বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র/তেইশ

উইকিসংকলন থেকে

তেইশ

 চিকিৎসকগণের পরামর্শ উপেক্ষা করিয়া ৫ই মার্চ্চ রবিবার রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্র অসুস্থদেহে বোম্বাই মেলযোগে ত্রিপুরী যাত্রা করিলেন। গাড়ি ছাড়িবার পনের মিনিট পূর্বে সুভাষচন্দ্র একটি এ্যাম্বুলেন্স গাড়িতে হাওড়া ষ্টেশনে উপস্থিত হন। সুভাষচন্দ্রের শরীরের উত্তাপ তখন ৯৯.৪ ডিগ্রী। ইতিপূর্বে ডাঃ স্যার নীলরতন সরকার সুভাষচন্দ্রের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়া তাঁহাকে ত্রিপুরী যাইতে নিষেধ করেন ও স্বাস্থ্যের অবস্থা উদ্বেগজনক বলিয়া মত প্রকাশ করেন। অসুস্থ শরীরেই তিনি ত্রিপুরী অভিমুখে রওনা হইলেন। হাওড়া স্টেশনে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁহাকে পুষ্পমাল্যভূষিত করেন। সুভাষচন্দ্রের কামরার বহির্দ্দেশে একটি বৃহৎ ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা দুলিতে থাকে। বিপুল বন্দেমাতরম্ ধ্বনির মধ্যে ট্রেণ খানি চলিতে আরম্ভ করে। সুভাষচন্দ্রের বৃদ্ধা জননী শ্রীযুক্তা প্রভাবতী দেবী তাঁহার সংগে ছিলেন।

 ত্রিপুরীতে রাষ্ট্রপতির অভ্যর্থনার বিরাট আয়োজন হইয়াছিল। রাষ্ট্রপতিকে শোভাযাত্রা সহকারে লইয়া যাইবার জন্য ৫২টি হস্তিবাহিত সুদৃশ্য রথের ব্যবস্থা হইয়াছিল। সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত দুর্বল ও ক্লান্ত বোধ করায় শোভাযাত্রার সহিত যাইতে পারেন নাই। রাষ্ট্রপতির একখানি বৃহৎ প্রতিকৃতি পুষ্পমাল্য বিভূষিত করিয়া একটি অতিকায় নানাঅলঙ্কার-পরিশোভিত গজপৃষ্ঠে স্থাপন করিয়া শোভাযাত্রা চলিতে আরম্ভ করে। বিষ্ণুদত্ত নগর হইতে ছয় মাইল দূরবর্ত্তী ‘পিসমিস মারিয়া’ হইতে শোভাযাত্রা বহির্গত হয়। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে এই শোভাযাত্রাকে উপলক্ষ করিয়া যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা গিয়াছিল তাহার তুলনা বিরল। ঝাণ্ডাচৌক পর্য্যন্ত এই অপূর্ব দৃশ্য দেখিবার জন্য পথের উভয় পার্শ্বে লক্ষ লক্ষ নর-নারী সমবেত হইয়াছিল। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলে পাহাড় ও উপত্যকার মধ্য দিয়া রাষ্ট্রপতির শোভাযাত্রার অনুগমন করে। সেইদিন প্রত্যূষে সূর্য্যোদয়ের বহু পূর্ব্বেই পথ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শত শত লোক গৃহের চাল, পাহাড় ও বৃক্ষোপরি আরোহণ করিয়া শোভাযাত্রার মনোহর শোভা নিরীক্ষণ করে। শোভাযাত্রার অগ্রভাগে এক বিরাটকায় হস্তী হাওদার উপর স্থাপিত ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা বহন করিয়া সর্বাগ্রে চলিতে থাকে। মনে হইতেছিল, বায়ুহিল্লোলে জাতীয় পতাকা যেন জাতীয় সংগীতের সহিত তালে তালে পত্ পত্ শব্দে উড়িতেছে। তৎপরে ২৫টি করিয়া দুই সারিতে ৫০টি হস্তী। প্রত্যেকটি-ই সুসজ্জিত ও নানালঙ্কারভূষিত। ৫০ টি হস্তীর পৃষ্ঠে বিগত ৫০ বৎসরের কংগ্রেস সভাপতিদের এক একখানি প্রতিকৃতি বিরাজ করিতেছিল। মধ্যভাগে রাষ্ট্রপতির প্রতিকৃতিবাহী দ্বিরদ। এই নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করিয়া বিরাট জনতা বিস্ময়বিমূঢ় হইয়া প্রস্তরমূর্তিবৎ অবস্থান করিতেছিল। সেই বিপুলজনসংঘ সুভাষচন্দ্রকে দেখিতে না পাইয়া সুভাষচন্দ্রের প্রতিকৃতির উদ্দেশ্যে ভক্তিপরিপ্লুতচিত্তে মস্তক অবনত করিয়া অন্তরের শ্রদ্ধা ঢালিয়া দিল।

 সুভাষচন্দ্র যখন এ্যাম্বুলেন্স যোগে ত্রিপুরী পৌঁছেন তথন তাঁহার শরীরের উত্তাপ ১০৩° ডিগ্রী। অভ্যর্থনা সমিতির চিকিৎসকগণের উপর তাঁহার সুশ্রূষার ভার অর্পিত হয়। সুভাষচন্দ্রের ত্রিপুরী আগমনের পূর্বেই ত্রিপুরীতে রাষ্ট্র হইয়া গিয়াছিল যে তিনি প্রকৃতপক্ষে অসুস্থ নহেন— অসুস্থতার ভান করিতেছেন মাত্র! কংগ্রেসের বড় কর্ত্তারা ইহাকে Political sickness বলিয়া তাঁহাদের সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন! ওয়ার্কিং কমিটির জনৈক প্রাক্তন সদস্য সুভাষচন্দ্রের চিকিৎসকগণকে গোপনে ডাকিয়া লইয়া সত্যই তাঁহার ১০৩° ডিগ্রী জ্বর আছে কিনা এরূপ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেও সঙ্কোচ বোধ করেন নাই। ফলতঃ, কংগ্রেসের উচ্চমণ্ডলের নিকট সুভাষচন্দ্রের অসুস্থতার সংবাদ অবিশ্বাস্য বোধ হইয়াছিল। তাঁহাদের এরূপ আচরণ যে গভীর ষড়যন্ত্র ও দুরভিসন্ধিমূলক তাহার পরিচয় কিছুদিন পূর্বে ওয়ার্দ্ধায় ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন সংক্রান্ত ব্যাপারেই পাওয়া গিয়াছে। কোন কোন কংগ্রেস নেতার সন্দেহজনক কৌতুহল প্রকাশে বিরক্ত হইয়া সুভাষচন্দ্রের চিকিৎসকগণ সরকারী মেডিক্যাল বোর্ডের শরণাপন্ন হইলেন। মধ্য প্রদেশ ও বেরারের বেসামরিক হাসপাতাল সমূহের Inspector-General, মধ্যপ্রদেশ ও বেরারের Director of Public Health ও জব্বলপুরের সিভিল সার্জ্জনকে লইয়া এই বোর্ড গঠিত হয়। এই বোর্ডের যুক্ত রিপোর্টে যখন সুভাষচন্দ্রের অসুস্থতার সংবাদ সমর্থিত হইল তখন হইতে অবস্থার কতকটা পরিবর্ত্তন হইতে থাকে। জামদোবা হইতে সুভাষচন্দ্র My strange illness নাম দিয়া একটি প্রবন্ধ লিখেন, উহা ১৯৩৯ সালের Modern Review’র এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধ পাঠে সুভাষচন্দ্রের অসুস্থতার বিস্তৃত বিবরণ অবগত হওয়া যায়। সুভাষচন্দ্রের হিতৈষী বন্ধুদের কেহ কেহ তাঁহার এই অসুস্থতার কারণ ‘বিষ-প্রয়োগ’ বলিয়া বেশ গাম্ভীর্য্যের সহিত মন্তব্য করেন। সুভাষচন্দ্র এইরূপ সিদ্ধান্তকে কল্পনাবিলাসী উর্ব্বর মস্তিষ্কের পরিচায়ক বলিয়া হাসিয়াই উড়াইয়া দেন। সংস্কৃতজ্ঞ জ্যোতির্ব্বিৎ পণ্ডিতেরাও অনুরূপ কল্পনাশক্তি প্রভাবে ‘তান্ত্রিক প্রথায় মারণ-ক্রিয়ার প্রয়োগ করা হইয়াছে’ বলিয়া মত প্রকাশ করেন। বিশেষ গবেষণালব্ধ এই সমস্ত কৌতুহলোদ্দীপক কাহিনীকে সুভাষচন্দ্র মোটেই আমল দিতেন না।

 ত্রিপুরী অধিবেশনে কংগ্রেসের এক অধ্যায় সমাপ্ত হইয়া সম্পূর্ণ এক নূতন অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়। এই অধিবেশনের গুরুত্ব সম্বন্ধে পূর্ণমাত্রায় অবহিত ছিলেন বলিয়াই শারীরিক অসুস্থতায় ভ্রূক্ষেপ না করিয়া তিনি ত্রিপুরী অধিবেশনে যোগদান করেন। ত্রিপুরীতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তাঁহাকে জব্বলপুর হাসপাতালে যাইবার জন্য অনুরোধ করিলে সুভাষচন্দ্র তাহার উত্তর দেন—“আমি জব্বলপুর হাসপাতালে যাইবার জন্য এখানে আসি নাই। এখানে যদি আমার মৃত্যু হয় সেও ভাল, তথাপি অধিবেশন সমাপ্ত না হওয়া পর্য্যন্ত আমি অন্য কোথাও যাইতে প্রস্তুত নই।” অবশ্য ম্যাডিকেল বোর্ডের নির্দ্দেশ অনুসারে তাঁহাকে কয়েকটি বৈঠকে অনুপস্থিত থাকিতে হইয়াছিল। সুভাষচন্দ্রের অসুস্থতার একটি ফল এই হইয়াছিল যে, বিষয়-নির্বাচনী সমিতির কয়েকটি বৈঠকে এবং কংগ্রেসের প্রকাশ্য অধিবেশনে তিনি উপস্থিত থাকিতে পারেন নাই। তাঁহার অনুপস্থিতিকালে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পণ্ডিত জওহরলালের সহায়তায় সভাপতির কার্য্য পরিচালনা করেন।

 ত্রিপুরী কংগ্রেসের অব্যবহিতপূর্বে গুজরাটের অন্তর্গত রাজকোট রাজ্যে প্রজাদিগের সহিত শাসকবর্গের বিরোধ উপস্থিত হওয়ায় সত্যাগ্রহ হয়। কস্তুরবাঈ গান্ধী, মণিবেন প্যাটেল, মৃদুলাবেন সারাভাই প্রভৃতি খ্যাতনামা দেশসেবিকাগণ এই সত্যাগ্রহে যোগদান করিয়া কারাবরণ করেন। মহাত্মাগান্ধী বিচলিত হইয়া শাসকের সহিত প্রজাদের এই বিরোধ মিটাইতে অগ্রসর হন। কিন্তু রাজকোটের শাসক ও তাঁহার মন্ত্রী ঠাকুর সাহেব বিশ্বাসঘাতকতা করায় মহাত্মার হস্তক্ষেপেও কোন ফল হয় না। ফলে, ৩রা মার্চ্চ শুক্রবার দ্বিপ্রহর হইতে মহাত্মা গান্ধী প্রায়োপবেশন আরম্ভ করেন। এই সংবাদে দেশের সর্ব্বত্র তুমুল আন্দোলন হইতে থাকে। বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রীরা সম্মিলিতভাবে তার যোগে বড়লাটকে জানান যে, এই ব্যাপারে বড়লাট মধ্যস্থতা না করিলে কংগ্রেস-মন্ত্রীরা পদত্যাগ করিবেন। গান্ধীজীর সহিত পত্রালাপ করিয়া অবশেষে বড়লাট রাজকোটের শাসককে গান্ধীজীর সর্ত্তে সম্মত হইতে বাধ্য করেন। তদনুসারে ৭ই মার্চ্চ ৪ দিন উপবাসের পর মহাত্মা প্রায়োপবেশন ভঙ্গ করেন। ৪ দিন উপবাসের ফলে তিনি অত্যন্ত দুর্ব্বল হইয়া পড়েন। সেজন্য তিনি ত্রিপুরী কংগ্রেসে উপস্থিত থাকিতে পারিলেন না। সুভাষচন্দ্রের অনুরোধের উত্তরে মহাত্মা তাঁহাকে তারে জানাইয়াছেন—“আপনি চিকিৎসকের নির্দ্দেশ অবহেলা করিয়াছেন, কিন্তু আমার সে সাহস নাই।” মহাত্মার চিকিৎসকগণ তাঁহাকে সোমবারের পূর্বে কোথাও রওনা হইতে নিষেধ করিয়াছেন— অর্থাৎ যতদিন না কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হয়! কংগ্রেসের এই গোলযোগর সময় মহাত্মা রাজকোট সমস্যাকে প্রধান করিয়া লইলেন। এদিকে কর্ত্তব্যানুরোধে অসুস্থতাসত্ত্বেও নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া সুভাষচন্দ্র ত্রিপুরীতে উপস্থিত হন।

 ১৯৩৯ সালের ত্রিপুরি কংগ্রেসে রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্র নিম্নোক্ত অভিভাষণ প্রদান করেন:—

সহকর্মী চেয়ারম্যান, ভ্রাতা ও ভগিনীস্থানীয় প্রতিনিধিবৃন্দ,

 ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত করিয়া আপনারা আমাকে যে মহাসম্মান প্রদান করিয়াছেন ও এখানে আপনারা আমাকে যে আন্তরিক ও সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করিয়াছেন, তজ্জন্য হৃদয়ের অন্তস্তল হইতে আপনাদিগকে ধন্যবাদ জানাইতেছি। অবশ্য, এই উপলক্ষে সাধারণতঃ অনুষ্ঠিত সমারোহের কতকাংশ আমার অনুরোধে আপনাদিগকে বর্জন করিতে হইয়াছে। বন্ধুগণ, রাজকোটে মহাত্মা গান্ধী যে সাফল্য লাভ করিয়াছেন ও তিনি যে উপবাস ভঙ্গ করিয়াছেন, তজ্জন্য সর্বপ্রথমে আমরা সকলে আনন্দ প্রকাশ করিতেছি। সমগ্র দেশ আজ বিরাট বিপদ হইতে মুক্ত হইয়া অনির্বচনীয় সুখলাভ করিয়াছে।

 বিশেষ বৎসর—বন্ধুগণ, নানা দিক দিয়া এই বৎসর একটি অস্বাভাবিক বা অসাধারণ বৎসর হইবে বলিয়া মনে হইতেছে। এইবার রাষ্ট্রপতি-নির্বাচন প্রচলিত রীতি অনুযায়ী হয় নাই। রাষ্ট্র-পতি নির্বাচনের পরে এমন সব চাঞ্চল্যকর ব্যাপার ঘটিয়াছে যাহার চরম পরিণতি স্বরূপ সর্দার প্যাটেল, মৌলানা আজাদ ও ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রমুখ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যবৃন্দ পদত্যাগ করিয়াছেন। ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম বিখ্যাত ও বিশিষ্ট সদস্য পণ্ডিত নেহেরু আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করিয়া না থাকিলেও এমন একটি বিবৃতি প্রকাশ করিয়াছেন যাহাতে সকলের মনেই এই বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে তিনিও পদত্যাগ করিয়াছেন।

 ত্রিপুরি কংগ্রেসের প্রাক্কালে রাজকোটের ঘটনায় মহাত্মা গান্ধী মৃত্যুপণে অনশন গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। রাষ্ট্রপতিও রুগ্ন অবস্থায় ত্রিপুরিতে আগমন করিয়াছেন। কাজেই, অন্যান্য বৎসরের অভিভাষণের আকার অপেক্ষা এই বৎসর রাষ্ট্রপতির অভিভাষণের আকার ক্ষুদ্র হইলে, বর্ত্তমান পরিস্থিতির উপযোগীই হইবে।

 ওয়াফ্‌দিষ্ট প্রতিনিধিমণ্ডলী—বন্ধুগণ, আপনারা জানেন যে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অতিথিরূপে মিশর হইতে ওয়াফ্‌দিষ্ট প্রতিনিধিগণ এখানে উপস্থিত হইয়াছেন। তাঁহাদের সকলকেই আমরা সাদর সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করিতেছি।

 ইয়োরোপীয় সঙ্কট—১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হরিপুরায় কংগ্রেস অধিবেশনের পরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কয়েকটি বিশেষ তাৎপর্য্যপূর্ণ ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে। এই ঘটনাগুলির মধ্যে ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ম্যুনিক চুক্তি (Munich Pact) সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্য শক্তিসমূহ—ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেন কীরূপ হীনভাবে নাজি জার্মানীর নিকট আত্মসমর্পন করিয়াছে, তাহা এই Munich চুক্তি হইতে বুঝা যায়। এই চুক্তির ফলে ইয়োরোপের নেতৃত্ব জার্মানীর হাতে চলিয়া গিয়াছে। সম্প্রতি স্পেনে সাধারণতন্ত্রী গভর্ণমেণ্টের পতনে ফ্যাসিস্ত ইটালি ও নাজি জার্মানীর শক্তি বৃদ্ধি হইয়াছে।

 বর্ত্তমানে ইয়োরোপীয় রাজনীতি হইতে সোভিয়েট রাশিয়াকে বিতাড়নের জন্য তথাকথিত গণতান্ত্রিক শক্তিদ্বয় ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেন, ইটালি ও জার্মানীর সহিত হাতে হাত মিলাইয়াছে। কিন্তু এইরূপ মিতালি কতদিন বজায় থাকিবে—রাশিয়াকে দমন করিয়া ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেনের কী লাভ হইবে? ইয়ােরােপে ও এশিয়ায় বর্ত্তমানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে, তাহার ফলে শক্তি ও মর্য্যাদার দিক দিয়া ব্রিটিশ ও ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের গতি বিশেষ বাধা ও পরাজয়ের সম্মুখীন হইয়াছে, এবিষয়ে সন্দেহ নাই।

 গ্রেট ব্রিটেনের চরমপত্র—আমাদের অবস্থা সম্বন্ধে আমি দুই একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার আলােচনা করিব। প্রথমতঃ, কিছুকাল ধরিয়া আমি যাহা গভীরভাবে অনুভব করিতেছি— দ্বিধাহীন ও সুস্পষ্টরূপে তাহা আমি প্রকাশ করিতে চাই। ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের নিকট চরমপত্রের আকারে আমাদের জাতীয় দাবী পেশ ও স্বরাজের প্রশ্ন উত্থাপনের প্রকৃত সময় ও সুযোেগ উপস্থিত হইয়াছে। কবে যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনা আমাদের ঘাড়ে জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইবে, বর্ত্তমানের সমস্যা তাহা নহে। ইয়ােরােপে শান্তিস্থাপন না হওয়া পর্য্যন্ত কয়েকবৎসর যদি যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনা বলবৎ করা না হয়, তবে আমাদের কী করিতে হইবে ইহাই বর্ত্তমানের প্রধান সমস্যা। ইহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই যে, যদি ইয়ােরাপে জোড়াতাড়া দিয়া কোন প্রকারে শান্তি স্থাপিত হয়, তবে গ্রেট ব্রিটেন সুকঠোর সাম্রাজ্যবাদনীতি গ্রহণ করিবে। প্যালেষ্টাইনে আরব ও ইহুদীদিগকে সন্তুষ্ট করিবার যে প্রয়াস ব্রিটিশ করিতেছে, তাহার কারণ এই যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেন দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে। অতএব আমার অভিমত এই যে, উত্তর প্রদানের সময় নির্দিষ্ট করিয়া আমাদের জাতীয় দাবি সম্বলিত চরমপত্র ব্রিটিশের নিকট পেশকরা উচিত। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোন সাড়া না পাই অথবা যদি উত্তর অসন্তোষজনক হয়, তবে আমাদের জাতীয় দাবি স্বীকারে ব্রিটিশকে বাধ্য করিবার উদ্দেশ্যে যে শক্তি আমাদের আয়ত্ত, তাহাই প্রযোগ করিতে হইবে।

 আইন অমান্যরূপ গণ-আন্দোলন অথবা সত্যাগ্রহই বর্ত্তমানে আমাদের একমাত্র শক্তি ও অবলম্বন। দীর্ঘকাল ধরিয়া নিখিল ভারতব্যাপী সত্যাগ্রহের সম্মুখীন হইবার শক্তি এখন ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের নাই। কংগ্রেসের মধ্যে কেহ কেহ মনে করেন যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্রাম করিবার প্রকৃত সময় এখনও আসে নাই —ইহাতে আমি দুঃখিত। বাস্তব দৃষ্টি সহকারে সমস্যার আলোচনা করিলে আমরা বুঝিতে পারিব যে, নৈরাশ্যবাদের বিন্দুমাত্র কারণ নাই। আটটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিত্ব গ্রহণের ফলে আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান কংগ্রেসের শক্তি ও মর্য্যাদা বিশেষ বৃদ্ধিলাভ করিয়াছে, সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে গণ-আন্দোলনও বিশেষভাবে বিস্তার লাভ করিয়াছে। দেশীয় রাজ্যসমূহেও অভূতপূর্ব জাগরণ আসিয়াছে। বিশেষতঃ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যখন আমাদের অনুকুল, তখন স্বরাজলাভার্থ আমাদের গণআন্দোলন আরম্ভ করিবার এমন সুযোগ ও সময় আমাদের জাতীয় ইতিহাসে আর কখনও কি আসিবে? শীতল-মস্তিষ্ক বাস্তববাদী হিসাবে আমি বলিতে পারি যে, সাম্প্রতিক পরিস্থিতির সমস্ত ঘটনাই আমাদের এইরূপ অনুকূল যে, এই সময়ে সাফল্যের উচ্চতম আশা পোষণ করিলেও অন্যায় হইবে না। যদি একবার আমাদের মধ্যেকার সমস্ত বিভেদ ভুলিয়া জাতীয় সংগ্রাম পরিচালনায় আমাদের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করি, তবে এই অনুকূল অবস্থার পূর্ণতম সুযোগ গ্রহণ করিতে ও সুফল লাভ করিতে পারিব। জাতীয় জীবনে এইরূপ সুযোগ কদাচিৎ আসে, আমরা কি হেলায় সেই সুযোগ হারাইব?

 দেশীয় রাজ্য—দেশীয় রাজ্যের নবজাগরণের পূর্ণ সদ্‌ব্যবহার করিবার সুযোগ যাহাতে গ্রহণ করিতে পারি, তদুদ্দেশ্যে নিখিল ভারত দেশীয় প্রজাসম্মেলনের সহিত মহাত্মাগান্ধীর নির্দেশ ও সহযোগিতার আলোকে পূর্ণ সহযোগিতা করিতে হইবে।

 ঐক্যের আহ্বান—স্বরাজলাভার্থ চুড়ান্ত সংগ্রাম আরম্ভ করিবার সমীচীনতার কথা বলিলাম। ইহার জন্য উপযুক্ত প্রস্তুতি ও আয়োজন চাই। প্রথমতঃ ক্ষমতালোলুপতাজনিত আমাদের মধ্যে যে দুর্বলতা ও দুর্নীতি প্রবেশ লাভ করিয়াছে কঠোরভাবে তাহার উচ্ছেদসাধন করিতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, কিষাণ আন্দোলন প্রমুখ সমস্ত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের সহিত ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা রক্ষা করিয়া কাজ করিতে হইবে। দেশের আমূলপরিবর্তনপন্থী সকল বৈপ্লবিক আন্দোলনের সহিত পূর্ণ সঙ্গতি ও সহযোগিতা রক্ষা করিয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসসাধনের জন্য সমস্ত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দলের সমবেত প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত করিতে হইবে। আজিকার দিনে কংগ্রেসের অভ্যন্তরস্থ আবহাওয়া মেঘাচ্ছন্ন। ইহার ফলে বিরোধ দেখা দিয়াছে। এইজন্য আমাদের বহু বন্ধু ও সহকর্মী নিরুৎসাহ ও বিষাদগ্রস্ত হইয়া আছেন। কিন্তু আমি চূড়ান্ত আশাবাদী। বর্ত্তমানের মেঘাড়ম্বর সাময়িক, আমার দেশবাসীর স্বদেশপ্রেমে আমার পূর্ণ আস্থা বর্ত্তমান। এবিষয়ে আমি নিশ্চিত যে অবিলম্বেই বর্ত্তমান বিরোধ দূরীভূত করিয়া আমাদের মধ্যে ঐক্যের পুনঃ প্রতিষ্ঠায় আমরা সমর্থ হইব। ১৯৪২ সালের গয়া কংগ্রেসের কালে ও পরে দেশবন্ধু দাস ও পুণ্যস্মৃতি মতিলাল নেহরু যখন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করেন, তখন কতকটা এই অবস্থা সঙ্কট ঘটিয়াছিল। আমার স্বর্গত গুরু ও শ্রদ্ধেয় মতিলালের ও ভারতমাতার অন্যান্য মহান সন্তানদের আত্মসাধনা বর্ত্তমান সঙ্কট-ত্রাণে আমাদিগকে উৎসাহিত ও প্রবর্ত্তিত করুক। মহাত্মা গান্ধী আমাদিগকে পরিচালনা করিবার ও আমাদের জাতীয় মুক্তিসাধনের জন্য এখনও আমাদের মধ্যে আছেন। তিনি বর্ত্তমান সঙ্কট দূরীকরণে আমাদের সহায় হউন—ইহাই আমার আকুল প্রার্থনা। “বন্দে মাতরম্”