বিষয়বস্তুতে চলুন

বিবিধ কাব্য (১৯৪০)/নীতিগর্ভ কাব্য — গদা ও সদা

উইকিসংকলন থেকে

গদা ও সদা

গদা সদা নামে
কোন এক গ্রামে
ছিল দুই জন।
দূর দেশে যাইতে হইল;
দুজনে চলিল।
ভয়ানক পথ—পাশে পশু ফণী বন,
ভল্লুক শার্দ্দূল তাহে গর্জ্জে অনুক্ষণ।
কালসর্প যেমতি বিবরে,
তস্কর লুকায়ে থাকে গিরির গহ্বরে;
পথিকের অর্থ অপতরে,
কখন বা প্রাণনাশ করে।
কহে সদা গদারে আহ্বানি
কর কিবা পশি মোর পাণি
ধর্ম্মে সাক্ষী মানি,
আজি হতে আমরা দুজন
হ’নু একপ্রাণ একমন,—
সিন্ধু অনুসিন্ধু যথা—জান সে কাহিনী।

আমার মঙ্গল যাহে,
তোমার মঙ্গল তাহে,
কবচে ভেদিলে বাণ, বক্ষ ক্ষত যথা,
অমঙ্গলে অমঙ্গল উভয়ের তথা।
কহে গদা ধর্ম্মসাক্ষী করি,
কিবা মোর তব কর ধরি,
একাত্মা আমরা দোঁহে কি বাঁচি কি মরি।
এইরূপে মৈত্র আলাপনে
মনানন্দে চলিলা দুজনে।
সতর্ক রক্ষকরূপে সদা গদা যেন
বন পাশে একদৃষ্টে চাহে অনুক্ষণ,
পাছে পশু সহসা করয়ে আক্রমণ।
গদা চারি দিকে চায়,
এরূপে উভয়ে যায়;
দেখে গদা সম্মুখে চাহিয়া
থল্যে এক পথেতে পড়িয়া।
দৌড়ে মূঢ় থল্যে তুলি
হেরে কুতূহলে খুলি
পূর্ণ থল্যে সুবর্ণমুদ্রায়,
তোলা ভার, এত ভারি তায়।
কহে গদা সহাস বদনে
করেছিনু যাত্রা আজি আতি শুভক্ষণে
আমরা দুজনে।
‘দুজনে?’ কহিল সদা রাগে,
‘লোভ কি করিস্‌ তুই এ অর্থের ভাগে?
মোর পূর্ব্ব পুণ্যফলে
ভাগ্যদেবী এই ছলে

মোরে অর্থ দিলা।
পাপী তুই, অংশ তোরে
কেন দিব, ক’ তা মোরে
এ কি বাললীলা?
রবির করে রাশি পরশি রতনে
বরাঙ্গের আভা তার বাড়ায় যতনে;
কিন্তু পড়ি মাটির উপরে
সে কর কি কোন ফল ধরে?
সৎ যে তাহার শোভা ধনে,
অসৎ নিতান্ত তুই, জনম কুক্ষণে।
এই কয়ে সদানন্দ থল্যে তুলে লয়ে
চলিতে লাগিলা সুখে অগ্রসর হয়ে।
বিস্ময়ে অবাক্‌ গদা চলিল পশ্চাতে,
বামন কি কভু পায় চারু চাঁদে হাতে?
এই ভাবি অতি ধীরে ধীরে
গেল গদা তিতি অশ্রনীরে।
দুই পাশে শৈলকুল ভীষণ-দর্শন,
শৃঙ্গ যেন পরশে গগন।
গিরিশিরে বরষায় প্রবলা যেমতি
ভীমা স্রোতস্বতী,
পথিক দুজনে হেরি তস্করের দল
নাবি নীচে করি কোলাহল
উভে আক্রমিল।
সদা অতি কাতরে কহিল,
শুন ভাই, পাঞ্চালে যেমতি,
বিষ্ণু রথিপতি,
জিনি লক্ষ রাজে শূর কৃষ্ণায় লভিল,

মার চোরে করি রণ-লীলা।
এই ধন নিও পরে বাঁটি
হিসাবে করিয়া আঁটাআঁটি,
তস্করদলের মাথা কাটি।
কহে গদা, পাপী আমি, তুমি সৎজন,
ধর্ম্মবলে নিজধন করহ রক্ষণ।
তস্কর-কুল-ঈশ্বরে
কহিল সে যোড়করে,
অধিপতি ওই জন ভাই,
সঙ্গী মাত্র আমি ওর, ধর্ম্মের দোহাই।
সঙ্গী মাত্র যদি তুই, যা চলি বর্ব্বর,
নতুবা ফেলিব কাটি, কহিল তস্কর।
ফাঁদে বাঁধা পাখী যথা পাইলে মুকতি,
উড়ি যায় বায়ুপথে অতি দ্রুতগতি,
গদা পলাইল।
সদানন্দ নিরানন্দে বিপদে পড়িল।
আলোক থাকিতে তুচ্ছ কর তুমি যারে,
বঁধু কি তোমার কভু হয় সে আঁধারে?
এই উপদেশ কবি দিলা এ প্রকারে।