বিষয়বস্তুতে চলুন

বিরাজ বৌ/পাঁচ

উইকিসংকলন থেকে

পাঁচ

 দিন-দুই পরে নীলাম্বর বলিল, সুন্দরীকে দেখচি নে কেন বিরাজ?

 বিরাজ বলিল, আমি তাকে ছাড়িয়ে দিয়েচি।

 নীলাম্বর পরিহাস মনে করিয়া বলিল, বেশ করেচ। বল না কি হয়েছে তার?

 বিরাজ বলিল, কি আবার হবে, আমি সত্যিই তাকে ছাড়িয়ে দিয়েছি।

 নীলাম্বর তথাপি কথাটা বিশ্বাস করিতে পারিল না। অতিশয় বিস্মিত হইয়া মুখপানে চাহিয়া বলিল, তাকে ছাড়িয়ে দেবে কি করে? আর সে যত দোষই করুক, কতদিনের পুরনো লোক তা জান? কি করেছিল সে?

 বিরাজ বলিল, ভাল বুঝেচি তাই ছাড়িয়ে দিয়েচি।

 নীলাম্বর বিরক্ত হইল, বলিল, কিসে ভাল বুঝলে তাই জিজ্ঞেস কচ্চি।

 বিরাজ স্বামীর মনের ভাব বুঝিল। ক্ষণকাল নিঃশব্দে মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আমি ভাল বুঝেচি—ছাড়িয়ে দিয়েচি, তুমি ভাল বুঝ, ফিরিয়ে আন গে।—বলিয়া উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করিয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল।

 নীলাম্বর বুঝিল বিরাজ রাগিয়াছে, আর কোন কথা কহিল না। সে ঘণ্টা-খানেক পরে ফিরিয়া আসিয়া রান্নাঘরের দরজার বাহিয়ে দাঁড়াইয়া ধীরে ধীরে বলিল, কিন্তু ছাড়িয়ে যে দিলে, কাজ করবে কে?

 এবার বিরাজ মুখ ফিরাইয়া হাসিল। তাহার পরে বলিল, তুমি।

 নীলাম্বর হাসিয়া বলিল, তবে দাও এঁটো বাসনগুলো মেজে ধুয়ে আনি।

 বিরাজ হাতের খুন্তিটা ঝনাৎ করিয়া ফেলিয়া হাত ধুইয়া কাছে আসিয়া পায়ের ধুলা মাথায় লইয়া বলিল, যাও তুমি এখান থেকে। একটা তামাশা করবার জো নেই—তা হলেই এমন কথা বলে বসবে যে, কানে শুনলে পাপ হয়।

 নীলাম্বর অপ্রতিভ হইয়া বলিল, এও কানে শুনলে পাপ হয়? তোর পাপ যে কিসে হয় না, তা ত বুঝিনে বিরাজ?

 বিরাজ বলিল, তুমি সব বোঝ। না বুঝলে এত কাজ থাকতে এঁটো বাসনের কথা তুলতে না—যাও, আর বেলা ক’রো না, স্নান করে এসো—আমার রান্না হয়ে গেছে।

 নীলাম্বর চৌকাঠের উপর বসিয়া পড়িয়া বলিল, সত্যি কথা বিরাজ, সংসারের কাজকর্ম করবে কে?

 বিরাজ চোখ তুলিয়া বলিল, কাজ আবার কোথায়? পুঁটি নেই, ঠাকুরপোরা নেই, আমিই ত কাজের অভাবে সারাদিন বসে কাটাই। বেশ ত, কাজ যখন আটকাবে তখন তোমাকে জানাব।

 নীলাম্বর বলিল, না বিরাজ, সে হবে না, দাসী-চাকরের কাজ আমি তোমায় করতে দিতে পারব না। সুন্দরী কোন দোষ করেনি, শুধু খরচ বাঁচাবার জন্য তুমি তাকে সরিয়েচ, বল সত্যি কিনা?

 বিরাজ বলিল, না সত্যি নয়। সে যথার্থই দোষ করেচে।

 কি দোষ?

 তা আমি বলব না। যাও, আর বসে থেক না, স্নান করে এসো।—বলিয়া বিরাজও দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল। খানিক পরে ফিরিয়া আসিয়া নীলাম্বরকে এইভাবে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া বলিল, কৈ গেলে না? এখনও বসে আছ যে?

 নীলাম্বর মৃদুম্বরে বলিল, যাই—কিন্তু, বিরাজ, এ ত আমি সইতে পারব না, তোমাকে উঞ্ছবৃত্তি করতে দেব কি করে?

 কথাটা শুনিয়া বিরাজ খুশী হইল না। ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া বলিল, কি করবে শুনি।

 সুন্দরীকে না চাও আর কোন লোক রাখি—তুমি একাই বা থাকবে কি করে?

 যেমন করেই থাকি না কেন, আমি আর লোক চাইনে।

 নীলাম্বর বলিল, না, সে হবে না। যতক্ষণ সংসারে আছি ততদিন মান-অপমানও আছে, পাড়ার লোকে শুনলে কি বলবে?

 বিরাজ অদূরে বসিয়া পড়িয়া বলিল, পাড়ার লোকে শুনলে কি বলবে এইটাই তোমার আসল ভয়। আমি কি করে থাকব, আমার দুঃখ-কষ্ট হবে, এ কেবল তোমার একটা ছল।

 নীলাম্বর ক্ষুব্ধ-বিস্ময়ে চোখ তুলিয়া বলিল, ছল?

 বিরাজ বলিল, হাঁ, ছল। আজকাল আমি সব দেখেচি। আমার মুখের দিকে যদি চাইতে, আমার দুঃখ ভাবতে, আমার একটা কথাও যদি শুনতে, তা হলে আজ আমার এ অবস্থা হ’ত না।

 নীলাম্বর বলিল, তোমার একটা কথাও শুনিনি!

 বিরাজ জোর দিয়া বলিল, না একটাও না। যখন যা বলেচি, তাই কোন না কোন ছল করে উড়িয়ে দিয়েচ—তুমি কেবল ভেবেচ নিজের পাপ হবে, মিথ্যে কথা হবে, লোকের কাছে অপযশ হবে—একবারও ভেবেচ কি, আমার কি হবে?

 নীলাম্বর বলিল, আমার পাপ কি তোমার নয়, আমার অপযশে কি তোমার অপযশ হবে না?

 এবার বিরাজ রীতিমত ক্রুদ্ধ হইল। তীক্ষ্ণভাবে বলিল, দেখ ও-সব ছেলেভুলনো কথা—ওতে ভোলবার বয়স আমার আর নেই ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিয়া উঠিল—কেবল তুমি নিজের কথা ভাব, আর কিছু ভাব না। অনেক দুঃখে আজ আমাকে এ কথা মুখ দিয়ে বার করতে হ’ল—আজ নিজের ঘরে আমাকে দাসীবৃত্তি করতে দিতে তোমার লজ্জা হচ্ছে, কিন্তু কাল যদি তোমার একটা কিছু হয়, পরশু যে আমাকে পরের ঘরে গিয়ে দুটো ভাতের জন্যে দাসীবৃত্তি করে বেড়াতে হবে। তবে একটা কথা এই যে সে তোমাকে চোখে দেখতেও হবে না, কানে শুনতেও হবে না—কাজে কাজেই তাতে তোমার লজ্জা ত হবে না, ভাবনা-চিন্তা করবারও দরকার নেই—এই না?

 নীলাম্বর সহসা এ অভিযোগের উত্তর দিতে পারিল না। মাটির দিকে খানিকক্ষণ চুপ করিয়া চাহিয়া থাকিয়া চোখ তুলিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, এ কক্ষণ তোমার মনের কথা নয়। দুঃখ-কষ্ট হয়েচে বলেই রাগ করে বলচ। তোমার কষ্ট আমি যে স্বর্গে বসেও সইতে পারব না, এ তুমি ঠিক জান।

 বিরাজ বলিল, তাই আগে জানতুম বটে, কিন্তু কষ্ট যে কি, তা কষ্টে না পড়লে যেমন ঠিক বোঝা যায় না, পুরুষমানুষের মায়াদয়াও তেমনই, সময় না হ’লে টের পাওয়া যায় না। কিন্তু, তোমার সঙ্গে এই দুপুরবেলায় আমি রাগারাগি করতে চাইনে—যা বলচি তাই কর, যাও নেয়ে এসো।

 নীলাম্বর ‘যাচ্চি’ বলিয়াও চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

 বিরাজ পুনরায় কহিল, আজ দু বছর হতে চলল, পুঁটির আমার বিয়ে হয়েচে। তার আগে থেকে আজ পর্যন্ত সব কথা সেদিন আমি মনে মনে ভেবে দেখছিলুম—আমার একটি কথাও তুমি শোননি। যখন যা কিছু বলেচি, সমস্তই একটা একটা করে কাটিয়ে দিয়ে নিজের ইচ্ছায় কাজ করে গেছ। লোকে বাড়ির দাসী-চাকরেরও একটা কথা রাখে, কিন্তু তুমি তাও আমার রাখনি।

 নীলাম্বর কি একটা বলিবার উপক্রম করিতেই বিরাজ বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল,—না না, তোমার সঙ্গে তর্ক করব না। কত কড় ঘেন্নায় যে আমি ইষ্টি দেবতার নাম করে দিব্যি করেচি, তোমাকে আর একটি কথাও বলতে যাব না, সে কথা তুমিও শুনতে পেতে না, আজ যদি না কথায় কথা উঠে পড়ত। এখন হয়ত তোমার মনে পড়বে—না, কিন্তু ছেলেবেলায় একদিন আমি মাথার ব্যথায় ঘুমিয়ে পড়ি; তোমাকে দোর খুলে দিতে দেরী হয়েছিল বলে মারতে উঠেছিলে, আমার অসুখের কথা বিশ্বাস করনি। সেইদিন থেকে দিব্যি করেছিলুম, অসুখের কথা আর জানাব না—আজ পর্যস্ত সে দিব্যি ভাঙ্গিনি।

 নীলাম্বর মুখ তুলিতেই দুজনের চোখাচোখি হইয়া গেল। সে সহসা উঠিয়া আসিয়া বিরাজের হাত দুটি ধরিয়া ফেলিয়া উদ্বিগ্ন-স্বরে বলিয়া উঠিল, সে হবে না বিরাজ, কক্ষণ তোমার দেহ ভাল নেই। কি অসুখ হয়েচে বল—বলতেই হবে।

 বিরাজ ধীরে ধীরে হাত ছাড়াইবার চেষ্টা করিয়া বলিল, ছাড়—লাগচে।

 লাগুক—বল কি হয়েচে?

 বিরাজ শুষ্কভাবে একটুখানি হাসিয়া বলিল, কৈ, কিছুই ত হয়নি, বেশ আছি।

 নীলাম্বর অবিশ্বাস করিয়া বলিল, না, কিছুতেই তুমি বেশ নেই। না হলে, কখন তুমি সেই কত বৎসরের পুরনো কথা তুলে আমার মনে কষ্ট দিতে না—বিশেষ যার জন্যে কতদিন, কত মাপ চেয়েচি।

 আচ্ছা, আর কোন দিন বলব না,—বলিয়া বিরাজ নিজেকে মুক্ত করিয়া ঈষৎ সরিয়া বসিল।

 নীলাম্বর তাহার কথার অর্থ বুঝিল, কিন্তু আর কিছু বলিল না। তার পর মিনিট দুই-তিন চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া উঠিয়া গেল।

 রাত্রে প্রদীপের আলোকে বসিয়া বিরাজ চিঠি লিখিতেছিল। নীলাম্বর খাটের উপর শুইয়া নিঃশব্দে তাহাই দেখিতেছিল। দেখিতে দেখিতে সহসা বলিয়া উঠিল, এ জন্মে তোমার ত কোন দোষ-অপরাধ শত্রুতেও দিতে পারে না, কিন্তু তোমার পূর্বজন্মের পাপ ছিল, না হলে কিছুতেই এমন হ’ত না।

 বিরাজ মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি হ’ত না?

 নীলাম্বর কহিল, তোমার সমস্ত দেহ-মন ভগবান রাজরানীর উপযুক্ত করে গড়ে ছিলেন, কিন্তু—

 কিন্তু কি?

 নীলাম্বর চুপ করিয়া রহিল।

 বিরাজ একমুহূর্ত উত্তরের আশায় থাকিয়া রুক্ষস্বরে বলিল, এ খবর কখন তোমাকে ভগবান দিয়ে গেলেন?

 নীলাম্বর কহিল, চোখ-কান থাকলে ভগবান সকলকেই খবর দেন। বিরাজ ‘হু’ বলিয়া চিঠি লিখিতে লাগিল।

 নীলাম্বর ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, তখন বলছিলে, আমি কোন কথা তোমার শুনিনে, হয়ত তাই সত্যি, কিন্তু তা কি শুধু একলা আমারই দোষ?

 বিরাজ আবার মুখ তুলিয়া চাহিল, বলিল, বেশ ত, আমার দোষটাই দেখিয়ে দাও?

 নীলাম্বর বলিল, তোমার দোষ দেখাতে পারব না; কিন্তু আজ একটা সত্যি কথা বলব। তুমি নিজের সঙ্গে অপরের তুলনা করেই দেখ। কিন্তু এটা ত একবার ভেবে দেখ না, তোমার মত ক’টা মেয়েমানষ এমন নির্গুণ মূর্খের হাতে পড়ে? এইটেই তোমার পূর্বজন্মের পাপ, নইলে তোমার ত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করবার কথা নয়।

 বিরাজ নিঃশব্দে চিঠি লিখিতে লাগিল। বোধ করি সে মনে করিল ইহার জবাব দিবে না; কিন্তু থাকিতে পারিল না। মুখ ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি মনে কর, এই সব কথা শুনে আমি খুশী হই?

 কি সব কথা?

 বিরাজ বলিল, এই যেমন রাজরানী হতে পারতুম—শুধু তোমার হাতে পড়েই এমন হয়েছি, এই সব; মনে কর, এ শুনলে আমার আহ্লাদ হয়, না যে বলে তার মুখ দেখতে ইচ্ছে করে?

 নীলাম্বর দেখিল, বিরাজ অত্যন্ত রাগিয়া গিয়াছে। ব্যাপারটা এইরূপ হইয়া দাঁড়াইবে সে আশা করে নাই, তাই মনে মনে সঙ্কুচিত এবং কুণ্ঠিত হইয়া পড়িল; কিন্তু কি বলিয়া প্রসন্ন করিবে, সহসা তাহাও ভাবিয়া পাইল না।

 বিরাজ বলিল, রূপ, রূপ, রূপ। শুনে শুনে কান আমার ভোঁতা হয়ে গেল। আর যারা বলে, তাদের না হয় এইটেই সব চেয়ে বেশী চোখে পড়ে, কিন্তু তুমি স্বামী, এতটুকু বয়স থেকে তোমাকে ধরে এত বড় হয়েচি, তুমিও কি এর বেশী আমার আর কিছু দেখ না? এইটেই কি আমার সবচেয়ে বড় বস্তু। তুমি কি বলে এ কথা মুখে আন? আমি কি রূপের ব্যবসা করি, না, এই দিয়ে তোমাকে ভুলিয়ে রাখতে চাই?

 নীলাম্বর অত্যন্ত ভয় পাইয়া থতমত খাইয়া বলিতে গেল, না না—

 বিরাজ কথার মাঝেই বলিয়া উঠিল, ঠিক তাই, সেই জন্যেই একদিন জিজ্ঞেস করেছিলুম, আমি কালো-কুচ্ছিত হলে ভালবাসতে কিনা। মনে পড়ে?

 নীলাম্বর ঘাড় নাড়িয়া বলিল, পড়ে, কিন্তুু তুমিই ত তখন বলেছিলে—

 বিরাজ বলিল, হাঁ বলেছিলুম আমি কালো-কুচ্ছিত হলেও ভালবাসতে, কেননা, আমাকে বিয়ে করেছ। গেরস্তর মেয়ে, গেরস্তর বউ, আমাকে এ-সব কথা শোনাতে তোমার লজ্জা করে না? এর পূর্বেও আমাকে তুমি এ কথা বলেচ।—বলিতে বলিতে তাহার ক্রোধে অভিমানে চোখে জল আসিয়া পড়িল, এবং সে জল প্রদীপের আলোকে চকচক করিয়া উঠিল। নীলাম্বর দেখিতে পাইয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিল।

 বিরাজ নিজেই একদিন বলিয়া দিয়াছিল, তিনি হাত ধরিলে আর তাহার রাগ থাকে না।

 নীলাম্বর সেই কথা হঠাৎ স্মরণ করিয়া উঠিয়া আসিয়া তাহার ডান হাতখানি নিজের দুই হাতের মধ্যে লইয়া পার্শ্বে উপবেশন করিয়া চুপ করিয়া রহিল।

 বিরাজ বাঁ হাত দিয়া নিজের চোখের জল মুছিয়া ফেলিল। সেই রাত্রে বহুক্ষণ পর্যন্ত উভয়েই নিঃশব্দে জাগিয়া ছিল। এক সময়ে নীলাম্বর সহসা স্ত্রীর দিকে মুখ ফিরাইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, আজ কেন অত রাগ, বিরাজ?

 বিরাজ জবাব দিল, কেন তুমি ও-সব কথা বললে?

 নীলাম্বর বলিল, আমি ত মন্দ কথা বলিনি!

 বিরাজ অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল, অধীরভাবে বলিল, তবু বলবে মন্দ কথা নয়? খুব মন্দ কথা। অত্যন্ত মন্দ কথা। ওর জন্যেই সুন্দরীকে—

 সে আর বলিল না, চুপ করিয়া গেল!

 নীলাম্বর ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, শুধু এই দোষে তাকে তাড়িয়ে দিলে?

 বিরাজ ‘হু’ বলিয়া চুপ করিল।

 নীলাম্বর আর প্রশ্ন করিল না।

 তখন বিরাজ নিজেই বলিল, দেখ, জেরা ক’রো না—আমি কচি খুকি নই—ভাল-মন্দ বুঝি। তাড়াবার মত দোষ করেছে বলেই তাড়িয়েচি। কেন, কি বৃত্তান্ত, এত কথা তুমি পুরুষমানুষ নাই শুনলে।

 না, আর অত শুনতে চাইনে, বলিয়া নীলাম্বর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে ধীরে পাশ ফিরিয়া শুইল।

 পৃথগান্ন হইবার দুই-চারি দিন পরেই ছোটভাই পীতাম্বর বাটীর মাঝখানে দরমা ও ছেঁচা বাঁশের বেড়া দিয়া নিজের অংশ আলাদা করিয়া লইয়াছিল। দক্ষিণ দিকে দরজা ফুটাইয়া এবং তাহারই সম্মুখে একটি ছোট বৈঠকখানা-ঘর করিয়া সে সর্বরকমে নিজের বাড়িটিকে বেশ মানানসই ঝরঝরে করিয়া লইয়া মহা আরামে জীবন-যাপন করিতেছিল। কোনদিনই প্রায় সে দাদার সহিত বড় একটা কথাবার্তা বলিত না। এখন সমস্ত একেবারে ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল। এদিকে বিরাজের প্রায় সমস্তদিন একলাটি কাটাইতে হইত। সুন্দরী যাওয়ার পর হইতে শুধু যে সমস্ত কাজকর্ম তাহাকেই করিতে হইত তাহা নহে; যে-সব কাজ পূর্বে দাসীতে করিত, সেইগুলো লোকলজ্জাবশতঃ লোকচক্ষুর অন্তরালেই তাহাকে সমাধা করিয়া লইবার জন্য অনেক রাত্রি পর্যন্ত জাগিয়া থাকিতে হইত। এমনই একদিন কাজ করিতেছিল, অকস্মাৎ ও-বাড়ি হইতে বেড়ার ফাঁক দিয়া অতি মৃদুকণ্ঠে ডাক আসিল, দিদি!

 রাত অনেক হইয়াছিল। বিরাজ চমকিয়া মুখ তুলিল। তেমনই মৃদুস্বরে আবার কহিল, দিদি, আমি মোহিনী।

 বিরাজ আশ্চর্য হইয়া বলিল, কে, ছোট বৌ! এত রাত্তি রে?

 হাঁ দিদি, আমি। একবারটি কাছে এসো।

 বিরাজ বেড়ার কাছে আসিতেই ছোটবৌ চুপি চুপি বলিল, দিদি, বঠঠাকুর ঘুমিয়েচেন?

 বিরাজ বলিল, হাঁ।

 মোহিনী বলিল, দিদি, একটা কথা আছে, কিন্তু বলতে পাচ্ছিনে,—বলিয়া চুপ করিল।

 বিরাজ তাহার কণ্ঠের স্বরে বুঝিল ছোটবৌ কাঁদিতেছে। চিন্তিত হইয়া প্রশ্ন করিল, কি হয়েছে ছোটবৌ?

 ছোটবৌ তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারিল না, বোধ করি, সে আঁচল দিয়া চোখ মুছিল। এবং নিজেকে সংবরণ করিতে লাগিল।

 বিরাজ উদ্বিগ্ন হইয়া বলিল, কি ছোটবৌ।

 এবার সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলিল, বঠঠাকুরের নামে নালিশ হয়েছে,—কাল সমন না কি বার হবে, কি হবে দিদি?

 বিরাজ ভয় পাইল, কিন্তু সে-ভাব গোপন করিয়া বলিল, সমন বার হবে, তার আর ভয় কি ছোটবৌ?

 ভয় নেই দিদি?

 বিরাজ বলিল, ভয় আর কি। কিন্তু নালিশ করলে কে?

 ছোটবৌ বলিল, ভুলু মুখুয্যে।

 বিরাজ ক্ষণকাল স্তম্ভিত হইয়া থাকিয়া বলিল, থাক আর বলতে হবে না—বুঝেচি। মুখুয্যেমশাই ওঁর কাছে টাকা পাবেন, তাই বোধ করি নালিশ করেচেন। কিন্তু তাতে ভয়ের কথা কিছু নেই ছোটবৌ। তারপর উভয়েই মৌন হইয়া রহিল। খানিক পরে ছোটবৌ কহিল, দিদি, কোনদিন তোমার সঙ্গে আমি বেশী কথা কইনি—কথা কইবার যোগ্যও আমি নই—আজ ছোটবোনের একটি কথা রাখবে দিদি?

 তাহার কণ্ঠম্বরে বিরাজ আর্দ্র হইয়া গিয়াছিল, এখন অধিকতর আর্দ্র হইয়া বলিল, কেন রাখব না বোন?

 তবে, একবারটি হাত পাত। বিরাজ হাত পাতিতেই একটি ক্ষুদ্র কোমল হাত বেড়ার ফাঁক দিয়া বাহির হইয়া তাহার হাতের উপর একছড়া সোনার হার রাখিয়া দিল।

 বিরাজ আশ্চর্য হইয়া বলিল,—কেন ছোটবৌ?

 ছোটবৌ কণ্ঠস্বর আরও নত করিয়া বলিল, এইটে বিক্রি করে হোক, বাঁধা দিয়ে হোক, ওর টাকা শোধ করে দাও দিদি।

 এই আকস্মিক অর্যাচিত ও অচিন্ত্যপূর্ণ সহানভূতিতে ক্ষণকালের নিমিত্ত বিরাজ অভিভূত হইয়া পড়িল—কথা কহিতে পারিল না।

 কিন্তু ‘চললাম দিদি,’ বলিয়া ছোটবৌ সরিয়া যায় দেখিয়া, সে তাড়াতাড়ি ডাকিয়া উঠিল, যেও না ছোটবৌ, শোন।

 ছোটবৌ ফিরিয়া আসিয়া বলিল, কেন দিদি?

 বিরাজ সেই ফাঁকটা দিয়া তৎক্ষণাৎ অপর দিকে হারটা ফেলিয়া দিয়া বলিল, ছি এ-সব করতে নেই।

 ছোটবৌ তাহা তুলিয়া লইয়া ক্ষুব্ধস্বরে প্রশ্ন করিল, কেন করতে নেই?

 বিরাজ বলিল, ঠাকুরপো শুনলে কি বলবেন?

 কিন্তু তিনি ত শুনতে পাবেন না।

 আজ না হোক দু’দিন পরে জানতে পারবেন, তখন কি হবে?

 ছোটবৌ বলিল, তিনি কোনদিন জানতে পারবেন না, দিদি। গত বছর মা মরবার সময় এটি নুকিয়ে আমাকে দিয়ে যান, তখন থেকে কোনদিন পরিনি, কোনদিন বার করিনি—তোমার পায়ে পড়ি দিবি, এটি তুমি নাও।

 তাহার কাতর অনুনয়ে বিরাজের চোখ দিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। সে স্তব্ধ হইয়া এই নিসম্পর্কীয়া রমণীর আচরণের সহিত সহোদরের আচরণ তুলনা করিয়া দেখিল। তারপর হাত দিয়া চোখ মুছিয়া ফেলিয়া রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, আজকের কথা মরণকাল পর্যন্ত আমার মনে থাকবে বোন। কিন্তু এ আমি নিতে পারব না। তা ছাড়া স্বামীকে লুকিয়ে কোন মেয়েমানুষের কোনও কাজই উচিত নয় ছোটবৌ! তাতে তোমার আমার দু’জনেরই পাপ।

 ছোটবৌ বলিল, তুমি সব কথা জান না তাই বলচ—কিন্তু ধর্মাধর্ম আমারও ত আছে দিদি,—আমিই বা মরণকালে কি জবাব দেব?

 বিরাজ আর একবার চোখ মুছিয়া নিজেকে সংযত করিয়া লইয়া বলিল, আমি সকলকেই চিনেছিলুম ছোটবৌ, শুধু তোমাকেই এতদিন চিনতে পারিনি; কিন্তু তোমাকে ত মরণকালে কোন জবাব দিতে হবে না, সে জবাব এতক্ষণ তোমার অন্তর্যামী নিজেই লিখে নিয়েচেন। যাও, রাত হ’ল, শোও গে বোন।—বলিয়া প্রত্যুত্তরের অবসর না দিয়াই দ্রুতপদে সরিয়া গেল।

 কিন্তু সেও ঘরে ঢুকিতে পারিল না। অন্ধকার বারান্দার একধারে আসিয়া আঁচল পাতিয়া শ‍ুইয়া পড়িল। তাহার নালিশ মকদ্দমার কথা মনে হইল না, কিন্তু ওই স্বল্পভাষিণী ক্ষুদ্রকায়া ছোট জায়ের সকরুণ কথাগুলি মনে করিয়া প্রস্রবণের মত তাহার দুই চোখ বাহিরা নিরন্তর জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। আজ সব চেয়ে দুঃখটা তাহার এই বাজিতে লাগিল যে, এতদিন এত কাছে পাইয়াও সে তাহাকে চিনিতে পারে নাই, চিনিবার চেষ্টা পর্যন্ত করে নাই, অসাক্ষাতে তাহার নিন্দা না করিলেও একটি দিনও তাহার হইয়া কখন ভাল কথা বলে নাই। সুতীক্ষ্ণ বাজের আলো একমুহূর্তে যেমন করিয়া অন্ধকার চিরিয়া ফেলে, আজ ছোটবৌ তেমনই করিরা তাহার বুকের অন্তস্থল পর্যন্ত যেন চিরিয়া দিয়া গেল। ভাবিতে ভাবিতে কাঁদিতে কাঁদিতে কখন এক সময়ে সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। হঠাৎ কাহার হস্তস্পর্শে সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দেখিল, নীলাম্বর আসিয়া তাহার শিয়রের কাছে বসিয়াছে।

 নীলাম্বর সংক্ষেপে বলিল, ঘরে চল, রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেচে।

 বিরাজ কোন কথা না বলিয়া স্বামীর দেহ অবলম্বন করিয়া নিঃশব্দে ঘরে আসিয়া নির্জীবের মত শুইয়া পড়িল।