বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/ধৈর্য্য ও সৎসাহস

উইকিসংকলন থেকে

নবম পরিচ্ছেদ॥ ধৈর্য্য ও সৎসাহস

 জন্মগ্রহণ করিলেই মনুষ্যকে বিপদ, কষ্ট, অভাব, যন্ত্রণা ও হানি সহ্য করিতে হয়। অতএব সাহস ও ধৈর্য্য দ্বারা চিত্তকে দৃঢ়ীভূত করা মানবমাত্ররই অবশ্যকর্ত্তব্য। কারণ, তাহা হইলে দুঃখের অংশ বহন করা সহজসাধ্য হইয়া মরুভূমির মধ্যে উষ্ট্র যেমন শ্রম, তাপ, ক্ষুধা ও পিপাসা সহ্য করে, কাতর হয় না; ধৈর্য্যশালী ব্যক্তিও সেইরূপ বিষাদ এবং কষ্টে পতিত হইয়াও সৎসাহসেরই পরিচয় প্রদান করিয়া থাকেন। উন্নতমনা, ওজস্বী ব্যক্তি অদৃষ্টের প্রতিকূলতাকে অবজ্ঞা করেন; তাঁহার মনোমাহাত্ম্য কিছুতেই খর্ব্ব হইবার নহে। তিনি সাগরশৈলের ন্যায় সংসার-জলধির বক্ষে অবস্থিতি করেন; বিপদরূপ তরঙ্গের আঘাতে তাঁহাকে বিচলিত করিতে পারে না। বিপদের সময় সাহস তাঁহার অন্তঃকরণে বলের সঞ্চার করে এবং তাঁহার চিত্তস্থৈর্য্য তাঁহাকে বহন করিয়া তাঁহার উদ্ধারসাধন করে। রণোন্মুখ সৈনিকের ন্যায় তিনি বিপদের সম্মুখীন হন, এবং হস্তে বিজয়লাভ করিয়া প্রত্যাগমন করেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল এবং তাঁহার পুস্তকের দ্বারা অর্থাগমের যথেষ্ট সুবিধা হইয়াছিল, তখন তিনি দেশে আগমন করিলে, বীরসিংহ ও নিকটবরর্ত্তী গ্রামের দীন দরিদ্র অবস্থাহীন ব্যক্তিবর্গকে আপনার সাধ্যমত অর্থসাহায্য করিতেন। সন্ধ্যার পর তিনি চাদরে টাকা বাঁধিয়া, লোকের গৃহে গৃহে যাইয়া গোপনে অর্থসাহায্য করিয়া আসিতেন। এইরূপ গোপনে অর্থসাহায্য করিবার কারণ এই যে, এই সকল লোক অবস্থাহীন বটে, কিন্তু ভদ্রপরিবারভুক্ত, সুতরাং প্রকাশ্যে অর্থসাহায্যের প্রার্থনা করা নিশ্চিত তাহাদের পক্ষে ঘোরতর লজ্জাজনক বিষয়।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় ১২৫৯ সালের গ্রীষ্মবকাশে কলিকাতা হইতে যাত্রা করিয়া পদৱজে ৬ ক্রোশ অন্তর চণ্ডীতলা গ্রামের এক পান্থনিবাসে রাত্রি যাপনপূর্ব্বক পরদিবস পদব্রজেই তথা হইতে ২০ ক্রোশ অন্তর বীরসিংহে নিজ বাটীতে উপস্থিত হইলেন। তদনন্তর পিতামাতা, ভ্রাতাভগিনী ও প্রতিবেশী বন্ধুবর্গের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।

 পরদিবস হইতে গ্রামস্থ নিরুপায়দিগকে যথাসাধ্য কিছু কিছু অর্থসাহায্য করিতে লাগিলেন। ইহা দেখিয়া গ্রামের ও পাশ্ববর্ত্তীগ্রামের অনেকে ইঁহাকে ধনশালী বলিয়া স্থির করিলেন। বোধ হয়, এই কারণেই গ্রামস্থ ব্যক্তিদিগের যোগে ৩০ বৈশাখ বীরসিংহের বাটীতে ডাকাইতি হয়। ঐ দিবস সকলে রাত্রি নয়টার পর ভোজনান্তে অতঃপরে শয়ন করিয়াছিলেন, বহির্বাটীতে প্রায় ৩০ জন পুরুষ নিদ্রা যাইতেছিলেন, এতদ্ব্যতীত দুইজন গ্রাম্য চৌকিদারও জাগরিত ছিল। নিশীথ সময়ে বাটীর সম্মুখে প্রায় ৪০ জন লোক ভয়ানক চীৎকার করিয়া উঠিল। এই চীৎকারধ্বনি শ্রবণে সকলেরই নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখন দস্যুগণ মশাল জ্বালিয়া মধ্যদ্বার ভাঙ্গিতেছিল, তদ্দর্শনে বিদ্যাসাগর অত্যন্ত ভীত হইলেন। সকলে অলক্ষিত ভাবে খিড়কির দ্বার দিয়া তাঁহাকে লইয়া বাটী হইতে প্রস্থান করিলেন। দস্যুগণ বিদ্যাসাগরকে ধরিতে পারিলে, টাকার জন্য বিলক্ষণ যাতনা দিত। দস্যুরা জ্বলন্ত মশাল ও উন্মুক্ত তরবারি হস্তে চতুর্দ্দিকে বিচরণ করিতে লাগিল। এমন সময়ে ভগবতী দেবী সুযোগ বুঝিয়া উপরে চলিয়া গেলেন। সেই বৎসর ঈশানবাবুর বিবাহের বৎসর। বিবাহের জন্য অলঙ্কারাদি প্রস্তুত হইয়াছিল। ভগবতী দেবী সেই গহনার বাক্স লইয়া যখন নিম্নে অবতরণ করেন, তখন এমনি ঘটিল যে এক প্রবল বাতাসে দস্যুগণের সমস্ত মশাল নির্ব্বাণ প্রাপ্ত হইল। ভগবতী তখন অন্ধকারে নিম্নে অবতরণ করিলেন এবং কৌশলপূর্ব্বক খিড়কীর দ্বার দিয়া গহনার বাক্স লইয়া পলায়ন করিলেন। অনন্তর দস্যুগণ যথাসর্ব্বস্ব লুণ্ঠন করিয়া প্রস্থান করিল। রাত্রিতেই ঘাটাল থানার দারোগার নিকট সংবাদ প্রেরিত হইল। তিনি পরদিন প্রাতে বীরসিংহে আগমন করিয়া পুলিশ কর্ম্মচারিদের প্রথানুসারে গোলমাল করায়, ঠাকুরদাস বলিলেন, “আপনি কুলীন ব্রাহ্মণের ছেলে বলিয়া আপনার মর্য্যাদা রাখিতে পারি, কিন্তু এসম্বন্ধে আপনাকে কিছু দিতে পারি না। অনন্তর ঠাকুরদাস, পরিবারবর্গের কাহারও দ্বিতীয় বস্ত্র ও ঘটী, বাটি, থালা ইত্যাদি না থাকায় এই সকল দ্রব্য ক্রয় করিবার জন্য উদয়গঞ্জ ও খড়ার গ্রামে গমন করিলেন। ইত্যবসরে বিদ্যাসাগর মহাশয় বাটীর সম্মুখে ভ্রাতা ও বন্ধুবর্গ লইয়া কপাটী খেলা আরম্ভ করিলেন। দারোগাবাবু, ফাঁড়িদারকে বলিলেন, “এ বামুনের (ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের) এত কি জোর যে, আমি দারোগা, আমার মুখের উপর জবাব দেয় যে একপয়সাও দিব না। অতি আশ্চর্য্যের বিষয় যে, এই ছোঁড়াটা কি রকমের লোক? কাল ডাকাইতি হইয়াছে, আজ সকালে বাটীর সম্মুখে কপাটি খেলিতেছে।” ফাঁড়িদার বলিল, “হুজুর ইনি সামান্য লোক নহেন। ইনি দেশে আসিলে, জাহানাবাদের ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট্‌ বাবু ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল, বন্ধুভাবে এখানে আসিয়া ইঁহার সহিত সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া, আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করেন। এবং শুনা যায় যে, বড়লাট ও ছোটলাট সাহেবের সহিত ইঁহার বন্ধুত্ব আছে। ইঁহার মত লইয়া জজ ম্যাজিস্ট্রেট্‌ বাহাল হয়।” ইহা শুনিয়া দারোগাবাবু, স্তব্ধ হইয়া শান্তভাবে কার্য্য করিলেন। কিন্তু ডাকাইতির কোন সন্ধান হইল না।

 সন ১২৭৫ সালের চৈত্র মাসে আর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা উপস্থিত হয়। বীরসিংহের পৈতৃক বাসভরন নিশীথ সময়ে অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হয়। সকলেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। অগ্নি যখন চতুর্দ্দিকে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিয়াছে, তখন সকলের নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখন সম্মুখে যে যাহা পাইল, তাহা লইয়া প্রাণভয়ে মুহর্ত্ত মধ্যে গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল। বাহিরে আসিয়া ভগবতী দেবীর মনে পড়িল, কনিষ্ঠ পুত্র ভূতনাথ গৃহে নিদ্রিত। তখন তিনি আর্দ্র কন্থায় গাত্র আবৃত করিয়া সেই প্রজ্বলিত গৃহ মধ্যে দ্রুতপদে প্রবেশ করিলেন এবং সুপ্ত সন্তানকে জাগরিত করিয়া তাহাকে ক্রোড়ে লইলেন এবং সেই কক্ষে গহনার বাক্স রহিয়াছে দেখিতে পাইয়া, পুত্র ও সেই গহনার বাক্স লইয়া দ্রুতপদে বহির্গত হইলেন। তিনি স্বয়ং বলিয়াছেন, “আসিবার সময় কে যেন আমার পথ মুক্ত করিয়া আমাকে জোর করিয়া বাহির করিয়া দিল। সকলের জীবন রক্ষা হইয়াছিল বটে, কিন্তু দ্রব্যাদি কিছুমাত্র রক্ষা হয় নাই। বিদ্যাসাগর এই সংবাদ প্রাপ্তি মাত্র দেশে আগমন করিলেন। মাতৃদেবীকে সমভিব্যাহারে লইয়া কলিকাতায় যাইবার জন্য যত্ন পাইলেন। কিন্তু তিনি যলিলেন, “আমি কলিকাতায় যাইব কারণ যে সকল ছাত্রগণ বাটীতে ভোজন করিয়া বীরসিংহ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে, আমি এ স্থান পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিলে, তাহারা কি করিয়া স্কুলে অধ্যয়ন করিবে। কে দরিদ্র বালকগণকে স্নেহ করিবে? বেলা দুই প্রহরের সময় অতিথিসকল ভোজন করিবার মানসে এখানে সমাগত হইলে, কে অভ্যর্থনাপূর্ব্বক তাহাদিগের পরিচর্য্যা করিবে? যে সকল কুটুুম্ব আগমন করিবেন কে তাঁহাদিগকে যত্ন করিয়া ভোজন করাইবে?” ভগবতী দেবী কলিকাতায় যাইতে সম্মত হইলেন না। জন্য বিদ্যাসাগর তাঁহার স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। বর্ষাকাল সমাগত; একারণ বিদ্যাসাগর তাহার বাসার্থ সামান্য গৃহ নির্ম্মাণ করাইয়া দিলেন।