বিদ্যাসাগর/সপ্তবিংশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তবিংশ অধ্যায়।

রাজা প্রতাপচন্দ্র, রাজ-পরিবার, অবাধ সাক্ষাৎ,

অনাহূতের অত্যাচার, দেবোত্তর সম্পত্তি,

দারুণ দুর্ঘটনা ও পারিবারিক

পার্থক্য।

 ১২৭৩ সালের ৪ঠা শ্রবণ বা ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দের ১৯শে জুলাই রাত্রি ৩ টার সময় পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ বাহাদুরের মৃত্যু হয়। রাজা প্রতাপচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরম বন্ধু ছিলেন। বিধবা-বিবাহ, স্ত্রী-শিক্ষা এবং অন্যান্য অনেক কার্য্যে রাজা বাহাদুর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রধান সহায় ও পোষক ছিলেন।[১] রাজা, বাহাদুরের মৃত্যুর পূর্ব্বে বিদ্যাসাগর মহাশয়, মুরশিদাবাদে গিয়া তাঁহার যথেষ্ট চিকিৎসা-শুশ্রুষাদি করিয়াছিলেন। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার রাজা বাহাদুরের চিকিৎসা করিতেন। এতদর্থে তিনি মাসে সহস্র টাকা পাইতেন। কাশীপুরের গঙ্গাতীরে রাজার মৃত্যু হয়। তিনি মৃত্যুর পূর্ব্বে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বিষয়ের ট্রষ্টি নিযুক্ত করিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাতে সম্মত হন নাই।

 রাজা প্রতাপচন্দ্রের মৃত্যুর পর পাইকপাড়া রাজপরিবারের শোচনীয় অবস্থা উপস্থিত হইয়াছিল। রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের পিতামহী রাণী কাত্যায়নীর অনুরোধে বিদ্যাসাগর মহাশয় তাৎকালিক বঙ্গেশ্বর বিডন্ সাহেবকে অনুরোধ করিয়া পাইকপাড়া ষ্টেট, কোর্ট অব্ ওয়ার্ডের অন্তর্ভূত করিয়া দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাৎকালিক পাইকপাড়ার নাবালক রাজপুত্রদিগকে সঙ্গে করিয়া বঙ্গেশ্বরের নিকট লইয়া গিয়াছিলেন। বিষয় কোর্ট অব ওয়ার্ডের অন্তর্ভুত হইবার সম্বন্ধে অনেকটা গোলযোগ হইয়াছিল। বাহুল্যভরে তদুল্লেখে নিবৃত্ত হইলাম। তবে একটা কথা বলা নিতান্ত আবশ্যক। কলেক্টরী খাজনার দায়ে পাইকপাড়া রাজবংশের বিষয় বিক্রীত হইবার সম্ভাবনা হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনুরোধে বঙ্গেশ্বর সে যাত্রা বিক্রয়দায় হইতে উদ্ধার করেন। কোর্ট অব্ ওয়ার্ডে বিষয় গিয়াছিল বটে; কিন্তু নাবালক রাজপুত্রদিগকে ওয়ার্ডের অধীন বিদ্যালয়ে থাকিতে হয় নাই। যাহাতে রাজকুমারদিগকে ওয়ার্ডের বিদ্যালয়ে যাইতে না হয়, তাহার জন্য রাণী কাত্যায়নী বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বাষ্পাকুলিত লোচনে অনুরোধ করেন। এতদর্থে বিদ্যাসাগর মহাশয় বঙ্গেশ্বরকে অনুরোধ করিয়াছিলেন। অনুরোধ রক্ষা হইয়াছিল।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রায়ই পাইকপাড়া রাজবাটীতে যাইতেন। একদিন পথিমধ্যে তাঁহার পূর্ব্ব-পরিচিত রামধন নামে এক মুদি তাঁহাকে ডাকিয়া আপনার দোকানে লইয়া যায়। রামধন বিদ্যাসাগর মহাশয়কে খুড়া খুড়া বলিয়া ডাকিত। রামধনের সাদর অভ্যর্থনায় আপ্যায়িত হইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় অম্লানবদনে তাহার দোকানের সম্মুখে ঘাসের উপর বসিয়া থেলো হুকার তামাক খাইতেছিলেন, এমন সময় রাজবাটীর কয়েক জন তাঁহাকে দেখিতে পান। বিদ্যাসাগর মহাশয় রাজবাড়ীতে যাইয়া উপস্থিত হইলে কেহ কেহ এ কথার উল্লেখ করেন। “এটা ভবাদৃশ জনোচিত নহে” বলিয়া একটা মৃদুতীক্ষ্ণ মন্তব্যও প্রকটিত যে না হইয়াছিল, এমন নহে; বিদ্যাসাগর মহাশয়, কিন্তু ধীর-গম্ভীর বাক্যে অথচ একটু মৃদু মন্দ হাস্যে বলিয়াছিলেন, “গরিব বড় মানুষ আমার সবই সমান।”

 এক সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় রাজবাটীতে বসিয়াছিলেন, এমন সময়ে দ্বারদেশে এক জন ভিখারী আসিয়া ভিক্ষা চাহে। দ্বারবানেরা তাহাকে তাড়াইয়া দেয়। বিদ্যাসাগর মহাশয ইহাতে বড় সংক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন। কেহ কেহ বলেন, ইহার পর হইতে বিদ্যাসাগর মহাশয রাজবাড়ী যাওয়া বন্ধ করেন; কিন্তু আমরা বিশ্বস্তসূত্রে শুনিয়াছি, বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহার জন্য রাজবাড়ী যাওয়া পরিত্যাগ করেন নাই। কোন কোন রাজকুমারের উচ্ছৃঙ্খল ব্যবহারে তিনি বিরক্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। পাছে আর পূর্ব্ব-সম্মান না থাকে, এই ভাবিয়া তিনি রাজবাটী যাওয়া বন্ধ করেন। রাজকুমারেরা কিন্তু একটী দিনের জন্যও তাঁহার প্রতি ভক্তিশূন্য হন নাই। কুমার হ_চন্দ্র প্রায়ই তাঁহার বাড়ীতে আসিতেন। কেহ তাঁহাকে বাড়ীতে দ্বারবান রাখিবার পরামর্শ দিলে, তিনি রাজবাড়ীর দিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করিতেন; এমন কি তিনি প্রায়ই বলিতেন,—“দ্বারবান রাখিলেই ত আমার বাড়ীতে ভিক্ষার্থী এক মুষ্টি ভিক্ষা পাইবে না; অধিকন্তু প্রায় অনেক সাক্ষাৎকার প্রার্থী ভদ্র লোকও সাক্ষাৎকারলাভে বঞ্চিত হইবেন; তাহা অপেক্ষা মৃত্যু ভাল।” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ীতে দ্বারবান্ ছিল না। কখনও কখনও তিনি আপনার দৌহিত্রবর্গকে বলিতেন,—যদি শুনিতে পাই, বাড়ীর কাহারও দ্বারা আমার বাড়ীতে কোন ভদ্রলোকের আসিবার পক্ষে ব্যাঘাত হয়, তাহা হইলে তাহাকে বাড়ী হইতে তাড়াইয়া দিব।” দ্বারবান্ রাখিবার কথা হইলেই তিনি বলিতেন,—“আমি অন্যের বাড়ীতে যে অসুবিধা দেখিয়া আসিয়াছি, সে অসুবিধা আমার বাড়ীতে যাহাতে না থাকে, তাহারই ব্যবস্থা করা তো আমার কর্ত্তব্য।”

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাক্ষাৎকার লাভের পক্ষে কখনও কোনরূপ বিঘ্ন-বাধার ব্যবস্থা ছিল না। তিনি যে সময় সুকিয়া স্ট্রীটে রাজকৃষ্ণ বাবুর বাড়ীতে থাকিতেন, সেই সময় এক দিন মধ্যাহ্নে এক ব্যক্তি অতি ব্যস্তভাবে তথায় উপস্থিত হন। তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় উপস্থিত ছিলেন। লোকটী বিদ্যাসাগর মহাশয়কে চিনিতেন না। তিনি একটু বিরক্ত, একটু উগ্রভাবে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বললেন—“বিদ্যাসাগর মহাশয় কোথায়?” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—কেন?” লোকট বলিলেন,—“তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে কি? অনেক বড় লোকের বাড়ী যাইলাম; কেহই সাক্ষাৎ করিলেন না; দেখিয়া যাই, বিদ্যাসাগর কিরূপ।” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—“আহার হইয়াছে?” উত্তর হইল,—“আহার কি, জলস্পর্শ হয় নাই। তৃষ্ণায় ছাতি ফাটিয়া যাইতেছে।” বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিলেন,—“বিদ্যাসাগরের সহিত সাক্ষাৎ হইবে। এখন আপনি কিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া শান্ত হউন।” লোকটি বলিলেন,—“অগ্রে সাক্ষাৎ চাই।” ইতিমধ্যে দিব্য-রূপ জলযোগ আসিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনুরোধে লোকটী জলযোগ করিলেন। পরে শান্ত হইয়া, তিনি বিদ্যাসাগরের সাক্ষাৎকার-প্রার্থী হইলে, বিদ্যাসাগর মহাশয় আর আত্মগোপন করিতে পারেন নাই। তখন লোকটি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রকৃত মহত্ত্বানুভব করিয়া পরম পুলকে বিদায় গ্রহণ করেন।

 অনেকেই আবার সাক্ষাৎকার জন্য অসময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উপর উৎপীড়ন করিতেন। এক বার উত্তরপাড়া হইতে কতকগুলি লোক তাঁহার বাদুড়বাগানের বাড়ীতে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসেন। উদ্দেশা,—চাকুরী প্রার্থনা। এই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কনিষ্ঠা কন্যা সাংঘাকিরূপে পীড়িতা ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় উপরে তাঁহার শুশ্রূষা করিতেছিলেন। মন অত্যন্ত চঞ্চল ছিল। এমন অস্থায়, উপস্থিত ব্যক্তিরা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহেন। সেই সময়ে ডাক্তার অমূল্যচরণ বসু মহাশয় নীচে এক স্থানে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি উপস্থিত ব্যক্তিগণকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মনের অবস্থা জানাইয়া তাহাদিগকে সময়ান্তরে আসিতে বলেন। তাঁহারা তাঁহার কপা শুনিলেন না; অধিকন্তু চাকরের দ্বারা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সংবাদ পাঠাইয়া দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় বলিয়া পাঠান,—“অদ্য আমার মন বড়ই চঞ্চল। কন্যায় কাছ-ছাড়া হইতে পারি না, আপনারা অন্য দিন আসিবেন।” লোক-কয়টী এ কথা না নিয়া উপরে যাইবার জন্য সিঁড়ির উপরে উঠিলেন। তখন বিদ্যাসাগর মহাশয় উপব হইতে নামিয়া আসিয়া একটু বিরক্তি সহকারে বলিলেন,—“আপনারা বড়ই গরজ বুঝেন। আপনাদের কি দয়া-মায়া নাই? অদ্য যাউন, আর একদিন আসিবেন।” তখন লোক গুলি অপ্রস্তুত হইয়া চলিয়া যান।

 বিদ্যাসাগর মহাশযের উপর এইরূপ উৎপীড়ন প্রায়ই হইত। তিনি বলিতেন,—“উৎপীড়ন প্রায়ই হইত বটে; কিন্তু উৎপীড়ন সহ্য করিতে অভ্যাস করিয়াছি।”

 এই সময়ে দেবোত্তর বিষয়ে হস্তান্তরকরণ সম্বন্ধে আইন করিবার বিল হয়। সরকার বাহাদুর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মত অবগত হইবার জন্য তাঁহাকে পত্র লিখিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় নিম্নলিখিত পত্রে নিম্নলিখিত রূপ অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়াছিলেন। পত্র ইংরেজিতে লিখিত হইয়াছিল, এইখানে তাহার মর্ম্মানুবাদ প্রকাশিত হইল,—


 আর, বি, চ্যাপমান স্কোয়ার
 বোর্ড অব্ রেভিনিউ আপিসের সেক্রেটরি
  মহোদয় সমীপেষু—

মহাশয়!

 আপনি গত ১৮ই জুলাই তারিখে ৬৫৬ নং বি নং পত্রে আমার যে মন্তব্য চাহিয়াছেন, তাহার প্রত্যুত্তরে আমার বক্তব্য এই যে, হিন্দু ব্যবহার-শাস্ত্রে, দেবোত্তর সম্পত্তির বিক্রয় বা প্রতিকূলে কোন প্রকার প্রমাণ-বাক্য দৃষ্ট হয় না; কিন্তু দেশের চিরন্তন পদ্ধতি, এরূপ সম্পত্তির কোন প্রকার হস্তান্তরের প্রতিকূলে দণ্ডায়মান। বস্তুতঃ হিন্দুধর্মাবলম্বী-মাত্রেই যখন ঈদৃশ দেবোত্তর সম্পত্তি প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁহাদিগের তখন প্রধান উদ্দেশ্য এই থাকে যে, এরূপ সম্পত্তি ভবিষ্যতে যেন কোন প্রকারে হস্তান্তরিত না হয় ও চিরদিন অক্ষুণ্ন থাকে। এরূপ অভিপ্রায়ের বশবর্ত্তী হইয়া তাঁহারা উক্ত প্রকার সম্পত্তিসংক্রান্ত কতকগুলি নিয়মের নির্দ্দেশ করিয়া দেন। উক্ত সম্পত্তির ট্রষ্টিরা (অধ্যক্ষেরা) তম্নিমিত্ত ঈদৃশ সম্পত্তি কোন প্রকারেই হস্তান্তর বা বিক্রয়াদি করিতে সমর্থ হন না। যদিও এ সম্বন্ধে কোন প্রকার সুস্পষ্টবিধি হিন্দুশাস্ত্রে লক্ষিত হয় না, তথাপি হিন্দু ব্যবহার-শাস্ত্রের ঈদৃশ সম্পত্তির হস্তান্তর কোন ক্রমেই সমীচীন বলিয়া বোধ হয় না। হিন্দু ব্যবহার-শাস্ত্রের নির্দ্দেশানুসারে কোন প্রকার হস্তান্তর উক্ত সম্পত্তির মালিকের স্পষ্ট সম্মতি ব্যতীত একেবারেই অসিদ্ধ। যে দেবতার উদ্দেশে দেবোত্তর সম্পত্তির সৃষ্টি হয়, তিনিই আইনানুসারে উক্ত সম্পত্তির একমাত্র মালিক; সুতরাং দেবতার সম্মতি ব্যতীত, উক্ত সম্পত্তি হস্তান্তর বা বিক্রয়াদি আদৌ সম্ভবপর নহে। দেবতার নিকট হইতে তাদৃশ সম্মতিগ্রহণ একেবারেই অসম্ভব; সুতরাং দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তান্তর কোন মতেই আইনসঙ্গত্ব নহে।

 ২। দেবোত্তর সম্পত্তির সুবন্দোবস্ত করিতে হইলে ট্রষ্টিদিগকে যে প্রকার সময়ে সময়ে কষ্টে পড়িতে হয়, তাহা আমি সবিশেষ অবগত আছি। এরূপ ঘটনা সংঘটিত হওয়া নিতান্ত অসম্ভব নহে যে, কখন কখন সম্পত্তির বন্দোবস্তের জন্য ট্রষ্টিদিগকে দায়গ্রস্ত হইতে হয় ও সম্পত্তির সামান্য আয় হইতে সেরূপ ঋণ পরিশোধ করা তাহাদিগের পক্ষে নিতান্তই দুরূহ হইয়া উঠে। কারণ অনেক স্থলেই দৃষ্ট হয় যে, দেবোত্তর সম্পত্তির অনুষ্ঠাতৃগণ উক্ত সম্পত্তির আয় এরূপভাবে স্বকীর ব্যয় সঙ্কুলনার্থ প্রয়োগ করেন যে, তাহা হইতে যৎসামান্য অংশমাত্র অবশিষ্ট থাকে। তাহাও মন্দির-সংস্কার, গবর্নমেণ্ট দেয় রাজস্ব প্রদান (অর্থাৎ যে বৎসর অনাবৃষ্টি ও বন্যা প্রভৃতি কারণবশতঃ প্রজাদিগের নিকট হইতে কর অনাদায় থাকে) প্রভৃতি অতিরিক্ত ব্যয়নির্ব্বাহার্থ পর্যাপ্ত হয় না। ট্রষ্টিরা যে ঈদৃশ অবস্থায় নিজের তহবিল বা সংগৃহীত চাঁদা হইতে উক্ত ব্যয় নির্ব্বাহ করিবেন, তাহা কোন মতেই আশা করা যাইতে পারে না। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আইনের বিধি নিতান্তই আবশ্যক এবং এই কারণবশতঃ ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দের ৮ আইনের পাণ্ডুলিপির ১ ধারা অনুসারে যদি এরূপ কোন বিধি স্পষ্টতঃ নির্দিষ্ট হয় যে, দেবোত্তর সম্পত্তির কোন প্রকার বন্দোবস্তলব্ধ আয় উক্ত সম্পত্তিসংক্রান্ত অতিরিক্ত ব্যয়নির্ব্বাহ ভিন্ন অন্য বিষয়ে প্রযুক্ত হইতে পারিবে না, তাহাতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। এরূপ উদ্দেশে দেবোত্তর সম্পত্তির কোন প্রকার হস্তান্তর আমার সামান্য বিবেচনায় হিন্দুব্যবহার শাস্ত্রের বিরোধী নহে। সকল প্রকার দেবোত্তর সম্পত্তির সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্য এই যে, উহার কোন প্রকার “তছরূপ” যাহাতে না ঘটে। উপরোক্ত অতিরিক্ত ব্যয় দেবোত্তর সম্পত্তির রক্ষার জন্যই প্রয়োজন হয়; সুতরাংঈদৃশ অবস্থায় কোন ক্রমেই ইহা “তছরূপ” শব্দে অভিহিত হইতে পারে না। অধিকন্তু দেবতা যদি বাক্য উচ্চারণ করিতে সমর্থ হইতেন, তাহা হইলে তিনি আপন সম্মতি প্রদান করিতে কখনই পরাঙ্মুখ হইতেন না; বরং এরূপ সঙ্কটে সম্পত্তির হস্তান্তরকরণের পক্ষে তিনি বিশেষ যত্নবান্ হইতেন।

 ৩। যে অবস্থায় দেবোত্তর সম্পত্তির হস্তান্তর সম্যক্ উচিত বলিয়া প্রতীয়মান হয়, তাহা উপরে বিশেষভাবে উল্লিখিত হইল। কিন্তু উপরোক্ত পাণ্ডুলিপির ২ ধারাতে ট্রষ্টিদিগকে যে ক্ষমতা প্রদান করা হইয়াছে, তাহা আমার বিবেচনায় নিতান্ত যুক্তিবিরুদ্ধ। তাহাতে এরূপ নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে যে, দেবোত্তর সম্পত্তির বিক্রয় বা বন্ধকদানের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, তাহার অনুসন্ধানের কোন আবশ্যকতা নাই। কিম্বা বিক্রয় ও বন্ধক দ্বারা প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থ সংগৃহীত হইতেছে কি না, তাহাও দেখিবার প্রয়োজন নাই। ট্রষ্টিদিগের এরূপ অসংযত ক্ষমতা এবং ক্রেতা ও বন্ধকগৃহীতাদিগের সম্বন্ধে সকল প্রকার দায়িত্ব হইতে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকিলে দেবোত্তর সম্পত্তির বহুবিধ “তছরুপ” নিতান্ত সম্ভবপর হইবে। তাহার বিরুদ্ধে প্রতীকার নিতান্তই আবশ্যক। আমার অনুমান হয়, অপরাপর সম্পত্তি হস্তান্তর সংক্রান্ত ঈদৃশ আইনাদি প্রচলিত আছে যে, উক্ত সম্পত্তির ক্রেতা বা বন্ধকগৃহীতাদিগকে সম্পত্তির হস্তান্তরে বাস্তবিক প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত অনেক অনুসন্ধান করিতে হয়। অপরআপর ট্রষ্টি সম্পত্তির বিক্রয় বা হস্তান্তর আইনসিদ্ধ কি না, ইহা বিচার করিতে হইলে দেখিতে হয় যে, উক্ত প্রকার হস্তান্তর দ্বারা সম্পত্তির কোন মঙ্গল সাধিত হইয়াছে বা কোন প্রকার আকস্মিক বিপদ হইতে রক্ষা করা হইয়াছে। কিন্তু দেবোত্তর সম্পত্তির বিক্রয় বা হস্তান্তর সম্বন্ধে এরূপ কোন নিয়মাদি পাণ্ডুলিপিতে সন্নিবিষ্ট হয় নাই, কেন বুঝিতে পারিলাম না। আমি তজ্জন্য প্রস্তাব করিতেছি, ২য় ধারা এরূপ ভাবে লিখিত হয় যে, ভবিষ্যতে সম্পত্তির কোন প্রকার ক্ষয় বা “তছরূপ” একেবারে অসম্ভব হয়। উক্তরূপ প্রতিবিধানগুলি বিনষ্ট হইলে পাণ্ডুলিপি লিখিত আইনটী হিন্দু ব্যবহার-শাস্ত্রের বিরোধী বা সাধারণ হিন্দু-সমাজের মনক্ষোভের কারণ হইবে না।

কলিকাতা,
৭ই আগষ্ট, ১৮৬১ খৃষ্টাব্দ।

(স্বাক্ষর) শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শৰ্মা

 বলা বাহুল্য দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তান্তর-করণ সম্বন্ধে কোন আইন পাশ হয় নাই।

 ১৮৭৩ সালের ২রা পৌষ বা ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেস্বর রবিবার বিদ্যাসাগর মহাশয় মিস্ কারপেন্টারকে[২]সঙ্গে লইয়া, উত্তরপাড়ায় বিজয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত ও বালিকাবিদ্যালয় পরিদর্শনার্থ গমন করেন। তাৎকালিক শিক্ষাবিভাগের ডাইরেক্টর আটকিন্‌সন্ সাহেব এবং স্কুল-ইনস্পেক্টর উড্রো সাহেব তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। বিদ্যালয় পরিদর্শনান্তে সকলেই গাড়ী করিয়া ফিরিয়া আসেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় একটী ভদ্রলোকের সহিত একখানি বগী করিয়া আসিতেছিলেন। গাড়ী চড়িবার সময় তিনি সঙ্গী ভদ্র লোকটীকে বলেন,—“বাপু! আমি কখনও বগী চড়ি নাই; হাঁকাইও নাই; দেখো সাবধানে হাঁকাইও।” ভদ্র লোকটী অবশ্য তাঁহাকে ধুই আশা-ভরসা দিয়াছিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় গাড়ীখানি কিছুদূর আসিয়া মোড় ফিরবার সময় একবারে উল্টাইয়া পড়ে। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখনই পড়িয়া অজ্ঞান হইয়া যান। তাঁহার যকৃতে দারুণ আঘাত লাগিয়াছিল। চারি দিক লোকে লোকারণ্য হইয়াছিল। মিস্ কারপেণ্টার তাঁহাকে বুকে তুলিয়া, আপন রুমাল ছিঁড়িয়া, ক্ষত স্থানে বাঁধিয়া দিয়াছিলেন। তাঁহার ও উড্রো সাহেবের শুশ্রূষায় বিদ্যাসাগর মহাশয় চৈতন্য লাভ করেন। পরে তিনি চৈতন্য লাভ করিয়া অনেক কষ্টে কলিকাতার কর্ণওয়ালিস্ ষ্ট্রীটস্থ বাসায় ফিরিয়া আসেন। এই দৈব-দুর্ঘটনার কথা শুনিয়া, তাঁহার বন্ধু-বান্ধব তাঁহাকে দেখিতে যান। পরম বন্ধু রাজকৃষ্ণ বাবু তাঁহাকে তুলিয়া লইয়া গিয়া সুকিয়া স্ট্রীটে নিজের বাটীতে লইয়া যান। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁহার চিকিৎসা করেন। ভয়ানক আঘাতে উরুদেশ ফুলিয়া উঠিয়াছিল। মাসের সুচিকিৎসায় তিনি এক রকম সারিয়া উঠেন; কিন্তু যে কালরোগে তাঁহার জীবনলীলার অবসান হয়, তাহার অঙ্কুরোৎপত্তি এই খানে। চিকিৎসকেরা বলেন, তাঁহার যকৃৎ উলটাইয়া গিয়াছিল। এই সময় হইতে তাঁহার স্বাস্থ্যভঙ্গ হইল। ইহার পর তাঁহাকে প্রায়ই শিরঃপীড়া ও উদরাময় রোগ ভোগ করিতে হইত। পরিপাক শক্তি হ্রাস হইয়া যায়। সুতরাং আহারও লঘু হইয়া পড়ে। দুগ্ধ সহ্য হইত না। প্রাতে মাছের ঝোল, ভাত এবং রাত্রিকালে বারলির রুটি, কখন কখন গরম লুচিমাত্র আহার ছিল। পরে তাহাও অসহ্য হইয়াছিল। অনেক সময় তিনি রাত্রিকালে দুই এক গাল মুড়ি খাইয়া থাকিতেন। তিনি প্রায়ই বলিতেন,—“বাল্যে পয়সার অভাবে দুগ্ধ খাই নাই; বয়সেও রোগের জ্বালায় তাহা হয় নাই।” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্বমুখে শুনিগাছি, উত্তরপাড়ার পতনের পর হইতে তাঁহার সাহস, উদ্যম, অধ্যবসায়, চেষ্টা, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি যা কিছু সকলেরই হ্রাস হইয়াছিল। আর তিনি শোধরাইতে পারিলেন না। স্বাস্থ্যরক্ষার্থ প্রায়ই তাঁহাকে ফরাসভাঙ্গা, বর্দ্ধমান, কাণপুর প্রভৃতি স্থানে থাকিতে হইত। তবুও কিন্তু কার্য্যবীরের কার্য্য বিরাম ছিল না।

 পতনাঘাত হইতে কতকটা আরোগ্য লাভ করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮৬৭ সালের প্রারম্ভে বীরসিংহ গ্রামে গমন করিয়াছিলেন। এই সময় এক অবীরা বিধবার আত্মীয়েরা তাঁহার জমী আত্মসাৎ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। সেই বিধবা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট কাঁদিয়া কাটিয়া আপন দুঃখ জ্ঞাপন করেন। তিনি বিধবার আত্মীয়দিগকে ডাকাইয়া আনিয়া বিধবার জমী আত্মসাৎ করিতে নিষেধ করেন। তাঁহারা তাঁহার কথা শুনেন নাই; বরং তাঁহারা বিধবার নামে আদালতে নালিশ করিয়াছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় এ বিধবার যথেষ্ট সহায়তা করিতেছেন শুনিয়া, তাঁহারা আর আদালতে উপস্থিত হন নাই।

 এই সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় বীরসিংহের বাটীতে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা করেন,—

 মধ্যম ও তৃতীয় সহোদর এবং স্বীয় পুত্রের পৃথক্ পৃথক্ ভোজনের ব্যবস্থা করিয়া দেন। সকলেরই মাসিক ব্যয়ের নিমিত্ত যাহার যেরূপ টাকার আবশ্যক, সেইরূপ ব্যবস্থা করেন। এরূপ করিবার কারণ এই, একত্র অনেক পরিবার থাকিলে কলহ হইবার সম্ভাবনা; বিশেষতঃ বহুপরিবার একত্র অবস্থিতি করিলে সকলেরই সকল বিষয়ে কষ্ট হয়। ইতিপূর্বে ভগিনীদ্বয়ের পৃথক্‌ বাটী নির্ম্মাণ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। বিদেশীয় যে সকল বালক বাটীতে ভোজন করিয়া বীরসিংহ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিত, তাহাদের মাসিক ব্যয়নির্ব্বাহের জন্য সমস্ত টাকা দিয়া পাচক ও চাকর দ্বারা স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত করেন। ইহার কিছু দিন পরে তাঁহার পুত্র নারায়ণের পৃথক বাটী প্রস্তুত হয়। এবং নিজের নিকট জননীদেবীর অবস্থিতি করিবার ব্যবস্থা হইল।[৩]

 এই ব্যবস্থায় হিন্দুর একান্নভুক্ত পরিবার প্রথার বিরোধ প্রমাণ। বিদ্যাসাগর মহাশয় একান্নভুক্ত পরিবার প্রথার পক্ষপাতী ছিলেন না। ইহা তাঁহার দোষ নহে, দোষ তাঁহার শিক্ষার। হিন্দুধর্ম্মের অন্তস্তলে প্রবেশ করিবার অধিকার তাঁহার ছিল না; হিন্দুসমাজের গঠনের মূল-তত্ত্বে এই জন্য তিনি লক্ষ্য করিতে সমর্থ হইতেন না। তিনি হিন্দুর যে সামাজিক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, তাহাতে ইহার পরিচয় পাওয়া যায়। এই একান্নভুক্ত পরিবারপ্রথার বিরুদ্ধাচরণ করাও সেই বিষয়ের পরিচয় দিতেছে। হিন্দুর সংসারে, সমাজে, অনেক সময় ব্যবহারিক সকল বিষয়ে পরমার্থতত্ত্বলাভের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রকট ভাবে অন্তস্তত্ত্ব বুঝাইবার নিমিত্ত হিন্দুর বাহ্য ব্যবহারের সৃষ্টি। একান্নভুক্ত-পরিবার প্রথা হিন্দুসমাজ-গঠনে একটা প্রধান অঙ্গ—হিন্দুর যোগ-সাধনে-মোক্ষ-প্রাপ্তির প্রধান পথ। এক অপরের সহিত যুক্ত হইলে যোগ হয়। সমস্ত জগতের সহিত মিশিয়া যাওয়া, আপনাতে সমস্তু জগতের লয় করা, জাগতিক প্রত্যেক বস্তুতে আপনার সত্ত্বা উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করা, হিন্দুর মুখ্য সাধন-পথ। গৃহে ইহার প্রথম সূত্রপাত হয়,—প্রথম সূত্রপাত হইয়া একে একে,—অর্থাৎ হয় গুরু-শিষ্যে না হয় স্বামী-স্ত্রীতে, না হয় পিতা-পুত্রে ইত্যাদি। দুই এক হইয়া দ্বিগুণ বললাভ করিলে অপর এক জনকে গ্রহণ করা অর্থাৎ আপন শক্তিতে মিশাইয়া লওয়া সহজ। এইরূপ দুই ও একে তিন হইলে তখন স্বচ্ছন্দে আর দুই জনকে লওয়া চলে—তাহার সুখদুঃখে সুখীদুঃখী হওয়া যায়। যাহারা আত্মীয়, যাহাদের একই রূপ সংস্কারবশে একই বংশে জন্ম, তাহাদের সহিত এরূপ মিল সহজ এবং অধিকতর অল্পায়াসসাধ্য। তাই একান্ন ভুক্ত-পরিবার-প্রথার সৃষ্টি।

  1. He was one of the principal suppoters of the female schools established and managed by Pandit Issur Chandra Vidysaghar.”
    Hindu Patriot, 1866, 23, July.
  2. ভারতীয় স্ত্রীলোকদিগের লেখাপড়া শিক্ষা বিস্তারের আকাঙ্খায় ইনি ভারতে আসিয়াছিলেন। বৃষ্টলে ইঁহার পিতা পাদরী কারপেন্টার সাহেবের গৃহে রাজা মমোহন রায়ের মৃত্যু হয়। তখন ইনি বালিকা দুষ্পাঠ্য
  3. বিদ্যারত্ন মহাশয় এই কথা লিখিয়াছেন। নারায়ণ বাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, সবই সত্য; তবে কলহের সম্ভাবনা নহে, সত্য সত্যই কলহ ঘটিয়াছিল।