বিষয়বস্তুতে চলুন

বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/মৃত্যু

উইকিসংকলন থেকে

বিংশ পরিচ্ছেদ॥ মৃত্যু

 কবি মৃত্যুকে ‘শয়ন-সুন্দর’ বলিয়াছেন। ফলতঃ দুর্জ্জয় জীবনসংগ্রামে শ্রান্তমানব যখন অশ্রুপূর্ণ নয়নে, বেদনা-বিবশ হৃদয়ে ক্ষণিক বিশ্রামলাভের আকাঙক্ষা করে, তখন মত্যুই তাহার নিকট মধুর বলিয়া প্রতীয়মান হয়! কিন্তু সে তখন উপলব্ধি করিতে পারে না যে, ইহা বিশ্রাম নহে!—চিরনিদ্রা! আর যখন জীব মায়ামুক্ত হয়, তখন এই অনিত্য দেহ-পিঞ্জর আর তৃপ্তিসাধন করিতে পারে না!—সে তখন মুক্তপক্ষ বিহঙ্গমের ন্যায় ঊর্দ্ধে বিমানে উঠিতে চাহে! তখন সেই মায়ামুক্ত জীব তারস্বরে বলে,

ওহে মৃত্যু! তুমি মোরে কি দেখাও ভয়?
ও ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়।
সংসারের প্রেমে মন মত নয় যার
ভ্রূভঙ্গে তোমার বল কিবা ভয় তার?
যে অম্লান কুসুমের মধুপান তরে,

লোলুপ নিয়ত মম মন মধুকরে
যে নিত্য উদ্যানে সেই পুষ্প বিরাজিত,
হে মত্যু! তাহার তুমি শরণি নিশ্চিত।”

 মৃত্যু তাহার নিকট বিশ্বের পরপারে যাইবার সেতু!

 মত্যু-এ নাম শ্রবণ করিলে, সহসা হদৃয়ে ভীষণ আতঙ্কেরই উদ্রেক হয়? কিন্তু মত্যু যতই আমাদের অপ্রিয় হউক না কেন, ইহারই জন্য আমরা জীবনে সুখের আস্বাদ প্রাপ্ত হই। অদূরে প্রচণ্ড মার্তগুতাপ রহিয়াছে বলিয়াই স্নিগ্ধ বৃক্ষচ্ছায়া বা সুকোমল তৃণশয্যা আমাদিগের নিকট সুখোদায়ক। অন্ধতমসাচ্ছন্ন রজনীতে গৃহমধ্যে নির্বাণোন্মুখ কম্পমান সামান্য দীপশিখাও আমাদিগের নিকট স্নিগ্ধ বোধ হয়। মত্যু আছে বলিয়াই যশোগৌরবে বিমণ্ডিত হইবার আমাদিগের এতদূর আকাক্ষা! বিজয়মাল্যে বিভূষিত হইবার এরপ ঐকান্তিক ইচ্ছা! মত্যু আছে বলিয়াই অমরত্ব লাভের জন্য আমাদিগের এরপ প্রয়াস। বিসর্জ্জন আছে বলিয়াই আবাহনের প্রভাতী সঙ্গীত এরপ শ্রুতিসুখকর। মৃত্যুর সহিত জড়িত বলিয়াই আমাদিগের নিকট জীবন এত প্রিয়! জীবিত থাকিবার জন্য আমাদিগের এত প্রয়াস!—এত বাঞ্ছা! এত আয়োজন।

 ১২৭৭ সালের ফাল্গুন মাসের প্রথম দিবস কাশীধাম হইতে সংবাদ আসিল ঠাকুরদাসের জীবন সংকটাপন্ন। সংবাদপ্রাপ্তিমাত্রই বিদ্যাসাগর সর্ব্বকর্ম পরিত্যাগ করিয়া পিতৃপদসেবার নিমিত্ত কাশীযাত্রা করিলেন। এদিকে দীনবন্ধু ও শম্ভুচন্দ্র ভগবতী দেবীকে সমভিব্যাহারে লইয়া কাশীধামে গমন করিলেন। রীতিমত সেবা শুশ্রূষা ও ঔষধাদির সুব্যবস্থায় ঠাকুরদাস শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করিলেন। ১৫ই ফাল্গুন বিদ্যাসাগর, জননী ও সহোদরদিগকে পিতৃপরিচর্য্যার নিমিত্ত নিযুক্ত রাখিয়া কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলেন। ভগবতী দেবী ফাল্গুন, চৈত্র দুই মাস কাশীবাস করেন।

 ক্রমে চৈত্রসংক্রান্তি সমাগত হইল। কাশীধামে সে দিন মহোৎসব। বিশ্বের ও অন্নপূর্ণার মন্দির জনতায় পরিপূর্ণ। বিবিধ বাদ্যধ্বনিতে চতুর্দ্দিক মুখরিত! পুতহোমগন্ধে দশদিক আমোদিত। ‘হর’, ‘হর’, ‘বম্’, ‘বম্’ শব্দে চতুর্দ্দিক বিকল্পিত। কাশীধামে সে দিন উৎসবের আনন্দস্রোত প্রবাহিত হইয়াছে। ভগবতী দেবী প্রাতঃকালে শয্যাত্যাগ করিয়া স্নান ও সন্ধ্যাবন্দনাদি সুসম্পন্ন করিলেন। তৎপরে দেবমন্দিরদি দর্শনাভিলাষে গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন। ভক্তিসহকারে দেবদর্শন, মন্দিরাদি প্রদক্ষিণ ও দানাদি কার্য্য সুম্পন্ন করিয়া গৃহে প্রত্যাগত হইলেন। পরে স্বহস্তে রন্ধনাদি সমাপন করিয়া সকলকে ভোজন করাইলেন।

 ক্রমে সন্ধ্যা সমাগত হইল। ভগবতী পুনরায় সন্ধ্যাকালীন আরত্রিক দর্শন মানসে বহির্গত হইলেন। দেবদর্শন ও প্রণামাদি করিয়া গৃহে পুনরায় প্রত্যাগত হইলেন। পরিশেষে রন্ধনাদি কার্য্য সমাপনান্তর সকলের পরিচর্য্যা করিয়া স্বয়ং ভোজন করিলেন। ভেজনান্তেই শয়ন করা তাহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। কিয়ৎক্ষণ বসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন এবং সকলের সহিত বিবিধ কথোপকথন করিতেছেন এমন সময়ে বিষম বিসূচিকা রোগে তিনি আক্রান্ত হইলেন। দীনবন্ধু দ্রুতপদে চিকিৎসকের নিকট গমন করিলেন। তিনি মুহূর্ত্ত মধ্যে চিকিৎসককে সঙ্গে লইয়া গৃহে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। সকলেই প্রাণপণে শুশ্রষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু রোগ ক্রমেই ভীষণ মূর্ত্তি ধারণ করিতে লাগিল। ক্রমে আরও দুই একজন চিকিৎসক আসিলেন। নিশাশেষে চিকিৎসকের পরামর্শ করিয়া বলিলেন, “জীবনের আর কোন আশা নাই।”

 ক্রমে রজনী প্রভাতা হইল। পুনরায় কাশীধামের চতুর্দ্দিক বিবিধ বাদ্যধ্বনিতে মুখরিত ও স্পন্দিত হইতে লাগিল। পুনরায় হোমগন্ধে চতুর্দ্দিক আমোদিত হইয়া উঠিল। পুনরায় ‘হর', ‘হর’, ‘বম্’, ‘বম্’ ধ্বনিতে চতুর্দ্দিক বিকম্পিত হইল।—এ সমস্ত কি কাশীধামের বিশ্বেশ্বর ও মহামায়ার পূজার আয়োজন? না-সাধ্বী সতী ভগবতীর স্বর্গারোহণের আবাহন। সাধু পাঠকগণ! সাধ্বী পাঠিকাগণ! হদয় থাকে ত একবার উপলদ্ধি করুন—উপলব্ধি করিয়া নীরবে অশ্রুবিসর্জ্জন করুন। কারণ, সংসারে স্বর্গ, নরক বলিয়া কিছুই জানি না—এই মৃত্যুতেই স্বর্গ নরকের পরিচয়! পাপী, তাপী বলিয়া কিছুই জানি না, এই মত্যুতেই তাহার পরিচয়। সরল, কপটাচারী বলিয়া কিছুই জানি না, এই মত্যুতেই সে সকলের পরিচয়। সেইজন্য মৃত্যুই সাধুদিগের উপাস্য! তাঁহার প্রেমভরে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিয়া থাকেন! এই মত্যুই বিশুদ্ধ পবিত্র বহ্নি! -ইহাই মানবাত্মাকে বিশ্বের পরপারে লইয়া যাইবার সময় পরিশুদ্ধ করে!

 ক্রমে মৃত্যু সন্নিকট দেখিয়া সকলে ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। ভগবতী সকলকে ক্ষীণস্বরে সুমিষ্টবাক্যে সান্তনা করিয়া, পরিশেষে পতির পদধুলি চাহিলেন। শান্ত, দান্ত, ধৈর্য্যশীল ঠাকুরদাস এতক্ষণ পর্যন্ত স্থিরভাবে ছিলেন। কিন্তু এইবার তাঁহার ধৈর্য্যচুতি হইল। আর তিনি শোকাবেগ সংবরণ করিতে পারিলেন না। গণ্ডস্থল বহিয়া প্রবল বেগে অশ্রুধারা নিপতিত হইতে লাগিল। ক্রন্দন করিতে করিতে ঠাকুরদাস গদগদস্বরে বলিতে লাগিলেন, “তুমি সাধ্বী সতী! তোমাকে আমি আর কি আশীর্ব্বাদ করিব! তুমি নিজ পুণ্যবলে অগ্রেই গমন করিলে। তোমারই জয় হইল! তুমি যে সদা সর্ব্বদা বলিতে,‘জপ তপ কর, কিন্তু মরতে জান‍্লে হয়।—কিরূপ করিয়া মরিতে হয়, যথার্থই তাহা তুমিই জানিয়াছিলে। তোমার অক্ষয় স্বর্গলাভ হউক।”

 ক্রমে ভগবতী দেবীর সংজ্ঞালোপ হইল। পুত্রপ্রদত্ত জলবিন্দু; ওষ্ঠপ্রান্তে গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। নাভিদেশ ঘন ঘন স্পন্দিত হইতে লাগিল। সাধ্বী সতী যোগনিদ্রায় অভিভূত হইলেন!—মুখমণ্ডলে অপূর্ব্ব শান্তি! অপূর্ব্ব মাধুরী!—জীবাত্মা দেহ—পিঞ্জর হইতে ধীরে ধীরে পরমাত্মায় লীন হইতেছে!—এ মহাসঙ্গম! এ গম্ভীর দৃশ্য দেখিয়া ভাবে বিহ্বল হইয়া যাইতে হয়! যেন স্বতই মনে হয়, মা আনন্দময়ি!—এ কি তোমার বিচিত্র লীলা! শুনিয়াছি সাধ্বী সতী পতিব্রতা রমণীর হৃদয়ে তুমি আনন্দময়ীরপে সতত বিরাজ কর। মা! মরণেও তুমি আনন্দময়ীরূপে স্বপ্রকাশ! একি তোমার আনন্দের লীলা খেলা! —মা! তোমার তত্ত্ব কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।