বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র/পনের

উইকিসংকলন থেকে

পনের

 ১৯৩৬ সালে লক্ষ্ণৌতে কংগ্রেসের অধিবেশন হইবার কথা। এই অধিবেশন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া বিবেচিত হয়; কেননা, এই অধিবেশনে ১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইন সম্পর্কে মত গ্রহণ করার কথা ছিল। তদুপরি এই অধিবেশনে বামপন্থীদলের বিশেষ করিয়া সমাজতন্ত্রী সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিবার সম্ভাবনা। বামপন্থীদের নেতা হিসাবে জওহরলাল কংগ্রেসের সভাপতি নির্ব্বাচিত হন। সুভাষচন্দ্রকে এই সম্মেলনে দেখিবার জন্য দেশবাসী অত্যন্ত উদ্‌গ্রীব হইয়া উঠে। দেশবাসীর পক্ষ হইতে জওহরলাল দেশবাসীর এই বাসনা সুভাষচন্দ্রকে জ্ঞাপন করেন। সুভাষচন্দ্র দেশে ফিরিবার সিদ্ধান্ত করেন। কিন্তু সরকার পক্ষ হইতে এক আদেশ জারী করিয়া তাঁহাকে জানানো হয় যে, দেশে তিনি মুক্ত অবস্থায় থাকিতে পারিবেন না। সুভাষচন্দ্র এই অন্যায় আদেশ অগ্রাহ্য করিয়া স্বদেশাভিমুখে যাত্রা করেন। যাত্রার প্রাক্কালে তিনি বিলাতের সংবাদ পত্রে এই অদ্ভুত আদেশের প্রতিবাদে এক বিবৃতি প্রচার করেন। ১৯৩৬ সালের ১১ই এপ্রিল কণ্টিভার্ড জাহাজ বোম্বাইয়ের জাহাজ ঘাটে আসিয়া লাগে। বন্দরে লক্ষ লক্ষ নরনারী এই দেশপ্রেমিক বীরের অভ্যর্থনায় দাঁড়াইয়াছিল; কিন্তু, ভারত-ভূমিতে পদার্পণ করিবামাত্রই ১৮১৮ সালের তিন আইনে তিনি বন্দী হইলেন এবং যারবেদা জেলে প্রেরিত হইলেন। গ্রেফ্‌তারের সময় দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি এই আবেগময়ী বাণী দিয়া যান—“স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন রাখুন।”—সুভাষচন্দ্রের গ্রেফ্‌তারের প্রতিবাদে ভারতব্যাপী দারুণ অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। ১০ই মে তাঁহার গ্রেফ্‌তারের প্রতিবাদে “নিখিল ভারত সুভাষ দিবস” প্রতিপালিত হয়।

 শীঘ্রই ভারতবর্ষ ও ইংলণ্ডে এমন তুমুল আন্দোলনের সৃষ্টি হয় যে গভর্ণমেণ্ট তাঁহাকে বেশীদিন আটক রাখিতে পারিলেন না। ইতিমধ্যে ২০শে মে তাঁহাকে যারবেদা জেল হইতে স্থানান্তরিত করিয়া কার্শিয়াং এর গির্দ্দা পাহাড়ে শরৎচন্দ্র বসুর বাড়ীতে অন্তরীণ রাখা হয়—সেখান হইতে চিকিৎসার জন্য ১৭ই ডিসেম্বর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। অবশেষে সুদীর্ঘ পাঁচ বৎসরকাল বন্দীজীবনের পর ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দের ১৭ই মার্চ্চ সুভাষচন্দ্র বিনাসর্ত্তে মুক্তি লাভ করেন। তখনও তাঁহার শরীর সুস্থ হয় নাই। প্রায় ১মাস কাল তিনি কলিকাতায় ডাঃ নীলরতন সরকারের চিকিৎসাধীনে থাকিয়া বায়ু পরিবর্ত্তনের জন্য পাঞ্জাবের ডালহৌসী পাহাড়ে যান এবং সেখানে ডাঃ ধরমবীরের গৃহে পাঁচ মাস কাল কাটাইয়া কলিকাতায় আসেন। এই সময় কলিকাতায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হইতেছিল। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের পর তিনি চতুর্থবার ইউরোপ যাত্রা করেন। ছাত্রজীবনের পর ইহাই তাঁহার প্রথম স্বাধীনভাবে ইয়োরোপ ভ্রমণ। ১৯৩৮ সালের ১০ই জানুয়ারী তিনি ইংলণ্ড পৌঁছেন। লণ্ডনে তাঁহাকে রাজোচিত সম্বর্দ্ধানা জ্ঞাপন করা হয়। সেখানে পার্লামেণ্টের বহু বিশিষ্ট সদস্যের সহিত তিনি ভারতীয় সমস্যা সম্বন্ধে বিশেষভাবে আলোচনা করেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন যে, কংগ্রেস সরকার-কল্পিত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালাইবে। লণ্ডনে আয়ার্ল্যাণ্ডের রাষ্ট্রপতি ডি, ভ্যালেরার সহিত তাঁহার দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়।

 ১৯৩৮ খৃষ্টাব্দের ১৮ই জানুয়ারী কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারী আচার্য্য কৃপালনী ঘোষণা করেন যে, সুভাষচন্দ্র হরিপুরায় নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের ৫১তম অধিবেশনের সভাপতি নির্ব্বাচিত হইয়াছেন। সেই বৎসর সভাপতি পদের জন্য শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ও খান আবদুল গফুর খাঁন—এই চারিজনের নাম প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু অন্যান্য সকলেই সুভাষচন্দ্রের পক্ষে তাঁহাদের নাম প্রত্যাহার করেন ও সুভাষচন্দ্র বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্ব্বাচিত হন। ২৪শে জানুয়ারী সুভাষচন্দ্র লণ্ডন হইতে কলিকাতায় প্রত্যাবর্ত্তন করেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সমরে আপোষহীন সংগ্রামের শ্রেষ্ঠ সৈনিক অক্লান্তকর্ম্মী এই বিপ্লবী তরুণকে রাষ্ট্রপতি পদে বরণ করিয়া দেশবাসী স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ লক্ষ শহিদকে সন্মানিত করেন ও কংগ্রেসের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে আরও মহিমামণ্ডিত করিয়া তোলেন। দুঃখনির্য্যাতনকে হাসিমুখে বরণ করিয়া যে শক্তিধর পুরুষ কঠোর অগ্নপরীক্ষায় সমুত্তীর্ণ হইয়াছেন আজ দেশবাসী তাঁহার গৌরবোন্নত শিরে বিজয় মুকুট পরাইয়া দিল। ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় জীবনস্পন্দনের মহাকেন্দ্র নিখিল ভারত জাতীয় মহাসভার সভাপতি পদ পরাধীন ভারত সন্তানের পক্ষে শ্রেষ্ঠ সম্মান—সুভাষচন্দ্র এই সম্মানেরঅধিকারী হইয়া বাঙালীর মুখোজ্জ্বল করিলেন।

 ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে দুইটি স্রোত বহিয়া চলিয়াছে। একটি স্রোতের অগ্রভাগে রহিয়াছে পুঁজিপতি, জমিদার ও মিলমালিকগণ। বৃটিশ ব্যবসায়ীদের সমান সুযোগ হইতে বঞ্চিত হওয়ার ফলে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ইঁহাদের আক্রোশ। এদেশে কলকারখানা স্থাপন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের তুল্য অধিকার যাহাতে পাওয়া যাইতে পারে তজ্জন্য বৃটিশরাজসরকারের নিকট হইতে সুবিধা আদায় করিবার জন্যই ইঁহারা সরকার বিরোধী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কংগ্রেসে যোগদান করে। অন্যদিকে জাতীয় আন্দোলনের দ্বিতীয় ধারায় রহিয়াছে দেশের অগণিত কৃষক, মজুর, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়—যাহাদের নিকট স্বাধীনতার অর্থ কেবল বৃটিশশাসন হইতে মুক্ত হওয়াই নহে, বিদেশী শোষক শ্রেণীর স্থলে স্বদেশী শোষক শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা নহে। তাহাদের নিকট স্বাধীনতার অর্থ দেশে শোষনহীন শ্রেণীহীন সমাজ-ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন। এই দলের মধ্যেই সর্ব্বপ্রথম বৈপ্লবিক চেতনা জাগ্রত হয় এবং ইহারাই বৈল্পবিক কর্ম্মপন্থা অনুসরণ করিয়া আপোষহীন সংগ্রাম চালাইতে থাকে। সুভাষচন্দ্র ইহাদেরই পুরোভাগে থাকিয়া এই বৃহৎ শক্তিকে একটি সুনির্দ্দিষ্ট কর্ম্মধারায় পরিচালিত করেন। তিনি দেশের সম্মুখে আজীবন পূর্ণ স্বাধীনতার আদর্শ তুলিয়া ধরিয়াছেন ও আপোষধীন রণনীতি অকুণ্ঠভাষায় প্রচার করিয়াছেন। বিপ্লবী গণশক্তি তাঁহাকে সেনাপতি হিসাবে গ্রহণ করিয়াছে। তাই তাঁহাকে রাষ্ট্রপতি পদে বরণ করায় যে কেবল একজন বহুনির্য্যাতিত অক্লান্তকর্ম্মী সর্ব্বত্যাগী মুক্তি সাধককে গৌরবান্বিত করা হইল তাহাই নহে, সুভাষচন্দ্র যে বামপন্থী কর্ম্ম-পন্থায় বিশ্বাসী সেই নীতিও জয়যুক্ত হইল। হয়ত কংগ্রেস কর্ত্তৃপক্ষ ভাবিয়াছিলেন সুভাষচন্দ্রকে সভাপতিপদে অভিষিক্ত করিলে সুভাষচন্দ্রও জওহরলালের ন্যায় আজন্মার্জ্জিত বিশ্বাস ও আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়া কংগ্রেসের বৃহৎ নেতৃত্বের একান্ত বাধ্য ভক্ত হইয়া পড়িবেন—কিন্তু তাঁহাদের সে আশা পূর্ণ হয় নাই। সুভাষচন্দ্রের বজ্রাদপি কঠোর ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব কাহারও নিকট কোন কারণেই আত্মবিক্রয় করিতে জানে না।