পাতা:জীবনানন্দ সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড).pdf/১১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

টেলিগ্রামের পাতাটা খোলে—এডিটরের আর্টিকেল কী, একবার তাকিয়ে দেখে। কিন্তু পড়বার চাড় নেই। কাগজ হাতের থেকে মেঝের উপর পড়ে যায়—চুরুটের থেকে আগুনের ফুলকি কাপড়ের উপর গিয়ে পড়ে—কাপড়ের খানিকটা খানিকটা জায়গায় আলপিনের মাথার মতো ছোট ছোট ছাদা হয়ে যায়—ক্রমে ক্রমে চুরুটও নিভে যায়—প্রভাত কলকাতার দূর দিগন্তের একটা সুরকিধুলিরক্তাক্ত ঝাউ গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে— দেশে সে যাবেই। আজ অবিশ্যি যাওয়া হল না। কালও হয়তো হবে না। তারাপদর কাছ থেকে টাকা ধার করে এনে তিন-চার দিনের মধ্যে নিশ্চয়ই রওনা দেবে সে। বিকেল চারটের সময়ও শিয়ালদা স্টেশনে ট্রেনের গায় বেশ চড়া রোদ—থার্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টের থেকে কেমন একটা গন্ধ বেরোয়। দেশে, যাবার জন্য যখন সে এই ট্রেনে চড়ত এই ঘ্ৰাণ এত ভালো লাগত তার—পড়ন্ত রোদ ভারি মিঠে মনে হত— হঠাৎ এক সময় গাড়িটা একটা বাকুনি খেয়ে প্ল্যাটফর্মের বাইরে চলে যেত—তার পরই কামরার বেঞ্চিগুলো রোদে যেত ভরে—মুখে রোদ, মাথায় রোদ। কেমন নরম রোদ—আঘাত দেয় না—বোনের মতো, মায়ের মতো সমেহে সমস্ত শরীর বুলোতে থাকে যেন—হৃদয়ের ভিতরেও একটা গম্ভীর ভরসা আসে—এখন থেকে আর সংগ্রামের দবকার নেই—চিন্তার প্রয়োজন নেই—উপায় খুঁজবার আবশ্যকতা নেই—জীবন এখন থেকে বেশ নির্বিবাদ নিশ্চিন্ত—নরম রোদ এসে আশীৰ্বাদ করে, ভালোবেসে, এক সুদূর শান্তির দেশে নিয়ে চলেছে— দেখতে দেখতে বি-কে পালের বাগান—নারিকেলের সারি—পামবীথি—পশ্চিমে ধোপাদের কাপড় কাচার ঘাট—ধোলাই কাপড়-ঢাকা সবুজ ঘাস—দমদম স্টেশনে ট্রেন ধরে এক বার—তার পরেই হুম হুম করে মুহুর্তের ভিতর খোলা পৃথিবীতে এসে পড়ে—দুধারে মাঠ প্রান্তর—খেজুরের জঙ্গল—আখের খেত, বড়-বড় সোদাল গাছ, পাকুড়, ঝরঝরিয়া ও অর্জুনের বন—নিস্তেজ বিকেল বেলার কোল থেকে নেমে পৃথিবী ভরা সোনালি রোদের হুড়োহুড়ি—শূন্য ধানখেত, ছিন্নবিচ্ছিন্ন কাশ, খড়ের স্তুপ, গাঙ শালিখগুলোর ওড়াওড়ি— তারপর রাত্রি নেমে আসে—অবসন্ন বিবির ডাক, কোকিলের গান ও ব্যাঙের এসে থামে। তারপর স্টিমার—এ এক নিরুপম বিচিত্র যাত্রা—মাঠ আছে, তেপান্তর আছে : সমস্ত রাত বিচিত্র সরীসৃপের মতো একে-বেঁকে নদী যেন তিমিরাবৃত শীতল পাতাল দেশের দিকে চলেছে— চুরুট নিবে গেল বুঝি ? কিন্তু জ্বালাল না আর প্রভাত— সকাল বেলা গিয়ে স্টিমারে দেশের স্টেশনে পোঁছায়। স্টেশনে নেমেই সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটা চোখে পড়ে—ফাল্গুন মাসেই সেটা ফুলে ভরে যায়— এক দিকে একটা ডালপালায় মস্ত বড় শিমূল গাছ—মাঘের শেষেই নীল আকাশের মাথায় আগুন লাগিয়ে দেয় যেন; এমন রক্তাক্ত শিমুল কোথাও কোনোদিন সে দেখে নি আর, যেন সিন্দুরমাখা সুন্দরী সধবার লেলিহান চিতা জুলে উঠেছে। SS a