বিদ্যাসাগর/পঞ্চত্রিংশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চত্রিংশ অধ্যায়।

বহুবিবাহ।

 ১২৭৮ সালের শ্রাবণ মাসে বা ১৮৭১ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে “বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না” বিচারের প্রথম পুস্তক প্রকাশিত হয়। পুস্তকের প্রথম প্রতিপাদ্য বিষয়,—বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত কি না। কয়েকটী কারণে হিন্দুর একাধিক বিবাহ যে শাস্ত্রসম্মত, বিদ্যাসাগর মহাশয় এ পুস্তকের প্রারম্ভে তাহা স্বীকার করিয়াছেন। দশরথ বহু-বিবাহ করিয়াছিলেন। পুত্রাভাব-নিবন্ধন দশরথের বহু-বিবাহ অশাস্ত্রীয় নহে, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহা বলিয়াছেন। যে কয়টী কারণে একাধিক বিবাহ শাস্ত্রসম্মত বলিয়া স্বীকৃত, তাহা এই,—

 (১) যদি স্ত্রী সুরাপায়িনী, ব্যভিচারিণী, সতত স্বামীর অভিপ্রায়ের বিপরীতকারিণী, চিররোষিণী, অতি ক্রূর-স্বভাবা ও অর্থনাশিনী হয়, তৎসত্ত্বে অধিবেদন অর্থাৎ পুনরায় দারপরিগ্রহ বিধেয়।

 (২) স্ত্রী বন্ধ্যা হইলে অষ্টম বর্ষে, মৃতপুত্রা হইলে দশম বর্ষে, কন্যামাত্র প্রসবিনী হইলে একাদশ বর্ষে ও অপ্রিয়বাদিনী হইলে কালাতিপাত ব্যতিরেকে বিবাহ করিবে।

 এতৎকারণ ব্যতীত একাধিক দারগ্রহণ অশাস্ত্রীয় এবং নিষিদ্ধ, বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহা প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা পাইয়াছেন। কলিযুগে অসবর্ণ বিবাহ রহিত হইয়াছে; সুতরাং যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত বিবাহের আর স্থল নাই, ইহাই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথা। এ কথার শাস্ত্রীয়তা বা অশাস্ত্রীয়তা লইয়া কোন বিচারও উথাপিত হয় নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মতে কৌলীন্যসম্মত বহুবিবাহ পাপাবহ ও শাস্ত্রবিরুদ্ধ। এতৎ-প্রমাণার্থ তিনি সাধ্যানুসারে চেষ্টা করিয়াছেন।

 কোন আত্মীয় কন্যার কষ্টানুভবে তিনি বহু-বিবাহ রহিত করিবার জন্য উদ্যোগী হন। আত্মীয় কুলীনকন্যার পতি বহুবিবাহ করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রায়ই পতিসাক্ষাৎ-লাভ ঘটিত না। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বলিয়াছিলেন,—“আমাদের অদৃষ্টে যা ছিল, তা হইয়াছে। আমাদের কন্যারা যাহাতে আর কষ্ট না পায়, তাহার একটা উপায় করিতে পারেন?” ইহারই পর হইতে বিদ্যাসাগর মহাশয় বহুবিবাহ রহিতকরণের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করেন। বাঙ্গালার কোন্ কোন্ কুলীনের একাধিকবিবাহ হয়, তাহারও তিনি তালিকা সংগ্রহ করেন। এই তালিকা “বহু-বিবাহ” বিষয়ক প্রথম পুস্তকে সন্নিবেশিত আছে।

 ১২৬২ সালের ১৩ই পৌষ বা ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের ২৭শে ডিসেম্বর বহু-বিবাহ-রদ-করণাভিলাষে বর্দ্ধমানের মহারাজপ্রমুখ অনেক ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একখানি আবেদন পত্র গবর্ণমেণ্টে প্রেরিত হইয়াছিল। এই আবেদনের মর্ম্ম এই,—“কোন কোন বিশেষ কারণে শাস্ত্রে একাধিক বিবাহের ব্যবস্থা আছে বটে; কিন্তু এখন এতৎসম্বন্ধে যথেচ্ছাচার ঘটিয়াছে। কুলীনদের ভিতর এই যথেচ্ছাচার প্রবল। কেবল অর্থ-লালসায় অনেকে বহু-বিবাহ করিয়া থাকে। সমাজে ভ্রুণহত্যা রূপ নানা অনর্থ সংঘটিত হইতেছে। এতন্নিবারণার্থ গবর্ণমেণ্টের কোনরূপ আইন করা উচিত।” এ আবেদনে ফল হয় নাই। তবুও অন্দোলন চলিয়াছিল। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহ ব্যাপারে বিব্রত ছিলেন বলিয়া, গবর্ণমেণ্ট ইহাতে মনোযোগী হইতে পারেন নাই।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় নিশ্চিন্ত থাকিবার পাত্র নহেন। ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে যখন কাশীর রাজা দেবনারায়ণ সিংহ বাহাদুর ব্যবস্থাপক সভার সভ্য ছিলেন, সেই সময় এসম্বন্ধে আইন হইবার উদ্যোগ হয়; কিন্তু কিয়দ্দিন পরে রাজাবাহাদুরকে ব্যবস্থাপক সভা হইতে যথানিয়মানুসারে বিদায় লইতে হইয়াছিল; সুতরাং উদ্যোগ কার্য্যে পরিণত হইল না। ১৮৬৫ সালে তাৎকালিক বঙ্গেশ্বর স্যর সিসিল বিডন সাহেবের নিকট বহুজন-স্বাক্ষরিত এক আবেদনপত্র প্রেরিত হয়। তাহাতে যে কোন ফলোদয় হয় নাই, তাহা পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে। ইহার পর বিদ্যাসাগর মহাশয় উত্তরপাড়ায় পড়িয়া যান। শরীরের অসুস্থতানিবন্ধন তিনি এতৎসম্বন্ধে আর কোন আলোচনা করিতে পারেন নাই। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে তাৎকালিক সনাতন ধর্ম্মরক্ষিণী সভায় এতৎসম্বন্ধে একটী আন্দোলন উপস্থিত হয়। সভায় বাদানুবাদ ও তর্কবিতর্ক চলিয়াছিল। এই অবসরে বিদ্যাসাগর মহাশয় পুনরায় এতদালোচনায় প্রবৃত্ত হন। সেই আলোচনার ফল,—এই প্রথম পুস্তক।

 প্রথম পুস্তক প্রকাশিত হইবার পর, তারানাথ বাচস্পতি, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, পণ্ডিত ক্ষেত্রনাথ স্মৃতিরত্ন, মুর্শিদাবাদে খ্যাতনামা কবিরাজ গঙ্গাধর কবিরত্ন প্রমুখ অনেকেই ইহার প্রতিবাদ করেন। সেই সময় ইহা লইয়া, সমগ্র বঙ্গদেশ বিলোড়িত হইয়াছিল। তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের পুস্তক সংস্কৃত ভাষায় রচিত হইয়াছিল। অন্যান্য পুস্তক বাঙ্গালায়। এই সব প্রতিবাদীর মত খণ্ডনার্থ, ১২৭৯ সালের চৈত্র মাসে বা ১৮৭২ খৃষ্টাব্দের মার্চ্চ মাসে “বহু-বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না?” বিচারের দ্বিতীয় পুস্তক প্রকাশিত হয়।

 বহু-বিবাহের আন্দোলনকালে উপযুক্ত ভাইপোর পুনরাবির্ভাব হইয়াছিল। উপযুক্ত ভাইপো এইবার তারানাথ বাচস্পতি মহাশয়কে লইয়া পড়িয়াছিলেন। তারানাথের উপর ভাইপোর তীব্র আক্রমণ। ভাষা-ভঙ্গী ভীষণ ভ্রুকুটীময়ী। তাহা সভ্য সাহিত্যের সম্মানাস্পদ নহে। একটু নমুনা দিই,—

“এত কাল পরে সব ভেঙ্গে গেল ভুর।
হতদর্প হইল বাচস্পতি বাহাদুর।
সকলের বড় আমি মম সম নাই।
কিসে এই দর্প কর ভেবে নাহি পাই।
  *  *  *  * *
তুমি গো পণ্ডিত-মূর্খ বুদ্ধিশুদ্ধিহীন।
অতি অপদার্থ তুমি অতি অর্ব্বাচীন॥”

 ভাইপোর এ পুস্তকের নাম “অতি অল্পই হইল।” পুস্তকের প্রারম্ভে উপরোক্ত ছড়া। পরে অরিও গালিগালাজ গদ্যে। তদুদ্ধার নিষ্প্রয়োজন। অনেকেই বলেন, এ ভাইপো স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়ই। আমরা কিন্তু ইহার তাদৃশ প্রমাণ পাই নাই। এ ভাষার ভাব-ভঙ্গী বিদ্যাসাগরের চরিত্রোচিত নহে। পওি তারানাথ বাচস্পতি মহাশয়ও ইহার উত্তরচ্ছলে একখানি ২০ পৃষ্ঠার পুস্তিকা লিখিয়াছিলেন। ইহা ভাইপোর মতন তীব্র নহে। তবে ভাইপোর উপর কটাক্ষ আছে। “ভাইপোস্য” শব্দ অশুদ্ধ ধরিয়া বাচস্পতি মহাশয় ভাইপোকে মৃত্তিকা-প্রোথিত করিয়াছেন। “কস্যচিৎ উচিতবাদিনঃ” নাম দিয়া এক ব্যক্তি “প্রেরিত তেঁতুল” নামে একখানি ২৫ পৃষ্ঠার ক্ষুদ্র পুস্তিকা লিখিয়াছিলেন। ইহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রতি আক্রমণ ছিল। এতদ্ব্যতীত গান ছাড়াও অনেক রকম প্রকাশিত হইয়াছিল। এডুকেশন গেজেটের প্রেরিত পত্রে “কুলীন-কামিনীর উক্তি” নামে একটা পদ্য প্রকাশিত হইয়ছিল।

 বাচস্পতি মহাশয়, যেরূপ বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আক্রমণ করিয়াছিলেন এবং বিদ্যাসাগর মহাশয় বাচস্পতি মহাশয়কে যে ভাবে আক্রমণ করিয়াছিলেন,তাহা বিজ্ঞোচিত হয় নাই। এই সূত্রে উভয়ের যে মনোমালিন্য হইয়াছিল, তাহা আর এ জন্মে বিদুরিত হয় নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয় বিচারে ভাষাভিজ্ঞতা, তর্কনিপুণতা, মীমাংসাপটুতা, অনুসন্ধিৎসা এবং বিদ্যাবুদ্ধিমত্তার প্রকৃত পরিচয় দিয়াছেন বটে; কিন্তু বাচস্পতি মহাশয়কে আক্রমণ করিতে গিয়া ধৈর্য্যচ্যুত হইয়া পড়িয়াছিলেন। আমরা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিব, বিদ্যাসাগর মহাশয় এ সম্বন্ধে যে তর্কপ্রণালীর অবতারণা করিয়াছেন, বাঙ্গালায় এ পর্য্যন্ত তেমন অল্প লোকেই পারিয়াছে। কোন কোন আত্মস্পর্দ্ধী দাম্ভিক লেখক তাঁহাকে সময়ে সময়ে ‘নিজস্ব’ হীন বলিয়া, তাঁহার গৌরবহানির চেষ্টা করিয়া থাকেন এবং সময়ে সময়ে তাঁহার অনুবাদিত গ্রন্থনিচয়, সেই সব দাম্ভিক পুরুষদের রহস্যবিষয়ীভূত হইয়া থাকে। বিদ্যাসাগরের “বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না” পুস্তক প্রকাশিত হইবার পর যাঁহাদের এরূপ স্পর্দ্ধা দেখিয়াছি, তাঁহাদিগকে আমরা কৃপার পাত্র মনে করিয়া রাখিয়াছি। কেননা, সেরূপ স্পর্দ্ধা ব্যাধি বিশেষ।

 বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না বিষয়ক পুস্তক লইয়া বাদানুকরিতে চাহি না। তাহার স্থানও নাই। এ সম্বন্ধে আইন যে হয় নাই,ইহাই দেশের মঙ্গলের বিষয়। আইনে বহু অনর্থপাতের সম্ভাবনা। বিদ্যাসাগর মহাশয়, “বহু-বিবাহ” সংক্রান্ত পুস্তকের ইংরেজী অনুবাদ করিয়া মুদ্রিত করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা সম্পূর্ণ হয় নাই।