বিবিধ প্রসঙ্গ/আত্মসংসর্গ

উইকিসংকলন থেকে

আত্ম-সংসর্গ।

 দুঃখের সুর একঘেয়ে কেন? বলা বাহুল্য, মন যেখানে বৈচিত্র্য দেখে না, সেখানে সে নিজের অন্তঃপুরের মধ্যে নিজে বসিয়া থাকে, কৌতুহল উদ্রেক না হইলে সে বাহির হইবার কোন আবশ্যক দেখে না। যাহা কিছু একঘেয়ে, তাহাই আমাদিগকে আমাদের নিজের কাছে প্রেরণ করে। এই জন্যই একঘেয়ে সুরের মধ্যে একটী করুণ ভাব আছে।

 যখনি আমরা আমাদের নিজের কাছে থাকি, তখনি আমাদের দুঃখ। আমরা নিজের কাছ হইতে পলাইয়া থাকিতে পারিলেই সুখে থাকি। যখন বাহ্য জগত সুন্দর আকার ধারণ করে, তখন আমরা কেন সুখে থাকি? কারণ, তখন আমাদের মন তাহার নিজের হাত এড়াইয়া বাহিরে সঞ্চরণ করিতে পারে; আর যখন আমাদের চারিদিকে বাহ্য জগৎ কদর্য্য মূর্ত্তি ধারণ করে, তখন আমাদের মনকে দায়ে পড়িয়া নিজের কাছেই ফিরিয়া আসিতে হয়, ও আমরা অসুখী হই। এই জন্যই, আমাদের অন্তর ও বাহির, আমাদের মন ও জগৎ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পদার্থ হইলেও জগতের উপর আমাদের মনের সুখ এতটা নির্ভর করে, যে, জগৎ বেঁকিয়া দাঁড়াইলেই আমাদের মন কাঁদিয়া উঠে। সে নিজের কাছে কোন মতেই থাকিতে চায় না। সে একটী অভাব মাত্র। সে এই বিশাল জগৎসংসারের মহা-ক্ষেত্রে প্রতি শব্দ, প্রতি দৃশ্য, প্রতি গন্ধ, প্রতি স্বাদকে শীকার করিয়া বেড়াইতেছে, যতক্ষণ শীকার করে ততক্ষণ থাকে ভাল, অবশেষে যখন রিক্তহস্তে শ্রান্ত দেহে গৃহে ফিরিয়া আসে তখনি তাহার দুঃখ। আমরা ভালবাসিতে চাই, কেননা আমরা আপনাকে চাই না, আর এক জনকে চাই; আমরা একটা কিছু কার্য করিতে চাই, কেননা আমরা নিজের কাছে থাকিতে চাই না; আমরা উপার্জ্জন করতে চাই, কেননা আমাদের পৈতৃক সম্পত্তিই অভাব। আমাদের মনের অর্থ— ভিক্ষার অঞ্জলি, জগতের অর্থ—ভিক্ষামুষ্টি। ভষ্মলোচনকে যেমন নিজের মুখ দেখাইয়া বধ করা হইয়াছিল, তেমনি সমস্ত জগৎ যদি একটা বিশাল দর্পণ হইত, চারিদিকে কেবল আমাদের নিজের মুখ দেখিতে পাইতাম, তাহা হইলে আমরা মরিয়া যাইতাম। তাহা হইলে আমরা কি দেখিতাম? একটা ক্ষুধ, একটা দুর্ভিক্ষ, একটা প্রার্থনা, একটা রোদন। আমাদের মন গোটাকতক ক্ষুধার সমষ্টি মাত্র। জ্ঞানের ক্ষুধা, আসঙ্গের ক্ষুধা, সৌন্দর্য্যের ক্ষুধা। আমাদের দিকে অনন্তজ্ঞানের পিপাসা, আর জগতের দিকে অনন্ত রহস্য। আমরা প্রাণের সহচর চাই, কিন্তু “লাখে না মিলল একে।” আমরা সৌন্দর্য্য উপভোগ করিতে চাই, অথচ সৌন্দর্য্যকে দুই হাতে স্পর্শ করিলেই সে মলিন হইয়া যায়। আমরা কৃষ্ণবর্ণ; সূর্য্য রশ্মির সমস্ত বর্ণধারা পান করিয়া থাকি তথাপি আমরা কালো। সূর্গ রশ্মি পান করিবার আমাদের অনন্ত পিপাসা এইরূপে অনন্ত জ্ঞানের ক্ষুধা লইয়া যে রহস্য দন্তস্ফুট করিতে পারিবনা তাহাকেই অনবরত আক্রমন করা, অনন্ত আসঙ্গের ক্ষুধা লইয়া যে সহচর মিলিবে না তাহাকেই অবিরত অম্বেষণ করা, অনন্ত সৌন্দর্য্যের ক্ষুধা লইয়া যে সৌন্দর্য্য ধরিয়া রাখিতে পারিব না তাহাকেই চির উপভোগ করিতে চেষ্টা করা, এক কথায়, অনন্ত মন অর্থাৎ সমষ্টিবদ্ধ কতকগুলি অনন্ত ক্ষুধা লইয়া জগতের পশ্চাতে অনন্ত ধাবমান হওয়াই মনুষ্য জীবন। এই নিমিত্তই মন নিজের কাছে থাকিতে চায় না জগতের কাছে যাইতে চায়, ক্ষুধা নিজের কাছে থাকিতে চায় না, খাদ্যের কাছে থাকিতে চায়। আমরা মানুষরা কতকগুলা কালো কালো অসন্তোষের বিন্দু, ক্ষুধার্ত্ত পিপীলিকার মত জগৎকে চারিদিক হইতে ছাঁকিয়া ধরিয়াছি; উষাকে, জ্যোৎস্নাকে, গানের শব্দকে দংশন করিতেছি, একটুখানি খাদ্য পাইবার। জন্য। হায় রে, খাদ্য কোথায়! হে সূর্য্য, উদয় হও। চন্দ্র হাস! ফুল, ফুটিয়া ওঠ! আমাকে আমার হাত হইতে রক্ষা কর; আমাকে যেন আমার পাশে বসিয়া না থাকিতে হয়; অনিচ্ছারচিত বাসর শয্যায় শুইয়া আমাকে যেন আমার আলিঙ্গনে পড়িয়া কাঁদিতে না হয়!