বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/বিদ্যাসাগরের বিদ্যাশিক্ষা

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ॥ বিদ্যাসাগরের বিদ্যাশিক্ষা

 তদানীন্তন কালে পাঠশালায় শিশুদিগের বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ হইত। কিছু দিন পাঠশালে লিখিয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তানেরা টোলে ব্যাকরণ পড়িতে আরম্ভ করিতেন। এবং যাঁহারা সন্তানদিগকে রাজকার্য্য শিক্ষা দিতে প্রয়াস পাইতেন, তাঁহারা তাহাদিগকে পারসী পড়াইতেন। যাহারা জমিদারী সরকারে কর্ম্ম করিতে বা বিষয়-বাণিজ্যে নিযুক্ত হইতে ইচ্ছা করিত, তাহারাই শেষ পর্যন্ত গুরুমহাশয়ের পাঠশালে পাঠাভ্যাসে নিরত থাকিত।

 পাঠশালে পাঠনার রীতি এই ছিল যে, বালকেরা প্রথমে মাটিতে খড়ি দিয়া বর্ণপরিচয় করিত। তৎপরে তালপত্রে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, যুক্তবর্ণ, শতকিয়া, কড়াকিয়া, বুড়িকিয়া প্রভৃতি লিখিত। শেষে তালপত্র হইতে কদলীপত্রে উন্নীত হইত। তখন তেরিজ, জমাখরচ, শুভঙ্করী, কাঠাকালী, বিঘকালী প্রভৃতি শিখিত। সর্ব্বশেষে কাগজে উন্নীত হইয়া চিঠিপত্র লিখিতে শিখিত। সে সময়ে শিক্ষাপ্রণালীর উৎকর্ষের মধ্যে এই ছিল যে, পাঠশালে শিক্ষিত বালকগণ মানসাঙ্ক সম্বন্ধে আশ্চর্য্য পারদর্শিতা দেখাইত। মুখে মুখে জটিল অঙ্কের সমাধান করিয়া দিতে পারিত। চক্ষের নিমিষে বড় বড় হিসাব পরিষ্কার করিয়া ফেলিত। হস্তাক্ষর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুমহাশয়দিগের বিশেষ লক্ষ্য ছিল। তৎকালে বাঙ্গালা মুদ্রাযন্ত্র প্রায় ছিল না। যাহাদের হস্তাক্ষর উৎকৃষ্ট হইত, তাহারা সংস্কৃত পুস্তক হস্তে লিখিত। হস্তাক্ষর উৎকৃষ্ট হইলে, তাহারা সাধারণের নিকট সম্মানিত হইত। এ কারণ অনেকে হস্তাক্ষর উৎকৃষ্ট করিবার জন্য বিশেষ যত্ন পাইত। তৎকালে এ প্রদেশে বিবাহসম্বন্ধ করিতে আসিলে, লোকে অগ্রে পাত্রের হস্তাক্ষর দেখিত, তৎপরে সম্বন্ধ স্থিরীকরণের ব্যবস্থা করিত।

 গুরুমহাশয়গণ বর্তমান স্কুলসমূহের শিক্ষকগণের ন্যায় কোনও কমিটি বা কোনও ব্যক্তির নিকট নির্দিষ্ট বেতন পাইতেন না। প্রত্যেক গৃহস্থ আপন আপন বালকদিগকে পাঠশালে দিবার সময় গরমহাশয়ের সহিত তন্ত্র ব্যবস্থা করিতেন। এইরুপে মাসে মাসে তাহার সামান্য ১০।১২ টাকা আয় হইত। তৎপরে যাত্রা, মহোৎসব, পার্বণ, বা পারিবারিক অনুষ্ঠানাদিতে উপরি কিছু কিছু জুটিত, তাহাতেই গুরুমহাশয়দিগের সংসারযাত্রা নির্বাহ হইত। পাঠে অমনোযোগী ও দুর্বৃত্ত ছাত্রগণ হাতছড়ি, লাড়ুগোপাল, ত্রিভঙ্গ প্রভৃতি বিবিধ দণ্ডে দণ্ডিত হইত। ১৮৩৪ সালে লর্ড উইলিয়ম বেণ্টিঙ্ক, মিষ্টর উইলিয়ম এডামকে দেশীয় শিক্ষার অবস্থা পরিদর্শনার্থ নিয়োগ করিয়াছিলেন। তিনি পাঠশালাসকলের অবস্থা পরিদর্শন করিয়া গবর্ণমেণ্টের নিকট একটি মন্তব্য প্রেরণ করেন। তাহাতে প্রায় চতুর্দ্দশ প্রকার দণ্ডবিধান প্রণালীর উল্লেখ দেখা যায়। তাহার অনেকগুলির বিবরণ শুনিলে হৃৎকম্প উপস্থিত হয়।

 পঞ্চম বৎসর বয়সের সময় বিদ্যাসাগরের বিদ্যারম্ভ হয়। তৎকালে বীরসিংহ গ্রামে সনাতন বিশ্বাস পাঠশালার সরকার ছিলেন। সনাতন ছোট ছোট বালকগণকে শিক্ষা দিবার সময় বিলক্ষণ প্রহার করিতেন, তজ্জন্য শিশুগণ সদা শঙ্কিত হইয়া পাঠশালায় যাইতে ইচ্ছা করিত না। একারণ ঠাকুরদাস বীরসিংহ নিবাসী কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে শিক্ষক মনোনীত করিলেন। কালীকান্ত ভঙ্গ কুলীন ছিলেন, সুতরাং বহুবিবাহ করিতে আলস্য করেন নাই। তিনি ভদ্রেশ্বরের নিকট গোরুটি গ্রামেই প্রায় অবস্থিতি করিতেন। অপরাপর শ্বশর ভবনেও টাকা আদায় করিবার জন্য মধ্যে মধ্যে পরিভ্রমণ করিতেন। ঠাকুরদাস তাঁহাকে অনেক উপদেশ দিয়া, সমভিব্যাহারে করিয়া বীরসিংহে আনিলেন এবং কয়েক দিন পরে পাঠশালা স্থাপন করিয়া দিলেন। কালীকান্ত অত্যন্ত ভদ্রলোক ছিলেন। শিশুগণকে শিক্ষা দিবার বিশেষরুপ প্রণালী জানিতেন এবং তাহাদিগকে অতিরিক্ত যত্ন ও স্নেহ করিতেন। ছোট ছোট বালকগণ তাঁহার নিকট সর্ব্বদা অবস্থিতি করিতে ইচ্ছা করিত। এতভিন্ন তিনি সকলের সহিত সৌজন্য প্রকাশ করিতেন।স্থানীয় লোকগণ কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে আন্তরিক ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিত, এবং সকলেই তাঁহাকে গুরুমহাশয় বলিত। কালীকান্তের নিকট বিদ্যাসাগর কিঞ্চিদুন তিন বৎসর ক্রমাগত শিক্ষা করিয়া বাঙ্গালা ভাষা ও সামান্য অঙ্ক কসিতে শিখিলেন।ঐ সময়েই তাহার হস্তাক্ষর উৎকৃষ্ট হইয়াছিল। কালীকান্ত নানাপ্রকার কৌশল ও স্নেহ প্রদর্শন করিয়া শিক্ষা দিতে কিছুমাত্র এটি করেন নাই। তিনি আপন সন্তান অপেক্ষাও বিদ্যাসাগরকে ভালবাসিতেন। গুরুমহাশয় অপরাহ্নে অপরপর ছাত্রগণকে অবকাশ দিতেন। কেবল বিদ্যাসাগর মহাশয়কে তাঁহার নিকটে রাখিয়া সন্ধ্যার পর নামতা ও ধারাপাতাদি শিক্ষা দিতেন। অধিক রাত্রি হইলে, প্রত্যহ স্বয়ং ক্রোড়ে করিয়া বাটীতে আনিয়া বিদ্যাসাগরের পিতামহীর নিকট পৌঁছিয়া দিতেন। গুরুমহাশয় একদিবস সন্ধ্যার সময় ঠাকুরদাসকে বলিলেন, “মহাশয়, আপনার পুত্র অদ্বিতীয় বুদ্ধিমান্‌, শ্রুতিধর বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। পাঠশালায় যাহা শিখিতে হয়, তৎসমুদায়ই ইহার শিক্ষা হইয়াছে। ঈশ্বরকে এখান হইতে কলিকাতায় লইয়া যাওয়া অত্যন্ত আবশ্যক হইয়াছে। আপনি নিকটে রাখিয়া ইংরাজী শিক্ষা দিলে ভাল হয়। এ ছেলে সামান্য ছেলে নয়, বড় বড় ছেলেদের অপেক্ষা ইহার শিক্ষা অতি উত্তম হইয়াছে। আর হস্তাক্ষর যেরূপ হইয়াছে, তাহাতে পুঁথি লিখিতে পারিবে।” বিদ্যাসাগরের কলিকাতায় যাইবার প্রস্তাব শুনিয়া ভগবতী দেবী উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন।

 ঠাকুরদাস ইং ১৮২৯ ও বাঙ্গালা ১২৩৫ সালের কার্ত্তিক মাসে গুরুমহাশয় কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে সমভিব্যাহারে লইয়া, কলিকাতা যাত্রা করিলেন। কলিকাতা, বীরসিংহ হইতে প্রায় ২৬ ক্রোশ উত্তর পূর্ব্বে। তৎকালে তথা হইতে কলিকাতায় আসিবার সুগম পথ ছিল না। বিশেষতঃ পথে অত্যন্ত দস্যুর ভয় ছিল। প্রায় মধ্যে মধ্যে অনেকেই দস্যুযদিগের হস্তে পতিত হইয়া প্রাণ হারাইত। বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনপূর্ব্বক আসিতে হইত। ঘাটাল হইয়া রূপনারায়ণ নদী দিয়া, জলপথে নৌকারোহণে কলিকাতা যাইবার উপায় ছিল বটে, কিন্তু দস্যুভয় প্রযুক্ত নৌকায় যাইতে কেহ সাধ্যমতে ইচ্ছা করিত না। সুতরাং পদব্রজেই আসিতে হইল। বিদ্যাসাগর সমস্ত পথ চলিতে পারিবেন না বলিয়া, ভৃত্য আনন্দরাম গুটিকে ঠাকুরদাস সমভিব্যাহারে লইয়াছিলেন। যখন বিদ্যাসাগর চলিতে অক্ষম হইবেন, তখন মধ্যে মধ্যে এই বাহক, ক্রোড়ে বা স্কন্ধে করিয়া লইয়া যাইবেক ইহাই তাঁহার মন্তব্য ছিল। প্রথম দিবস বাটী হইতে ৬ ক্রোশ অন্তর পাতুল গ্রামে রাধামোহন বিদ্যাভূষণের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। পরদিবস সমস্ত দিনের পর সন্ধ্যার সময়, তথা হইতে ১০ ক্রোশ অন্তর সন্ধিপুর গ্রামে রাজচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাটীতে আগমন করিলেন। পরদিবস প্রাতে শ্যাখালা গ্রামের প্রান্তভাগে যে বাঁধা রাজপথ শালিকা পর্য্যন্ত গিয়াছে, সেই পথ দিয়া গমনকালে বিদ্যাসাগর মহাশয় পথে মাইল-ষ্টোন দেখিয়া বলিলেন, “বাবা! হলুদ বাটিবার শিল এখানে কেন মাটিতে পোতা রহিয়াছে। আর ইহাতে কি লেখা আছে?” তদুত্তরে ঠাকুরদাস বলিলেন, “ইহাকে মাইল-ষ্টোন বলে। ইহাতে ইংরাজী ভাষার নম্বর লেখা আছে। এক মাইল (বাঙ্গালা অর্দ্ধ ক্রোশ) অন্তর এক একটি এইরূপ পাথর পোতা আছে।” শ্যাখালা হইতে শালিকার ঘাট পর্য্যন্ত এইরূপ মাইল-ষ্টোনে ইংরাজী অঙ্ক দেখিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় ১ এক সংখ্যা হইতে ১০ পর্য্যন্ত চিনিলেন। কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ও ঠাকুরদাস মধ্যে জগদীশপুরে যে স্থানে মাইল-স্টোন ছিল, সেই স্থান দেখান নাই। ইহার কারণ বিদ্যাসাগর অক্ষর চিনিতে পারিয়াছেন কি না, জানিবার অভিপ্রায়ে উভয়ে যুক্তি করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর বলিলেন, “ইহার পূর্ব্বে তবে একটা পাথর আমরা দেখিতে বিস্মৃত হইয়াছি।” তখন কালীকান্ত বলিলেন, “ঈশ্বর, তুমি ইংরাজী সংখ্যা চিনিয়াছ কি না জানিবার জন্য আমরা ঐরূপ করিয়াছি। তুমি যে বলিতে পারিলে, তাহাতে আমরা পরম আহ্লাদিত হইলাম।” শ্যাখালা গ্রাম হইতে শালিকার গঙ্গার ঘাট ১০ক্রোশ। সন্ধ্যার সময় তথায় সকলে উপস্থিত হইলেন, এবং গঙ্গাপার হইয়া বড়বাজারে বাবু জগদ্দুর্লভ সিংহের বাটীতে আগমন করিলেন। পরদিন প্রাতে ঠাকুরদাস, জগদ্দুর্লভ বাবুর এক ইংরাজী বিল ঠিক দিতেছিলেন; তথায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলিলেন, “বাবা, আমি ইহা ঠিক দিতে পারি।” তাহা শুনিয়া উক্ত সিংহ বলিলেন-“ঈশ্বর, তুমি ইংরাজী অক্ষর কিরূপ করিয়া জানিলে?” তাহাতে তিনি বলিলেন, “কেন, বাবা ও কালীকান্ত খুড়া শ্যাখালা হইতে শালিকার ঘাট পর্য্যন্ত পাথরে অঙ্কিত মাইল-ষ্টোন আমাকে দেখাইয়াছিলেন। তাহাতেই ইংরাজী অঙ্কের ১ সংখ্যা হইতে ১০ সংখ্যা পর্য্যন্ত শিখিয়াছি। সেইজন্য ঠিক দিতে পারিব সাহস করিয়াছি।” উক্ত সিংহ কয়েকটা বিল ঠিক দিবার জন্য বিদ্যাসাগকে দিলেন। এই বিলে তাঁহার ঠিক দেওয়া নির্ভুল হইল দেখিয়া, কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরকে ক্রোড়ে করিয়া মুখচুম্বন পূর্ব্বক বলিলেন, “তুমি চিরজীবী হও। আমি যে আন্তরিক যত্নের সহিত পরিশ্রম করিয়া তোমাকে শিক্ষা দিয়াছিলাম, তাহা অদ্য আমার সার্থক হইল।” উপস্থিত সকলে বলিলেন, “বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, আপনার এই বুদ্ধিমান্‌ পুত্রটিকে ভালরূপ লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক।” তাহাতে ঠাকুরদাস বলিলেন, “ইহাকে হিন্দু কলেজে পড়িতে দিব মনে মনে স্থির করিয়াছি।” ইহা শুনিয়া উপস্থিত সকলে বলিলেন, “আপনি মাসিক দশটাকা বেতন পাইয়া থাকেন, তাহাতে হিন্দু কলেজে কেমন করিয়া পুত্রকে অধ্যয়ন করাইবেন?” এই কথা শুনিয়া, তিনি উত্তর করিলেন, “ছেলের কলেজের মাসিক বেতন ৫ টাকা দিব, আর বাটীর খরচ ৫ টাকা পাঠাইব।” ইহার কিছুদিন পরে, জগদ্দুর্লভ বাবুর বাটীর সন্নিহিত বাবু শিবচন্দ্র মল্লিকের বাটীতে যে পাঠশালা ছিল, তথায় রামলোচন সরকারের নিকট শিক্ষা করিবার জন্য তিনি বিদ্যাসাগরকে পাঠাইয়া দেন। বিদ্যাসাগর কার্ত্তিক অগ্রহায়ণ দুই মাস তাঁহার নিকট লেখাপড়া শিক্ষা করেন। তিনি প্রত্যহ ঠাকুরদাসকে বলিতেন, “বীরসিংহের কালীকান্ত খুড়ার পাঠশালে যেরূপ উপদেশ ও শিক্ষা পাইয়াছি, তদপেক্ষা ইঁহার নিকট অতিরিক্ত কিছুই শিক্ষা করিবার আশা নাই।” ইহার কয়েক দিন পরে, বিদ্যাসাগর উদরাময়ে আক্রান্ত হইয়া, সর্ব্বদা অসাবধান অবস্থায় শয্যায় মলমূত্র ত্যাগ করিতে লাগিলেন। অন্য কেহ অভিভাবক না থাকায়, ঠাকুরদাসকেই ঐ বিষ্ঠা স্বহস্তে পরিষ্কার করিতে হইত। এক একদিন এরূপ হইত যে, সিঁড়িতে মলত্যাগ করিলে, সমস্ত সিঁড়িতে তরল মল গড়াইয়া পড়িত। ঠাকুরদাস স্বহস্তে ঐ বিষ্ঠা পরিষ্কার করিতেন। এই সংবাদ বীরসিংহে প্রেরিত হইলে, ভগবতী দেবী কাঁদিয়া আকুল হইলেন, ভাবিয়া অস্থির হইয়া পড়িলেন এবং আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিলেন। কলিকাতায় আসিবার জন্য ব্যগ্রতা প্রকাশ করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহার স্বশ্রু দুর্গা দেবী পৌত্রের এই নিদারুণ পীড়ার সংবাদ শ্রবণ করিয়া অনতিবিলম্বেই কলিকাতায় উপস্থিত হইলেন এবং তথা হইতে পৌত্রকে দেশে লইয়া গেলেন।

 তৎকালে পল্লীগ্রাম হইতে যে সকল লোক প্রথমে কলিকাতায় আসিতেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই অজীর্ণ রোগে আক্রান্ত হইতেন। এ পীড়াকে সাধারণতঃ সকলে ‘লোনা লাগা’ কহিত।

 এখন পল্লীগ্রাম হইতে পীড়িত হইয়া লোকে সুস্থ হইবার জন্য কলিকাতা নগরীতে আগমন করে। তখন কলিকাতাতে দুই মাস অবস্থিতি করিলেই, লোকের শরীর ভগ্ন হইত এবং কলিকাতা হইতে বাহির হইলে, তৎপর দিনই শরীর একটু সুস্থ বোধ হইত। সে সময়ে কলিকাতার যে অবস্থা ছিল, তাহাতে এরুপ ঘটনা কিছুই বিচিত্র নহে। তখন জলের কল ছিল না। প্রত্যেক ভবনে এক একটি কূপ ও প্রত্যেক পল্লীতে দুই চারটি পুষ্করিণী ছিল। এই সকল পচা দুর্গন্ধময় জলপূর্ণ পুষ্করিণীগুলি জ্বরের উৎস স্বরপ ছিল। এতদ্ভিন্ন গবর্ণমেণ্ট স্থানে স্থানে কয়েকটি দীর্ঘিকা খনন করাইয়া দিয়াছিলেন, তাহাতে কাহাকেও স্নান করিতে দিতেন না। সেইগলি লোকের পানার্থ ব্যবহৃত হইত। তন্মধ্যে লালদিঘী সর্বপ্রধান ছিল। উড়িয়া ভারিগণ ঐ জল বহন করিয়া গৃহে গৃহে দিয়া আসিত। যখন জলের এই প্রকার দুরবস্থা, তখন অপর দিকে সহরের বহিরাকৃতিও অতীব ভীষণ ছিল। এখনকার ফুটপাথের পরিবর্তে প্রত্যেক রাজপথের পাশে জল নিগমের জন্য এক একটি বিস্তীর্ণ পয়ঃপ্রণালী ছিল। কোন কোনও পয়ঃপ্রণালীর পরিসর অট দশ হস্তেরও অধিক ছিল। প্রতি গৃহেই পথের পার্শ্বে এক একটি শৌচাগার ছিল। সেগুলি দিবারাত্রি অনাবৃত থাকিত। সেই জন্য নাসারন্ধ্র উত্তমরপে বস্ত্রাবৃত না করিয়া সেই সকল পথ দিয়া গমন করা দুরূহ ছিল। মাছি ও মশার উপদ্রব যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। সেই জন্যই বালক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলিয়াছিলেন,

“রেতে মশা দিনে মাছি,
দুই নিয়ে কলকেতায় আছি।”

 বীরীসংহে ৩।৪ মাস অবস্থিতি করিয়া বিদ্যাসাগর রোগমুক্ত হইলেন। পুনর্বার জ্যৈষ্ঠ মাসে ঠাকুরদাস দেশে আসিয়া বিদ্যাসাগরকে সমভিব্যাহারে লইয়া কলিকাতায় যাত্রা করিলেন। ঐ সময়ে বিদ্যাসাগরকে ঠাকুরদাস জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন ঈশ্বর! এবার বরাবর বাটী হইতে কলিকাতায় চলিয়া যাইতে পারিবে ত? যদি চলিতে না পার, তাহা হইলে একজন লোক সঙ্গে লইব। সে মধ্যে মধ্যে তোমাকে ক্রোড়ে করিবে।” ভগবতী দেবী ও দুর্গাদেবীও বারম্বার অনুরোধ করিতে লাগিলেন কিন্তু বিদ্যাসাগর উত্তর করিলেন যে, ‘এবার চলিয়া যাইতে পারিব; সঙ্গে লোক লইবার আবশ্যক নাই।” পরদিন ঠাকুরদাস পুত্রকে সঙ্গে লইয়া পাতুল গ্রামে রাধামোহন বিদ্যাভূষণের ভবনে অবস্থিতি করিলেন। তৎপর দিবস তথা হইতে তারকেশ্বরের সন্নিহিত রামনগরগ্রামে কনিষ্ঠা পিতৃসার বাটী যাত্রা করিলেন। রাজবলহাটের দোকানে উপস্থিত হইয়া ফলাহার করিলেন। তথা হইতে উঠিবার সময় বিদ্যাসাগর বলিলেন, ‘বাবা, আমি আর চলিতে পারিব না!” পিতা কতই বুঝাইলেন, তাহাতে বিদ্যাসাগর বলিলেন, ‘'দেখন পা ফলিয়া গিয়াছে, আর পা ফেলিতে পারিব না।” পিতা বলিলেন, “একট; চল, আগে যাইয়া তরমুজ কিনিয়া দিব।” এই বলিয়া ভুলাইতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু তিনি কিছুতেই এক পাও চলিলেন না। পিতা বলিলেন, “যদি চলিতে না পারিবে, তবে লোক সঙ্গে লইতে কেন বারণ করিলে?” এই বলিয়া প্রহার করিলেন। তাহাতে বিদ্যাসাগর রোদন করিতে লাগিলেন। তবে তুই এখানে থাক, আমি চলিলাম” এই বলিয়া পিতা কিয়দ্দুর গমন করিয়া দেখিলেন, পুত্র সেই স্থানে বসিয়া আছে, এক পাও চলে নাই। কি করেন, পিতা অগত্যা ফিরিয়া আসিয়া পুত্রকে কন্ধে লইয়া চলিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলেন, “এবার খানিক চল, আগের দোকানে তরমুজ কিনিয়া দিব।’ ঠাকুরদাস অতি খর্ব্বকায় ও ক্ষীণজীবি ছিলেন। সুতরাং তাঁহার পক্ষে অষ্টম বর্ষীয় বালককে কন্ধে করিয়া অধিক দর গমন করা সহজ ব্যাপার নহে। ঠাকুরদাস তাহাকে কখন স্কন্ধে, কখনও ক্রোড়ে করিয়া চলিলেন। অনন্তর তাঁহারা সন্ধ্যার সময় রামনগরের রামতারক মুখোপাধ্যায়ের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। বিদ্যাসাগরের পদদ্বয়ের বেদনা লাঘবের জন্য পিতৃস্বসা অন্নপূর্ণা দেবী উষ্ণ তৈল দ্বারা পদদ্বয় মর্দ্দন করিয়া দিলেন। পরদিন পিতাপুত্রে তথায় অবস্থিতি করিলেন। তৎপরদিন বৈদ্যবাটীর পথে আগমন করিলেন, এবং নৌকাযোগে সন্ধ্যার সময় কলকাতায় উপস্থিত হইলেন।

 হিন্দু কলেজ স্থাপিত হইলে, সহরে উচ্চ শিক্ষা দিবার পথ উন্মুক্ত হইয়াছিল। কিন্তু তৎপুর্ব্বে শিক্ষার অবস্থা অতিশয় শোচনীয় ছিল। অথচ মধ্যবিত্ত লোকদিকের অন্তঃকরণে সন্তানদিগকে ইংরাজী শিক্ষা দিবার প্রবৃত্তি দিন দিন প্রবল হইতে লাগিল। সুবিধা বুঝিয়া কয়েকজন ইংরাজ কলিকাতার স্থানে স্থানে ইংরাজী কুল স্থাপন করিলেন। এই সকল স্কুলে উত্তীর্ণ ছাত্রদিগের মধ্যে যাঁহারা প্রসিদ্ধ ছিলেন, তাঁহারা অসংলগ্ন ব্যাকরণহীন ইংরাজী বলিতে পারিতেন এবং লিখিতে পারিতেন বলিয়া তকালীন কলিকাতা সমাজে ইহাদের খ্যাতি প্রতিপত্তির সীমা ছিল না।

 সে সময়ে যে ইংরাজী শিক্ষা দেওয়া হইত, তাহার বিষয় কিছু উল্লেখ করা আবশ্যক। সে সময়ে বাক্যরচনাপ্রণালী বা ব্যাকরণ প্রভৃতি শিক্ষা দিবার দিকে আদৌ দৃষ্টি ছিল না। কেবল ইংরাজী শব্দ ও তাহার অর্থ শিখাইবার দিকে প্রধানতঃ মনোযোেগ দেওয়া হইত। যে যত অধিকসংখ্যক ইংরজী শব্দ ও তাহার অর্থ কণ্ঠস্থ করিত, ইংরাজী ভাষায় শিক্ষিত বলিয়া তাহার তত খ্যাতি প্রতিপত্তি হইত। এরূপ শুনা যায়, শ্রীরামপুরের মিশনারিগণ সে সময়ে এই বলিয়া তাহাদের আশ্রিত ব্যক্তিদিগকে প্রশংসাপত্র দিতেন যে, এ ব্যক্তি দুই শত বা তিন শত ইংরাজী শব্দ শিখিয়াছে। এই কারণে সে সময়ে কোন কোনও বালক ইংরাজী অভিধান মুখস্থ করিত। অনেক বিদ্যালয়ে দৈনিক পাঠ সমাপ্ত হইলে, স্কুল বন্ধ হইবার পূর্ব্বে নামতা পড়াইবার ন্যায় ইংরজী শব্দ পড়ান হইত। যথা—

ফিলজফার—বিজ্ঞলোক, প্লৌম্যান—চাষ।
পমকিন—লাউ কুমড়া, কুকুম্বার—শসা।

বাক্যহীন ও ব্যাকরণহীন ইংরাজী শব্দের দ্বারা তৎকালীন ইংরাজী শিক্ষিত ব্যক্তিগণ ইংরাজগণের সহিত কথাবার্ত্তা কহিতেন। ইংরাজগণও ভাবে আকারে ইঙ্গিতে তাঁহাদের কথাবার্তা বুঝিয়া লইতেন। এবং সেই সকল প্রসঙ্গ সায়াহ্নিক ভোজের সময়ে তাঁঁহাদের আমোদ প্রমোদের বিশেষ সহায়তা করিত।

  কিছুদিন পরে ঠাকুরদাস স্থির করিলেন যে, আমাদের বংশের পুবপুরুষগণ সকলেই সংকৃত অধ্যয়ন করিয়া বিদ্যাদান করিয়াছেন। কেবল আমাকে দুভার্গ্যপ্রযুক্ত বাল্যকাল হইতে সংসার প্রতিপালন জন্য আশু অর্থকরী ইংরাজী বিদ্যাশিক্ষা করিতে হইয়াছে। ঈশ্বর সংস্কৃত অধ্যয়ন করিলে, দেশে টোল করিয়া দিব। জগদ্দুর্লভ সিংহের বাটীতে অনেক পণ্ডিত বার্ষিক আদায় করিতে আসিতেন। তন্মধ্যে পটোলডাঙ্গাস্থ গবর্ণমেণ্ট সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের ৩য় শ্রেণীর পণ্ডিত গঙ্গাধর তকবাগীশ মহাশয়ের সহিত ঠাকুরদাসের আলাপ ছিল। তাঁহাকে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করায়, তিনি উপদেশ দিলেন যে, কলেজে প্রবিষ্ট করিয়া দিলে ৫।৬ মাস পরে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে, আপাততঃ মাসে মাসে ৫ টাকা বৃত্তি পাইবে। দেশের টোলে পড়িতে দিলে সংক্ষিপ্তসার অধ্যয়ন করিতে দীর্ঘকাল লাগিবে। কলেজে মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ অধ্যয়ন করিয়া ৩ বৎসরের মধ্যে ব্যাকরণে বুৎপত্তি জন্মিলে, কাব্যের শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইতে পারিবে। দ্বিতীয়তঃ তৎকালে পাতুলগ্রামনিবাসী রাধামোহন বিদ্যাভূষণের পিতৃব্যপত্র মধুসদন বাচস্পতি, সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করিতেন এবং বৃত্তি পাইতেন। ঠাকুরদাস উক্ত বাচস্পতিকে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলে তিনিও পরামর্শ দেন যে, “ঈশ্বরকে সংস্কৃত কলেজে ভত্তি করিয়া দাও।”

 জগদ্দুর্লভ সিংহের ভগিনী রাইমণি দাসী ও তাঁহার পরিবারগণ বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অতি শিশু দেখিয়া, অত্যন্ত ভাল বাসিতেন। ঠাকুরদাস চাকুরী উপলক্ষ্যে প্রাতঃকাল হইতে বেলা ৯টা পর্যন্ত কার্যসমাধা করিয়া বাসায় প্রত্যাবৃত্ত হইতেন। পরে পাকাদি কার্য্য সম্পন্ন করিয়া পিতাপুত্রে ভোজন করিতেন। কম্বল হইতে বাসায় আসিয়া রাত্রি দশটার সময় পুনর্বার পাকাদি কার্য্য সমাধা করিয়া, ভেজনান্তে উভয়ই নিদ্রা যাইতেন। প্রাতঃকাল হইতে অষ্টমবর্ষীয় বালক বিদ্যাসাগর প্রায় সমস্ত দিন এই দয়াময়ী মহিলার দয়ার উপর নির্ভর করিয়া বিদেশে অবস্থিতি করিতেন। তাঁহারা স্নেহপূর্ব্বক তাঁহাকে খাবার দিতেন ও কথাবার্ত্তায় ভুলাইয়া রাখিতেন। বিদ্যাসাগর যখন জননী প্রভৃতির জন্য ভাবনা করিতেন, তখন ঐ রমণীদ্বয় ভুলাইয়া ও কত প্রকার গল্প বলিয়া সান্ত্বনা করিতেন এবং দেশের জন্য বা জননীর জন্য ভাবিতে দিতেন না। উক্ত রাইমণি দাসী ও জগদ্দুর্লভ সিংহের পত্নীর দয়াদাক্ষিণ্য গুণেই শৈশবকালে বিদ্যাসাগর সবিশেষ উপকৃত হইয়াছিলেন। তাঁহারা এরূপ দয়াদাক্ষিণ্য প্রকাশ না করিলে, বিদ্যাসাগরের কলিকাতায় অবস্থিতি করা দুষ্কর হইত। কারণ তখন সহরের স্বাস্থ্যের অবস্থা যেরূপ শোচনীয় ছিল, নৈতিক অবস্থাও তদপেক্ষা দূষণীয় ছিল। এস্থলে আমরা তাহার কিঞ্চিৎ আভাষ দিতেছি। তখন নাচ, যাত্রা, কবি, হাফআখড়াই, পাঁচালী, বুলবুলের লড়াই প্রভৃতি বিবিধ কৌতুকপ্রদ আমোদ তদানীন্তন বঙ্গসমাজের আচার পদ্ধতির মধ্যে বিধিবদ্ধ ছিল। বুলবুলের লড়াই দেখা ও ঘুড়ী উড়ান সেই সময়ে সহরের ভদ্রলোকদিগের এক মহা আনন্দের বিষয় ছিল। এক একটা স্থানে লোহার জাল দিয়া বেষ্টন করিয়া বহুসংখ্যক বুলবুলি পক্ষী রাখা হইত এবং মধ্যে মধ্যে ইহাদের মধ্যে লড়াই বাধিয়া দিয়া কৌতুক দেখা হইত। সেই কৌতুক দেখিবার জন্য সহরের লোকের জনতা হইত। ঢাউস ঘুড়ী, মানুষ ঘুড়ী প্রভৃতি ঘুড়ীর প্রকার ও প্রণালী বহুবিধ ছিল। এবং সহরের ভদ্রগৃহের নিষ্কর্ম্মা ব্যক্তিগণ গড়ের মাঠে গিয়া ঘুড়ীর মেলা দেখিতেন।

 এতদ্ভিন্ন সেই সময়ে অন্যান্য কৌতুকময় প্রথাও প্রচলিত ছিল। কোন কোন স্থানে সন্দেশের মজ্‌লিস্‌ অর্থাৎ গোল্লা বিছাইয়া তাহার উপর বসিয়া বৈঠকী সঙ্গীত হইত। কোন কোন স্থানে মানুষ পক্ষীর সভা অর্থাৎ বৃহৎ বৃহৎ পিঞ্জর মধ্যে মনুষ্য পক্ষিস্বরূপ অবস্থিতি করিত। আমোদ ক্ষেত্রে সেই সকল পিঞ্জর আনীত হইলে, কেহ কাক, কেহ কাঁদাখোঁচা, কেহ সারস, কেহ বক, এইরূপ নানাবিধ পক্ষীর প্রকৃতি দেখাইত, এবং মধ্যে মধ্যে পক্ষীর অব্যক্তস্বরে গান করিত।

 জননীর স্নেহ ও ভালবাসা হইতে দূরে থাকিয়া এই সকল নীচ আমোদপ্রিয় পুরুষ দলবেষ্টিত সহরে আসিয়া বাস করিতে হইলে, সিংহ পরিবারের ন্যায় পরিবার মধ্যে আশ্রয় লাভ করা অতীব সৌভাগ্যের বিষয় মনে করিতে হইবে। সিংহ পরিবারের স্নেহ ও ভালবাসা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যে কি মহা ইষ্ট সাধন করিয়াছিল, তাহা বাক্যে বর্ণনা করিতে পারা যায় না। উত্তরকালে যাঁহারা বঙ্গদেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়াছিলেন, তাঁহাদের অনেকে নারীগণের এইরূপ অযাচিত স্নেহ পাইয়া মানুষকে ভালবাসিতে শিখিয়াছিলেন। এই সিংহ পরিবারের রাইমণি প্রবাসে বিদ্যাসাগরের মাতৃস্থান অধিকার করিয়াছিলেন। তাঁহার অনুপম স্নেহ ও যত্নের দ্বারা তিনি কি পরিমাণে বিদ্যাসাগরের হৃদয় পরিতৃপ্ত করিয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে তাঁহার আত্মজীবনচরিতে তিনি যাহা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাহা উদ্ধৃত করিয়া পাঠকবর্গকে উপহার দিলামঃ—

 তাঁহার একমাত্র পুত্র গোপালচন্দ্র ঘোষ আমার প্রায় সমবয়স্ক ছিলেন। পুত্রের উপর জননীর যেরূপ স্নেহ ও যত্ন থাকা উচিত ও আবশ্যক ছিল, তাহাতে সংশয় নাই। কিন্তু আমার আন্তরিক দৃঢ় বিশ্বাস এই, স্নেহ ও যত্ন বিষয়ে আমার ও গোপালে রাইমণির অণুমাত্র বিভিন্নতা ছিল না। ফল কথা এই, স্নেহ, দয়া, সৌজন্য, অমায়িকতা, সদ্বিবেচনা প্রভৃতি সদগুণ বিষয়ে রাইমণির সমকক্ষ স্ত্রীলোক এ পর্য্যন্ত আমার নয়নগোচর হয় নাই। এই দয়াশীলা সৌম্যমূর্ত্তি আমার হৃদয় মন্দিরে দেবীমূর্ত্তির ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হইয়া বিরাজমান রহিয়াছে। প্রসঙ্গক্রমে তাঁহার কথা উপস্থিত হইলে, তদীয় অপ্রতিম গুণের কীর্ত্তন করিতে করিতে অশ্রুপাত না করিয়া থাকিতে পারি না। আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া অনেকে নির্দ্দেশ করিয়া থাকে। আমার বোধ হয় সে নির্দ্দেশ অসঙ্গত নহে। যে ব্যক্তি রাইমণির সেই দয়া, সৌজন্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে, এবং ঐ সমস্ত গুণের ফলভোগী হইয়াছে, সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী না হয়, তাহা হইলে তাহার তুল্য কৃতঘ্ন পামর ভূমণ্ডলে নাই।” শুনা যায়, মহাত্মা ডিঙ্কওয়াটার বেথুনও বাল্যকালে নারীজাতির স্নেহ, মমতা লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া উত্তরকালে নারীজাতির বিশেষ পক্ষপাতী হইয়াছিলেন।

 বিদ্যাসাগর কলিকাতায় আগমন করিলে, প্রথমতঃ পুত্রবৎসলা জননী ভগবতী দেবী পুত্রের জন্য ব্যাকুল হৃদয়ে দিনযাপন করিতেন। এবং অবিরত অশ্রুবিসর্জ্জন করিয়া হৃদয়ের গুরুভার লাঘব করিতেন। পরিশেষে যেদিন শুনিলেন, রাইমণির দয়াদাক্ষিণ্যে প্রবাসে পরিপুষ্ট হইতেছেন, সেই দিন হইতে তিনি কথঞ্চিৎ ধৈর্য্যাবলম্বন করিতে পারিয়াছিলেন। সেইদিন হইতেই গৃহের অন্যান্য নিত্য নৈমিত্তিক ধর্ম্মানুষ্ঠানের ন্যায়, রাইমণির ও তাঁহার পুত্রের মঙ্গল কামনা তাঁহার নিত্য কার্য্যের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছিল।

 ইংরাজী ১৮২৯ সালের জুন মাসের প্রথম দিবসেই ঠাকুরদাস বিদ্যাসাগরকে কলিকাতাস্থ পটোলডাঙ্গা গবর্ণমেণ্ট সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের ৩য় শ্রেণীতে প্রবিষ্ট করাইয়া দিলেন। এই দিন বঙ্গসাহিত্যের ও বাঙ্গালা ইতিহাসের এক স্মরণীয় দিন। এই দিনের মাহাত্ম্য এক্ষণে আমরা সম্পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিতেছি। যে সুললিত দেবভাষা সংস্কৃতের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এ পর্য্যন্ত কেহই সাহসী হন নাই এবং যাঁহারা প্রতিযোগিতা করিবার উদ্যোগ করিয়াছিলেন, তাঁহারাও ব্যর্থমনোরথ হইয়াছেন, বাঙ্গালীর গৌরবের বিষয় বলিতে হইবে যে, আজ বঙ্গসাহিত্য এবং বঙ্গভাষা সেই সুললিত দেবভাষা সংস্কৃতের প্রতিদ্বন্দ্বিরূপে দণ্ডায়মান হইতে সাহসী হইয়াছে। বাঙ্গালীর সৌভাগ্য যে, বিদ্যাসাগর বঙ্গভাষার জননী সংস্কৃতভাষার সেবার নিমিত্ত সংস্কৃত কলেজে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন। তাঁহার ন্যায় বিরাট মহাপুরুষ ব্যতীত কে মাতৃভাষার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিতে পারিতেন? তিনি সযত্নে ও পরিশ্রমে যে মাতৃভাষাতরু রোপণ করিয়া গিয়াছিলেন, তাহাতে অক্ষয়কুমার, বঙ্কিমচন্দ্র, কালীপ্রসন্ন, মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র প্রভৃতি বঙ্গজননীর কৃতী সন্তানগণ যত্নসহকারে প্রতিভাবারি সিঞ্চন করিয়াছেন বলিয়াই আজ আমরা মাতৃভাষাতরুকে ফুলপুষ্পে সুশোভিত মহীরুহরূপে অনুধ্যান করিতে পারিতেছি।

 বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজে পরিগৃহীত হন, তখন তাঁহার বয়ঃক্রম নয় বৎসর মাত্র। ইহার পূর্ব্বে তাঁহার সংস্কৃত শিক্ষা আরম্ভ হয় নাই। আমার অপেক্ষা ক্লাসে আর কেহ উৎকৃষ্ট শিক্ষা করিতে না পারে, এরূপ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া বিদ্যাভ্যাস করিতে ঈশ্বরচন্দ্র চিরকাল আন্তরিক যত্ন পাইয়াছিলেন। এমন কি শৈশবকালে প্রায় সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া পাঠাভ্যাস করিতেন। প্রায়ই পিতাকে বলিতেন, ‘রাত্রি দশটার সময় আহার করিয়া শয়ন করিব, আপনি রাত্রি ১২টা বাজিলে আমায় তুলিয়া দিবেন, নচেৎ আমার পাঠাভ্যাস হইবে না।” পিতা আহারের পর দুই ঘণ্টা বসিয়া থাকিতেন। নিকটে আরমাণি গির্জার ঘণ্টারব শুনিয়া, তাঁহার নিদ্রা ভঙ্গ করিয়া দিতেন। পরে তিনি উঠিয়া সমস্ত রাত্রি অধ্যয়ন করিতেন। এইরূপ অত্যধিক পরিশ্রম করিয়া মধ্যে মধ্যে তিনি অত্যন্ত কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হইতেন। যেমন তিনি পাঠে অনুরক্ত ছিলেন, সেইরূপ শিক্ষকগণের প্রতি ভক্তিমান্‌ ও সমপাঠীদিগের সহিত প্রীতির বন্ধনেও আবদ্ধ ছিলেন। লোকে মনে করিয়া থাকে, লিখিয়া পড়িয়া কৃতী ও কার্য্যক্ষম হওয়ার নামই শিক্ষা। কিন্তু গুরু শিষ্যের ভক্তির সম্বন্ধ, বালকে বালকে সখ্যভাব যে শিক্ষার এক প্রধান অঙ্গ—তাহা অনেকে জানেন না। সেইজন্য বর্ত্তমান শিক্ষাপ্রণালীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ন্যায় মানুষ প্রস্তুত হওয়া একপ্রকার অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে।

 নয় বৎসর বয়সের সময় সংস্কৃত কলেজে প্রবিষ্ট হইয়া ২২ বৎসরের মধ্যে বিদ্যাসাগর কলেজের পাঠ্য সমস্ত বিদ্যায় পারদর্শী হইলেন। এই সময়ের মধ্যে তাঁহার অনুজ দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন ও শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং বিদ্যাসাগর ও দীনবন্ধু ন্যায়রত্নের শুভ বিবাহকার্য্য সুসম্পন্ন হইয়াছিল। সন্তানগণের পঠদ্দশায় ভগবতী দেবী চরকায় সুতা কাটিয়া পুত্রগণের জন্য বস্ত্র প্রস্তুত করিয়া কলিকাতায় পাঠাইয়া দিতেন। ভ্রাতৃগণ সেই মোটা বস্ত্র পরিধান করিয়া অধ্যয়নার্থ পটোলডাঙ্গায় কলেজে গমন করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আজীবন মোটা বস্ত্র পরিধান করিতে দেখা গিয়াছে। তিনি কখন সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করেন নাই।