বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র/চব্বিশ

উইকিসংকলন থেকে

চব্বিশ

 ত্রিপুরীতে সুভাষচন্দ্র বৃটিশ সরকারকে ছয়মাসের চরম পত্র দিবার প্রস্তাব করিলেন; কিন্তু, কংগ্রেসী বড় কর্ত্তাদের নিকট হইতে তাহার যে উত্তর আসিল তাহা আদৌ রাজনৈতিক সমস্যাসম্পর্কিত নহে—তাহা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খর্ব্ব করিয়া দিয়া তাঁহাকে দক্ষিণপক্ষের কুক্ষিগত করিবার কূট ষড়যন্ত্রমূলক। যুক্তপ্রদেশের প্রধান মন্ত্রী পণ্ডিত গোবিন্দ বল্লভ পন্থ এই অপকার্য্যের প্রধান সহায়ক হইয়া গণতন্ত্রের হত্যায় দক্ষিণপন্থীদের হাতিয়ারম্বরূপ ব্যবহৃত হইলেন। ত্রিপুরীতে অনুষ্ঠিত দক্ষযজ্ঞের হোতা পন্থজী যে প্রস্তাব উত্থাপন করিলেন কংগ্রেসের ইতিহাসে তা পন্থ-প্রস্তাব নামে কুখ্যাত হইয়া থাকিবে। পন্থ-প্রস্তাব কংগ্রেসের ইতিহাসের শুভ্র ললাটে কলঙ্কতিলক আঁকিয়া দিয়াছে। ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি নির্ব্বাচনের সূত্রপাত হইতে আরম্ভ করিয়া কলিকাতা ও ওয়েলিংটন স্কোয়ারে নিখিলভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির অধিবেশনে রাষ্টপতির পদত্যাগ পর্য্যন্ত কংগ্রেস ইতিহাসের এই কয়টি পাতায় একখানি পূর্ণাঙ্গ বিয়োগান্ত নাটক রচিত হইয়াছে। পন্থ-প্রস্তাবের দ্বারা রাষ্ট্রপতিকে গান্ধীজীর কর্ত্তৃত্বাধীন করা হইল এবং রাষ্ট্রপতির প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করা হইল। পন্থ-প্রস্তাবটি এই—“গত কয়েক বৎসর যাবৎ মহাত্মাগান্ধী নিরূপিত যে সব মূলনীতি অনুযায়ী কংগ্রেসের কর্মপন্থা পরিচালিত হইয়াছে এই কমিটি সেই সব মূলনীতির প্রতি অবিচল আনুগত্য বোষণা করিতেছে এবং সুস্পষ্টভাবে এই অভিমত জ্ঞাপন করিতেছে যে, ঐ সব মূলনীতির কোন পরিবর্ত্তন হইতে পারিবে না এবং ভবিষ্যতেও ঐ সব মূলনীতিই কংগ্রেসের কর্মপন্থা নিয়ন্ত্রণ করিতে থাকিবে। এই কমিটি গতবৎসরের ওয়ার্কিংকমিটির কার্য্যে পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করিতেছে এবং ঐ কমিটির কোন কোন সদস্যের বিরুদ্ধে নিন্দাপ্রচার হইয়াছে বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিতেছে। আগামী বৎসরে বিশেষ সঙ্কটজনক পরিস্থিতির উদ্ভবের সম্ভাবনা এবং যেহেতু ঐ সঙ্কটক্ষণে একমাত্র মহাত্মা গান্ধীই কংগ্রেস ও দেশকে বিজয়ের পথে পরিচালিত করিতে সক্ষম, সেই হেতু এই কমিটি মনে করে যে কংগ্রেসের কার্য্যনির্বাহক কর্ত্তৃপক্ষের প্রতি মহাত্মাগান্ধীর পূর্ণ আস্থা থাকা একান্ত প্রয়োজন। অতএব, রাষ্ট্রপতির নিকট এই কমিটির অনুরোধ, তিনি যেন গান্ধীজীর ইচ্ছা অনুযায়ী আগামী বৎসরের ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেন।”

 পন্থজীর প্রস্তাবে বলা হইয়াছে, অতীতে কংগ্রেসে গান্ধীজীর পরিচালনাধীনে একটি নির্দ্দিষ্ট কর্মপন্থা অনুসৃত হইয়াছে। কিন্তু, ইহা সম্পূর্ণ সত্য নহে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও পণ্ডিত মতিলালের নেতৃত্বে কংগ্রেসে স্বরাজ্যদল নামে একটি বিশিষ্ট দল গঠিত হয়। স্বরাজ্যদলের কর্মপন্থা মহাত্মা গান্ধীর নির্দ্দেশে উদ্ভাবিত ও অনুসৃত হয় নাই।

 সুভাষচন্দ্র ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যের প্রতি অপমানসূচক উক্তি করিয়াছেন পন্থজীর প্রস্তাবে এইরূপ বলা হইয়াছে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র নিজেই বহুবার বলিয়াছেন যে, তিনি কাহারও প্রতি বা কাহাকেও উদ্দেশ্য করিয়া কোনও অভিযোগ করেন নাই। তাঁহার সহিত দক্ষিণপন্থীদের যে পার্থক্য তাহা আদর্শ ও নীতির পার্থক্য—ব্যক্তিবিশেষের প্রশ্ন এখানে উঠে না। প্রস্তাবের উত্থাপক পন্থজী নিজেও স্বীকার করিয়াছেন, ব্যক্তিগতভাবে সভাপতির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করা তাঁহার অভিপ্রেত নয়। পন্থজী ও রাষ্ট্রপতির স্বীকারোক্তির পরেও ঐ অংশটি যে কেন তুলিয়া দেওয়া হইল না তাই আমাদের বোধগম্য নয়। দক্ষিণপক্ষের জেদ—পন্থ প্রস্তাবের একটি ‘কমা’ও পরিবর্ত্তন করা চলিবে না।

 কংগ্রেসের গঠনতন্ত্র অনুসারে কংগ্রেস সভাপতি নিজমতানুযায়ী কর্ম-পরিষদ গঠনের সম্পূর্ণ অধিকারী। পন্থ-প্রস্তাবের দ্বারা সভাপতির ন্যায়সঙ্গত অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হইয়াছে এবং কংগ্রেস সভাপতিকে মহাত্মা গান্ধীর ‘রবার ষ্ট্যাম্পে’ পরিণত করা হইয়াছে। গান্ধীজীকে কংগ্রেসের একচ্ছত্র অধিনায়ক করাই যদি গান্ধীবাদীদের আসল উদ্দেশ্য হয়, তবে গান্ধীজীকে কংগ্রেসের আজীবন সভাপতি (Life President) করিয়া রাখিলেই লেঠা চুকিয়া যাইত—নির্ব্বাচনের প্রহসন করিবার প্রয়োজন হইত না।

 কংগ্রেসের নিয়মতন্ত্র অনুসারে আইনসঙ্গত ভাবেই রাষ্ট্রপতি পন্থপ্রস্তাবকে বিধিবহির্ভূত বলিয়া ঘোষণা করিতে পারিতেন, কিন্তু শুধুমাত্র নিয়ম শৃঙ্খলার দোহাই দিয়া প্রস্তাবটিকে বাতিল করিয়া দেওয়াকে তিনি কাপুরুষোচিত ও গণতন্ত্র-বিরোধী কাজ বলিয়া মনে করিলেন। উপরন্তু তিনি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে এই প্রস্তাবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলিয়া এই প্রস্তাবের আলোচনাকেই তিনি প্রাধান্য দিলেন। দক্ষিণপন্থীরা পূর্ব হইতেই প্রস্তুত হইয়াছিলেন — ঐ দিন দক্ষিণপন্থীদেরই জয় হইল। সুভাষচন্দ্র যাহাদের উপর একান্তরূপে নির্ভর করিতেন তাহারাই শেষমুহূর্ত্তে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া বিপক্ষদলের জয়লাভে সহায়তা করিলেন। ঐক্যের দোহাই দিয়া অপরাপর বামপন্থীদলগুলি ঐক্য-প্রতিষ্ঠার মূলে কুঠারাঘাত করিল। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদল ও সাম্যবাদীদল নিরপেক্ষ রহিল—এইরূপে বামপক্ষের সংহতি নষ্ট হইল। পণ্ডিত জওহরলালের হাতে যন্ত্রস্বরূপ থাকিয়া জয়প্রকাশ নারায়ণ নিখুঁত অভিনয় করিলেন। বাঙলার মধ্যে আজিকার বহুনিন্দিত মানবেন্দ্র নাথ রায়ই কেবল সেদিন সুভাষচন্দ্রের পক্ষে দক্ষিণপক্ষের বিরুদ্ধে লড়িয়াছিলেন।

 পন্থ-প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে গণতন্ত্রবিরোধী। গণতন্ত্রের নামে এই গণতন্ত্র বিগর্হিত কার্য্যের নিদর্শন অতি অল্পই দেখা যায়। ইতিপূর্বে সর্দার প্যাটেল প্রমুখ নেতৃবর্গের আচরণে সাধারণ ভদ্রতাজ্ঞান ও শালীনতাবোধের অভাব দেখা গিয়াছিল, কিন্তু ত্রিপুরীতে তাঁহারা নির্বাচিত সভাপতিকে অন্যের কর্ততৃত্বাধীনে আনিবার হীন অভিসন্ধিমূলক নিয়মবহির্ভূত এক অদ্ভুত প্রস্তাব উপস্থিত করিয়া যে ঘৃণিত মনোবৃত্তির পরিচয় দিলেন তাহা কংগ্রেসের গৌরবময় অতীতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করিয়া গণতন্ত্রের স্থলে একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা করিল। বস্তুতপক্ষে সেদিন কংগ্রেসের অধিবেশনে অনেক দক্ষিণপন্থী নেতাই একনায়কত্বের অজস্র প্রশংসা করিয়া গুরুগম্ভীর বক্তৃতা করিলেন। পন্থজী মুক্তকণ্ঠে মুসোলিনীর ফ্যাসিষ্ট নীতির ভূয়সী প্রশংসা করিয়া ডিক্‌টেট্‌রসীপকেই একমাত্র প্রয়োজনীয় অস্ত্র হিসাবে ব্যাখা করিলেন। বক্তারা এক বাক্যে ঘোষণা করিলেন, কংগ্রেসই মহাত্মা—মহাত্মাই কংগ্রেস। সত্যমূর্ত্তি মহাত্মাকে ভগবানের অবতাররূপে বর্ণনা করিলেন। রাজাগোপালাচারী সুস্পষ্ট ভাবে জানাইয়া দিলেন, কংগ্রেস রাষ্ট্রতরীর মহাত্মাই একমাত্র সার্থক কর্ণধার। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি শেঠ গেবিন্দদাস অধিকতর কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়া বলিলেন, মহাত্মার স্থান কংগ্রেসের উপরে— ফ্যাসিষ্টদের মধ্যে মুসোলিনীর যে স্থান,নাৎসীদের মধ্যে হিটলারের যে স্থান, কম্যুনিষ্টদের মধ্যে ষ্ট্যালিনের যে স্থান কংগ্রেসীদের মধ্যে গান্ধীজীর স্থানও ঠিক সেরূপ। গান্ধীজীকে সকলেই ভারতবর্ষের Non-violent Dictator বলিয়া ঘোষণা করিলেন। গান্ধী ডিক্‌টেটরের প্রশংসায় দিঙমণ্ডল মুখরিত হইল। ‘মহাত্মাজী কী জয়! হিন্দুস্থান কী হিট্‌লার কী জয়!’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করিয়া তুলিল। গান্ধীবাদী দক্ষিণ পন্থীদের বিজয় উল্লাসের এইরূপ অর্থহীন প্রলাপোক্তি গান্ধীজীর কর্ণগোচর হইলে তিনি কি মনে করিতেন ভাবিয়া কৌতুক বোধ হইতেছে। গান্ধীজীর সহিত হিটলার-মুসোলিনীর তুলনা কতদুর অশোভন তাহা একবার গান্ধীজীর সুস্থমস্তিষ্কে ভাবিয়া দেখা উচিত ছিল। ত্রিপুরীতে অভিমন্যুবধের পালা সমাপ্ত করিয়া প্রধান উদ্যোক্তা সর্দার প্যাটেল বলিয়াছিলেন “লোকে আমাকে হিটলার বলে, আমি হিটলারের বাবা।” পন্থজীর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় পরক্ষণেই পণ্ডিত জওহরলাল যখন বৃটেনের পররাষ্ট্র নীতির নিন্দা করিয়া এক প্রস্তাব উত্থাপন করিয়া বক্তৃতা প্রসঙ্গে ঘোষণা করিলেন, বৃটেন ও ফ্রাস গণতন্ত্রের হত্যা (Murder of Democracy) করিয়াছে, তখন অদৃশ্যদেবতা বোধ করি অলক্ষ্যে থাকিয়া গণতন্ত্রের হত্যাপরাধে অপরাধী দক্ষিণপন্থীদের মুখে বৈদেশিক শাসনে গণতন্ত্রহীনতার অভিযোগ শুনিয়া হাস্যসংবরণ করিতে পারেন নাই!

 বামপন্থীদের ঐক্য ও সংহতি নষ্ট হওয়ায় পন্থ-প্রস্তাব পাশ হইয়া গেল। সুভাষচন্দ্র নামে সভাপতি রহিলেন, কিন্তু কংগ্রেস তাঁহার মাথার উপর মহাত্মাজীকে বসাইয়া দিল। স্বাধীনভাবে ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করিবার ক্ষমতাও তাঁহার রহিল না। নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতিতে তখন দক্ষিণপন্থীদেরই সংখ্যাধিক্য।