বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র/পঁচিশ

উইকিসংকলন থেকে

পঁচিশ

 ত্রিপুরীর অধিবেশন সমাপ্ত হইল—এইবার ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের পালা। পন্থজীর প্রস্তাবানুসারে সুভাষচন্দ্র ওয়ার্কিং কমিটি গঠন সম্পর্কে গান্ধীজীর নির্দ্দেশ চাহিয়া পাঠাইলেন। সুভাষচন্দ্র চাহিলেনদক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী উভয়দলেরই প্রতিনিধি লইয়া সর্বদলীয় (Composite) ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করিতে। কিন্তু মহাত্মাজী তাহাতে সম্মতি দিলেন না। গান্ধীজী বলিলেন, হয় কেবল বামপন্থী, না হয় কেবল দক্ষিণপন্থী লোক লইয়াই একদলীয় (Homogeneous) ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করিতে হইবে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র তাহাতে সম্মত হইলেন না।

 রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্রের সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের সঙ্কল্প স্থূল আদর্শবাদ বা কল্পনাবিলাসিতার পরিচায়ক নহে, উহা কংগ্রেসের অতীত ইতিহাসের সহিত সর্ব্বতোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও তৎকালীন পরিস্থিতির সূক্ষ্ম বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ ও গভীর রাজনীতিজ্ঞানের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। অতীতে কংগ্রেসের কর্ম-পরিষদ কখনই এক মতাবলম্বী লোক লইয়া গঠিত হয় নাই। পূর্ববর্ত্তী পরিষদেও শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র বসু ও পণ্ডিত জওহরলালকে দক্ষিণপন্থী বলা চলে না।

 মহাত্মাজীর সহিত সুভাষচন্দ্রের এই বিষয়ে অনেক পত্র ও টেলিগ্রাম আদান-প্রদান হয়, কিন্তু মতভেদ দূর হয় নাই। শ্রীযুক্ত বসু তাঁহার পত্রে অসঙ্কোচে ও খোলাখুলিভাবে গান্ধীজীকে সমস্ত বিষয় জানাইয়াছেন। প্রত্যেকটি ঘটনা ও তাহার কার্য-কারণ যথাযথরূপে প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার পত্র পড়িয়া তাঁহার মনোগতভাব ঠিক ঠিক বুঝা যায়। কিন্তু গান্ধীজীর পত্র পড়িলে এই কথাই মনে হইবে যে তিনি যেন অত্যন্ত সাবধানে ও সতর্কতার সহিত প্রত্যেকটি কথা উচ্চারণ করিয়াছেন। সুভাষচন্দ্র নিজের মতামত নিঃশেষে ব্যক্ত করিয়া তাঁহার ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করিয়া লইতে চাহিয়াছেন, কিন্তু গান্ধীজী তাঁহার মত পরিবর্ত্তন করিলেন না।

 গান্ধী-বসু পত্রালাপ হইতে জানা যায়, রাজকোটে জনৈক সংবাদদাতা গান্ধীজীকে জানাইয়াছিলেন যে, ত্রিপুরীতে পূর্বতন ওয়ার্কিং কমিটির উপর আস্থা জ্ঞাপন করিয়া এক প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে। ইহাও প্রকাশ, গান্ধীজী উক্ত সংবাদদাতার নিকট এই প্রস্তাবের বিষয়ে তাঁহার সম্মতি জ্ঞাপন করেন। অবশ্য ইহা জানা যায় নাই, উক্ত সংবাদদাতা গান্ধীজীকে পূর্ণ প্রস্তাবটি শুনাইয়াছিলেন কিনা—বিশেষ করিয়া নূতন কর্ম-পরিষদ গঠন সম্পর্কিত অংশটি। শ্রীযুক্ত বসু এক পত্রে গান্ধীজীকে লিখিয়াছিলেন, “ত্রিপুরীতে জোর গুজব রটিয়াছে যে, পন্থ-প্রস্তাব আপনার সমর্থন ও অনুমোদন লাভ করিয়াছে। আপনি সম্ভবতঃ অবগত আছেন যে, যাঁহারা পন্থ-প্রস্তাবের পক্ষে ভোট সংগ্রহের জন্য প্রচারকার্য্য চালায় তাঁহারা সকলকে এই কথাই বলিয়া বেড়ায় যে রাজকোটের সহিত টেলিফোনযোগে কথাবার্ত্তা হইয়াছে এবং গান্ধীজী তাঁহার পূর্ণ সমর্থন জানাইয়াছেন। ঘরোয়া বৈঠকের আলোচনায় ইহাও প্রকাশ করা হয় যে সম্পূর্ণ পন্থ-প্রস্তাবের উপর কোন সংশোধন বা ছাঁট-কাটেই গান্ধীজী ও তাঁহার গোঁড়া ভক্তগণ সন্তুষ্ট হইবেন না। ব্যক্তিগতভাবে আমি যদিও এই সকল গুজবে বিশ্বাস করি না, কিন্তু এই সকল অমূলক প্রচারকার্য্য ভোট-অর্জ্জনের পক্ষে নিঃসন্দেহে অনেকখানি সহায়তা করিয়াছে।” আশ্চর্য্যের বিষয় এই গুরুতর অভিযোগের উত্তর দেওয়া গান্ধীজী প্রয়োজন বোধ করেন নাই।

 যিনি কংগ্রেসের চার আনার সদস্য থাকিতেও অস্বীকৃত তাঁহাকে প্রস্তাবের দ্বারা কার্য্যতঃ ডিক টেটরের ক্ষমতা দান কতদূর শোভন ও কংগ্রেসের নিয়মতন্ত্র সঙ্গত তাহা বিবেচনা-সাপেক্ষ। মহাত্মা কি কংগ্রেসের চার আনা সদস্য হইতে ও কংগ্রেসের কার্য্যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হইতে সম্মত হইতেন? বল্লভ-কোম্পানীর উচিত ছিল পূর্ব্বাহ্ণে গান্ধীজীর নিকট হইতে এ বিষয়ে তাঁহার সম্মতি লাভ করা।

 ১৯৩৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর গান্ধীজী কংগ্রেসের কার্য্য হইতে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। উক্ত ঘোষণায় তিনি বলেন, “কংগ্রেসের স্বাভাবিক বিকাশের পথে আমি সহায়ক না হইয়া অন্তরায় হইয়াছি। কংগ্রেস গণতান্ত্রিক ও প্রতিনিধিমূলক প্রতিষ্ঠান না হইয়া আমার নিজ ব্যক্তিত্বের দ্বারাই সমধিক প্রভাবান্বিত হইয়াছে। এই কারণে কংগ্রেসের মধ্যে সহজ সরল যুক্তির স্বাভাবিক বিকাশলাভের এখন কোন সুযোগ নাই।” কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে গান্ধীজীকে তাঁহার এইরূপ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করিতে অনুরোধ করা হইলে তদুত্তরে তিনি বলেন, “কংগ্রেস যাহাতে স্বাভাবিক পরিণতির পথে অগ্রসর হইতে পারে ও সহজভাবে বিকাশপ্রাপ্ত হইতে পারে তাহার জন্যই আমি কংগ্রেসের সহিত প্রত্যক্ষ যোগ ছিন্ন করিতে মনস্থ করিয়াছি। যে ভাবেই হউক, বর্ত্তমান সময়ে আমার উপস্থিতিতে কংগ্রেসের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশে বিঘ্ন উৎপন্ন হইতেছে! ইহা এখন একটি কৃত্রিম ও জবরদস্তিমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইয়াছে—যে কোন প্রতিষ্ঠান বা জাতির উন্নতির পথে এইরূপ অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ও অনিষ্টকর।” গান্ধীজীর এই ঘোষণা বলবৎ থাকা সত্ত্বেও গান্ধীজীর অনুচরবর্গ যে তাঁহার সম্মতি ব্যতিরেকেই গান্ধীজীর উপর সমস্ত দায়িত্বভার অর্পণ করতে সাহসী হইলেন—ইহাই আশ্চর্য্য! আর যদি গান্ধীজীর সম্মতি প্রচ্ছন্নভাবে থাকিয়াই থাকে তাহা হইলে পূর্বোক্ত ঘোষণার সহিত পন্থ-প্রস্তাবের সামঞ্জস্য বিধান করা যায় কিরূপে?

 ওয়ার্কিং কমিটির বার জন সদস্য তাঁহাদের পদত্যাগ পত্রে রাষ্ট্রপতিকে লিখিয়াছিলেন “আমাদের মনে হয়, আপনার মনোমত কর্ম-পরিষদ গঠনে আপনাকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়াই কর্ত্তব্য।” মহাত্মা গান্ধীও তাঁহার সমর্থকদের কংগ্রেসের বাহিরে থাকিয়া একনিষ্ঠভাবে দেশের সেবা করিয়া যাইতে পরামর্শ দিয়াছিলেন। কিন্তু পন্থ-প্রস্তাবের ফলে ত্রিপুরীতে গান্ধীবাদীদের যে স্বরূপ প্রকাশ পাইল তাহাতে সুভাষচন্দ্রের পুনর্নির্বাচন ব্যাপারটিকে তাঁহারা যে সহজভাবে গ্রহণ করিতে পারেন নাই তাহা কাহারও বুঝিতে বাকী রহিল না। সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাঁহাদের বিদ্ধেষভাব এতই প্রবল হইয়া উঠিয়াছে যে তাঁহারা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য বৃহত্তর জাতীয় কল্যাণকে বিসর্জ্জন দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নাই। সুভাষচন্দ্র তাঁহার মনোনীত বামপন্থী কর্মীদের লইয়া অনায়াসে নিজ কর্মপরিষদ গঠন করিতে পারিতেন কিন্তু কংগ্রেসের মধ্যে কোনরূপ ভেদসৃষ্টি করা ও পন্থ-প্রস্তাবের অন্যথাচরণ করা তাঁহার অভিপ্রেত নয় বলিয়াই তিনি বারংবার হাই কমাণ্ডের সহযোগিতা প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। সুভাষচন্দ্র যে একদলীয় ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করিতে সম্মত হন নাই—আপাত-দৃষ্টিতে অনেকের নিকট দুর্ব্বলতাপ্রসূত বলিয়া মনে হইলেও ইহা তাঁহার বিশেষ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক। দুই বিরুদ্ধ দলের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করিয়া কংগ্রেসকে ও জাতীয় আন্দোলনকে অধিকতর শক্তিশালী করিয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে সুভাষচন্দ্র দক্ষিণপন্থীদের দ্বারস্থ হওয়াই যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করিয়াছিলেন। ত্রিপুরী অভিভাষণে সুভাষচন্দ্র বৃটিশ গভর্ণমেণ্টের নিকট চরম পত্রের আকারে জাতীয় দাবী পেশ করিবার যে সঙ্কল্প জানাইয়াছেন সেই চরম পত্রের মেয়াদ উত্তীর্ণ হইলে ব্যাপক গণ-আন্দোলন অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠিবে। সেই গণ-আন্দোলন ব্যাপক আকারে সম্ভব হইতে পারে যদি কংগ্রেসের নির্দ্দেশ ও নেতৃত্বের পিছনে সমস্ত রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা থাকে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই সর্ব্বদলীয় মন্ত্রীসভার উপযোগিতা ও প্রয়োজন অপরিহার্য্য। অপরপক্ষে একদলীয় মন্ত্রীসভার দ্বারা এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইতে পারে না। সর্ব্বদলীয় মন্ত্রীসভা গঠনের পক্ষে ইহই সুভাষচন্দ্রের অন্যতম প্রধান যুক্তি।

 মহাত্মা গান্ধী যখন কার্য্যতঃ সুভাষচন্দ্রকে নিজ মতানুযায়ী কর্মপরিষদ গঠন করিতে পরামর্শ দিলেন তখন যদি তিনি সেই পরামর্শানুসারেই মন্ত্রীসভার সভা মনোনয়ন করিতেন তাহা হইলে সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীর নির্দ্দেশের অনুরূপ কাজ করিতেন বটে কিন্তু তাহাতে পন্থ-প্রস্তাবের সর্ত্ত সম্পূর্ণরূপে রক্ষিত হইত না। পন্থ-প্রস্তাবের সর্ত্তানুসারে কেবল ওয়ার্কিং কমিটি গঠনে গান্ধীজীর নির্দ্দেশ লইলেই চলিবে না, ওয়ার্কিং কমিটির সভ্যগণ গান্ধীজীর আস্থাভাজন হওয়া চাই। কিন্তু মহাত্মাজী যখন সুভাষচন্দ্রকে তাঁহার Vote of Confidence দেন নাই তখন সুভাষচন্দ্রের মনোনীত সভ্যরা গান্ধীজীর আস্থাভাজন হইবে ইহা বলা চলে না। কংগ্রেসের পরবর্ত্তী অধিবেশন পর্য্যন্ত গান্ধীজীর Vote of Confidence (সমর্থনের আশ্বাস) চাহিয়া পাঠাইয়াও সুভাষচন্দ্র তাহার কোন জবাব পান নাই। এক পত্রে সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীকে লিখেন, “যদি শেষাবধি আপনি এই মতই পোষণ করেন যে সর্ব্বদলীয় মন্ত্রীসভা কার্য্যকরী হইবে না ও একদলীয় মন্ত্রীসভাই একমাত্র অন্যতর উপায় এবং আপনি যদি আমাকেই আমার পছন্দমত মন্ত্রীসভা গঠন করিতে বলেন তাহা হইলে আমি আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাইব যে, আপনি অন্ততঃ আগামী অধিবেশন পর্য্যন্ত আমার প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করুন।”

 নিঃসংশয়ে ইহাই বুঝিতে হইবে যে, সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সংহতি অক্ষুণ্ণ রাখিতে চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই। কিন্তু ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ইহার পরে কংগ্রেসের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির দায়িত্ব যে কাহাদের তাহা সহজেই অনুমেয়।

 ওয়ার্দ্ধায় গান্ধীজীর সহিত তিনঘণ্টাব্যাপী দীর্ঘ আলোচনা করিয়াও সুভাষচন্দ্র কোন মীমাংসায় উপস্থিত হইতে পারিলেন না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য দেশবাসীর আকুল আবেদন ওয়ার্দ্ধাগঞ্জের নির্মম ও অবিচল মনোভাবে নিস্ফল হইল। আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের (মহাত্মার ‘গুরুদেব’) মধ্যস্থতায় কোন ফল হইল না। ১৬ই এপ্রিল তারিখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এসোসিয়েটেড্ প্রেসের প্রতিনিধির মারফৎ স্বদেশবাসীর নিকট নিম্নলিখিত আবেদন জানান। “বর্ত্তমান অপ্রীতিকর অবস্থার কারণ ব্যক্তিগতই হউক বা রাজনীতিগতই হউক, এই অবস্থাঘটিত তিক্ততা নিবার্য্যই হউক কি অনিবার্য্যই হউক, এই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই যে, কোন পক্ষের রাজনৈতিক ক্ষমতা বা চাতুর্য প্রয়োগেই ইহার অবসান হইবে না। প্রায় সর্ববিধ বাস্তব উপকরণ ও অভাব সত্ত্বেও বিঘ্নজটিল পথে আমরা এখনও অগ্রসর হইয়া চলিয়াছি; এই সময়ে জাতীয় ঐক্যরূপ পরমতম প্রয়োজন সম্পর্কে মারাত্মক বিস্মৃতি ও চেতনারাহিত্যের নানা কারণ ঘটিয়া থাকিলেও, যে মনোভাব ও চেতনা আমাদের ঐক্যবন্ধন দৃঢ় করিয়া তোলে, তাহার অপেক্ষা শ্রেয় ও পরম সম্পদ বর্ত্তমানে আমাদের আর কিছুই হইতে পারে না।

 এই সময়ে পারস্পরিক সন্দেহ ও দোষানুসন্ধিৎসা আমাদের জাতীয় সংহতির যেরূপ হানিকর, এমন আর কিছুই নয়। কেবলমাত্র আমাদের নৈতিক বুদ্ধির প্রতি আবেদনেই, নৈতিক চেতনার উদ্বোধনেই এই সত্যের উপলব্ধি ঘটিতে পারে।

 অতএব, মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ক্ষুদ্র বিষয়গুলিকে যেন আমরা পরম ক্ষমা ও উদারতার সহিত ভুলিয়া যাই—বাঙ্গালা তথা সমগ্র ভারতের স্বদেশীয়গণের প্রতি আমার এই ব্যাকুল আবেদন জ্ঞাপন করিতেছি।”

অবশেষে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের আভ্যন্তরিক অচল অবস্থা দূরীকরণের জন্য সর্ব্বশেষ প্রচেষ্টা হিসাবে রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দেওয়াই সাব্যস্ত করিলেন। এই উদ্দেশ্যে ১৯৩৯ সালের ২৮ শে এপ্রিল কলিকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন আহূত হইল। এই অধিবেশন কলিকাতায় আহ্বান করাতে অনেকেই আশঙ্কা করিলেন বাঙলার জনসাধারণ এইবার ত্রিপুরীর অপমানের প্রতিশোধ লইবে। এই আশঙ্কার কথা জানিতে পারিয়া সুভাষচন্দ্র নিম্নোক্ত বিবৃতি প্রচার করিয়া সকলকে আশ্বস্ত করিলেন। “যাহারা এই প্রকার আশঙ্কা পোষণ করেন আমার মতে তাঁহারা বাঙলাকে চেনেন না। কোন প্রদেশে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন আহ্বান করা সেই প্রদেশের পক্ষে গৌরবের বিষয় এবং সেই প্রদেশের উচিত এই অমূল্য সুযোগ সাগ্রহে গ্রহণ করিয়া তাহার যথোচিত সদ্ব্যবহার করা। এই উপলক্ষে বাঙলার জনসাধারণ ও বিশেষ করিয়া কলিকাতাবাসীদের গৃহে অন্য সকল প্রদেশের অধিবাসী অতিথি হইবেন। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, বাংলাদেশ যে দেশপ্রেম ও আতিথেয়তার ঐতিহ্যের অধিকারী বলিয়া যথার্থ ই গর্ব অনুভব করিতে পারে সেই ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রাখিয়া অভ্যাগতদের সাদরে অভ্যর্থনা করিবে ও বাঙলার চিরাচরিত অতিথিপরায়ণতার পরিচয় দিবে।” নির্দ্দিষ্ট দিনে কলিকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারে অধিবেশন আরম্ভ হইল। এই অধিবেশনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা—সুভাষচন্দ্রের পতন ও রাজেন্দ্র প্রসাদের অভ্যুত্থান!

 সুভাষচন্দ্র পদত্যাগ করিতে উঠিয়া তাঁহার পদত্যাগের কারণ সম্বন্ধে বলিলেন,—‘আমার উপর মহাত্মাজীর নির্দ্দেশ, আমি যেন পূর্বতন ওয়ার্কিং কমিটির যে কয়জন সদস্য পদত্যাগ করিয়াছেন তাঁহাদের বাদ দিয়া নূতন বৎসরের ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করি। কয়েকটি কারণে আমি গান্ধীজীর এই নির্দ্দেশের অনুরূপ কাজ করিতে পারিতেছি না। তন্মধ্যে দুইটি প্রধান কারণ উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট হইবে। প্রথমতঃ, গান্ধীজীর নির্দ্দেশানুসারে নিজমতানুযায়ী ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করিলে তাহা পন্থজীর প্রস্তাবের সর্ত্তবিরোধী হইত। কারণ, পন্থজীর প্রস্তাবে বলা হইয়াছে, আমি যে শুধু গান্ধীজীর ইচ্ছানুসারে ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করিব তাহাই নয়—আমার নির্ব্বাচিত ওয়ার্কিং কমিটির উপর গান্ধীজীর পূর্ণ আস্থা থাকা চাই। কাজেই এমতাবস্থায় আমি নিজে কর্মপরিষদ গঠন করিলে আপনাদিগকে এই আশ্বাস দিতে পারিতাম না যে আমার নির্বাচিত কর্মপরিষদ গান্ধীজীর বিশ্বাসভাজন হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ আমার স্থির বিশ্বাস—আমরা অদূর ভবিষ্যতে ভারতবর্ষে ও ভারতের বহির্দ্দেশে যে সঙ্কটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হইতে চলিয়াছি সে অবস্থায় আমাদের একান্ত কর্ত্তব্য খুব বেশী সংখ্যক কংগ্রেস কর্মীর সমর্থন পাইতে পারে এইরূপ সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা গঠন করা। এবং এইরূপ সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা কংগ্রেসের গঠন-প্রকৃতির অনুরূপ হইত।’

 ‘আমি যখন মহাত্মার উপদেশ কার্য্যে পরিণত করিতে পারিলাম না তখন মহাত্মাজীকে পুনরায় অনুরোধ করা ছাড়া আমার অন্য উপায় রহিল না যে, ত্রিপুরীতে তাঁহার উপর যে দায়িত্বভার ন্যস্ত হইয়াছে তিনি যেন অনুগ্রহপূর্ব্বক সে দায়িত্ব নিজেই বহন করেন এবং পন্থ-প্রস্তাবানুযায়ী নিজেই ওয়ার্কিং কমিটির সভ্য মনোনীত করেন। আমি তাঁহাকে ইহাও বলিয়াছি যে, তিনি যে ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করিবেন তা মানিয়া লইতে আমি বাধ্য থাকিব, যেহেতু পন্থ-প্রস্তাবকে কার্য্যকরী করাই আমার স্থির সঙ্কল্প। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয় মহাত্মাজী কর্মপরিষদ গঠনে তাঁহার চূড়ান্ত অক্ষমতা (utter incompetency) জ্ঞাপন করিয়াছেন।’ অতঃপর সুভাষচন্দ্র বলেন যে, তিনি গান্ধীজীর দ্বিতীয় নির্দ্দেশক্রমে পূর্বতন সদস্যদের সহিত ঘরোয়া বৈঠকে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা দ্বারা সিদ্ধান্তে পৌঁছিতে যধাসাধ্য চেষ্টা করেন, কিন্তু সে চেষ্টাও ফলবতী হয় নাই। এমতাবস্থায় অনন্যোপায় হইয়া তিনি পদত্যাগ করিলেন। সুভাষচন্দ্রের শেষ কথাগুলি এই,—“আমি গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সম্মুখে যে সমস্যা দেখা দিয়াছে তাহার কোনরূপ সমাধান করা যায় কিনা। যতই ভাবিয়াছি এই কথাই আমার মনে হইয়াছে যে বর্ত্তমান অবস্থায় আমার সভাপতিপদে বহাল থাকাই সমস্যা সমাধানের পথে প্রতিবন্ধক হইয়াছে। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি হয়ত এমন কর্মপরিষদ গঠন করিতে চাহেন যেখানে সভাপতিপদে আমি অনুপযুক্ত বিবেচিত হইব। আমি ইহাও মনে করি যে, নূতন সভাপতি থাকিলে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা অধিকতর সহজ হইবে। কাজেই বিশেষরূপে চিন্তা করিয়া ও বর্ত্তমান অবস্থায় আমার পদত্যাগ মঙ্গলজনক ও কমিটির কার্য্যে সহায়ক হইবে বিবেচনা করিয়াই আমি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে আপনাদের সমক্ষে আমার পদত্যাগ পত্র উপস্থিত করিলাম।”

 শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রসের সভাপতি পদ ত্যাগ করায় কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ পুরী হইতে তারযোগে তাঁহাকে অভিনন্দন জানাইয়াছেন—“অত্যন্ত বিরক্তিকর ও উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থার মধ্যে পড়িয়াও তুমি যে স্থৈর্য্য ও মর্য্যাদা বোধের পরিচয় দিয়াছ তাহাতে তোমার নেতৃত্বের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের উদ্রেক হইয়াছে। আত্মসম্মান রক্ষার জন্য বাঙ্‌লাকে এখনও সম্পূর্ণরূপে ধীরতা ও ভদ্রতাবোধ অব্যাহত রাখিতে হইবে। তাহা হইলেই আপাত দৃষ্টিতে যাহা তোমার পরাজয় বলিয়া মনে হইতেছে তাহাই চিরন্তন জয়ে পরিণত হইবে।”

 সুভাষচন্দ্র সভাপতির পদ ত্যাগ করিলেন। ওয়ার্কিং কমিটির প্রবীণতম সদস্যা সরোজিনী নাইডুকে সভানেত্রীর আসনে বসাইয়া দক্ষিণপন্থীরা লুণ্ঠিতদ্রব্য অশোভন ব্যস্ততার সহিত আত্মসাৎ করিতে লাগিয়া গেলেন! পণ্ডিত জওহরলাল অবশ্য সুভাষচন্দ্রকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে পুনর্ব্বিবেচনা করিতে অনুরোধ করিয়া এক প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন, কিন্তু এই প্রস্তাবের যে কোন ফল হইবে না তাহা একরূপ অবধারিতই ছিল। সুভাষচন্দ্রের পদত্যাগ পত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত না হইতেই ঐ দিনই নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদকে সভাপতি নির্ব্বাচিত করিলেন। রাজেন্দ্রপ্রসাদ কেবল দক্ষিণপন্থীদের লইয়াই ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করিলেন। মিঃ এম, এস্ অ্যানি ও মিঃ এম, এন্, রায় Point of Order তুলিতে গেলে তাঁহাদিগকে বক্তৃতা করিবার সুযোগই দেওয়া হইল না।

 মহাত্মার ইচ্ছানুসারে ওয়ার্কিং কমিটি মনোনয়ন হইয়াছে কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে ডাঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলেন, পন্থ-প্রস্তাব তাঁহার উপর প্রযোজ্য নহে! নেহাৎ চক্ষুলজ্জাবশতঃ পণ্ডিত জওহরলাল প্রথমে ওয়ার্কিং কমিটির সভ্যপদ গ্রহণ করিলেন না—নিরপেক্ষ রহিলেন। কয়েকমাস পরেই অবশ্য তিনি ওয়ার্কিং কমিটিতে প্রবেশ করেন।