তু প্রায়ই তাহা নির্ভুল হইত। যে বালক বিবেচনা না করিয়া তাড়াতাড়ি বলিইয়াছিল, তাহা ভাল হউক, আর মন্দই হউক, সাহেব তাহকে বুদ্ধিমান জানিয়া অধিক নম্বর দিয়াছিলেন।” সংস্কৃত ব্যাকরণের পরীক্ষায় সাহেব পরীক্ষক সম্বন্ধে এরূপ হওয়া অসম্ভব নহে। সাহেব কেন, কোন কোন টোলের ও কলেজের অধ্যাপকের এরূপ সংস্কার ছিল ও আছে, যে বালক দ্রুত উত্তর করিতে পারে, সে নির্ভুল বলিতেছে; সত্বর উত্তর করায় তাহারা ভুল ধরিতে পারেন না” পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয় দুই একবার ঐরূপ বালকদের দ্বারা প্রতারিত হইয়াছিলেন।

 এই সময় বালক ঈশ্বরচন্দ্রের “একগুঁয়েমী ফুটিতে আরম্ভ হয়। এই “এক গুঁয়েমীর” দরুণ পিতা অনেক সময় উত্যক্ত হইতেন। পিতা বলিতেন,—“ফরসা কাপড় পরিয়া স্কুলে যাও।* ঈশ্বরচন্দ্র বলিতেন,—“ময়লা কাপড় পরিয়া যাইব।” যে দিন ঈশ্বরচন্দ্র স্নান করিব না মনে করিতেন, সে দিন তাঁহাকে স্নান করান বড়ই দুষ্কর হইত। পিতা তাঁহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়া গঙ্গার ঘাটে বলপুর্ব্বক স্নান করাইয়া দিতেন। অন্য কোন গুরু জন কোন কাজ করিতে বলিলে, ঈশ্বরচন্দ্র যদি মনে করিতেন করিব না, তাহা হইলে কেহই তহিকে তাহা করাইতে পারিতেন না। গুণের মধ্যে এই ছিল, ঈশ্বরচন্দ্র কাহারও কথায় কোন উত্তর না দিয়া কেবল ঘাড় বাঁকাইয়া দাড়াইয়া থাকিতেন। এই জন্য পিতা ঠাকুরদাস তাঁহাকে অনেক সময় “ঘাড়কেঁদো” বলিয়া ডাকিতেন। বালক ঈশ্বরচন্দ্রের “একগুঁয়েমীর” কথায় বালক জনসনের “একগুঁয়েমীর” কথা মনে পড়িয়া যায়। বাল্য কালে এক জন ভৃত্য জনসনকে প্রত্যহ স্কুল হইতে লইয় আসিত। এক দিন ভূত্যের যাইতে বিলম্ব হওয়ায় বালক জনসন আপনি স্কুল হইতে বাহির হন এবং পথে চলিয়া যান। স্কুলের কর্ত্রী জানিতে পারিয়া ভাবিলেন, বালক হয় পথ ভুলিয়া অন্যত্র গিয়া পড়িবে, না হয় অন্য কোনরূপ বিপদগ্রস্ত হইবে। এই ভাবিয়া তিনি জনসনের অনুবর্ত্তিনী হন। বালক জনসন দেখিলেন কর্ত্রী তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ অসিতেছেন। তাঁহার শক্তি সম্বন্ধে কর্ত্রী সন্দিহীন হইয়াছেন ভাবিয়া, বালক জনসন অভিমানে অভিভূত হইলেন এবং অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হইয়া উঠলেন, এমন কি তখনই ফিরিয়া গিয়া কর্ত্রীকে যথাসাধ্য প্রহার করিলেন। জনসনের জীবনীলেখক বসওয়েল তাঁহারি এই “একগুঁয়েমীর” বা দৃঢ়প্রতিজ্ঞতার দৃষ্টান্ত তুলিয়া বলিয়াছেন,—“জনসনের ভবিষ্যৎ জীবনে ইহার পরিচয় পাওয়া যায়।” বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে আমরাও এই কথা বলিতে পারি।

 ব্যাকরণ পাঠের সময় ১২৩৭ সালে বা ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র কলেজের ইংরেজি শ্রেণীতে প্রবেশ করিয়াছিলেন। ১২৩৩ সালে বা ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে এই ইংরেজী শ্রেণী প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। ভবিষ্য বিশাল ইংরেজি-বৃক্ষের ইহাই বীজাঙ্কুর। ছাত্রের কাজের মতন যৎকিঞ্চিৎ ইংরেজি শিখিতে পারে, ইংরেজি শিখিয়া, ইংরেজি চিকিৎসা-গ্রন্থাদি কতক পরিমাণে সংস্কৃতে ও বাঙ্গালায় অনুবাদ করিতে পারে, এই উদ্দেশ্যে এই ইংরেজি শ্রেণী প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। তৎকালে উলষ্টন সাহেব এই শ্রেণীর শিক্ষক ছিলেন। ইহাতে পড়িতে কিন্তু অনেকের প্রবৃত্তি ছিল না। বহু ছাত্রের মধ্যে অল্পসংখ্যকই পড়িত। বিদ্যাসাগর ছয় মাস মাত্র এই শ্রেণীতে পড়িয়াছিলেন, সুতরাং ইংরেজিতে তিনি তাদৃশ জ্ঞান লাভ করেন নাই। তাহার জন্য ভবিষ্যৎ জীবনে অদ্য চেষ্টা করিতে হইয়াছিল। “

 এইবার বালকের অক্ষুণ্ণ শ্রমশীলতার পরিচয় লউন। ব্যাকরণ শ্রেণীতে তিনি তিন বৎসর ছয় মাস অধ্যয়ন করেন। তিন বৎসরে ব্যাকরণপীঠ সাঙ্গ করিয়া, বাকি ছয় মাস তিনি অমরকোষের মনুষ্যবৰ্গ ও ভটিকাব্যের পঞ্চম সর্গ পর্যন্ত পড়িয়াছিলেন। এ অল্প বয়সেও তিনি প্রায় সারা রাত্রি জাগিয়া পাঠাভ্যাস করিতেন। রাত্রি দশটার সময় আহারান্তে ঠাকুরদাস দুই ঘণ্টা জাগিয়া থাকিতেন। ঈশ্বরচন্দ্র তখন নিদ্রা যাইতেন। রাত্রি বারটার সময় পিতা তাঁহাকে তুলিয়া দিতেন। তার পর বালক সমস্ত রাত্রি পড়িতেন। এইরূপ গুরুতর পরিশ্রমে ঈশ্বরচন্দ্রকে মধ্যে মধ্যে পীড়া ভোগ করিতে হইত। এইরূপ অমানুষিক পরিশ্রম বিদ্যাসাগর যাবজ্জীবন করিয়াছিলেন। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র পাঠ্যাবস্থায় এইরূপ পরিশ্রম করিয়া থাকেন বটে; কিন্তু অনেকের ভবিষ্যৎ জীবনে তাঁহা দেখিতে পাওয়া যায় না। পরিশ্রমের কথা তো পরের কথা, দুই পয়সা, উপার্জ্জন করিতে শিখিলে, তাহারা বিলাস-মদ-লালসার সম্পূর্ণ পরবশ হইয় এক একটা “বাবুজী” হইয় পড়েন।

 নবম বর্ষ বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র কলেজে ভর্ত্তি হইয়াছিলেন। একাদশ বৎসর বয়সে তাঁহার উপনয়ন হয়।

 দ্বাদশ বৎসরে ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের কাব্য শ্রেণীতে প্রবেশ করেন। সেই সময় পণ্ডিতবর জয়গোপাল তর্কালঙ্কার সাহিত্যাধ্যাপক ছিলেন। মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ মহাশয় বালক বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পাঠ করিতেন।[২] বিদ্যাসাগর মহাশয় অন্যান্য ছাত্র অপেক্ষা অল্পবয়স্ক ছিলেন; কিন্তু তাঁহার অদ্ভুত ধী-শক্তির পরিচয় পাইয়া অধ্যাপকমণ্ডলী বিস্মিত হইতেন। প্রথম বৎসরে ঈশ্বরচন্দ্র রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, রাঘব-পাণ্ডবীয় প্রভৃতি সাহিত্য-পরীক্ষায় সর্ব্বপ্রধান স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় বৎসরে তিনি মাধ, ভারবি, শকুন্তলা, মেঘদূত, উত্তরচরিত, বিক্রমোর্ব্বশী, মুদ্রারাক্ষস, কাদম্বরী, দশকুমারচরিত প্রভৃতি পাঠ করেন। এ সব কাব্য আদ্যোপান্ত তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল।অনুবাদে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। পুস্তক না দেখিয়া তিনি সংস্কৃত নাটকাদি অনর্গল বলিতে পারিতেন। স্বাদশ বর্ষীয় বালক সংস্কৃত কথা কহিতে পারিতেন। প্রাকৃত ভাষায় কথা কহিতেও তাঁহার কোন সঙ্কোচ হইত না। তদানীন্তন পণ্ডিতগণ তাহার অদ্ভুত স্মৃতি-শক্তি ও অশ্রুত-পূর্ব বাক্যবিন্যাস-ক্ষমতা দেখিয়া মোহিত হইতেন এবং প্রায়ই বলিতেন,—“এ বালক পৃথিবীতে অদ্বিতীয় পণ্ডিত হইবে।” প্রতিভা আর কাহাকে বলে?

 দ্বিতীয় বৎসর সাহিত্য-পরীক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র সর্ব্বপ্রথম হন। হস্তাক্ষরেরর জন্য তিনি প্রতি বৎসর পারিতোষিক পাইতেন। হস্তাক্ষরের প্রশংসা তাঁহার যাবজ্জীবন ছিল। সকল সাহিত্যসেবকের ভাগে এরূপ প্রশংসা ঘ্টিয়া উঠে না। আধুনিক উচ্চতম সাহিত্য-সেবক ও সাহিত্য-সমালোচকদিগের সংস্রবে থাকিয়া আমাদের কতকটা এই প্রতীতি জন্মিয়াছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় অনেক সংস্কৃত পুঁথি স্বহস্তে লিখিয়া লইতেন। পুঁথির লেখা দেখিয়া সকলে তাহার ভূয়সী প্রশংসা করিতেন। তিনি যে সকল পুঁথি স্বহস্তে লিখিয়া গিয়াছেন, তাহার পঙক্তিগুলি দেখিলে মনে হয়, যেন কারপেটে উল বুনিয়া লেখা।

 এই সময় বালক বিদ্যাসাগর জীবন-সংগ্রামে কঠোরতার অভেদ্য ব্যুহ-বিবরে পতিত হন। সে কঠোরতা দরিদ্র হীনাবস্থাপন্ন বালকের অনুকরণীয়, শিক্ষণীয় এবং সর্ব্ব সাধারণের চিরস্মরণীয়। সেই সময় তাঁহার মধ্যম, ভ্রাতা দীনবন্ধু[৩] শিক্ষার্থ কলিকাতায় আগমন করেন। পাক-কার্য্যের ভার ঈশ্বরচন্দ্রের উপর পতিত হয়। কেবল কি তাই, প্রত্যহ প্রাতঃকালে স্নান করিয়া তিনি বাজারে ঘাইতেন এবং বাজার হইতে পিতার অবস্থানুসারে আলু, পটোল প্রভৃতি তরি-তরকারী ও মৎস্যাদি ক্রয় করিয়া লইয়া বাসায় ফিরিয়া আসিতেন।তারপর তিনি নিজেই ঝাল হলুদ শিলে বাটিয়া লইতেন। তখন পাথুরে কয়লার প্রচলন হয় নাই। তিনি স্বহস্তে কাঠ চালা করিতেন এবং উকুন ধরাইতেন। বাসায় চারিটী লোক খাইতেন। চারিজনের জন্য ভাত, ডাল মাছের ঝোল রাধিয়া তিনি সকলকে আহার করাইতেন এবং আহারান্তে সকলের উচ্ছিষ্ট মুক্ত করিয়া স্বয়ং বাসনাদি ধৌত করিতেন। হলুদ বাটিয়া, কাট চিরিয়া, বাসন মাজিয়া সত্য সত্য তাঁহার অঙ্গুলি ও নখ কতকটা খয়িয়া গিয়াছিল। তুমি আমি শুনিলে শিহরিয়া উঠি বটে; বালক ঈশ্বরচন্দ্র ইহাতে কিন্তু অপার আনন্দ ও পরম পরিতোষ লাভ করিত্বেন। অনেক অবস্থাহীন ব্যক্তি বাল্য কালে এইরূপ কঠোরতার সহিত সংগ্রাম করিয়া ভবিষ্যৎ জীবনে অতুল কীর্ত্তিমান ও যশস্বী হইয়া গিয়াছেন। ডক্তার গুডিব চক্রবর্ত্তীর সম্বন্ধে এইরূপ শুনা যায়। তাঁহাকে একজনের বাসায় রন্ধন করিতে হইত। রন্ধন করিতে করিতে তিনি পুস্তক লইয়া পাঠ করিতেন। তিনি ভবিষ্যৎ জীবনে একজন যশস্বী চিকিৎসক বলিয়া পরিচিত হন। বাল্যে বা যৌবনে কঠোরতার সঙ্গে সংগ্রাম করিয়া ভবিষ্যৎ জীবনে কোন বিষয়ে কীর্ত্তিমান হইয়াছেন, এমন দৃষ্টান্ত অনেক পাওয়া যায়। দারিদ্র্যের কঠোরতীয় ভবিষ্যৎ জীবনোন্নতির বীজ উপ্ত হয়। দারিদ্র্যের নির্ম্মমতায় অসাধারণ চরিত্র, শক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তি প্রস্ফুটিত হইয়া উঠে। কঠোরতার উত্তেজিকা শক্তি দরিদ্রের শিরায় শিরায় শোণিত-প্রবাহে যেন বিদ্যুৎ ছুটায় এবং দারিদ্র্যের আলিঙ্গনে প্রীতি ও প্রফুল্পতা, অধ্যবসায় ও আত্মসংযম সহজসিদ্ধ হইয়া থাকে। এই জন্য রিচার বলিয়াছেন,—“এস, দরিদ্র্য এস; তোমায় আলিঙ্গন করি; জীবনে যেন বিলম্ব করিয়া আসিও না।”

 স্পেনের কবি সারবেস্তিসের দারিদ্র্যের কথায় একজন বলিয়াছেন,—

“ইহার দারিদ্র্যে পৃথিবী ধনশালিনী।” অর্থাৎ তাঁহার গ্রন্থে জগৎ উপকৃত।

 সত্যসত্যই তো বুদ্ধিজীবী শক্তিশালী ব্যক্তি দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করিয়া যে শক্তি ও ক্ষমতা সঞ্চয় করেন, আত্মীয়-পরিজনপরিবৃত অতুল ধনের উপর অধিষ্ঠিত ব্যক্তি অনেক সময় তাহা পারে না। কার্লাইল সাধে কি বলিয়াছেন,—

 “যাহাকে দুঃখদারিদ্র্যের সহিত যুঝিতে হয় নাই; যিনি ঘরে বসিয়া সর্ব্ব সম্পদের প্রহরী বেষ্টিত হইয়া নিশ্চিন্তু থাকেন, তাঁহার অপেক্ষা যিনি দুঃখ দারিদ্রের কঠোর সমরে জয়ী হন, দেখিবে পরিণামে তিনিই বলবস্তুর শূর এবং অধিকতর কর্ম্মঠ বলিয়া সমাজে প্রতিপন্ন হইবেন।”[৪]

 বালক বিদ্যাসাগর রন্ধনাদি করিয়া ভ্রাতা ও পিতাকে মনের আনন্দে আহার করাইতেন এবং সতত আত্মপ্রসাদে প্রফুল্প থাকিতেন। যাঁহাকে আমাদের কঠোর কষ্ট বলিয়া মনে হয়, তাহা তাঁহার মনোমদ স্নিগ্ধ মুখকর,বলিয়াই মনে হইত। তিনি রন্ধনের ক্লেশকে ক্লেশ বলিয়া মনে করিতেন না; অধিকন্তু পাঠাভ্যাসে অবিরাম পরিশ্রম করিয়া ও কিছুমাত্র কষ্ট অনুভব করিতেন না। কষ্টের সীমা ছিল না। যে ঘরে তিনি রন্ধন করিতেন, সে ঘরটা অতি জঘন্য ছিল। একে তো ঘরটা বাড়ীর সর্ব্ব নিয়তলে, তাহার উপর জানালার অভাবে ভয়ানক অন্ধকারময়। নিকটে দুইটা পাইখানা ছিল; সুতরাং ঘরটা সদাই দুর্গন্ধে পূর্ণ থাকিত। মলমূত্রের কীটসকল কিলি-বিলি করিয়া ঘরের ভিতর ঢুকিত। ঈশ্বরচন্দ্র রন্ধন করিবার সময় ঘটাতে জল লইয়া বসিয়া থাকিতেন। পোকাগুলো ঘরের ভিতর ঢুকিলে তিনি জল দিয়া ধুইয়া দিতেন। এতদ্ব্যতীত ঘরময় প্রায় আরসুলা ঘুরিয়া বেড়াইত। সময়ে সময়ে উঠে ব্যঞ্জনে আরসুলা উড়িয়া পড়িত। হঠাৎ কোন দিবস ঈশ্বরচন্দ্র অজ্ঞাতে ব্যঞ্জনের সঙ্গে একটা আরসুলা রাঁধিয়া ফেলিয়াছিলেন। প্রকাশ করিলে বা পাতের নিকট রাখিলে, ভ্রাতা বা পিতা ঘৃণাপ্রযুক্ত আর ভোজন করিবেন না, ইহা ভাবিয়া তিনি আরসুলাটী ব্যঞ্জন সহিত ভক্ষণ করেন।

 আহারের তো এই অবস্থা। শয়নের অবস্থা শুনিলে চমৎকৃত হইতে হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুত্র শ্রীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের মুখে তাহার শয়নব্যাপারের এইরূপ পরিচয় পাইয়াছি” নারায়ণ বাবু বলেন,—“এক দিন চন্দননগরের বাসা-বাড়ীতে আমি বলিলাম,—বাবা! এ ছোট ঘরে শুইতে আপনার কষ্ট হইবে না তো?’ বাবা বলিলেন,—“বলিস্ কি রে! ছেলে বেলায় বড়বাজারের বাসায় আমি দেড় হাত চওড়া ও দু-হাত লম্বা একটী বারাণ্ডায় প্রত্যহ শয়ন করিতাম। বারাণ্ডার আলিসা আমার বালিস ছিল। আমি বারাণ্ডার মাপে একটা মাজুরী করিয়াছিলাম, সেই মাজুরীতেই শয়ন করিতাম। এক দিন রাত্রিকালে দেখিলাম, সেই মাজুরীরর উপর আমার একটা ভ্রাতা শুইয়া আছে। এ আমি তাহার নিকট গিয়া অনেক ডাকা-ডাকি করিলাম; সে কিন্তু কিছুতেই উঠিল না, তখন আমি তাহার নিজের বিছানায় শুইলাম।শুইবামাত্র আমার গায়ে বিষ্ঠা লাগিয়া গেল। আমি তখন আস্তে আস্তে উঠিয়া একটু মজা করিব বলিয়া যেখানে আমার সাধের বিছানায় ভাইটী গুইয়াছিল, সেইখানে গিয় তাহাকে ডাকিয়া বলিলাম, উটবি তো ওট, না হলে তোর গায়ে বিষ্ঠা মাখাইয়া দিব। তখন সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া, পড়িল। তাহাকে উঠিতে দেখিয়া চলিয়া আসিলাম। সে রাত্রিতে আর নিদ্রা হয় নাই।” জগদদুর্ল্ভ বাবুর বাড়ীর সন্মুখে তিলকচন্দ্র ঘোষ নামক এক ব্যক্তির বাড়ীর নিম্নতলে একটা ঘরে ঈশ্বরচন্দ্র শয়ন করিবার আদেশ পাইয়াছিলেন। তখন তাহার তৃতীয় ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র কলিকাতায় থাকিতেন। ভ্রাতা তাঁহার শয্যায় শয়ন করিতেন। বালক বিদ্যাসাগর পাঠাভ্যাস করিয়া অধিক রজনীতে শয়ন করিতেন। এক দিন ভ্রাতা বিছানায় মলত্যাগ করিয়া ফেলিয়াছিলেন। পাছে একথা বলিলে পেটের ব্যারাম হইয়াছে বলিয়া খাইতে না পান, সেই ভয়ে ভ্রাতা মলত্যাগের কথা প্রকাশ করেন নাই | ঈশ্বরচন্দ্র তো তাহা জানিতে পারেন নাই। তিনি প্রাতে উঠিয়া দেখেন, তাহার সর্ব্বাঙ্গে বিষ্ঠা। তখন তিনি বিষ্ঠা ধৌত করিয়া স্বহস্তে ভ্রাতার মলমূত্রাদি পরিষ্কার করিয়া দেন। বিদ্যাসাগরের যেমন পিতৃ-মাতৃ-ভক্তি ছিল, তেমনই ভ্রাতৃ-স্নেহ ছিল।

 বালক ঈশ্বরচন্দ্র যখন সাহিত্য-শ্রেণীতে পড়িতেন, তখন তাঁহার উপর এক বেলা রন্ধনের ভার ছিল। রাত্রিকালে পিতা নয়টার সময় বাসায় অসিয়া পাকাদি করিতেন। এত কষ্টে বিদ্যাসাগরের পাঠাভ্যাসে ক্রটি ছিল না। তিনি কলেজে যাইবার সময় পুস্তক খুলিয়া পড়িতে পড়িতে যাইতেন এবং কলেজ হইতে আসিবার সময়ও ঐরূপ করিতেন। চিরকাল তিনি বিলাসে বীতস্পৃহ ছিলেন। সঞ্চয়ে সমর্থ হইয়াও তিনি মোটা কাপড় ও মোট চাদর ব্যবহার করিতেন। বাল্যেও তাঁহার তাহাই ছিল। জননী চরকায় সুতা কাটিয়া, বস্ত্র প্রস্তুত করিয়া, কলিকাতায় পাঠাইতেন। সেই মোটা কাপড় পরিয়া তিনি কলেজে যাইতেন। বিদ্যাভ্যাসে তাঁহার ক্রটির কথা শুনা যায় নাই। দৈবাৎ একটু ক্রটি হইলে পিতা ঠাকুরদাস ভয়ানক শাসন করিতেন। পুত্রও পিতার শাসনকে বড় ভয় করিতেন। বাল্যাবস্থায় বিদ্যাসাগর সন্ধ্যার মন্ত্র ভুলিয়া গিয়াছিলেন। এ কথা পূর্ব্বে একবার উল্লেখ করিয়া আসিয়াছি। - পিতা তাঁহাকে শাসন করেন। এই শাসনে তিনি সন্ধ্যার পুঁথি দেখিয়া সন্ধ্যা মুখস্থ করিয়াছিলেন।

 কাব্যে ও ব্যাকরণে ঈশ্বরচন্দ্রের অসাধারণ বুৎপত্তি অত্যদ্ভুত ব্যাপার। বীরসিংহ গ্রামে আদ্যশ্রাদ্ধাদি উপলক্ষে তিনি এত অল্পবয়সে অনেক সময় সংস্কৃত কবিতা রচনা করিয়া দিতেন। তাঁহার রচনা দেখিয়া তাৎকালিক প্রসিদ্ধ পণ্ডিতমণ্ডলী অবাক হইতেন। মিলটন ত্রয়োদশ বর্ষে কবিতা রচনা করিয়া তাৎকালিক বিলাতী পণ্ডিতবর্গকে মুগ্ধ করিয়াছিলেন।[৫] জীবিত, সর্ব্বত্র-প্রচারিত ও প্রচলিত ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখিবার চেষ্টামাত্রে যদি মিলটন প্রতিভাশালী বলিয়া অভিহিত হইতে পারেন, তাহা হইলে বালক বিদ্যাসাগর অধুনা সংকীর্ণপ্রচার সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিতজনমোহকর কবিতা রচনা করিয়া তদপেক্ষা অধিকতর প্রতিভাশালী বলিয়া কি পরিচিত হইতে পারেন না? সংস্কৃত ভাষা আজ যদি পুর্ব প্রচলিত থাকিত, সংস্কৃত যদি হিন্দুসন্তানের সাধারণ শিক্ষণীয় ও পঠনীয় হইত, তাহা হুইলে এই প্রতিভাশালী বাল-কবির মস্তিষ্ক হইতে ভবিষ্য জীবনে অপূর্ব্ব জ্যোতির্ম্ময়ী কবিতা নিঃসৃত হইয়া যে প্রতিভার পূর্ণ বিভায় দিগন্ত উদ্ভাসিত করিত না, তাহাই বা কে বলিতে পারে? বালক বিদ্যাসাগর শ্রাদ্ধ-সভায় সমাগত পণ্ডিতমণ্ডলীর সহিত সংস্কৃত ভাষায় ব্যাকরণের বিচার করিতেন। তাঁহার সংস্কৃত ভাষাভিজ্ঞতা ও কথনশক্তিশীলতার প্রতিপত্তি ক্রমে চারিদিকে প্রচারিত হইল। চারিদিকে ধন্য ধন্য রব উঠিল। লোকে বলিতে লাগিল,— “অদ্বিতীয় পণ্ডিত।”

  1. বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্কলিত “শ্লোক মঞ্জরী” নামক গ্রন্থে বহু সংখ্যক উদ্ভট শ্লোক দেখিতে পাইবেন।বিদ্যাসাগর মহাশয় লিখিয়াছেন,—"এই উদ্ভট শ্লোক দ্বারা আমরা সবিশেষ উপকার লাভ করিয়াছিলাম, সন্দেহ নাই। আমাদের পাঠদ্দশায় যেরূপ আকার ও আলোচনা লক্ষিত হইয়াছিল, এক্ষণে আর সেরূপ দেখিতে শুনিতে পাওয়া যায় না। বস্তুতঃ উদ্ভট শ্লোকের আলোচনা একেবারে লুপ্তপ্রায় হইয়াছে।”
  2. এই মদনমোহন উত্তরকালে সুকবির খ্যাতি পাইয়াছিলেন ও মুক্তারাম শ্রীমদ্ভাগগতের বঙ্গানুবাদ কার্য্যে লিপ্ত থাকিয়া সুপণ্ডিত হইয়াছিলেন।
  3. ইনি স্যাররত্ন উপাধি ভূষিত হন।ইনি স্কুলের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট এবং তৎপরে স্কুলের ইনসপেক্টর ইইয়াছিলেন। ইহাঁর রচিত একখানি পদ্য পুস্তক ছিল।
  4. He who has battled, were it only with poverty and hard toil, will be found stronger and more expert than he who could stay at home from the battle, concealed among the provision waggons, or even rest unwatchfully, abiding by the stuff.
  5. His first attempts in poetry were made as early as his 13th year, so that he is as striking an instance of perocity as of power of genius-Shaw's Students English.