বিষয়বস্তুতে চলুন

বিশ্বমানবের লক্ষ্মীলাভ

উইকিসংকলন থেকে

বিশ্বমানবের লক্ষ্মীলাভ

বিশ্বমানবের লক্ষ্মীলাভ

একেলে কথকতা

সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়

২ বঙ্কিম চাটুজ্জে স্ট্রীট, কলিকাতা

প্রকাশ ১৩৪৭ বৈশাখ

প্রকাশক প্রপুলিনবিহারী সেন
বিশ্বভারতী, ৬।৩ দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন, কলিকাতা

মুদ্রাকর শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
শান্তিনিকেতন প্রেস, শান্তিনিকেতন

ধরো! ধরো!
ওগো ঘরে-বাইরের নাতি-নাতনীরা।
অনেক মজার জিনিস জুটিয়ে এনেছি, সব ধরে—
লক্ষ্মণ যেমন ফল ধরেছিল, ওরকম বোকার মতো নয়—
পড়বে, ভাববে, আমোদ করবে ব'লে।
তোমাদের মা-বাপেরা একটু গম্ভীর হয়ে পড়েছেন,
ভাই, চুপিচুপি বলি, সাবধানের মার নেই।
কানটা যদি আমার দিকে রাখ,
আমার কথা শোনার সুবিধে তো হবেই,
ওদিক থেকে মলানির তয়টাও কম থাকবে।

তোমাদের 
দাদা 

ভণিতা

 ভূগোল নামে আমাদের ছেলেবেলায় যা পড়তে হত, তার বেশির ভাগই ফর্দের মতো ছিল— রাজ্যের ফর্দ, শহরের, সমুদ্রের, নদীর, পাহাড়ের, মরু-ভূমির ফর্দ। আর ছিল অঙ্কের ঘটা,— দেশের প্রসার, শহরের ভিড়, নদীর লম্বাই, পাহাড়ের খাড়াই,— রকম-বেরকমের অঙ্ক, সাংখ্য প্রদর্শনী বললেও হয়। এ সব তথ্য এমন ভাবে ধরে দেওয়া হত, যেন চিরকাল ঐ ছিল, আজও আছে, বরাবরই থাকবে। এক কথায়, জগতের জঙ্গমত্ব লোপাট করে দিয়ে পৃথিবীর চেহারা একটা স্থাবর পিণ্ডের মতো দেখানো হত!

 কিন্তু আমাদের আমলটুকুর মধ্যে কী হের-ফের না দেখা গেল। কত রাজ্যের রাজা কালের কবলে পড়ল, রক্তস্রোতের তোড়ে কত সীমানার অদলবদল হল। কোথাও বা কাটা খালের জলে মরু উদ্ধার পেল, কোথাও নদী শুখিয়ে লোকালয় উজাড় হতে চলল। সমুদ্রে সমুদ্রে যোগ করা হল, মানুষে মানুষে বিচ্ছেদ বাড়তে থাকল; যানবাহনের গতি বেড়ে গেল তো কাছাকাছির ঘেঁষার মতি রইল না। দেখে শুনে সেয়ানা হবার পর সেকেলে ভুগোলের পাতা ওলটালে কোন্‌ অতীতের পুঁথির মতো লাগে।

 কাজেই আজকালকার শিক্ষা ব্যাপার হয়েছে রকমারি। কোন্‌ দেশে কত শহর আছে জানিয়ে দিলেই কথা ফুরোয় না; সে সে জায়গায় লোকে জটলা করল কেন, নগরপল্লীর মরণবাচনের ধারা কেমন, তাতে দৈবের হাত কতখানি, মানুষ নিজেই বা কী করতে পারে— নানান আলোচনা এসে পড়ে। তেমনি এখানে-ওখানে পাহাড়গুলো পাশাপাশি মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে দেখিয়ে দিলেই কৌতূহল মেটে না; ও কিসের ঠেলায় ওরা সার বেঁধে আকাশ ফুঁড়ে উঠল, ওদের গায়ে কিরকম অক্ষরে পৃথিবীর ইতিহাস টোঁকা আছে, সে লিখন কেমন ক’রে পড়ে,— শিক্ষার আসনে যিনি বসেন তাঁকে এমন কত কী খবর যোগাতে হয়।

  মানুষের শিক্ষা বল, চেষ্টা বল, তার প্রথম উদ্দেশ্য লক্ষ্মীলাভ। 'প্রথম' বলছি কেন, না, সচ্ছলতার ব’নেদের উপর দাঁড়াতে না পারলে, আরো উপরের দিকে হাত বাড়ানোরই যো থাকে না। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক, তাঁকে পাবার লালসে লোকে যে-রকম ঠেলাঠেলি কাড়াকাড়ি বাধায়, তাতে লক্ষ্মীকে দেশছাড়া কেন, পৃথিবীছাড়া করার যোগাড় করেছে। দোষ শুধু এ যুগের নয়, মন দিয়ে দেখলে দেখা যায় যে, কোনো দেশে কোনো কালে লক্ষ্মীকে দুস্থির হয়ে তিষ্ঠতে দেওয়া হয়নি। সাধে চাঞ্চল্যরোগ তাঁর ধাতে ব'সে গেছে।

  ব্রাহ্মণ প্রাধান্যের সত্যযুগে তাঁদের সাধনায় পাওয়া অধ্যাত্মতত্ত্ব আজও জগতের সম্পদ ব'লে মানা হয়। কিন্তু লক্ষ্মীকে আটক রাখার কথা তাঁরা ভাবেননি, তাই তাঁদের প্রচার-করা বাণী চিদাকাশেই উড়ে বেড়াচ্ছে, কর্মদেহ নিয়ে ধরাধামের লক্ষ্মীশ্রী বিধান করে উঠতে পারল না।

 ত্রেতার ক্ষত্রিয়রাজারা একমাত্র ভারতে প্রকট হননি পৃথিবীময় বিকটভাবে তাঁরা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। “পুরুষসিংহ” উপাধি পাবার যোগ্যপাত্র হলেও, সাম্রাজ্যনেশায় তাঁদের উদ্যোগ বরাবর এমনি উদ্ভ্রান্ত যে, হতভাগা প্রজাদের শ্রীসম্বৃদ্ধি বারে বারে নষ্ট বৈ পুষ্ট হতেই পেল না।

  এক রকমের বাহাদুরি দেখিয়েছেন দ্বাপরের বৈশ্য কর্তারা, য়ুরোপে ধারা বিরাজ করেন। ওঁদের লোভ তো রাবণের চুলোর মতো জ্বলতেই আছে। সে-লোভের খোরাক জোগাবার কাজে ওঁরা ব্রাহ্মণের বিজ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের বীরত্ব, দুটোকেই জুড়ি জুতে লাগিয়ে রাখতে পেরেছেন। মাঝে মাঝে যুদ্ধের যে-আগুন জ্বলে ওঠে তার ঝলসানি খেয়েও ওঁদের হুঁশ হল না, আসছে বারের অগ্নিকাণ্ডে পিলপিল করে ঝাঁপ দেওয়াটা বাকি। ইতিমধ্যে গো-বেচারীর আড্ডা যেখানে যত ছিল, তা লুটপাট করে এক একটি কুবের হয়ে উঠলেও, লক্ষ্মীলাভের হিসেবে ওঁদের নাম খরচের খাতায় লিখতে হয়।

 রইল শূদ্র, যাঁদিকে ভাষায় বলে শ্রমিক। ঘোর কলি ঘনিয়ে আসায় এবার লক্ষ্মী-আহ্বানের পালা পড়েছে তাঁদের। গত ক'বার অবতার হয়েছেন এক-একটি করে জীব, নৃসিংহের বেলা না হয় জোড়া জীব। গতিক যেরকম, এবার বুঝি মানবসংঘের বৃহৎ কলেবরে ভগবান অবতীর্ণ হতে ইচ্ছে করছেন। এবার শ্রমিকের রাজত্বের পালা। ধনীর দিন ফুরিয়ে আসার আভাস চারিদিকেই পাওয়া যাচ্ছে। রুশদেশে শ্রমিক-প্রধান তন্ত্র দেখতে দেখতে গড়ে উঠছে। হয়তো সেখানে স্বয়ং কল্কি এসে পড়েছেন বা,- সেই USSR[] এর মূর্তি ধরে, যাঁদের সংঘবদ্ধ উদ্যমে পুরোনো মানবসমাজের যত আধ-মরা সংস্কারবিকার আচারবিচার, সমস্ত ঝেঁটিয়ে ফেলে আগামী সত্যযুগের জমি পরিষ্কার করে রাখা হচ্ছে।

 সে যাই হোক, এইটুকু ঠিক যে, লক্ষ্মীকে অচলা করে রাখতে না পারলেও, USSR তাঁর প্রসাদ বিতরণের এলোমেলো-পনা কাটিয়ে ওঠার হিকমত বার করেছেন। ধাত যাবে কোথায়, এঁদেরও এলাকার মধ্যে লক্ষ্মী অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়ান, কখনো দিতে ভোলেন, কখনো বা বেশি ঢালেন; কিন্তু এঁদের পঞ্চবার্ষিক সংকল্প (5-year-plan) যখন যেখানে যতখানি পায়, কুড়িয়ে গুছিয়ে নিয়ে তা থেকে সবাইকার দরকার বুঝে পরিবেশন করে। তা ছাড়া, ভক্তের আওড়ানো মন্ত্র অনেক সময় দেবী কানেই তোলেন না, কিন্তু এঁদের নাছোড়বান্দা বৈজ্ঞানিক তন্ত্রের পেড়াপিড়ি তিনি অত সহজে এড়াতে পারেন না।

 সেকালের কথকঠাকুরেরা যে সব পুরাণকাহিনী বলতেন, তার চেয়ে লক্ষ্মীছাড়া নারায়ণের চির বিরহ ঘোচাবার জন্যে USSR-এর যে নতুন ধরনের যজ্ঞ চলছে, তার গল্প কম মনোহারী বা হিতকারী হবে না, এই আশায় নারায়ণ (বলতে বিশ্বমানবের যিনি অন্তর্যামী নিয়ন্তা) নরোত্তম (বলতে যারা গুরুস্থানীয়) আর দেবী সরস্বতী (বলতে যে প্রজ্ঞার কৃপায় গুরুবাণীর মর্ম হৃদয়ংগম হয়) মনে মনে তাঁদিকে নমস্কার ক'রে আমি ভনতে বসে গেছি। পুণ্যবান না হলেও কারো শুনতে মানা নেই। ইতি

সুরেন ঠাকুর 

নির্ঘণ্ট

ভণিতা
 
বেদের গল্প
  
১৩
 
চাষার গল্প
  
১৬
 
দুর্গতি-নাশন যজ্ঞারম্ভ
  
২১
 
মাটির কথা
  
২৫
 
জলের কথা
  
৩২
 
আকাশের কথা
  
৪৩
 
পাতালের কথা
  
৫১
 
আহারের সমস্যা
  
৬৪
 
শ্রেষ্ঠের তল্লাশ
  
৭০
 
কুল-শীলের রহস্য
  
৮০
 
ঈশা-সংকট
  
৮৯
 
মহাভাঙন তন্ত্র
  
১০৩
 
অর্বাচীনের কথা
  
১০৭
 
গ্রামের কথা
  
১০৯
 
গ্রাম্য বৈঠক
  
১১২
 
জমিদার-রাখালের কথা
  
১২০
 
সমবায়-নেতার কথা
  
১২৫
 
গোপিকা কর্ত্রীর কথা
  
১৩০
 
ফলেন পরিচীয়তে
  
১৩৮
 
ধর্ম-এব হতো হন্তি
  
১৪২
 
ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা
  
১৫০
 
স্বে মহিম্নি
  
১৫৬
 
ন হি কল্যাণ-কৃৎ দুর্গতিং গচ্ছতি
  
১৭২
 
কী হবে
  
১৮২
 
কুলক্ষণ
  
১৮৫
 
ভয় নেই
  
১৮৬
 
ঋণ-স্বীকার
  
১৯০
 
খেলার ভাব
  
১৯১
 
খেলার উৎপত্তি
  
১৯৩
 
ভয় ভাবনা, আশা ভরসা
  
১৯৪
 
সত্যাগ্রহ-সংকল্প
  
১৯৫

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৫ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৫ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।

  1. ইউ এস্ এস্ আর রুশ-মহাদেশের সমবেত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ।