বিদ্যাসাগর/বিংশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

বিংশ অধ্যায়।

বিধবা-বিবাহে ঋণ, বিধবা-বিবাহ নাটক, দান-দাক্ষিণ্য, ইংরেজী স্কুল, কৃতজ্ঞতা, হিন্দু পেট্রিয়াট্, সোম-প্রকাশ, বর্দ্ধমানরাজের সহিত ঘনিষ্ঠতা, সোম-প্রকাশে বিদ্যাভূষণ, সংবাদ-পত্রের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় যে বৎসর সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল পদ পরিত্যাগ করেন, সেই বৎসর তিনি হুগলী জেলার মধ্যে কতকগুলি গ্রামে নিজ ব্যয়ে ১৫ (পনেরটী) বিধবার বিবাহ দিয়াছিলেন। অনেক পুনর্ব্বিবাহিত বিধবাদের ভরণ এবং সংরক্ষণ জন্য তাঁহাকে অনেক অর্থব্যয় করিতে হয়। ইহার জন্য তাঁহাকে ঋণগ্রস্ত হইতে হইয়াছিল। ঋণ করিয়াও, তিনি দীন-হীন ঋণীর ঋণ পরিশোধ করিতেন। তিনি স্বয়ং ঋণগ্রস্ত বটেন; কিন্তু দানে যে তিনি মুক্ত-হস্ত। দয়ার বা দানে এতাদৃশ অসংযম বিজ্ঞ-জন-সম্মত নহে। অধিকন্তু ইহা সংসারীর সন্ত্রাসকারী। অসংযম কিছুতেই ভাল নয়। বিদ্যাসাগরের ন্যায় বিচক্ষণ বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি তাহা বুঝিতেন না, তাহা কেমন করিয়া বলিব? কিন্তু তাঁহার দান ও দয়া এইরূপই ছিল। হয়তো তিনি কোন নৈসর্গিক শক্তি-বলে বুঝিতেন-ঋণ যতই হউক, পরিশোধের পথ পরিষ্কৃত করিবই, অথবা স্বভাবদাতার পথ ভগবৎকৃপায় আপনি পরিষ্কৃত হইয়া পড়ে। বস্তুতঃ বিদ্যাসাগরের দান ও দয়ার কথা ভাবিলে, কি যেন একটা ঐন্দ্রজালিক বাপার বলিয়া মনে হয়।

 সেই সময়ে বিধবা-বিবাহ-সম্বন্ধে তুমুল আন্দোলন চলিয়াছিল। সেই আন্দোলন সতত প্রবল রাখিবার জন্য নানা দিকে নানা উপায় উদ্ভাবিত হইয়াছিল। সেই উদ্দেশ্যে হাইকোর্টের ভূতপূর্ব্ব জজ মাননীয় শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র মিত্রের জ্যেষ্ঠ সহোদর উমেশচন্দ্র মিত্র, “বিধবা-বিবাহ নাটক” রচনা করেন। সেই সময়ে (অর্থাৎ ১৮৫০ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে) উহার অভিনয়। কেশবচন্দ্র সেন সেই অভিনয়ে “ষ্টেজ ম্যানেজার” এবং বাবু, নরেন্দ্রনাথ সেন, বাবু প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, কৃষ্ণবিহারী সেন প্রভৃতি অভিনেতা ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের থিয়েটার দেখিবার প্রবৃত্তি ছিল না। একবার একান্ত অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া, তিনি বেলগাছিয়া পাইকপাড়ার রাজ-বংশ কর্ত্তৃক অনুষ্ঠিত নাট্যাভিনয় দেখিতে গিয়ছিলেন। সুপ্রসিদ্ধ নট-কবি ৺গিরিশচন্দ্র ঘোষ, স্বপ্রণীত “সীতার বনবাস” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নামে উৎসর্গ করিয়া তাঁহার অভিনয় দেখাইবার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অনুরোধ করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, সে অনুরোধ রক্ষা করিতে পারেন নাই, কিন্তু তিনি বিধবা-বিবাহের অভিনয় একাধিক বার দেখিয়াছিলেন এবং সে সম্বন্ধে উৎসাহ দিতেন। অভিনয় দেখিতে দেখিতে, চক্ষের জলে তাঁহার বক্ষঃস্থল ভাসিয়া যাইত।[১] বিধবা-বিবাহ-প্রচলনের জন্য তিনি প্রাণপণে যত্ন করিতেন। বিধবা-বিবাহের আন্দোলনোদ্দীপক অভিনয় বলিয়াই তো তাঁহার এত সহানুভূতি ছিল।

 কলেজের চাকুরী নাই, আয়েরও নূতন উপায় উদ্ভাবিত হয় নাই, অথচ ঋণ অনেক; তেমন অবস্থায় বৈঁচিনিবাসী গোকুলচাঁদ এবং গোবিনচাঁদ বসু নামক দুই ভাই আসিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বলিলেন-“নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায়[২] আমাদের বসতি-বাটী ক্রোক করিতে সংকল্প করিয়াছেন। আপনি রক্ষা করুন। বিদ্যাসাগর শরণাগতের কাতর ক্রন্দনে ব্যথিত হইলেন। তিনি তখনই নীলকমল বাবুকে ১,০০০্ (এক সহস্র) টাকা দিয়া বসু-পরিবারের বাস্তুভিটার উদ্ধার করিয়া দেন। রাজকৃষ্ণ বাবু আমাকে বলিয়াছেন, তিনি ডিপজিটরীর কার্য্য পরিত্যাগ করিলে পর বিদ্যাসাগর মহাশয় গোকুলচাঁদি বাবুকে ৫০ (পঞ্চাশ) টাকা বেতনে সেই কার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় গোকুলচাঁদের মত কত বিপন্ন ব্যক্তির দায়োদ্ধার করিয়াছেন, তাহার ঠিক সংবাদ সংগ্রহ করা, বড় দুঃসাধ্য ব্যাপার। কেন না তিনি গগন-ভেদী ঢক্কাশব্দে কাঁপাইয়া দান করিতেন না। অনেক সময়ে, তিনি অনেককে এক কালেই দান করিতেন; কিন্তু সে সব প্রায়ই লিপিবদ্ধ করিতেন না। তবে রাজকৃষ্ণ বাবুর ন্যায় বন্ধু এবং ভ্রাতৃবর্গ, সে সব দানের কথা জানিতে পারিতেন, তাহা সময়ে সময়ে লোক পরস্পরায় প্রকাশিত হইয়া পড়িত।

 যে সময়ে গোকুলচাঁদের বাস্তুভিটার উদ্ধার-সাধন হয়, সেই সময়ে শ্যামাচরণ বন্দোপাধ্যায় নামক এক ব্যক্তির ৫০০ (পাঁচশত) টাকার দেনার দায়ে বাটী নীলাম হইবার উপক্রম হইয়াছিল। বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়কে উপস্থিত দায় জানাইলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, ক্ষণবিলম্ব না করিয়া, তাঁহাকে ঐ ৫০০ (পাঁচ শত) টাকা দান করেন।

 একটা মহত্তর দান ও দয়ার পরিচয় এই খানেই দিই। রাজকৃষ্ণ বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেও, তিনি ইহার মূল-তত্ত্ব স্মরণ করিয়া বলিতে পারেন নাই। ইহার বিস্তৃত বিবরণ, বিদ্যারত্ন মহাশয়ের লিখিত বিদ্যাসাগরের জীবনচরিতে বিবৃত আছে।

 “আমাদের বাটীর সন্নিহিত রাধানগর-নিবাসী[৩]জমিদার ৺বৈদ্যনাথ চৌধুরী এ প্রদেশের মধ্যে সম্ভ্রান্ত ও মান্যগণ্য জমিদার ছিলেন। বাবু রামপ্রসাদ রায়ের নিকট ইনি, জমিদারী বন্ধক রাখিয়া, পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। ইঁহার পুত্রও[৪] ২৫ হাজার টাকা লইয়াছিলেন। এই পাঁচাত্তর হাজার টাকা কিস্তিবন্দী করিতে যাইয়া, বাবু শিবনারায়ণ চৌধুরী, কলিকাতাস্থ রায় মহাশয়ের দপ্তরখানায় পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হন।

 অতঃপর বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার পুত্রদ্বয় ও পত্নীর উদ্ধার করেন। এতৎসম্বন্ধে বিদ্যারত্ন মহাশয় লিখিয়াছেন,—

 অনুন্তর ক্ষীরপাই রাধানগরনিবাসী মৃত শিবনারায়ণ চৌধুরীর পুত্রদ্বয় এবং মৃত সদানন্দ ও শিবনারায়ণ চৌধুরীর বিধবা পত্নী, ইহাঁরাও কলিকাতায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট যাইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। ইঁহাদের রোদমে অগ্রজ মহাশয়েরও চক্ষে জল আসিল। অগ্রজ ইঁহাদিগকে ঋণজাল হইতে মুক্ত করিবার চেষ্টা করেন। অবশেষে রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের আত্মীয় বাবু কালিদাস ঘোষ মহাশয়ের নিকট পঞ্চাশ হাজার টাকা ও অন্য এক ব্যক্তির নিকট পঞ্চাশ হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়া টাকা দিলেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় এই টাকা দিয়া কোন প্রকারে চৌধুরীদের ঋণোদ্ধার করিয়া দেন। ঋণোদ্ধার হইল বটে; কিন্তু এ বিষয় রহিল না। বিদ্যারত্ন মহাশয় সে সম্বন্ধে লিখিয়াছেন,—

 অতঃপর কয়েক বৎসর চৌধুরী বাবু পরম সুখে কালাতিপাত করেন। দুঃখের বিষয় এই, ভাতৃবিরোধে ও বন্দোবস্ত না হওয়াতে দুই এক মহাজন পরিবর্ত্তের পর ঐ সম্পত্তি ক্রোকে নীলামে বিক্রয় হয়। তন্নিবন্ধন উহাদের কষ্ট উপস্থিত হইল। মৃত শিবনারায়ণ চৌধুরীর পত্নী ও সদানন্দ চৌধুরীর পত্নীকে মাসিক ব্যয়-নির্ব্বাহার্থে অগ্রজ মহাশয়, প্রতি মাসে প্রত্যেককে সমান ভাবে ৩০্ টাকা মাসহারা প্রেরণ করিতেন। কিছুদিন পরে মোনপুরের কাশীনাথ ঘোষ ৮০০ শত টাকার জন্য উক্ত চৌধুরীদের নামে অভিযোগ করিয়া নালিশ করিলে, আমি উক্ত মহাশয়দের অনুরোধে কাশীনাথ ঘোষের সহিত ১৫০ টাকার রফা করি। দাদার নিকট ঐ টাকা লইয়া উক্ত বিষয় খোলসা করিয়া দিয়াছিলাম।”

 কলেজের চাকুরীর সময় কর্ত্তব্য কর্ম্ম ভাবিয়া শিক্ষার উন্নতিকল্পে বিদ্যাসাগর মহাশয় বড়ই যত্ন করিতেন। চাকুরি পদত্যাগ করিয়াও তৎপক্ষে এক মুহূর্ত্তের জন্যও তিনি ঔদাসীন্য প্রকাশ করেন নাই। বরং সে সম্বন্ধে স্বাধীন ভাবে কার্য্য করিবার প্রশস্ততর পথ প্রাপ্ত হইয়া, দ্বিগুণতর উৎসাহে ও উদ্যমে তিনি আত্মোৎসর্গ করিয়াছিলেন। ইংরেজী শিক্ষার সুবিস্তর সংপ্রসারণে এ দেশের প্রকৃত মঙ্গল সাধন হয়, এটা অবশ্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সুদৃঢ় ধারণা ছিল। সেই জন্য কি পরাধীন অবস্থা, কি স্বাধীন অবস্থা, সর্ব্বাবস্থাতেই তিনি ইংরেজী শিক্ষার সংপ্রসারণ-সংকল্পে আত্ম-প্রাণ নিয়োজিত করিতেন। ইংরেজী আদর্শে গঠিত চরিত্রবান অনেকেই ইংরেজী শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা করিয়াছেন; কিন্তু বিদ্যাসাগরের মত কৃতকর্ম্মা কয় জন? চাকুরির সময়ে তিনি যেমন নানা স্থানে নানা স্কুলের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, চাকুরী যাইবার পরেও তাঁহার যত্নে এবং অর্থব্যয়ে নানা স্থানে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। আপন আর্থিক উন্নতিসাধন অপেক্ষা ঐ কার্য্যকে তিনি জীবনের অধিকতর কর্তব্য কর্ম্ম বলিয়া বিবেচনা করিতেন। তাহারও পরিচয় পদে পদে পাওয়া যায়। চাকুরী পরিত্যাগ করিবার পর প্রথমতঃ ১২৬৫ সালে ২১ শে চৈত্র শুক্রবার (১৮৫৯ খৃষ্টাব্দের ১লা এপ্রিল) বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যত্নে ও উদ্যোগে মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত কান্দী গ্রামে একটা ইংরেজী ও সংস্কৃত স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। কান্দী গ্রাম পাইকপাড়া রাজবংশীয় রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের জন্মস্থান। রাজা বাহাদুরেরা আপন ব্যয়ে স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন; কিন্তু উহাতে বিদ্যাসাগরের সম্পূর্ণ উত্তেজনা। স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় ঐ স্কুলের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। সেই সময়ে রাজা প্রতাপনারায়ণের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সবিশেষ সদ্ভাব সংস্থাপিত হয়। সিংহরাজপরিবারও এক সময়ে বিদ্যাসাগরের নিকট যথেষ্ট উপকার ও সাহায্য পাইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগরের স্বভাবসিদ্ধ সরলতার এমনই মোহকরী আকর্ষণী শক্তি যে, একবার তাঁহার সহিত যাঁহার আলাপ পরিচয় হইত, তিনি তাঁহার হৃদয়ে অঙ্কিত হইয়া থাকিতেন।

 সেই সময়ে, ঐ কান্দী গ্রামে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পূর্ব্ব-আশ্রয়দাতা ৺জগদ্দুর্ল্লভ সিংহের কন্যা ক্ষেত্রমণি দাসীর সহিত সাক্ষাৎ হয়। ক্ষেত্রমণি রাজপরিবারের রাজ-বাটীর ভাগিনেয়বধূ। রাজবাটীর ভাগিনেয় লালমোহন ঘোষ তাঁহার স্বামী। বিদ্যাসাগর মহাশয় বাটী গিয়াছেন শুনিয়া, ক্ষেত্রমণি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন। নানা কারণে ক্ষেত্রমণির অবস্থা বড়ই হীন হইয়াছিল। বহু দিনের পর সেই দীন হীন ক্ষেত্রমণিকে দেখিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় চক্ষের জলে ভাসিয়া গিয়াছিলেন। তিনি ক্ষেত্রমণির প্রার্থনায় মাসিক ১০্ দশ টাকা বৃত্তি বরাদ্দ করিয়া দেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় গুণী ও গুণগ্রাহী। জগতে সকল গুণীরই গুণনির্ণয়ে শক্তি থাকে না। সেই শক্তি অন্তর্ভেদিনী সূক্ষ্ম দৃষ্টির অন্তর্ভুতা। বিদ্যাসাগরের সেই শক্তি অতুলনীয়। চাকুরীর সময়ে তাহার বহু পরিচয় পাইয়াছি। স্বাধীন অবস্থায় হিন্দুপেট্রিয়টের সম্পাদক নিয়োগেও তিনি সে শক্তির প্রকৃষ্ট পরিচয় দিয়াছিলেন। ১২৬৮ সালের ১লা আষাঢ় (১৮৬১ খৃষ্টাব্দের ১৪ই জুন) শুক্রবার বেলা ৯ নয়টার সময় হিন্দুপেট্রিয়টের স্বত্বাধিকারী ও সম্পাদক সুলেখক হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। ঐ বৎসরে ১২৬৮ সালের ১১ই শ্রাবণ (১৮৬১ খৃষ্টাব্দের ২৫শে জুলাই) পেট্রিয়ট কার্য্যালয় ভবানীপুর হইতে কলিকাতায় উঠিয়া আইসে। বাবু কালী প্রসন্ন সিংহ ৫০০০্ পাঁচ হাজার টাকা দিয়া হিন্দুপেট্রিয়টের স্বত্ব ক্রয় করিয়া ইহা পরিচালিত করিয়াছিলেন; কিন্তু ইহা তিনি বেশী দিন রাখিতে পারেন নাই; অবশেষে তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে হিন্দুপেট্রিয়টের ভারার্পণ করেন। সেই সময়ে বাবু কৃষ্ণদাস পাল মহাশয় “বৃটিশ ইণ্ডিয়া এসোসিয়েশনের” কেরাণী ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহাকে উপযুক্ত বিবেচনা করিয়া হিন্দুপেট্রিয়টের সম্পাদক পদে নিযুক্ত করেন। কৃষ্ণদাস বাবু কেবল সম্পাদক নহেন; স্বত্বাধিকারীও হইলেন। ইহার জন্য তাঁহাকে এক কপর্দকও ব্যয় করিতে হয় নাই। উদীয়মান লেখক কৃষ্ণদাসের প্রতি বিদ্যাসাগরের এরূপ অসম্ভব বিশ্বাস প্রীতি দেখিয়া সেই সময়ে অনেকেই চমকিত হইয়াছিলেন। দীর্ঘদর্শী বিদ্যাসাগর খুব বুঝিয়াছিলেন,—কৃষ্ণদাস বাবু শক্তিশালী প্রতিভা সম্পন্ন পুরুষ। কৃষ্ণদাসের অশেষ শক্তিসম্পন্নতার অনুভবে বিদ্যাসাগর আপনার সুতীক্ষ্ণ-শক্তিশালিতার পরিচয় দিশাছিলেন। তৎকালে তাঁহার আত্মীয়, বন্ধু ও বান্ধবেরা তাহা বুঝিতে পারেন নাই; কিন্তু পরে কৃষ্ণদাসের অসীম শক্তিশালিতার অকাট্য প্রমাণে তাঁহাদিগকেও লজ্জায় মস্তক অবনত করিতে হইয়াছিল।

 প্রিন্সিপাল-পদ পরিত্যাগ করবার বৎসর দুই পূর্ব্বে বিদ্যাসাগর মহাশয় কেবল পরপোকারার্থ“সোম প্রকাশ”প্রকাশ করিয়াছিলেন। এক দিন সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় নামক এক ব্রাহ্মণ তাঁহার নিকটে আসিয়া সজল নয়নে বলিলেন,—“মহাশয়! রক্ষা করুন। সংসার চলে না।” সারদাপ্রসাদ সংস্কৃত কলেজের সুশিক্ষিত ছাত্র ছিলেন। তিনি ইংরেজী ও সংস্কৃত ভাষায় বুৎপন্ন হইয়া বৃত্তি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। দৈববিড়ম্বনায় তাঁহার শ্রুতি-শক্তি নষ্ট হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার দুঃখে বিগলিত হইয়া তৎপরিবারপ্রতিপালনের সদুপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। অবশেষে তিনি সারদা প্রসাদের উপকারার্থে “সোমপ্রকাশ” প্রকাশ করেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনুরোধে সারদা প্রসাদ পরে বর্দ্ধমান রাজবাটীতে মহাভারতের অনুবাদ কার্য্যে এবং লাইব্রেরিয়ান্-পদে প্রতিষ্ঠিত হয়েন। বর্দ্ধমানরাজ মহাতাপচন্দ্র বাহাদুর বিদ্যাসাগর মহাশয়কে যথেষ্ট ভক্তি করিতেন। ১২৫৪ সালে (১৮৪৭ খৃষ্টাব্দে) বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত মহারাজের প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয় হয়। সেই সময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় বাবু রামগোপাল ঘোষজ ও ভূকৈলাসের বাজা সত্যশরণ ঘোষালের সহিত বর্দ্ধমান দর্শনার্থ গমন করেন। তাঁহারা তিন জনে এক বাসায় ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় রাজবাটী সিদায় উদর পূর্ণ করিতে অসম্মত হইয়া অপর কোন বন্ধুর বাড়ীতে ভোজনক্রিয়া সম্পন্ন করিতেন। মহারাজ এই সংবাদ পাইয়াছিলেন। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত আলাপ-পরিচয় করিবার অভিপ্রায়ে তাঁহাকে বাড়ীতে আনাইবার জন্য লোকপ্ররণ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথম যাইতে সম্মত হয়েন নাই; কিন্তু নানা সাধ্য-সাধনায় শেষে অনুরোধ এড়াইতে পারেন নাই। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করিয়া মহারাজ আপনাকে ধন্য জ্ঞান করিয়াছিলেন। বিদায়-সময়ে মহারাজ বাহাদুর তাঁহাকে উপহার স্বরূপ ৫০০ (পাঁচ শত) টাকা ও এক জোড়া শাল দিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, কিন্তু উহা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন,—“আমি কাহার ও দান লই না। কলেজের বেতনেই আমার স্বচ্ছন্দে চলে। চতুষ্পাঠীর অধ্যাপকগণ এইরূপে বিদায় পাইলে অনেকটা উপকৃত হইতে পারেন।” রাজা বিস্মিত হইলেন! সেই সময় হইতে বিদ্যাসাগর মহাশয় যখনই বর্দ্ধমানে যাইতেন, তখনই মহারাজ তাঁহার সসন্ত্রম আদর-অভ্যর্থনা করিতেন। বর্ধমানাধিপতি, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এমনই শুভাকাঙ্খী ছিলেন যে, বীরসিংহ গ্রামকে তাঁহার তালুক করিয়া দিবার জন্য তিনি স্বয়ং স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া প্রস্তাব করিয়াছিলেন।

 এই প্রস্তাবে বিদ্যাসাগর মহাশয় এই কথা বলিয়াছিলেন,—“আমার যখন এমন অবস্থা হবে যে, আমি সমুদয় প্রজার খাজানা দিতে পারিব, তখন তালুক লইব।”[৫]

 এই বর্দ্ধমানরাজ বিধবা-বিবাহ-বিষয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিধবা-বিবাহের আইন জন্য যে আবেদন করিয়াছিল, তাহাতে বর্দ্ধমান-রাজের স্বাক্ষর ছিল।

 যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত বর্দ্ধমান-রাজের এত ঘনিষ্ঠতা ও আত্মীয়তা, তাঁহার অনুরোধে-মাত্রেই যে সারদাপ্রসাদ বর্দ্ধমানরাজবাটীতে কর্ম্ম পাইবেন, তাহা আর বেশী কথা কি? সারদাপ্রসাদের সংসার পরিচালন-সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিশ্চিন্ত হইলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং সোমপ্রকাশে লিখিতেন। সুলেখক মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের দুই একটা প্রবন্ধও মধ্যে মধ্যে ইহাতে প্রকাশিত হইত। ক্রমে কিন্তু প্রতি সোমবারে নিয়মিত সোমপ্রকাশ বাহির করা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পক্ষে কিছু ভার-স্বরূপ হইয়া পড়িল। সমায়াভাবপ্রযুক্ত তিনি ইহাতে আর সম্যক্ মনোযোগী হইতে পারিতেন না। এক দিন বিদ্যাসাগর মহাশয় স্পষ্টই বলেন,—“একে তো আমার সময় নাই, তাহার উপর যথানিয়মে সাপ্তাহিক সংবাদপত্র-প্রকাশ করা বাস্তবিক চাকুরী অপেক্ষাও কষ্টকর।” অগত্যা এক জন সুদক্ষ সম্পাদকের অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। তিনি পণ্ডিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয়কে উক্ত কার্য্যের উপযুক্ত পাত্র বিবেচনা করিয়া তাঁহার হস্তে সোমপ্রকাশ সমর্পণ করেন। বিদ্যাভূষণ মহাশয় সোমপ্রকাশের সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী হইলেন।

 অধুনা যে প্রণালীতে ও যে প্রকরণে ইংরেজী সংবাদপত্র পরিচালিত হইয়া থাকে, বিদ্যাভূষণ মহাশয় সেই প্রণালীতে ও সেই প্রকরণে সোমপ্রকাশ পরিচালিত করিতেন। বিদ্যাভূষণ বিদ্যাসাগরের মুখ উজ্জ্বল করিয়াছেন। সোম প্রকাশ প্রকাশিত হইবার পূর্ব্বে অনেক বাঙ্গালা সংবাদপত্র প্রকাশিত হইয়াছিল। সেই সব সংবাদপত্রের অধিকাংশে সমাজ-বিষয়ক ও ধর্ম্মসংক্রান্ত বিষয়ের আলোচনা অধিক পরিমাণে থাকিত। রাজনীতির আলোচনা যে হইত না, এমন নহে; তবে সোম প্রকাশের ন্যায় উচ্চতর গভীর প্রণালীতে নহে। ভাষার পুষ্টিসাধন সম্বন্ধে সোমপ্রকাশ উচচতর আদর্শস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। যাহা বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত, তাহাতে যে ভাষার পুষ্টিকারিতার উচ্চতর সোপান প্রতিষ্ঠিত হইবে, তাহাতে আর সন্দেহ কি? তবে সোমপ্রকাশের পূর্ব্বে যে সব সংবাদপত্র প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহারাও বাঙ্গালা ভাষায় পুষ্টিসাধন জন্য বাঙ্গালী মাত্রের বরণীয়। প্রকৃতই বাঙ্গালা গদ্যের পুষ্টি-প্রারম্ভ বাঙ্গালা সংবাদপত্রে। প্রথম সংবাদ পত্রে পুষ্টিসঞ্চার, পরে তাহার ক্রমবিকাশ। সোম প্রকাশের পূর্ব্বে যে সব সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, “প্রভাকরের” ভূতপূর্ব্ব সম্পাদক শ্রীযুক্ত গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় দ্বিতীয় বর্ষের দ্বাদশ-সংখ্যক “নব-জীবনে”[৬] “বাঙ্গালা সংবাদপত্রের ইতিহাস” নামক একটি ঘটনাপূর্ণ প্রবন্ধ লিখিয়া তাহাদের অধিকাংশের উল্লেখ করিয়াছেন। আমরা তাহা হইতে সংক্ষেপে এখানে তাহার উল্লেখ করিলাম।

 অনেকের ধারণা,—মিসনরীরা প্রথমে বাঙ্গালা সংবাদপত্র প্রকাশ করেন; কিন্তু প্রকৃত কথা তাহা নহে। ১২১২ সালে বা ১৮১৫ খৃষ্টাব্দে গঙ্গাধর ভট্টাচার্য্য নামক একজন পণ্ডিত কলিকাতা সহরে সর্ব্বপ্রথম “বাঙ্গালা-গেজেট” নামে সংবাদপত্র প্রচার করেন। ১২২৪ সালে শ্রীরামপুরের পাদরী সাহেবেরা “সমাচার দর্পণ”-নামক সংবাদপত্র প্রচার করেন। ১২২৭ সালে রাজা রামমোহন রায়, তারাচাঁদ দত্ত এবং ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক “সংবাদকৌমুদী” নামক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। রাজা রামমোহন রায় এই সংবাদপত্রে প্রচলিত সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখিতে আরম্ভ করেন। ইহাতে ভবানীচরণ বাবু উহার সম্পাদকতা ত্যাগ করেন। ১২২৮ সালে ঐ ভবানীচরণ “সমাচার চন্দ্রিকা” নামে সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। ইহা শেষে প্রাত্যহিক হয়। তৎপরে ইহা “বঙ্গবাসীর” কার্য্যালয় হইতে প্রকাশিত “দৈনিক” নামক প্রাত্যহিক পত্রের সহিত সম্মিলিত হইয়াছিল। “চন্দ্রিকা” প্রকাশিত হইবার পর মৃজাপুরনিবাসী কৃষ্ণমোহন দাস “সংবাদ-তিমির” নামক সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশিত করেন। কয়েক বর্ষ পরে এ-খানি উঠিয়া যায়। “তিমিরনাশক” প্রকাশ হইবার পর রাজা রামমোহন রায়, বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের উদ্যোগে “বঙ্গ-দূত” নামক সংবাদপত্রের সৃষ্টি হয়।[৭] ১২৩৭ সালের ১৬ই মাঘ শুক্রবারে “সংবাদ-প্রভাকর” প্রকাশিত হয়। পাথুরিয়াঘাটার যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুর “সংবাদ প্রভাকর” প্রকাশের প্রধান উদ্যোগী। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মহাশয় উহার সম্পাদক হইয়াছিলেন। ১২৩৩ সালে যোগেন্দ্রমোহন মানবলীলা সম্ববণ করিলে “প্রভাকরের” প্রচার বন্ধ হয়। ঐ বর্ষে গুপ্ত মহাশয় “সংবাদ-রত্নাবলী” নামক সংবাদপত্রের সম্পাদক হয়েন। কিছু দিন পরে তিনি ইহার সম্পাদকতা পরিত্যাগ করেন। পরে ১২৪৩ সালে ..শে শ্রাবণে তিনি আবার “সংবাদ-প্রভাকরের” প্রকাশ আরম্ভ করেন। সেই সময়ে প্রভাকর সপ্তাহে তিন দিন প্রকাশিত হইত। ১২৪৬ সালের ১লা আষাঢ়ে ইহা প্রাত্যহিক হয়। ১২৪২ সালে “পূর্ণ চন্দ্রোদয়” প্রকাশিত হয়। ইহা প্রথমে প্রতি পূর্ণিমায় প্রকাশিত হইত। উহা ১২৪৩ সালে সাপ্তাহিক ও কয়েক বৎসর পরে প্রাত্যহিক হয়। ১২৩৭ সাল হইতে ১২৫৯ সাল পর্যন্ত যে সকল সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, গোপাল বাবু[৮] তাহার একটি তালিকা প্রকাশ করিয়াছেন। সে তালিকায় প্রকাশকের এবং সম্পাদকের নাম আছে। কোন্ সংবাদপত্রের কত দিনে আরম্ভ, তাহারও উল্লেখ আছে। গণনায় ৮৯ খানি হইবে। “সংবাদ মৃত্যুঞ্জয়” নামক একখানি সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন হইতে সংবাদ পর্য্যন্তও পদ্যে লিখত হইত। প্রবন্ধ, অনুবন্ধ, সংবাদ প্রভৃতির সর্ব্ববিধ ভাষা, রুচি ও ভাব সম্বন্ধে সোমপ্রকাশ পূর্ব্ব প্রকাশিত সংবাদপত্র অপেক্ষা উন্নততর।

  1. The pioneer father of the widow marrige movement Pandit Iswar Chandra Vidyasagar came more than once and tender-herated as he is, was moved to floods of tears,— Life and Teachings of Keshub Chandra Sen by P.C Mozumder.
  2. নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায় রাজকৃষ্ণ বাবুর ভ্রাতা।
  3. এই রাধানগর “ক্ষীরপাই রাধানগর” বলিয়া খ্যাত—গ্রন্থকার।
  4. হরিনারায়ণের পুত্রের নাম শিবনারায়ণ চৌধুরী।—গ্রন্থকার।
  5. এই ঘটনার কথা উত্তরপাড়া নিবাসী শ্রীযুক্ত রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকট শুনিয়াছি।
  6. শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত মাসিক পত্র। এখন নাই।
  7. তৎপরে “বঙ্গ-দূত“ও “সংবাদ সুধাকর” এই দুই পত্র প্রচারিত হয়।
  8. অধ্যাপক মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি এম্ এ এস পি কর্ত্তৃক লিখিত “জন্মভূমি,” সাহিত্যপরিষদ্” ও “অনুসন্ধান্” পত্রে লিখিত বঙ্গীয় সংবাদপত্রের ইতিবৃত্তও দ্রষ্টব্য।