বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/লোকানুরাগ ও সেবাধর্ম্ম

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পরিচ্ছেদ॥ লোকানুরাগ ও সেবাধর্ম্ম

 সন ১২৭২ সালে ঐ প্রদেশে অনাবৃষ্টি প্রযুক্ত কিছুমাত্র ধান্যাদি শস্য উৎপন্ন হয় নাই। সুতরাং সাধারণ লোকের দিনপাত হওয়া দুষ্কর হয়। ঐ সালের পৌষ মাসে কোন কোন কৃষক যৎসামান্য ধান্য পাইয়াছিল, তাহাও প্রায় মহাজনগণ আদায় করেন। কৃষকদের বাটীতে কিছুমাত্র ধান্য ছিল না। দুঃসময় দেখিয়া ভদ্রলোকেরা ইতর লোকদিগকে কোনও কাজ কর্ম্মে নিযুক্ত করেন নাই। সুতরাং যাহারা নিত্য মজুরি করিয়া দিনপাত করিত, তাহাদের দিনপাত হওয়া সুকঠিন এই সময়ে টাকায় পাঁচ সের চাউল বিক্রয় হইত, তাহাও সকল সময়ে দুষ্প্রাপ্য। মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র এই তিন মাস অনেকেই ঘটী বাটি ও অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া কথঞ্চিৎ প্রাণধারণ করে। পরে চাউল ক্রয়ে অপারক হইয়া, কেহ কেহ বুনো ওল ও কচু খাইয়া দিনপাত করে এবং নানাপ্রকার কষ্টভোগ করিয়া অনাহারে অকালে কালগ্রাসে নিপতিত হয়। শত শত ব্যক্তি সমস্ত দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া উদরের জ্বালায় কলিকাতায় প্রস্থান করিয়াছিল ও তথায় পথে পথে ভিক্ষা করিয়া উদরপূর্ত্তি করিত। ৭৩ সালের বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে জাহানাবাদ মহকুমায় প্রায় অশীতি সহস্র লোক অন্নাভাব প্রযুক্ত কলিকাতায় যাইয়া তথাকার অন্নসত্রে ভোজন করিত। তংকালে কেহ জাতিবিচার করে নাই। জননী সন্তানকে পথে ফেলিয়া দিয়া কলিকাতায় প্রস্থান করেন। অনেক কুলকামিনী জাত্যাভিমানে জলাঞ্জলি দিয়া জাত্যন্তরিতা হয়। চতুর্দ্দিকেই হাহাকার শব্দ, কেহ কাহারও প্রতি দয়া প্রকাশ করে নাই, সকলেই অন্নচিন্তায় ব্যাকুল হইয়াছিল।

 বীরসিংহবাসী অধিকাংশ লোক প্রাতঃকাল হইতে রাত্রি ১০টা পর্য্যন্ত বিদ্যাসাগরের দ্বারে দণ্ডায়মান থাকিত। তাহাদিগকে ভোজন না করাইয়া কেহ ভোজন করিতে পারিতেন না। কোন কোনও দিন রাত্রিতেও সন্নিহিত গ্রামের ভদ্রলোকগণ উদরের জ্বালায় দ্বারে দ্বারে উপস্থিত হইয়া চীৎকার করিতেন, তাঁহাদিগকে ভোজন না করাইলে সমস্ত রাত্রই চীৎকার করিতেন। এইরূপ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে প্রায় শতাধিক নিরন্ন ব্যক্তি ক্ষুধার জ্বালায় দিবারাত্রি চীৎকার করিয়া বেড়াইত।

 ক্রমে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাটীর চতুর্দ্দিকে বিদেশী ও স্বদেশস্থ অসংখ্য দীন দুঃখী সমবেত হইতে লাগিল। করুণাময়ী, দীনজননী সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা ভগবতী দেবী কি আর স্থির থাকতে পারেন? নিরন্ন দীনহীন সন্তানগণের মর্ম্মভেদী চীৎকারধ্বনিতে দীন জননীর কোমল হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া গেল। সাক্ষাৎ অন্নপুর্ণা ভগবতী দেবী অন্নহীনজনের অন্নদানার্থ অন্নসত্রের প্রতিষ্ঠা করিলেন। প্রথমতঃ তিনি স্বয়ং রন্ধন করিয়া অন্নসত্রের দুর্ভিক্ষপীড়িত লোকদিগকে ভোজন করাইতেন। তাহাদিগের ভোজনের সময় তিনি তথায় উপস্থিত থাকিতেন। তাহারা যেরূপ আগ্রহ ও আনন্দের সহিত ভোজন করিত, সে দৃশ্য যেন তাঁহার হৃদয়ের অন্তস্থল স্পর্শ করিত। হৃদয়ের প্রবল আবেগ তিনি আর সম্বরণ করিতে পারিতেন না। তাঁহার গণ্ডস্থল বহিয়া প্রবল বেগে অশ্রুধারা নিপতিত হইত। এ দৃশ্য কি মধুর। কি হৃদয়স্পর্শী! ভগবতী দেবী একদিন ঠাকুরদাসকে যে বলিয়াছিলেন, “সেই আমার কাশী, সেইখানেই আমার বিশ্বেশ্বর।” পাঠকগণ, চক্ষু থাকে নিরীক্ষণ করুন, হৃদয় থাকে অনুভব করুন, ক্ষুদ্র বীরসিংহ পল্লী সত্য সত্যই আজ কাশীধামে পরিণত হইয়াছে কি না? কাশীধামের অন্নদাত্রী অন্নপূর্ণা দেবীর মূর্ত্তিমতী প্রতিকৃতি আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত কি না! শুদ্ধ অন্নদান করিয়াই মাতা আজ ক্ষান্ত নহেন। পাঠকগণ, ঐ দেখন সন্তানগণের রুক্ষ্ম কেশপাশ দেখিয়া মাতা কিরূপ মর্ম্মপীড়িত হইয়াছেন! দরিদ্রগণের ভোজনান্তে ভগবতী তিন কন্যা সমভিব্যাহারে তাহাদিগের মধ্যে সমুপস্থিত হইয়াছেন। মাতার স্নেহের উৎস আজ উদ্বেলিত—উচ্ছলিত। প্রেমের প্রবল বন্যা অপ্রতিহত গতিতে প্রবাহিত। সেই প্রবল প্রবাহে আজ হাড়ি, ডোম, তিওর, বাগ্দী জাতিবিচার ভাসিয়া গিয়াছে। ঐ দেখুন, কন্যাগণ নারিকেল তৈল ও বাটা হলুদ স্ত্রীলোকদিগকে মাখাইয়া দিতেছেন, আর ভগবতী দেবী এয়েদিগের ললাটে স্বয়ং সিন্দুর বিন্দু পরাইয়া দিতেছেন! ধন্য পুণ্যের লীলাক্ষেত্র ভারতভূমি! এ দৃশ্য তোমাতেই সম্ভবে।

 হিন্দু পেট্‌রিয়টের সংবাদদাতা ১২৭৩ সালের ১৫ই শ্রাবণ এই হৃদয়স্পর্শী সেবাব্রত সম্বন্ধে লিখিয়াছিলেন “বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মাতা প্রত্যহ ৪৫ শত লোককে অকাতরে, অকুণ্ঠিতচিত্তে অন্নদান করিতেছেন।”

 ক্রমে দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তখন এই সংবাদ কলকাতায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট প্রেরিত হইল। তিনি উত্তরে লিখিলেন যে, “স্বগ্রাম বীরসিংহ ও উহার সন্নিহিত ৫৬টি গ্রামের দরিদ্রগণকে প্রত্যহ ভোজন করাইতে পারিব। অন্যান্য গ্রামের লোককে কেমন করিয়া খাওয়াইতে পারি? যেহেতু আমি ধনশালী লোক নহি। অপরাপর গ্রামের দরিদ্রদিগকে প্রত্যহ ভোজন করাইতে হইলে অনেক অর্থ প্রয়োজন। এমন স্থলে জাহানাবাদের ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট বাবু ঈশ্বরচন্দ্র মিত্রকে আমার নাম করিয়া বলিবে যে, তিনি জাহানাবাদ মহকুমার দুর্ভিক্ষের কথা গবর্ণমেণ্টের নিকট রিপোর্ট করিলে আমি এখানে লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর সিসিল বীডনকে বলিয়া সাহায্য করাইতে পারিব।”

 বিদ্যাসাগর, নিজ জন্মভূমি বীরসিংহ ও তৎসংলগ্ন পাথরা, কেঁচে, অর্জ্জুনআড়ী, বুয়ালিয়া, রাধানগর, উদয়গঞ্জ, কুরাণ, মামুদপুর প্রভৃতি কয়েকখানি গ্রামবাসী নিরুপায় লোকদিগের প্রতি দয়া করিয়া, বীরসিংহে অন্নসত্র স্থাপন করেন। প্রথমতঃ গ্রামস্থ লোকদিগের ভোজন করিবার এই ব্যবস্থা হয় যে, যে ভদ্রলোক অন্নসত্রে ভোজন করিতে কুণ্ঠিত হইবেন, তাঁহারা লোকসংখ্যা হিসাবে আহার্য্য পাইবেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং এরূপ আহার্য্যের ব্যবস্থা করিয়া দিয়া কলিকাতা আগমন করেন। শ্রাবণ মাসে স্বতন্ত্র বাটীতে অন্নসত্র স্থাপিত হয়। ভাদ্র মাস হইতে রাধানগর, কেঁচে, অর্জ্জুনআড়ী প্রভৃতি চতুর্দ্দিকের লোক আসিয়া ভোজন করায়, ক্রমশঃ লোকসংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল, এই সমাচার কলিকাতায় বিদ্যাসাগরকে লিখিলে, তিনি তদুত্তরে লিখিলেন, ‘‘অভূক্ত যত লোক আসিবে, সকলকেই সমাদর পুর্ব্বক ভোজন করাইবে, কেহ যেন অভুক্ত ফিরিয়া না যায়। শীঘ্র টাকা পাঠাইতেছি এবং আমিও সত্বর বাটী যাইতেছি।” যে কয়েক মাসদেশে অন্নসত্র ছিল, সেই সময়ে তিনি মাসে প্রায় একবার করিয়া বাটীতে আগমন করিতেন।

 অনেক নিরুপায় দরিদ্র লোক, ছোট ছোট বালক বালিকাগকে ঐ অন্নসত্রে ফেলিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করে। এই বালক বালিকাগণের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কয়েকজন লোক নিযুক্ত করা হয়। অন্নসত্রে গর্ভবতী কয়েকটি স্ত্রীলোক প্রত্যহ ভোজন করিত। প্রসবের পর তাহাদিগের নবপ্রসূত সন্তানগণের দুধ ও প্রসূতির পথ্যের ব্যবস্থা হয়। কিছুদিন পর ঐ প্রসূতিদের মধ্যে একটি মৃত্যুমুখে নিপতিত হইলে, উহার সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোক নিযুক্ত হয়। ঐ সন্তানের ১৭ বৎসর বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত সমস্ত ব্যয় নির্ব্বাহ করা হইয়াছিল। অন্নসত্র খুলিবার প্রথমাবস্থায় দেখা গিয়াছে যে, কেহ কেহ স্বীয় প্রাণসম সন্তানগণের হস্তধারণপূর্ব্বক স্বয়ং সমস্ত খাইয়া ফেলিত। তৎকালে কেহ কাহারও প্রতি স্নেহ মমতা করিত না। সকলেই সতত স্ব স্ব উদরের জ্বালায় বিব্রত ছিল। কিছুদিন পরে ঐ ভাব তিরোহিত হইয়া যায়। অন্নসত্রে ভেজনকারিণী স্ত্রীলোকদের মস্তকের কেশগুলি তৈলাভাবে বিরূপ দেখাইত। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহা দেখিয়া, দুঃখিত হইয়া তৈলের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। প্রত্যেককে দুই পলা করিয়া তৈল দেওয়া হইইত। যাহারা তৈল বিতরণ করিত, তাহারা পাছে মুচি, হাড়ী, ডোম প্রভৃতি অপকৃষ্ট জাতীয় স্ত্রীলোককে স্পর্শ করে এই আশঙ্কায় দুর হইতে তৈল দিত। ইহা দেখিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং উক্ত অপকৃষ্ট জাতীয় স্ত্রীলোকদিগের মস্তকে তৈল মাখাইয়া দিতেন। নীচ বংশোদ্ভবা স্ত্রীজাতির প্রতি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এরূপ দয়া দেখিয়া, তাহারা পরম আহ্লাদিত হইয়াছিল এবং কর্ম্মচারিগণ তাঁহার এরূপ দয়া অবলোকনে, তদবধি উহাদিগকে স্পর্শ করিতে ঘৃণা করিত না। পরিবেশনের সময় বিদ্যাসাগর স্বয়ং পরিবেশন কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেন দেখিয়া, উপস্থিত ভদ্রলোকেরাও যোগ দিতেন।

 অন্নসত্রে যাহারা ভোজন করিত, তাহারা বিদ্যাসাগরের নিকট প্রকাশ করিয়া বলে, “মহাশয়! প্রত্যহ খেচরান্ন খাইতে অরুচি হয়, সপ্তাহের মধ্যে একদিন অন্ন ও মৎস্য হইলে আমাদের পক্ষে ভাল হয়। একারণ প্রতি সপ্তাহে একদিন অন্ন, পোনা মৎস্যের ঝোল ও দধি হইত। ইহাতে ব্যয় বাহুল্য হওয়ায় বিদ্যাসাগর অকাতরে যথেষ্ট টাকা বৃদ্ধি করিয়াছিলেন। পুর্ব্বে দেশস্থ লোক মনে করিত যে, বিদ্যাসাগর বিদ্যোৎসাহী, একারণ দরিদ্র বালকদের জন্য অবৈতনিক বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয় ও রাখাল-স্কুল স্থাপন করিয়াছেন। কিন্তু তিনি দরিদ্রগণের প্রতি এতদূর দয়াল ছিলেন, তাহা কেহই জানিত না। এই অবধি সকলে তাঁহাকে বলিত যে, ইনি দয়াময় অথবা দয়ার সাগর। নীচজাতীয় স্ত্রীলোকদের মাথায় স্বয়ং তৈল মাখাইয়া দেন, ইনি ত মানুষে নন—সাক্ষাৎ ঈশ্বর। তৎকালে ঐ প্রদেশে সকলেই এই কথার আন্দোলন করিতে লাগিল।

 গবর্ণমেণ্ট অন্নসত্রে দরিদ্রদিগকে কর্ম্ম করাইয়া খাইতে দিতেন; এজন্য কতকগুলি লোক কর্ম্ম করিবার ভয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অন্নসত্রে ভোজন করিতে আসিত। তজ্জন্য ক্রমশঃ লোকসংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। এখানে পীড়িতদিগের চিকিৎসা হইত, এবং রোগীদিগের পথ্যের স্বতন্ত্র ব্যবস্থা ছিল। গ্রামস্থ ভদ্রলোকের মধ্যে যাহাদের অবস্থা অতি মন্দ, তাহাদিগকে প্রত্যহ প্রাতে বেলা ৯ ঘটিকা পর্যন্ত আহার্য্য দেওয়া হইত। এতদ্ব্যতীত প্রায় ২০টি পরিবার প্রত্যহ আহার্য্য লইতে লজ্জিত হইতেন; তন্নিমিত্ত তাঁহাদিগকে গোপনে নগদ টাকা দেওয়া হইত। খাতায় নাম লেখা ব্যতীত আরও ২৫|২৬টি গৃহস্থ রাত্রিতে গোপনে চাউল, ডাইল ও লবণ লইয়া যাইতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, খাতায় ইঁহাদের নাম লিখিতে বারণ করিয়া দেন। যে যে ভদ্রপরিবারের বস্ত্র ছিল না, তাহারা প্রকাশ্যে বস্ত্র লইতে লজ্জিত হইবেন, একারণ প্রায় দুই সহস্র টাকার বস্ত্র গোপনে বিতরিত হয়। সন্ধ্যার পর বিদ্যাসাগর স্বয়ং বস্ত্র লইয়া মোটা চাদর গাত্রে দিয়া বস্ত্র বিতরণ করিবার জন্য অনেক ভদ্রলোকের বাটীতে গমন করিতেন এবং বলিতেন, “ইহা কাহারও নিকট বলিবার আবশ্যক নাই।” তিনি ভদ্রলোকদিগকে অতি গোপনে দান করিতেন।