জোড়াসাঁকোর ধারে/১৬: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

উইকিসংকলন থেকে
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
আফতাব বট (আলোচনা | অবদান)
প্রতিস্থাপন
বট পুরাতন শীর্ষক অপসারণ করছে, সমস্যা জানান
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:

{{শীর্ষক
<pages index="জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu" from=118 to=125 fromsection=B118 tosection=A125 header=1 />
| শিরোনাম = [[../]]
| লেখক = অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
| অনুবাদক =
| অনুচ্ছেদ = ১৬
| পূর্ববর্তী = [[../১৫/]]
| পরবর্তী = [[../১৭/]]
| টীকা =
}}
<pages index="জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu" from=118 to=125 fromsection=B118 tosection=A125 />

১৫:০১, ৫ জুলাই ২০২১ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

১৬

 সকাল থেকে ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। বসে থাকতে থাকতে মনে হল গঙ্গার রূপ—বর্ষায় গঙ্গা হয়তো ভরে উঠেছে এতক্ষণে।

 সেবার এখান থেকে কলকাতায় গিয়ে একবার গেলুম দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গাকে দেখতে। কিন্তু সে গঙ্গাকে যেন পেলেম না আর কোথাও। কোথায় গেল তার সেই রূপ। মনে হল কে যেন গঙ্গার আঁচল কেটে সেখানে বিচ্ছিরি একটা ছিটের কাপড় জুড়ে দিয়েছে। চারদিকে খানিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ফিরে এলেম বাড়িতে। কিন্তু দেখেছি আমি গঙ্গার সেই রূপ।—

 ‘বন্দ্য মাতা সুরধুনী পুরাণে মহিমা শুনি পতিত পাবনী পুরাতনী।’

 শিশুবোধ পড়তুম, বড় চমৎকার বই, অমন বই আমি আর দেখিনে। এখনকার ছেলেরা পড়ে না সে বই—

কুরুবা কুরুবা কুরুবা লিজ্জে
কাঠায় কুরুবা কুরুবা লিজ্জে
কাঠায় কাঠায় ধুল পরিমাণ
দশ বিশ কাঠায় কাঠায় জান।

 আমার যাত্রায় ছাগলের মুখে এই গান জুড়ে দিয়েছিলুম। কেমন সুন্দর কথা বল দেখিনি, যেন কুর কুর করে ঘাস খাচ্ছে ছাগলছানা।

 আরো সব নানা গল্প ছিল, দাতা কর্ণের গল্প, প্রহ্লাদের গল্প, সন্দীপনী মুনির পাঠশালায় কেষ্ট বলরাম পড়তে যাচ্ছেন, সন্দীপনী মুনির দ্বারে কেষ্ট বলরাম, আরো কত কি। বড় হয়েও এই সেদিনও পড়েছি আমি বইখানি মোহনলালকে দিয়ে আনিয়ে।

 তা সেই সুরধনী গঙ্গাকে দেখেছি আমি। ছেলেবেলায় কোন্নগরের বাগানে বসে বসে দেখতুম—দুকূল ছাপিয়ে গঙ্গা ভরে উঠেছে, কুলু কুলু ধ্বনিতে বয়ে চলেছে; সে ধ্বনি সত্যিই শুনতে পেতুম। ঘাটের কাছে বসে আছি, কানে শুনছি তার সুর, কুল্‌ কুল্‌ ঝুপ্‌, কুল্‌ কুল্‌ ঝুপ্‌—আর চোখে দেখছি তার শোভা—সে কী শোভা, সেই ভরা গঙ্গার বুকে ভরা পালে চলেছে জেলে নৌকো, ডিঙি নৌকো। রাত্তিরবেলা সারি সারি নৌকোর নানারকম আলো পড়েছে জলে। জলের আলো ঝিলমিল করতে করতে নৌকোর আলোর সঙ্গে সঙ্গে নেচে চলত। কোনো নৌকোয় নাচগান হচ্ছে, কোনো নৌকোয় রান্নার কালে হাঁড়ি চেপেছে, দূর থেকে দেখা যেত আগুনের শিখা।

 স্নানযাত্রীদের নৌকো সব চলেছে পর পর। রাতের অন্ধকারে সেও আর এক শোভা গঙ্গার। গঙ্গার সঙ্গে অতি নিকট সম্বন্ধ তেমন ছিল না; চাকররা মাঝে মাঝে গঙ্গাতে স্নান করাতে নিয়ে যেত, ভালো লাগত না, তাদের হাত ধরেই দু-বার জলে ওঠানামা করে ডাঙার জীব ডাঙায় উঠে পালিয়ে বাঁচতুম। কিন্তু দেখেছি, এমন দেখেছি যে দেখার ভিতর দিয়েই গঙ্গাকে অতি কাছে পেয়েছি।

 তার পর বড় হয়ে আর একবার গঙ্গাকে আর এক মূর্তিতে দেখি। খুব অসুখ থেকে ভুগে উঠেছি নিজে ওঠবার বসবার ক্ষমতা নেই। ভোর ছটায় তখন ফেরি স্টীমার ছাড়ে, জগন্নাথ ঘাট থেকে শিবতলা ঘাট হয়ে ফেরে নটা সাড়ে নটায়। বিকেলেও যায়, আপিসের বাবুদের পৌঁছে দিয়ে আসে। ঘণ্টা দুই-আড়াই লাগে। ডাক্তার বললেন, গঙ্গার হাওয়া খেলে সেরে উঠব তাড়াতাড়ি। নির্মল আমায় ধরে ধরে এনে বসিয়ে দিলে স্টীমারের ডেকে একটা চেয়ারে। মনে হল যেন গঙ্গাযাত্রা করতে চলেছি। এমনি তখন অবস্থা আমার। কিন্তু সাত দিন যেতে না-যেতে গঙ্গার হাওয়ায় এমন সেরে উঠলুম, নির্মলকে বললুম, ‘আর তোমায় আসতে হবে না, আমি একাই যাওয়া-আসা করতে পারব।’

 সেই দেখেছি সেবারে গঙ্গার রূপ। গ্রীষ্ম বর্ষ শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত কোনো ঋতুই বাদ দিইনি, সব ঋতুতেই মা গঙ্গাকে দেখেছি। এই বর্ষাকালে দুকূল ছাপিয়ে জল উঠেছে গঙ্গার,—লাল টকটক করছে। জলের রং—তোমরা খোয়াইধোয়া জলের কথা বল ঠিক তেমনি, তার উপরে গোলাপী পাল তোলা ইলিশ মাছের নৌকো এদিকে ওদিকে দুলে দুলে বেড়াচ্ছে, সে কি সুন্দর। তার পর শীতকালে বসে আছি ডেকে গরম চাদর গায়ে জড়িয়ে, উত্তুরে হাওয়া মুখের উপর দিয়ে কানের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলেছে হু হু করে। সামনে ঘন কুয়াশা, তাই ভেদ করে স্টীমার চলেছে একটানা। সামনে কিছুই দেখা যায় না। মনে হত যেন পুরাকালের ভিতর দিয়ে নতুন যুগ চলেছে কোন রহস্য উদ্ঘাটন করতে। থেকে থেকে হঠাৎ একটি দুটি নৌকো সেই ঘন কুয়াশার ভিতর থেকে স্বপ্নের মত বেরিয়ে আসত।

 দেখেছি, গঙ্গার অনেক রূপই দেখেছি। তাই তো বলি, আজকাল ভারতীয় শিল্পী বলে নিজেকে যারা পরিচয় দেয় ভারতীয় তারা কোন্‌খানটায়? ভারতের আসল রূপটি তারা ধরল কই? তাদের শিল্পে ভারত স্থান পায়নি মোটেই। কারণ তারা ভারতকে দেখতে শেখেনি, দেখেনি। এ আমি অতি জোরের সঙ্গেই বলছি। আমি দেখেছি, নানারূপে মা গঙ্গাকে দেখেছি। তাই তো ব্যথা বাজে, যখন দেখি কি জিনিস এরা হারায়। কত ভালো লাগত, কত আনন্দ পেয়েছি গঙ্গার বুকে। একদিনও বাদ দিইনি, আরো দেখবার, ভালো করে দেখবার এত প্রবল ইচ্ছে থাকত প্রাণে। গঙ্গার উপরে সে বয়সে কত হৈচৈই না করতুম। সঙ্গী সাথিও জুটে গেল। গাইয়ে বাজিয়েও ছিল তাতে। ভাবলুম, এ তে মন্দ নয়। গানবাজনা করতে করতে আমাদের গঙ্গা-ভ্রমণ জমবে ভালো। যেই না ভাবা, পরদিন বাঁয়া তবলা হারমোনিয়ম নিয়ে তৈরি হয়ে উঠলুম স্টীমারে। বেশির ভাগ স্টীমারে যারা বেড়াতে যেত তারা ছিল রুগীর দল। ডাক্তারের প্রেসকিপশন গঙ্গার হাওয়া খেতে হবে, কোনোরকমে এসে বসে থাকেন— স্টীমার ঘণ্টা কয়েক চলে ফিরে ঘুরে এসে লাগে ঘাটে, গঙ্গার হাওয়া খেয়ে তারাও ফিরে যায় যে যার বাড়িতে। আর থাকত আপিসের কেরানিবাবুরা, কলকাতার আশপাশ থেকে এসে আপিস করে ফিরে যায় রোজ। সেই একঘেয়েমির মধ্যে আমরা দু-চারজন জুড়ে দিলুম গানবাজনা। কি উৎসাহ আমাদের, দু-দিনেই জমে উঠল খুব। রায়বাহাদুর বৈকুণ্ঠ বোস মশায় বৃদ্ধ ভদ্রলোক, তিনিও আসেন স্টীমারে বেড়াতে। সম্প্রতি অসুখ থেকে উঠেছেন, খুব ভাল বাঁয়া তবলা বাজাতে পারতেন এককালে, তিনিও জুটে পড়লেন আমাদের দলে বাঁয়া তবলা নিয়ে। কানে একদম শুনতে পেতেন না, কিন্তু কি চমৎকার তবলা বাজাতেন। বললুম, ‘কি করে পারেন?’ তিনি বললেন, ‘গাইয়ের মুখ দেখেই বুঝে নিই।’ গানও হত, নিধুবাবুর টপ্পা, গোপাল উড়ের যাত্রা, এই সব। গানবাজনায় হৈ হৈ করতে করতে চলেছি—এদিকে গঙ্গাও দেখছি। এ খেয়ায় ও খেয়ায় স্টীমার থেমে লোক তুলে নিচ্ছে, ফেরি বোটও চলেছে যাত্রী নিয়ে। মাঝে মাঝে গঙ্গার চর—সে চরও আজকাল আর দেখিনে। ঘুষুড়ির চড়া বরাবর দেখেছি, বাবামশায়দের আমলেও তাঁরা যখন পলতার বাগানে যেতেন, ওই চরে থেমে স্নান করে রান্নাবান্নাও হত কখনো কখনো চরে, সেখানেই খাওয়াদাওয়া সেরে আবার বোট ছেড়ে দিতেন। বরাবরের এই ব্যবস্থা ছিল। এবারে ছেলেদের জিজ্ঞেস করলুম, ‘ওরে সেই চর কোথায় গেল? দেখছিনে যে। গঙ্গার কি সবই বদলে গেল? এ যে সেই গঙ্গা বলে আর চেনাই দায়।’

 তা সেই তখন একদিন দেখলুম। সে যে কি ভালো লেগেছিল। স্টীমার চলেছে খেয়া থেকে যাত্রী তুলে নিয়ে। সামনে চর যেন—এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যিখানে চর তার মাঝে বসে আছে শিবু সদাগর। ওপাশের ঘাটে একটি ডিঙি নৌকো। ছোট্ট গ্রামের ছায়া পড়েছে, ঘাটে ডিঙি নৌকায় ছোট্ট একটি বউ লাল চেলি পরে বসে—শ্বশুরবাড়ি যাবে, কাঁদছে চোখে লাল আঁচলটি দিয়ে, পাশে বুড়ি দাই গায়ে হাত বুলিয়ে সান্তত্বনা দিচ্ছে, নদীর এপার বাপের বাড়ি, ওপার শ্বশুরবাড়ি—ছোট্ট বউ কেঁদেই সারা ওইটুকু রাস্তা পেরতে। সে যে কি সুন্দর দৃশ্য, কি বলব তোমায়। মনের ভিতর আঁকা হয়ে রইল সেদিনের সেই ছবি, আজও আছে ঠিক তেমনটিই। এমনি কত ছবি দেখেছি তখন। গঙ্গার দুদিকে কত বাড়ি ঘর, মিল, ভাঙা ঘাট, কোথাও বা দ্বাদশ মন্দির, চৈতন্যের ঘাট, বটগাছটি গঙ্গার ধারে ঝুঁকে পড়েছে তারই নিচে এসে বসেছিলেন চৈতন্যদেব—গদাধরের পাট, এই সব পেরিয়ে স্টীমার চলত এগিয়ে। গান হৈ-হল্লার ফাঁকে ফাঁকে দেখাও চলত সমানে। এই দেখার জন্য ছেলেবেলার এক বন্ধুকে কেমন একদিন তাড়া লাগিয়েছিলুম। বলাই, ছেলেবেলায় এক সঙ্গে পড়েছি—অসুখে ভোগার পর একদিন দেখি সেও এসেছে স্টীমারে, দেখে খুব খুশি। খানিক কথাবার্তার পর সে পকেট থেকে একটি বই বের করে পাতা খুলে চোখের সামনে ধরলে, দেখি একখানি গীতা। একমনে পড়েই চলল, চোখ আর তোলে না পুথির পাতা থেকে। বললে, ‘মা বলে দিয়েছেন গীতা পড়তে, আমায় বিরক্ত কোরো না।’ বললুম, ‘বলাই, ও বলাই, বইটা রাখ্‌ না। কি হবে ও-বই পড়ে, চেয়ে দেখ্‌ দেখিনি কেমন দুপাতা খোলা রয়েছে সামনে, আকাশ আর জল, এতেই তোর গীতার সব কিছু পাবি। দেখ্‌ না একবারটি চেয়ে দেখ ভাই।’ বলাই মুখ তোলে না। মহামুশকিল।

 ধম্মকম্ম আমার সয় না। কোনোকালে করিওনি। ওসব দিকই মাড়াইনে। আর তা ছাড়া প্রথম প্রথম যখন আসি স্টীমারে, একদিন পিছনে সেকেণ্ড ক্লাসে বসে কেরানিবাবুরা এ ওর গায়ে ঠেলা মেরে চোখ ইশারা করে বলছে, ‘কে রে, এ কে এল?’ একজন বললে, ‘অবন ঠাকুর ঠাকুরবাড়ির ছেলে।’ আর একজন বললে, ‘ও, তাই, বয়েসকালে অনেক অত্যাচার করেছে এখন এসেছে পরকালের কথা ভেবে গঙ্গায় পুণ্যি করতে।’ শুনেছিলুম আপন মনেই। কিন্তু কথাটা মনে ছিল।

 অবিনাশ ছিল আমাদের মধ্যে ষণ্ডাগুণ্ডা ধরনের। আমার সঙ্গে আসত গানবাজনার আড্ডা জমাতে। তাকে ঠেলা দিয়ে বললুম, ‘দেখ না অবিনাশ, ওদিকে যে গীতার পাতা থেকে চোখই তুলছে না বলাই আর কোনোদিকে।’ শুনে অবিনাশ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, বলাই বই পড়ছে ঘাড় গুঁজে তার ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বইটি ছোঁ মেরে নিয়ে একেবারে তার পকেটজাত করলে। বলাই চেচিয়ে উঠল, ‘কর কি, কর কি মা বলে দিয়েছেন সকাল-বিকেল গীতা পড়তে।’ আর গীতা! অবিনাশ বললে, ‘বেশি বাড়াবাড়ি কর তো গীতা জলে ফেলে দেব।’ বলাই আর কি করে, সেও শেষে আমাদের গানে বাজনায় যোগ দিলে। কেরানিবাবুরা দেখি উৎসুক হয়ে থাকেন আমাদের গানবাজনার জন্য। যে কেরানিবাবু আমাকে ঠেস দিয়ে সেদিন ওই কথা বলেছিলেন তিনি একদিন স্টীমারে উঠতে গিয়ে পা ফসকে গেলেন জলে পড়ে, আমরা তাড়াতাড়ি সারেঙকে বলে তাকে টেনে তুলি জল থেকে। পরে আমার সঙ্গে তাঁর খুব ভাব হয়ে যায়। তখন যে কেউ আসত আমাদের ওই দলে যোগ না দিয়ে পারত না। একবার এক যাকে বলে ঘোরতর বুড়ো—নাম বলব না—শরীর সারাতে স্টীমারে এসে হাজির হলেন। দেখে তো আমার মুখ শুকিয়ে গেল। অবিনাশকে বললুম, ‘ওহে অবিনাশ, এবারে বুঝি আমাদের গান বন্ধ করে দিতে হয়। টপ্পা খেয়াল তো চলবে না আর ধর্ম-সংগীত ছাড়া।’ সবাই ভাবছি বসে, তাই তো। আমাদের হারমোনিয়ম দেখে তিনি বললেন, ‘তোমাদের গানবাজনা হয় বুঝি। তা চলুক না, চলুক।’ মাথা চুলকে বললুম, ‘সে অন্য ধরনের গান।’ তিনি বললেন, বেশ তো তাই চলুক, চলুক না। ভয়ে ভয়ে গান আরম্ভ হল। দেখি তিনি বেশ খুশি মেজাজেই গান শুনছেন। তাঁর উৎসাহ দেখে আর আমাদের পায় কে—দেখতে দেখতে টপাটপ টপ্পা জমে উঠল। শুধু গানই নয়, নানারকম হৈচৈও করতুম, সমস্ত স্টীমারটি সারেঙ থেকে মাঝিরা অবধি তাতে যোগ দিত। জেলে নৌকো ডেকে ডেকে মাছ কেনা হত—ইলিশ মাছ, তপসে মাছ। একদিন ভাই রাখালি অনেকগুলি তপসে মাছ কিনে বাড়ি নিয়ে গেল। পরদিন জিজ্ঞেস করলুম, ‘কি ভাই কেমন খেলি তপসে মাছ?’ সে বললে, ‘আর বোলো না দাদা, আমায় আচ্ছা ঠকিয়ে দিয়েছে। তপসে নয়, সব ভোলামাছ দিয়ে দিয়েছিল, ভোলামাছ দিয়ে ভুলিয়ে ঠকিয়ে দিলে।’ আমরা সব হেসে বাঁচিনে। সেই রাখালি বলত, ‘অবনদাদা, তুমি যা করলে, দিল্লিতে মেডেল পেলে, খেতাব পেলে, ছবি এঁকে হিস্ট্রিতে তোমার নাম উঠে গেল।’ এতেই ভায়া আমার খুশি। আমাদের স্টীমারযাত্রীদের সেই দলটির নাম দিয়েছিলুম গঙ্গাযাত্রী ক্লাব। এই গঙ্গাযাত্রী ক্লাবের জন্য স্টীমার কোম্পানির আয় পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। দস্তুরমত একটি বিরাট আড্ডা হয়ে উঠেছিল। একবার ডারবির লটারির টিকিট কেনা হল ক্লাবের নামে। সকলে এক টাকা করে চাঁদা দিলুম। টাকা পেলে ক্লাবের সবাই সমান ভাগে ভাগ করে নেব। বৈকুণ্ঠবাবু প্রবীণ ব্যক্তি, তাকেই দেওয়া হল টাকাটা তুলে। তিনি ঠিকমত টিকিট কিনে যা যা করবার সব ব্যবস্থা করলেন। ওদিকে রোজই একবার করে সবাই জিজ্ঞেস করি, ‘বৈকুণ্ঠবাবু, টিকিট কিনেছেন তো ঠিক?’ তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, সব ঠিক আছে, ভেবো না। টাকাটা পেলে ঠিকমতই ভাগাভাগি হবে।’ তা তো হবে, কিন্তু মুখে মুখে কথা সব, লেখাপড়া তো হয়নি কিছুই। অবিনাশকে বললুম, ‘অবিনাশ, এই তো ব্যাপার, কি হবে বল তো?’ অবিনাশ ছিল ঠোঁটকাটা লোক, পরদিন বৈকুণ্ঠবাবু স্টীমারে আসতেই সে চেপে ধরলে, ‘বৈকুণ্ঠবাবু, আপনাকে উইল করতে হবে।’ ‘উইল? সে কি, কেন?’ ‘কেন নয়, আপনাকে করতেই হবে।’ বৈকুণ্ঠবাবু দারুণ ঘাবড়ে গেলেন—বুঝতে পারছেন না কিসের উইল। অবিনাশ বললে, ‘টাকাটা পেলে শেষে যদি আপনি আমাদের না দেন বা মরে-টরে যান, টিকিট তো আপনার কাছে। তখন কি হবে? আজই আপনাকে উইল করতে হবে।’ বৈকুণ্ঠবাবু হেসে বললেন, ‘এই কথা? তা বেশ তো, কাগজ কলম আনো।’ তখনি কাগজ কলম জোগাড় করে বসল সবাই গোল হয়ে। কি ভাবে লেখা যায়, উকিল চাই যে উকিল ছিলেন একজন সেখানে—তিনিও গঙ্গাযাত্রী ক্লাবের মেম্বার, ডিসপেপসিয়ায় ভুগে ভুগে কঙ্কালসার দেহ হয়েছে তাঁর। তাঁকেই চেপে ধরা গেল, তিনি মুসাবিদা করলেন—উইল তৈরি হল, গঙ্গাযাত্রী ক্লাবের টিকিটে যে টাকা পাওয়া যাবে তা নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ সমান ভাগে পাবে ও আমার অবর্তমানে আমার ভাগ আমার সহধর্মিণী শ্রীমতী অমুক পাবেন ব’লে নিচে বৈকুণ্ঠবাবু নাম সই করলেন। উইল তৈরি। কিছুদিন বাদে ডারবির খেলা শুরু হল। রোজই কাগজ দেখি আর বলি, ‘ও বৈকুণ্ঠবাবু, ঘোড়া উঠল?’ জানি যে কিছুই হবে না তবু রোজই সকলের ওই এক প্রশ্ন। একদিন এইরকম ‘ও বৈকুণ্ঠবাবু, ঘোড়া উঠল’ প্রশ্ন করতেই বৈকুণ্ঠবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ঘোড়া উঠেছে, ঘোড়া উঠেছে, ওই দেখুন, সামনে।’ চেয়ে দেখি বরানগরের পরামানিক ঘাটের কাছ বরাবর একজোড়া কালো ঘোড়। জল থেকে উঠছে। স্নান করাতে জলে নামিয়েছিল তাদের। অমনি রব উঠে গেল, আমাদের ঘোড়া উঠেছে, ঘোড়া উঠেছে। গঙ্গাযাত্রীদের কপালে ঘোড়া ওই জল থেকেই উঠে রইল শেষ পর্যন্ত।

 কি দুরন্তপনা করেছি তখন মা গঙ্গার বুকে। কত রকমের লোক দেখেছি, কতরকম ক্যারেক্টার সব। একদিন এক সাহেব এসে ঢুকল স্টীমারে। গঙ্গাপারের কোন্‌ মিলের সাহেব, লম্বাচওড়া জোয়ান ছোকরা, হাতে টেনিস ব্যাট, দেখেই মনে হয় সদ্য এসেছে বিলেত থেকে। সাহেব দেখেই তো আমরা যে যার পা ছড়িয়ে গম্ভীর ভাবে বসলুম সবাই, মুখে চুরুট ধরিয়ে। সাহেব ঢুকে এদিক ওদিক তাকাতেই সেই ডিস্‌পেপটিক উকিল তাড়াতাড়ি তাঁর জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সাহেব বসে পড়ল সেখানে। আড়ে আড়ে দেখলুম, এমন রাগ হল সেই উকিলের উপর। সঙ্গে সঙ্গে সাহেবের চাপরাসিও এসে জায়গার জন্য ঠেলাঠেলি করতে লাগল ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট হাতে নিয়ে—টিকিট আছে তো এখানে সে বসবে না কেন? অবিনাশ তো উঠল রুখে, বললে, ‘ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট আছে তো নিচে যা, সেখানে কেবিনে বোস গিয়ে—এখানে আমাদের সমান হয়ে বসবি কি?’ বলে জামার হাতা গুটোতে লাগল। দেখি একটা গোলযোগ বাধবার জোগাড়। গোলযোগ শুনে সাহেবও উঠে দাঁড়িয়েছে, বুঝতে পারছে না কিছু। সাহেবকে বললুম, ‘চাপরাসিকে এখানে ঢুকিয়েছ কেন, তাকে পিছনে যেতে বল।’ বিলিতি সাহেব, এদেশের হালচাল জানে না, ব্যাপারটা বুঝে চাপরাসিকে পিছনে পাঠিয়ে দিলে। সাহেবটি লোক ছিল ভালো। খানিক বাদে সে নেমে গেল চাপরাসিকে নিয়ে। উকিলকে বললুম, ‘সাহেব তোমায় কি জিজ্ঞেস করছিল হে?’ সে বললে, ‘সাহেব জানতে চাইলে তুমি কে।’ বললুম, ‘নাম দিয়ে দিলে বুঝি?’ সে বললে, ‘হ্যাঁ।’ বললুম, ‘বেশ করেছ, এত লোক থাকতে তুমি আমারই নাম দিতে গেলে কেন? এবার আমার নামে কেস করলেই মারা পড়েছি।’ চিরকালের ভীতু আমি, ভয় পেয়েছিলুম বই কি একটু।

 ‘পথে বিপথে’র জাহাজী গল্পগুলি আমি তখনই লিখি। স্টীমারের সেই সব ক্যারেকটারই গেঁথে গেঁথে দিয়েছি তাতে। অনেক দিন বাদে ভাদরের ভরা গঙ্গার ছবি এঁকেছিলুম দু-চারখানি। একজিবিশনে দিয়েছিলুম, কোথায় গেল তা কে জানে। একখানি মনে আছে, রুমানিয়ার রাজা নিলেন, গঙ্গার ছবি রুমানিয়ার রাজা নিয়ে চলে গেলেন, দেশি লোকের নজরই পড়ল না তাতে, অথচ মা গঙ্গা মা গঙ্গা বলে আমরা চেঁচিয়ে আওড়াই খুব—বন্দ মাতা সুরধুনী, পুরাণে মহিমা শুনি, পতিতপাবনী পুরাতনী। আর ডুব দিয়ে দিয়ে উঠি আমাদের সেই ডারবির ঘোড়া ওঠার মতন।