শেষ সপ্তক/বিয়াল্লিশ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

উইকিসংকলন থেকে
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Jonoikobangali (আলোচনা | অবদান)
{{BnHeader |title= শেষ সপ্তক |section = তেতাল্লিশ. পঁচিশে বৈশাখ চলেছে |previous = ... দিয়ে তৈরি পাতা
WikitanvirBot I (আলোচনা | অবদান)
বট কসমেটিক পরিবর্তন করছে
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
{{BnHeader
{{BnHeader
|title= [[শেষ সপ্তক]]
|title= [[শেষ সপ্তক]]
|section = বিয়াল্লিশ. [[তুমি গল্প জমাতে পার]]
|section = তেতাল্লিশ. [[পঁচিশে বৈশাখ চলেছে]]
|previous = একচল্লিশ. [[হালকা আমার স্বভাব]]
|previous = বিয়াল্লিশ. [[তুমি গল্প জমাতে পার]]
|next = তেতাল্লিশ. [[পঁচিশে বৈশাখ চলেছে]]
|next = চুয়াল্লিশ. [[আমার শেষ বেলাকার ঘরখানি]]
|notes =
|notes =
|author =রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর}}
|author =রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর}}
<div style="padding-left:2em;font-size:1.3em">
<div style="padding-left:2em;font-size:1.3em">
<poem>
<poem>
শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র দত্ত প্রিয়বরেষু
শ্রীমান অমিয়চন্দ্র চক্রবতী কল্যাণীয়েষু




তুমি গল্প জমাতে পার।
পঁচিশে বৈশাখ চলেছে
বসো তোমার কেদারায়,
জন্মদিনের ধারাকে বহন করে
ধীরে ধীরে টান দাও গুড়গুড়িতে,
মৃত্যুদিনের দিকে।
উছলে ওঠে আলাপ
সেই চলতি আসনের উপর বসে
তোমার ভিতর থেকে
কোন্‌ কারিগর গাঁথছে
হালকা ভাষায়,
ছোটো ছোটো জন্মমৃত্যুর সীমানায়
যেন নিরাসক্ত ঔৎসুক্যে,
নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা।
তোমার কৌতুকে-ফেনিল মনের
রথে চড়ে চলেছে কাল;
কৌতূহলের উৎস থেকে।
পদাতিক পথিক চলতে চলতে
ঘুরেছ নানা জায়গায়, নানা কাজে,
পাত্র তুলে ধরে,
আপন দেশে, অন্য দেশে।
পায় কিছু পানীয়;--
মনটা মেলে রেখেছিলে চারদিকে,
পান সারা হলে
চোখটা ছিলে খুলে।
পিছিয়ে পড়ে অন্ধকারে;
মানুষের যে-পরিচয়
চাকার তলায়
তার আপন সহজভাবে,
ভাঙা পাত্র ধুলায় যায় গুঁড়িয়ে।
যেমন-তেমন অখ্যাত ব্যাপারের ধারায়
তার পিছনে পিছনে
দিনে দিনে যা গাঁথা হয়ে ওঠে,
নতুন পাত্র নিয়ে যে আসে ছুটে,
সামান্য হলেও যাতে আছে
পায় নতুন রস,
সত্যের ছাপ,
একই তার নাম,
অকিঞ্চিৎকর হলেও যার আছে বিশেষত্ব,
কিন্তু সে বুঝি আর-একজন।
সেটা এড়ায়নি তোমার দৃষ্টি।
একদিন ছিলেম বালক।
সেইটে দেখাই সহজ নয়,
কয়েকটি জন্মদিনের ছাঁদের মধ্যে
পণ্ডিতের দেখা সহজ।
সেই যে-লোকটার মূর্তি হয়েছিল গড়া
শুনেছি তোমার পাঠ ছিল সায়ান্সে,
তোমরা তাকে কেউ জান না।
শুনেছি শাস্ত্রও পড়েছ সংস্কৃত ভাষায়;
সে সত্য ছিল যাদের জানার মধ্যে
পার্সি জবানিও জানা আছে।
কেউ নেই তারা।
গিয়েছ সমুদ্রপারে,
সেই বালক না আছে আপন স্বরূপে
ভারতে রাজসরকারের
না আছে কারো স্মৃতিতে।
ইম্পীরিয়ল রথযাত্রার লম্বা দড়িতে
সে গেছে চলে তার ছোটো সংসারটাকে নিয়ে;
"হেঁইয়ো' ব'লে দিতে হয়েছে টান।
তার সেদিনকার কান্না-হাসির
অর্থনীতি রাষ্ট্রনীতি
প্রতিধ্বনি আসে না কোনো হাওয়ায়।
মগজে বোঝাই হয়েছে কম নয়,
তার ভাঙা খেলনার টুকরোগুলোও
পুঁথির থেকেও কিছু,
দেখিনে ধুলোর 'পরে।
মানুষের প্রাণযাত্রা থেকেও বিস্তর।
সেদিন জীবনের ছোটো গবাক্ষের কাছে
তবু সব-কিছু নিয়ে
সে বসে থাকত বাইরের দিকে চেয়ে।
তোমার যে পরিচয় মুখ্য
তার বিশ্ব ছিল
সে তোমার আলাপ-পরিচয়ে।
সেইটুকু ফাঁকের বেষ্টনীর মধ্যে।
তুমি গল্প জমাতে পার।
তার অবোধ চোখ-মেলে চাওয়া
তাই যখন-তখন দেখি,
ঠেকে যেত বাগানের পাঁচিলটাতে
তোমার ঘরে মানুষ লেগেই আছে,
সারি সারি নারকেল গাছে।
কেউ তোমার চেয়ে বয়সে ছোটো
সন্ধ্যেবেলাটা রূপকথার রসে নিবিড়;
কেউ বয়সে বেশি।
বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝখানে
গল্প করতে গিয়ে মাস্টারি কর না,
বেড়া ছিল না উঁচু,
এই তোমার বাহাদুরি।
মনটা এদিক থেকে ওদিকে
তুমি মানুষকে জান, মানুষকে জানাও,
ডিঙিয়ে যেত অনায়াসেই।
জীবলীলার মানুষকে।
প্রদোষের আলো-আঁধারে
একে নাম দিতে পারি সাহিত্য,--
বস্তুর সঙ্গে ছায়াগুলো ছিল জড়িয়ে,
সব-কিছুর কাছে-থাকা।
দুইই ছিল একগোত্রের।
তুমি জমা করেছ তোমার মনে
সে-কয়দিনের জন্মদিন
নানা লোকের সঙ্গ,
একটা দ্বীপ,
সেইটে দিতে পার সবাইকে
কিছুকাল ছিল আলোতে,
অনায়াসে,--
কাল-সমুদ্রের তলায় গেছে ডুবে।
সেইটেকে জ্ঞানবিজ্ঞানের তকমা পরিয়ে
ভাঁটার সময় কখনো কখনো
পণ্ডিত-পেয়াদা সাজাও না
দেখা যায় তার পাহাড়ের চূড়া,
থমকিয়ে দিতে ভালোমানুষকে।
দেখা যায় প্রবালের রক্তিম তটরেখা।
তোমার জ্ঞানবিজ্ঞানের ভাণ্ডারটা
পঁচিশে বৈশাখ তার পরে দেখা দিল
পূর্ণ আছে যথাস্থানেই।
আর-এক কালান্তরে,
সেটা বৈঠকখানাকে কোণ-ঠেসা করে রাখেনি।
ফাল্গুনের প্রত্যুষে
যেখানে আসন পাত'
রঙিন আভার অস্পষ্টতায়।
গল্পের ভোজে
তরুণ যৌবনের বাউল
সেখানে ক্ষুধিতের পাতের থেকে ঠেকিয়ে রাখ
সুর বেঁধে নিল আপন একতারাতে,
লাইব্রেরি ল্যাবরেটরিকে।
ডেকে বেড়াল
একটিমাত্র কারণ,--
নিরুদ্দেশ মনের মানুষকে
মানুষের 'পরে আছে তোমার দরদ,--
অনির্দেশ্য বেদনার খ্যাপা সুরে।
যে-মানুষ চলতে চলতে হাঁপিয়ে ওঠে
সেই শুনে কোনো-কোনোদিন বা
সুখদুঃখের দুর্গম পথে,
বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মীর আসন টলেছিল,
বাঁধা পড়ে নানা বন্ধনে
তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন
ইচ্ছায় অনিচ্ছায়,--
তাঁর কোনো কোনো দূতীকে
যে-মানুষ বাঁচে,
পলাশবনের রঙমাতাল ছায়াপথে
যে-মানুষ মরে
কাজ-ভোলানো সকাল-বিকালে।
অদৃষ্টের গোলকধাঁদার পাকে।
তখন কানে কানে মৃদু গলায় তাদের কথা শুনেছি,
সে-মানুষ রাজাই হোক ভিখিরিই হোক
কিছু বুঝেছি, কিছু বুঝিনি।
তার কথা শুনতে মানুষের অসীম আগ্রহ।
দেখেছি কালো চোখের পক্ষ্ণরেখায়
তার কথা যে-লোক পারে বলতে সহজেই
জলের আভাস;
সে-ই পারে,
দেখেছি কম্পিত অধরে নিমীলিত বাণীর
অন্যে পারে না।
বেদনা;
বিশেষ এই হাল-আমলে।
শুনেছি ক্বণিত কঙ্কণে
আজ মানুষের জানাশোনা
চঞ্চল আগ্রহের চকিত ঝংকার।
তার দেখাশোনাকে
তারা রেখে গেছে আমার অজানিতে
দিয়েছে আপাদমস্তক ঢেকে।
পঁচিশে বৈশাখের
একটু ধাক্কা পেলে
প্রথম ঘুমভাঙা প্রভাতে
তার মুখে নানা কথা অনর্গল ছিটকে পড়ে--
নতুন ফোটা বেলফুলের মালা;
নানা সমস্যা, নানা তর্ক,
ভোরের স্বপ্ন
একান্ত মানুষের আসল কথাটা
তারি গন্ধে ছিল বিহ্বল।
যায় খাটো হয়ে।
সেদিনকার জন্মদিনের কিশোর জগৎ
আজ বিপুল হল সমস্যা,
ছিল রূপকথার পাড়ার গায়ে-গায়েই,
বিচিত্র হল তর্ক,
জানা না-জানার সংশয়ে।
দুর্ভেদ্য হল সংশয়,--
সেখানে রাজকন্যা আপন এলোচুলের আবরণে
আজকের দিনে
কখনো বা ছিল ঘুমিয়ে,
সেইজন্যেই এত করে বন্ধুকে খুঁজি,
কখনো বা জেগেছিল চমকে উঠে'
মানুষের সহজ বন্ধুকে
সোনার কাঠির পরশ লেগে।
যে গল্প জমাতে পারে।
দিন গেল।
এ দুর্দিনে
সেই বসন্তীরঙের পঁচিশে বৈশাখের
মাস্টারমশায়কেও অত্যন্ত দরকার।
রঙ-করা প্রাচীরগুলো
তাঁর জন্যে ক্লাস আছে
পড়ল ভেঙে।
পাড়ায় পাড়ায়--
যে পথে বকুলবনের পাতার দোলনে
প্রায়মারি, সেকেণ্ডারি।
ছায়ায় লাগত কাঁপন,
গল্পের মজলিস জোটে দৈবাৎ।
হাওয়ায় জাগত মর্মর,
সমুদ্রের ওপারে
বিরহী কোকিলের
একদিন ওরা গল্পের আসর খুলেছিল,
কুহুরবের মিনতিতে
তখন ছিল অবকাশ;
আতুর হত মধ্যাহ্ন,
ওরা ছেলেদের কাছে শুনিয়েছিল,
মৌমাছির ডানায় লাগত গুঞ্জন
রবিন্‌সন্‌ ক্রুসো,
ফুলগন্ধের অদৃশ্য ইশারা বেয়ে,
সকল বয়সের মানুষের কাছে
সেই তৃণ-বিছানো বীথিকা
ডন্‌ কুইক্‌সোট্‌।
পৌঁছল এসে পাথরে-বাঁধানো রাজপথে।
দুরূহ ভাবনার আঁধি লাগল
সেদিনকার কিশোরক
দিকে দিকে;
সুর সেধেছিল যে-একতারায়
লেক্‌চারের বান ডেকে এল,
একে একে তাতে চড়িয়ে দিল
জলে স্থলে কাদায় পাঁকে
তারের পর নতুন তার।
গেল ঘুলিয়ে।
সেদিন পঁচিশে বৈশাখ
অগত্যা
আমাকে আনল ডেকে
অধ্যাপকেরা জানিয়ে দিলে
বন্ধুর পথ দিয়ে
একেই বলে গল্প।
তরঙ্গমন্দ্রিত জনসমুদ্রতীরে।
বন্ধু,
বেলা-অবেলায়
দুঃখ জানাতে এলুম
ধ্বনিতে ধ্বনিতে গেঁথে
তোমার বৈঠকে।
জাল ফেলেছি মাঝদরিয়ায়;
আজকাল-এর ছাত্রেরা দেয়
কোনো মন দিয়েছে ধরা,
আজকাল-এর দোহাই।
ছিন্ন জালের ভিতর থেকে
আজকাল-এর মুখরতায়
কেউ বা গেছে পালিয়ে।
তাদের অটুট বিশ্বাস।
কখনো দিন এসেছে ম্লান হয়ে,
হায় রে আজকাল
সাধনায় এসেছে নৈরাশ্য,
কত ডুবে গেল কালের মহাপ্লাবনে
গ্লানিভারে নত হয়েছে মন।
মোটাদামের মার্কা-মারা
এমন সময়ে অবসাদের অপরাহ্নে
পসরা নিয়ে।
অপ্রত্যাশিত পথে এসেছে
যা চিরকাল-এর
অমরাবতীর মর্ত্যপ্রতিমা;
তা আজ যদি বা ঢাকা পড়ে
সেবাকে তারা সুন্দর করে,
কাল উঠবে জেগে।
তপঃক্লান্তের জন্যে তারা
তখন মানুষ আবার বলবে খুশি হয়ে,--
আনে সুধার পাত্র;
গল্প বলো।
ভয়কে তারা অপমানিত করে
উল্লোল হাস্যের কলোচ্ছ্বাসে;
তারা জাগিয়ে তোলে দুঃসাহসের শিখা
ভস্মে-ঢাকা অঙ্গারের থেকে;
তারা আকাশবাণীকে ডেকে আনে
প্রকাশের তপস্যায়।
তারা আমার নিবে-আসা দীপে
জ্বালিয়ে গেছে শিখা,
শিথিল-হওয়া তারে
বেঁধে দিয়েছে সুর,
পঁচিশে বৈশাখকে
বরণমাল্য পরিয়েছে
আপন হাতে গেঁথে।
তাদের পরশমণির ছোঁওয়া
আজো আছে
আমার গানে আমার বাণীতে।
সেদিন জীবনের রণক্ষেত্রে
দিকে দিকে জেগে উঠল সংগ্রামের সংঘাত
গুরু গুরু মেঘমন্দ্রে।
একতারা ফেলে দিয়ে
কখনো বা নিতে হল ভেরী।
খর মধ্যাহ্নের তাপে
ছুটতে হল
জয়পরাজয়ের আবর্তনের মধ্যে।
পায়ে বিঁধেছে কাঁটা,
ক্ষত বক্ষে পড়েছে রক্তধারা।
নির্মম কঠোরতা মেরেছে ঢেউ
আমার নৌকার ডাইনে বাঁয়ে,
জীবনের পণ্য চেয়েছে ডুবিয়ে দিতে
নিন্দার তলায়, পঙ্কের মধ্যে।
বিদ্বেষে অনুরাগে
ঈর্ষায় মৈত্রীতে,
সংগীতে পরুষ কোলাহলে
আলোড়িত তপ্ত বাষ্পনিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে
আমার জগৎ গিয়েছে তার কক্ষপথে।
এই দুর্গমে, এই বিরোধ-সংক্ষোভের মধ্যে
পঁচিশে বৈশাখের প্রৌঢ় প্রহরে
তোমরা এসেছ আমার কাছে।
জেনেছ কি,
আমার প্রকাশে
অনেক আছে অসমাপ্ত
অনেক ছিন্ন বিচ্ছিন্ন
অনেক উপেক্ষিত?
অন্তরে বাহিরে
সেই ভালো মন্দ,
স্পষ্ট অস্পষ্ট,
খ্যাত অখ্যাত,
ব্যর্থ চরিতার্থের জটিল সম্মিশ্রণের মধ্য থেকে
যে আমার মূর্তি
তোমাদের শ্রদ্ধায়, তোমাদের ভালোবাসায়,
তোমাদের ক্ষমায়
আজ প্রতিফলিত,
আজ যার সামনে এনেছ তোমাদের মালা,
তাকেই আমার পঁচিশে বৈশাখের
শেষবেলাকার পরিচয় বলে
নিলেম স্বীকার করে,
আর রেখে গেলেম তোমাদের জন্যে
আমার আশীর্বাদ।
যাবার সময় এই মানসী মূর্তি
রইল তোমাদের চিত্তে,
কালের হাতে রইল বলে
করব না অহংকার।
তার পরে দাও আমাকে ছুটি
জীবনের কালো-সাদা সূত্রে গাঁথা
সকল পরিচয়ের অন্তরালে;
নির্জন নামহীন নিভৃতে;
নানা সুরের নানা তারের যন্ত্রে
সুর মিলিয়ে নিতে দাও
এক চরম সংগীতের গভীরতায়।



</poem>
</poem>
</div>
</div>

[[Category:কবিতা]]
[[বিষয়শ্রেণী:কবিতা]]
[[Category:শেষ সপ্তক]]
[[বিষয়শ্রেণী:শেষ সপ্তক]]
[[Category:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]]
[[Category:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা]]
[[বিষয়শ্রেণী:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]]
[[বিষয়শ্রেণী:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা]]

১৩:২৪, ২০ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

টেমপ্লেট:BnHeader

শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র দত্ত প্রিয়বরেষু


তুমি গল্প জমাতে পার।
বসো তোমার কেদারায়,
ধীরে ধীরে টান দাও গুড়গুড়িতে,
উছলে ওঠে আলাপ
তোমার ভিতর থেকে
হালকা ভাষায়,
যেন নিরাসক্ত ঔৎসুক্যে,
তোমার কৌতুকে-ফেনিল মনের
কৌতূহলের উৎস থেকে।
ঘুরেছ নানা জায়গায়, নানা কাজে,
আপন দেশে, অন্য দেশে।
মনটা মেলে রেখেছিলে চারদিকে,
চোখটা ছিলে খুলে।
মানুষের যে-পরিচয়
তার আপন সহজভাবে,
যেমন-তেমন অখ্যাত ব্যাপারের ধারায়
দিনে দিনে যা গাঁথা হয়ে ওঠে,
সামান্য হলেও যাতে আছে
সত্যের ছাপ,
অকিঞ্চিৎকর হলেও যার আছে বিশেষত্ব,
সেটা এড়ায়নি তোমার দৃষ্টি।
সেইটে দেখাই সহজ নয়,
পণ্ডিতের দেখা সহজ।
শুনেছি তোমার পাঠ ছিল সায়ান্সে,
শুনেছি শাস্ত্রও পড়েছ সংস্কৃত ভাষায়;
পার্সি জবানিও জানা আছে।
গিয়েছ সমুদ্রপারে,
ভারতে রাজসরকারের
ইম্পীরিয়ল রথযাত্রার লম্বা দড়িতে
"হেঁইয়ো' ব'লে দিতে হয়েছে টান।
অর্থনীতি রাষ্ট্রনীতি
মগজে বোঝাই হয়েছে কম নয়,
পুঁথির থেকেও কিছু,
মানুষের প্রাণযাত্রা থেকেও বিস্তর।
তবু সব-কিছু নিয়ে
তোমার যে পরিচয় মুখ্য
সে তোমার আলাপ-পরিচয়ে।
তুমি গল্প জমাতে পার।
তাই যখন-তখন দেখি,
তোমার ঘরে মানুষ লেগেই আছে,
কেউ তোমার চেয়ে বয়সে ছোটো
কেউ বয়সে বেশি।
গল্প করতে গিয়ে মাস্টারি কর না,
এই তোমার বাহাদুরি।
তুমি মানুষকে জান, মানুষকে জানাও,
জীবলীলার মানুষকে।
একে নাম দিতে পারি সাহিত্য,--
সব-কিছুর কাছে-থাকা।
তুমি জমা করেছ তোমার মনে
নানা লোকের সঙ্গ,
সেইটে দিতে পার সবাইকে
অনায়াসে,--
সেইটেকে জ্ঞানবিজ্ঞানের তকমা পরিয়ে
পণ্ডিত-পেয়াদা সাজাও না
থমকিয়ে দিতে ভালোমানুষকে।
তোমার জ্ঞানবিজ্ঞানের ভাণ্ডারটা
পূর্ণ আছে যথাস্থানেই।
সেটা বৈঠকখানাকে কোণ-ঠেসা করে রাখেনি।
যেখানে আসন পাত'
গল্পের ভোজে
সেখানে ক্ষুধিতের পাতের থেকে ঠেকিয়ে রাখ
লাইব্রেরি ল্যাবরেটরিকে।
একটিমাত্র কারণ,--
মানুষের 'পরে আছে তোমার দরদ,--
যে-মানুষ চলতে চলতে হাঁপিয়ে ওঠে
সুখদুঃখের দুর্গম পথে,
বাঁধা পড়ে নানা বন্ধনে
ইচ্ছায় অনিচ্ছায়,--
যে-মানুষ বাঁচে,
যে-মানুষ মরে
অদৃষ্টের গোলকধাঁদার পাকে।
সে-মানুষ রাজাই হোক ভিখিরিই হোক
তার কথা শুনতে মানুষের অসীম আগ্রহ।
তার কথা যে-লোক পারে বলতে সহজেই
সে-ই পারে,
অন্যে পারে না।
বিশেষ এই হাল-আমলে।
আজ মানুষের জানাশোনা
তার দেখাশোনাকে
দিয়েছে আপাদমস্তক ঢেকে।
একটু ধাক্কা পেলে
তার মুখে নানা কথা অনর্গল ছিটকে পড়ে--
নানা সমস্যা, নানা তর্ক,
একান্ত মানুষের আসল কথাটা
যায় খাটো হয়ে।
আজ বিপুল হল সমস্যা,
বিচিত্র হল তর্ক,
দুর্ভেদ্য হল সংশয়,--
আজকের দিনে
সেইজন্যেই এত করে বন্ধুকে খুঁজি,
মানুষের সহজ বন্ধুকে
যে গল্প জমাতে পারে।
এ দুর্দিনে
মাস্টারমশায়কেও অত্যন্ত দরকার।
তাঁর জন্যে ক্লাস আছে
পাড়ায় পাড়ায়--
প্রায়মারি, সেকেণ্ডারি।
গল্পের মজলিস জোটে দৈবাৎ।
সমুদ্রের ওপারে
একদিন ওরা গল্পের আসর খুলেছিল,
তখন ছিল অবকাশ;
ওরা ছেলেদের কাছে শুনিয়েছিল,
রবিন্‌সন্‌ ক্রুসো,
সকল বয়সের মানুষের কাছে
ডন্‌ কুইক্‌সোট্‌।
দুরূহ ভাবনার আঁধি লাগল
দিকে দিকে;
লেক্‌চারের বান ডেকে এল,
জলে স্থলে কাদায় পাঁকে
গেল ঘুলিয়ে।
অগত্যা
অধ্যাপকেরা জানিয়ে দিলে
একেই বলে গল্প।
বন্ধু,
দুঃখ জানাতে এলুম
তোমার বৈঠকে।
আজকাল-এর ছাত্রেরা দেয়
আজকাল-এর দোহাই।
আজকাল-এর মুখরতায়
তাদের অটুট বিশ্বাস।
হায় রে আজকাল
কত ডুবে গেল কালের মহাপ্লাবনে
মোটাদামের মার্কা-মারা
পসরা নিয়ে।
যা চিরকাল-এর
তা আজ যদি বা ঢাকা পড়ে
কাল উঠবে জেগে।
তখন মানুষ আবার বলবে খুশি হয়ে,--
গল্প বলো।