বিদ্যাসাগর/ষড়্‌বিংশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

ষড়্‌বিংশ অধ্যায়।

বেথুনে নরম্যাল, বেথুনে মিস্ পিগট্, পিতার

কাশীবাস, প্রসন্নকুমার ও দুর্ভিক্ষ।[১]

 বিদ্যাসাগর মহাশয় চিরকাল স্ত্রী-শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন। বেথুন স্কুলের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। ১২৭১ সালের ১লা চৈত্র বা ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দের ১৩ই মার্চ বেথুন-বিদ্যালয়ের পারিতোষিকের সময় তিনি এক ছড়া সোনার চিক উপহার দিয়াছিলেন। এই পারিতোষিক-সভায় বড়লাট লরেন্স ও তাঁহার পত্নী উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় মধ্যে মধ্যে এইরূপ পারিতোষিক দিতেন। বেথুন স্কুলের কোন বিভ্রাট উপস্থিত হইলে তাহার মীমাংসার ভার তাঁহার উপর অর্পিত হইত। ১২৭৪ সালে বা ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে বেথুন স্কুলকে নরম্যাল স্কুলে পরিণত করিবার কথা প্রস্তাবিত হয়; অর্থাৎ এখানে হিন্দু স্ত্রীলোককে এমনই করিয়া শিখান হইবে যে, তাঁহারা পরে শিক্ষয়িত্রী-কার্য্যে নিযুক্ত হইয়া উপার্জ্জনক্ষম হইবেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় এই প্রস্তাবের পক্ষপাতী ছিলেন না। তৎকালে ৺কেশবচন্দ্র সেন, বাবু এম, এম্ ঘোষ প্রভৃতি ব্যক্তিগণ ইহার একান্ত পক্ষপাতী ছিলেন। এ প্রস্তাব কার্য্যে পরিণত করা উচিত কি না, তন্নির্দ্ধারণার্থ একটা ‘কমিটী’ হইয়াছিল। সেই কমিটীতে বিদ্যাসাগর মহাশয় ছিলেন। কিন্তু ৺কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ ব্যক্তিগণ ব্রাহ্মসমাজে একটা সভা করিয়া সিদ্ধান্ত করেন যে, নরম্যাল স্কুলের প্রতিষ্ঠার জন্য লেপ্টনেণ্ট গবর্ণরকে আবেদন করিতে হইবে। এই মীমাংসাটা অতি তাড়াতাড়ি হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মতে এত তাড়াতাড়ি হওয়া উচিত ছিল না। তিনি জানিতেন, এতৎসম্বন্ধে খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গের মতামত লওয়া হইবে এবং তাঁহাদের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া কার্য্য করা হইবে, তাহা হয় নাই। এজন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় বিরক্ত হইয়া এক পত্র লিখিয়া কমিটী হইতে আপনার নাম উঠাইয়া লয়েন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়, ৺কৃষ্ণদাস পাল প্রভৃতির মত ছিল যে, সৎকুলজাত ভদ্রমহিলারা মেয়ে পড়াইবার জন্য শিক্ষা লাভ করিতে সম্মত হইবেন না। এজন্য তাঁহাদের আপত্তি ছিল। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আপত্তি করিবার জন্য একটা ‘কমিটী’ও সংঘটিত হইয়াছিল। তাহাতে নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ সভ্য ছিলেন,—“অনারেবল ডবলিউ, এস, সিটনকর,—সভাপতি; অনারেবল শম্ভুনাথ পণ্ডিত; ডবলিউ এস্ আটকিনসন; রাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুর; হরচন্দ্র ঘোষ; কাশীপ্রসাদ ঘোষ; রাজেন্দ্রনাথ দত্ত; হরনাথ রায়; কুমার হরেন্দ্রকৃষ্ণ বাহাদুর এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

 প্রস্তাব অবশ্য কার্য্যে পরিণত হয় নাই বটে; কিন্তু ক্রমে বেথুন স্কুলের শিক্ষাপ্রণালী বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অননুমোদিত হইয়া উঠে। সেইজন্য ১২৭৬ সালে বা ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দে তিনি বেথুন স্কুলের সেক্রেটারী-পদ পরিত্যাগ করেন। ১২৭৪ খৃষ্টাব্দে ফাল্গুন মাসে বা ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে তাঁহাকে বেথুন স্কুলের আরও একটি গুরুতর কার্য্যের মীমাংসা করিতে হইয়াছিল। স্কুলের তত্ত্বাবধায়িকা মিস্ পিগটের নামে এক অভিযাগ উপস্থিত হয় যে, তাঁহার অমনোযোগিতা হেতু বিদ্যালয়ের অবনতি হইতেছে। তদ্ব্যতীত স্কুলে খৃষ্টানী গান গীত, হইত, এইরূপও একটী অতি ভয়ঙ্কর অভিযোগ হয়, অধিকন্তু স্কুলের বেতনবৃদ্ধির প্রস্তাব হইয়াছিল। এইজন্য অনেকে স্কুলে আর মেয়ে পাঠাইত না। এই অভিযোগের অনুসন্ধানার্থ এক কমিটী হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় ও ৺প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী মহাশয় এই কমিটীর সব্‌কমিটীতে সভ্য ছিলেন। অনুসন্ধানে নির্দ্ধারিত হয়, মিস্ পিগট্ বাস্তবিক অপরাধিনী।[২] তিনি পদচ্যুত হন।

 ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দের শেষভাগে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতা কাশীবাসী হন। পিতৃভক্ত পুত্র পিতাকে প্রথমতঃ কাশী পাঠাইতে সম্মত হন নাই। পিতার সনির্ব্বন্ধ ব্যগ্রতা দেখিয়া তিনি অবশেষে তাঁহাকে কাশী পাঠাইতে বাধ্য হন। পিতাকে কাশী পাঠাইবার পূর্ব্বে তিনি তিন শত টাকা ব্যয় করিয়া পিতার প্রতিকৃতি অঙ্কিত করিয়া লয়েন। এই প্রতিকৃতি এখনও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ীতে বিরাজমান। অতঃপর তিনি জননীরও প্রতিমূর্তি অঙ্কিত করিয়া লইয়াছিলেন। জননীর প্রতিকৃতিও পিতার প্রতিকৃতির সম্মুখেই প্রতিষ্ঠিত আছে। পিতামাতার মৃত্যুর পর তিনি সময়ে সময়ে তাঁহাদের প্রতিকৃতি দেখিয়া চক্ষের জলে ভাসিয়া যাইতেন। প্রত্যহ তিনি দুইবার করিয়া তাঁহাদের প্রতিকৃতি দেখিতেন।[৩]

 ১২৭২ সালের ১৬ই বৈশাখ বা ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দের ২৭শে এপ্রেলে সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী মহাশয় পদত্যাগ করিয়াছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপাল সার্টক্লিফ্ সাহেবের সহিত তাঁহার, মনোবাদ হইয়াছিল। সংস্কৃত কলেজের দ্বিতলের একটা গৃহে প্রেসিডেন্সি কলেজের লাইব্রেরী ছিল। সেই ঘরে লাইব্রেরীর স্থান সঙ্কুলন হইত না। যে ঘরে সংস্কৃত কলেজের লাইব্রেরী ছিল, সার্টক্লিফ্ সাহেব প্রেসিডেন্সি কলেজের লাইব্রেরীর জন্য সেই ঘরটী চাহেন এবং স্ংস্কৃত কলেজের লাইব্রেরিটীকে নিম্নতলে লইযা যাইতে বলেন। প্রসন্ন বাবু তাহাতে সম্মত হন নাই। ইহাতে সার্টক্লিফ্ সাহেব প্রসন্ন বাবুর উপর বিরক্ত হন। পরে প্রসন্ন বাবু তৎকালিক ডাইরেক্টর আটকিনসন সাহেবের নিকট হইতে সংস্কৃত কলেজের লাইব্রেরী স্থানান্তরিত করিবার জন্য আদেশ পত্র প্রাপ্ত হন। প্রসন্ন বাবু পত্রখানি বড় অপমানজনক মনে করিয়া তদ্দণ্ডেই একখানি অভিমানসূচক পত্র লিখিয়া পদ পরিত্যাগ করেন। তাঁহার পদত্যাগের পর সণ্ডর্স সাহেব ছয় মাস কাল সংস্কৃত কলেজর পিন্সিপাল ছিলেন। একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয় ছোটলাট বাহাদুর বিডন্ সাহেবের নিকট গিয়া প্রসন্ন বাবুর পদত্যাগের কথা উত্থাপন করিয়া বলেন,—“আপনার রাজত্বে এ কি অন্যায়!” বিডন্ সাহেব বলেন,—“আমি প্রসন্নকে পুনরায় প্রিন্সিপালের পদ গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিব।” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন,—“তিনি যেরূপ স্বাধীনচেতা ও তেজস্বী, তাহাতে আমার মনে হয় না যে, তিনি অবাব পদ গ্রহণ করিবেন।” তদুত্তরে বিডন্ সাহেব বলেন,—“প্রসন্ন আমার ছাত্র, আমার অনুরোধ ঠেলিবে না।” ইহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় অত্যন্ত সন্তোষলাভ করিয়া ফিরিয়া আসেন। পরে ১২৭২ সালে ১৬ই ভাদ্র বা ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দের ৩১শে আগষ্ট বিডন্ সাহেবের অনুরোধে প্রসন্ন বাবু সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের পদ গ্রহণ করিয়াছিলেন।[৪]

 সরকারী কর্ম্মে বিদ্যাসাগরের আর কোনও সম্পর্ক ছিল না; তবুও রাজপুরুষগণ তাঁহার কত সম্মান করিতেন, তাহা এইখানে বুঝা যায়। তেজস্বী বিদ্যাসাগর মহাশয়ও বঙ্গেশ্বরকে স্পষ্টাক্ষরে কথা বলিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। বিদ্যাসাগর মহাশয় বুঝিতেন, বিডন্ সাহেব তাঁহার যথেষ্ট সম্মান করিতেন; নহিলে তিনি কি অমন করিয়া বলিতে পারেন,—“আপনার রাজত্বে এ কি অন্যায়!” কোথায় সম্ভ্রমত্রুটীর সম্ভাবনা আর কোথায় নহে, তাহার বিচার করিয়া তিনি ভাল মন্দ কথা কহিতেন; এবং কহিতে জানিতেন।

 ১২৭৩ সালের বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে বা ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দের মে ও জুলাই মাসে দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ আবির্ভূত হইয়াছিল। সে দুর্ভিক্ষের কথা স্মবণ হইলে শরীর শিহরিয়া উঠে এবং মস্তক ঘুরিয়া পড়ে। কত লোককে শাক, কচু সিদ্ধ করিয়া খাইতে হইয়াছে; কত লোক অনাহারে মরিয়াছে; কত পিতামাতা পুত্রকন্যাকে ফেলিয়া, কত স্বামী স্ত্রীর মুখ না চাহিয়া, কত স্ত্রী স্বামীর অপেক্ষা না করিয়া, দগ্ধ জঠরজ্বালায় অস্থির হইয়া একমুষ্টি অন্নের জন্য সহরে দলে দলে ছুটিয়াছিল, তাহার সবিস্তর বিবৃতির স্থান তো হইবে না। তবে এ দুর্ভিক্ষ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যতটুকু সম্পর্ক, তাহার একটা সংক্ষিপ্ত উল্লেখ হইবে মাত্র। জাহানাবাদ জেলা অঞ্চলের দুর্ভিক্ষ-বার্ত্তা প্রথম হিন্দু-পেট্রিয়টে একজন লিখিয়া পাঠান। দুর্ভিক্ষদমনে তত্রত্য জমীদারমণ্ডলী প্রথম উদাসীন ছিলেন। তৎকালিক ডেপুটি মাজিষ্টের বাবু ঈশ্বরচন্দ্র মিত্র প্রথম প্রথম এ বিষয়ে তত মনোযোগী হন নাই। হিন্দু-পেট্রিয়টে লিখিত হয়, গড়বেতার ডিপুটী মাজিষ্টর শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র কর মহাশয় বহু শ্রম স্বীকার করিয়া দেশের অবস্থা পরিদর্শন করেন এবং দেশের লোককে সাহায্য করিবার জন্য গবর্ণমেণ্টের নিকট অনুরোধ করিয়া পাঠান। জাড়ার জমীদার শিবনারায়ণ রায় মহাশয় অনেককে অন্ন দিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। প্রথমতঃ বিদ্যাসাগর মহাশয় দারুণ দুর্ভিক্ষের সংবাদ পান নাই। হিন্দু-পেট্রিয়টের একজন সংবাদদাতা কাতর-কণ্ঠে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আবেদন করেন এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ও গ্রাম হইতে সংবাদ প্রাপ্ত হন। স্বভাবদাতা বিদ্যাসাগর কি আর স্থির থাকতে পারেন? তিনি তখনই গ্রামে অন্নসত্র স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। ইতিপূর্ব্বে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননী অনেককেই অল্প দিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। দয়াময়ের দয়াময়ী জননী অকাতরে, অকুণ্ঠিত চিত্তে, বহু লোককে অন্নদান করিতেছিলেন। হিন্দু পেট্রিয়টের সংবাদদাতা ১২৭৩ সালের ১৫ই শ্রাবণ বা ১৮৩৬ খৃষ্টাব্দের ৩০শে জুলাই তারিখে এই মর্ম্মে লিখিয়াছিলেন,—  “বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মাতা প্রত্যই ৪।৫ শত লোক খাওয়াইয়া থাকেন।”

 ইহার পর বিদ্যাসাগর মহাশয় বীরসিংহ এবং নিকটবর্ত্তী ১০।১২ খানি গ্রামের নিরন্ন লোকদিগের জন্য অন্নসত্র স্থাপন করিয়াছিলেন। প্রথম প্রথম বীরসিংহের অন্নসত্রে এক শত করিয়া লোক অন্ন পাইয়াছিল।

 ক্রমে অন্নার্থী দলে দলে বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তদনুপাতে সাহায্য-পরিমাণ বাড়াইয়া দিলেন। তিনি স্বয়ং অন্নসত্রের ব্যবস্থা করিয়া নিশ্চিন্ত ছিলেন না। যাহাতে এ বিষয়ে গবর্ণমেণ্টের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়, তৎপক্ষে তিনি সর্ব্বাগ্রে যত্নশীল হইয়াছিলেন। বাবু ঈশ্বরচন্দ্র মিত্র প্রথমতঃ উদাসীন ছিলেন বটে, কিন্তু অবশেষে তিনি দুর্ভিক্ষের দারুণতা অনুভব করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মধ্যম ভ্রাতা দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন মহাশয়কে লইয়া ঘাটাল, ক্ষীরপাই-রাধানগর, চন্দ্রকোণা প্রভৃতি স্থান পরিদর্শন করিয়া অনসত্র স্থাপন করিবার জন্য গবর্ণমেণ্টকে অনুরোধ করেন। তাঁহার অনুরোধ রক্ষিত হইয়াছিল। জুন, জুলাই, আগষ্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এই কয় মাস বহুসংখ্যক লোক সরকারী অন্নছত্রে অন্ন পাইয়াছিল।

 যে কয় মাস দুর্ভিক্ষ প্রবল ছিল এবং যে কয় মাস অন্নসত্রের কাজ চলিয়াছিল, বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই কয় মাস প্রতি মাসে একবার করিয়া বাড়ী যাইতেন। তাঁহার অনুপস্থিতিতে তাঁহার ভ্রাতা, পুত্র প্রভৃতি আত্মীয় স্বজনের উপর অন্নসত্রপরিদর্শনের ভার ছিল। তাঁহারা কোন রূপই ত্রুটি করিতেন না। যাহারা অন্নসূত্রে আহার না করিত, তাহারা প্রত্যহ সিধা পাইত। কেহ পুত্রকন্যা ফেলিয়া স্থানান্তরে চলিয়া গেলে, তাহার পুত্রকন্যার রক্ষণাবেক্ষণের ভার বিদ্যাসাগর মহাশয় লইতেন। গর্ভবতী স্ত্রীলোক প্রসব করিলে, তাহার নবজাত শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিপালনের জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় সুবন্দোবস্ত করিয়া দিতেন।

 যখন কাঙ্গালীরা খাইতে বসিত, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জয়জয়কার ধ্বনিতে গগনমেদিনী পূর্ণ হইয়া যাইত। সেই সময় মনে হইত, অনন্ত মরুভূমে যেন শতধারে মন্দাকিনীর স্রোত ছুটিতেছে; এবং সকলের বিষাদক্লিষ্ট মুখমণ্ডলে যেন প্রীতি প্রফুল্লতার এক পবিত্র জ্যোতি নিঃসারিত হইতেছে।

 সকলে প্রত্যহ খেচরান্ন পাইত। প্রত্যেক সপ্তাহে এক দিন করিয়া ভাত, মৎস্যের ঝোল ও দধির ব্যবস্থা ছিল। অনেক সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং অনেক রুক্ষ্মকেশ দীনহীন মলিন স্ত্রীলোককে তৈল মাখাইয়া দিতেন। যে সব ভদ্রলোক সিধা লইতে কুণ্ঠিত হইতেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় গোপনে তাঁহাদিগকে টাকা দিতেন। অনেক ভদ্র মহিলাকে তিনি গোপনে কাপড় বিতরণ করিয়া আসিতেন। অন্নসত্রে রোগীর চিকিৎসা চলিত, মৃতের সৎকার হইত।

 ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অন্নসত্রের কাজ চলিয়াছিল। অন্নসত্রের আবশ্যকতা তিরোহিত হইলে, বিদ্যাসাগর মহাশয় পাচক, পরিচারক প্রভৃতি কর্ম্মচারিবর্গকে যথারীতি বেতনাদি দিয়া বিদায় দেন। অন্নকষ্টের অবসানের পরও গ্রামের যে সব লোকের কষ্ট ছিল, তাহাদিগকে তিনি মাসিক কিছু কিছু সাহায্য করিবার ভার জননীর উপর অর্পণ করিয়াছিলেন। যেমন পুত্র তেমনই মাতা! গৃহস্থ বিদ্যাসাগরের এই অসীম করুণার কার্য্য দেখিয়া, অনেক কোটিপতিরও মস্তক হেঁট হইয়াছিল, দীন-হীন কাঙ্গালীরা তাঁহাকে দয়ার সাগর বলিয়া ডাকিত।

বিদ্যাসাগর “দয়ার সাগর” হইলেন।

 দয়ার কথা তাঁর আর কত বলিব? বিদ্যারত্ন মহাশয় লিখিয়াছেন,—

“ইতিমধ্যে গড়বেতায় অন্নসত্রের কর্ম্মাধ্যক্ষ বাবু হেমচন্দ্র কর ও তাঁহার ত্রাতৃগণ সাহায্য প্রার্থনায় অগ্রজ মহাশয়কে পত্র লিখিলেন। তাহাতে অগ্রজ মহাশয় আমার দ্বারা দরিদ্রাওভোজনের ৫০৲ আর উহাদের বস্ত্রের জন্য ৫০৲ একুনে ১০০৲ টাকা প্রেরণ করেন। এতদ্ব্যতীত ঐ সমর কোন কোন ভদ্রলোক পিতৃহীন অবস্থায় যাঞ্চা করিতে আইসেন, তাঁহাদের মধ্যে কাহাকেও ৫০৲ টাকা, কাহাকেও ১০০৲ টাকা, কাহাকেও ২০৲ টাকা দান করেন। ২৮শে শ্রাবণ পৃথক্ বাটীতে অন্নসত্র স্থাপিত হয়। ১লা পৌষ ভোজনের পর অন্নসত্র বন্ধ করা হইয়াছিল; কিন্তু বিদেশীয় নিরুপায় ব্যক্তিগণ ৮ই পৌষ পর্যন্ত অন্নসূত্রগৃহে উপস্থিত ছিল। একারণ দুর্ব্বল নিরুপায় প্রায় ৬০ জনকে কয়েক দিন ভোজন করাইতে হইয়াছিল।”

  1. বীটন সাহেব কর্ত্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও হওয়া অবধি স্কুলটীর বেথুন স্কুল নাম চলিয়া আসিতেছে।
  2. মিস্ পিগট্ আত্মপক্ষসমর্থনার্থই একটী সুবিস্তর মন্তব্য লিখিয়াছিলেন।
  3. পিতা ঠাকুরদাসের কাশীবাসসম্বন্ধে পুত্র নারায়ণ বাবুর মুখে এই কথা শুনিয়াছি,—পিতার কাশীবাস করিবার প্রস্তাব শুনিয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয় বাড়ী যান। তথায় নির্জ্জনে তিনি পিতাকে বলেন,—“আপনি কাশীবাসী হইবেন কেন? যদি পুণ্যার্থে যান, তবে কথা নাই, যদি সংসার বৈরাগ্যে যান, তাতেও কথা নাই; কিন্তু সুখস্বচ্ছন্দে সংসার চালাইবার উপযুক্ত টাকা পান না বলিয়া যদি যান, তাহা হইলে আমি টাকার বন্দোবস্ত করিতে পারি।” পিতা বলিলেন,—“পুণ্যার্থেই যাইব।” বিদ্যাসাগর মহাশয় দ্বিরুক্তি করেন নাই। পিতা যখন কাশী যাইবার জন্য উদ্যোগী হইয়া কলিকাতায় আসেন, তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় পুত্র নারায়ণকে বলিলেন,—দেখ্, তোর ঠাকুরদাদার যাহাতে কাশী না যাওয়া হয়, তাহার চেষ্টা কর্ দেখি।” অতঃপর নারায়ণচন্দ্র ঠাকুরদাদার সঙ্গ ছাডিলেন না। ঠাকুরদাদা নাতির মায়ায় জড়াইয়া পড়িলেন। ক্রমে কাশী যাওয় বন্ধ হইবার উপক্রম হইল। এমন সময় কনিষ্ঠ পুত্র ঈশানচন্দ্র আসিয়া উত্তেজন-বাক্যে পিতার মত পরিবর্ত্তন করেন।
  4. ১২৭১ সালের ১লা পৌষ বা ১৮৭২ খৃষ্টাব্দের ১৪ই ডিসেম্বর প্রসন্ন বাবুকে সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল পদ পরিত্যাগ করিয়া বহরমপুর কলেজে যাইতে হইয়াছিল। তখন এ পদের বেতন হাজার টাকা ছিল। এই বেতনের উল্লেখ করিয়া, ৺শ্যামাচরণ বিশ্বাস মহাশয়ের স্ত্রী, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জ্যেষ্ঠ কন্যাকে বলিয়াছিলেন,—এতদিন তোমার বাপের হাজার টাকা মাহিনা হইত।” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কন্যা বলেন, “তাহা হইলে স্কুল বাড়ী এ সব হইত কি?” বিদ্যাসাগর মহাশয় কন্যার মুখে এই কথা শুনিয়া বলিয়াছিলেন,—“হইত বৈকি?” আমরা বলি, হইত বৈকি, যদি ইয়ং সাহেবের সহিত মতান্তর না হইত।