বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/দয়া ও পরোপকার

উইকিসংকলন থেকে

একাদশ পরিচ্ছেদ॥ দয়া ও পরোপকার

 দুঃখভারাক্রান্ত ও শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে শান্তিবারি বর্ষণ করিবার জন্যই করুণাময় পরমেশ্বর মানবহৃদয়ে দয়াগুণ প্রদান করিয়াছেন। দয়ালু ব্যক্তি পৃথিবীর ভূষণস্বরূপ। সমগ্র পৃথিবী তাহার দানের ক্ষেত্র। পথিবীর সকল দেশে, সকল জাতির মধ্যে এবং সকল শাস্ত্রেই দয়ার ভূয়সী প্রশংসা দৃষ্টিগোচর হয়। দানসম্মন্ধে শাস্ত্রে কোন প্রকার মতভেদ দৃষ্ট হয় না। দয়ার কার্ষ্যে জাতি, ধর্ম্ম, কিংবা কুলশীলের বিচার নাই। নিম্নভূূমিতে যেরূপ জল ধাবিত হয়, সেইরূপ দীন দুঃখী দেখিলেই দয়াশীল ব্যক্তির দয়ার স্রোত প্রবাহিত হয়। কত শত কৃপাবান মহাত্মা দয়াপরতন্ত্র হইয়া, পরোপকারকার্ষ্যেে ধন প্রাণ উৎসর্গ করিয়া গিয়াছেন, তাহার ইয়ত্তা নাই। তাঁহাদের কার্য্য দেখিলে বোধ হয়, পরের উপকার করিবার জন্যই যেন তাঁহারা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। কি ধনী, কি দরিদ্র, মনে করিলে, সকল লোকেই পরের উপকার করিতে পারেন। ধন থাকিলেই যে, পরের উপকার করিতে পারা যায় তাহা নহে; শরীর, মন, বাক্য এবং কার্য্য দ্বারাও অপরের বিস্তর উপকার করা যায়। ফলতঃ যাঁঁহার যেরূপ ক্ষমতা, তিনি সেইরূপে পরের উপকার করিতে পারেন। দয়ালুু ব্যক্তিরা কেবল মানবের উপকার করিয়াই যে ক্ষাত থাকেন, তাহা নহে। জীবমাত্রই তাঁহাদের দয়ার পাত্র। অক্ষম, রুুগ্ন, দুুর্ব্বল এবং বৃদ্ধ ইতর প্রাণী দেখিলেই তাঁহাদের কৃপাসিন্ধু উদ্বেল হইয়া উঠে। দুঃখীর দুঃখমোচন, বিপন্ন ব্যক্তির বিপদুদ্ধার, শোকার্ত্তকে সান্ত্বনা দান, এই সকলই দয়ার কার্য্য। দয়ালুু মহোদয়গণ বিবিধ সদানুষ্ঠান দ্বারা প্রতিনিয়ত জগতের অশেষ কল্যাণ সাধন করিতেছেন।

 মনুষ্যজাতির মধ্যে দয়াবৃৃত্তি রমণীহৃদয়ে অধিক পরিস্ফুট দেখিতে পাওয়া যায়। রমণী জাতি দয়া-পূূর্ণিমার নিষ্কলঙ্ক পূূর্ণচন্দ্র। তাঁহাদের দয়ায় স্বার্থরূপ মলিনতার লেশমাত্র নাই। বিদ্যাসাগরজননী ভগবতী দেবীর দয়া কিন্তু সাধারণ রমণী হইতে অনেকাংশে বিভিন্ন ছিল। তাহার দয়া অলৌকিক; তাহা কোন প্রকার শাস্ত্র বা লোকাচার প্রথায় আবদ্ধ ছিল না। বীরসিংহ ও তন্নিকটবর্ত্তী গ্রামসমূহের অধিবাসিদের উপর তাঁহার দয়াপ্রবণ হৃদয়ের করুণাাবারি সতত বর্ষিত হইত। তাঁহার সেই উন্নত হৃদয়, রোগার্ত্তের সেবা, ক্ষুধার্তকে অন্নদান, শোকাতুরের শোকে শোক ও সহানুভূতি প্রকাশ করিতে সতত ব্যস্ত থাকিত।

 ভগবতী দেবী সর্ব্বদাই গ্রামস্থ অভুক্ত লোকদিগকে ভোজন করাইতেন। স্থানীয় প্রতিবাসিগণ পীড়িত হইলে, সর্ব্বদাই তাহাদের তত্ত্বাবধান করিতেন। বিদেশীয় যে সকল রোগিগণ চিকিৎসার জন্য বাটীতে আসিয়া অবস্থিতি করিত, তিনি স্বয়ং তাহাদের আবশ্যক দ্রব্যাদি পাক করিয়া দিতেন। যে সকল দরিদ্র প্রতিবেশীর বস্ত্র না থাকিত, সময়ে সময়ে তাহাদিগকে যথেষ্ট বস্ত্র ক্রয় করিয়া দিতেন, এবং সময়ে সময়ে অনেকের আপদ বিপদে যথেষ্ট অর্থ প্রদান করিতেন। ভগবতী দেবীর দানের জন্য যখন যাহা আবশ্যক হইত, বিদ্যাসাগর মহাশয় অবিলম্বে তাহা পাঠাইয়া দিতেন। তিনি যাহাতে সন্তুষ্ট থাকেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই কার্য্য অবিলম্বে সম্পন্ন করিতেন। প্রতি বৎসরেই বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ করিয়া অনেক দীন দরিদ্রের কর্ম্ম করিয়া দিতেন। বৎসরের মধ্যে নূতন নূতন অনেক কুটুম্ব ও গ্রামস্থ অনাথগণের মাসহারা করাইয়া দিতেন। গ্রামে বিদ্যালয় সংস্থাপনের পূর্ব্বে গ্রামস্থ প্রায় সকল লোকেই দরিদ্র ছিল। কেহ লেখাপড়া জানিত না। কেহ চাকরী করিত না। সকলেই সামান্য কৃষিবৃত্তি অবলম্বন করিয়া দিনপাত করিত। সংবৎসরের পরিশ্রমলব্ধ সমস্ত ধান্য পৌষ মাসেই মহাজনগণ বলপূর্ব্বক এক কালেই লইয়া যাইতেন। গ্রামের প্রায় অনেক লোক এক সন্ধ্যা আহার করিয়া অতি কষ্টে দিনপাত করিত। ভগবতী দেবী গ্রামস্থ অনেককেই টাকা ধার দিতেন, কিন্তু কাহারও নিকট পাইবার আশা রাখিতেন না।

 কেহ দেনা শোধ করিতে অক্ষম হইলে, তিনি তাহার নিকট হইতে আসল টাকা পযত লইতেন না। তিনি বলিতেন, “উহাদের অভাব দূর করিবার জন্যই ত টাকা ধার দেওয়া; অর্থ সঞ্চয় করা ত আমার উদ্দেশ্য নহে।” তিনি এমনই দয়াবতী ছিলেন যে, অক্ষম অধমণগণকে ক্রন্দন করতে দেখিলে, তাহাদিগকে সান্ত্বনাবাক্যে বলিতেন, ‘অবস্থা ভাল হয়, দিবি। না হয় না দিবি, তার জন্য কাঁদিস কেন?”

 অর্থের প্রয়োজন হইলে, মধ্যে মধ্যে তিনি এইরূপ টাকা আদায় করিতে বাহির। হইতেন। কেহ বা তখন হলুদ বাটিয়া; তাঁহাকে মাখাইয়া দিত। কেহ বা তাঁহার অঞ্চলে মুড়ি কিম্বা অন্য কোন খাদ্যদ্রব্য বাঁধিয়া দিত। দয়াবতী ভগবতী দেবী তাহাদের যত্নে টাকা আদায়ের কথা ভুলিয়া যাইতেন। এবং গৃহে প্রত্যাগমনকালে তাহাদিগকে বলিয়া আসিতেন, ‘“আজ তোরা আমাদের বাটীতে প্রসাদ পাস্”। এইরূপে টাকা আদায়ের পরিবর্ত্তে গৃহে গৃহে নিমন্ত্রণ করিয়া অবশেষে স্বীয় ভবনে প্রত্যাগত হইতেন। বাটির সকলের আহার শেষ হইলে, যদি কোন অধমর্ণ আহার করিতে আসিত, ভগবতী দেবী তাহাকে দেখিবামাত্র জিব কাটিয়া বলিতেন, “তাই ত বাবা, আমার মনে ছিল না। একটুখানি বস, আমি আবার ভাত রাঁধিয়া দিতেছি।” এই কথা বলিয়া দয়াশীলা ভগবতী দেবী তৎক্ষণাৎ আহারাদি প্রস্তুত করিয়া দিতেন।

 এক সময়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় কলিকাতা হইতে কয়েকখানি লেপ প্রস্তুত করাইয়া দেশে পাঠাইয়া দেন। গ্রামের কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তি শীতে অতি কষ্টে নিশাযাপন করে শ্রবণ করিয়া ভগবতী ঐ লেপ কয়েকখানি তাহাদিগকে দান করেন। পরিশেষে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে পত্র লিখিলেন, “তুমি যে কয়েকখানি লেপ পাঠাইয়া দিয়ছি, তাহা গ্রামের কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তিকে দিয়াছি। আমাদের। জন্য কয়েকখানি কম্বল শীঘ্র পাঠাইয়া দিবে।” এই কথা শুনিয়া বিদ্যাসাগর বাটির জন্য আবার কয়েকখানি লেপ প্রস্তুত করাইয়া পাঠাইয়া দিলেন। মাতাকে লিখিলেন, “ঐরূপ বিতরণের জন্য আপনার যে কয়েকখানি লেপের প্রয়োজন আমাকে সত্ত্বর লিখিবেন, আমি এখান হইতে পাঠাইয়া দিব।’ এইরূপে ভগবতী দেবীর দয়া ও পরোপকার, প্রবৃত্তি পর্য্যালোচনা করিলে মনে হয়, তিনি পরের উপকারের জন্যই জন্মিয়াছিলেন, এবং পরের উপকার করিয়াই আপনার জন্ম সার্থক করিয়াছিলেন।