বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র/ষোল

উইকিসংকলন থেকে

ষোল

 ১৯৩৮ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী জাতীয় মহাসভার ৫১তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তাপ্তী নদীর তীরে হরিপুর গ্রামে এই বিরাট অধিবেশনের আয়োজন হয়। ২৪শে জানুয়ারী সুভাষচন্দ্র বিমানযোগে ইউরোপ হইতে ভারতবর্ষে তকরিলে করাচী বিমান ঘাঁটিতে দেশবাসী এই নবনির্ব্বাচিত সভাপতিকে বিপুল সম্বর্দ্ধনা জ্ঞাপন করেন। ১৪ই ফেব্রুয়ারী ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হইবার কথা। ১১ই ফেব্রুয়ায়ী জাতীয় অধিবেশনে পৌরোহিত্য করিবার নিমিত্ত সুভাষচন্দ্র কলিকাতা হইতে বোম্বাই মেলযোগে হরিপুরা যাত্রা করেন। ১৩ই ফেব্রুয়ারী বার্দ্দৌলী ষ্টেশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি দরবার গোপাল দাস দেশাই ও সর্দ্দার প্যাটেল তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। অতঃপর তাঁহাকে মোটর যোগে হরিপুরা গ্রামে স্বর্গত কালুভাই প্যাটেলের গৃহে লইয়া যাওয়া হয়। সেখানে বাসন্তী রঙের সাড়ি পরিহিতা একশত স্বেচ্ছাসেবিকা ও সমাগত স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ নবীন রাষ্ট্রপতিকে সম্বর্দ্ধনা করেন। একদল বালিকা তাঁহার কপালে কুমকুম পরাইয়া আরতি সহযোগে তাঁহাকে বন্দনা করে। তৎপর সুভাষচন্দ্র ও দরবার গোপাল দাস একান্নটি বলিবর্দ্দ বাহিত একখানি সুসজ্জিত নানালঙ্কারপরিশোভিত রথে আরোহন করিয়া অধিবেশন মণ্ডপের দিকে অগ্রসর হন। সেই রথের পশ্চাতে ছয়খানি শকটে সর্দ্দার প্যাটেল ও অভ্যর্থনা সমিতির অন্যান্য কর্ম্মকর্ত্তারা অনুগমন করেন। চার মাইল দীর্ঘ এই শোভাযাত্রার প্রতি পংক্তিতে দশজন করিয়া লোক ছিল। পথের উভয় পার্শ্বে পল্লীবাসী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা বিপুল হর্ষধ্বনি সহকারে শোভাযাত্রীদের অভিনন্দিত করিতেছিল। শোভাযাত্রা সভামণ্ডপে পৌঁছিতে দুইঘণ্টা লাগে। শোভাযাত্রা সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বলেন, “বিরাট জনতা আমাকে যে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করিয়াছে, তাহা আমাকে অভিভূত করিয়াছে। এই শোভাযাত্রার বর্ণনা প্রদান করা আমার পক্ষে সম্ভব নহে।” স্বর্গত বিটলভাই প্যাটেলের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্ত অধিবেশন মণ্ডপের নাম রাখা হয় ‘বিটল নগর’। কংগ্রেসের ৫১তম অধিবেশনকে স্মরণীয় করিবার জন্য মণ্ডপের ৫১টি তোড়নে ৫১টি জাতীয় পতাকা উড়িতে থাকে, ৫১টি জাতীয় সঙ্গীত গীত হয়, এবং ৫১টি বলিবর্দ্দ কর্ত্তৃক সভাপতির রথ বাহিত হয়।

 ১৯শে ফেব্রুয়ারী অপরাহ্ণে বিচিত্র সমারোহে ও মনোহর দৃশরাজির মধ্যে ‘বিটলনগরে’ ভারতীয় জাতীয় মহাসভার ৫১তম অধিবেশন আরম্ভ হয়। সুভাষচন্দ্র এই জাতীয় যজ্ঞের ঋত্বিক। ভারতের বিভিন্ন স্থান হইতে আগত দুই লক্ষাধিক নর-নারীর সমাবেশে ‘বিটলনগর’ জনসমুদ্রে পরিণত হইয়াছে। বাঙ্‌লার একদল গায়িকা কর্ত্তৃক সুললিত কণ্ঠে বন্দেমাতরম্ সঙ্গীত গীত হওয়ার পর অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি গোপালদাস সমাগত প্রতিনিধি ও দর্শক বৃন্দকে সাদর সম্ভাষণ জানাইয়া তাঁহার সংক্ষিপ্ত অথচ চিত্তাকর্ষক অভিভাষণ পাঠ করেন। অতঃপর বিপুল জয়ধ্বনির মধ্যে মাল্যবিভূষিত রাষ্ট্রপতি বক্তৃতামঞ্চে আরোহণ করেন। শ্রোতৃবৃন্দ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাঁহার জ্ঞানগর্ভ অভিভাষণ শ্রবণ করে।

 হরিপুরা কংগ্রেসে রাষ্ট্রপতি সুভাষচন্দ্রের অভিভাষণের সারমর্ম নিয়ে প্রদত্ত হইল:—

 সাম্রাজ্যের পরিণতি—গ্রেট-ব্রিটেনের প্রতি সতর্কবাণী— মানব-ইতিহাসে সাম্রাজ্যসমূহের উত্থান-পতনই সর্ব্বপ্রথম আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রাচ্যের মত প্রতীচ্যের ক্রমবর্দ্ধমান সাম্রাজ্যসমূহ একসময় উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করিয়াছে এবং ক্রমশঃ ক্ষীণায়ু হইতে হইতে আবার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হইয়াছে। প্রাচীন যুগের রোমক সাম্রাজ্য এবং বর্ত্তমানযুগের তুর্কী ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যসমূহ এই বিশ্ব-নীতির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ভারতের মৌর্য্য, গুপ্ত ও মুঘল সামাজ্যের ক্ষেত্রেও এই নীতির ব্যতিক্রম হয় নাই। বিশ্বের ইতিহাসের এই সমস্ত দৃষ্টান্তের পরেও, ব্রিটীশ সামাজ্যের ভিন্নরূপ পরিণতি হইবে, ইহা বলিতে কেহ সাহসী হইবেন কি? ইতিহাসের চৌমুহনী রাজপথে আজ ব্রিটীশ সাম্রাজ্য দণ্ডায়মান, ইহাকে অন্যান্য সাম্রাজ্যসমূহের পন্থানুসরণ করিতে হইবে, অথবা স্বাধীন জাতিসমূহের স্বেচ্ছাগঠিত যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হইতে হইবে। এই দুইটির যে কোন পন্থাই ইহার জন্য উন্মুক্ত রহিয়াছে। ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে জারের সাম্রাজ্য ধ্বংস হইয়াছে এবং সেই ধ্বংসস্তুপের ভস্মরাশি হইতেই পুনরায় সােভিয়েট রাশিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে। গ্রেট বৃটেনের পক্ষে রাশিয়ার ইতিহাস হইতে শিক্ষালাভের এখনও অবকাশ রহিয়াছে। বৃটেন ইহার সুযােগ গ্রহণ করিবে কি? ব্রিটীশ সাম্রাজ্য আজ নানাবিধ প্রভাবে প্রপীড়িত। বর্ত্তমানে বৃটেন ‘সমুদ্রের রাণী’ বলিয়া গর্ব্ব করিতে পারে না। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে নৌ-শক্তির বলেই বৃটেনের অভ্যুত্থান হইয়াছিল। বিমান-শক্তির অভাবেই বিংশ শতাব্দীতে বৃটেনের প্রাধান্য বিনষ্ট হইয়াছে এবং বিশ্বরাজনীতি-ক্ষেত্রে ক্ষমতার সামঞ্জস্য রক্ষার নীতি গুরুতররূপে পর্য্যুদস্ত হইয়াছে। বিরাট ব্রিটীশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূল আজ যেরূপ শিথিল হইয়াছে পূর্ব্বে কখনও এইরূপ হয় নাই।

 ভারতবর্ষের সুযােগ—বিশ্বশক্তিসমূহের বর্ত্তমান ঘাত-প্রতি ঘাত—বিশ্ব-পরিস্থিতির এই সঙ্কট মুহূর্ত্তে ভারতবর্ষ আজ নবতর শক্তি সঞ্চয় করিয়াছে। বিরাট মহাদেশ-সদৃশ আমাদের জন্মভূমিতে পঁয়ত্রিশ কোটি লােকের বাস। দেশের এই বিপুল লােকসংখ্যা ও বিরাট পরিধি এতাবৎকাল আমাদের দুর্ব্বলতার কারণ ছিল। আজ যদি সম্মিলিত হইয়া আমরা শাসকসম্প্রদায়ের সম্মুখীন হইতে পারি, তবে উহা আমাদের বর্দ্ধিত শক্তিরই প্রমাণ দিবে। ভারতের এই ঐক্যের বিষয় উল্লেখের সময় আমাদিগকে সর্ব্বাগ্রে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, ব্রিটীশভারতের সহিত দেশীয় রাজ্যের জনসাধারণের বিভেদের সীমারেখা কৃত্রিম। ভারতবর্ষ অখণ্ড এবং ব্রিটীশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যের জনসাধারণের আশাআকাঙ্ক্ষার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা লাভই আমাদের সকলের আদর্শ। যে গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যসমূহ স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করিতে পারে, আমার মতে, তাহার মধ্য দিয়াই এই স্বাধীনতা লাভ করা যাইবে। গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্ত্তনের জন্য দেশীয় রাজ্যের জনসাধারণ যে আন্দোলন করিতেছেন কংগ্রেস উহা সমর্থন করিয়া সহানুভূতি জ্ঞাপন করিয়াছেন। বর্ত্তমানে ইহার অতিরিক্ত কোন সাহায্য প্রদানে কংগ্রেস সক্ষম না হইলেও, কংগ্রেসকর্ম্মীদের পক্ষে দেশীয় রাজ্যের আন্দোলনে ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করিবার কোন বিধিনিষেধ নাই। দেশীয় রাজ্যের সহকর্ম্মীরা আমাদের সহানুভূতি ও সাহায্যলাভের আশায় রহিয়াছেন, ইহা যেন আমরা বিস্মৃত না হই।

 সংখ্যালঘুসম্প্রদায়ের সমস্যা—ভারতের ঐক্যের বিষয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সমস্যার উল্লেখ করিতে হয়। কংগ্রেসের এতৎসম্পর্কিত নীতি বহুবার ঘোষিত হইয়াছে। ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে কলিকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি যে প্রস্তাব গ্রহণ করেন, তাহাতে ভ্রান্তধারণার সৃষ্টি ও কংগ্রেসনীতি বিকৃত হওয়ায় নিখিল ভারত, কংগ্রেস কমিটি মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত প্রস্তাবে তাঁহাদের নীতি পুনরায় ঘোষণা করেন। মৌলিক অধিকারঘটিত প্রস্তাবে স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে, লোকের ধর্ম্ম, বিবেক ও সংস্কৃতি বিষয়ক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হইবে না এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় তাঁহাদের ব্যক্তিগত নিয়মকানুন অক্ষুণ্ণ রাখিতে পারিবেন। সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ভারতের ঐক্যের পরিপন্থী ও জাতীয়তার বিরোধী বলিয়া ঘোষণা করা সত্ত্বেও কংগ্রেস বলিয়াছেন যে, সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের অভিমত অনুসারেই ইহার পরিবর্ত্তন করা হইবে। পারস্পরিক আপোষ-মীমাংসার দ্বারা সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার পরিবর্ত্তন সাধনের সুযোগ গ্রহণ করিতে কংগ্রেস সর্ব্বদা উৎসুক।

 সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে নূতন উদ্যমে আত্মনিয়োগ করিবার সময় বর্ত্তমানে সমুপস্থিত। ধর্ম্মবিষয়ে ‘নিজেরা বাঁচিয়া থাক এবং অপরকে বাঁচিতে দাও’—এই নীতি গ্রহণ এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে একটি আপোষ-মীমাংসা করা খুবই সঙ্গত হইবে। সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সমস্যার কথা চিন্তা করিতে মুসলমানদের কথা বড় হইয়া দেখা দিলেও অন্যান্য সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের বিষয়েও যথাযোগ্য মনোযোগ প্রদান করিতে কংগ্রেস ব্যগ্র। অখণ্ড ভারতবর্ষের সর্ব্বশ্রেণীর জনসাধারণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার দাবী লইয়াই আজ কংগ্রেস সংগ্রামরত। কংগ্রেসের অভীষ্টলাভ হইলে ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মত সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়সমূহও উপকৃত হইবে। ভারতের স্বাধীনতালাভে মুসলমানদের শঙ্কিত হইবার কোন কারণ নাই—লাভবান হইবারই বরং সুবিধা রহিয়াছে। বিগত সতের বৎসর ধরিয়া কংগ্রেস তথাকথিত অনুন্নত সম্প্রদায়ের সামাজিক ও ধর্ম্মবিষয়ক অসুবিধা দূরীকরণের নানারূপ চেষ্টা করিতেছে। অদূর ভবিষ্যতে সে সকল অসুবিধা দূরীভূত হইবে, ইহা নিঃসন্দেহে বলিতে পারি।

 ভবিষ্যৎ কর্ম্মপন্থা—এখন আমি কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ নীতি ও কর্ম্মপন্থা সম্বন্ধে কিছু বলিব। জাতীয় সংগ্রামে অহিংস-অসহযোগ অথবা সত্যাগ্রহ কংগ্রেসের কর্ম্মপন্থা হইবে, ইহা আমি দৃঢ়তার সহিত বলিতে পারি। এই অহিংস-অসহযোগ কথাটিকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করিতে হইবে এবং ইহার মধ্যে আইন-অমান্য আন্দোলনও নিহিত থাকিবে। ইহাকে কেবলমাত্র নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ বলা সঙ্গত হইবে না; কারণ, সত্যাগ্রহ বলিতে আমি নিষ্ক্রিয় ও সক্রিয় উভয় প্রকার প্রতিরোধই বুঝিয়া থাকি। তবে এই সক্রিয় প্রতিরােধ সম্পূর্ণ অহিংস ধরণের হইবে। আমাদের সম্মুখে বর্ত্তমানে দুইটি পন্থা রহিয়াছে। পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জ্জন না করা পর্য্যন্ত সংগ্রাম চালনা এবং সংগ্রামের পথে যে সকল ক্ষমতা আমাদের হস্তে আসিবে তাহা গ্রহণে অস্বীকার করা অথবা পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামকালে আমাদের অবস্থিতিকে সুদৃঢ় করা—এই দুই পন্থার একটি পন্থা আমাদিগকে বাছিয়া লইতে হইবে। নীতির দিক দিয়া উভয় পন্থাই গ্রহণযােগ্য। তবে আমরা যে পন্থাই গ্রহণ করি না কেন, ব্রিটীশ সম্পর্কচ্ছেদের প্রতি আমাদের চরম লক্ষ্য থাকিবে। যখন ঐ সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হইবে এবং আমাদের ভারতবর্ষে ব্রিটীশ প্রভুত্ব নিশ্চিহ্ন হইবে, তখনই তাহাদের সহিত মৈত্রীসুচক চুক্তিতে আবদ্ধ হইবার মত আমাদের অবস্থা হইবে। আয়ার্‌ল্যাণ্ডের রাষ্ট্রপতির ন্যায় আমিও বলিতে চাই যে, ব্রিটীশ জনসাধারণের প্রতি আমরা বিন্দুমাত্র বৈরীভাব পােষণ করি না। গ্রেট বৃটেনের সহিত আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ণয় করিবার অধিকার অর্জ্জনের নিমিত্ত আমরা সংগ্রাম করিতেছি। আমাদের আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভের পর ব্রিটীশ জনগণের সহিত সখ্যসূত্রে আবদ্ধ না হইবার কোন কারণই নাই।

 স্বাধীনতা লাভের পর কংগ্রেসের কর্ত্তব্য—জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে কংগ্রেসের অবস্থিতি কোথায়—অনেক কংগ্রেসকর্ম্মীর মনেই এই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নাই। আমি জানি, আমাদের বহু বন্ধুর মনে এইরূপ ধারণা আছে যে, ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর কংগ্রেসের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইয়া যাইবে এবং উহার আর কোন অস্তিত্ব থাকিবে না। আমি বলিতে চাই যে, স্বাধীনতা লাভের পরও কংগ্রেসের অস্তিত্ব মুছিয়া যাইবে না—বরং তখনই কংগ্রেসকে শক্তি, দায়িত্ব ও শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার গুরুভার গ্রহণ করিতে হইবে এবং পুনর্গঠনমূলক কর্ম্মসূচীকে কার্য্যকরী করিতে হইবে। জোর করিয়া কংগ্রেসের মূলে কুঠারাঘাত করিলে দেশব্যাপী অনর্থের সৃষ্টি হইবে। মহাযুদ্ধের পরবর্ত্তী ইউরোপের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলে দেখা যায় যে, যে সকল দেশে শক্তিশালী দল পুনর্গঠনকার্য্যে আত্মনিয়োগ করিয়াছে, সেই সকল দেশে জাতীয় অগ্রগতি অব্যাহত রহিয়াছে।

 কংগ্রেস ও সমাজিক পুনর্গঠন—ভবিষ্যৎ সমাজ-গঠন ব্যবস্থার বিস্তৃত বিবরণ প্রদান বর্ত্তমানে সম্ভব না হইলেও, আমার বিশ্বাস এই যে, কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতির দ্বারাই দারিদ্রমোচন, নিরক্ষরতা ও ব্যাধি দূরীকরণ এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যবস্থা সম্পর্কিত আমাদের প্রধান জাতীয় সমস্যাসমূহের সমাধান হইতে পারে। এই পুনর্গঠন কার্য্যে আমাদের ভবিষ্যৎ জাতীয় সরকারকে সর্ব্বাগ্রে একটি কমিশন নিয়োগ করিতে হইবে। এই কমিশন জাতিগঠনের ব্যাপক কর্ম্মপন্থা নির্দ্ধারণ করিবেন। কমিশন কর্ত্তৃক নির্দ্ধারিত কর্ম্মপন্থার দুইটি অংশ থাকিবে। প্রথম অংশে অবিলম্বে কার্য্যে পরিণত করিবার উপযোগী একটি কর্ম্মপন্থা এবং দ্বিতীয় অংশে, কিছুকাল যাবৎ অনুসরণের যোগ্য অপর একটি কর্ম্মপন্থা থাকিবে। প্রথম অংশ রচনার সময় নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখিতে হইবে:—

 (১) আত্মত্যাগের জন্য দেশকে প্রস্তুত করা,

 (২) দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা,

 (৩) ব্যক্তিগত ও সংস্কৃতিগত স্বাধীনতা।

 যে বৈদেশিক শাসনের ফলে আমরা আজ পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও হেয় অবস্থায় পতিত, আমাদের স্কন্ধ হইতে সেই গুরুভার অপসারণের পর সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখিবার নিমিত্ত বিশেষ সচেষ্ট হইতে হইবে। জাতীয় ঐক্যবৃদ্ধির নিমিত্ত একটি সাধারণ বর্ণমালা ও রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রবর্ত্তন প্রয়োজন। অতঃপর বিমান, টেলিফোন, বেতার, চলচ্চিত্র, টেলিভিসন প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে ভারতের বিচ্ছিন্ন অংশকে একত্রিত করিয়া একটি সাধারণ শিক্ষানীতির দ্বারা জনসাধারণের মধ্যে জাতীয় ভাবের প্রবর্ত্তন করিতে হইবে। সাধারণ বর্ণমালা প্রবর্ত্তনের বিষয় আমি পুনরায় বলিতেছি। যাহাতে পৃথিবীর অন্যান্য জাতির নিকটবর্ত্তী হইতে পারি আমাদিগকে এইরূপ একটি বর্ণমালা গ্রহণ করিতে হইবে। রোমান বর্ণমালা প্রবর্ত্তনের কথা বলিলে অনেকেই হয়ত আতঙ্কিত হইবেন; কিন্তু বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা আমি তাদিগকে এই সমস্যাটি বিবেচনা করিতে সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ জানাইতেছি। দেশের শতকরা নব্বইজন লোক অশিক্ষিত এবং তাহারা কোন বর্ণমালার সহিত পরিচিত নহে। এইরূপ ক্ষেত্রে যে বর্ণমালাই প্রবর্ত্তন করি না কেন, তাহাতে তাহাদের কোন ক্ষতি হবে না। রোমান বর্ণমালা গ্রহণের ফলে তাহারা অনায়াসে আর একটি ইউরোপীয় ভাষা শিক্ষা করিতে পারিবে—এই বিষয়ে চিন্তা করিবার জন্য আমি দেশবাসীকে অনুরোধ করিতেছি। রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আমার অভিমত এই যে, হিন্দী ও উর্দ্দুর মধ্যে পার্থক্য কৃত্রিম —সুতরাং, এতদুভয়ের সংমিশ্রণেই আমাদের রাষ্ট্রভাষার সৃষ্টি হওয়া উচিত।

 দারিদ্র্য দূরীকরণই পুনর্গঠনকার্য্যে আমাদের প্রধান ও প্রাথমিক কর্ত্তব্য হইবে। এতদুদ্দেশ্যে ভূমি-ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ও জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ প্রয়োজন। কৃষি-ঋণ মকুব করিতে হইবে এবং পল্লীবাসীদের জন্য অল্পসুদে অর্থসাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করিতে হইবে। উৎপাদক ও গ্রাহক উভয়ের সুবিধার নিমিত্ত সমবায় আন্দোলনের প্রসারের চেষ্টা করিতে হইবে। অধিকতর ফসল উৎপাদনের জন্য বৈজ্ঞানিক প্রথায় কৃষিকার্য্যের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

 একমাত্র কৃষি-ব্যবস্থার উন্নতির দ্বারা জাতির অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হইবে না; রাষ্ট্রীয় অধিকারে ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে শিল্পবাণিজ্যের প্রসারও প্রয়োজন। ভারতের অভ্যন্তরে বৈদেশিক শাসন বিদ্যমান থাকিবার এবং বাহিরে শিল্পবাণিজ্যের প্রসার হইবার ফলে, এই দেশের পুরাতন শিল্পবাণিজ্য-পদ্ধতি ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। উহার স্থলে নূতন পদ্ধতি গ্রহণ প্রয়োজন। আধুনিক ফ্যাক্টরীসমূহের প্রতিযোগিতা বিরাজমান থাকা সত্বেও কোন্ কোন্ কুটীর-শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা হইবে এবং ব্যাপকভাবে উৎপাদনের নিমিত্ত কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করা হইবে, পুনর্গঠন কমিশন তাহা নির্দ্ধারণ করিবেন। এই কমিশনের সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রকে আমাদের কৃষি ও শিল্প ব্যবস্থাকে উৎপাদন ও ব্যবহারের উভয়ক্ষেত্রেই সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুযায়ী পুনর্গঠিত করিতে হইবে। যেই প্রকারেই হউক, অর্থ সংগ্রহ করিয়া এই কার্য্যে অতিরিক্ত মূলধন নিয়োজিত করিতে হইবে।

 কংগ্রেস মন্ত্রিমণ্ডলী—ভারতের এগারটি প্রদেশের মধ্যে সাতটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিত্বভার গ্রহণ করিয়ছেন। অতএব নূতন শাসনতন্ত্রের প্রাদেশিক অংশে বিরোধিতার সম্ভাবনা নাই। ইহার ফলে কংগ্রেসকে কেবলমাত্র সঙ্ঘবদ্ধ ও শক্তিশালী করা যাইতে পারে। কংগ্রেসী মন্ত্রিমণ্ডলের আমলে কিরূপে কংগ্রেসকে শক্তিশালী করা সম্ভব? সর্ব্বপ্রথম আমলাতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্ত্তন সাধন করিতে হইবে; ইহা অসম্ভব হইলে কংগ্রেসের পক্ষে দুঃখের কারণ হইতে পারে। দ্বিতীয়ত, কংগ্রেসী মন্ত্রিগণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাদক দ্রব্য বর্জ্জন, কারা-সংস্কার, সেচ-শিল্পবাণিজ্য-ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার, শ্রমিক ও কৃষিমঙ্গল প্রভৃতি বিষয়ে জাতিগঠনমূলক পন্থা অবলম্বন করিবেন। এই সমস্ত বিষয়ে ভারতের সর্ব্বত্র অনুরূপ ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন সঙ্গত। দুইটি উপায়ে এই ঐক্য-ব্যবস্থা বাস্তবে পরিণত হইতে পারে। প্রথমতঃ, বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রেসী মন্ত্রিগণ সম্মিলিত হইয়া একটি সমভাবাপন্ন কর্ম্মপন্থা নিদ্ধারণ করিতে পারেন; দ্বিতীয়তঃ, বিশেষজ্ঞগণের পরামর্শানুসারে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বিভিন্ন সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে সাহায্য করিতে পারেন। ইহা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে বিভিন্ন সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে সহায়তা করিবার সময় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যগণকে উক্ত প্রদেশসমূহের বিভিন্ন সমস্যার সহিত পরিচিত থাকিতে হইবে। এই প্রসঙ্গে কিছু বলিতে চাই। এই কমিটি কেবলমাত্র ভারতের মুক্তি সংগ্রামের সৈন্যদল নিয়ন্ত্রণ-সঙ্ঘ নহে, ইহা স্বাধীন ভারতের মন্ত্রিসভা। সেইজন্য ওয়ার্কিংকমিটিকে স্বাধীন ভারতের প্রাক্-মন্ত্রিসভার ন্যায় কার্য্য করিতে হইবে। রাষ্ট্রপতি ডি, ভ্যালেরার প্রজাতন্ত্র যখন ব্রিটীশ সরকারের সহিত সংগ্রামলিপ্ত ছিল, তখন তাঁহারাও এইরূপ পন্থা অবলম্বন করিয়াছিলেন। শাসনাধিকার লাভের পূর্ব্বে মিশরের ওয়াকফদলও এইরূপ নীতি গ্রহণ করিয়াছিল।

 ওয়ার্ধা প্রস্তাব—প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনার বিরোধিতা— প্রাদেশিক কংগ্রেসী মন্ত্রিমণ্ডলের কার্য্যপরিচালনা অপেক্ষা নূতন শাসনতন্ত্রের যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনাকে কিভাবে বাধা দান করিতে হইবে, তাহা বিবেচনার আশু প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে। ওয়ার্কিং কমিটির বিগত ৪ঠা ফেব্রুয়ারীর ওয়ার্দ্ধা অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনা সম্পর্কিত কংগ্রেসের মনোভাব সুস্পষ্ট ব্যক্ত হইয়াছে। বিষয়নির্ব্বাচনী সমিতি কর্ত্তৃক বিবেচিত হইবার পর এই প্রস্তাবটি বর্ত্তমান অধিবেশনে আলোচিত হইবে।

 যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনার প্রতি বিরুদ্ধভাব পোষণের কারণ সম্পর্কে আমি দুই একটি কথা বলিতেছি। নুতন শাসনতন্ত্রের বাণিজ্য ও অর্থবিষয়ক রক্ষাকবচগুলিই এই পরিকল্পনার প্রতি আমাদের বিরুদ্ধভাব পোষণের অন্যতম কারণ। কেবলমাত্র দেশরক্ষা বিভাগ ও পররাষ্ট্র নীতিতে জনসাধারণের অধিকার থাকিবে না এমন নহে, ইহাতে সরকারের ব্যয়ের অধিকাংশ অংশের উপর জনগণের প্রতিনিধিবর্গের বিন্দুমাত্র কর্ত্তৃত্ব থাকিবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের ১৯৩৭-৩৮ খৃষ্টাব্দের বাজেট প্রস্তাব অনুসারে সরকারের মোট ব্যয়ের শতকরা সাতান্ন ভাগই সেনাদলের জন্য নির্দ্ধারিত হইয়াছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সংরক্ষিত অংশ বড়লাট কর্ত্তৃক নিয়ন্ত্রিত হইবে তাহা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়ের শতকরা আশী ভাগ। ইহা ব্যতীত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, যুক্তয়াষ্ট্রীয় রেল বিভাগ প্রভৃতি ব্যবস্থাতন্ত্র ইতিমধ্যেই গঠিত হইয়াছে; উহা যুক্তরাষ্ট্রের নামমাত্র অধীনে পরিচালিত হইবে। রেল বিভাগের নীতি সম্পর্কে আইনসভার কোন কর্ত্তৃত্ব থাকিবে না;—মুদ্রানীতি ও বাটার হার নির্দ্ধারণের ব্যাপারটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির মূলকথা হইলেও তাহার উপর এই আইনসভার কোন কর্ত্তৃত্বই থাকিবে না। পররাষ্ট্রবিষয়ক ব্যাপারগুলি প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রে সংরক্ষিত বিষয় বলিয়া বিবেচিত হইবে। ইহাতে অন্যান্য রাষ্ট্রের সহিত বাণিজ্য-চুক্তি করিবার সাধারণ স্বাধীনতাটি পর্য্যন্ত ভারতীয় আইনসভাকে প্রদান করা হয় নাই। এতদ্বারা আর্থিক স্বাধীনতা গুরুতররূপে ক্ষুণ্ণ হইয়াছে। ভারত শাসন আইনে যে সকল বাণিজ্যসংক্রান্ত অসম-সংরক্ষণ ব্যবস্থার নির্দ্দেশ আছে, তাহাতে ভারতের জাতীয় শিল্প-বাণিজ্যও যখন ব্রিটীশ স্বার্থের প্রতিকূল হইবে (উহা সর্ব্বদাই হইতে বাধ্য), তখন কোনরূপ ব্যবস্থার দ্বারা ঐগুলিকে রক্ষা করা বা উহার প্রসারে সহায়তা করা সম্ভব হইবে না। এই ভারত শাসন আইনে যে সকল অসমঞ্জস বাণিজ্যিক নীতি আছে, তাহা যথযথ প্রতিপালিত হইতেছে কিনা তাহা দেখিবার জন্য বড়লাটের বিশেষ ক্ষমতা রহিয়াছে। ইহা ছাড়া যদি কখন কোন ব্রিটীশ-পণ্যের উপর অতিরিক্ত আমদানী-শুল্ক ধার্য্যকরণ বা অন্য কোন প্রকারে উহার আমদানী সম্পর্কে কড়াকড়ি ব্যবস্থা করিবার প্রস্তাব হয়, তবে বড়লাট উহা অগ্রাহ্য করিয়া দিতে পারেন। এই সমস্ত ব্যবস্থা হইতে প্রতীয়মান হয় যে, বড়লাটের বিশেষ ক্ষমতাবলে বাতিলের বহির্ভূত ব্রিটীশ স্বার্থবিরোধী কোন প্রস্তাব আইন পরিষদে বা শাসনতন্ত্রের অন্য যে কোন ক্ষেত্রে হইতে পারিবে না। দেশীয় শিল্প-বাণিজ্য রক্ষাকল্পে জাতীয় প্রচেষ্টার মধ্যে প্রয়োজনমত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা প্রবর্ত্তনের অধিকার আমরা কোনক্রমেই ত্যাগ করিতে পারি না।

 বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি—আর্থিক স্বাধীনতা ও বাণিজ্যবিষয়ক সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিষয় আলোচনা প্রসঙ্গে ভারতের পক্ষে অত্যাবশ্যকীয় একটি কার্য্যকরী বৈদেশিক বাণিজ্যনীতির কথা বলিব। ভারতের রপ্তানী-বাণিজ্য ও ইহার বৈদেশিক বাধ্যবাধকতার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া ব্যাপকভাবে ঐরূপ নীতির বিবেচনা করিতে হইবে। অন্যান্য রাষ্ট্রের সহিত ভারতের বাণিজ্য-চুক্তি সাধন দুর্ঘট হয় অথবা সম্রোজ্যের বাহিরের যে সমস্ত দেশ ভারতীয় পণ্যের ক্রেতা তাহাদের সহিত ব্যবসাক্ষুণ্ণকর কোনপ্রকার চুক্তি ইংলণ্ডের সহিত করা সঙ্গত হইবে না। ভারতের বহির্বাণিজ্যের পক্ষে ইহা একান্ত আবশ্যক। দুঃখের বিষয়, এখনও ইঙ্গভারতীয় বাণিজ্য-আলোচনা চলিতেছে; পক্ষান্তরে অটোয়া চুক্তির নোটিশের কাল উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে এবং ভারতীয় আইনসভা কর্ত্তৃক নাকচের সিদ্ধান্তসত্ত্বেও উহাকে এখনও বহাল রাখা হইয়াছে। বর্ত্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় ইংলণ্ড ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য-চুক্তি হইলে, ইংলণ্ডের অনুকূলে তুলাদণ্ড ঝুঁকিয়া পড়িবেই। বাণিজ্য-চুক্তির আশ্রয়ে এই দেশে অ-ভারতীয় কায়েমী স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত হইতে দিবার পূর্ব্বে উঠার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও আর্থিক ফলাফল সম্বন্ধেও আমাদিগকে সতর্কতার সহিত বিবেচনা করিতে হইবে। আমি আশাকরি, বর্ত্তমানে যে ইঙ্গ-ভারতীয় বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা চলিতেছে, তাহাতে অন্যান্য রাষ্ট্রের সহিত সরাসরি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনে বাধা উপস্থিত হইবে না এবং ভারতীয় ব্যবস্থা পরিষদ কর্ত্তৃক অনুমোদিত হওয়া পর্য্যন্ত গভর্ণমেণ্ট ঐরূপ কোন চুক্তি স্বাক্ষর করিবে না।

 প্রাদেশিক মন্ত্রিমণ্ডল ও প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় মন্ত্রিমণ্ডলের ক্ষমতার তুলনা করা যায় না। তাহা ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের গঠন অত্যন্ত প্রগতিবিরােধী। দেশীয় রাজ্যসমূহের লােকসংখ্যা সমগ্র ভারতের লােকসংখ্যার শতকরা প্রায় চব্বিশজন মাত্র। তাহা সত্ত্বেও দেশীয় রাজ্যসমূহের নৃপতিগণকে (তাঁহাদের প্রজাবৃন্দকে নহে) যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার নিম্নতর পরিষদে শতকরা তেত্রিশটি ও উচ্চতর পরিষদে শতকরা চল্লিশটি আসন দেওয়া হইয়াছে। এরূপ ক্ষেত্রে আমি মনে করি যে, যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনার প্রতি কংগ্রেসের মনােভাব কখনও পরিবর্ত্তিত হইবার সম্ভাবনা নাই। সরকার যে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা এ দেশের স্কন্ধে চাপাইতে চাহিতেছেন, তাহাতে বাধা প্রদান করিবার সাফল্যের উপরই আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করিতেছে। সর্ব্বপ্রকার বৈধ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমাদিগকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে হইবে—সর্ব্বশেষে আমাদিগকে হয়ত ব্যাপক আইন-অমান্য আন্দোলনের আশ্রয় লইতে হইবে। ভবিষ্যতে যদি এইরূপ ব্যাপক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়, তবে তাহা কেবল ব্রিটীশ ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিবে না, দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের মধ্যেও উহা বিস্তৃতি লাভ করিবে।

 স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী—অদূর ভবিষ্যতে কোন সংগ্রামে অবতীর্ণ হইতে হইলে আমাদিগকে যথাযথভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হইতে হইবে। গত কয়েক বৎসরের মধ্যে জনজাগরণ এরূপ ব্যাপক আকার ধারণ করিয়াছে যে আমাদের দল পরিচালনা সম্পর্কে বহু নূতন সমস্যার উদ্ভব হইয়াছে। বর্ত্তমানে যে কোন সভা-সমিতিতে পঞ্চাশ হাজার নরনারীর সমাবেশ হইরা থাকে। অনেক সময় দেখা গিয়াছে যে এইরূপ সভা ও শােভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত ব্যবস্থা নাই। ইহা ছাড়া এই বিরাট জন-জাগরণকে কেন্দ্রীভূত করিয়া সুনির্দ্দিষ্ট পথে চালিত করিবার বৃহত্তর সমস্যাও বিদ্যমান। এই জন্য আমাদের সুসংবদ্ধ স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী আছে কি? ভবিষ্যৎ নেতৃবৃন্দ ও তরুণ কর্ম্মীদের জন্য আমরা কোনপ্রকার শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়াছি কি? আধুনিক রাজনৈতিক দলের এই সকল প্রয়ােজন মিটাইবার এখন সময় আসিয়াছে। সুশিক্ষিত অধিনায়কবৃন্দ পরিচালিত একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আজ আমাদের বিশেষ প্রয়োজন। রাজনৈতিক কর্ম্মীদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা হইলে ভবিষ্যতে আমরা যোগ্য রাজনৈতিক নেতা লাভ করিতে পারিব। বিলাতে নিদাঘ-বিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে এইরূপ শিক্ষার ব্যবস্থা আছে—এইরূপ শিক্ষাদান একনায়কত্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইউরোপের কোন কোন দেশ কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করিতেছেন, তাহা অবশ্যই লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন। আমাদের আদর্শ ও শিক্ষার প্রণালী তাঁহাদের সহিত সামঞ্জস্যহীন হইলেও, ইহা সর্ব্বজনস্বীকৃত যে আমাদের কর্ম্মীদের জন্য বৈজ্ঞানিক ধারায় সর্ব্বাঙ্গীন শিক্ষাদানের ব্যবস্থা প্রয়োজন। নাৎসীদের শ্রমিক সেবাহিনীর (Labour Service Corps) ন্যায় প্রতিষ্ঠান বিশেষ বিবেচনাযোগ্য এবং উপযুক্তভাবে সংশোধন করিয়া প্রবর্ত্তন করিলে উহা ভারতের পক্ষে কল্যাণকর হইতে পারে।

 কিষাণ সভাসমূহ—সঙ্ঘানুবর্ত্তিতার আলোচনা প্রসঙ্গে আর একটি সমস্যা সম্পর্কেও আমাদিগকে বিবেচনা করিতে হইবে। ভারতীয় জাতীয় মহাসভার সহিত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস ও কিষাণ সভাসমূহের সম্পর্কের কথাই আমি বলিতেছি; উহা আমাদের উদ্বেগের কারণ হইয়াছে। কেহ কেহ কংগ্রেসের বহির্ভূত যে-কোন প্রতিষ্ঠানের নিন্দা করেন এবং কেহ কেহ উহাদের আবশ্যকতা স্বীকার করেন। আমার মতে, উহাদের অস্তিত্ব আমরা পছন্দ করি বা না করি, উহাদের সহিত আমাদিগকে সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া চলিতে হইবে। প্রশ্ন হইতেছে, উহাদের প্রতি কংগ্রেসের কিরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত। রাজনৈতিক অধিকার লাভের সংগ্রামে কংগ্রেস জনগণের প্রতিনিধি। কংগ্রেসের বিরোধীদলরূপে এই সকল প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব স্বীকার করা যাইতে পারে না। সুতরাং, এই সকল প্রতিষ্ঠানকে কংগ্রেসের আদর্শে ও কার্য্যপন্থায় উদ্বুদ্ধ হইয়া কংগ্রেসের সহিত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখিয়া কার্য্য করিতে হইবে। এইজন্য ট্রেড ইউনিয়ন ও কিষাণ সভাসমূহে কংগ্রেস কর্ম্মীবৃন্দের দলে দলে যোগদান কর্ত্তব্য। শ্রমিক ও কৃষকদের আর্থিক দুরবস্থার প্রতি অধিক অবহিত হইয়া ট্রেড ইউনিয়ন ও কিষাণ সভাসমূহ যদি কংগ্রেসকে দেশের মুক্তিসাধনার সার্ব্বজনীন প্রতিষ্ঠানরূপে গণ্য করেন, তবে কংগ্রেস ও উক্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা সহজসাধ্য হইতে পারে। সমষ্টিগত সমর্থন বা সংযোগসাধনের কথা ছাড়িয়া দিলেও, কংগ্রেসের সহিত সমস্ত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা থাকা বাঞ্ছনীয়।

 কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদল গঠনে বহু বিতর্কের সৃষ্টি হইয়াছে। কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদের পক্ষে আমি ওকালতি করিতেছি না এবং আমি উহার সদস্য নহি। তাহা সত্ত্বেও আমি বলিব যে ইহার সাধারণ নীতির সহিত আমি প্রথম হইতেই একমত। প্রথমতঃ, বামপন্থীদের একটি দলে সুসংহত হওয়া বাঞ্ছনীয়। দ্বিতীয়তঃ বামপন্থীদলের প্রকৃতি যদি সমাজতন্ত্রমূলক হয়, তাহা হইলে একটি বামপন্থী ‘ব্লক’ (বিরোধীদল) থাকার সঙ্গত কারণ থাকতে পারে। এইরূপ ‘ব্লক’কে দল বলা হইলে অনেকে আপত্তি করেন। আমার মতে, এইরূপ পার্থক্য সৃষ্টির কোন অর্থ হয় না। ভারতীয় জাতীয় মহাসভার নিয়মতন্ত্র অনুসারে ঐরূপ চরমপন্থী বিরোধীদল গঠন করা কিছুই অন্যায় নহে—উহাকে দল বা লীগ বা ব্লক যে কোন নামই দেওয়া যাইতে পারে। কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদল বা অনুরূপ দলকে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী বা চরমপন্থীদল স্বরূপ কার্য্য করিতে হইবে। সমাজতন্ত্রবাদ আমাদের আশু সমাধানযোগ্য সমস্যা নহে; কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতালাভের পর সমাজতন্ত্রবাদ গ্রহণের জন্য দেশকে প্রস্তুত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক প্রচারকার্য্যের প্রয়োজন রহিয়াছে। সুতরাং সমাজতন্ত্রবাদে আস্থাবান কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদলের দ্বারা সেই প্রচার-কার্য্য চলিতে পারে।

 পররাষ্ট্রনীতি ও বিদেশে প্রচার কার্য্য—গত কয়েক বৎসর যাবৎ একটি সমস্যা সম্পর্কে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ আগ্রহান্বিত। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জ্জাতিক সংযােগ স্থাপনের বিষয় উপস্থিত করাই আমার উদ্দেশ্য। আমার মনে হয় যে আগামী কয়েক বৎসরের মধ্যে আন্তর্জ্জাতিক পরিস্থিতির এরূপ পরিবর্ত্তন ঘটিবে যে তাহা ভারতের মুক্তিসংগ্রামের অনুকুল বলিয়া বিবেচিত হইবে। সেই জন্য বিশ্বপরিস্থিতির প্রত্যেকটি পরিবর্ত্তন সম্পর্কে সচেতন থাকিতে হইবে এবং কিরূপে তাহার সুযােগ গ্রহণ করা যায় তাহা বিবেচনা করিতে হইবে। আমাদের সম্মুখে মিশরের দৃষ্টান্ত রহিয়াছে। কোন প্রকার হিংসাত্মক নীতি গ্রহণ না করিয়া মিশর কিরূপে স্বাধীনতার সন্ধি-চুক্তি আদায় করিতে সমর্থ হইয়াছিল? তাহারা ভূমধ্যসাগরে ইঙ্গ-ইতালীয় বিরােধের সুযােগ গ্রহণ করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া তাহা সম্ভব হইয়াছিল।

 আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আমার প্রথম বক্তব্য এই যে কোন দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা উহার রাষ্ট্রীয় গঠন আমাদিগকে যেন প্রভাবান্বিত না করে। প্রত্যেক দেশেই ভারতের মুক্তি-আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন নরনারী থাকিবেই। প্রত্যেক দেশেই ভারতের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন নরনারীর দল গঠন করিতে হইবে। বিদেশে যে সকল ভারতীয় ছাত্র আছে, তাহারাও আমাদের এই প্রচেষ্টায় সহায়তা করিতে পারে। ভারতীয় ছাত্রদের অভাব-অভিযােগের প্রতি আমরা দৃষ্টি রাখিতে পারিলে, তাহারাও এই বিষয়ে আমাদিগকে সাহায্য করিবে। বিদেশের ভারতীয় ছাত্রগণের সহিত ভারতের জাতীয় মহাসভার ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রাখিতে হইবে। আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত ছায়াচিত্র যদি আমরা বিদেশে পাঠাইতে পারি, তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জনধারণ আমাদের বিষয় অবগত হইবে এবং আমরা তাঁহাদের সহানুভূতি লাভ করিতে সমর্থ হইব। আমাদের এই প্রচেষ্টাকে সার্থক করিয়া তুলিতে হইলে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকায় জাতীয় মহাসভার বিশ্বস্ত প্রতিনিধি নিয়োগ করিতে হইবে। এতদ্ব্যতীত, আন্তর্জ্জাতিক সভা বা সম্মেলনে ভারতবর্ষকে যোগদান করিতে হইবে। এইরূপ সভাসম্মেলনে যোগদানের ফলে ভারতের প্রয়োজনীয় প্রচারকার্য্যের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে এবং বিশ্বজনমতের নিকট ভারতের দাবী স্বীকৃত হইবে।

 এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে—বিশেষতঃ জাঞ্জিবার, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয় ও সিংহলের প্রবাসী ভ্রাতৃবৃন্দের অভাব-অভিযোগ ও সমস্যার বিষয় আমরা যেন বিস্মৃত না হই। তাঁহাদের সম্পর্কে কংগ্রেস সর্ব্বদা গভীর মনোযোগ প্রদান করিয়াছেন এবং ভবিষ্যতেও করিবেন। আমরা এখনও দাস-জীবন যাপন করিতেছি বলিয়া তাঁহাদের জন্য প্রয়োজনানুরূপ কিছু করা হয়ত আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই। স্বাধীন ভারত বিশ্বের রাজনীতিক্ষেত্রে বিরাট শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করিবে; তখন প্রবাসী ভারতীয়দের স্বার্থসংরক্ষণে কোন বাধার সৃষ্টি হইবে না।

 এই প্রসঙ্গে পারস্য, আফগানিস্থান, নেপাল, চীন, ব্রহ্ম, শ্যাম, মালয়, পূর্ব্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও সিংহল প্রভৃতি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত সংস্কৃতিগত ঘনিষ্টতা স্থাপনের আবশ্যকতার উল্লেখ করিতে চাই। এই সমস্ত রাষ্ট্রের সহিত পারস্পরিক পরিচয় ও সহযোগিতা থাকিলে উভয় পক্ষেরই কল্যাণ হইবে। ব্রহ্ম ও সিংহলের সহিত আমাদের সংযোগ বহু যুগের বলিয়া এই দুইটি রাষ্ট্রের সহিত ঘনিষ্ঠতম সংস্কৃতিগত সম্পর্ক রাখিতে হইবে।

 আটক ও রাজনৈতিক বন্দী—এক্ষণে আমি আটক এবং রাজনৈতিক বন্দীদের সমস্যার প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। উহাই বর্ত্তমানে আমাদের প্রধান সমস্যা। বন্দিগণের অনশনের ফলে এই সমস্যাটি জনসাধারণের নিকট আরও সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। তাহাদের আশু মুক্তির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা কর্ত্তব্য। আমার বিশ্বাস, আমার এই মন্তব্যে কংগ্রেসের মনোভাব ব্যক্ত হইবে।

 যে সকল আটক ও রাজনৈতিক বন্দী কারাগারের ভিতরে ও বাহিরে অবরুদ্ধ আছেন, তাঁহারাই কেবল দুঃখভোগ করিতেছেন না; যাঁহারা আজ মুক্তি পাইয়াছেন, তাঁহাদের অবস্থাও অধিকাংশক্ষেত্রে শোচনীয়। যক্ষ্মার মত নানারূপ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হইয়া ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া তাঁহারা গৃহে ফিরিয়াছেন। অনাহারের ভয়াবহ সম্ভাবনা তাঁহাদের সম্মুখে। আত্মীয়পরিজনবর্গের হাসিমুখের অভ্যর্থনার পরিবর্ত্তে, অশ্রুজলের করুণ অভিনন্দন তাঁহারা লাভ করেন। মাতৃভূমির সেবায় জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ উৎসর্গ করিয়া যাঁহারা বিনিময়ে দুঃখ ও দারিদ্র্য লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদের প্রতি কি আমাদের কোন কর্ত্তব্য নাই? অতএব, যাঁহারা দেশপ্রীতির অপরাধে নির্য্যাতন ভোগ করিয়াছেন, তাঁহাদের সকলকে যেন আমরা আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি প্রেরণ করি এবং তাঁহাদের দুঃখলাঘবের সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করি।

 বর্ত্তমান সংকট ও ঐক্যের আহ্বান—বন্ধুগণ! আর একটি বিষয়ের অবতারণা করিয়া আমি আমার বক্তব্য শেষ করিব। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যে যে পার্থক্য বিরাজমান, তাহাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা অর্থহীন। বাহিরে ব্রিটীশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান। আমাদিগকে এই আহ্বানের প্রত্যুত্তর দিতে হইবে। এই সঙ্কটকালে আমাদের কর্ত্তব্য কি? যাত্রাপথের ঝড়ঝঞ্ঝার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দণ্ডায়মান থাকিয়া আমাদিগকে শাসকশ্রেণীর ছলকৌশল বিস্তারের প্রতিরোধ করিতে হইবে। কংগ্রেসই বর্ত্তমানে গণ-সংগ্রামের সার্ব্বভৌম প্রতিষ্ঠান। ইহার মধ্যে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদল থাকিতে পারে—কিন্তু, ইহা ভারতের মুক্তিকামী সমস্ত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতিষ্ঠানের মিলনক্ষেত্র। অতএব, আসুন, ভারতীয় জাতীয় মহাসভার পতাকাতলে সমগ্র জাতিকে সমবেত করুন। কংগ্রেসকে শক্তিশালী ও সঙ্ঘবদ্ধ করুন—বামপন্থীদের প্রতি ইহাই আমার আবেদন। ব্রিটীশ সাম্যবাদীদলের নেতৃবৃন্দের মনোভাবে বিশেষ ভাবে উৎসাহিত হইয়া আমি এই আবেদন করিলাম। ভারতবর্ষ সম্পর্কে ব্রিটীশ সাম্যবাদীদলের সাধারণনীতি কংগ্রেসের নীতির প্রায় অনুরূপ।

 উপসংহারে আপনাদের মনোভাবের প্রত্যভিব্যক্তিস্বরূপ আমি ব্যাকুলভাবে প্রার্থনা করিতেছি যে, জাতির মুক্তির জন্য মহাত্মাজী আরও দীর্ঘকাল জীবিত থাকুন। এই যুগসন্ধিক্ষণে ভারতবর্ষ তাঁহাকে কিছুতেই হারাইতে পারে না। দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ রাখিবার জন্য তাঁহাকে প্রয়োজন, আমাদের সংগ্রামকে হিংসা-দ্বেষ মুক্ত রাখিতে তাঁহাকে প্রয়োজন। ভারতের স্বাধীনতা ও সর্ব্বমানবের কল্যাণের জন্য গান্ধীজীর সাহচর্য্য প্রয়োজন। কেবলমাত্র ব্রিটীশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম নহে— বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম। কেবলমাত্র ভারতের স্বাধীনতার জন্য আমরা সংগ্রাম করিতেছি না— সর্ব্বমানবের মুক্তির জন্য আমরা সংগ্রাম করিতেছি। ভারতের স্বাধীনতার সহিত বিশ্বমানবের মুক্তিসমস্যা বিজড়িত।”