বিদ্যাসাগর/পরিশিষ্ট

উইকিসংকলন থেকে

পরিশিষ্ট।

জীবনান্তে আলোচনা।

পরলোকগত রমেশচন্দ্র ও কর্ত্তৃক লিখিত।

 সাহিত্য-সংসারে সুপরিচিত নানা গ্রন্থ প্রণেতা শ্রীযুক্ত সুবলচন্দ্র মিত্র মহাশয় ইংরাজীতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের একখানি বিস্তৃত জীবন-চরিত লিখিয়াছেন। পরলোকগত রমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয় সেই গ্রন্থের ভূমিকা লিখিয়াছেন। সে ভূমিকায় অনেক জ্ঞাতব্য কথা আছে। নিম্নে সে ভূমিকার মর্ম্মানুবাদ প্রকাশিত করিলাম;—

 স্বর্গীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের একখানি সুন্দর জীবনচরিত বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত হইয়াছে বটে, কিন্তু এই মাননীয় পণ্ডিতের যশ শুধু বাঙ্গালার মধ্যেই আবদ্ধ নহে; ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন প্রধান কর্ম্মবীর বলিয়া তিনি ভারতের সর্ব্বত্রই বিখ্যাত। সার সেসিল বিডনের বন্ধু ও ড্রিন্‌ক্‌ওয়াটার বেথুনের সহযোগী এই উন্নতমনা বাঙ্গালীর মহৎ চরিত্র ও কীর্ত্তিকলাপের প্রশংসা করেন নাই, এরূপ ইংরাজ তৎকালে অতি অল্পই ছিলেন। এই জন্যই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনচরিত ইংরাজিতে প্রণয়ন করিয়া শ্রীযুক্ত সুবলচন্দ্র মিত্র, অতি উত্তম কার্য্যই করিয়াছেন এবং তাঁহার পুস্তক এই সম্বন্ধে একটি প্রকৃত অভাব পূরণ করিবে।

 ভারতের ইতিহাসে বিদ্যাসাগর মহাশয় চিরকালই অতি উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত থাকিবেন। ইংরাজ-রাজত্ব ও ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে এদেশে নব আশা, নূতন ভাব ও নূতন উদ্যমের সৃষ্টি হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজা রামমোহন রায়ের জীবনে এবং পরে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কার্য্যে ইহার পরিচয়।

 এই দুই কর্ম্মবীরের জীবনের কতিপয় প্রধান ঘটনা প্রায় একই সময়ে ঘটে। ১৮২৮ খৃষ্টাব্দে রাজা রামমোহন রায়, সমাজ ও ধর্ম্মসংস্কার সম্বন্ধীয় তাঁহার চুড়ান্ত কার্য্য ব্রাহ্মসমাজ বা একেশ্বরবাদী হিন্দুসমাজ স্থাপন করেন; পর বৎসর বালক, ঈশ্বরচন্দ্র, তাঁহার জীবনের কার্য্যোপযোগী বিদ্যাশিক্ষার্থ জন্মস্থান হইতে কলিকাতায় আগমন করেন। ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে রাজা রামমোহন ইংলণ্ডে প্রাণত্যাগ করেন, ইহার কয়েক বৎসর পরেই ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের অধ্যয়ন সমাপনান্তে দক্ষতার সহিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া বিদ্যাসাগর এই উপাধি লাভ করেন।

 বিলাত হইতে যে সকল অল্পবয়স্ক সিবিলিয়ান এদেশে আসিতেন, তাঁহাদের বাঙ্গালা, হিন্দি, উর্দ্দু, প্রভৃতি এদেশীয় ভাষাসকল শিক্ষা দিবার নিমিত্ত ১৮০০ খৃষ্টাব্দে লর্ড ওয়েলেস্‌লি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮৪১ খৃষ্টাব্দে একুশ বৎসর বয়সে ইহার প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হন। এই পদপ্রাপ্তি হইতেই তাঁহার ভবিষ্যৎ জীবনের সৌভাগ্য-গৌরব সুচিত হয়। ইতিপূর্ব্বে তিনি অতি অল্পই ইংরাজি শিখিয়াছিলেন, কিন্তু এই সময় প্রয়োজনবশতঃ তাঁহার উত্তমরূপে ইংরাজি ভাষা শিখিবার বাসনা বলবতী হয়। তিনি সমবয়স্ক ও একাগ্রচিত্ত রাজনারায়ণ বসুর সহিত ইংরাজি শিক্ষা করেন। এই রাজনারায়ণ বাবু পরে বাঙ্গালা সাহিত্যক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনের এই অংশ কতকগুলি বিশেষ গুরুতর ঘটনার জন্য চিরস্মরণীয়। তাঁহাকে এই সময় কতিপয় বিশিষ্ট ইংরাজ ও কয়েকজন দেশীয় কর্ম্মবীরের সংস্পর্শে আসিতে হয়। তাঁহারই সাহায্যে অল্পবয়স্ক দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের পিতা) ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড বাইটারের পদ প্রাপ্ত হন। এই সময়েই তিনি হিন্দুসমাজের তৎকালীন নেতা রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের নিকট পরিচিত হন ও এই সময়েই অসাধারণ প্রতিভাশালী অক্ষয়চন্দ্র দণ্ডের সহিত তাঁহার জীবনব্যাপী বন্ধুত্বের প্রথম সূত্রপাত।

 ১৮৪৪ খৃষ্টাব্দে তদানীন্তন বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ্ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ পরিদর্শন করিতে আসিলে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত তাঁহার অনেক কথাবার্ত্তা হয়। পরবর্ত্তী দুই বৎসরের মধ্যে যখন বঙ্গের বিভিন্ন প্রদেশে একশত একটি ‘হার্ডিঞ্জ বিদ্যালয়’ স্থাপিত হইল, তখন সেই সমুদয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক-নির্ব্বাচনের ভার মার্শাল সাহেব ও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উপর অর্পিত হইল। এই প্রভূত ক্ষমতার পরিচালনে বিদ্যাসাগর মহাশয় কখনও ব্যক্তিগত স্বার্থের দিকে দৃষ্টিপাত করেন নাই। তাঁহার উপর যে গুরুতর দায়িত্বপূর্ণ কার্য্যাভার অর্পিত হইয়াছিল, তিনি সর্ব্বতোভাবে তার সম্মান রক্ষা করিয়াছিলেন। তিনি কিরূপ স্বার্থত্যাগ করিয়া যোগ্যতর ব্যক্তিকে উচ্চ পদলাভে সাহায্য করিতেন, তাহার একটি সুন্দর মর্ম্মস্পর্শী দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণ-অধ্যাপকের পদ শূন্য হইলে, মার্শাল সাহেবের সুপারিশে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ঐ পদ গ্রহণ করিতে অনুরোধ করা হয়। ঐ পদের বেতন ৯০৲ টাকা। বিদ্যাসাগর মহাশয় তৎকালে ৫০৲ টাকা মাত্র বেতন পাইতেন। তিনি কিন্তু ঐ পদ গ্রহণে অসম্মত হন; কারণ তাঁহার বিবেচনায় প্রসিদ্ধ তারানাথ তর্কবাচস্পতি মহাশয় ব্যাকরণ-শাস্ত্রের অধ্যাপনায় যোগ্যতর ব্যক্তি বলিয়া অনুমিত হইয়াছিল। তর্কবাচস্পতি মহাশয়ই ঐ পদে মনোনীত হইলেন এবং তাঁহাকে এই সংবাদ প্রদান করিবার নিমিত্ত বিদ্যাসাগর মহাশয় পদব্রজে কলিকাতা হইতে কালনাভিমুখে যাত্রা করিলেন। এই অপূর্ব্ব স্বার্থত্যাগ দেখিয়া তর্কবাচস্পতি মহাশয় অতিশয় বিস্মিত ও চমৎকৃত হইয়াছিলেন এবং বিস্ময়-বিহ্বলচিত্তে বলিয়াছিলেন, “ধন্য বিদ্যাসাগর! তুমি মানুষ নও, তুমি মনুষ্যাকারে দেবতা!”

 ১৮৪৬ খৃষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের পদ শূন্য হয়। তখন খ্যাতনামা বাবু রসময় দত্ত সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক ছিলেন। তিনি ইতিপূর্ব্বেই বিদ্যাসাগর মহাশয়েয় অসামান্য প্রতিভা ও অসাধারণ উদ্যমের পরিচয় পাইয়াছিলেন। সহকারী সম্পাদকের পদের বেতন বৃদ্ধি করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ঐ পদে নিযুক্ত করিতে তিনি শিক্ষাবিভাগের কর্ত্তৃপক্ষগণকে অনুরোধ করেন। বেতন বৃদ্ধি করা হইল না বটে, কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় ঐ পদে মনোনীত হইলেন। ঐ পদে নিযুক্ত হইয়া তিনি সংস্কৃত-শিক্ষা-প্রণালী সংস্কারে মনোনিবেশ করিলেন। সংস্কারসম্বন্ধীয় তাঁহার কঠোর ব্যবস্থাসকল দেখিয়া রসময় বাবু পর্য্যন্ত ভীত হইলেন এবং তাঁহার কতিপয় প্রস্তাব অনুমোদিত না হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করিয়া কিছুদিনের জন্য [দুষ্পাঠ্য] হইতে অবসর গ্রহণ করেন।

১৮৫০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি পুনরায় সংস্কৃত কলেজের সংস্কৃত-সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং তাঁহার প্রস্তাবিত সংস্কারসম্বন্ধীয় একটি বিস্তৃত রিপোর্ট প্রকাশিত করেন। রসময় বাবু দেখিলেন, এক্ষণে তাঁহার পদত্যাগ করাই শ্রেয়স্কর। তখন সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদকের পদ এক হইয়া প্রিন্সিপাল পদের সৃষ্টি হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় সংস্কৃত কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হইলেন ও তাঁহাকে ইচ্ছামত সংস্কৃত শিক্ষা প্রাণী সংস্কার ক্ষমতা প্রদত্ত হইল।

 দেখিতে দেখিতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যশঃ চতুর্দ্দিকে বিস্তৃত হইয়া পড়িল। তখন তাঁহার বয়স ত্রিশ বৎসর মাত্র। তিনি বঙ্গদেশের সম্ভ্রান্ত জমীদারগণের দ্বারা বন্ধুরূপে পরিগণিত হইলেন। শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকগণ এই নূতন সহযোগীকে পাইয়া আনন্দসহকারে ইঁহার সংবর্দ্ধনা করিলেন। যে সকল সহৃদয় ইংরাজ ভারতের উন্নতিকল্পে ঐকান্তিক যত্ন চেষ্টা করিতেছিলেন, তাঁহারা একজন উপযুক্ত সাহায্যকারী পাইলেন। তিনি এ দেশে স্ত্রী শিক্ষা-প্রচলনে মন প্রাণ সমর্পণ করেন এবং এতদ্‌সম্বন্ধে মহানুভব বেথুন সাহেবকে অনেক সাহায্য করেন। বঙ্গের প্রথম ছোটলাট স্যার ফ্রেড্‌রিক হ্যালিডে সাহেব তাঁহার কার্য্যে সন্তুষ্ট কইয়া বেথুন সাহেবের মৃত্যুর পর বেথুন স্কুল নামক বালিকা-বিদ্যালয়ের ভার তাঁহার উপর অর্পণ করেন।

 ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দে যখন এদেশে বাঙ্গালা ও ইংরাজি বিদ্যালয় সংস্থাপিত করা গবর্ণমেণ্টের অভিপ্রেত হয়, তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় এ সম্বন্ধে একটি রিপোর্ট লেখেন। এই রিপোর্ট পাঠে সন্তুষ্ট হইয়া কর্তৃপক্ষেরা তাঁহাকে ২০০৲ টাকা বেতনে হুগলি, বর্দ্ধমান, মেদিনীপুর ও নদীয়া জেলাসমূহের একজন বিশেষ ইনস্পেক্টার- রূপে নিযুক্ত করেন। ইহা ভিন্ন তিনি সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের বেতন ৩০০৲ টাকাও পাইতেন। তিনি ঐ চারিটি জেলায় বালক বালিকাগণের জন্য অনেক গুলি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এ সয়ে তাঁহাকে কলিকাতার সংস্কৃত কলেজের ও নর্ম্ম্যাল স্কুলের কার্য্যেরও তত্ত্বাবধান করিতে হইত। তাঁহার একান্ত অনুরোধে অক্ষয়কুমার দত্ত নর্ম্ম্যাল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন।

 এই সমস্ত কার্য্যে ব্যাপৃত থাকিয়াও বিদ্যাসাগর মহাশয় সাহিত্য চর্চ্চায় বিরত হন নাই। ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দে তাঁহার বাঙ্গালা ‘শকুন্তলা’ প্রকাশিত হইল। ইহার তিন বৎসর পরে তাঁহার সর্ব্বোৎকৃষ্ট পুস্তক সীতার বনবাস প্রকাশিত হয়। বর্ত্তমান কালের বাঙ্গালা গদ্যসাহিত্য ইহার সৌষ্ঠব ও সৌন্দর্যের জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয়ের নিকট ঋণী।

 রাজা রামমোহন রায় ও তাঁহার সমসাময়িক লেখকগণের ভাষা তেজোময়ী ও ভাবপ্রকাশক হইলেও অতীব জটিল ও দুর্ব্বোধ ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অক্ষয়কুমার বাবুই যে আধুনিক মনোহারী বাঙ্গালা গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টিকর্ত্তা, ইহা বলিলে কিছুমাত্র অতিরঞ্জিত করা হয় না। যে সকল হংরাজ-লেখক রাজ্ঞী অ্যানের সময়ে ইংরাজি গদ্য বর্ত্তমান ছাঁচে ঢালিয়া ভাষার স্রোত ফিরাইয়া দিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অক্ষয়কুমার স্বদেশীয় সাহিত্যসেবা বিষয় তুলনায় সমকক্ষ।

 এই সময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় একটি গুরুতর কার্য্যে ব্যস্ত হইয়া পড়েন। ____ খৃষ্টাব্দে এই বহুশাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত নির্ভীকচিত্তে প্রকাশ করিলেন যে, শাস্ত্রে হিন্দু-বিধবাদিগের চির বৈধব্য-বিধি নাই এবং বিধবা-বিবাহ শাস্ত্র-সম্মত। চতুর্দ্দিকে ভীষণ অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল। বাঙ্গালার প্রত্যেক নগরে এবং প্রত্যেক গ্রামে তুমুল আন্দোলন হইতে লাগিল। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ও দাশরথি রায় এই নব্য সমাজ-সংস্কারককে ব্যঙ্গ করিয়া কবিতা লিখিতে লাগিলেন। গ্রামে গ্রামে উৎসবাদি উপলক্ষে বিধবা-বিবাহ বিষয়ক গান গীত হইতে লাগিল। শান্তিপুরের তন্তুবায়ের স্ত্রীলোকদিগের শাড়ীর পাড়ে এই সম্বন্ধে গান বুনিতে আরম্ভ করিল। তখন ঘরে ঘরে স্ত্রী-পুরুষ সকলেরই মুখে কেবল এই কথা। অতঃপর এই সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতি বাদ করিয়া রাজা রাধাকান্ত দেব স্বয়ং গবর্ণমেণ্টের নিকট আবেদন করিলেন।

 এই প্রবল ঝটিকার মধ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয় অচল ও অটল। বিরুদ্ধ-মতসকল খণ্ডন করিয়া তিনি আর একখানি পুস্তক প্রচার করিলেন। ইহাতে তিনি যেরূপ প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ও সুন্দর যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাহাতে এই আন্দোলন প্রায় একরূপ বন্ধ হইয়া যায়। শুধু তাহাই নহে, তিনি প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষ, প্রতাপচন্দ্র সিংহ প্রভৃতি অনেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিকে নিজ মতাবলম্বী করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। ইহার পর পুনর্বিবাহিত হিন্দুবিধবাগণের সন্তানসন্ততিকে আইনসমত উওরাধিকারী করিবার জন্য গবর্ণমেণ্টের নিকট আবেদন করা হয় এবং ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দে এই বিষয়ক আইন পাস হয়।

 ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে যখন লর্ড ক্যা__ কলিকাতা-বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন, তখন ইহার সভ্য সংখ্যা __ জন মাত্র। তন্মধ্যে কেবল ৬ জন এ দেশীয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহার মধ্যে একজন ছিলেন। কিন্তু এক্ষণে শিক্ষাবিভাগের সহিত তাঁহার সম্বন্ধ শেষ হইয়া আসিল। এডুকেশন কাউন্‌সিলের স্থানে ডাইরেক্টার অব্‌ পাবলিক ইন্‌ষ্ট্রাক্‌সন পদের সৃষ্টি হইল ও গর্ডন ইয়ং সাহেব প্রথম ডাইরেক্টার নিযুক্ত হইলেন। ইনি একজন নবীন ও অল্পদর্শী কর্ম্মচারী। এস্থলে সেই পুরাতন নিমানুযায়ী ব্যবস্থাই হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় সংস্কৃত শিক্ষা- প্রণালীসংস্কারক, বাঙ্গালা শিক্ষার জন্মদাতা, স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনকারী, একাগ্রচিত্ত সংস্কারক ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যসেবক হইয়াও স্বদেশের শিক্ষাবিভাগের সর্বোচ্চ পদ লাভ তাঁহার অদৃষ্টে ঘটিল না। কারণ তিনি এ দেশীয়। আবার যিনি তাঁহার উপরে নিযুক্ত হইলেন, সেই গর্ডন ইয়ং সাহেব তাঁহার গুণগ্রহণে সমর্থ হইলেন না, পরন্তু তাঁহার সহিত বিশেষ ভাল ব্যবহারও করিতেন না, এইরূপ শুনা যায়। ইহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় অতিশয় মর্ম্মাহত হইয়াছিলেন এবং ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে প্রায় ৪০ বৎসর বয়সে তিনি গবর্ণমেণ্টের সহিত সকল সম্বন্ধ ছিন্ন করেন। তাঁহার এতদিনের কার্য্যের পুরস্কার স্বরূপ তিনি কোনরূপ পেন্‌সন বা পুরস্কারও পাইলেন না। তাঁহার কর্ম্মত্যাগ মঞ্জুর করিয়া ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে ২রা ডিসেম্বর গবর্ণমেণ্ট যে পত্র লিখেন, তাহার শেষে লেখা ছিল, দেশীয় শিক্ষার জন্য তিনি যে দীর্ঘব্যাপী ও অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়াছেন, তাহা গবর্নমেণ্ট স্বীকার করিতেছেন।

 ইহা অবশ অতিশয় সুখের বিষয় যে, এই কর্ম্মত্যাগের পর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ___ কার্য্যা দানশীলতার সুবিধা হইয়াছিল এবং তিনি ___ মহত্ত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন।

যত দিন না বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভা সাধারণে বুঝিয়াছিল, ততদিন সাহিত্যিক হিসাবে বাঙ্গালায় তাঁহার সমকক্ষ অপর কেহই ছিল না। এ প্যর্যন্ত পৃথিবীতে যে সকল পরোপকারী এবং আর্ত্ত ও দরিদ্রদিগের দুঃখমোচনকারী মহাত্মা জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ শ্রেণীতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্থান। তাঁহার পুস্তকের প্রভূত আয়—আর্ত্ত ও দরিদ্রদিগের দুঃখ দূর করিতে ব্যয়িত হইত, শত শত দরিদ্র-বিধবা জীবিকার জন্য ও শত শত অনাথ বালক শিক্ষার জন্য তাঁহার নিকট ঋণী। বাঙ্গালার ঘরে ঘরে তাঁহার নাম কীর্ত্তন হইত, কি ধনী— কি দরিদ্র সকলেই তাঁহাকে সমভাবে ভালবাসিত।

 যাঁহারা বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধ মতাবলম্বী ছিলেন, তাঁহারাও ইঁহাকে ইঁহার সহযোগীদের ন্যায় মান্য করিতেন। শ্রেষ্ঠ জমীদারগণ এই শ্রদ্ধাস্পদ সরল অসম সাহসী ও অসীম দয়াবান্ পণ্ডিতকে সম্মানিত করিয়া আনন্দিত হইতেন। তৎকালীন ছোটলাট স্যার সেসিল বিডন এই অবসরপ্রাপ্ত, শিক্ষাকার্য্যে বিশেষ পারদর্শী পণ্ডিতের সহিত প্রায়ই পরামর্শ করিতেন এবং তাঁহার সহিত সর্ব্বদা আলাপ করিয়া বিশেষ আনন্দিত হইতেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত আমার মধ্যে মধ্যে সাক্ষাৎ ইত এবং তাঁহার জীবনের শেষ কুড়ি বৎসর আমি তাঁহার সহিত পত্র-ব্যবহার করিয়াছিলাম। তাঁর জীবনের প্রথম ভাগের কার্য্য-সংগ্রাম ও জয়-পরাজয়ের উল্লেখ করিতে তিনি তখনও উৎসাহিত হইয়া উঠিতেন। তিনি যাঁহাদিগের সহিত একযোগে কার্য্য করিয়াছিলেন ___ সকলেই তখন কার দিনে এক এক জন কর্ম্মবীর। প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষ, হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণদাস পাল, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, মধুসূদন দত্ত, রাজেন্দ্র লাল মিত্র প্রভৃতি অনেকেই এই তালিকাভুক্ত। ঊনবিংশ শতাব্দীর আমাদের জাতীয় কার্য্যের ইতিহাস আশার শুভ্র আলোকে সমুজ্জ্বল এবং ইহার সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়েব জীবনের ইতিহাস সর্ব্বাপেক্ষা সূক্ষ্মভাবে জড়িত।

 আমি প্রায়ই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রভাত ভ্রমণের সঙ্গী হইতাম এবং কখনও কখনও তাঁহার সহিত তাঁহার বাটীতে সাক্ষাৎ করিতাম। তখন আমি তাঁহার সংগৃহীত ইংরাজি ও সংস্কৃত পুস্তকরাশি দেখিবার অনুমতি পাইতাম। তাঁহার কথাবার্ত্তায় তাঁহার ঘটনাবহুল জীবনের অনেক গল্পই শুনা যাইত এবং তাঁহার সরস রসিকতা তাঁহার জীবনের শেষ দিন পর্যন্তু তাঁহাতে বর্ত্তমান ছিল।

 আমি যখন আমার কর্ম্মস্থলে পুস্তকালয় স্থাপন করিলাম, তখন তিনি প্রায়ই স্বরচিত পুস্তকাবলী আমাকে প্রেরণ করিতেন। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে যখন আমি প্রতিবাদের ভীষণ ঝটিকার মধ্যে ঋগ্বেদের বাঙ্গালা অনুবাদ করিতে আরম্ভ করি, তখন মহামতি বিদ্যাসাগর মহাশয় আমায় বিশেষরূপে সাহায্য করেন।

 এই সময় তাঁহার স্বাস্থ্যভঙ্গ হইয়াছিল এবং তিনি প্রায়ই কলিকাতা ছাড়িয়া কর্ম্মটাঁড়ের বাটীতে বায়ুপরিবর্ত্তনের জন্য গমন করিতেন। তথায় সরল গ্রামবাসিগণ দলে দলে তাঁহাকে দেখিতে আসিত এবং তিনি তাহাদের বিপদে আপদে সর্ব্বদাই সাহায্য করিতেন; ___ দরিদ্রদিগের মধ্যে ঔষধ বিতরণ করিতেন। তাঁহার দয়ায় ইহারা অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল। অবশেযে সকলই ফুরাইল, ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে ৭০ বৎসর বয়সে এই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী আমাদের ছাড়িয়া অনন্তধামে চলিয়া গেলেন।

শ্রীযুক্ত রায় বৈকুণ্ঠনাথ বসু বাহাদুর কর্ত্তৃক লিখিত।

 কলিকাতার টাকশালের ভূতপূর্ব্ব দেওয়ান সুলেখক সঙ্গীতশাস্ত্রবিশারদ শ্রীযুক্ত রায় বৈকুণ্ঠনাথ বসু মহাশয়, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনচরিতে কয়েকটা নূতন কথা লিখিয়াছেন। নিম্নে তা প্রকাশিত হইল,—

সবিনয় নিবেদনমেতৎ—

 আপনার প্রণীত বিদ্যাসাগর চরিতের তৃতীয় সংস্করণ শীঘ্রই প্রকাশিত হইবে, এ সংবাদে আমি যারপরনাই প্রীতিলাভ করিলাম। এই নাটক-নভেল-প্লাবিত দেশে, এরূপ সারবান্ গ্রন্থের যে তৃতীয় সংস্করণের প্রয়োজন হইয়াছে, ইহা রচয়িতা ও পাঠক উভয়েরই গৌরবের বিষয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্বন্ধে আমার নিম্নলিখিত কয়েকটি গল্প আছে। এগুলি যদি আপনার সংগৃহীত গল্পগুচ্ছের মধ্যে না থাকে, তাহা হইলে (যদি আবশ্যক মনে করেন) নূতন সংস্করণে এগুলি ব্যবহার করিতে পারেন।

(১)

 কলিকাতার কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির বুদ্ধিহীনতা সম্বন্ধে কথা উঠিলে, বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—“উনি কিরূপ বোকা জান? এক চাষার বালক-পুত্র মাতার নির্দ্দেশে এক মুদির দোকানে এক পয়সার কড়ি ___ নিয়াছিল। মুদী ব্যস্ত থাকায়, বালককে বলে—“ঐ কলসির ভিতর কড়ি আছে। কুড়ি গণ্ডা ভাগা দিয়া লও। বালক ভাগা নিতেছে; এমন সময়ে মুদী ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল যে, পাঁচটা করিয়া ভাগ হইতেছে। মুদী বলল—‘বেটা, পাঁচটা করিয়া গণ্ডা হয়?’ বালক থতমত খাইয়া উত্তর দিল—‘আমি ত জানি না।’ মুদী বলিল— ‘জানিস্‌নে? আচ্ছা দেখ্‌!’ এই বলিয়া সে তিনটা করিয়া ভাগ দিয়া বালককে কহিল, ‘এই রকম কুড়িটা ভাগ করিয়া লও।’ বালক চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিলে মুদী জিজ্ঞাসা করিল— ‘দাঁড়িয়ে রহিলি যে?’ বালক মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল,—‘তা হ’লে মা যে ব’কবে!’ ধনবান্‌টি সেই চাষা বালকের ন্য়ায় বুদ্ধিহীন!”

(২)

 কলিকাতার কোন উচ্চ-পদস্থ বাঙ্গালী কর্ম্মচারী পীড়িত হইলে, চিকিৎসক তাঁকে বায়ু-পরিবর্ত্তন করিবার পরামর্শ দেন, এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কর্ম্মটাঁড়স্থ বাড়িটি কিছু দিনের জন্য চাহিয়া লইবার উদ্দেশে রোগীকে সঙ্গে লইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ীতে গমন করেন। চিকিৎসক বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরিচিত, কিন্তু রোগী পরিচিত ছিলেন না। চিকিৎসক রোগীর পরিচয় দিয়া বলিলেন—“ইনি অতিশয় ভদ্রলোক।” বিদ্যাসাগর মহাশয় একটু হাসিয়া বলিলেন—“উঁহার সঙ্গে যখন আমার আলাপ নাই, তখন আপনার কথা স্বীকার করিয়া লইতে আমি বাধ্য। এ পর্য্যন্ত যাঁহাদের সহিত আমার আলাপ হইয়াছে, তাঁহাদের মধ্যে ত বড় একটা ভদ্রলোক দেখিতে পাই নাই।”

(৩)

 বহুদিনের পর জনৈক সব-জজের সহিত সাক্ষাৎ হইলে, বিদ্যাসাগর মহাশয় কথায় কথায় জানিতে পারিলেন যে, বৃদ্ধ বয়সে সব-জজ মহাশয় প্রথমা পত্নীর বিয়োগান্তে আবার দার-পরিগ্রহ করিয়াছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—“তবে ত তোমার স্বর্গের দোর একেবারেই খোলা হে!” সব-জজ জিজ্ঞাসা করিলেন—“সে কি রকম, মহাশয়?” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন— “তবে শোন, মরণের পরই মানুষমাত্রেই স্বর্গে প্রবেশ করিবার জন্য স্বর্গের দ্বারে হুড়াহুড়ি করে; দ্বারপাল একে একে সকলকে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি পৃথিবীতে কি কার্য্য করিয়া আসিয়াছ?” যাহারা পুণ্য কার্য্য করিয়া আসিয়াছে, তাহাদিগকে স্বর্গে প্রবেশ করিতে দেওয়া হয়, অপরগুলিকে নির্দ্দিষ্ট সময়ের জন্য নরকে পাঠান হয়। জনৈক স্বৰ্গ-প্রার্থী এইরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া কোন বিশেষ পুণ্য বা পাপ কার্য্যের পরিচয় দিতে পারিল না। কথায় কথায় দ্বারপাল জানিতে পারিল যে, সে ব্যক্তি বৃদ্ধ-বয়সে দ্বিতীয় পক্ষের বিবাহ করিয়াছে। দ্বারপাল বলিল—“তুমি এখনই স্বর্গে প্রবেশ করিতে পার, পৃথিবীতেই তোমার নরকভোগ হইয়া গিয়াছে!”

(৪)

 কোন অনুগত কর্ম্ম প্রার্থীকে বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিয়াছিলেন, “আমার পরিচিত কোন লোকের অধীনে কোন কর্ম্ম খালি থাকিলে, আমাকে জানাইও, আমি চিঠি দিব। অনেক অনুসন্ধানের পর এক দিন সেই লোকটী বিদ্যাসাগর মহাশয়কে জানাইল যে, টেলিগ্রাফ আপিসে অমুক সাহেবের অধীনে একটি কর্ম্ম খালি আছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন—“সে সাহেবের সঙ্গে ত আমার আলাপ নাই, তাহাকে কেমন করিয়া চিঠি দিব?” লোকটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল,—“তা হ’লে আর আমার আশা ভরসা কিছুই নাই।” এই বলিয়া সে ক্ষুণ্ন মনে বিদায় গ্রহণ করিল। তাহার কাতরভাব দর্শনে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল। তিনি রাস্তা হইতে সেই লোকটিকে ফিরাইয়া আনিয়া, টেলিগ্রাফ আফিসের সেই সাহেবের নাম জিজ্ঞাসা করিয়া লইলেন, এবং তাঁহার নামে তৎক্ষণাৎ কর্ম্ম প্রার্থীর অনুকূলে একখানি অনুরোধ-পত্র লিখিয়া দিলেন। লোকটি পত্রখানি লইয়া যাইবার পরে, পার্শ্বস্থ জনৈক বন্ধু বিদ্যাসাগর মহাশকে বলিলেন,—“মহাশয়, আপনি অপরিচিত সাহেবকে পত্র লিখিলেন কেমন করিয়া?” বিদ্যাসাগর মহাশয় উত্তর দিলেন, “তাতে দোষ কি? সাহেব যদি আমার অনুরোধ রক্ষা করেন, তাহলে গরিবটির অন্ন-কষ্ট দুর হয়, আর যদি না করেন, তা হলে আমি তার সম্পূর্ণ অপরিচিত, তাতে আমার লজ্জা আর অপমানই বা কি?” পরে জানা গেল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্বাক্ষরিত পত্র পাইয়া সাহেব আপনাকে সম্মানিত জ্ঞান করিয়াছিলেন এবং পত্রবাহককে প্রার্থিত কর্ম্মে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।

ত্বদীয়

শ্রী বৈকুণ্ঠনাথ বসু

১৬৭, মাণিকতলা স্ট্রীট, কলিকাতা।
১০ই অশ্বিন, ১৩১৭।

শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ কর্ততৃক লিখিত।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দেহান্তর হইবার পর তাঁহার স্মৃতি সম্মানার্থ যে কয়েকটি সভা হইয়াছিল, তাহাদের মধ্যে কয়েকটী সভায় পঠিত প্রবন্ধের ভাব লইয়া বঙ্গের সুপ্রসিদ্ধ লেখক ও ঔপন্যাসিক শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ মহাশয় যাহা আলোচনা করিয়াছেন, নিম্নে তাহা প্রকাশিত হইল।

 বিদ্যাসাগর যেমন বাঙ্গালার বর্ত্তমান যুগে অসাধারণ ব্যক্তি, তাঁহার মৃত্যুতে বঙ্গদেশে যে শোকাচ্ছ্বাস লক্ষিত হইয়াছিল, তাহাও তেমনই অসাধারণ। তাঁহার মৃত্যুতে সমগ্র বঙ্গদেশ যেন স্বজন-বিয়োগ বেদনাবিধুর হইয়াছিল। তৎপূর্ব্বে সমগ্র দেশে এরূপ শোকাচ্ছ্বাস আর দেখা যায় নাই। ছাত্রগণ নগ্নপদে বিদ্যালয়ে গমন করিত, যুবকগন বিদ্যাসাগরের নিকট আপনাদের কৃতজ্ঞতার ঋণ স্মরণ করিয়া তাঁহার বিষয় আলোচনা করিত, প্রৌঢ়গণ তাঁহার গুণপরিচয় দিতেন। বিদ্যাসাগর ও রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র, অল্প দিনের ব্যবধানে দুইজনের মৃত্যু হয়। উভয়েই বরুেণ্য, উভয়েই বাঙ্গালীর ভক্তি অর্জ্জন করিয়াছিলেন। রাজেন্দ্রলাল সব্যসাচী রূপে এক দিকে রচনায় ও অপর দিকে সমালোচনায় ব্যাপৃত ছিলেন। কিন্তু তাঁহার কর্ম্মের গুরুত্ব উপলব্ধি করিবার ক্ষমতা জনসাধারণের ছিল না। তাঁহার কার্য্য উপলব্ধি করিবার ক্ষমতা কোবিদ-দিগেরই ছিল; এবং তাঁহার যশ স্বদেশে ও বিদেশে কোবিদ-সমাজেই আবদ্ধ ছিল। বিশেষ তিনি যে কার্য্য করিয়াছিলেন—যে মত প্রতিষ্ঠিত করিতে জীবনব্যাপী শ্রম করিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহাকে বাঙ্গালীর পক্ষে তাঁহার ___টের হীরক দীপ্তিতে আপনাদের জাতীয় জীবনের সঞ্চিত অন্ধকার দূর করা সম্ভব হইলেও তিনি কেবল বাঙ্গালীরই ছিলেন না। বিদ্যাসাগরের কথা স্বতন্ত্র। তিনি যে কার্য্য করিয়া সমগ্র ভারতে সম্প্রদায়বিশেষের মধ্যে খ্যাতি অর্জ্জন করিয়াছিলেন—যে অসাফল্যকে তিনি সাফল্য অপেক্ষা অধিক আদরণীয় মনে করিতেন—সেই বিধবাবিবাহ প্রচলনচেষ্টার উপযোগিতা সম্বন্ধে সন্দেহ থাকিতে পারে, কিন্তু বাঙ্গালার শিক্ষাবিস্তার কার্য্যে তাঁহার স্বকার্য্যের গুরুত্ব সম্বন্ধে তিল মাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই। তিনি বাঙ্গালার শিক্ষাকে নূতন উন্নত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। যখন পরিণত বয়সে তাঁহার মৃত্যু হয়, তখনকার শিক্ষিত বাঙ্গালীর তাঁহারই ‘বর্ণপরিচয়ে’ বাঙ্গালা বর্ণমালার সহিত পরিচিত। তখন ‘শিশুবোধকের’ কথা বৃদ্ধাদিগের স্মৃতিতে বিরাজিত। ‘বর্ণপরিচয়’ ঘরে ঘরে পরিচিত। সেইজন্য তাঁহার মৃত্যুতে বাঙ্গালী স্বজন-বিয়োগ- বেদনা অনুভব করিয়াছিল।

 বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর কয় বৎসর কলিকাতায় তাঁহার স্মৃতিসভার অধিবেশন হইয়াছিল। সেই সকল সভায় ৺রজনীকান্ত গুপ্ত, শ্রীযুক্ত শিবাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য, শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শ্রীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রবন্ধ পাঠ করিয়াছিলেন। রজনী বাবু ও রামেন্দ্র বাবুর প্রবন্ধ ‘সাহিত্যে’, শিবাপ্রসন্ন বাবুর প্রবন্ধ ‘প্রয়াসে’, রবীন্দ্র বাবুর প্রবন্ধ ‘সাধনায়’ প্রকাশিত হইয়াছিল। তৎপরে কলিকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্‌ষ্টিটিউটের বিশেষ অধিবেশনে বর্ত্তমান লেখক কর্ত্তৃক পঠিত একটা প্রবন্ধও ‘সাহিত্যে’ প্রকাশিত হইয়াছিল।

 বিদ্যাসাগর, ও ___ন্দ্রলাল উভয়ের শোকসভায় যেরূপ জনসমাগম হইয়াছিল, সভায় সেরূপ জনসমাগম তৎকালে সুলভ ছিল না। বাঙ্গালার ছোটলাট সে সভার সভাপতি ছিলেন। সে সভার বক্তৃগণ ও উক্তিখিত প্রবন্ধলেখকগণ সকলেই বাঙ্গালার শিক্ষাবিস্তারকল্পে বিদ্যাসাগরের কৃতকার্য্যের বিশেষ উল্লেখ করিয়াছিলেন। বাঙ্গালা ভাষার সংস্কার এই ক্ষেত্রে তাঁহার বিরাট্ কীর্তি। রবীন্দ্র বাবু তাঁহার প্রবন্ধে লিখিয়াছেন,— “তাঁহার প্রধান কীর্ত্তি বঙ্গভাষা। যদি এই ভাষা কখনও সাহিত্য-সম্পদে ঐশ্বর্য্যশালিনী হইয়া উঠে, যদি এই ভাষা অক্ষয় ভাবজননীরূপে মানবসভ্যতার ধাতৃগণের ও মাতৃগণের মধ্যে গণ্য হয়, যদি এই ভাষা পৃথিবীর শোকদুঃখের মধ্যে এক নুতন সান্ত্বনাস্থল—সংসারের তুচ্ছতা ও ক্ষুদ্র স্বার্থের মধ্যে এক মহত্ত্বের আদর্শ লোক, দৈনন্দিন মানবজীবনের অবসাদ ও অস্বাস্থ্যের মধ্যে সৌন্দর্যের এক নিভৃত নিকুঞ্জবন সৃজন করিতে পারে, তবেই তাঁহার এই কীর্ত্তি তাঁহার উপযুক্ত গৌরব লাভ করিতে পারিবে। বঙ্গভাষার বিকাশে বিদ্যাসাগরের প্রভাব কিরূপ কার্য্য করিয়াছে, এখানে তাহা স্পষ্ট করিয়া নির্দ্দেশ করা আবশ্যক। বিদ্যাসাগর বাঙ্গালা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্ব্বে বাঙ্গালায় গদ্যসাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সর্ব্বপ্রথমে বাঙ্গালা গদ্যে কলা-নৈপুণ্যের অবতারণা করেন। ভাষা যে কেবল ভাবের একটা ঝুলিমাত্র নহে, তাহার মধ্যে যেন তেন প্রকারেণ কতকগুলা বক্তব্য বিষয় পুরিয়া দিলেই যে কর্ত্তব্য সমাপন হয় না, বিদ্যাসাগর দৃষ্টান্ত দ্বারা তাহাই প্রমাণ করিয়াছিলেন। তিনি দেখাইয়াছিলেন যে, যতটুকু বক্তব্য তাহা সরল কা____ করিয়া এবং সুশৃঙ্খল করিয়া, ব্যক্ত করিতে হইবে। আজিকার দিনে এ কার্য্যটীকে তেমন বৃহৎ বলিয়া মনে হইবে না, কিন্তু সমাজবন্ধন যেমন মনুষ্যত্ব বিকাশের পক্ষে অত্যাবশ্যক, তেমনি ভাষাকে কলাবন্ধনের দ্বারা সুন্দররূপে সংযমিত না করিলে, সে ভাষা হইতে কদাচ প্রকৃত সাহিত্যের উদ্ভব হইতে পারে না। সৈন্যলের দ্বারা যুদ্ধ সম্ভব, কেবলমাত্র জনতার দ্বারা নহে;— জনতা নিজেকেই নিজে খণ্ডিত, প্রতিহত করিতে থাকে, তাহাকে চালনা করাই কঠিন। বিদ্যাসাগর বাঙ্গালা গদ্য ভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজ গতি এবং কার্য্য-কুশলতা দান করিয়াছিলেন। এখন তাহার দ্বারা অনেক সেনাপতি ভাবপ্রকাশের কঠিন বাধা সকল অতিক্রম করিয়া সাফল্য লাভে সমর্থ হইয়াছেন। কিন্তু যিনি সেই সেননীর রচনাকর্তা, যুদ্ধজয়ের যশোভাগ সর্ব্ব প্রথমে তাঁহাকেই দিতে হয়।”

 এই বিষয়ে বিদ্যাসাগরের কৃত কর্ম্ম বিশেষত্বব্যঞ্জক। উল্লিখিত প্রবন্ধে আমি লিখিয়াছিলাম,—“বিদ্যাসাগর মৌলিক রচনায় বিশেষ কৃতকার্য্য হইতে পারিতেন। তিনি তাহা না করিয়া ‘বর্ণপরিচয়’ হইতে ‘সীতার বনবাস’ পর্য্যন্ত নানা পুস্তক রচনা করিয়া বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষার পথ সুগম করিয়াছিলেন। তিনি যদি মৌলিক উপায়ে ভাষা শিক্ষার পথ সুগম না করিয়া মৌলিক রচনায় প্রবৃত্ত হইতেন, তবে আজ বাঙ্গালা ভাষার এত উন্নতি লক্ষ্য করিতে পারিতাম কি না সন্দেহ। আমাদের সৌভাগ্যের বিষয়, বিদ্যাসাগর যশের আশায় দাঁড় ধরিয়া দ্রুত ফেনপুঞ্জমাত্রের সৃষ্টি ____ পশ্চাতে হাল ধরিয়া বঙ্গভাষার তরণীকে সাবধানে গন্তব্য স্থানে লইয়া গিয়াছিলেন, তাঁহারই জন্য তরণী চড়ায় বাধে নাই, ঘূর্ণাবর্ত্তে পড়িয়া নিমজ্জিত হয় নাই। বিদ্যাসাগর একটা বেদী নির্ম্মাণ করিয়া তাহার উপর আপনি দেবতা সাজিয়া দাঁড়ান নাই; পড়াইয়া উচ্চকণ্ঠে আপনার যশোঘোষণা করিবার চেষ্টা করেন নাই; অসাধারণ ধৈর্য্য সহকারে নিপুণতার সহিত বঙ্গভাষার মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া গিয়াছেন; ভক্তের মত তিনি সে মন্দিরের সোপান হইতে চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত করিয়া আপনি তৃপ্ত হইয়াছেন। তিনি সে মন্দির নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন বলিয়াই আজ আমরা অবাধে সে মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে পূজা করিয়া ধন্য হইতে পারিতেছি। বিদ্যাসাগর যে মৌলিক রচনা না করিয়া দেশের লোকের হিতের জন্য মৌলিক উপায়ে বঙ্গভাষা শিক্ষার পথ সুগম করিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার মহত্ত্ব ও স্বার্থত্যাগই প্রকাশ পাইয়াছে। যশোলাভের অপেক্ষা স্বার্থত্যাগের গৌরব অনেক অধিক। দধীচির গৌরব তপস্যায় নহে, স্বার্থত্যাগে—আত্মত্যাগে। সেরূপ তপস্যা অনেকের পক্ষে সম্ভব; সেরূপ স্বার্থত্যাগ নিতান্ত দুর্ল্লভ।”

 রবীন্দ্রবাবু বলিয়াছিলেন, “মাঝে মাঝে বিধাতার নিয়মের ব্যতিক্রম হয়,” এবং “বিশ্বকর্ম্মা যেখানে সাত কোটি বাঙ্গালী নির্ম্মাণ করিতেছিলেন, সেখানে দুই এক জন মানুষ গড়িয়া বসেন!” বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব সেইরূপ নিয়মের ব্যতিক্রম! রামেন্দ্র বাবুও তাঁহার প্রবন্ধের প্রারম্ভে বলিয়াছিলেন, “এই হতভাগ্য দেশে হতভাগ্য জাতির মধ্যে সহসা বিদ্যাসাগরের মত একটা কাঠের কঙ্কালকিশিষ্ট মনুষ্য ___পে উৎপত্তি হইল, তাহা জীববিদ্যা ও সমাজবিদ্যার পক্ষে একটা বিষম সমস্যা হইয়া দাঁড়ায়। সেই দুর্দ্দম প্রকৃতি, যাহা ভাঙ্গিতে পারিত, কখন কেহ নোয়াইতে পারে নাই; সেই উগ্র পুরুষকার, যাহা সহস্র বিঘ্ন বিপত্তি ঠেলিয়া ফেলিয়া আপনাকে অব্যাহত করিয়াছে; সেই উন্নত মস্তক, যাহা কখন ক্ষমতার নিকট অবনত হয় নাই; সেই উৎকট বেগবতী ইচ্ছা, যাহা সর্ব্ববিধ মিথ্যাচার ও কপটাচার হইতে আপনাকে সর্ব্বতোভাবে মুক্ত ও স্বাধীন করিয়াছিল, তাঁহার বঙ্গদেশের বাঙ্গালীর মধ্যে আবির্ভাব, একটা অদ্ভুত ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে গণ্য হইত, সন্দেহ নাই।” পরে স্বাভাবিক নৈপুণ্য সহকারে প্রাচ্যে ও প্রতীচ্যে—ভারতে ও জগতের অন্য দেশে প্রভেদ বিশ্লেষণ করিয়া তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন;—“ভাগীরথী গঙ্গার পুণ্যধারায় যে ভূমি যুগ যুগান্তর ব্যাপিয়া সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা হইয়া রহিয়াছে, রামায়ণী গঙ্গার পুণ্যতর অমৃত-প্রবাহ সহস্র বৎসর ধরিয়া যে জাতিকে সংসারতাপ হইতে শীতল রাখিয়াছে, সেই ভূমির মধ্যে ও সেই জাতির মধ্যেই বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব সঙ্গত ও স্বাভাবিক।

 রজনী বাবু তাঁহার প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরকে অতি উচ্চস্থান দিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছিলেন,—“বিদ্যাসাগর ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ! পৃথিবীতে যে সকল মহাপুরুষ মহৎকার্য্যে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন, বিদ্যাসাগর তাঁহাদের অপেক্ষাও মহত্তর। তিনি প্রতিভাশালী পণ্ডিত অপেক্ষাও মহত্তর। যেহেতু তিনি প্রতিভার সহিত অসামা তেজস্বিতার পরিচয় দিয়াছেন। তিনি তেজস্থি মহাপুরুষ অপেক্ষা ___ যেহেতু তিনি তেজস্বিতার সহিত স্বার্থত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছেন। তিনি দানশীল ব্যক্তিগণ অপেক্ষা মহত্তর, যেহেতু তিনি দানশীলতা প্রকাশের সহিত বিষয়বাসনা ও আত্মগৌরব ঘোষণার ইচ্ছা সংযত রাখিয়াছেন।”

 যে সকল সভায় উপরিলিখিত প্রবন্ধগুলি পঠিত হইয়াছিল, সে সকল সভায় জনসমাগমের অভাব হয় নাই। বিদ্যাসাগরের কথা শুনিতে বাঙ্গালীর আগ্রহের অন্ত নাই। এই আগ্রহের আর এক প্রমাণ—বিদ্যাসাগরের তিনখানি বিস্তৃত জীবনী রচিত হইয়াছে। আর কোন বাঙ্গালীর ভাগ্যে এরূপ ঘটে নাই।

 বিদ্যাসাগরের হিতৈষণা ও স্বদেশপ্রীতি লইয়া অনেক কথা শুনা গিয়াছে। এই Philanthrophy ও patriotism জিনিষ দুইটা আমাদের বহুদিনের; কিন্তু নাম দুইটা বিদেশের। আমাদের দেশে লোকহিতৈষণা ধর্ম্মের অঙ্গ ছিল—তাহার স্বতন্ত্র নামের প্রয়োজন হইত না। যে সমাজে মানুষ সমাজেরই ছিল—সে সমাজে স্বদেশপ্রীতি স্বাভাবিক ছিল।

 রামেন্দ্র বাবু বলিয়াছেন,—“পাশ্চাত্যগণের মধ্যে ফিলান্‌থ্রপি নামে একটা পদার্থ আছে, তাহার বাঙ্গালা নাম লোকহিতৈষণা। তাঁহাদের এই লোকহিতৈষণাটা কোন সঙ্কীর্ণ সমাজের মধ্যে আবদ্ধ নহে, সমগ্র মানবজগৎ এই হিতৈষণার বিষয়ীভূত। এবং ইহাও বলা যাইতে পারে যে, এই হিতৈষণা পলিটিকাল ইকনমি শাস্ত্রেরও সম্পূর্ণ বিরোধী নহে। *** বিদ্যাসাগরকে এইরূপ ফিলান্‌থ্রপিষ্ট বলিলে গালি দেওয়া হয়। বিদ্যাসাগরের লোকহিতৈষিতা সম্পূর্ণ অন্য ধরণের এবং এই মৌলিক বিভেদই তাঁহার চরিত্রকে পাশ্চাত্য চরিত্র হইতে পৃথক করিয়া রাখিয়াছে। বিদ্যাসাগরের লোকহিতৈষিতা সম্পূর্ণ প্রাচীন ___ ইহা কোনরূপ নীতিশাস্ত্রের, ধর্ম্মশাস্ত্রের, অর্থশাস্ত্রের, বা সমাজশাস্ত্রের অপেক্ষা করিত না। এমন কি, তিনি হিতৈষণাবশে যে সকল কাজ করিয়াছেন, তাহার অধিকাংশই আধুনিক সমাজতত্ত্ব মঞ্জুর করিবে না। কোন স্থানে দুঃখ দেখিলেই যেমন করিয়াই হউক তাহার প্রতীকার করিতে হইবে, একালের সমাজতত্ত্ব তাহা স্বীকার করিতে চাহে না। কিন্তু দুঃখের অস্তিত্ব দেখিলেই বিদ্যাসাগর তাহার কারণানুসন্ধানের অবসর পাইতেন না। লোকটী অভাবে পড়িয়াছে জানিবামাত্রই বিদ্যাসাগর সেই অভাবনোচন না করিয়া থাকিতে পারতেন না।”

 বিদ্যাসাগরের Patriotism সম্বন্ধে ১৩০৬ সালের ৪ঠা বৈশাখ তারিখে বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতি শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাই উদ্ধৃত করিয়া বর্তমান প্রবন্ধ শেষ করিব।—“দেশের হিত-সাধনকারী Philanthropist স্বতন্ত্র, আর কায়মনোবাক্যে দেশের স্বীয় মাহাত্ম্যের সমর্থনকারী Patriot স্বতন্ত্র। যিনি স্বদেশের স্বাধীনতা, গৌরব, তেজোবীর্য্য এবং মহত্ত্ব রক্ষা করিয়া মাতৃভূমির মুখ উজ্জ্বল করেন, তিনিই Patriot। তিনি যদি নেপোলিয়নের ন্যায় রুধিরস্রোতে দেশকে ভাসাইয়া দিয়া দেশের অহিত সাধন করেন, আর বলেন যে, দেশের মহত্ত্ব যদি না রহিল, তবে তাহার হিতে কাজ নাই, তথাপি তিনি Patriot। পক্ষাস্তরে যাঁহারা কাটা ছাঁটা আঁটা সাঁটা পোষাক এবং দোকান-সাজানিয়া গৃহসজ্জাতেই সভ্যতার পরাকাষ্ঠা দেখেন; স্বদেশের কিছুই দুচক্ষে দেখিতে পারেন না; ____ দেশের সর্ব্ববাদি-সম্মত বিশিষ্ট উৎকর্ষ-স্থানটীকে ____ কেবল অন্যের দেখাদেখি নাক মুখ সিট্‌কাইয়া ভালবাসেন,বলেন—তা বই, তাহার ভালত্ব আপন চক্ষে দেখেনও না-দেখিতে জানেনও না; যাঁহারা স্বদেশের গৌরবে আপনাদিগকে গৌরবান্বিত মনে করেন না, তাহা দুরে থাকুক, উল্টা আরো যাঁহারা স্বদেশকে নীচু করিয়া আপনারা উচু হইবার চেষ্টায় ‘যাচিয়া মান’ এবং ‘কাঁদিয়া সোহাগের’ কর্দ্দমাক্ত পথে উর্দ্ধশ্বাসে ধাবমান হন; তাঁহারা যদি দেশের ‘মাথা হেঁট করা’ দেহের যাঁতা চালাইবার উপযোগী মহামহা বহ্বাড়ম্বরে ব্যাপৃত হইয়া দেশ-হিতৈষিতার ধ্বজা উড়াইতে একমুহূর্তও ক্ষান্ত না হন, তাহা হইলেও আমি তাঁহাদিগকে Garibaldi বলিব না। স্বর্গীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় ওরূপ Garibaldi ছিলেন না, কিন্তু তাঁহাকে আমরা patriot বলিতেছি। তিনি যদি একশত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতেন, শত সহস্র দরিদ্র লোককে আহায়ের ব্যবস্থা করিয়া দিতেন, দশ কোটি বিধবার মৃত সাধব্য পুনর্জীবিত করি- তেন, তাহা হইলে বলিতাম, তিনি মস্ত একজন philanthropist patriot। তাঁহাকে বলিতেছি আরেক কারণে যখন তিনি Woodrow সাহেবের অধীনতা-শৃঙ্খল ছিন্ন করিয়া নিঃসম্বল হস্তে গৃহে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক লেখনী যন্ত্রদ্ধারা জীবিকা সংস্থানের পথ কাটিতে আরম্ভ করিলেন, তখন বুঝিলাম যে, হাঁ ইনি patriot, যেহেতু ইনি খাওয়া পরা অপেক্ষা স্বাধীনতাকে প্রিয় বলিয়া জানেন। যখন দেখিলাম যে, তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার সারাংশ সমস্তই ক্রোড় পাতিয়া গ্রহণ করিঘাছেন, অথচ সে সভ্যতার কৃত্রিম কুহকাংশে পদাঘাত করিয়া স্বদেশীয় উচ্চ অঙ্গের সভ্যতা বিদ্যা-বিনয়- দয়া-দাক্ষিণ্য-মহত্ত্ব এবং সদাশয় ____আপনাতে মূর্ত্তিমান্ করিয়াছেন, তখন বুঝিলাম যে, এ ___করণ সত্য সত্যই patriot ছাঁচে গঠিত। যখন দেখিলাম যে, ‘এদেশের কিছু হইবে না’ বলিয়া তিনি অকেজো মৌখিক সম্ভ্রান্ত লোকদিগের সংসর্গে বিমুখ হইয়া বাষ্পগদ গদলোচনে গৃহ-কোটরে ঢুকিয়া আপনাতে আপনি ভর করিয়া অবস্থিতি করিতেছেন—দীপ্ত দিবাকর অল্পে অল্পে তেজোরশ্মি গুটাইয়া অস্তাচলশিখরে অবনত হইতেছেন, তখন বুঝিলাম যে, পূর্ব্বজন্মে ইনি প্রাচীন রোম নগরের কোন একজন খ্যাতনামা patriot ছিলেন—পুণ্যক্ষয়ে স্বর্গ হইতে আমাদের এই হতভাগ্য দেশে নিপতিত হইয়া মনের খেদে ধুলিতে অবলুণ্ঠিত হইতেছেন; অথচ কেহ তাঁহাকে পুঁছিতেছে না।

শ্রীহেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ।

জীবনকথা।

দ্বারকানাথ মিত্র

 ১৮৩৬ খৃষ্টাব্দে হুগলি জেলার আগুন্সী গ্রামে এই মনস্বী জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার পিতা হুগলি আদালতে মোক্তারী করিতেন। ইঁহার অবস্থা তত স্বচ্ছল না হইলেও পুত্রকে রীতিমত বিদ্যাশিক্ষা দানে ইনি পরাঙ্মুখ ছিলেন না। প্রতিভার প্রভাব প্রায়ই বাল্যকাল হইতেই প্রকাশ পাইয়া থাকে। দ্বারকানাথের পক্ষে তাহাই ঘটিয়াছিল। হুগলিকলেজ ও হিন্দুকলেজে অধ্যয়ন ফলে ইঁহার মানসিক বৃত্তি বিলক্ষণ স্ফূর্ত্তি পাইয়াছিল। ইনি বেকন বিষয়ক যে প্রবন্ধটী রচনা করেন, তাহাতে হিন্দু কলেজের প্রবন্ধচয়িতা-শ্রেণীর শীর্ষস্থান অধিকার করেন। ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দে ইনি কলিকাতার অন্যতম ম্যাজিষ্ট্রেট কিশোরীচাঁদ মিত্রের অধীনে দ্বিভাষীর পদ গ্রহণ করেন। অল্পদিন পরেই প্লিডারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া সদর দেওয়ানী আদালতে উকিল স্বরূপে প্রবেশ করেন। ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে হাইকোর্ট স্থাপিত হইলে ইনি এই আদালতে ব্যবসায় করিতে থাকেন এবং উত্তর কালে তদানীন্তন সমব্যবসায়িগণের অগ্রণী হইয়া উঠেন। প্রধান বিচারপতি স্যার বার্ণেস পিকক ইঁহার গুণের একান্ত পক্ষপাতী ছিলেন। ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দে যখন ১৫ জন জজের সমক্ষে বিখ্যাত Re__ case বিচারাধীন হয়, তখন প্রজাপক্ষে স্বারকানাথ ___ ৭ দিন ধরিয়া আপন পক্ষ যেরূপ যোগ্যতা ও তেজস্বিতার সহিত সমর্থন করেন, তাহাতে কি বিচারপতিগণ, কি ব্যবহারজীবগণ, কি জনসাধারণ সকলেই দ্বারকানাথের অসাধারণ শক্তি দর্শনে বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া পড়েন। অল্প দিনের জন্য ইনি হাইকোর্টের জুনিয়র প্লিডার পদে কার্য্য করিয়া ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে জুন মাসে শম্ভুনাথ পণ্ডিতের মৃত্যুজনিত শূন্য বিচারাসন অধিকার করেন। ৭ বৎসর কাল হাইকোর্টের বিচারপতি পদে আধিষ্ঠিত থাকিয়া ইনি যেরূপ ব্যবহার-জ্ঞান, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, তর্কশক্তি ও নির্ভীকতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা কেবল বাঙ্গালীর পক্ষে কেন, অনেক ইংরাজ বিচারপতির পক্ষেও দুর্লভ। প্রসিদ্ধ “অসতী” মোকর্দ্দমার বিচারে হাইকোর্টে এই নিষ্পত্তি হয় যে, হিন্দু-বিধবা অসতী হইলেও বিষয়চ্যুত হইবে না। এই বিচারের বিরুদ্ধে ফুল বেঞ্চের সমক্ষে আপিল করা হয়। দ্বারকানাথ ফুল বেঞ্চের অন্যতম জজ ছিলেন। সহ—বিচারকগণ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। কিন্তু দ্বারকানাথ ভিন্ন মত প্রকাশ করিয়া হিন্দু-ব্যবহারজ্ঞান ও যুক্তির প্রাখর্য্য যেরূপ বিশদভাবে দেখাইয়াছিলেন, তাহাতে দেশবাসিগণের নিকট তিনি অগণ্য প্রশংসাবাদের পাত্র হইয়াছিলেন। এই বিচার দ্বারকানাথের পীড়া ও মৃত্যুর অল্পদিন পূর্ব্বেই ঘটিয়াছিল। তিনি কয়েক মাস ধরিয়া কণ্ঠের ভিতর ক্ষয়রোগে পীড়িত হন। পীড়িতাবস্থায় ইনি জম্মস্থান দেখিবার ইচ্ছা করেন। পরিবর্ত্তনে মঙ্গল হইতে পারে এই ভাবিয়া চিকিৎসকগণ ইঁহার দেশ গমনে সম্মতি দেন। সেইখানেই ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দে ২রা মার্চ্চ দ্বারকানাথ দেহত্যাগ করেন। জীবনের শেষ ভাগ পর্য্যন্ত ইঁহার ___ হ্রাস হয় নাই। ইনি প্রত্যক্ষবাদী (Pori___এবং ফরাসী ভাষায় লিখিত এই ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠাতা কোম তের (comte) গ্রন্থগুলি মনোযোগের সহিত পাঠ করিয়াছিলেন। ইহাঁর মাতৃভক্তি অতুলনীয়। দেশে বিদ্যালয়, ও ডাক্তারখানা স্থাপন করিয়া এবং আরও অন্যান্যরূপে ইনি দানশীলতা এবং শিক্ষানুরাগ দেখাইয়া গিয়াছেন। উচ্চ গণিতে ও বিজ্ঞানেও ইঁহার বিশেষ পারদর্শিতা দৃষ্ট হইত। ইঁহার ইংরাজী ভাষাজ্ঞান ইংরাজগণেরও বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছিল। দ্বারকানাথ মিত্রের মত প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি বাঙ্গালীর মধ্যে বিরল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

কৃষ্ণদাস পাল।

 জন্ম ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দ। ওরিয়েণ্টাল সেমিনারি ও মেট্রোপলিটন কলেজে শিক্ষা প্রাপ্ত হইয়া ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বৃটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন নামক জমিদার সভার সহকারী সম্পাদকের পদে নিযুক্ত হন। অতঃপর এই সভার সম্পাদক হন (১৮৯৯ খৃষ্টাব্দ)। ইঁহার কার্য্যকালে সভায় বিশেষ উন্নতি সঞ্চিত হইয়াছিল। কিছুদিন পর কৃষ্ণদাস এই সভার মুখপত্র হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রের পরিচালনা-ভার প্রাপ্ত হইয়া ইহার প্রতিষ্ঠা অক্ষুণ্ন রাখিয়াছিলেন। কৃষ্ণদাস নানা কার্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন বট, কিন্তু কোন কার্য্যই অসম্পূর্ণ রাখিতেন না পরন্তু সকল কার্য্যই অতি সুচারুরূপে সম্পাদিত করিতেন। তিনি কলিকাতায় মিউনিসিপাল সভায় সদসা থাকিয়া ___ অনেক উন্নতি বিধান করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে ইনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার এবং ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে (খখন বাঙ্গালার প্রজা- সম্বন্ধীয় আইন বিধিবদ্ধ হইতেছিল) বড়লাটের ব্যবস্থাপক সভার অন্যতম সভ্যরূপে গবর্ণমেণ্ট কর্ত্তৃক মনোনীত হন। উভয় সভাতেই কৃষ্ণদাস সর্ব্বতোমুখী প্রতিষ্ঠা ও তেজস্বিতার বিশেষ পরিচয় দিয়াছিলেন। কি গবর্ণমেণ্টের উচ্চতম কর্ম্মচারিগণ, কি জমিদারগণ,কি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভদ্রলোকগণ, সকলেই সময়ে সময়ে কৃষ্ণদাসের পরামর্শ গ্রহণ করিতেন। সরকারী ও বেসরকারী সাহেবেরা ইঁহাকে যথেষ্ট ভক্তিশ্রদ্ধা করিতেন এবং ইঁহার অনুরোধে তাঁহারা অনেক বঙ্গবাসীর উপকার করিতেন। কৃষ্ণদাস নিজে অত্যন্ত আড়ম্বরশূন্য ছিলেন। তাঁহার কৃতজ্ঞতা যেরূপ, পরোপকারিতাও সেইরূপ ছিল। তাঁর বক্তৃতাশক্তি যেরূপ, লিখন-শক্তিও সেইরূপ ছিল। শব্দাড়ম্বর বা ভাষার সৌন্দর্য্য অপেক্ষা যুক্তি এবং প্রমাণ প্রয়োগাদি দ্বারা কিরূপে আলোচ্য বিষয় বিশদ ভাবে শ্রোতা বা পাঠকের হৃদয়ঙ্গম হইবে, সেই দিকেই তাঁহার অধিকতর দৃষ্টি ছিল। তিনি বলিতেন, রাজকর্ম্মচারিগণের সহিত সদ্ভাব রাখিয়া চলিলে তাঁহাদের নিকট হইতে যেরূপ কাজ পাওয়া যায়, চোখ রাঙাইয়া সেরূপ পাওয়া যায় না। কার্য্যতঃ সেইরূপই ঘটিত। ইনি সাহেবদের নিকট বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন বলিয়াই দেশের ও দেশবাসিগণের অনেক উপকার করিতে পারিয়াছিলেন। ইনি জমিদারগণের বন্ধু ও পরামর্শদাতা ছিলেন বটে, কিন্তু মধ্যবিত্ত বা নিম্নশ্রেণীর স্বত্ত্বের জন্য আপনার লেখনী বা জিহ্বার পরিচালনা করিতে কখনও বিস্মৃত হইতেন না। ইঁহার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও অসাধারণ ___ ছিল। ইলবার্ট বিল যখন বড়লাটের সভায় আলোচিত হয়, তখন কৃষ্ণদাস সেই সভায় জ্বলন্ত ভাষায় সেই বিলের সমর্থন করেন। ইলবার্ট সাহেব ইঁহার সম্বন্ধে বলিয়াছিলেন, ইনি বিখ্যাত বাগ্মী ও সাময়িক পত্রচালক। ইঁহার মত লোক যে দেশে যে কোন সময়ে যশেচিহ্ন রাখিয়া যাইতে পারিবে। ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে ইনি রায় বাহাদুর ও পর বৎসর সি. আই. ই উপাধি লাভ করেন। ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে ২০ জুলাই বহুমূত্র রোগে ইনি দেহত্যাগ করেন। কয়েক বৎসর পরে কলিকাতা হ্যারিসন রোড্ ও কলেজ স্ট্রীটের সংযোগস্থানে ইঁহার একটী প্রস্তরময়ী পূর্ণমূর্ত্তি স্থাপিত হয়। বঙ্গের ভূতপুর্ব্ব ছোটলাট স্যার রিচার্ড ট্যাম্পল “Men and events of my time in India" নামক স্বরচিত পুস্তকে লিখিয়াছেন—রাজা স্যার তাঞ্জোর মাধবরাও ব্যতীত আমি ভারতবর্ষে কৃষ্ণদাস পালের মত রাজনীতিজ্ঞ পুরুষ দেখিতে পাই নাই। স্বৰ্গীয় নগেন্দ্র নাথ ঘোষ (N. N. Ghose) মহাশয় Kristo Dass Paul, A study নামধেয় একখানি কৃষ্ণদাসের জীবনচরিত লিখিয়া গিয়াছেন। এই পুস্তকখানিতে কৃষ্ণদাসের রাজনৈতিক জীবনের একটী মূল্যবান্ বিশ্লেষণ আলোচিত হইয়াছে।

প্রতাপচন্দ্র সিংহ।

 ইনি স্বনামধন্য লালাবাবুর পুত্র শ্রীনারায়ণ সিংহের জ্যেষ্ঠ দত্তক পুত্র। ইনি পাইকপাড়ার রাজা বলিয়া বিখ্যাত। কলিকাতা মেডিকেল ফিভার হাসপাতাল___ তর হিতকর কার্য্যে সহায়তার জন্য ইনি গবর্নমেণ্ট কর্ততৃক ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দে রাজা বাহাদুর এবং আর, সি, এস, আই উপাধি দ্বারা বিভূষিত হইয়াছিলেন। বেলগেছিয়া জিলা নামক সুরম্য উদ্যান ইঁহার এবং ইঁহার কনিষ্ঠ (দত্তক) ভ্রাতা ঈশ্বর চন্দ্র সিংহের সম্পত্তি। এই বাগানেই উঁহাদের পুত্রগণের অধিকার কালে বর্ত্তমান ভারতসম্রাট্ যুবরাজরূপে ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে দেশীয়গণ কর্ত্তৃক নিমন্ত্রিত হইয়া আসেন। এই বাগানেই উভয় ভ্রাতার সঙ্গে ও মহাহাজ যতীন্দ্রমোহন প্রমুখ বন্ধুগণের সহায়তায় বাঙ্গালা নাটক অভিনীত এবং বাঙ্গালা ঐক্যতান- বাদন প্রণালী উদ্ভূত হয়। উহাই বর্ত্তমান সাধারণ নাট্যমঞ্চের সূত্রপাত বলিয়া পরিগণিত হয়। প্রতাপচন্দ্র চারি পুত্র রাখিয়া ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে ৩৯ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন। তাঁহাদের নাম গিরিশচন্দ্র, পূর্ণচন্দ্র, কান্তিচিন্দ্র ও শরচ্চত্র। এক্ষণে কেবল শরচ্চন্দ্রই জীবিত আছেন। তাঁহার পুত্রের নাম বীরেন্দ্র চন্দ্র। গিরিশচন্দ্র ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। সিংহ বংশের আদি নিবাস মুর্শিদাবাদ জেলাস্থ কাঁদি গ্রামে একটী হাঁসপাতাল পরিচালনার জন্য এক লক্ষ পঁচিশহাজার টাকা প্রদান করেন। পূর্ণচন্দ্র ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন ও ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে পরলোক গমন করেন। কান্তিচন্দ্র, ১৮৮০ খৃষ্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পুত্র ইন্দ্রচন্দ্র জীবনের শেষভাগে সন্ন্যাসিবেশ ধারণ করিয়া বোধানন্দনাথ স্বামী নাম গ্রহণ করেন। ১৮৯৪ ধৃষ্টাব্দে ৩৭ বৎসর বয়সে ইঁহার মৃত্যু হয়।

হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

 ১২৩০ সালে (খৃঃ ১৮২৪) কলিকাতার দক্ষিণ তবানীপুরে ইঁহার জন্ম হয়। ইঁহার পিতার নাম রামধন মুখোপাধ্যায়। বাল্যে দারিদ্র্য-নিবন্ধন ইঁহার বিদ্যাশিক্ষা সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় নাই কিন্তু প্রগাঢ় অধ্যবসায় ও তীক্ষ্ণ মেধার বলে পরে স্বীয় চেষ্টায় ইনি বিদ্যাশিক্ষায় সম্যক্ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। ইনি ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা মিলিটারী অডিটর জেনারেল কার্য্যালয়ে ২৫৲ টাকা বেতনের কার্য্যে প্রবিষ্ট হইয়া অল্পদিন মধ্যেই ১০০৲ শত টাকা বেতনের পদে উন্নীত হইয়াছিলেন। উত্তরকালে ঐ আফিসে ৪০০৲ শত টাকা বেতনে এসিষ্ট্যাণ্ট মিলিটারী অডিটার পদ প্রাপ্ত হন। ইঁহার লিখিবার শক্তি যথেষ্ট ছিল। “হিন্দুপেট্রিয়ট ইঁহার অসাধারণ কীর্ত্তি। ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দে ইনি একক এই পত্রিকার সম্পাদন তার প্রহণ করেন। এক সময়ে এই পত্র এতাধিক উন্নতি করিয়াছিল যে, ভারতের গভর্ণর জেনারেল লর্ড ক্যানিং বাহাদুর পর্যন্ত এই পত্র পাঠ করিবার জন্য আগ্রহান্বিত থাকিতেন। সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইনিই লেখনী সঞ্চালন দ্বারা বঙ্গবাসীকে রাজবিদ্রোহিতার ফল হইতে মুক্ত করেন এবং তাহাদিগকে একান্ত রাজভক্ত বলিয়া প্রকাশ করেন। তৎকালে নীলকরের অত্যাচারে বঙ্গদেশ বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। ইনি নির্ভীকভাবে স্বীয় পত্রিকায় সেই সকল অত্যাচার কাহিনী প্রকাশ করেন এবং নীল কমিশনে নীলকরদিগের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। নীলকরগণ ইঁহার নামে দেওয়ানি ও ফৌজদারী আদালতে নালিশ করে এবং তাহার ফলে ইঁহার মৃত্যুর পর ইঁহার বিষয় সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া দেয়। ব্যক্তিগত হিসাবে ইঁহার বিশেষ ক্ষতি হইয়াছিল বটে, কিন্তু একথা একরূপ নিশ্চয় বলা যাইতে পারে যে, ইঁহারই আলোচনার ফলে এদেশ হইতে নীলকরের অত্যাচার দূরীভূত হয়। ইঁহার মত পরিশ্রমী লোক সচরাচর দৃষ্ট হয় না। বিপন্নের উদ্ধারার্থ ইনি বুক দিয়া পড়িতেন। কি নিঃস্বার্থ পরোপকার, কি দেশহিতৈষণা, কি বিদ্যাবত্তা সকল বিষয়েই ইনি অসাধারণতার পরিচয় দিয়া গিয়াছেন। ১২৬৮ সালে ১২ই আষাঢ় (১৮৬১ খৃঃ ১৪ই জুন) এই মহানুভবের দেহত্যাগ হয়। ইঁহার স্মরণার্ধ বৃটীশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েসনের গৃহের নিম্নতলে হরিশ লাইব্রেরী নামে একটী পুস্তকাগার স্থাপিত হইয়াছে। ফ্রামজী বোমানজী নামক জনৈক পার্শী হরিশ্চন্দ্রের একখানি জীবনচরিত রচনা করিয়াছিলেন। (পুস্তকের নাম Lights and Shades of the East.)

মহাতাপ চাঁদ।

 বর্দ্ধমান রাজ্যের অধিপতি। ১৭৪৮ শকে বর্দ্ধমানাধিপতি তেজশ্চন্দ্র বাহাদুর ইঁহাকে দত্তকপুত্ররূপে গ্রহণ করেন। ইহার কিছুকাল পরে তেজশ্চন্দ্র পরলোক গমন করিলে রাজমহিষী কমলকুমারী দেওয়ানের সাহায্যে রাজকার্য্য নির্ব্বাহ করেন। পরে মহাতাপচাঁদ ১৭৬৫ শকে ২৩ বৎসর বয়সে রাজপদে অভিষিক্ত হন। ইঁহার সুশাসনে রাজ্যের অনেক উন্নতি হয়। ইনি এক সময় কাশীরামদাসী মহাভারত পাঠ করেন। কিন্তু তাহাতে পরিতৃপ্ত না হইয়া সভাসদ পণ্ডিত তারকনাথ তত্ত্বরত্ন মহাশয়ের মুখে মূল মহাভারতের ব্যাখ্যা শ্রবণ করিতে থাকেন। এই ব্যাখ্যা শ্রবণ করিতে করিতে মহাভারতের বিশুদ্ধ বঙ্গানুবাদ প্রকাশের জন্য ইঁহার অত্যন্ত আগ্রহ জন্মে এবং ইনি বহু পণ্ডিত নিযুক্ত করিয়া সমগ্র মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করাইয়া তাহা প্রকাশ করেন। ১৮০১ শকে ৫৯ বৎসর বয়সে ইঁহার পরলোক প্রাপ্তি হয়। ইঁহার রচিত বিবিধ বিষয়ক গান পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইয়াছে। রাজসরকারে ইঁহার প্রভূত প্রতিপত্তি ছিল। ইনি সম্মানসূচক “তোপ” পাইবার অধিকারী হইয়াছিলেন। ইনি ভিন্ন বর্ত্তমান সময়ে বঙ্গদেশীয় জমিদার শ্রেণীর মধ্যে কেহই এ সম্মান পান নাই। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার “ভারতেশ্বরী” উপাধি গ্রহণ উপলক্ষে ইনি মহারাণীর এক শ্বেত প্রস্তরময়ী মূর্তি সাধারণকে প্রদান করেন। তখনকার বড়লাট লর্ড লিটন এই মূর্ত্তিটী মহাসমারোহে কলিকাতা যাদুঘরে স্থাপন করেন। এখনও ঐ মূর্ত্তি সেখানে রহিয়াছে।

মদনমোহন তর্কালঙ্কার।

 প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও কবি। ১২২২ সালে নদীয়া জেলার অন্তঃপাতী বিল্বগ্রামে ইঁহার জন্ম হয়। ইঁহার পিতার নাম রামধন চট্টোপাধ্যায়। বাল্যে পাঠশালার শিক্ষা শেষ করিয়া ইনি সংস্কৃত কলেজে প্রবিষ্ট হন এবং তথায় ব্যাকরণ, সাহিত্য, দর্শন, স্মৃতিশাস্ত্র শিক্ষা করেন। কলেজে অধ্যয়ন কালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত ইঁহার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়। ___ ই ইনি সংস্কৃত রসতরঙ্গিণী ও বাসবদত্তার পদ্যানুবাদ করেন। শিক্ষাশেষে ইনি প্রথমে গবর্নমেণ্ট পাঠশালায় ১৫৲ টাকা বেতনে কার্য্য করেন। পরে যথাক্রমে বারাসত গবর্ণমেণ্ট বিদ্যালয়, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ এবং কৃষ্ণনগর কলেজে প্রধান পণ্ডিতের কার্য্যে নিযুক্ত হন। অতঃপর কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে ৯০৲ টাকা বেতনে সাহিত্যাধ্যাপকের কার্য্য করেন। কিন্তু কলিকাতার জলবায়ু অসহ্য হওয়ার ইনি ৫০৲ টাকা বেতনে মুর্শিদাবাদে জজ পণ্ডিতের কার্য্য গ্রহণ করেন এবং ছয় বৎসর এই কার্য্যে নিযুক্ত থাকিয়া শেষে ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট হন। ইঁহার রচিত প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ভাগ শিশুশিক্ষা সর্ব্বজন-বিদিত। ইনি ‘সর্ব্বশুভঙ্করী’ নামে একখানি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করিয়াছিলেন। ১২৬৪ সালে ফাল্গুন মাসে মুর্শিদাবাদ কান্দিতে বিসূচিকা রোগে ইনি প্রাণত্যাগ করেন।

দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ।

 বিখ্যাত “সোমপ্রকাশ” সংবাদপত্র-সম্পাদক ও বিবধ এই রচয়িতা। ইনি ১২২৭ সালে কলিকাতার দক্ষিণ পূর্ব্বস্থিত চাঙ্গড়িপোতা গ্রামে দাক্ষিণাত্য বৈদিককূলে জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার পিতার নাম হরচন্দ্র ন্যায়রত্ন। গ্রাম্য পাঠশালায় কিছুকাল অধ্যয়ন করিয়া দ্বারকানাথ স্বগ্রামে জনৈক আত্মীয়ের চতুষ্পাঠিতে সংস্কৃত শিক্ষা আরম্ভ করেন। পরে ইঁহার পিতা ইঁহাকে কলিকাতায় আনয়ন করিয়া সংস্কৃত কলেজে ভর্ত্তি করিয়া দেন। ১৮৪৫ খৃষ্টাব্দে শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ___ বিদ্যাভূষণ উপাধি প্রাপ্ত হন। পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে কিছুকাল অল্প বেতনে কার্য্য করিয়া সংস্কৃত কলেজে লাইব্রেরিয়ানের পদে নিযুক্ত হন। এবং শেষে সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হইয়া ২৮ বৎসর চাকরীর পর অবসর গ্রহণ করেন। ইঁহার পিতা একটী মুদ্রাযন্ত্র স্থাপন করিয়া যান। দ্বারকানাথ তাহা হইতে রোম ও গ্রীসের ইতিহাস নামক দুইখানি পুস্তক প্রকাশিত করেন। ইহার পর ইনি নীতিসার, বিশ্বেশ্বর বিলাপ এবং ভূষণসার ব্যাকরণ প্রভৃতি পুস্তকসমূহ প্রণয়ন ও প্রকাশ করেন। এই সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়, সারদাপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য নামক জনৈক কৃতবিদ্য বধির যুবকের জীবিকানির্ব্বাহের জন্য “সোম প্রকাশ” নামক একখানি সংবাদপত্র প্রকাশের সঙ্কল্প করেন, কিন্তু সারদাপ্রসাদ বর্দ্ধমান রাজবাটীতে মহাভারতের অনুবাদ কার্য্যে নিযুক্ত হওয়ায় উক্ত কার্য্য স্থগিত থাকে। ইহার কিছু দিন পরে দ্বারকানাথ প্রভৃতি কয়েক জন বন্ধুর উৎসাহে বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে নবেম্বর মাসে “সোমপ্রকাশ” প্রকাশিত করেন। দ্বারকানাথ উহার সম্পাদক হন। কিছুকাল পরে সোমপ্রকাশের সমস্ত ভারই দ্বারকানাথের উপর পড়ে। দ্বারকানাথও অসীম অধ্যবসায়ের সহিত মৃত্যুকাল পর্যন্ত ইহার পরিচালনা করেন। এই সোমপ্রকাশ এক সময়ে অতিশয় প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দে তদানীন্তন বড়লাট লর্ড লিটন বঙ্গীয় মুদ্রাযন্ত্র বিষয়ক আইন (Vernacular Press Act) বিধিবদ্ধ করিলে দ্বারকানাথ মুচলেকা দিতে অসম্মত হইয়া সোমপ্রকাশের প্রচার বন্ধ করেন। পরে লর্ড রিপন উক্ত আইন রহিত করিয়া দিলে সোমপ্রকাশ পুনঃ প্রকাশিত ___ মপ্রকাশ ব্যতীত “কল্পদ্রুম” নামক আর একখানি মাসিকও ইনি প্রকাশ করেন। ইনি অতিশয় শ্রমশীল ছিলেন। ব্রাক্ষণ-পণ্ডিত হইলেও ইনি কখনও কাহারও নিকট বিদায় বা বৃত্তি গ্রহণ করেন নাই। ইঁহার নিজব্যয়ে একটি বিদ্যালয় সংস্থাপিত হয়। স্বাস্থ্যের জন্য ইনি সাতারা নগরে যান। সেইখানে ১২৯১ সালে ৮ই ভাদ্র তারিখে বিস্ফোটক রোগে ইঁহার মৃত্যু হয়।

রামমোহন রায়।

 আধুনিক ব্রাহ্মধর্ম্মের প্রবর্ত্তক। ১৭৭৪ খৃষ্টাব্দে হুগলি জেলার অন্তঃপাতী রাধানগর গ্রামে ইঁহার জন্ম হয়। গ্রাম্য পাঠশালায় তৎকাল প্রচলিত বাঙ্গালা বিদ্যা শিক্ষা করিয়া ইনি আরবী ও পারশী শিক্ষার নিমিত্ত পাটনায় গমন করেন এবং অল্পকাল মধ্যেই ঐ দুই ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়া সংস্কৃত শিখিবার জন্য কাশীতে গমন করেন। অসাধারণ মেধা ও পরিশ্রমের গুণে রামমোহন উক্ত ভাষাতেও বিলক্ষণ জ্ঞান লাভ করিলেন। এই সময়ে তাঁহার বয়ঃক্রম যোড়শ বর্ষ মাত্র।

 অতঃপর রামমোহন স্বদেশে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন এবং প্রচলিত পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে স্বীর মত খ্যাপন করিতে লাগিলেন। এই সময়ে ইনি তৎসম্বন্ধে একখানি গ্রন্থও রচনা করেন। ইহাতে আত্মীয় স্বজনের সহিত ইঁহার মনোবাদ উপস্থিত হওয়ায় ইনি গৃহত্যাগ করিলেন এবং ধর্ম্মতত্ত্ব-জিজ্ঞাসু হইয়া নানাস্থানে ভ্রমণ করিতে করিতে তিব্বতে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু তথায় বৌদ্ধদিগের আচার ব্যবহারের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করায় রামমোহন তাহাদিগের বিরাগভাজন হইলেন এবং নানাপ্রকার অত্যাচার উৎপীড়ন সহ্য করিয়া পুনরায় স্বদেশে প্রত্যাগমন করিলেন। ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে পিতার মৃত্যু হইলে তিন সহোদরে পৈতৃক সম্পত্তি বিভাগ করিয়া লইয়া রামমোহন সংসারী হইলেন। কিন্তু বিষয়ের আয় হইতে ব্যয় নির্ব্বাহ হওয়া সম্ভবপর নয় দেখিয়া ইনি চাকরী অন্বেষণে বহির্গত হইলেন এবং রঙ্গপুরে কালেক্টারী অফিসে সামান্য বেতনে একটী কর্ম্ম পাইলেন; নিজ কার্য্যদক্ষতায় অতি অল্পদিনের মধ্যে ইনি সেরেস্তাদারের পদে উন্নীত হইলেন। এই সময়ে ইনি প্রভূত পরিশ্রম করিয়া ইংরেজী ভাষায় জ্ঞানলাভ করেন। কিছুদিন পর ইঁহার অগ্রজদ্বয়ের মৃত্যু হওয়ায় এবং তাঁহাদের সন্তানাদি না থাকায় রামমোহন সমস্ত পৈতৃক বিষয়ের অধিকারী হইলেন। এইরূপে গ্রাসাচ্ছাদনের চিন্তা হইতে মুক্ত হইয়া ইনি রাজকার্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করিলেন এবং কিঞ্চিৎকাল মুর্শিদাবাদে অবস্থিতি করার পর ৪০ বৎসর বয়ঃক্রম কালে কলিকাতায় আসিয়া বাস করিলেন।

 অতঃপর রামমোহন অনন্যচিত্ত ও অনন্যকর্ম্মা হইয়া ধর্ম্মালোচনায় প্রবৃত্ত হইলেন এবং ১৮২৭ খৃষ্টাব্দে কলিকাতায় ব্রাহ্মসমাজ সংস্থাপন করিলেন। কেবল তাহাই নহে, ইনি পূর্ব্বে যে সকল ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলেন, তদ্ভিন্ন উর্দ্দু, হিব্রূ, ফরাসী, গ্রীক এবং ল্যাটিন ভাষাতেও অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিলেন। এক্ষণে ইনি ইংরেজী প্রভৃতি ঐ সমস্ত ভাষা হইতে ধর্ম্ম-সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ সকল সঙ্কলন করিয়া বাঙ্গালা গদ্যে প্রকাশ করিতে লাগিলেন। বলিতে গেলে ইনিই প্রথম মার্জ্জিত বাঙ্গালা গদ্য লেখক, উত্তরকালীন লেখকগণ তাঁহারাই ভাষা অনুকরণ করিয়াছেন ___ হউক, এইরূপনূতন ধর্ম্মমত প্রচার করায় ইনি সাধারণ হিন্দুর নিকট “নাস্তিক” আখ্যা প্রাপ্ত হইলেন এবং তজ্জন্য ইঁহাকে নানাপ্রকার অত্যাচার উৎপীড়ন সহ্য করিতে হইল। কিন্তু তথাপি ইনি স্বীয় ধর্ম্ম-বিশ্বাস হইতে বিচলিত হইলেন না। উনি সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করিয়া এবং ঐ প্রথা রহিতকরণ বিষয়ে গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেণ্টিঙ্ক বাহাদুরের সহায়তা করিয়া স্বজাতীয়গণের অধিকতর বিরাগভাজন হইয়া পড়িয়াছিলেন।

 রামমোহন দিল্লীর সম্রাটের বিশেষ কার্য্যোপলক্ষে ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে ইংলণ্ডে গমন করেন। আধুনিক বাঙ্গালীদের মধ্যে ইনিই এই পথের প্রদর্শক। বিলাতে যাইবার পূর্ব্বে সম্রাট ইঁহাকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করিয়াছিলেন। সম্রাটের কার্য্য সমাধান্তে ১৮৩২ খৃষ্টাব্দে ইনি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারি নগরে গমন করেন এবং তথাকার রাজার নিকট বিলক্ষণ সমাদর প্রাপ্ত হন। পর বৎসর ইনি ইংলণ্ডে প্রত্যাগত হইয়া বৃষ্টল নগরে জনৈক বন্ধু ভবনে অবস্থিতি করিবার সময় পীড়িত হন এবং সেই রোগেই ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে ২৭শে সেপ্টেম্বর কালগ্রাসে পতিত হন। বৃষ্টল নগরেই ইঁহার সমাধি হয়।

কিশোরী চাঁদ মিত্র।

 জন্ম ১৮২২ খৃষ্টাব্দ মে মাস। কিশোরী চাঁদ হেয়ার স্কুল ও হিন্দু কলেজে শিক্ষিত হইয়া ১৮৪৬ খৃষ্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটির সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ইনিই ‘কলিকাতা রিভিউ’নামক পত্রের প্রথম বাঙ্গালী ___ এই পত্রিকায় ইঁহারই রচিত রামমোহন রায় শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করিয়া হ্যালিডে সাহেব (যিনি পরে বঙ্গের ছোট লাট হইয়াছিলেন) ইঁহাকে ডাকাইয়া আনেন এবং রাজশাহীর ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট পদে নিযুক্ত করেন। পরে ইঁহাকে কলিকাতায় আনাইয়া সহরের জুনিয়ার ম্যাজিষ্ট্রেটের পদে বসাইয়া দেন। এই সময়ে ইঁহারই অধীনে মাইকেল মধুসূদন দত্ত দ্বাভাষীর পদে কিছুদিনের জন্য কার্য্য করেন। কিশোরী চাঁদ এই কার্য্য হইতে অবসর লইতে বাধ্য হইয়া সাহিত্যক্ষেত্রে নিজ শক্তির পরিচালনা করেন। ইনি ‘ইণ্ডিয়ান্ ফিল্ড’ নামক একখানি সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশ করিতেন। এই পত্র উত্তরকালে হিন্দু-পেট্রিয়ট পত্রের সহিত মিলিত হয়। কলিকাতা রিভিউ পত্রের অনেক প্রবন্ধ কিশোরী চাঁদ কর্ত্তৃক লিখিত হইত। টেরিটোরিয়াল এরিষ্টোক্রেসি অব্ বেঙ্গল (Territorial Aristocracy of Bengal) অর্থাৎ বঙ্গের জমিদারগণ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রবন্ধ ইঁহারই লেখনীসম্ভূত এবং অনুসন্ধান ও অধ্যবসায়ের ফল। দ্বারকানাথ ঠাকুরের একখানি জীবনচরিত ইনি প্রণয়ন করেন। রাজনৈতিক ব্যাপারেও ইনি যোগদান করিতেন এবং সাধারণ সভায় সময়ে সময়ে বক্তৃতাও করিতেন। ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দে ৬ই আগষ্ট ইনি দেহত্যাগ করেন। কিশোরী চাঁদ প্যারিচাঁদ মিত্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন। কিন্তু ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য অনেক। প্যারিচাঁব্দ আধ্যাত্মিক ভাবাপন্ন ছিলেন। কিশোরী চাঁদ অনেকটা জড়বাদীর ন্যায় দৃষ্ট হইতেন।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

 প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্ত্তক। ইনি ১৮১৭ খৃষ্টাব্দে কলিকাতার বিখ্যাত ঠাকুরবংশে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি দ্বারকানাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। শৈশবে দেবেন্দ্রনাথ মহাত্মা রামমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে অধ্যয়ন করেন, এবং পরে চতুর্দ্দশ বর্ষ বয়সে হিন্দু কলেজে প্রবিষ্ট হন। শৈশবে ইনি পিতামহী কর্ত্ত্রৃক পালিত হইয়াছিলেন, এজন্য তাঁহার প্রতিই সমধিক অনুরক্ত ছিলেন। ইঁহার অষ্টাদশ বর্ষ বয়ঃক্রম কালে পিতামহীর মৃত্যু হয়। অন্যান্য লোকের সহিত দেবেন্দ্রনাথও তাঁহার দাহকার্য্যের জন্য শ্মশানে গমন করেন। এই সময়েই ইঁহার মনোমধ্যে বৈরাগ্যভাবের উদয় হয় এবং সত্য তত্ত্ব কি তাহা জানিবার জন্য আগ্রহ উপস্থিত হয়। এই সময়ে সহসা ঈশোপনিষদের একখানি ছিন্ন পত্রে একটী শ্লোক পড়িয়াই ইঁহার হৃদয়ে একেশ্বরবাদের উদয় হয় এবং রামমোহন রায়ের সহিত যোগ দিয়া ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রচারে মনোযোগী হন। এজন্য ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে হিন্দুশাস্ত্রান্তৰ্গত ব্রহ্ম-প্রতিপাদক তত্ত্বসমূহের বহুল প্রচারার্থ তত্ত্ববোধিনী নামক সভা স্থাপন করেন; এবং পরে তত্ত্ববোধিনী নামক এক মাসিক পত্রিকায় উক্ত ধর্ম্ম প্রচার করিতে থাকেন। প্রথম অক্ষয় কুমার দত্ত ইহার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দে ১৮ জন সভ্যের সহিত ইনি প্রতিজ্ঞা পত্রে স্বাক্ষর পূর্ব্বক ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। পূর্ব্বে ব্রাহ্ম সভায় কোনরূপ উপাসনাদির পদ্ধতি ছিল না, কেবল তথায় উপনিষদের শ্লোক পাঠ ও ব্যাখ্যা হইত। দেবেন্দ্রনাথই তথায় উপাসনা পদ্ধতি প্রচলন করেন এবং ___ একটী প্রার্থনাও প্রস্তুত করিয়া দেন। অতঃপর ইনি ব্রাহ্ম ধর্ম্মগ্রন্থ রচনা করেন। তাহাতে ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীদিগের কর্ত্তব্যাদি বহুবিধ বিষয় সন্নিবিষ্ট হয়। ইঁহার ধর্ম্ম প্রাণতায় মুগ্ধ হইয়া ব্রাহ্মগণ ইঁহাকে মহর্ষি উপাধিতে ভূষিত করেন। অতঃপর ইনি মাষুরি পর্ব্বতে গমন করিয়া তথায় চারি বৎসর কাল নির্জ্জনে ব্রহ্ম-সাধনায় নিযুক্ত থাকেন। জীবনের শেষ কয়েক বৎসর একরূপ সংসারত্যাগী হইয়া পারিবারিক বাটী হইতে দূরে অবস্থান করিতেন। ইনি নিম্নলিখিত পুস্তকগুলি প্রণয়ন করেন—ব্রহ্মধর্ম্ম তাৎপর্য্য সহিত ১ম ও ২য় খণ্ড, ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যান, ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস, উপদেশাবলী, ব্রাহ্মসমাজের বক্তৃতা, বক্তৃতাবলী, জ্ঞান ও ধর্ম্মের উন্নতি, পরলোক ও মুক্তি, উপহার, আত্মজীবনী। এতদ্ব্যতীত তিনি ঋগ্বেদের বঙ্গানুবাদ এবং উপনিষদের সংস্কৃত ও বাঙ্গালায় বৃত্তি রচনা করেন; ইঁহার দানশীলতাও যথেষ্ট ছিল। ইনি সংস্কৃত, বাঙ্গালা, ইংরাজি ও পারস্য ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। ১৯০৫ খৃষ্টাগে ১৯শে জানুয়ারী তারিখে ইনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

 কলিকাতা তালতলনিবাসী প্রসিদ্ধ ডাক্তার। ইনি বারাকপুরের নিকট পৈতৃক বাসস্থান মণিরামপুর গ্রামে,১৮১৯ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। দশ বৎসর বয়সে হিন্দু কলেজে শিক্ষার্থ প্রবিষ্ট হন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে ইনি সতী___পেক্ষা ইতিহাস ও গণিতে অধিকতর পারদর্শিতা দেখান। পরে বিবাহিত হইয়া অনিচ্ছাসত্ত্বে পিতৃ কর্ত্তৃক সল্ট বোর্ডের (Salt Board) অধীনে একটী সামান্য কর্ম্মে নিয়োজিত হন। দুর্গাচরণ এক দিন উক্ত বোর্ডে দেওয়ান স্বনামখ্যাত দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া নিজের পাঠতৃষ্ণার অতৃপ্ততার কথা জ্ঞাত করেন। দ্বারকানাথ দুর্গাচরণের পিতাকে ডাকাইয়া পুত্রকে আবার হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের জন্য প্রেরণ করিতে বলেন। কলেজে প্রেরণ করা হইল বটে, কিন্তু অর্থের অসচ্ছলতা হেতু দুই এক বৎসর থাকিয়া শিক্ষা সমাপ্ত না করিয়া দুর্গাচরণ কলেজের শিক্ষা বন্ধ করিতে বাধ্য হন। এই সময় সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ পাঠে দুর্গাচরণ, অধিকতর মনোনিবেশ করিলেন। দুর্গাচরণ ২১ বৎসর বয়সে হেয়ার সাহেবের ইংরাজী বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শিক্ষকের পদ গ্রহণ করিলেন এবং সাহেবের অনুমতি লইয়া প্রত্যহ দুইঘণ্টা কাল মেডিকেল কলেজে যাইয়া ডাক্তারী বিদ্যা শিখিতে লাগিলেন। ডাক্তারী শিক্ষার কারণ নিয়ে বিবরিত করা হইল। একদিন বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা কালে শুনিলেন যে, ইঁহার স্ত্রী কঠিন রোগাক্রান্ত হইয়াছেন। তৎক্ষণাৎ গৃহে আসিয়া দেখিলেন যে রোগীর অবস্থা বড়ই মন্দ। তখনই ডাক্তার অন্বেষণে বহির্গত হইলেন, কিন্তু ডাক্তার সঙ্গে করিয়া আসিবার পূর্ব্বেই রোগী প্রাণত্যাগ করে। দুর্গাচরণ ভাবিলেন যে, ঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা না হওয়াতে তাঁহার স্ত্রীর প্রাণবিয়োগ ঘটে। সেই সময় হইতেই ইনি পিতার অমতেও চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষায় যত্নবান্ হইলেন। জোন্স সাহেব হেয়ার স্কুলের অধ্যক্ষ হইয়া দুর্গাচরণকে যে প্রত্যহ দুইঘণ্টা সময় অবসর দেওয়া হইত, ত___য়া দিলেন। দুর্গাচরণ অতঃপর শিক্ষকতা কার্য্য ত্যাগ করিয়া চিকিৎসা বিদ্যায় সমস্ত সময়ই নিযুক্ত করিলেন। ইনি পাঁচবৎসর কাল মেডিকেল কলেজে শিক্ষা করেন। এই সময়ে বহুবাজারের নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায় সাংঘাতিক রূপে রোগাক্রান্ত হন। সকল চিকিৎসক রোগীর জীবনাশা ত্যাগ করিলে দুর্গাচরণকে ডাকা হইল। ইনি যে ঔষধ ব্যবস্থা করিলেন, তাহা নবাগত সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার জ্যাকসনকে দেখান হইল; তিনি ঐ ব্যবস্থার অনুমোদন করিলেন। অল্প সময়ে রোগীর অবস্থা ভাল হইয়া আসিল দেখিয়া সাহেব আনন্দিত হইলেন এবং দুর্গাচরণকে ডাকাইয়া তাঁহার করমর্দ্দন করিয়া বলিলেন, তুমি নেটীভ জ্যাকসন্। সেই সময় হইতে দুর্গাচরণের প্রতিপত্তি চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ হইয়া পড়িল। নীলকমল বাবু আরোগ্য লাভ করিলে পর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রভৃতি বন্ধুর অনুরোধে দুর্গাচরণ ৮০৲ টাকা বেতনে কলিকাতা কেল্লার খাজাঞ্জির পদ গ্রহণ করিলেন। কিন্তু সকালে, বৈকালে ও অবসর দিনে ইনি ডাক্তারী ব্যবসায় করিতে পারিবেন এরূপ ব্যবস্থা করিয়া লওয়া হইল। কিছুদিন পরে এ কার্য্য ত্যাগ করিয়া ৩৪ বৎসর বয়সে কেবল মাত্র চিকিৎসা ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন। এই সময়ে ইঁহার নামডাক এতই হইয়াছিল যে, যাহারা ইঁহার চিকিৎসার সাহায্য পাইতেন, তাঁহারা মনে করিতেন যে স্বয়ং ধন্বন্তরীকে পাইলেন। ইনি এ ব্যবসায়ে যে নিপুণতা দেখাইয়াছিলেন ও সফলতা লাভ করিয়াছিলেন, তাহা বাঙ্গালা দেশে চিকিৎসক-ইতিহাসে দুর্লভ। ন্যূনাধিক ১০ বৎসর ব্যবসায় করিয়া ইনি লক্ষ টাকা উপার্জ্জন করিয়াছিলেন। কি ধনী, কি নির্ধন, যে কেহ ইঁহার চিকিৎসা-প্রার্থী হইতেন, ইনি স__ সময়েই তাহার প্রার্থনা পুরণ করিতেন। আহার ও পরিচ্ছদ বিষয়ে ইঁহার কিছুমাত্র আড়ম্বর ছিল না। স্বাস্থ্যভঙ্গ বশতঃ জীবনের শেষ ভাগে ইনি চিকিৎসা ব্যবসায় হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছিলেন। এই সময়ে ইনি অনেক মানসিক কষ্ট ভোগ করিতেছিলেন। কারণ যদিও এই সময়ে ইঁহার মধ্যম পুত্র (এক্ষণে ভারতবিখ্যাত) সুরেন্দ্রনাথ সিবিল সার্ব্বিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন, কিন্তু বয়োধিক্য জন্য তাঁহাকে নির্ব্বাচিত করা হইবে না এইরূপ কথাবার্ত্তা চলিতেছিল। দুর্গাচরণের মৃত্যুর পূর্ব্ব সপ্তাহে পুত্রের পত্রে অবগত হইয়াছিলেন যে, বিচার ফল তাঁহার অনুকুল হইবার আশা আছে। ইহাতে দুর্গাচরণ কিঞ্চিৎ শান্তচিত্ত হইয়াছিলেন। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে ১৬ই ফেব্রুয়ারি ইনি হঠাৎ নিউমোনিয়া যুক্ত জ্বরাক্রান্ত হন এবং ২২শে তারিখে মানবলীলা সংবরণ করেন। মৃত্যুর একঘণ্টা পরে সংবাদ আসে যে, সুরেন্দ্রনাথ বিজয়ী হইয়াছেন। দুর্গাচরণের আর এক পুত্র জিতেন্দ্রনাথ ব্যারিষ্টার ব্যবসায়ী হইয়াছেন; শারীরিক বলের জন্য ইঁহার প্রসিদ্ধি আছে।

দিগম্বর মিত্র।

 (রাজা)। ১৮১৭ খৃষ্টাব্দে কোন্নগর গ্রামে জন্ম। বাল্যকালে ইনি কলিকাতা শ্যামপুকুরে পিতা শিবচরণ মিত্রের নিকট থাকিয়া হেয়ার স্কুলে ও হিন্দু কলেজে শিক্ষালাভ করেন। প্রথমে ইনি মুর্শিদাবাদে কালেকটরের অধীনে আমীনের কার্য্য করেন, পরে কাশীমবাজারের ___থের গৃহশিক্ষকরূপে নিযুক্ত হন। রাজা প্রীত হইয়া ইঁহাকে কাশিমবাজারের বিপুল রাজসম্পত্তির ম্যানেজারপদে উন্নীত করেন। তৎকালে কোনও সাময়িক পত্রে এই কথা প্রচারিত হয় যে, রাজা কৃষ্ণনাথ দিগম্বরকে লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন। কথাটা বাস্তবিক সত্য নহে, কিন্তু রাজা এই সংবাদ পাঠান্তে সভ্য সত্যই, দিগম্বরকে লক্ষ টাকা দান করিলেন। এই টাকা মূলধন করিয়া দিগম্বর নীল ও রেসমের ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন। প্রথম প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হইলেন বটে, কিন্তু স্বীয় বুদ্ধিবলে উত্তরকালে লাভ হইয়া ২৪ পরগণা, যশোহর, বাখরগঞ্জ ও কটক জেলার জমিদারী ক্রয় করিলেন। ১৮৫১ খৃষ্টাব্দে ইনি বৃটীশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশনে সহকারী সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত হন। পরে এই সভার সভাপতি হইয়াছিলেন। ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে সংক্রামক জ্বরের কারণ অনুসন্ধান উদ্দেশ্যে একটি কমিশন গঠিত হয়। দিগম্বর ইহার অন্যতম সদস্য থাকিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন যে, রেলওয়ে হইয়া মাটীর স্বাভাবিক পয়ঃপ্রণালী অবরুদ্ধ হওয়াতে ম্যালেরিয়া জ্বরের উৎপত্তি হইয়াছে। মতটী তখন গৃহীত হয় নাই, কিন্তু উত্তরকালে ইহার সত্যতা অনেকেই উপলব্ধি করিয়াছেন। ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষের সময় দিগম্বর গভর্ণমেণ্টকে অনেক সাহায্য করিয়াছিলেন। ইনি ক্রমান্বয়ে তিনবার বঙ্গের ছোটলাট কর্ত্তৃক বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় সদস্যরূপে মনোনীত হন। ইনি ১৮৭৪ খৃষ্টাকে কলিকাতার সরিফ পদে অধিষ্ঠিত হন। বাঙ্গালীদিগের মধ্যে ইনিই প্রথম এই পদ লাভ করেন। ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে ১লা জানুয়ারী ইনি যুবরাজ (স্বর্গীয় সম্রাট্ এওয়ার্ড) সমক্ষে প্রকাশ্য দরবারে সি, এস, আই উপাধি দ্বারা ভূষিত হন। পর বৎসর ১৮৭৯ ___ এপ্রেল ইঁহার দেহত্যাগ ঘটে। ঠিক ঐ দিনে ইনি রাজা উপাধি লাভ করেন। জমিদারী ও রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে ইঁহার ভূয়োদর্শন ছিল।


জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়।

 জন্ম ১৮০৮ খৃষ্টাব্দে। ১৮২৫ খৃষ্টাব্দে ইনি সৈনিক বিভাগে কেরাণীর কার্য্য লইয়া ভরতপুরে গমন করেন। ভরতপুর অবরোধ সময় ইনি সেইখানে উপস্থিত ছিলেন এবং লুণ্ঠিত অর্থের অংশীও হইয়াছিলেন। অনন্তর ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে হুগলী কালেক্টারীতে রেকর্ড কিপারের কার্য্য করেন। ইনি উত্তরকালে অনেক জমিদারী সম্পত্তি ক্রয় করেন। জয়কৃষ্ণ ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে ৩১ মার্চ্চ জাল করা অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। বিলাত আপীলে নিম্ন আদালতের রায় রহিত হইল না বটে, প্রিভি কাউন্‌সিলের বিচারকগণ ইঁহার নির্দোষিতা সম্বন্ধে এরূপ যুক্তিপূর্ণ মন্তব্য লিখিয়াছিলেন যে, তাহার ফলে গবর্ণমেণ্ট অবিলম্বে ইঁহাকে কারামুক্ত করিয়া দেন। বৃটীশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েসন প্রতিষ্ঠা কার্য্যে ইনি অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। যাহাতে ইঁহার উন্নতি সাধন হয়, সে জন্য ইনি আজীবন চেষ্টিত ছিলেন। ইঁহার বিষয়বুদ্ধি অত্যন্ত প্রখর ছিল, এবং জমিদারী পরিচালনা কার্য্যে ইঁহার অসাধারণ নৈপুণ্য লক্ষিত হইত। ৭০ বৎসর বয়ঃক্রম কালে ইনি সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হইলেও সাধারণ কার্য্যে সহায়তা করিতে, এমন কি সাধারণ সভায় উপস্থিত হইতেও বিরত হইতেন না। ১৮৮৮ খৃষ্টাব্দে ইঁহার মৃত্যু হয়। রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় ইঁহারই সুযোগ্য পুত্র। জয়কৃষ্ণ নিজ বাসস্থান উত্তরপাড়ায় একটী বিদ্যালয় ও একটী সাধারণ পাঠাগার স্থাপন করিয়া পল্লীবাসীদিগের স্বপেষ্ট উপকার করিয়া গিয়াছেন।


আনন্দ কৃষ্ণ বসু।

 ইনি ১৭৪৪ শকে ১৬ই ভাদ্র জন্মগ্রহণ করেন। কলিকাতা শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব মহাশয় ইঁহার মাতামহ। আনন্দ কৃষ্ণ সমস্ত জীবন সাহিত্য সেবায় অতিবাহিত করেন। নানা বিদ্যানুশীলনই ইঁহার একমাত্র প্রিয়পদার্থ ছিল। বিশেষতঃ ইনি ইংরাজী ও সংস্কৃত দর্শনশাস্ত্রের বিশেষ আলোচনা করিতেন। বহু কৃতবিদ্য ব্যক্তির প্রথম শিক্ষা আনন্দকৃষ্ণের নিকট আরব্ধ হয়। Shakespeare বা অন্য ইংরাজ গ্রন্থকারের পুস্তক অধ্যয়নে অনেকেই ইহার সাহায্য পাইয়াছেন। প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় আনন্দকৃষ্ণের নিকট ইংরাজী ভাষা অধ্যয়ন করিতেন। বিষয় কর্ম্মেও ইনি অতিশয় বুদ্ধিমান ছিলেন। অনেকেই বিষয় কর্ম্ম সম্বন্ধে ইঁহার নিকট পরামর্শ গ্রহণ করিতেন। ইঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র নগেন্দ্রনাথ বসু Paper Currency আফিসের দেওয়ান ছিলেন। সম্প্রতি ইঁহার মৃত্যু হইয়াছে। ১৮৯৭ সালের জুন মাসে আনন্দকৃষ্ণ পরলোক গমন করিয়াছেন।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

 বঙ্গের সুপ্রসিদ্ধ কবি। হুগলি জেলার অন্তঃপাতী গুলিটা নামক গ্রামে ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দে ইঁহার জন্ম হয়। তাঁহার পিতার নাম কৈলাস চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। হেমচন্দ্র বাল্যকালে গ্রাম্য-পাঠশালায় গুরুমহাশয়ের নিকট তৎকাল-প্রচলিত শিক্ষা লাভ করেন। পরে বিংশতি বর্ষ বয়ঃক্রমকালে খিদিরপুরে আসিয়া হিন্দুকলেজে প্রবিষ্ট হন ও তৎপরে উক্ত বিদ্যালয় প্রেসিডেন্সি কলেজে পরিণত হইলে তাহাতেও অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় ইনি বৃত্তিসহ উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন।

 কিছু দিন পরে হেমচন্দ্রকে বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়া বিষয়কর্ম্মে প্রবিষ্ট হইতে হয়। সেই সময় ইনি বি, এ, ও বি, এল্ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অনন্তর কিছুদিন মুন্‌সেফের পদে কার্য্য করিয়া ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে কলিকাতার হাইকোর্টে ওকালতী করিতে আরম্ভ করেন। এই কার্য্যে বিদ্যা, বুদ্ধি, সাধুতা, বিচক্ষণতা ও কার্য্যকুশলতার পরিচয় প্রদান করিয়া বিলক্ষণ যশস্বী হইয়াছিলেন এবং যথেষ্ট অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত মুক্তহস্ত হওয়ায় কিছুই সঞ্চয় করিতে পারেন নাই। শেষ দশায় অন্ধ হইয়া ইনি বিশেষ কষ্ট পাইয়াছিলেন। এমন কি ইঁহাকে অন্যের অর্থ সাহায্যের উপর নির্ভর করিতে হইয়াছিল। অতঃপর ইনি ভবযন্ত্রণা হইতে অব্যাহতি লাভ করেন।

 হেমচন্দ্র একজন স্বভাব কবি। ইনি মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্যের টীকা রচনা ও সমালোচনা করিয়া স্বকীয় বিদ্যাবুদ্ধি ও কাব্যপ্রিয়তার প্রকৃষ্ট পরিচয় প্রদান করেন। মধুসূদনের পর ইনি কাব্যোচ্ছ্বাসে বঙ্গবাসীকে মোহিত করিয়াছিলেন। ইঁহার নূতন নূতন ছন্দোবন্ধে ও সুললিত ভাষায় বঙ্গীয় পাঠকগণ যেন মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া পড়িত। মধুসূদনের অকাল মৃত্যুতে বঙ্গীয় কবি সিংহাসন শূন্য ___ গুণগ্রাহী বঙ্কিমচন্দ্র ইঁহাকে সেই সিংহাসনে স্থাপন করেন। ইঁহার রচিত কবিতাগ্রন্থের মধ্যে চিন্তাতরঙ্গিণী, বৃত্রসংহার কাব্য, ছায়াময়ী, দশমহাবিদ্যা, বীরবাহুকাব্য ও কবিতাবলী সমধিক প্রসিদ্ধ। এতদ্ভিন্ন ইনি বহুতর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতা রচনা করিয়া গিয়াছেন। সে গুলি অতুলনীয়।

দীনবন্ধু মিত্র।

 বঙ্গের খ্যাতনামা নাটককার। পিতার নাম কালাচাঁদ মিত্র। নদীয়া জেলার অন্তঃপাতী চৌবেড়িয়া গ্রামে ১৮২৯ খৃষ্টাব্দে দীনবন্ধুর জন্ম হয়। ইনি শৈশবে গ্রাম্য পাঠশালায় লেখাপড়া শিক্ষা আরম্ভ করিয়া পরে হুগলি কলেজে ও অবশেষে কলিকাতার হিন্দু কলেজে পাঠ সমাপ্ত করেন।

 ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দে দীনবন্ধু বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়া ডাকবিভাগের কার্য্যে প্রবিষ্ট হন, এবং অতি অল্পকাল মধ্যে শ্রমশীলতার ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় প্রদান করিয়া ১৫০৲ টাকা বেতনে ডাকবিভাগের অন্যতম তত্ত্বাবধায়ক (Superintendent) নিযুক্ত হন। এই পদে ইনি ক্রমশঃ উন্নতিলাভ করিয়া প্রথম শ্রেণীর কর্ম্মচারী হইয়াছিলেন। ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে ইনি ডাকবিভাগের কর্ত্ত হইয়া লুসাই যুদ্ধে গমন করেন। ইঁহার কার্য্যদক্ষতায় সন্তুষ্ট হইয়া ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে গবর্ণমেণ্ট ইঁহাকে “রায় বাহাদুর” উপাধি প্রদান করেন। ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দের ১লা নবেম্বর বহুমূত্ররোগে ইঁহার মৃত্যু হয়।

 ছাত্রাবস্থা হইতে দীনবন্ধু বাঙ্গালা কবিতা রচনা করিতেন। তাৎকালিক প্রসিদ্ধ প্রভাকর-সম্পাদক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সহিত ইঁহার বিশেষ পরিচয় ছিল। পাঠ্যাবস্থায় ইনি মধ্যে মধ্যে কবিতা লিখিয়া প্রভাকর পত্রে প্রকাশ করেন। ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে দীনবন্ধু “নীলদর্পণ” নাটক রচনা করেন। এই নাটক ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে লঙ সাহেব ইংরাজীতে অনুবাদ করায় দেশমধ্যে হুলস্থূল পড়িয়া যায়। ইহার জন্য লঙ সাহেবের কারাদণ্ড পর্য্যন্ত হয়। যাহা হউক, এই নীলদর্পণের ফলে চক্ষু সমধিক প্রস্ফুটিত হওয়ায় নীলকরদিগের অত্যাচার অনেক পরিমাণে কমিয়া যায়। অতঃপর দীনবন্ধু, “নবীন তপস্বিনী,” “সধবার একাদশী,” “লীলাবতী” “কমলে কামিনী” প্রভৃতি নাটক, “জামাই বারিক” প্রভৃতি প্রহসন এবং “দ্বাদশ-কবিতা” ও “সুরধুনী কাব্য” নামক পদ্যগ্রন্থ প্রণয়ন করেন। রাজকার্য্য উপলক্ষে ইনি নানাদেশ ভ্রমণ করিয়া সেই সেই দেশবাসিগণের ভাষা ও আচার ব্যবহার সম্বন্ধে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন, ইঁহার রচিত গ্রন্থসমূহে সেই অভিজ্ঞতা, ইনি প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করিয়াছেন। ইঁহার নাট্যাদিতে সন্নিবেশিত অনেক ঘটনা ও চরিত্র প্রকৃতমূলক। হাস্যরসে দীনবন্ধুর সমকক্ষ বঙ্গভাষার,লেখকদিগের মধ্যে নাই বলিলেও হয়। ইনি “বঙ্গদর্শন” পত্রিকায় কয়েকটা কবিতা ও গল্প লিখিয়াছিলেন। ইঁহার পুত্রগণ সকলেই কৃতবিদ্য ও ভাল চাকুরী করেন।

রসিকচন্দ্র রায়।

 প্রসিদ্ধ পাঁচালিকার ও সঙ্গীত রচয়িতা। ১২২৭ সালে মাতুলালয় পালাড় গ্রামে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার পিতার নাম রামকমল রায়। দশবৎসর বয়স হইতেই ইনি কবিতা রচনা আরম্ভ করেন। ইনি হরিভক্তি চন্দ্রিকা, কৃষ্ণপ্রেমাঙ্কুর, বর্দ্ধমান-চন্দ্রোদয়, পদাঙ্কদূত, শকুন্তলা বিহার, দশমহাবিদ্যা-সাধন প্রভৃতি অনেক গুলি গ্রন্থ রচনা করেন। তদ্ভিন্ন ইনি যাত্রাওয়ালা, কীর্ত্তনওয়ালা, কবিওয়ালা প্রভৃতিকে অনেক গান বাঁধিয়া দিতেন। ইঁহার প্রণীত একাদশ খণ্ড পাঁচালি ও বহুসংখ্যক গান আছে। ইঁহার পিতা মাতামহ-সম্পত্তি প্রাপ্ত হইয়া হুগলী শ্রীরামপুরের নিকটবর্ত্তী বড়া গ্রামে আসিয়া বাস করেন। ইঁহাদের বাসভবনের নিকটে একটী সুন্দর পুষ্পোদ্যান ছিল। রসিকচন্দ্র এই উদ্যানবাটীতে একাকী থাকিতে ভালবাসিতেন। দশরথী রায়ের সহিত ইঁহার অতিশয় সৌহার্দ্দ ছিল। ১৩০০ সালে ইঁহার দেহান্তর হয়।

অক্ষয়কুমার দত্ত।

 বাঙ্গালার একজন প্রসিদ্ধ গ্রন্থকর্ত্তা। তিনভাগ চারুপাঠ, বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার, পদার্থবিদ্যা, ধর্ম্মনীতি, দুইভাগ ভারতীয় উপাসকসম্প্রদায় প্রভৃতি ইঁহারই রচিত। ১৮২১ খৃষ্টাব্দে নবদ্বীপের অদূরবর্তী চুপিগ্রামে পীতাম্বর দত্তের ঔরসে ও দয়াময়ীর গর্ভে ইঁহার জন্ম হয়। ইনি বাল্যকালে গ্রামে পাঠশালায় বিদ্যাশিক্ষা করেন। অনন্তর দশম বর্ষ বয়ঃক্রম সময়ে ইংরেজি শিক্ষা করিবার জন্য ইনি কলিকাতায় ওরিয়েণ্ট্যাল সেমিনারীতে প্রবিষ্ট হন। এয়োদশ বর্ষ বয়ঃক্রম সময়ে ইঁহার পিতার মৃত্যু হয়, সুতরাং পরিবার প্রতিপালনের জন্য এই অল্প বয়সেই ইঁহাকে বাধ্য হইয়া অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টা দেখিতে হয়।

 তত্ত্ববোধিনী সভার অধীনে একটী পাঠশালা ছিল। উনিশ বৎসর বয়সে অক্ষয়কুমায় মাসিক ৮৲ বেতনে ঐ পাঠশালার শিক্ষক নিযুক্ত হন। অনন্তর ইনি স্বীয় প্রভূত চেষ্টা দ্বারা বিদ্যাবিষয়ে যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। পরে তত্ত্ববোধিনী-পত্রিকার সম্পাদকের পদ শূন্য হইলে অক্ষয়কুমার ঐ পদে অধিষ্ঠিত হইয়া স্বীয় বিদ্যাবত্তা ও জ্ঞানবত্তার পরিচয় প্রদান করিবার অবসর প্রাপ্ত হন। অক্ষয়কুমার “মাদক সেবনের অপকারিতা” সম্বন্ধে বিবিধ উপদেশপূর্ণ প্রবন্ধ প্রচারিত করিয়াছিলেন।

 ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে ইনি পরলোক গমন করেন। অক্ষয়কুমার দত্ত ব্রাহ্মধর্ম্মাবলম্বী ছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

 সুপ্রসিদ্ধ উপন্যাসকার। চব্বিশ পরগণার অন্তঃপাতী কাঁটালপাড়া গ্রামে ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দে ২৭শে জুন ইঁহার জন্ম। ইঁহার পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অতি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন এবং বহুদিন গভর্ণমেণ্টের অধীনে ডেপুটী কালেক্টারের কার্য্য করিয়া খ্যাত্যাপন্ন হইয়াছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র শৈশবে গ্রাম্য পাঠশালায় বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ করেন এবং পরে ইংরেজী শিখিবার নিমিত্ত প্রথমে হুগলি কলেজে ও তৎপরে কলিকাতার হিন্দু কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিস্থালয় স্থাপিত ও হিন্দু কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজে পরিণত হইলে ইনি সেই বৎসরই উক্ত কলেজ হইতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালজের বি, এ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গবর্ণমেণ্ট সঙ্গে সঙ্গে ইঁহাকে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের পদ প্রদান করিয়া গুণগ্রাহিতার পরিচয় প্রদান করেন। অতঃপর ইনি বি, এল,পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। অতীব দক্ষতার সহিত কার্য্য করিয়া ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে ইনি পেন্‌সন সহ অবসর গ্রহণ করেন। ইনি “রায় বাহাদুর” ও পরে “সি. আই. ই” উপাধি লাভ করিয়াছিলেন।

 বঙ্কিমচন্দ্র যেমন অসাধারণ মেধাবী, তেমনই কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন। কর্তব্যকর্ম্মের সম্পাদনে অনেক সময় ইঁহার জীবন সঙ্কটাপন্ন হইয়াছে, তথাপি ইনি তাহা হইতে কিঞ্চিন্মাত্র বিচলিত বা পশ্চাৎপদ হন নাই। একদা কোন বিষয়ের তদন্তভার অন্যের উপর না দিয়া স্বয়ং ঐ কার্য্যে গমন করেন এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া নিজে বিপদে পতিত হন, এমন কি, প্রাণরক্ষার নিমিত্ত ইঁহাকে নক্রসমাকুল নদীতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হইয়া নিশাষাপন করিতে হয়। কিন্তু তথাপি কর্ত্তব্য সম্পাদনের কিছুমাত্র ত্রুটী করেন নাই। চাকরী করিবার সময় এরূপ সঙ্কটে ইঁহাকে বহুবার পড়িতে হইয়াছিল। কি ধনবান্, কি নির্ধন, কি স্বদেশী, কি বিদেশী সকলের সম্বন্ধেই ইনি আইনের বিধানানুসারে তুল্যরূপ বিচারকার্য্য নির্বাহ করিতেন।

 বঙ্কিমচন্দ্র পাঠ্যাবস্থাতেই বাঙ্গালা পদ্য রচনা করিয়া মধ্যে মধ্যে প্রভাকর ও অন্যান্য পত্রে প্রকাশ করিতেন। প্রভাকর সম্পাদক সুকবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নিকটই ইঁহার বাঙ্গালা লেখার “হাতে খড়ি” হয়। এই সময়ে ইনি “ললিতা__স” নামক একখানি ক্ষুদ্র কবিতাগ্রস্থ প্রণয়ন করেন। ইহার অনেক দিন পরে ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে ইঁহার প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস “দুর্গেশনন্দিনী” প্রকাশিত হয়। ইঁহার অসামান্ত প্রতিভায় ও মনোহারিণী রচনায় বঙ্গবাসী বিমোহিত হইয়া পড়ে। এই একখানি গ্রন্থেই ইনি সর্ব্বোচ্চ শ্রেণীর লেখক বলিয়া পরিগণিত হন। তাহার পরে ক্রমে ইনি আরও অনেকগুলি উপন্যাস রচনা করিয়াছেন। ঐ সমস্ত উপন্যাস এমন উৎকৃষ্ট যে, উহাদের মধ্যে কোন একখানি মাত্র লিখিলেই ইনি অমরত্ব লাভ করিতে পারিতেন। ইঁহার কয়েকখানি উপন্যাস ইংরেজী ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় অনুদিত হইয়াছে। যে ইউরোপীয়গণ বাঙ্গালীদিগকে অতি আসার অপদার্থ জ্ঞান করিয়া ঘৃণার চক্ষে দেখিয়া থাকেন, তাঁহারাই যে বাঙ্গালীর রচিত উপন্যাস নিজ নিজ ভাষায় অনুবাদ করিয়াছেন, ইহা বঙ্গবাসীর পক্ষে সামান্য গৌরবের বিষয় নহে। বঙ্কিমচন্দ্র হইতেই বাঙ্গালীর এই গৌরববৃদ্ধি। ইনিই ষে আধুনিক বঙ্গীয় উপন্যাস লেখকগণের অধিকাংশের আদর্শ, তাহাতে সন্দেহ নাই।

 বঙ্কিমচন্দ্র ১২৭৯ বঙ্গাব্দে “বঙ্গদর্শন” নামে একখানি নূতন ধরণের উচ্চশ্রেণীর মাসিক পত্র প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন। ইঁহার সুসম্পাদন গুণে “বঙ্গদর্শন” অচিরে প্রতিষ্ঠান্বিত হইয়া উঠিল। ৰঙ্গভাষার লেখকগণ বুদ্ধি ও গবেষণা বৃত্তি পরিচালনের এক উত্তম সুযোগ প্রাপ্ত হইলেন। ফলতঃ কি গবেষণাপূর্ণ প্রবন্ধ, কি ঐতিহাসিক তত্ত্ব, কি বৈজ্ঞানিক রহস্য, কি কবিতা, কি সমালোচনা, সর্ব্ব বিষয়ের উৎকৃষ্ট রচনাসমূহে সুশোভিত হইয়া “বঙ্গদর্শন” ঙ্গ বিদ্যালোচনা বিষয়ে যুগান্তর উপস্থিত করিল দুঃখের বিষয় এই ষে, বঙ্কিমচন্দ্র উহার সম্পাদন ভার পরিত্যাগ করিলে ১২৮২ বঙ্গাব্দে উহা উঠিয়া যায়। বহুদিন পরে উহা আবার নূতন সম্পাদকের অধীনে পুনঃ প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে।

 বঙ্কিমচন্দ্র কেবল যে উপন্যাস রচনাতেই কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছেন, এমত নহে। ধর্ম্মতত্ত্ব বিষয়েও ইনি অতি উৎকৃষ্ট পুস্তক লিখিয়াছেন। ধর্ম্মবিষয়ক্ পুস্তকগুলিতে ইঁহার যথেষ্ট সূক্ষ্মদর্শিতা, দুরদর্শিতা, আন্তরিকতা ও গবেষণার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলতঃ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের পর বঙ্কিমচন্দ্র ভিন্ন আর কেহ এরূপ পুস্তক বাঙ্গালী ভাষায় লিখিয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন বলিয়া বোধ হয় না। ইঁহার রচিত “কৃষ্ণচরিত” পাঠে, বহু ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিমান্ হইয়াছেন এবং তাঁহাকে ভগবানের পূর্ণ অবতীর বলিয়া স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছেন। ইঁহার রচিত “ধর্ম্মতত্ত্ব” বঙ্গভাষায় ধর্ম্মবিষয়ক একখানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ। এই পুস্তক অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করিলে সকলকেই হিন্দুধর্ম্মের মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে।

 বঙ্কিমচন্দ্র যেমন অলৌকিক প্রতিভাসম্পন্ন, তেমনই অসামান্ত স্বদেশপ্রেমিক। ইঁহার রচিত অধিকাংশ গ্রন্থে ইঁহার সেই স্বদেশপ্রেমিকতার উচ্ছ্বাস সুপরিস্ফুট।

 বঙ্কিমচন্ত্রের রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েকখানির নাম দেওয়া গেল, যথা-দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডল, মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর, কৃষ্ণকান্তের উইল, দেবী চৌধুরাণী, সীতারাম, আনন্দমঠ, রজনী, যুগলাঙ্গুরীয়, রাধারাণী, রাজসিংহ, ইন্দিরা, কমলাকাস্তের দপ্তর, লোকরহস্য, বিবিধ প্রবন্ধ, কৃষ্ণচরিত্র ও ধর্ম্মতত্ত্ব।

 এই মহাপুরুষ ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে ৮ই এপ্রেল স্বর্গারোহণ করেন।

রাজেন্দ্রলাল মিত্র।

 কলিকাতার নিকটবর্ত্তী শুঁড়ায় ১৭৪৩ শকে ৫ই ফাল্গুন তারিখে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার পিতার নাম জনমেজয় মিত্র। পঞ্চমবর্ষ বয়সে হাতে খড়ি হইলে ইনি বাঙ্গালা ও পারসী শিক্ষা আরম্ভ করেন। পরে ১১ বৎসর বয়সে ইংরাজী স্কুলে প্রবিষ্ট হন। প্রথমে ইনি ডাক্তারী পড়িতে ইচ্ছা করেন এবং তদনুসারে মেডিকেল কলেজে প্রবিষ্ট হন। কিন্তু দ্বারকনাথ ঠাকুর ইঁহাকে ডাক্তারী পড়াইবার জন্য বিলাতে লইয়া যাইবার প্রস্তাব করিলে, ইঁহার পিতা তাহাতে অসম্মত হন। ইহার ফলে ডাক্তারী পড়া ছাড়িয়া ইনি আইন পড়িতে আরম্ভ করেন এবং তাহার যথারীতি পরীক্ষাও দেন। কিন্তু উত্তরের কাগজ চুরি যাওয়ায় ইনি পাশ করিতে পারলেন না। ইহার পর ২৩ বৎসর বয়সে ইনি এসিয়াটিক সোসাইটার এ্যাসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারী ও লাইব্রেরীয়ানের পদে নিযুক্ত হন। এই সময়ে ইনি ইচ্ছামত পুস্তক পাঠ করিয়া জ্ঞান সঞ্চয় করিতে লাগিলেন এবং এসিয়াটিক সোসাইটীর জর্ণালে গভীর গবেষণামূলক ইংরাজি প্রবন্ধ লিখিতে আরম্ভ করিলেন। ক্রমে ইনি সংস্কৃত, বাঙ্গালা, ইংরাজী, পারস্য, উর্দু, হিন্দি, গ্রীক, ল্যাটিন, ফরাসী, জর্ম্মন প্রভৃতি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করিলেন। ইঁহার পাণ্ডিত্যে পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ পর্যন্ত মুগ্ধ হইতে লাগিলেন। ইনি মোট ১২৮ খানি গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন। তন্মধ্যে ১৩ খানি সংস্কৃত, ১০ খানি বাঙ্গালা। ইঁহার লিখিত বিবিধার্থ সংগ্রহ, প্রকৃতি ভূগোল, পত্রকৌমুদী, ব্যাকরণ প্রবেশ, রহস্য সন্দর্ড, মিবারের ইতিহাস, শিবাজীর জীবনী প্রভৃতি গ্রন্থগুলি বাঙ্গালা সাহিত্যে অমূল্য রত্ব বিশেষ। ১৮৭৫ খৃষ্টাঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভা ইঁহাকে ডি, এল (ডাক্তার অফ্ ল) উপাধি প্রদান করেন। এতদ্ব্যতীত ইনি বিবিধার্থ সংগ্রহ নামক একখানি মাসিকপত্র প্রকাশ করেন। প্রত্নতত্ত্বে ইঁহার অসাধারণ প্রতিষ্ঠা। বুদ্ধগয়া ও উড়িষ্যার প্রাচীনত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থদ্বয় ইঁহার অক্ষয় কীর্ত্তি। ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে ইনি রায় বাহাদুর, ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দে সি, আই, ই, ও ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে রাজা উপাধি পান। বাঙ্গালীদের ভিতর ইনিই সর্ব্ব প্রথমে এসিযটিক সোসাইটীর সভাপতি হন। ইঁহার লিখিত ও বক্তৃতার ভাষা উভয়ই রসপূর্ণ। ইনি বৃটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েসনের সভ্য ও সভাপতি থাকিয়া দেশের অনেক হিতসাধন করিয়াছিলেন। “হিন্দু পেট্রিয়ট” পত্রে প্রবন্ধ লিখিয়া ও ঐ পত্রের উদেশ্য ও নীতি পরিচালনা করিয়া কাগজখানির সম্যক্ উন্নতি বিধান করিয়াছিলেন। সকল কার্য্যেই ইনি নির্ভীকতা ও তেজস্বিতার পরিচয় দিয়াছিলেন। কলিকাতায় Wards institution নামক নাবালক জমিদারদিগের আবাস ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দ হইতে ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত ইঁহার তত্ত্বাবধানে ছিল। কালে ঐ আবাস উঠিয়া যায় এবং ইনি বিশেষ পেনসন প্রাপ্ত হইয়া অবসর গ্রহণ করেন। ১২৯৮ সালে ১১ই শ্রাবণ (২৬ জুলাই ১৮৯১) তারিখে ইনি ইহলোক পরিত্যাগ করেন।

ভূদেব মুখোপাধ্যায়।

 ইনি ১৮২৫ খৃষ্টাব্দে ২৫শে মার্চ কলিকাতা মহানগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার পিতা বিশ্বনাথ তর্কভূষণ একজন বিখ্যাত শাস্ত্রব্যবসায়ী অধ্যাপক ছিলেন। ভূদেব প্রথমে সংস্কৃত কলেজে ও পরে হিন্দু কলেজে অধ্যয়ন করেন। পাঠশালায় ইনি উৎকৃষ্ট ছাত্রমধ্যে গণা ছিলেন এবং প্রতিবর্ষে নানারূপ পুরস্কার ও বৃত্ত্বি পাইতেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রভৃতি ইঁহার সহপাঠী ছিলেন। মধুসূদন খৃষ্টধর্ম্ম অবলম্বন করিলেন; ভূদেবেরও মতিগতি কতকটা সেইদিকে নত হইয়া পড়িয়াছিল। কিছুদিন পরে একদিন কৌশলক্রমে পিতা পুত্রকে প্রতিজ্ঞা করাইয়া লইলেন যে, যে ভক্ষ্য বা পানীয় পিতার সাক্ষাতে ভক্ষণ বা পান করা যায় না, এরূপ বস্ত ভূদেব জন্মাবচ্ছিন্নে কদাচ গ্রহণ করিবেন না। ভূদেব উত্তরকালে, নিষ্ঠাবান্ হিন্দু ৰলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

 বিদ্যালয় পরিত্যাগের পর ভূদেব স্থানে স্থানে স্কুল স্থাপন করিয়া পাশ্চাত্য প্রণালীতে বঙ্গীয় বালকদিগকে শিক্ষণ দিতে প্রবৃত্ত হইলেন। স্বয়ং অবিরত পরিশ্রম করিয়াও দেশের লোকের উৎসাহ ও যত্নের অভাবে এবং অর্থাভাবে কয়েক বৎসর পরে ইঁহাকে সেই মহদুদ্দেশ্য পরিত্যাগ করিতে হয়। অতঃপর ইনি মাসিক ৫০৲ টাকা বেতনে গভর্ণমেণ্ট স্কুল শিক্ষক নিযুক্ত হইলেন, এবং নিজের অসাধারণ পরিশ্রম, কার্য্যপটুতা, বুদ্ধিমত্তা ও বিদ্যাবত্তার পরিচয় দিয়া ক্রমশঃ উন্নতি লাভ করিয়া ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে অতিরিক্ত বিদ্যালয় পরিদর্শকের (Additional Inspector of schools) পদ প্রাপ্ত হন। এক সময়ে গভর্ণমেণ্ট ইঁহার নিকট এদেশের শিক্ষার অবস্থার সম্বন্ধে এক রিপোর্ট তলব করেন। সে সমন্ধে ইনি এমন সসার উৎকৃষ্ট রিপোর্ট প্রদান করেন যে, তেমন রিপোর্ট গভর্ণমেণ্টের দপ্তরে আর নাই। এই বিদ্যালয় পরিদর্শকের কার্য্য ইনি বিহার অঞ্চলে যাইয়া সেখানকার শিক্ষা বিষয়েরও অনেক উৎকর্ষ সাধন করেন। এইরূপ অতিশয় দক্ষতার সহিত কর্ত্তব্য সম্পাদন করিয়া ইনি কয়েক বৎসর পরেই ইনস্পেক্টর পদ প্রাপ্ত হন। কিছুদিনের জন্য অস্থায়িভাবে ইনি Director of Public Instruction, Bengal পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে ইনি প্রশংসার সহিত কর্ম্ম হইতে অবসর গ্রহণ করার পর গভর্ণমেণ্ট হইতে পেনসন প্রাপ্ত হন। ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে ইনি সি, আই, ই, (C.I, E.) উপাধি পাইয়াছিলেন এবং ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে ইনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার অন্যতম সভ্যপদে আসীন থাকেন। ইনি বঙ্গভাষায় অনেকগুলি বিদ্যালয়-পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন করেন, যথা;— ভূ-প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ক্ষেত্রতত্ত্ব (জ্যামিতি), ইংলণ্ডের ইতিহাস, পুরাবৃত্তসার, রোমের ইতিহাস ইত্যাদি। শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব নামক গ্রন্থ রচনা করিয়া ইনি ছাত্র ও শিক্ষকমণ্ডলীর অশেষ উপকার করিয়া গিয়াছেন। ইঁহার ঐতিহাসিক উপন্যাস বাঙ্গালা ভাষায় অপূর্ব্ব পদার্থ। পুষ্পাঞ্জলি নামক পুস্তক প্রণয়ন করিয়া ইনি স্বদেশপ্রীতির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন। অতঃপর ইনি আচার প্রবন্ধ, পারিবারিক প্রবন্ধ ও সামাজিক প্রবন্ধ নামক তিনখানি পুস্তক রচনা করেন। ইনি দীর্ঘকাল সাতিশয় যোগ্যতার সহিত এডুকেশন গেজেট পত্রের সম্পাদকত্বও করিয়াছিলেন। প্যারিচরণ সরকার ইহার সম্পাদন ভার ত্যাগ করিলে গভর্ণমেণ্ট ভূদেবের হস্তেই ইহা অর্পণ করেন।

 পরন্তু ভূদেবের সর্ব্বোপরি অক্ষয়কীর্ত্তি তাঁহার নিঃস্বার্থ দানশীলতা সংস্কৃত শাস্ত্রের চর্চ্চাকল্পে ইনি প্রায় দুই লক্ষ টাকা দান করেন এবং তাহার সুপরিচালন জন্য পিতার নামে “বিশ্বনাথ ট্রষ্ট ফণ্ড” নামে একটা ফণ্ড গঠন করিয়া গিয়াছেন। অধুনা এডুকেশন গেজেট পত্রের আয়ত্ত এই ফণ্ডে উৎসর্গীকৃত হয়। তদ্ভিন্ন ইনি নিজ বাসস্থান চুঁচুড়াতে পিতার নামে “বিশ্বনাথ চতুষ্পাঠী” নামে একটা সংস্কৃত বিদ্যালয় এবং মাতার নামে “ব্রহ্মময়ী ভেষজালয়"নামে একটা দাতব্য দেশীয় বৈদ্যক চিকিৎসালয় স্থাপন করিয়া গিয়াছেন। ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে ১৬ই মে ইহার পরলোক গমন ঘটে।


রমেশচন্দ্র দত্ত।

 ইনি কলিকাতা রামবাগানের দত্তবংশ-সম্ভূত। রসময় দত্তের ভ্রাতা পীতাম্বর দত্তের পৌত্র ও ঈশান চন্দ্র দত্তের মধ্যম পুত্র। ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দে ১৩ই আগষ্ট রমেশচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে সিভিল সার্ভিস্ পরীক্ষা দিবার জন্য ইনি, বিহারীলাল গুপ্ত ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ইংলণ্ডে যান। ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে তিন জনই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

 রমেশচন্দ্র পরীক্ষোত্তীর্ণ ছাত্রগণের মধ্যে তৃতীয়স্থান অধিকার করেন। ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে রমেশ্চন্দ্র বঙ্গদেশেই কার্য্যে নিযুক্ত হন। ১৮৯৪–৯৫ খৃষ্টাব্দে ইনি বিভাগীয় কমিশনারের পদে উন্নীত হন। এই উচ্চপদ বাঙ্গালীর ভিতর রমেশচন্দ্রই প্রথম লাভ করেন। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে ইনি রাজকার্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু সাহিত্য আলোচনা হইতে ইঁহার অবসর কোন কালেই ঘটে নাই। প্রথমেই ইনি বঙ্গসাহিত্য বিষয়ে রেভাঃ লালবিহারী দে পরিচালিত Bengal Magazine নামক মাসিক পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। তাহার পর মাধবীকঙ্কণ,বঙ্গবিজেতা, জীবন-প্রভাত, জীবনসন্ধ্যা, সংসার ও সমাজ নামক কয়েকখানি উপন্যাস রচনা করেন। ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে ইনি সি, আই, ই, উপাধি লাভ করেন। রাজকার্য্য হইতে অবসর লইয়া কিছুদিন ইনি লণ্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভারতের ইতিহাসের অধ্যাপনা করেন। কিছুদিন বরোদার রাজস্বসচিবের পদেও আসীন ছিলেন। বঙ্গ সাহিত্যে ইঁহার প্রগাঢ় অনুরাগ। “বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ” স্থাপিত হইলে ইনিই তাহার প্রথম সভাপতি হন। ইনি ঋগ্বেদের একখানি বঙ্গানুবাদ করিয়াছেন। ইঁহার রচিত ইংরাজি গ্রন্থের মধ্যে নিম্নে কয়েকখানির নাম প্রদত্ত হইল:—Ancient civilization in India, Lays of ancient India, Ramayana and Mahabharata in English verse, Economic History of British India. লর্ড মিণ্টোর শাসন কালে যে Decentralization commission বসে, রমেশচন্দ্র তাহাতে অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯০৯ খৃষ্টাব্দের জুন মাস হইতে ইনি বরোদার প্রধান রাজমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন, এবং তৎপরে The Slave Girl of Agra নামক একখানি উপন্যাস প্রণয়ন করেন। 

প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ।

 ১৮০৬ খৃষ্টাব্দে বর্ধমান জেলার অন্তর্গত রায়না থানার অধীন শাকনাড়া গ্রামে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার পিতার নাম রামনারায়ণ ভট্টাচার্য্য। ইনি প্রথমতঃ নৃসিংহ তর্কপঞ্চাননের নিকট ব্যাকরণ পড়িতে আরম্ভ করেন। কিন্তু তাঁহার মৃত্যু মৃত্যু হওয়ায় ইঁহাকে অন্যত্র যাইতে হয়। ব্যাকরণ ও কাব্য শেষ করিয়া কুড়ি বৎসর বয়সে ইনি কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করেন এবং ছয় বৎসর অধ্যয়ন করিয়া শিক্ষাকার্য্য শেষ করেন। পরে ইনি এই সংস্কৃত কলেজেই অলঙ্কার শাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হইলেন। অধ্যাপনার অবসরে ইনি মনোযোগ সহকারে নানাবিধ শাস্ত্রগ্রন্থ পড়িয়া জ্ঞানসঞ্চয় করিতেন। এই সময় এডুকেশন কমিটী ইহাকে “তর্কবাগীশ” উপাধি প্রদান করেন। ইনি পূর্ব্বনৈষধ, রাঘবপাণ্ডবীয়, কুমারসম্ভব ৮ম সর্গ, অভিজ্ঞান শকুন্তল, চাটু পুষ্পাঞ্জলি, অনর্থরাঘব, উত্তর রামচরিত, প্রভৃতি অনেকগুলি সংস্কৃতগ্রন্থের টীকা রচনা করিয়াছেন। অনুবাদ কার্য্যে সুনিপুণ ছিলেন বলিয়া হরেস্ হেম্যান উইলসন সাহেব ইঁহাকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন। ভারতের পুরাতত্ব সংকলনে ইনি জেমস প্রিন্সেপকে অনেক সাহায্য করিয়াছিলেন। শেষ বয়সে পেন্সন লইয়া ইনি কাশীবাস করেন এবং তথায় ১২৭৩ সালে বিসূচিকা রোগে প্রাণত্যাগ করেন। 

রাজনারায়ণ বসু।

 কলিকাতার দক্ষিণ বেড়াল গ্রামে ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে ৭ই সেপ্টেম্বর ইঁহার জন্ম হয়। ইঁহার পিতার নাম নন্দকিশোর বসু। ইনি আশৈশৰ বিদ্যানুরাগী ছিলেন। ষোড়শ বর্ষ বয়সে হিন্দু কলেজের শেষ পরীক্ষায় ইনি উত্তীর্ণ হন এবং বাটীতে মুন্সীর লিঙ্কট পারস্যভাষা উত্তমরূপ শিক্ষা করেন। পরে ১৮৫১ খৃষ্টাব্দে মেদিনীপুর গবর্নমেণ্ট স্কুলের হেডমাষ্টার নিযুক্ত হন। ইনি ব্রাহ্মধর্ম্মে দীক্ষিগত হইয়াছিলেন এবং মেদিনীপুরে থাকিবার সময় তথায় যাহাতে সমধিকরূপে ব্রাহ্মধর্ম্মের প্রচার হয়, তজ্জন্য বিশেষ চেষ্টা করিয়াছিলেন। ইঁহার উদ্যোগে, মেদিনীপুরে বালিকা বিদ্যালয়, সুরাপান-নিবারণী সভা, ব্যয়ামশালা প্রভৃতি স্থাপিত হয়। ইনি ধর্ম্মতত্ত্বদীপিকা ১ম ও ২য় ভাগ, ব্রহ্মসাধন, হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা, ব্রাহ্মসমাজের বক্তৃত ১ম ও ২য় ভাগ, সে কাল আর এ কাল প্রভৃতি অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেন। ইনি মাইকেল মধুসূদনের বন্ধু ছিলেন। ইঁহারই পরামর্শে মাইকেল “সিংহল-বিজয়” নামক একখানি বাঙ্গালা কাব্য অমিত্রাক্ষরচ্ছন্দে লিখিতে আরম্ভ করেন, কিন্তু রচনা শেষ করেন নাই। ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে ৯ই জুন মাইকেল বিলাত যাইবার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ইঁহার পাঁচ দিন পূর্ব্বে তিনি রাজনারায়পকে একখানি বিদায়পত্র লিখেন এবং সেই পত্র মধ্যে “বঙ্গভূমির প্রভি” নামক কবিতাটি ইঁহার নিকট পাঠাইয়া দেন। রাজনারায়ণ ধর্ম্মপরায়ণ ও সরলচিত্ত ছিলেন। জীবনের শেষভাগে ইনি দেওঘর নামক স্থনে বাস করিতেন। ১৯•• খৃষ্টাব্দে ১৬ই সেপ্টেম্বর বাতরোগে ইনি পরলোক গমন করেন। 

রামকৃষ্ণ পরমহংস।

 ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে ২০শে ফেব্রুয়ারি হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় রামোপাসক ছিলেন। রামকৃষ্ণ তাঁহার তৃতীয় বা কনিষ্ঠ পুত্ত্র। বাল্যে ইঁহার নাম ছিল “গদাধর"। বিদ্যালয়ে ইঁহার তাদৃশ লেখাপড়া শিক্ষা হয় নাই। কলিকাতার সন্নিহিত দক্ষিণেশ্বর গ্রামে রাণী রাসমণির স্থাপিত কালীর পুজারি স্বরূপে ইনি নিযুক্ত হন। এই খানেই ইঁহার ধর্ম্মভাবের অপূর্ব্ব স্ফুর্ত্তি দৃষ্ট হয়। ইনি ঈশ্বরকে মাতৃভাবেই দেখিতে লাগিলেন এবং সকল প্রকার ধর্ম্মের মূল অবগত হুইবার মানসে, ইনি কখন মুসলমান বেশধারী, মুসলমান খাদ্যাহারী হইয়া “আল্লার উপাসনা করিতে লাগিলেন; কখনও বা খৃষ্টান ধর্ম্মমন্দিরে যাইয়া ভজনায় যোগ দিতে লাগিলেন; কখনও গোপীবেশে শ্রীকৃষ্ণের প্রেম উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিলেন; আবার কখনও আপনাকে হনুমান কল্পনা করিয়া দাস্যভাবে উপাসনায় প্রবৃত্ত হইলেন। ইনি কি শৈব, কি শাক্ত, কি রামাৎ, কি বৈষ্ণব, কিংবা বৈদান্তিক, ইহার একটীও ছিলেন না; অথচ সবই ছিলেন। সর্ব্বধর্ম্ম সমন্বয়ের ভাব ইঁহারই নিকট হইতে গ্রহণ করিয়া কেশবচন্দ্র সেন নববিধান ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠা করেন, এইরূপ কথিত আছে। কামিনী-কাঞ্চন বর্জ্জনই রামকৃষ্ণের নিজ জীবনের এবং ধর্ম্ম অধ্যাপনার মূলমন্ত্র ছিল। অল্প বয়সেই ভার্য্যা সারদা দেবীর সন্মতি লইয়া তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। উত্তরকালে যশোধরার ন্যায় তিনি স্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রামকৃষ্ণ বলিতেন, রমণী মাত্রই বিশ্বজননী। কথিত আছে, ইনি একহাতে টাকা ও অপর হাতে মাটী লইয়া টাকাকে মাটী ও মাটীকে টাকা বলিতে ৰলিতে উভয়ের পার্থক্য ভুলিয়া যাইতেন। আরও কথিত আছে যে, যখন ইনি সমাধিমগ্ন হইতেন, সেই সময়ে ইঁহার দেহের যে কোন স্থানে টাকা স্পৃষ্ট হইলে সেই স্থানটী সঙ্কুচিত হইত। প্রথমে এক সন্ন্যাসিনীর নিকট তাহার পর তোতাপুরী নামক এক যোগীর নিকট কিছুদিন ইনি যোগ ও বেদান্ত শিক্ষা করেন। রামকৃষ্ণ কথম সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করেন নাই। ইনি সংসারে থাকিয়াই নির্লিপ্তভাবে সমাগত লোককে ধর্ম্মের গৃঢ় তত্বের উপদেশ দিতেন। অতি সহজ ভাষায় উপমা দিয়া এবং গল্পের অবতারণা করিয়া ইনি পুরাণাদি ও বেদান্তের গভীর ও জটিল তত্ত্ব বুঝাইতেন) রামকৃষ্ণের উপদেশ প্রণালীর ইহাই বিশেষত্ব। কেশবচন্দ্র সেন, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার, নরেন্দ্রনাথ দত্ত (যিনি পরে স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হইয়াছিলেন), রামচন্দ্র দত্ত, মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রভৃতি শিক্ষিত বাঙ্গালিগণ ইঁহার উপদেশ অতি আগ্রহের সহিত শ্রৰণ করিতেন। কিন্তু “গুরু” অভিধা গ্রহণ করিয়া ইনি শিষ্যগণকে শিক্ষা দিতেছেন, এ ভাব ইঁহার মনে স্থান পাইত না। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ীর উত্তর পশ্চিম কোণে ইঁহার অধিবেশন ও শয়ন গৃহ ছিল। প্রত্যহই সেই ঘর পরমহংসের দর্শন ও তাঁহার জ্ঞানগর্ভ উপদেশ-শ্রবণেচ্ছুগণে পরিপূরিত হইত। রামকৃষ্ণ সকলকেই মিষ্ট বচন ও রহস্যালাপের সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম্মোপদেশ দান করিয়া পরিতুষ্ট করিতেন। এখনও সেই প্রকোষ্ঠটী পূর্ব্ববৎ সজ্জিত আছে এবং অনেকেই তীর্থস্থান মনে করিয়া সেটি দেখিতে যান। রমকৃষ্ণ অতি মধুরস্বরে গান গাহিতে গাহিতে বা উপদেশ দিতে দিতে অনেক সময় ভাবে বিভোর হইয়া সংজ্ঞাশূণ্য হইতেন। ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে ১৬ই আগষ্ট এই মহাত্মার মর্ত্তলীলা শেষ হয়। বঙ্গের অনেক শিক্ষিত লোক ইঁহাকে অবতার স্বরূপে ভক্তি শ্রদ্ধা করিয়া থাকেন। ইঁহার আবির্ভাব ও তিরোভাবের দিন পর্ব্বদিন জ্ঞানে ইঁহাদের দ্বারা ঐ ঐ দিবলে মহোৎসব সম্পাদিত হয়। রামকৃষ্ণের নামযুক্ত অনেক গুলি সদনুষ্ঠান ভারতের নানা স্থানে হইয়াছে; সেখানে দুঃখী ও পীড়িতগণ সাহায্য পায়। একজন অপেক্ষাকৃত শিক্ষাবিহীন পূজারী ব্রাহ্মণ যে ভারত ও জামেরিকাবাসী শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনের মধ্যে এমন দৃঢ়ভাবে স্থান অধিকার করিতে পারিয়াছেন, ইহাতে স্বভাবতঃই মনে হয় যে, রামকৃষ্ণ পরমহংস অসাধারণ পুরুষ ছিলেন। চরিত্রের নির্ম্মলতা, সাংসারিক প্রলোভনের অতীত স্বভাব এবং ভগবদ্ভক্তির ঐকান্তিকতা ষে ইঁহার অসাধারণত্বের মূল ভিত্তি ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।


রাজকৃষ্ণ রায়।

 জন্ম ১২৬২ সাল। শৈশবে মাতৃপিতৃহীন হইয়া ইনি মাতৃত্বসার যত্নে প্রতিপালিত হন। কিন্তু মাতৃত্বসার অবস্থা ভাল মা থাকায় ইঁহাকে অতি কষ্টে দিনপাত এৰং শিক্ষালাভ করিতে হইয়াছিল। ২১ বৎসর বয়সে ইনি আলবার্ট প্রেসের ম্যানেজার হন। পরে ইনি স্বয়ং “বীণা প্রেস” নাম দিয়া একটী ছাপাখানা স্থাপন করেন এবং তাহা হইতে স্বরচিত কবিতা পুস্তক বাহির করিতে থাকেন, কিন্তু তাহাতেও ইঁহার অর্থাভাব দুর হয় না। মধ্যে কিছুদিন রাজা স্যার শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের নিকট কর্ম্ম করেন। অতঃপর ইনি নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন। বঙ্গ রঙ্গভূমিতে তাঁহার রচিত প্রহলাদচরিত্র নাটক অতি প্রশংসার সহিত বহুদিন ধরিয়া অভিনীত হয়। ইনি নিজেও “বীণা থিয়েটার” নামে একটী থিয়েটার স্থাপন করেন, তাহার জন্য কতকগুলি নাটক ও গীতিনাট্য রচনা করেন এবং অভিনেত্রীর পরিবর্ত্তে বালক স্বারা তাহাতে অভিনয় করান। কিন্তু এই থিয়েটার দ্বারা ইনি এরূপ ঋণজালে জড়িত হইয়াছিলেন যে, শেষে থিয়েটার গৃহ, ছাপাখানা এবং স্ত্রীপুত্ত্রাদির অলঙ্কার পর্য্যন্ত বিক্রয় করিয়া ইঁহাকে ঋণ পরিশোধ করিতে হইয়াছিল। ইঁহার পর ষ্টার থিয়েটারে ইঁহার রচিত নরমেধ-যজ্ঞ, বনবীর, লয়লা-মজনু প্রভৃতি অনেকগুলি নাটকের অভিনয় হয়। নাটক, উপন্যাস এবং কবিতা প্রভৃতিতে ইনি অনেকগুলি পুস্তক রচনা করিয়া গিয়াছেন। তদ্বাতীত ইনি সংস্কৃত রামায়ণ ও মহাভারতের পদ্যানুবাদ করিয়াছিলেন। ইনি এত দ্রুত পদ্য রচনা করিতে পারিতেন যে, দুইজন লেখকেও তাহ লিখিয়া উঠিতে পারিত না। কিন্তু দারিদ্র্য ইঁহার চিরসহচর ছিল। তবে ষ্টার থিয়েটারের কর্তৃপক্ষদের যত্বে পূর্ব্বাপেক্ষা ইঁহার অবস্থা কথঞ্চিৎ সচ্ছল হয়। ইনি অতি বিনয়ী ও মিষ্টভাষী ছিলেন। ১৩০০ সালে ২৮শে ফাল্গুন ইঁহার লোকান্তর হয়। 

প্যারিচরণ সরকার

 প্রসিদ্ধ ইংরাজী পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা। কলিকাতা চোরবাগানে ১২৩০ সালের ২৮শে মাঘ (১৮২৩ খৃষ্টাব্দে) ইঁহার জন্ম হয়। বাল্যে ইনি হেয়ার সাহেবের পাঠশালায় প্রবিষ্ট হন। পরে এই পাঠশালা হেয়ার স্কুলে পরিণত হয়। প্যারিচরণ এই স্কুলে তিন বৎসর অধ্যয়ন করিয়া জুনিয়ার স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং মাসিক ৮৲ টাকা বৃত্তি লইয়া হিন্দু কলেজে প্রবেশ করেন। এখানে তিন বৎসর কাল অধ্যয়ন করিয়া সিনিয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ৪০৲ টাকা বৃত্তি পান। ইহার পর স্কুল ছাড়িয়া হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ও পরে বারাসত গভর্ণমেণ্ট বিদ্যালয়ে কার্য্য করিয়া ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দে হেয়ার স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হন এবং স্কুলের নানাবিধ উন্নতি সাধন করেন। পরে ইনি প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। উক্ত স্কুলে ইংরাজী অধ্যাপনার ভার বাঙ্গালী এই প্রথম পাইল। প্যারিচরণের চেষ্টায় “সুরাপান নিবারণী সভা” স্থাপিত হয়। সুরাপানের অপকারিতা বুঝাইবার জন্য ইনি ইংরাজি ভাষায় “ওয়েল উইসার” এবং বাঙ্গালা ভাষায় “হিতসাধক” নামে দুইখানি মাসিকপত্র প্রকাশ করেন। ১২৭৩ সালে উড়িষ্যা ও বাঙ্গালায় ভীষণ দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হইলে ইনি একটী অন্নসত্রের প্রতিষ্ঠা করিয়া বিস্তর লোককে অন্নদান করেন। ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দে এডুকেশন গেজেট নামক সংবাদ পত্র প্রকাশিত হয়, ইনি তাহার সম্পাদক নিযুক্ত হন। এজন্য তিনি মাসিক ৩০০৲ টাকা বেতন পাইতেম। কিন্তু সামান্য কারণে গভর্ণমেণ্টের সহিত মতের মিল না হওয়ায় ইনি সম্পাদকের কার্য্য পরিত্যাগ করেন। ইঁহার প্রণীত ফার্ষ্ট বুক, সেকেণ্ড বুক প্রভৃতি শিশুপাঠ্য ইংরাজী পুস্তক সর্ব্বত্র গ্রসিদ্ধ। ১২৮২ সালের ১৫ই আশ্বিন (১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে ৩০শে সেপ্টেম্বর) ৫২ বৎসর বয়সে বহুমূত্র রোগে ইঁহার মৃত্যু হয়। ইঁহার শিক্ষকতা কার্য্যে রগবী স্কুলের আরনল্ড সাহেবের ন্যায় পারদর্শিতার জন্য সকলে ইঁহাকে আরনল্ড অব দি ইষ্ট(Arnold of the East) বলিত। ইনি বড় মিষ্টভাষী, সরলান্তঃকরণ ও সামাজিক লোক ছিলেন। ছাত্রগণকে ইনি পুত্রের ন্যায় স্নেহ করিতেন এবং তাহারা ইঁহাকে পিতার ন্যায় ভক্তি ও সন্মান করিত।

প্রসন্নকুমার ঠাকুর।

 ইনি গোপীমোহন ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র। জন্ম ১৮•৩ খৃষ্টাব্দে। ইনি ধনবান্ হইলেও কলিকাতা সদর দেওয়ানি আদালতে ওকালতী করিয়া স্বশ্রেণীর মধ্যে স্বাধীনভাবে অর্থোপর্জ্জনের পথ প্রদর্শন করিয়া ছিলেন। ইনি ওকালতী করিয়া উপার্জন করিতেন। কিছুদিন ইনি গভর্ণমেণ্ট প্লিডারের কার্য্যও করিয়াছিলেন। ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দে যখন গভর্ণমেণ্ট লাখেরাজ জমী বাজেয়াপ্ত করিবার প্রস্তাব করেন,তখন প্রসন্নকুমার “বেঙ্গল হরকরা” নামক সংবাদপত্রে এ সম্বন্ধে তীব্রভাবে আলোচনা করেন। এই প্রস্তাব কার্য্যে পরিণত হইল এবং সরকারী তহশীলদারগণের অত্যাচার অসহনীয় হইয়া উঠিল দেখিয়া প্রসন্নকুমার, দ্বারকানাথ ঠাকুর ও কতিপয় বন্ধুর সাহায্যে কলিকাত টাউনহলে লাখেরাজগণের একটা বিরাট সভা আহবান করেন। আন্দোলন এরূপ আকার ধারণ করিল যে, তখনকার গভর্ণর জেনারেল লর্ড অকলণ্ড ভীত হইলেন এবং লাটভবন অক্রান্ত হইবে এইরূপ আশঙ্কা করিলেন। বিরাট সভার সংবাদ অৰ্দ্ধঘণ্টা অন্তর তাঁহার নিকট পৌঁছিতে লাগিল। আন্দোলনের ফলে এই হইল যে, ৫০ বিঘার অনধিক লাখেরাজ জমিগুলির বাজেয়াপ্ত রহিত হইল। লর্ড ডালহৌসির শাসনকালে ব্যবস্থাপক সভার সৃষ্টি হইলে প্রসন্নকুমার ঐ সভার Clerk Assistant পদে নিযুক্ত হন। এই পদে অধিষ্ঠিত থাকিয়া অনেক আইন বিধিবদ্ধ হুইবার সময়ে ইনি গভর্ণমেণ্টকে বিশেষ সাহায্য করিয়াছিলেন। ইনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার অন্ততম সদস্য ছিলেন। বাঙ্গালীর পক্ষে বড়লাটের ব্যবস্থাপক সভার সভ্য হইবার প্রথম সম্মান ইঁহারই ঘটে। কিন্তু তখন ইনি অত্যন্ত পীড়িত, সুতরাং সভায় যোগদান করা ইঁহার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠিল না। ১৮৩৬ খৃষ্টাব্দে ৩০ এপ্রেল ইনি সি,এস,আই উপাধি দ্বারা ভূষিত হন। ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে ৩১শে আগষ্ট ইনি দেহত্যাগ করেন। ইনি তেজস্বী, মনস্বী ও যশস্বী পুরুষ ছিলেন। প্রসন্নকুমার আইন ও জমাদারীতে যেমন অভিজ্ঞ, সংস্কৃত শিক্ষায়ও তেমনই অনুরাগী ছিলেন। মৃত্যুর লময় ইনি যে উইল করিয়াছিলেন, তদ্দ্বারা ৩ লক্ষ টাকা আইন শিক্ষাকল্পে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্তে দিয়া যান। সেই টাকার সুদে ঠাকর ল-লেকচার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। মূলাযোড়ের সংস্কৃত বিদ্যালয়ের গৃহনির্ম্মাণ জন্য ৩৫,০০০ টাকা; ঐখানে দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা জন্য ১ লক্ষ টাকা; অনুগত স্বজনের জন্য এক লক্ষ নয় হাজার টাকা, স্বীয় কর্ম্মচারী ও ভৃত্যগণের জন্য এক লক্ষ ছয় হাজার টাকা দান করেন। এতদ্ব্যতীত উইলের দ্বারা এবং জীবিত কালে প্রসন্নকুমার বিস্তর টাকা দান করিয়াছিলেন। ইঁহার পুস্তকাগারে সাহিত্য ও আইন বিষয়ক অনেক মূল্যবান্ পুস্তক আছে। ইনি বড়ই প্রজাবৎসল ছিলেন এবং প্রজার উন্নতিকল্পে অনেক অর্থব্যয় করিয়াছিলেন। যৌবনকালে “অনুবাদক” নামে একখানি বাঙ্গালা ও “রিফর্মার” নামে একখানি ইংরাজি সংবাদপত্রের সম্পাদন করিয়া দেশের রাজনীতি, সমাজ এবং ধর্ম্মসম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছিলেন। ইনি সংস্কৃত হইতে দায়বিষয়ক গ্রন্থ সঙ্কলন করিয়া প্রকাশ করিয়াছিলেন। ইঁহার মাতৃভক্তি অসীম ছিল। কথিত আছে, ইঁহার মাতৃদেবী যে রৌপ্যনির্ম্মিত খাট ব্যবহার করিতেন, তাঁহার মৃত্যুর পর পাছে অন্য কেহ ব্যবহার করিয়া তাঁহার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে, এই জন্য সেই খাটখানি মুলাজোড়ে তাঁহার পিতৃ-প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মময়ী দেবীর সেবার্থে উৎসর্গীকৃত করেন। বৃটীশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েসন স্থাপনে প্রসন্নকুমার বিশেষ যত্নবান ছিলেন। রাজা স্যার রাধাকান্ত দেবের পর ইনি এই সভার সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। ইঁহার শুঁড়ার উদ্যানে ইঁহার ষত্ত্বে ও অর্থব্যয়ে উইলিয়ম সাহেবের অনুবাদিত উত্তর চরিতের প্রথম অঙ্ক এবং জুলিয়স সিজারের পঞ্চম অঙ্ক ইংরাজী ভাষায় ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে অভিনীত হয়। মূলাজোড়ে ঠাকুরবাড়ীর সংলগ্ন সংস্কৃত বিদ্যালয়টী ইঁহারই প্রদত্ত মূলধন দ্বারা পরিচালিত হইতেছে। ইঁহার দুই কন্যা ও একটি পুত্ত্র। পুত্ত্র(জ্ঞানেন্দ্রমোহন) খৃষ্টধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়াছিলেন বলিয়া প্রসন্নকুমার তাঁহাকে বিষয় হইতে বঞ্চিত করিয়াছিলেন এবং ঐ বিষয় প্রথমে ভ্রাতু-ষ্পুত্র যতীন্দ্রমোহন এবং তাহার পর ঠাকুর বংশের অন্যান্য প্রতিনিধিগণ যথাক্রমে পাইবেন, উইলে এইরূপ ব্যবস্থা করিয়া গিয়াছিলেন। এই উইল লইয়া বহুদিন পর্য্যন্ত মোকৰ্দমা হয়, পরে প্রিভি কাউন্‌সিলের বিচারে ধার্য্য হয় যে, যতীন্দ্রমোহন জীবিতকাল পর্য্যন্ত এই বিষয়ের উপস্বত্ব ভোগ করিবেন, পরে তাঁহার সমস্ত বিষয় জ্ঞানেন্দ্রমোহনের হস্তে স্থায়িভাবে আসিবে। মহারাজ যতীন্দ্রমোহনের প্রদত্ত প্রসন্নকুমারের প্রস্তরময়ী মূর্ত্তি লর্ড রিপণের দ্বারা উন্মোচিত হইয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোপানের উপর বিদ্যমান আছে।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত।

 ইনি একজন বিখ্যাত বাঙ্গালী কবি। কাঁচড়াপাড়ানিবাসী বৈদ্যজাতীয় হরিনারায়ণ গুপ্তের দ্বিতীয় পুত্র। বাঙ্গালা ১২১৩ সালে ইঁহার জন্ম হয়। বাল্যকাল্যে ইনি বড় দুরন্ত ছিলেন; লেখাপড়ায় ইঁহার তাদৃশ মনোযোগ ছিল না। গ্রাম্য পাঠশালায় সামান্য বাঙ্গালা লেখা পড়া শিথিয়াছিলেন। কিন্তু ইঁহার অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তি ছিল। একবার যাহা শুনিতেন, তাহাই আয়ত্ত করিয়া ফেলিতেন। কথিত আছে যে, ইনি ১৭।১৮ বৎসর বয়সের সময় দেড়মাসের মধ্যে মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের মিশ্র পর্য্যন্ত অর্থ সহিত কণ্ঠস্থ করিয়াছিলেন। বাল্যকাল হইতেই ইঁহার কবিতা লিখিবার সথ ছিল। এই সময়ে ইঁহার জ্যেষ্ঠতাত-পুত্ত্র মহেশচন্দ্রের সহিত ইঁহার কবিতার লড়াই হইত। মহেশচন্দ্র একজন স্বভাব-কবি ছিলেন। কোন কারণে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, ঈশ্বরচন্দ্র জীবিত থাকিতে তিনি আর কবিতা লিখিবেন না। এ প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করিয়াছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র একদিন মহেশচন্দ্রকে ঠাট্টা করিয়া বলিয়াছিলেন, “দাদা! লেজ ওটালে কেন?” তাহাতে মহেশচন্দ্র এই উত্তর করেন;–

 
“ওরে দুই ভায়ের দুই থাকলে লেজ,
থাকতে ন সংসার।
একে তোমার লেজে গেছে মজে,
সোণার লঙ্কা ছারখার॥”

 দশমবর্ধ বয়ঃক্রম কালে ঈশ্বরচন্দ্রের মাতৃবিয়োগ হয়। ইহার কিছু দিন পরে ইঁহার পিতা দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেন। এই ঘটনায় ঈশ্বরচন্দ্র নিতান্ত বিরক্ত হইয়া কলিকাতায় মাতুলালয়ে চলিয়া আসেন। এখানে থাকিয়া ইংরাজী বিদ্যাভ্যাসের চেষ্টা করেন, কিন্তু অনুরাগের অভাবে তাহাতেও অধিক উন্নতি লাভ করিতে পারিলেন না। পঞ্চদশ বর্ষ বয়ঃক্রমকালে গুপ্তিপাড়ার গৌরহরি মল্লিকের কন্যা দুর্গামণির সহিত ইঁহার বিবাহ হয়। দুর্গামণি নাকি দেখিতে তেমন সুশ্রী ছিলেন না, অধিকন্তু কতকটা হাবাগোবার মত। কাজেই ঈশ্বরচন্দ্র এ বিষয়ে সুখী হইতে পারিলেন না।

 কলিকাতার ঠাকুরবংশের সহিত ঈশ্বরচন্দ্রের মাতামহের কিঞ্চিৎ ঘনিষ্ঠত ছিল। সেই সূত্রে ঈশ্বরচন্দ্র সর্ব্বদাই ঠাকুরবাড়ীতে যাতায়াত করিতেন। ক্রমে গোপীমোহন ঠাকুরের পৌত্র যোগেন্দ্রমোহনের সহিত ইঁহার বন্ধুত্ব জন্মে। উভয়েই সমবয়স্ক। কথিত আছে যে, ঈশ্বরচন্দ্রের সহবাসে যোগেন্দ্রমোহনের রচনাশক্তি জন্মিয়াছিল। এই যোগেন্দ্রমোহনের সাহায্যে ১২৩৭ সালে ঈশ্বরচন্দ্র “সংবাদ প্রভাকর” নামে একখানি সাপ্তাহিক সংবাদ পত্র প্রকাশ করেন। ১২৩৯ সালে যোগেন্দ্রমোহনের মৃত্যু হওয়ার সঙ্গে প্রভাকরও অদৃশ্য হয়। ঈশ্বরচন্দ্রের কবিত্ব ও রচনা শক্তি দেখিয়া আন্দুলের জমিদার জগন্নাথ প্রসাদ মল্লিক ঐ বৎসরেই “সংবাদ রত্নাবলী” প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র উক্ত পত্রিকায় লেখা বিষয়ে বিশেষ সাহায্য করিতেন।

 ইহার কিছুদিন পরে ঈশ্বরচন্দ্র তীর্থ পর্যটনে বহির্গত হন এবং শ্রীক্ষেত্রাদি দর্শন করিয়া ১২৪২ সালে কলিকতায় প্রত্যাবৃত্ত হন, এবং কানাইলাল ঠাকুরের সাহায্য “সংবাদ প্রভাকর” পত্রকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ১২৪৫ সালে “সংবাদ প্রভাকর” দৈনিক আকার ধারণ করে। বাঙ্গালা দৈনিক সংবাদ পত্রের মধ্যে প্রভাকরই প্রথম। ইহার কিছু দিন পরে স্বনামপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু বিধবার-বিবাহের বৈধতা প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত পুস্তিকা প্রচার করেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাহার প্রতিবাদস্বরূপ ব্যঙ্গকবিতাসমূহ প্রভাকারে প্রকাশ করিয়া বিধবা-বিবাহ বিরোধীদিগের চিত্তরঞ্জন করেন। ১২৫৩ সালে ইনি “পাষণ্ডপীড়ন” নামে আর একখানি পত্র প্রকাশ করেন। এই সময়ে “ভাস্কর” সম্পাদক গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ (গুড়গুড়ে ভট্টাচার্য) “রসরাজ” নামে একখানি পত্র প্রকাশ করিয়া ঈশ্বরচন্দ্রের সহিত কবিতা যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। ঈশ্বরচন্দ্র ও 'পাষণ্ডপীড়ন' পত্রে গৌরীশঙ্করের কবিতাযর উত্তর দিতে লাগিলেন। কিছু দিন পরে দুইখানি পত্রই উঠিয়া যায়। তখন ঈশ্বরচন্দ্র ১২৫৪ সালে “সাধু রঞ্জন” নামে আর একখানি সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশ করেন। ইহাতে তাঁহার ছাত্রদিগের কবিতা ও প্রবন্ধ মুদ্রিত হইত। ঈশ্বরচন্দ্র প্রায় ১০ বৎসর নানাস্থানে ঘুরিয়া বহু যত্ন ও পরিশ্রমে ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন, রাম বসু, হরুঠাকুর, নিতাই দাস প্রভৃতি প্রাচীন কবিগণের জীবন চরিত ও অনেক লুপ্ত কবিতা প্রকাশ করেন। বস্তুতঃ প্রাচীন বঙ্গীর কবিদিগের জীবনবৃত্তান্ত উদ্ধার বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্রই প্রথম ও প্রধান উদ্যোগী। ১২৬৪ সালে ইনি 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রে “প্রবোধপ্রভাকর", “হিত প্রভাকর", “বোধেন্দু বিকাশ” নামক তিনখানি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তৎপরে শ্রীমদ্ভাগবতের বাঙ্গালা পদ্যানুবাদ প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন; পরন্তু মঙ্গলাচরণ ও কয়েকটা শ্লোকের অনুবাদ করিয়া মৃত্যুশয্যায় শয়ন করেন। ১২৬৫ সালের ১০ই মাঘ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সজ্ঞানে গঙ্গালাভ করেন।

 ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পর তদীয় অনুজ রামচন্দ্র গুপ্ত সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদন ভার গ্রহণ করেন। এই সময়ে পূর্বোক্ত মহেশচন্দ্র গভীর দুঃখের সহিত গাহিয়াছিলেন;—

“সাত মেড়াতে জড় হয়ে নষ্ট করলে প্রভাকর।
জন্মে কলম ধরেনি কো, রাম হল এডিটর।
আগা পাছ বাদ দিয়ে শ্যাম হল কমাণ্ডর।

 বাঙ্গালীদিগের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তই প্রথম কেবল নিজের লেখনীয় উপর নির্ভর করিয়া জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন। ইনি বিলক্ষণ অর্থোপার্জ্জন ও সমাজে প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। ইনি যেমন অর্থোপার্জ্জন করিতেন, তেমনি তাহার সদ্ব্যয় করিতেন। ইনি মুক্ত পুরুষ ছিলেন; ইঁহার বাড়ীতে সদাব্রত ছিল। অন্নপ্রার্থী হইয়া কেহ কখনও বিমুখ হয় নাই। ইনি খুব উচ্চশ্রেণীর কবি না হইলেও একজন স্বভাবকবি ছিলেন। ইঁহার রচনা অতিশয় প্রাঞ্জল, তবে অনুপ্রাসের ভারে মধ্যে মধ্যে পীড়িত। হাস্যরসে ইঁহার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। বস্তুতঃ হাস্যরসে ইঁহার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল।বস্তুতঃ হাস্যরসে ইনি অদ্বিতীয়।

রমাপ্রসাদ রায়।

 ইনি স্বপ্রসিদ্ধ রাজা রামমোহন রায়ের কনিষ্ঠ পুত্র। সদর দেওয়ানী আদালতে ওকালতী ব্যবসায় করিয়া ইনি প্রভূত অর্থ সঞ্চয় করিয়াছিলেন। ইনি উক্ত আদালতে গভর্ণমেণ্ট কর্ত্তৃক সিনিয়ার প্লিডার পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। এই পদ বাঙ্গালীর ভিতর ইনিই প্রথম পাইয়াছিলেন। ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে ইনি কলিকাতা হাইকোর্টের অন্যতম জজ স্বরূপে নিযুক্ত হন। এ উচ্চ সম্মান ৰাঙ্গালীর পক্ষে এই প্রথম। যখন নিয়োগ সংবাদ পাইলেন, তখন ইনি পীড়াগ্রস্ত। ইনি সে পীড়া হইতে আরোগ্য লাভ করিতে পরিলেন না। সুতরাং বিচারালয়ে বসিবার অবসর আর ইহার ঘটল না।

মধুসূদন দত্ত (মাইকেল)।

 যশোহর জেলার অন্তর্গত সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ খৃষ্টাব্দে ২৫শে জানুয়ারি কবিবর মধুসূদনের জন্ম হয়। ইঁহার পিতার নাম রাজনারায়ণ দও। তিনি কার্য্যোপলক্ষে কলিকাতায় থাকিতেনে। মধুসূদন বাল্যে গ্রাম পাঠশালায় শিক্ষা আরম্ভ করিয়া পরে কলিকাতায় পিতার নিকট থাকিয়া হিন্দু কলেজে বিদ্যাভ্যাস করেন। পঠদ্দশায় ইনি একজন উৎকৃষ্ট ছাত্র বলিয়া পরিগণিত ছিলেন এবং ইংরেজী ভিন্ন গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষা শিক্ষা করিয়াছিলেন। ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে ৯ই ফেব্রুয়ারী ইনি খৃষ্টীয়ান ধর্ম্ম অবলম্বন করেন। ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দে ইনি মাদ্রাজে গমন করেন এবং তথায় সংবাদ পত্রে সারগর্ভ প্রবন্ধ ও The Captive Lady নামক ইংরাজী পদ্যে সংযুক্তার আখ্যান লিখিয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এই সময়ে ইনি মাদ্রাজ কলেজের ইউরোপীয় অধ্যক্ষের কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। পরে ইঁহার সহিত বিবাহ-বন্ধন ছিন্ন করিয়া হেনরিয়েটা নাম্নী একজন রমণীকে পত্নী ভাবে গ্রহণ করেন। ১৮৫৮ গ্রীষ্টাব্দে ইনি সস্ত্রীক কলিকাতায় আগমন করিয়া পুলিশ আদালতের কেরাণীর কার্য্যে নিযুক্ত হন, এবং কিছুদিন পরে উক্ত আদালতে দোভাষীর(Interpreter) পদ প্রাপ্ত হন।

 ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে মধুসূদন রত্নাবলী নাটকের ইংরেজী অনুৰাগ করেন। অতঃপর ইনি মাতৃভাষার চর্চা আরম্ভ করিয়া দুই বৎসরের মধ্যে ক্রমান্বয়ে নিম্নলিখিত পুস্তকগুলি লিখিয়া অক্ষয় যশঃ অর্জন করেন,—শখিষ্ঠা নাটক, পদ্মাবতী নাটক, তিলোত্তমা-সম্ভব কাব্য, একেই কি বলে সভ্যতা, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদবধ কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, কৃষ্ণকুমারী নাটক, বীরাঙ্গনা কাব্য। ইঁহার পর কবিবর আইন শিক্ষার নিমিত্ত ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে ৯ই জুন সপরিবারে ইংলণ্ডে গমন করেন। তথায় যাইয়া যৎপরোনাপ্তি অর্থক্লেশে পতিত হইয়া দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরণাপন্ন হন। বিদ্যাসাগর মহাশয় সে সময়ে ইঁহাকে অনেক টাকা দিয়া সাহায্য করিয়াছিলেন। ইংলণ্ডে ও ফান্সে অবস্থিতিকালে মধুসূদন “চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী” রচনা করেন।

 ব্যারিষ্টারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া মধুসূদন ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে কালিকাতায় আগমন করিলেন ও ব্যবসায় করিবার জন্য হাইকোর্টে প্রবেশ করিলেন। এই সময়ে ইনি “নীতিমূলক কবিতা মালা,” “হেক্টর বধ” (গদ্য) ও “মায়াকানন” (নাটক) কেবল অর্থোপার্জ্জন কল্পে প্রণয়ন করিয়াছিলেন। অমিতব্যয়িতা নিবন্ধন কবির শেষ জীবন বড়ই দুঃখময় হইয়াছিল। পত্নীর মৃত্যুর পর মধুসূদন স্বয়ং রুগ্ন শয্যায় শয়ন করিলেন; কিন্তু চিকিৎসা করাইবার সঙ্গতি নাই। অর্থাভাবে পথ্যও জুটিয়া উঠিত না। এবংপ্রকার নানাবিধ কষ্টভোগের পর ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৯শে জুন আলিপুরের দাতব্য চিকিৎসালয়ে কবিবরের প্রাণবায়ু বহির্গত হয়। ১৮৮৮ খৃষ্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর স্বৰ্গীয় মনোমোহন ঘোষের যত্নে ইঁহার সমাধিস্থানের উপর একটা মর্ম্মর বেদী নির্ম্মিত হইয়া সাধরণের সমক্ষে উন্মুক্ত হয়। ইঁহার কবরের উপর বাঙ্গালা অক্ষরে “দাঁড়াও পথিকবর” প্রমুখ যে কবিতাটা খোদিত আছে, তাহা মধুসুদন জীবিত কালে নিজের জন্যই রচনা করিয়া রাখিয়াছিলেন।

 মধুসূদন বঙ্গভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্ত্তক। বঙ্গভাষায় যে বীররস-প্রধান কাব্য (Heroic poem) রচনা করা যায়, তাহা ইনিই প্রথম প্রদর্শন করেন। ভাষার উন্নতি করিয়া মধুসুদন বঙ্গবাসীর চিরকৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন। 

শম্ভুনাথ পণ্ডিত।

 ১২২৬ সালে (১৮২০ খৃঃ) কলিকাতায় ইনি জন্মগ্রহণ করেন। ইহার পিতার নাম শিবনাথ; কেহ কেহ বলেন সদাশিব পণ্ডিত। ইহাদের আদি নিবাস কাশ্মীর দেশ। বাল্যকালে শম্ভুনাথ গৌর মোহন আঢ্যের স্কুলে ইংরাজী শিক্ষা করেন। শিক্ষা বিষয়ে ইঁহার সমধিক উৎসাহ ও ষত্ন ছিল। এজন্য বিদ্যালয় ব্যতীত বাটতে বসিয়াও অভিজ্ঞ লোকের সাহায্যে ভাল ভাল পুস্তক পাঠ করিতেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই বিদ্যালয় ত্যাগ করিয়া ইঁহাকে বিষয় কর্ম্মে প্রবিষ্ট হইতে হয়। প্রথমে ইনি সদর দেওয়ানি আদালতে ২০৲ টাকা বেতনে মহাফেজের সহকারীরূপে নিযুক্ত হন, পরে তত্রত্য জজ স্তার রবার্ট বারলো সাহেবের কৃপায় ডিক্রীজারি মোহরের পদ প্রাপ্ত হন। এই কার্য্যকালে ইনি ডিক্রীজারির আইন সম্বন্ধে এক পুস্তক প্রণয়ন করেন। ঐ আইনে যে সকল দোষ ছিল, এই পুস্তকে সেই সকল দোষের সুন্দররূপে আলোচনা করা হয়। ইহাতে তিনি গভর্ণমেণ্টের নিকট পরিচিত হন। পরে ইঁহার নির্দেশমতে ঐ সকল দোষ সংশোধিত হয়। চাকরীতে নানা গোলযোগ হওয়ায় তাহা ত্যাগ করিয়া ইনি ওকালতী অরম্ভ করেন। এই কার্য্যে ইনি বিশেষ সুখ্যাতি লাভ করেন। আইন বিষয়ে ইঁহার সূক্ষদর্শিতা দেখিয়া সকলেই অবাক হইতেন। কিছুদিন পরে ইনি গভর্ণমেণ্টের জুনিয়র, পরে (১৮৬১ খৃঃ) সিনিয়র উকীল নিযুক্ত হন। আইনের সূক্ষতর্কে কেহই ইঁহার প্রতিযোগিতা করিয়া উঠিতে পারিতেন না। ইঁহার আইনজ্ঞান দর্শনে গভর্ণমেণ্ট ইঁহাকে কলিকাভা প্রেসিডেন্সী কলেজের ব্যবস্থা শাস্ত্রের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত করেন। পরে ১২৬৯ সালে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হইলে ইনি তাহার বিচারপতি-পদে উপবিষ্ট হন। ভারতবাসীদের ভিতর রমাপ্রসাদ রায়ই প্রথমে হাইকোর্টের জজ হইবার সনন্দ পান। কিন্তু বিচারালয়ে বসিবার তাহার অবসর হয় নাই, ইহার অগ্রেই তাঁহার মৃত্যু ঘটে। স্বতরাং এই আদালতে শম্ভুনাথকে এদেশীয় প্রথম বিচারপতি বলিয়া গণ্য করা হয়। ইনি এখানে সবিশেষ ন্যায়পরায়ণতা ও সুখ্যাতির সহিত ১৮৬৭ খৃষ্টান্ধ পর্যন্ত প্রায় ৫ বৎসর কাল বিচারকার্য্য নির্ব্বাহ করেন। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “হিন্দু পেট্রিয়টে” ইনি আইন বিষয়ক যে সকল প্রবন্ধ লিখিতেন, তাহা পাঠে উচ্চ আদালতের বিচারপতিগণ পর্য্যস্ত মুক্তকণ্ঠে ইহার প্রশংসা করিতেন। ইহার হৃদয় অতিশয় সরল ও উদার ছিল। ভৃত্যগণকে পর্যন্ত কখন তুমি ভিন্ন তুই বলিয়া সম্বোধন করিতেন না। ইনি ভবানীপুর ব্রাহ্মসমাজের সভাপতি ছিলেন। ১২৭৪ সালে ২৪শে জ্যৈষ্ঠ (১৮৬৭ খৃঃ ৬ই জুন) ৫৮ বৎসর বয়সে ইনি দেহত্যাগ করেন।

হরচন্দ্র ঘোষ।

 ইঁহার পিতার নাম হলধর ঘোষ। হুগলি বাবুগঞ্জে ১৮১৭খৃষ্টাব্দে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার আদিবাস খানাকুলকৃষ্টনগর। ইঁহার পিতা হলধর কার্য্যোপলক্ষে হুগলিতে আসিয়া বাস করেন।ইনি ২০ বৎসর বয়স পর্য্যস্ত আরবী ও পারসী ভাষা শিক্ষা করেন। পরে হুগলি কলেজ স্থাপিত হইলে ইংরাজী শিক্ষার জন্য তাহাতে প্রবিষ্ট হন এবং অল্পদিনের মধ্যেই ইংরাজী ভাষায় সবিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। শিক্ষায় পারদর্শিতার জন্ত ইনি একটা সোণার ও একটী রূপার ঘড়ি পুরস্কার পান। এই ঘড়ির ভিতর বড়লাট আরল্ অব অকল্যাণ্ডের নাম স্বাক্ষরিত ছিল। শিক্ষান্তে ইনি দেড়শত টাকা বেতনে আবগারী সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টের পদে নিযুক্ত হন। এবং কিছুদিন ঐ কার্য্যে নিযুক্ত থাকিয়া ও নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া শেষে ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট হন। শেষ বয়সে পেনসন লইয়া ইনি হুগলিতে অবস্থান করেন এবং হুগলি মিউনিসিপ্যালিটার ভাইস চেয়ারম্যান হন। ইনি নিম্নলিখিত পুস্তকগুলি প্রণয়ন করিয়াছিলেন;–ভানুমতী চিত্তবিলাস নাটক, কৌরব-বিয়োগ নাটক, চারুমুখ চিত্তহরা নাটক, সপত্নীসরোজ উপন্যাস, রজতগিরিনন্দিনী নাটক, রাজতপস্বিনী গদ্যকাব্য, বারুণী বারণ। ইহা ব্যতীত ইনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রভাকরে অনেক প্রবন্ধ লিখিয়াছেন। ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে নবেম্বর মাসে ইনি দেহত্যাগ করেন।

রামগোপাল ঘোষ।

 বিখ্যাত বাগ্মী। ১২২১ সালে আশ্বিন (খৃঃ ১৮১৫, অক্টোবর) মাসে কলিকাতা রাজধানীতে ইঁহার জন্ম হয়। ইঁহার পিতার নাম গোবিন্দচন্দ্র ঘোষ। পিতার অবস্থা তাদৃশ ভাল না থাকায় বাল্যে রামগোপালের বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ হয় নাই। কিন্তু বাল্যকাল হইতেই ইঁহার বক্তৃতা-শক্তি জন্মিয়াছিল। ইঁহার নয় বৎসর বয়ঃক্রমকালে ইহাদের বাটীতে একটী বিবাহ-সভায় অন্যান্য বালকগণের সহিত মিখ্যা ইংরাজীতে রামগোপাল বরকে বিদ্রূপ করিতেছিলেন। সে ইংরাজীর কোন অর্থ না থাকিলেও তাহার উচ্চারণ এবং স্বরভঙ্গীতে সভাস্থ সকলে মুগ্ধ হন এবং তাঁহারা রামগোপালকে বলেন যে, ভাল ইংরাজী শিখিলে তিনি একজন উৎকৃষ্ট বক্তা হইতে পরিবেন। এই কথা বালক রামগোপালের হৃদয়ে জগরূক হইয়া রহিল। পিতার অবস্থা সচ্ছল না হইলেও ইনি তাঁহাকে অনুরোধ করিয়া হিন্দু কলেজে প্রবিষ্ট হইলেন। তখন এই কলেজের বেতন পাঁচ টাকা ছিল। সুতরাং পিতা তাহা যোগাইয়া উঠিতে পারিলেন না। কিন্তু এই বালকের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ও অধ্যবসায় দর্শনে কলেজের অধ্যক্ষ ডেভিড হেয়ার ইঁহাকে অবৈতনিক ছাত্র করিয়া লইলেন। রামগোপাল অধিকতর যত্ন ও উৎলাহের সহিত অধ্যয়ন করিতে লাগিলেন। এই সময়ে হেনরী ডিরোজিও নামক কলেজের জনৈক শিক্ষক একটা স্বতন্ত্রশ্রেণী স্থাপনপূর্ব্বক কতকগুলি বুদ্ধিমান্ ছাত্র লইয়া উচ্চ ধরণের শিক্ষা দিতে লাগিলেন। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল প্রভৃতি ছাত্রগণ এই শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তাঁহার শিক্ষায় ছাত্রগণের ইংরাজীতে ব্যুৎপত্তি ও স্বাধীন চিন্তা এবং তর্কশক্তির স্ফূর্ত্তি হইতে লাগিল, কিন্তু ঐ সকল ছাত্র ক্রমেই জাতীয় ধর্ম্ম ও আচার ব্যবহারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হুইয়া পড়িতে লাগিলেন। এই শ্রেণী হইতেই এদেশে বিলাতি। সুরার প্রচলন আরম্ভ হয়। এই জন্য কলেজের অধ্যক্ষেরা বিরক্ত হইয়া উক্ত শিক্ষককে পদচ্যুত করিতে সংকল্প করেন। ফলে ডিরোজিও স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করায় অনেক ছাত্রও বিদ্যালয় পরিত্যাগ করেন। তাঁহদের মধ্যে রামগোপাল একজন।

 কলেজ ত্যাগ করিয়া রামগোপাল ১৭ বৎসর বয়সে জোজেফ নামক জনৈক ইহুদী বণিকের আফিসে প্রবিষ্ট হন এবং সাতিশয় মনোযোগ সহকারে প্রভুর কার্ধ্য সম্পাদন করিতে থাকেন। কিন্তু এ সময়েও ইনি পাঠে বিরত হন নাই। অবসর কালে কাব্য, ইতিহাস এবং মনোবিজ্ঞান শাস্ত্রসমূহের আলোচনা দ্বারা সময় ক্ষেপণ করিতেন। এই সময়ে রসিককৃষ্ণ মল্লিকের বাগানে সাহিত্যালোচনার জন্য একটী সভা স্থাপিত হয়। এই সভায় রামগোপাল বক্তৃত করিতেন। এই সভা তৎকালে অতিশয় প্রসিদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। বক্তৃতা ব্যতীত ইনি “জ্ঞানান্বেষণ,” “বেঙ্গল স্পেকটেটর”, (Bengal Spectator) প্রভৃতি সাময়িক পত্র স্বয়ং প্রতিষ্ঠিত করেন ও তাহাতে অনেক প্রবন্ধ লেখেন। অতঃপর কেলসল নামক জনৈক সাহেব জোজেফের কুঠির অংশী হইলে রামগোপাল কুঠির মুচ্ছুদী হন এবং কিছুদিন পরে উহার অংশীদার হন। এই কুঠির নাম 'কেলসল ঘোষ এও কোং' হয়। পরে ১২৫৭ সালে ইনি বণিকসভার সভ্য হন। কিরূপে দেশের উন্নতি হইবে, কিরূপে গভর্ণমেণ্টের সুশাসন বৰ্দ্ধিত হইবে, কিরূপে শিক্ষিত ভারতবাসী উচ্চ রাজকার্য্যে নিযুক্ত হইবে, কিরূপে দেশে শিক্ষার বিস্তার হইবে, এই সকল চিন্তাতেই ইনি সর্ব্বদা ব্যাপৃত থাকিতেন এবং বক্তৃত ও লেখনী সঞ্চালন দ্বারা এই সকল ভাব প্রকাশ করিতেন। কিছুদিন পরে সাহেবের সংস্রব ত্যাগ করিয়া রামগোপাল স্বয়ং কুঠী স্থাপন করেন। ইহাতে ইনি যথেষ্ট লাভবান হন। ঋণ বিষয়ে ইনি সতর্ক ছিলেন। একবার সাহেবেরা দেউলিয়া হইয়া পড়ায় ইঁহার এমন অবস্থা হইয়াছিল যে, সমস্ত ঋণ পরিশোধ করিতে হইলে ইঁহাকে সর্ব্বস্বান্ত হইতে হইত। তৎকালে অনেকেই ইঁহাকে বিষয় সম্পত্তি বেনামী করিবার পরামর্শ দেন, কিন্তু রামগোপাল তাঁহাদিগকে স্পষ্টবাক্যে বলেন, ঋণ পরিশোধের জন্য যদি পরিধেয় বস্ত্রখানিও বিক্রয় করিতে হয়, তাহাও করিব। সৌভাগ্যবশতঃ সেবার ইঁহাকে এক পয়সাও লোকসান দিতে হয় নাই। বাজারে ইঁহার এমনই নামডাক হইয়াছিল যে, ইঁহার মুখের কথায় লোকে লক্ষ টাকা পর্য্যন্ত কর্জ দিতে কুষ্ঠিত হইত না। লোকে বলিত, পূর্ব্বের সূর্য্য পশ্চিমে উদয় হইলেও রামগোপাল ঠকাইবে না।

 বক্তৃতা ও লেখনী সঞ্চালন দ্বারা রামগোপাল দেশের অনেক কাজ করিয়া গিয়াছেন। ইঁহার কথায় গবর্ণমেণ্ট আইনের সংশোধন করেন। গবর্ণমেণ্ট নিমতলার শ্মশান ঘাট কলিকাতার আরও দক্ষিণে লইয়া যাইবার জন্য উদ্যত হইলে রামগোপালের বাকপটুতাগুণেই উক্ত কার্য্য স্থগিত হয়। ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দে ইহাকে কলিকাতা ছোট আদালতে দ্বিতীয় জজের পদ গ্রহণ করিবার জন্য অনুরোধ করা হয়। ইনি এ পদ গ্রহণ করিতে অস্বীকার করেন। মফঃস্বলের ইংরাজগণের বিচার কলিকাতা মুপ্রিম কোর্টেই হইবার নিয়ম ছিল। কোম্পানি যখন উহাদিগকে দেওয়ানী মোকদ্দমা সম্বন্ধে দেশীয় আদালতের বিচারাধীন করিবার প্রস্তাব করেন, তখন ইংরেজের ঐ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ঘোরতর আন্দোলন উথপিত করে। ঐ আন্দোলনের প্রতিবাদ উপলক্ষে রামগোপাল বিলক্ষণ বক্তৃতা ও যুক্তিপ্রয়োগ শক্তি দেখাইয়াছিলেন। বেথুন স্কুল স্থাপিত হইলে যে সকল বাঙ্গালী তাঁহাদের কন্যাগণকে উক্ত বিদ্যালয়ে পাঠার্থ প্রেরণ করেন, রামগোপাল তাঁহাদের অন্যতম। ইনি বঙ্গদেশীয় ব্যবস্থাপক সভার সভ্য ছিলেন এবং অনেক কমিটী ও দেশহিতকর অনুষ্ঠানের সহিত সংসৃষ্ট ছিলেন। শক্তিশালী ৰাঙ্গালী রাজনৈতিকগণের মধ্যে ইনি তৎসময়ে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিলেন। ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে ভারতবাসীদিগকে সিবিল সার্ব্বিসে লওয়া উচিত কিনা এই বিষয় লইয়া বিলাতের পাৰ্লিয়ামেণ্টে আন্দোলন উপস্থিত হইলে, রামগোপাল যে যুক্তিপূর্ণ সুদীর্ঘ বক্তৃতা দেন, তাহা পাঠ করিয়া ইংলণ্ডের লোকেরা চমকিত হইয়াছিলেন এবং উহা সুবিখ্যাত বাগী বার্কের বক্তৃতার সহিত তুলনা করিয়াছিলেন। ইঁহার দানশক্তিও যথেষ্ট ছিল। মৃত্যুর পূর্ব্বে আপনার তিন লক্ষ টাকার সম্পত্তির মধ্যে দাতব্য চিকিৎসালয়ে ২০ হাজার এবং বিশ্ব-বিদ্যালয়ে ৪০ হাজার টাকা দান করেন। বন্ধুগণের নিকট প্রায় ৪০ হাজার টাকা পাওনা ছিল, তাহার খতপত্র ছিঁড়িয়া ফেলিয়া এই টাকাও ছাড়িয়া দেন। বাঙ্গালা ১২৭৫ সালে (১৮৬৮ খৃঃ ১৫ই জানুয়ারী) ৫৪ বৎসর বয়সে ইঁহার দেহত্যাগ হয়।

প্যারিচাঁদ মিত্র।

‘আলালের ঘরের দুলাল' প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণেতা। ১২২১ সালে শ্রাবণ মাসে কলিকাতা নিমতলার মিত্রবংশে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার পিতার নাম রামনারায়ণ মিত্র। প্যারিচাঁদ বাঙ্গালা ও পারসী ভাষায় অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া:৯ বৎসর বয়সে হিন্দু কলেজে প্রবিষ্ট হন এবং অল্প দিনের মধ্যেই তথাকার পাঠ শেষ করেন। পরে ইনি কলিকাতা পাব্লিক লাইব্রেরীর ডেপুটী লাইব্রেরীয়ান পদে নিযুক্ত হন এবং ক্রমে তাহার সেক্রেটারী ও লাইব্রেরীয়ান পদে উন্নীত হন। কিন্তু অল্পদিন পরেই ইনি চাকুরীতে জবাব দিয়া ব্যবসায় কার্য্যে প্রবৃত্ত হন এবং তাহাতে প্রভূত অর্থ ও সন্মান উপার্জন করেন। ইনি “কলিকাতা রিভিউ” নামক ইংরাজী পত্রে বহু প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন এবং স্বয়ং 'মাসিক পঞ্জিকা' নামে একখানি মাসিক পত্রিক সম্পাদন করিয়া বঙ্গভাষার যথেষ্ট উন্নতি সাধন করিয়াছিলেন। ইঁহার প্রণীত “আলালের ঘরের দুলাল’ বঙ্গ সাহিত্যে এক অপূর্ব্ব গ্রন্থ। ইনি অতিশয় মাতৃভক্ত ছিলেন। প্রত্যহ প্রাতে উঠিয়া মার পাদোদক পান না করিয়া অন্য কার্য্যে মনোনিবেশ করিতেন না। ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে ২৩শে নবেম্বর ইনি দেহত্যাগ করেন। ইনি বৃটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েসন ও কলিকাতায় থিয়সফিক্যাল সোসাইট প্রতিষ্ঠা কার্য্যে বিশেষ যোগদান করিয়াছিলেন। ইনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় থাকিয়া পশুক্লেশ নিবারণ বিষয়ক আইন পাশ করেন। ইনি একদিকে যেমন প্রেততত্ত্ব ও অধ্যাত্মবিদ্যার আলোচনা করিতেন, অপর দিকে তেমনই বঙ্গভাষা ও সমাজ সংস্কার কার্য্যেও মনোযোগী ছিলেন। ইঁহার রহস্যপ্রিয়তা শেষ বয়স পর্যন্ত সমভাবে বিদ্যমান ছিল। ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে ইঁহার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। কথিত আছে, তাঁহার প্রেতাত্মা স্থূল শরীর ধারণ করিয়া মধ্যে মধ্যে প্যারিচাঁদের সহিত কথাবার্ত্তা কহিতেন। প্যারিচাদের লিখিত পুস্তকগুলির মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি বিশেষ উল্লেখ যোগ্য,—আলালের ঘরের দুলাল, রামারঞ্জিকা, মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়, আধ্যাত্মিক, অভেদী ও ডেভিড হেয়ারের জীবন চরিত।

নরেন্দ্রনাথ সেন।

 ইনি কলিকাতার কলুটোলার হরিমোহন সেনের চতুর্থ পুত্ত্র ও রামকমল সেনের পৌত্ত্র। জন্ম ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দে ২৩শে ফেব্রুয়ারি। নরেন্দ্রনাথের চারি ভ্রাতাই জয়পুর রাজসরকারে কর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন, কিন্তু ইনি চিরদিনই স্বাধীনভাবে জীবিকানির্ব্বাহ করিয়াছেন। হিন্দু কলেজে কিছু দিন পাঠান্তে ইনি কাপ্তেন পামারের নিকট কয়েক বৎসর গৃহে বসিয়া বিদ্যা শিক্ষা করেন। বাল্যকাল হইতেই ইঁহার সংবাদপত্রে লিখিবার অনুরাগ দৃষ্ট হয়। ১৯ বৎসর বয়সে ইনি আন্‌লি (Anley) নামক এটর্ণীর অফিসে কার্য্য শিক্ষার জন্য প্রবেশ করেন। সেই সময় কিশোরীচাঁদ মিত্র সম্পাদিত ইণ্ডিয়ান ফিল্ড নামক সংবাদপত্রের প্রবন্ধলেখকস্বরূপ ঐ পত্রের সহিত সংশ্লিষ্ট হন। ১৮৬১ খৃষ্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্থমুকুলে ষ্টণ্ডিয়ান মিরার নামক পাক্ষিক পত্র স্থাপিত হয়। মনোমোহন ঘোষ ইহার সম্পাদক ছিলেন এবং নরেন্দ্রনাথ নিয়মিতরূপে ইহাতে প্রবন্ধাদি লিখিতেন। ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দে মনোমোহন ইংলওে গমন করিলে সম্পাদনভার নরেন্দ্রনাথের উপরেই ন্যস্ত হয়। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে হাইকোর্টের এটর্ণী দলভূক্ত হইয়া নব ব্যবসায়ে লিপ্ত নরেন্দ্রনাথ সময়াভাবে কিছু দিনের জন্য মিরারের সহিত সম্বন্ধ ত্যাগ করিতে বাধ্য হন। তখন পত্রখানি সপ্তাহিক হইয়াছে। কেশবচন্দ্র সেন ইংলও হইতে প্রত্যাগত হইয়া মিরারকে দৈনিক পত্রে পৱিণত করিতে ইচ্ছ প্রকাশ করিলে নরেন্দ্রনাথ, ইঁহার সহিত একমত হইয়া পুনরায় ইহার সহিত সম্বন্ধ স্থাপিত করিলেন এবং প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের অল্পদিনব্যাপী সম্পাদকতার পর নরেন্দ্রনাথ মিরারের সম্পাদনভার গ্রহণ করিলেন। ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দে পত্রখনির একমাত্র স্বত্বাধিকারী হইয়া এখনও পর্য্যন্ত ইনি অতি যোগ্যতার ও নির্ভীকতাযর সহিত ইহার সম্পাদন করিয়া আসিতেছেন। কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটীর প্রতিনিধিস্বরূপ ইনি ১৮৯৭ হইতে ১৮৯১ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য থাকিয়া দেশহিতৈষিতা ও তেজস্বিতার সম্যক্ পরিচয় প্রদর্শন করিয়াছেন। ইনি গীতা-সভার সভাপতি। বিদেশে যাইয়া ভারতীয় যুবকগণ যাহাতে শিল্পাদি শিক্ষা করিতে পারে, তাহার ব্যবস্থা ও অর্থানুকুল্য করিবার জন্য কলিকাতায় একটা সমিতি আছে। নরেন্দ্রনাথ তাহারও সভাপতি। শিল্প, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজনীতি ও ধর্ম্মসংস্কারসম্বন্ধীয় যত সভা কলিকাতায় আছে, নরেন্দ্রনাথ প্রায় সকলগুলির সহিত বিশিষ্টভাবে জড়িত আছেন। কেবল থিয়জফিকেল সোসাইটী ইঁহারই নেতৃত্বাধীনে আছে। ইনি এত প্রকার কার্য্যের সহিত সম্বন্ধ রাখেন ষে, লোকে আশ্চর্য্যাম্বিত হয় কেমন করিয়া ইনি এই সকল কার্য্য সম্পন্ন করেন। কিন্তু এত কাজ সত্ত্বেও মিরার ইঁহার মনোযোগের প্রধান বিষয়। ইঁহার পাঠাভ্যাস, চিন্তাশীলতা ও শারীরিক পরিশ্রম অনেক যুবকেরও আদর্শস্থানীয়। চরিত্রনির্ম্মলতায়, দেশনুরাগে, রাজভক্তিতে, পরোপকারিতায় ইমি ৰঙ্গীয় সমাজে অতি উচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছেন। ১৯৩৮ খৃষ্টাব্দে ২৬শে জুন ইনি “রায় বাহাদুর” উপাধি লাভ করেন। ইঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র সত্যেন্দ্রনাথ অন্ততম এটর্ণী।

রমেশচন্দ্র মিত্র।

(স্যার) জন্ম ১৮৪০ খৃষ্টাব্দে। ইঁহার পৈত্রিক বাসস্থান দমদমার সন্নিকট রাজহাট বিষ্ণুপুর গ্রামে। ইনি বি, এল, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া ২১ বৎসর বয়সে সদর দেওয়ানি আদালতে ওকালতী ব্যবসায় আরম্ভ করেন। উক্ত আদালতে দেড় বৎসর থাকিয়া প্রায় বার বৎসর কাল হাইকোর্টে ব্যবসায় করিয়া তৎকালীন উকিলগণের শীর্ষস্থান অধিকার করেন। অনুকুল মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর ইনি হাইকোর্টের অন্যতম জজস্বরূপে নিযুক্ত হন। ১৮৭১ হইতে ১৮৯০ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত এষ্ট পদে অবস্থিত হইয়া ইনি বহুল পরিমাণে তীক্ষ্ণধীশক্তি, আইন জ্ঞান ও তেজস্বিতার পরিচয় দেন। এই সময়ের মধ্যে ইনি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে দুইবার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন। বাঙ্গালী জজের মধ্যে এই সন্মান ইনিই প্রথমে প্রাপ্ত হন। ইনি বড়লাটের ব্যবস্থাপক সভার ও Public service commission নামক সমিতির অন্ততম সভ্যরূপে কার্য্য করিয়াছিলেন। ইনি প্রথমে নাইট ও পরে কে, সি, আই, ই,উপাধি প্রাপ্ত হন। আদালতকে অবজ্ঞা করা অপরাধে যখন সুরেন্দনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ফুলবেঞ্চের বিচারাধীন হন, তখন কেবল রমেশচন্দ্রই অন্যান্য জজগণের সহিত ভিন্নমত হন এবং যুক্তিপূর্ণ একটী সুদীর্ঘ মন্তব্য পাঠ করেন। ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে ১৩ই জুলাই বহুমুত্ররোগে ইঁহার দেহত্যাগ ঘটে। ইনি পিতার ষষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন। ইঁহার দ্বিতীয় অগ্রজ উমেশচন্দ্র “বিধবা-বিবাহ” নাটকের প্রণেতা এবং তৃতীয় অগ্রজ কেশবচন্দ্র সুবিখ্যাত মৃদঙ্গবাদক ছিলেন। কর্ম্ম হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া রমেশচন্দ্র বিবাহ ব্যয় সংক্ষেপ কল্পে বিশেষ চেষ্টান্বিত হইয়াছিলেন এবং জাতীয় সমিতিতে যোগদান করিয়াছিলেন।

তারানাথ তর্কবাচস্পতি।

 বিখ্যাত পণ্ডিত এবং গ্রন্থরচয়িতা। ১৮১২ খৃষ্টাব্দে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। ইনি কাশীধামে এবং কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত ভাষায় যাবতীয় শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া তর্কবাচস্পতি উপাধি প্রাপ্ত হন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত ইঁহার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। তাঁহার চেষ্টায় ইনি ১৮৪৫ খৃষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকের পদ প্রাপ্ত হন। ইহার পূর্বেই তিনি অর্থোপার্জ্জনের নিমিত্ত বহুবিধ ব্যবসায় অবলম্বন করিয়াছিলেন। কাপড়ের কারবার, স্বর্ণালঙ্কারের দোকান, কৃষিকার্য্য প্রভৃতি বহুবিধ ব্যবসায়ে তিনি লিপ্ত ছিলেন। নেপাল হইতে কাষ্ঠ আনাইয়া বিক্রয়, বীরভূমে বিঘাপ্রতি দুই আনা খাজনায় দশহাজার বিঘা জমি লইয়া চাষ, এবং তথায় পাঁচশত গরু রাখিয়া তাহা হইতে উৎপন্ন ঘৃত কলিকাতায় চালান দেওয়া প্রভৃতি তাঁহার অনেকগুলি ব্যবসায় ছিল; কিন্তু ব্যবসায় কার্য্যে নিযুক্ত থাকিয়াও তিনি শাস্ত্রালোচনা বা সাহিত্যসেবা পরিত্যাগ করেন নাই। ইনি বার বৎসর পরিশ্রম ও প্রায় ৮০,০০০ টাকা ব্যয় করিয়া বাচস্পত্যাভিধান নামক এক সুবৃহৎ অভিধান প্রণয়ন করেন; তদ্ব্যতীত শব্দস্তোম মহানিধি, আশুবোধ ব্যকরণ, শব্দার্থরত্ন, বহুবিবাহবাদ প্রভৃতি বহুবিধ গ্রন্থ এবং বেণীসংহার, কাদম্বরী, মালবিকাগ্নিমিত্র, মুদ্রারাক্ষস প্রভৃতি সংস্কৃত গ্রন্থের টীকা রচনা করেন। ইনি স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন এবং বিধবা বিবাহ প্রচলন বিষয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহায় ছিলেন, বহুবিবাহ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত তাঁহার মতান্তর হওয়ায় তিনি ‘লাঠি থাকিলে পড়ে না' নামক একখানি ক্ষুদ্র গ্রন্থ রচনা করিয়া বছৰিবাহ প্রথার পক্ষ সমর্থন করেন। ১৮৬১ খৃষ্টাব্দে ‘গয়া-মাহাত্মা’ ও ‘গয়া শ্রাদ্ধাদি পদ্ধতি’ নামক পুস্তক রচনা করিয়া তাহার তিন সহস্র খণ্ড বিনামূল্যে বিতরণ করিয়াছিলেন। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে ৺কাশীধামে ইহার পরলোক প্রাপ্তি হয়। ইঁহার পুত্র শ্রীযুক্ত জীবানন্দ বিদ্যাসাগর বি, এ সংস্কৃত ভাষায় রচিত কাব্য নাটকাদি প্রকাশ করিয়া সংস্কৃঙ শিক্ষার পক্ষে অনেক সুবিধা করিয়াছেন।

কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায় (দেওয়ান)।

 প্রসিদ্ধ “ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত” প্রণেতা। ১২২৭ সালের কার্ত্তিক মাসে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। ইহার পিতার নাম উমাকান্ত রায়। ইহাদের বংশ কৃষ্ণনগর রাজসংসারের দেওয়ান চক্রবর্ত্তী বলিয়া বিখ্যাত। পঞ্চম বৎসর বয়সে পিতার নিকট ইঁহার বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ হয়। পরে অষ্টমবর্ষ বয়সে পার্শী শিখিতে আরম্ভ করিয়া ইনি তাহাতে যথেষ্ট বুৎপত্তি লাভ করেন এবং কৃষ্ণনগর জজ আদালতে রিটর্শনবিসের সেরেস্তার কাজ শিখিতে আরম্ভ করেন। এই সময় গভর্ণমেণ্টের আদেশে আদালত হইতে পার্শী ভাষা উঠিয়া ষায় এবং ইংরাজি ভাষার প্রচলন হয়। কার্ত্তিকেয়চন্দ্র অতঃপর ইংরাজী শিক্ষা করেন। প্রথমে ইনি ডাক্তারী পড়িবার জন্য কলিকাতা মেডিকেল কলেজে প্রবিষ্ট হন, কিন্তু নানা কারণে তাহা ত্যাগ করিয়া কৃষ্ণনগর রাজবাটীতে খাস সেক্রেটারীর পদে নিযুক্ত হন। পরে ইনি এই রাজষ্টেটের দেওয়ানী লাভ করেন এবং তিনশত টাকা পর্য্যন্ত বেতন পান। ইনি রাজষ্টেটের উন্নতি এবং রাজপরিবারের মঙ্গল জন্য আন্তরিক চেষ্টা করেন। ইনি “ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত” নামক এক বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেন। ইহাতে কৃষ্ণনগর রাজবংশের ইতিহাস সবিস্তারে লিখিত আছে।. তদ্ব্যতীত ইনি “গীতমঞ্জরী” এবং আত্মজীবনচরিত প্রণয়ন করেন। সঙ্গীতবিদ্যাতেও ইঁহার পারদর্শিত ছিল। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে ২রা আক্টোবর তারিখে ইনি দেহত্যাগ করেন। সুবিখ্যাত নাটককার ও হাস্যরসাত্মক গীতরচয়িত শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্র লাল রায় ইঁহার অন্ততম পুত্র।

গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

(স্যার) জন্ম ২৬শে জানুয়ারি, ১৮৪৪ খৃষ্টাব্দ। ইনি হেয়ার স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করিয়া প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রবেশ করেন এবং সেইখান হইতে ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে গণিতবিদ্যায় এম. এ. পরীক্ষার উত্তীর্ণ হইয়া সুবর্ণপদক পুরস্কার প্রাপ্ত হন। পর বৎসরই বি, এল, পরীক্ষার উত্তীর্ণ হইয়া গুরুদাস কিছুদিনের জন্ত বহরমপুর কলেজে আইনের অধ্যাপন করেন। অতঃপর ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা হাইকোর্টে ওকালতী আরম্ভ করেন। ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে ইনি ডি, এল, উপাধি লাভ করেন। অতঃপর গুরুদাস দুই বৎসর পরে ঠাকুর ল-লেকচারার কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া “হিন্দুগণের বিবাহ ও স্ত্রীধনসম্বন্ধীয় আইন"বিষয়ে শিক্ষা নেন। ইনি ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার অন্ততম সভ্যরূপে মনোনীত হন এবং ১৮৮৮ খৃষ্টাব্দে অস্থায়ী ও পর বৎসর স্থায়িভাবে কলিকাতা হাইকোর্টের অন্যতম জজের পদে অধিষ্ঠিত হন এবং এই পদ হইতে ১৯০৪ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে অবসর গ্রহণ করেন। ঐ বৎসরেই গবর্ণমেণ্ট ইহাকে “নাইট” উপাধি প্রদান করেন। শিক্ষা বিষয়ে ইঁহার বিশেষ অনুরাগ ছিল। ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে ইনি কলিক্কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইসচেন্‌সেলার পদে অধিষ্ঠিত হন এবং নিয়মিত দুই বৎসর কাল কার্য্য করিয়া ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে আবার দুই বৎসরের জন্য ঐ কার্যে নিযুক্ত হন। ১৯৯২ খৃষ্টাব্দে ইনি ইণ্ডিয়ান ইউনিভারসিটী কমিসনের অন্ততম সদস্ত নির্ব্বাচিত হন। ছাত্রমণ্ডলীর সহিত ইঁহার বিশেষ সহানুভূতি ছিল এবং ইহাদের উন্নতিকল্পে অনেক কার্য্য ইনি করিয়াছিলেন। ইনি ইংরেজী ভাষায় একখানি পাটীগণিত প্রকাশিত করিয়াছিলেন এবং A few thoughts of Education নামক একটী শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। বাঙ্গালা ও সংস্কৃত সাহিত্যে ইনি বিলক্ষণ বুৎপন্ন ছিলেন এবং সাহিত্যিক ব্যাপারে বোগদান করিতেন। ইনি একজন আড়ম্বরশূন্য নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন। 

মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর।

 কলিকাতায় পাথুরিয়াঘাটার বিখ্যাত জমিদার। ১৮৩১ খৃষ্টাঙ্গে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। ইহার পিতার নাম হরকুমার ঠাকুর। ইনি প্রথমে বাড়ীতে গুরুমহাশয়ের নিকট সামান্য শিক্ষালাভ করিয়া, তৎকালীন ইনফ্যাণ্ট স্কুলে, পরে হিন্দুকলেজে অধ্যয়ন করেন। সে সময়ে এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হয় নাই, সুতরাং হিন্দু কলেজের পড়া শেষ হইলে যতীন্দ্রমোহন বাড়ীতে ইংরাজ শিক্ষকের নিকট ইংরাজী এবং পণ্ডিতের নিকট সংস্কৃত শিক্ষা করেন। ২৭ বৎসর বয়সে পিতৃবিয়োগ হইলে ইনি খুল্লতাত প্রসন্নকুমার ঠাকুরের নিকট বিষয় কার্য্যাদি শিক্ষা করেন। ইহার অল্পদিন পরেই ইনি বৃটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েসনের সম্পাদক হন এবং ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্ত পদ লাভ করেন এবং পরে বড়লাটের ব্যবস্থাপক সভার সভ্য পদে অধিষ্ঠিত হন। এই সকল কার্য্যে ইনি গভর্ণমেণ্টের নিকট প্রচুর সুখ্যাতি পাইয়াছিলেন। ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে বড়লাট লর্ড মেয়ো ইঁহাকে ‘রাজা বাহাদুর’ এবং ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ‘রাজরাজেশ্বরী’ উপাধি গ্রহণ-কালে বড়লাট লর্ড লিটন ‘মহারাজা’ উপাধি প্রদান করেন। ১৮৭৯ খৃষ্টাব্দে ইনি সি, এস, আই; ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে কে, সি, এস, আই; ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে মহারাজা বাহাদুর ও ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে পুরুষানুক্রমে ‘মহারাজা’ উপাধি প্রাপ্ত হন। ইনি বহুবিধ সৎকার্য্য করিয়া গিয়াছেন। বিধবাদের দুঃখ দূরীকরণ জন্য এক লক্ষ টাকা, মেও হাঁসপাতালের জন্য দশ হাজার টাকা, দাতব্য সভায় আট হাজার টাকা দান করিয়া গিয়াছেন। ইহা ব্যতীত গোপনে দান অনেক আছে। ইহার বাটতে প্রত্যহ অতিথিসেবা হয়। হিন্দুধর্ম্মে ইঁহার প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। প্রভাতে সন্ধ্যাবন্দনাদি না করিয়া ইনি বাহিয়ে আসিত্তেন না। ইনি একজন সুকবি ছিলেন।প্রবন্ধ, সঙ্গীত এবং পুস্তক প্রণয়ন করিয়াছেন। উভয় সঙ্কট, চক্ষুদান, যেমন কর্ম্ম তেমনি ফল, বিদ্যাসুন্দর নাটক প্রভূতি প্রহসনগুলি ইঁহার লিখিত। ইঁহারই চেষ্টায় ও উৎসাহে এদেশে থিয়েটারের প্রথম স্বত্রপাত হয়, এবং ইনিই ভ্রাতা সোরীন্দ্র মোহনকে লইয়া থিয়েটারে ঐক্যতান বাদনের প্রতিষ্ঠা করেন। ইনি একদিকে যেমন অতুল ঐশ্বর্ষ্যের অধিকারী, অন্যদিকে তেমনই সাহিত্য ও সঙ্গীতের অনুরাগী ও উৎসাহদাতা ছিলেন। ইনি সাহিত্যসেবীগণকে বিশেষ আদর করিতেন এবং জীবনের অন্তিম ভাগেও সাহিত্যিকগণের মিলন জন্য যে “পূর্ণিমা -সম্মিলন” হয়, তাহাতে যোগদান করিতেন। ইনি রাজদ্বারে যেমন সম্মান, দেশের লোকের নিকটও তেমনই সম্মান পাইতেন। ইনি বৃটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েসানের সেক্রেটারীর কার্ঘ্য বহুদিন ধরিয়া সম্পন্ন করেন; পরে উক্ত সভার সভাপতিও হইয়াছিলেন। জীবনের শেষ ভাগে সাধারণ সভায় বড় একটা যোগদান করিতে পারিতেন না, কিন্তু কি দেশের লোক, কি ছোটলাট, বড়লাট সকলেই বিশেষ বিশেষ কার্য্যোপলক্ষে ইঁহার সহিত পরামর্শ করিতেন। লর্ড নর্থব্রুক, লর্ড রিপণ, লর্ড ল্যান্সডাউন ও বঙ্গের অনেক ছোটলাট ইঁহার বাড়ীতে আসিয়া আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছেন। বেলগেছিয়া নাট্যশালা স্থাপনে ইনি প্রধান উদ্যোগী ছিলেন। পরে এইখানে অভিনয় ঋদ্ধ হইলে নিজবাটীতে কয়েক ৰৎসর অভিনয় করাইয়া দেশীয়গণ মধ্যে নাট্যাভিনয়ে রুচিবর্ধন করেন। ইঁহারই উৎসাহে মাইকেল মধুসূদন অমিত্রাক্ষরচ্ছন্দে তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য বাঙ্গাল ভাষায় রচনা করেন। যতীন্দ্রমোহন উক্ত গ্রন্থের মুদ্রাঙ্কন ব্যয়ভার বহন করেন এবং মাইকেল উক্ত গ্রন্থের হস্তলিপি ইঁহাকে উপহার প্রদান করেন। এই হস্তলিপিখানি ইঁহার পুস্তকাগারে যত্নের সহিত রক্ষিত হইয়াছে। যতীন্দ্রমোহনের বিদ্যানুরাগ তাঁহার সংগৃহীত বহুসংখ্যক মূল্যবান্ গ্রন্থ-পরিপূর্ণ বিস্তৃত পুস্তকাগার দেখিলে বুঝিতে পারা যায়। যেরূপ অবস্থার লোক হউন না কেন, সকলেই ইহার সাক্ষাৎলাভ করিতে পারিতেন এবং সকলকেই ইনি মিষ্টালাপে পরিতুষ্ট করিতেন। পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যশিক্ষা ও সভ্যতা ইঁহাতে এক অপুর্ব্ব ভাবে সম্মিলিত ছিল।

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

 ইনি কলিকতা তালতলার প্রসিদ্ধ ডাক্তার দুর্গাচরণ বলোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় পুত্ত্র। ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দে নবেম্বর মাসে সুরেন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। ডভেটন কলেজে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করিয়া ইনি ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে বি, এ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঐ বৎসরেই রমেশচন্দ্র দত্ত ও বিহারিলাল গুপ্তের সহিত ইনি সিভিল সারভিস্ পরীক্ষা দিবার মানসে ইংলণ্ডে যান। তিনজনেই প্রতিষ্ঠার সহিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সুরেন্দ্রনাথের বয়স লইয়া গোলমাল হয় এবং ইনি আদালতের আশ্রয় লইঙে বাধ্য হন, কিন্তু মোকদ্দমা উঠিবার আগেই কর্তৃপক্ষীয়গণ ইঁহাকে পরীক্ষাত্তীর্ণের তালিকাভুক্ত করিয়া লন। ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে ভারতে আসিয়া ইনি সিলেটের আসিষ্টেণ্ট ম্যাজিষ্ট্রেটস্বরূপে কার্য্য করেন। আদালতের নথী কাটাকাটি করিয়াছেন, এই হেতুবাদে ইঁহার নামে অভিযোগ উপস্থিত হইলে বেঙ্গল গভর্ণমেণ্ট তদন্ত করিয়া ইঁহাকে নিয়ম বিরুদ্ধ কার্য্য করার জন্য মাসিক ৫০৲ টাকা বৃত্তি দিয়া কর্ম্ম হইতে অপসারিত করেন। শুনা যায়, এই বৃত্তি ইনি গ্রহণ করেন নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয় ইঁহাকে ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা মেট্রোপলিটন ইনষ্টিটিউসনে ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপনায় ২০০৲ শত টাকা বেতনে নিযুক্ত করেন; তাহার পর নব প্রতিষ্ঠিত সিটী কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনা করিয়া ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে ইনি ফি চার্চ ইনষ্টিটিউশনে ইংরাজি সাহিত্যের প্রধান অধ্যাপকের পদে অধিষ্ঠিত হন। এইখান হইতে ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে বহুবাজারে নিজ প্রতিষ্ঠিত একটী বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করিবার জয় গমন করেন। এই বিদ্যালয় কালে রিপন কলেজ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। অল্পদিন হইল এই কলেজটী সুরেন্দ্রনাথ সাধারণের হস্তে দিয়াছেন। ইঁহার অধ্যাপনায় ছাত্রগণ এত মুগ্ধ যে, ছাত্রসমাজ ইহাকে গুরুর ন্যায় শ্রদ্ধা তক্তি করে। ইনিও ছাত্রমণ্ডলীকে পুত্ত্রে ন্যায় স্নেহ করেন। ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে ২৩শে জুলাই আনন্দমোহন বসুর সহযোগিতায় ইনি Indian Association নামক সমিতি স্থাপিত করিয়া এখন পর্যন্ত অতিশয় যোগ্যতায় সহিত ইহার সম্পাদকের কার্য করিতেছেন। ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দে ইনি ‘বেঙ্গলি' পত্রের স্বত্ব কিনিয়া লন এবং ইহার সম্পাদনাযভার গ্রহণ করেন। তখন এখানি সাপ্তাহিক ছিল। উত্তরকালে ইহার স্বত্ব বিক্রয় করেন এবং ইহা সৈনিক পত্রে পরিণত হয়। কিন্তু সম্পাদন ভার ইঁহার হস্তে বরাবরই ন্যাস্ত আছে। সিভিল সারভিস পরীক্ষা দিবার বয়স ২১ হইতে ১৯ বৎসরে কমান হইলে সুরেন্দ্রনাথ ভারতে তুমুল আন্দোলন উপস্থিত করেন ও ভারতের নানা প্রদেশে বক্তৃতাদি করিয়া লোক-মত গঠন করেন। লর্ড লিটনের সংবাদপত্র-আইনের বিরুদ্ধেও অনেক সভাসমিতি আহূত করেন। ইনি চিরকালই নিয়মাধীন আন্দোলনের পক্ষপাতী এবং ইংরাজ জাতির ন্যায়পরায়ণতায় আস্থাবান। ইঁহার ধারণা এই যে, দেশের অভিৰোগ ও অভাৰ ইংরাজাতির সমক্ষে ধীরভাবে জানাইলে, আজই হউক বা কিছুদিন পরেই হউক, তাঁহারা তাহার প্রতিকার করিবেন। ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা মিউনিসিপাল সভার সদস্য রূপে প্রবেশ করিয়া ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে ১৭ জন সদস্যের সহিত উহার সংশ্রব ত্যাগ করেন। ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে ইনি উক্ত সভার প্রতিনিধিস্বরূপ বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় প্রবেশ করেন এবং ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে যখন নূতন মিউনিসিপাল আইনের পাণ্ডুলিপি ব্যবস্থাপক সভায় উপস্থাপিত করা হয়, তখন ইনি তাহার তীব্র প্রতিবাদ করেন। ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে একখানি বাঙ্গালা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যে, হাইকোর্টের জজ নরিস্ সাহেব জবরদস্তি করিয়া শালগ্রাম শিলা আদালতে লইয়া যান। এই সংবাদ অবলম্বনে বেঙ্গলিপত্রে ইনি জজ সাহেবের আচরণ সম্বন্ধে কঠোর মন্তব্য প্রকাশিত করেন। ইহার ফলে আদালত অবজ্ঞা করার অপরাধে ইনি অভিযুক্ত হইয়া হাইকোর্টের ফুলবেঞ্চের বিচারাধীনে আসেন। প্রকৃত ঘটনা এই যে, নরিস সাহেব বাদী প্রতিবাদী উভয়েরই সম্মতিক্রমে শালগ্রাম শিলা আদালতে লইয়া যাইতে আদেশ করেন। প্রকৃত কথা অবগত হইয়াই সুরেন্দ্রনাথ ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহাতে কোন ফল হইল না, দোষী সাব্যস্ত হইয়া দুই মাসের জন্য সিভিল জেলে থাকিতে হইবে, এই দণ্ডে ইনি দণ্ডিত হইলেন। কেবলমাত্র রমেশচন্দ্র মিত্র মহাশয় বলিয়াছিলেন যে, অর্থদণ্ডই যথেষ্ট, কিন্তু এককের মত বলিয়া তাহা গ্রাহ্য হয় নাই। নরিস সাহেবের জন্য সুরেন্দ্রনাথের এই দুৰ্গতি ঘটে; কিন্তু ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে যখন সুরেন্দ্রনাথ সংযোগিগণের সহিত ভারতবিষয়ক আন্দোলন করিতে ইংলণ্ডে যান, তখন বৃষ্টল নগরে একটী সভা আহবান উপলক্ষে নরিস সাহেব অযোচিত হইয়া ইঁহাদের অনেক সাহায্য করিয়াছিলেন। জাতীয় সমিতি কল্পে সুরেন্দ্রনাথ একজন প্রধান উদ্যোক্ত। ইনি ১৮৯৫ খৃষ্টাব্দে পুনা নগরে এই সমিতির ১১শ অধিবেশনে এবং ১৯০২ খৃষ্টাব্দে আমেদাবাদে ইহার ১৮ শ অধিবেশনে সভাপতির আসন গ্রহণ স্বরূপ সম্মান পাইয়াছিলেন। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে Royal commission on Indian Expenditure নামক সমিতির সমক্ষে ইনি যে সাক্ষ্য প্রদান করেন, তাহাতে ইঁহার রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক গভীর জ্ঞান সম্যক্ প্রতিভাত হইয়াছিল। জুরি নোটিফিকেসন প্রধানতঃ ইঁহারই আন্দোলনের ফলে প্রত্যাহৃত হয়। বঙ্গচ্ছেদ উপলক্ষে যে এদেশে ঘোরতর আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছে, তাহার মূলে ইনিই অন্যতম। ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে এপ্রেল মাসে বরিশালে যে প্রাদেশিক সমিতি বসাইবার আয়োজন হয়, তাহা মাজিষ্ট্রেট সাহেবের জাদেশে বন্ধ হইয়া যায়। অভিধান গমনের সময়ে সুরেন্দ্রনাথ ধৃত হন এবং অবজ্ঞা করা অপরাধে অভিযুক্ত হইয়া অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হন। কলিকাতা হাইকোর্টে আপীলের ফলে সুরেন্দ্রনাথের নির্দ্দোযিতা প্রমাণ হয় এবং দও রহিত হয়। ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে মে মাসে ইনি কলিকাতার সংবাদপত্রের অন্ততম প্রতিনিধি স্বরূপে Press Conference নামক সমিতিতে নিমন্ত্রিত হইয়া, ইংলণ্ডে গমন করেন। গত ৩০ বৎসর ধরিয়া সুরেন্দ্রনাথ অবিশ্রান্তভাবে সাধারণ হিতকর কার্য্যে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন। এমন কোন রাষ্ট্রনীতি, বিষয়ক সভা সমিতি নাই, এমন কোন সাধারণের আলোচ্য বিষয় নাই, যাহার সহিত স্বরেন্দ্রনাথ সংশ্লিষ্ট নহেন। ইঁহার বক্তৃতা শক্তি অসাধারণ! বক্তৃতা করিয়া লোক মাতাইবার ক্ষমতা ইঁহার অসীম এবং কি বক্তৃতায়, কি সংবাদ পত্রে লিখিত মন্তব্যে ইঁহারে তেজস্বিতা ও নির্ভীকতা ছত্রে ছত্রে দৃষ্ট হইয়া থাকে। বর্তমান সময়ে ভারতে যে সকল মনীষী রাষ্ট্রনীতিক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাবান, সুরেন্দ্রনাথ তাঁহাদের মধ্যে অতি উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছেন। কার্য্যই ইঁহার মূলমন্ত্র। ইহার ন্যায় কার্য্যময় জীবন অধুনা অতি অল্পই দৃষ্ট হইয়া থাকে।

নবীনচন্দ্র সেন।

 ১২৫৬ সালের ২৯শে মাঘ চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার অন্তর্গত নয়াপাড়া গ্রামে ইঁহার জন্ম হয়। ইহার পিতা গোপীমোহন সেন মুন্সেফ ছিলেন। নবীন চট্টগ্রামের পাঠশালায় পাঠ সাঙ্গ করিয়া স্কুলে প্রবেশ করেন। মাতার অত্যধিক প্রশ্রয় পাইয়া ইনি বাল্যকাল হইতেই অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল হইয়া পড়িয়ছিলেন। স্কুলে নবীনচন্দ্র শাসনের অতীত হইয়াছিলেন। স্কুলেই wicked the great (দুষ্টের শিরোমণি) এই উপাধি পাইয়াছিলেন। ইঁহার পিতা অতিশয় দানশীল ও পরোপকারী ছিলেন। তাঁহার প্রচুর আয় ছিল বটে, কিন্তু তিনি কিছুমাত্র সঞ্চয় করিতে পারিতেন না। পুত্রের এইরূপ উচ্ছৃঙ্খলতা ও পাঠে অমনোযোগ দেখিয়া তিনি একদিন আক্ষেপ করিয়া পুত্রকে বলিয়াছিলেন, “বৎস! লেখা পড়া না করিলে তোমাকৈ কষ্ট পাইতে হইবে, আমি তোমার জন্য একটা পয়সাও রাখিয়া যাইতে পারিব না।” ১৮৬৩ খৃষ্টাবো নবীনচন্দ্র চট্টগ্রাম স্কুল হইতে প্রবেশিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দে গ্রেসিডেন্সি কলেজ হইতে এফ-এ পাশ করেন। নানাকারণে ইঁহার পিতা এই সময় খরচ বন্ধ করিলে ইনি ছেলে পড়াইয়া সেই আয়ের দ্বারা বি, এ, পড়িতে লাগিলেন; এই সময়েই ইঁহার পিতার মৃত্যু হয়। জনপ্তর ইনি ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে বি,এ, পাশ করেন এবং কয়েক মাসের মধ্যে প্রতিযোগী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট পদ প্রাপ্ত হন। ইনি বাল্যকাল হইতেই অত্যন্ত কবিতা-প্রিয় ছিলেন। পাঠ্যাবস্থাতেই ইনি বিবিধ বিষয়ক কবিতা লিখিয়া অনেক মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত করিতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক স্বৰ্গীয় প্যারিচরণ সরকার যখন এডুকেশন গেজেটের সম্পাদক, সেই সময় নবীনচন্দ্রের অনেক কবিতা এডুকেশন গেজেটে মুদ্রিত হয়। এ বিষয়ে প্যারিচরণ ইঁহাকে বিশেষ উৎসাহ দিতেন। ইঁহার যৌবনকালের রচনায়ও বিলক্ষণ কবিত্বশক্তি দৃষ্ট হয়। ১২৭৮ সালে ইঁহার অবকাশ রঞ্জিনী বাহির হয়। কবি সুকৌশলে আপনার জীবনের সুখ দুঃখের কাহিনী এই কাব্যে সন্নিবিষ্ট করেন। অনন্তর ১২৮২ সালে ইঁহার 'পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্য প্রকাশিত হয়। এই পুস্তক প্রকাশিত হইলে ইনি যে একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক, তাহা সকলেই বুঝিঙে পারিলেন। এই 'পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্য নাটকাকারে পরিণত হইয়া বহুবার বঙ্গীয় নাট্যমঞ্চে সুখ্যাতির সহিত অভিনীত হইয়াছিল। অতঃপর কবিবর ক্রমে রঙ্গমতী, রৈবতক, কুরুক্ষেত্র, অমিতাভ প্রভূতি কাব্য প্রণয়ন করেন। এ সকল কাব্যেই ইনি সাধারণের নিকট যথেষ্ট প্রতিষ্ঠালাভ করেন। ফলতঃ নবীনচন্দ্র একজন স্বভাব-কবি ছিলেন। বঙ্গভাষা চিরকাল নবীন চন্দ্রের নিকট ঋণী থাকিবে।


মহেন্দ্রলাল সরকার।

 (ডাক্তার)ইনি ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে ২রা নবেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে এম, ডি, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ। ইনি Bengal Branch of the British Medical Association নামক সভার সেক্রেটারী ও সহকারী সভাপতি থাকার সময় উক্ত সভার সমক্ষে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা প্রণালীর বিরুদ্ধে মন্তব্য প্রকাশ করেন। কিন্তু পরে ইঁহার মত পরিবর্ত্তিত হয়। (১৮৬৭ খৃঃ)। তখন ইনি প্রকাশ্যভাবে হোমিওপ্যাধির সপক্ষে দণ্ডায়মান হইলেন এবং নূতন অবলম্বিত মতের বহুল প্রচার করে পরবৎসর Calcuta Journal of Medicine নামক মাসিক পত্র প্রতিষ্ঠিত করিয়া উহার সম্পাদনভার গ্রহণ করিলেন। মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত ইনি এই পত্রখানি অতিশয় যোগ্যতার সহিত চালাইয়াছিলেন। মত পরিবর্ত্তনের ফলে এলোপ্যাথিক প্রণালীর চিকিৎসকগণের সহিত ইনি সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করেন এবং তাঁহাদিগের দ্বারা বহুপ্রকারে নিগৃহীত হন। কিন্তু ইহাতে ইনি কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া হোমিওপ্যাথি মতে ব্যবসায় করিতে লাগিলেন। উত্তরকালে ইনি এই মতাবলম্বী চিকিৎসকগণের অগ্রণী হইয়া প্রচুর খ্যাতি ও অর্থ উপার্জন করেন। বঙ্গের ছোট লাট স্যার রিচার্ড টেম্পলের পৃষ্ঠপোষকতায় (১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে) কলিকাতার বৌবাজার ষ্ট্রীটে Indian Association for the cultivation of science নামক শিক্ষালয় স্থাপিত করিয়া ইনি এখানে বিজ্ঞানের অধ্যাপনা করিতে আরম্ভ করিলন। এই শিক্ষালয় বঙ্গবাসীমধ্যে বিজ্ঞানলোচনার রুচি সৃজন করিয়াছে। এবং মহেন্দ্রলালের অক্ষয় কীর্ত্তি স্বরূপে বিরাজ করিতেছে। ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে ইনি কলিকাতায় সেরিফ পদে আসীন ছিলেন। ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দ হইতে ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দ পর্য্যস্ত বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক-সভার সদস্য ছিলেন। ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে ইনি সি, আই, ই, ও ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে ডি-এল্ উপাধি ভূষিত হইয়াছিলেন। ১৯০৪ খৃষ্টাব্দে ২৩শে ফেব্রুয়ারি ইনি লোকান্তরিত হন। ইনি কেবল চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন না; প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, জ্যোতিষ এবং ইংরাজী সাধারণ সাহিত্যেও ইনি অসাধারণ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। ইঁহার পুত্র ডাক্তার অমৃতলাল সরকার পিতৃ-প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাখানি চালাইতেছেন।

কালীপ্রসন্ন সিংহ।

 মহাভারতের বিখ্যাত বাঙ্গলা অনুবাদক। ইনি কলিকাতা ষোড়াসাঁকোর প্রসিদ্ধ জমীদার-বংশে জন্ম গ্রহণ করেন। ইঁহার প্রপিতামহ শান্তিরাম সিংহ মিঃ বোলড্ ও মিঃ মিডলটনের নিকট মুর্শিদাবাদ ও পাটনায় দেওয়ানি করিতেন। কালীপ্রসন্নের পিতার নাম নন্দলাল সিংহ। কালীপ্রসন্ন সংস্কৃত, বাঙ্গালা ও ইংরাজী ভাষায় সবিশেষ বুৎপন্ন ছিলেন। ইঁহার যত্নে ইঁহার বাটীতে ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে বেণীসংহার নাটকের অভিনয় হয়। ইহার ৮ মাস পরে ইনি বিক্রমোর্ব্বশী নাটকখনি বাঙ্গালায় স্বয়ং অনুবাদ করিয়া আপনার বাড়ীতে অভিনয় করান। মাইকেল মধুসূদন দত্ত কর্তৃক মেঘনাদবধকাব্য রচিত হইলে কালীপ্রসন্ন স্বীয় বাটিতে একটি সভা আহবান করিয়া কবিবরকে বাঙ্গালী ভাষায় একখানি অভিনন্দন-পত্র ও রৌপ্যানর্ম্মিত ক্ল্যারেট পানোপযোগী একটি মদ্যপাত্র প্রদান করেন। ইনি বহু অর্থ ব্যয় করিযী পণ্ডিতমণ্ডলীর সাহায্যে মূল সংস্কৃত মহাভারতের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন এবং উহা বিনামূল্যে বিতরণ করেন। এই অনুবাদ কার্য্য ১৭৮০ শকে অরব্ধ হইয়া ১৭৮৮ শকে সমাপ্ত হয়। এই অনুবাদ কার্য্য ৰঙ্গদেশে তাঁহার নাম চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিবে। এই অনুবাদিত গ্রন্থাবলী তিনি মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে উৎসর্গীকৃত করিয়াছিলেন। ইনি 'হুতোম প্যাঁচার নক্সা' নামক একখানি সমাজরহস্য গ্রন্থও প্রণয়ন করেন।

রাধাকান্ত দেব।

 (রাজা স্যার)। ইনি মহারাজ নবকৃষ্ণ দেবের পৌত্র ও রাজা গোপীমোহনের একমাত্র পুত্ত্র। ১৭৮৪ খৃষ্টাব্দে ১১ই মার্চ (১৭০৫ শকের ১লা চৈত্র) ইনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রভূত ঐশ্বর্য্যের ক্রোড়ে পালিত হইলেও বিদ্যাশীলনে ইঁহার মূল্যবান্ জীবন অতিবাহিত হইয়াছিল। ইনি সংস্কৃত, আরবী, পারসী ও ইংরাজী ভাষায় সম্যক্ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। হিন্দুকলেজ স্থাপন বিষয়ে ইনি বিশেষ চেষ্টত ছিলেন এবং স্থাপনার পর উহার অন্ততম পরিচালক হইয়াছিলেন। ইনি সংস্কৃত কলেজেও সেক্রেটারীর কার্য্য করিয়াছিলেন। School Book Society প্রতিষ্ঠিত হইলে হেয়ার সাহেবের সহযোগিতায় ইনি ঐ সমিতির সেক্রেটারীর পদে আসীন থাকিয়া ১৮২০ খৃষ্টাব্দে “নীতিকথা” এবং প্রাথমিক শিক্ষার উপযোগী spelling Book বা Reader ইউরোপীয় প্রণালীতে প্রণয়ন করিয়াছিলেন। ইনি স্ত্রী-শিক্ষার বিশেষ উৎসাহদাতা ছিলেন, কিন্তু বালিকা-বিদ্যালয়ের পক্ষপাতী ছিলেন না। ‘শব্দকল্পদ্রুম’ নামক সংস্কৃত অভিধান প্রণয়ন ইঁহার জীবনের অবিনশ্বর গৌরব। ইহার জন্য ইনি একটি স্বতন্ত্র ছাপাখানা স্থাপিত এবং টাইপ প্রস্তুত করা করাইয়াছিলেন। এক জাতীয় টাইপ “রাজার টাইপ” নামে উত্তর কালে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। প্রভূত অর্থ ব্যয়ে ও ৪৬ বৎসরের পরিশ্রমে এই মুল্যবান্ অভিধান প্রকাশিত হইয়া বিনামূল্যে বিতরিত হইয়াছিল। এই গ্রন্থ প্রণয়নের পরে ইউরোপে নানা সভাসমিতি হইতে ইনি সম্মান প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ডেনমার্কের রাজা সপ্তম ফ্রেডরিক ইঁহাকে একটি সুন্দর কারুকার্য্যসমন্বিত হারযুক্ত স্বর্ণ-পদক দিয়াছিলেন। মহারাণী ভিক্টোরিয়াও ইঁহাকে একটি স্বর্ণ-পদক দান করিয়াছিলেন।

 ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দে ১০ই জুলাই ইনি ‘রাজাবাহাদুর উপাধি দ্বারা’ ভূষিত হন। ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে মহারাণী ভিক্টোরিয়া ভারত-শাসন-ভার গ্রহণ করিলে, ইনি শোভারাজার রাজবাটিতে একটি সন্মিলনী আহূত করেন। তাহাতে বড়লাট প্রমুখ ইংরেজ কর্ম্মচারিগণ এবং দেশের গণ্যমান সকলেই উপস্থিত ছিলেন। সেরূপ বৃহৎ অনুষ্ঠান এদেশে আর কখন কেহ দেখেন নাই। সিপাহিবিদ্রোহ দমনের পর শান্তি স্থাপনের স্মরণার্থে ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে ইনি আর একটি সন্মিলনী আহূত করেন। ১৮৬১ খৃষ্টাব্দে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন স্থাপিত হইলে, ইনি সেই সময় হইতে মৃত্যুকাল পর্যন্ত ইহার সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে কলিকাতাবাসিগণ জাতি নির্ব্বিশেষে ইঁহার পাণ্ডিত্যের এবং তাঁহাদের ভক্তি-সম্মানের নিদর্শনস্বরূপে ইঁহাকে একখানি অভিনন্দন-পত্র প্রদান করেন এবং সংগৃহীত অর্থ দ্বারা ইহার একখানি তৈলচিত্র প্রস্তুত করেন। সেই চিত্রথনি এসিয়াটিক সোসাইটির একটি প্রকোষ্ঠে রক্ষিত হইয়াছে। ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে রাধাকান্ত ধর্ম্মসাধন মানসে কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া বৃন্দাবনে বাস করেন। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে ইনি কে-সি-আই উপাধি প্রাপ্ত হন। এই উচ্চতর সম্মান বাঙ্গালীর মধ্যে ইনিই প্রথম লাভ করেন। কথিত আছে যে, এই উপাধির ভূষণ (তারকা) লইবার জন্য অনুরুদ্ধ হইলে, ইনি কলিকাতায় আসিতে অসন্মত হওয়ায় তখনকার লাটসাহেব স্যার জন লরেন্স আগ্রা সহরে দরবার করিবার ব্যবস্থা করেন।

 পণ্ডিতেরা বলিয়াছিলেন যে, অগ্রবন (আগ্রা) বৃন্দাবনেরই অন্তর্গত, সুতরাং সেখানে ঘাইতে কোন আপত্তি নাই। এই জন্যই রাধাকান্ত আগ্রার দরবারে উপস্থিত হইয়াছিলেন। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে ১৬ই নবেম্বর এই দরবার হয়। রাধাকান্ত দরবার মণ্ডপে প্রবেশ করিলে লাট সাহেব ও দেশীয় রাজন্যবর্গ হইতে অন্যান্য সমস্ত উপস্থিত নিমন্ত্রিতগণ দণ্ডায়মান হইয়া ইঁহার অভ্যর্থন করেন। বৃন্দাবনে ইংরেজ শিকারিগণ কর্তৃক ময়ূরাদি পক্ষী হনন রাধাকান্তের চেষ্টায় বন্ধ হইয়া যায়। সকল বিষয়েই রাধাকান্ত তৎকালীন হিন্দুসমাজে অগ্রণী ছিলেন এবং কি ইংরেজগণ, কি দেশীয়গণ, সকলেই তাঁহ কে অদৃষ্টপূর্ব্ব শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শন করিতেন। রাধাকান্ত দেবের ন্যায় সর্ব্বজনসমাদৃত, উন্নতমনা, নির্ম্মলচরিত্র মনীষী অধুনা বঙ্গদেশে বিরল।

 ইঁহার জীবন যেমন গৌরবান্বিত, মৃত্যুও সেইরূপ। মৃত্যুর তিন দিবস পূর্ব্ব হইতে ইনি সন্দি ভোগ করিতেছিলেন। মৃত্যুর দিন প্রাতে কিঞ্চিৎ দুগ্ধ পান করিয়া প্রিয় ভূত্যকে বলিলেন— “নবীন, আজ আমার শেষ দিন; আমার দাহ কার্য্য কিরূপে করিতে হইবে, তাহা পুরোহিত মহাশয়কে ইতিপূর্ব্বে বলিয়া রাখিয়াছি, তোমাকে আবার বলতেছি শুন। আমার প্রাণবায়, বহির্গত হইলে আমার দেহকে স্নাত, নব বস্ত্রাবৃত ও সুগন্ধিলেপিত করিয়া যমুনাকুলে লইয়া যাইবে। জীবিতকালে যে ভাবে আমি বসিতাম আমার দেহটি চিতার উপর সেই ভাবে বসাইবে। উপরে একটি চন্দ্রাতপ দিবে। চন্দন ও তুলসী কাষ্ঠে আমার দেহ পোড়াইবে। শুষ্ক তুলসী বৃক্ষ আমি সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছি। আমার দেহ ভস্মীভূত হইলে যখন অনুমান এক সের ওজন অবশিষ্ট থাকিবে, সেই অবশিষ্টাংশকে তিনভাগে বিভাগ করিয়া এক ভাগ কচ্ছপগণকে খাওয়াইবে। দ্বিতীয় ভাগ যমুনায় নিক্ষেপ করিবে এবং তৃতীয় ভাগটি বৃন্দাবনের মৃত্তিকায় গভীর করিস প্রোথিত করিবে।” এই উপদেশদান করিয়া এবং আত্মীয় বন্ধুগণের সহিত কথাবার্ত্তা কহিয়া ইনি বাটীর প্রাঙ্গণে নামিয়া আসিলেন। তুলসীতলায় বৃন্দাবনের পবিত্র ব্রজের শয্যা প্রস্তুত করাইয়া মস্তকের নিকট শালগ্রামশিলা স্থাপিত করিয়া সেই শয্যায় শয়ন করিলেন। দুই ঘণ্টাকাল মালা জপ করিবার পর ইঁহার আত্মা দেহত্যাগ করিয়া পরমাত্ময় মিলিত হইল। ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দের ১৯শে এপ্রিল রাধাকান্তের লোকান্তর গমন হয়। ইনি তিন পুত্ত্র রাখিয়া যান। মহেন্দ্রনারায়ণ, রাজেন্দ্রনারায়ণ ও দেবেন্দ্রনারায়ণ। মধ্যম পুত্র রাজেন্দ্রনারায়ণ ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রেল ‘রাজা বাহাদুর উপাধি দ্বারা ভূষিত হন। ইনি পিতার ন্যায় ধর্ম্মনিষ্ঠ ও সদাচারী ছিলেন। ইঁহার পুত্র গিরিন্দ্রনারায়ণ জয়েণ্ট মাজিষ্ট্রেটের পদে নিযুক্ত আছেন।


সমাপ্ত।