বিশ্বমানবের লক্ষ্মীলাভ (১৯৪০)/চতুর্থ পালা
চতুর্থ পালা
প্রবাসী-গ্রামবাসী সংবাদ
মহাভাঙন তন্ত্র
বিপ্লবের প্রথম পঞ্চবার্ষিক সংকল্পে চাষাদের উপর হাত পড়েনি। শ্রমিকদের মধ্যে ওরাই সবচেয়ে অবুঝ, সবচেয়ে পুরোনোর গোঁড়া। তা ছাড়া, তখনো বাইরের শত্রুর আক্রমণ পুরোদমে চলেছে। এ অবস্থায় দেশসুদ্ধ লোককে ঘাঁটালে সামলানো মুশকিল হত।
১৯৩০ সালের গোড়ায় বিপ্লবীকর্তারা সময় বুঝে উপদেশ জারি করলেন, “এখন চাষাকেও বিপ্লবের মধ্যে নিজের স্থান ঠিক করে নিতে হবে, তাই এবারকার পঞ্চবার্ষিক সংকল্প শেষ না হতেই, বাপপিতামহের ধারা ছেড়ে, নিজের জমিবাড়ি, নিজের গোরুভেড়ার মায়া কাটিয়ে গ্রামসমবায়ের (kolhoxy) মধ্যে তাদের আত্মসমর্পণ করা আবশ্যক।”
কর্তাদের বিধান অনুসারে, এই সমবায়ই গ্রামের সব কাজ চালাবে। একসঙ্গে গুছিয়ে কলের সাহায্যে চাষবাস পশুপালন করলে আগের চেয়ে ফল অনেক বেশি পাওয়ার কথা, তাই দিয়ে সমবায়ীদের জীবনযাত্রা ভালোমতে চালিয়েও যা বাঁচবে সেটা দেশের অভাব পূরণের জন্যে কর্তৃপক্ষের হাতে থাকবে। তাতে পল্লীবাসীরও অবস্থার উন্নতি হবে, রাষ্ট্রমধ্যে অসাম্য ক্রমে আর থাকবে না।
সমবায়ভুক্ত হতে যাদের নেহাতই মন সরবে না, তাদের উপর জবরদস্তি করার হুকুম হয়নি; তারা নিজেদের পরিবার পালনের জন্যে একটি গোরু বা ঘোড়া, গুটিকতক ছাগল ভেড়া বা শুয়োর রাখতে পারার ব্যবস্থা হল। কিন্তু সমাজে তাদের মানমর্যাদা থাকবে না, সমবায়ভাণ্ডারে সস্তায় কেনার অধিকার তারা পাবে না; তা ছাড়া, এ ভাবে রাখা সম্পত্তির মূল্য অনুসারে তাদিকে একলসেঁড়ে টেক্স দিতে হবে।
কিন্তু পরের মেহনতে নিজের দরকারের অতিরিক্ত চাষআবাদ করিয়ে, বা পশু রেখে, বা কারবার চালিয়ে বিনাশ্রমে আরামের চেষ্টা একেবারেই মানা। এটা অপরাধের মধ্যে গণ্য। এরকম কুধনী (koolack) ধরা পড়লে, তার সম্পত্তি সরকারে বাজেয়াপ্ত হয়ে তাকে নিধনী (de-koolackise) করে দিয়ে, যেখানে নতুন আবাদ করা হচ্ছে সেখানে তাকে সপরিবারে মজুরি করতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
মরিস হিণ্ডাস (Maurice Hindus) একজন নামজাদা লেখক। তাঁর জন্ম রুশের এক গণ্ডগ্রামে। ১৪।১৫ বছর বয়সে ঘরবাড়ি ছেড়ে তিনি মার্কিন দেশে গিয়ে বসবাস করেন; সেখানেই কৃতী হন। কিন্তু দেশের উপর তাঁর টান যায়নি, তার সব খবর তিনি রাখতেন।
বিপ্লব শুরু হলে, সেই প্রবাসী জন্মভূমিতে বেড়াতে এসে বুঝতে পেরেছিলেন যে, রুশের মাটির সঙ্গে চিরকাল লেপ্টে আছে যে-চাষী, এ মহা নাটকে তাকেই প্রধান পাত্র হতে হবে, যদিও তখনো ভূমির স্বত্বাধিকার নিয়ে আইনের টানাটানি পড়েনি। পরে মার্কিন দেশে ফিরে গিয়ে তিনি যখন বিপ্লবীকর্তাদের মহাভাঙন তন্ত্র—স্টালিন নাম দিয়েছিলেন দি গ্রেট ব্রেক (The Great Break) প্রচারের সংবাদ পেলেন, তাঁর মন বড়োই খারাপ হয়ে গেল।
এই নিরীহ কৃষক জাতের উপর ইতিহাসের কী সাংঘাতিক ধাক্কাটাই এসে পড়ল। এক ঠেলায় সেকাল থেকে একালে লাফিয়ে আসা, রাজশক্তির আশ্রয় ছেড়ে আত্মশক্তির উপর এসে পড়া, সম্রাট আমলের শত-অত্যাচার সহ্য করেও যে বাস্তুটুকু জমিটুকু আগলে এসেছে, অবশেষে সে সব অনভ্যস্ত সমবায়ের হাতে ইচ্ছে-দুখে সঁপে দেওয়া— এ বড়ো ভীষণ ফরমাশ। সকলের বাড়া এই, যে গৃহস্থ রাতদিন জমিজমার ভাবনা ভেবে, তিলে তিলে পলে পলে সম্পত্তি বাড়িয়ে মুরুব্বি হয়ে উঠেছে, এখন তার এই যথাসর্বস্ব না ছাড়লে তাকে কিনা পেতে হবে সাজা।
প্রবাসীর মনের ব্যথা আমরাও বুঝি। ধনীর ধন জালিয়াতে ফাঁকতালে মেরে নিলে তাকে সশ্রম নির্বাসন-দণ্ড দেওয়া হয়, তা তো গা সওয়া হয়ে গেছে। অন্যের খাটুনির ফল ভোগ করে ধনী গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ায়, তাও দেখে দেখে আর বিসদৃশ লাগে না। কিন্তু ধনী বেচারীকে জালিয়াতের মেকদারের সাজা পেতে হবে শুনলে মনটা ছ্যাঁক করে ওঠে বইকি।
পৃথিবীর কোনো জাতকে কোনো কালে কি এত বড়ো সর্বনাশের মুখে পড়তে হয়েছে। এ কথা প্রবাসী মাথায় হাত দিয়ে বসে ভাবছেন, এমন সময় তিনি নদিয়া (Nadya) নামের একটি পরিচিত রুশমেয়ের চিঠি পেলেন—
নদিয়ার চিঠি
আমাদের দল-বল নিয়ে আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরতে চলেছি,—চাষীদের সমবায় পত্তন করতে। কাজটা সহজ নয়, কিন্তু ফলটা বিরাট। তুমি এখানে চলে এসো; যে চাষীদের প্রকৃতি তুমি অচল অটল মনে কর, তারা কেমন করে সমবায়ী হতে শিখছে, দেখবে এসো। চোখে দেখলে, ওদের দুঃখ কল্পনা করে তোমায় আর দুঃখ পেতে হবে না, তোমার নিজেরও চিত্তশোধন হবে। তুমি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলে—প্রাণ যাবে তবু চাষায় বাস্তু ছাড়বে না; সেই একগুঁয়ে চাষীকে আমরা কেমন করে পথে আনছি, দেখে যাও। শুধু দেখেই বা ক্ষান্ত হবে কেন। রুশকে নতুন ভিতের উপর খাড়া করার কাজে আমাদের সঙ্গে যোগ দাও। এখানকার হাওয়ায় আগুন লেগেছে,—নতুন ভাবের, অভাবনীয় উদ্যমের আগুন।—
এই নদিয়া একটি বেঁটেখাটো মেয়ে, ঝাঁকড়া কটা চুল, বড়ো বড়ো কটা চোখ উৎসাহে জ্বলজ্বল করছে, গোলগাল মুখ, সু-ছাঁদের ঠোঁট, মিষ্টি কিন্তু তীক্ষ্ণ গলার স্বর, মন-কাড়া হাসি। আত্মশক্তির উপর তার অগাধ বিশ্বাস। ১৯ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়, কিন্তু স্বামী তাকে বিপ্লবের ধান্দায় জড়াতে দিতে চায় না বলে, সে সংকল্প ত্যাগ না করে ত্যাগ করল স্বামীকে। এখন সে অসীম আনন্দ-উচ্ছ্বাসে USSR-এর নববিধান প্রচারে মেতে আছে।
নদিয়াকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে— “এ কাজে তুমি কি সুখ পাচ্ছ—সে হেসে ওঠে, কিংবা রাগ করে। ব্যক্তিগত সুখ বলে জিনিসটাই সে মানে না। তাকে যাতে খেপিয়ে বেড়াচ্ছে, সে সুখের সন্ধান নয়। মহাযুদ্ধে সামান্য সৈনিকের মতো সে এই বিরাট যজ্ঞে আত্মনিবেদিতা। যে শরীর পাত করতে বসেছে, তার আবার আলাদা সুখদুঃখ কিসের। যজ্ঞের প্রগতিতেই তার সুগতি।
নদিয়া একা নয়। আজকের রুশে এমন হাজার মেয়ে আছে, তাদের হাজার ভাইও আছে, যারা সমীকরণ যজ্ঞ পূর্ণ করার মহাব্রত সাধনে প্রাণ পণ করেছে।
নদিয়ার ডাকে সেই প্রবাসী জন্মভূমিতে ফিরে এলেন,—বিপ্লবের ধারা নিজের চোখে দেখতে। তিনি যা দেখলেন শুনলেন, কতক তাঁর নিজের জবানিতে, কতক তাঁর টুকে-নেওয়া পাঁচ জনের মুখের কথায়, এ পালায় ধরে দেওয়া যাচ্ছে।
বিকেলবেলা রেলস্টশনে নেমে, আমার ছেলেবেলাকার খেলাঘর সেই গণ্ডগ্রামের রাস্তায় হেঁটে চললাম। যে ধারে যাই, মেঘমুক্ত রোদে ভরা আকাশের মনোহর নীলে চোখ জুড়োয়। মনে হল লার্ক[১] পাখির এমন আপনহারা গান আর কখনো শুনিনি। চারিদিকে কোথাও হেলাফেলার চিহ্ন নেই, ফসলে ফসলে মাঠ উথলে উঠছে, ভাবী আশার উৎসবে সবই উৎফুল্ল।
আমি প্রাণ ভরে দেখতে শুনতে চলেছি, এমন সময় গ্রামের কাছাকাছি পৌছে এক স্কুলের ছেলের সঙ্গে দেখা। বয়স বছর বারো হবে। চাষার রীতি অনুসারে সে কাঁধে-ফেলা লাঠির আগায় জুতো জোড়া টাঙিয়ে খালি পায়ে চলেছে, মাথার ছাঁটা চুলের উপর টুপিও নেই। বগলে একঝুলি বই। সে বুঝি সমবায়ের লাইব্রেরির জন্য শহরে বই আনতে গিয়েছিল, এখন বাড়ি ফিরছে।
আমি প্রবাসী বলে নিজের পরিচয় দিয়ে, ওর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম—বাড়ির কথা, গ্রামের কথা, গ্রাম-সমবায়ের কথা, যার মধ্যে এই বছরের গোডায় ওর বাপ ভর্তি হয়েছেন।
জিজ্ঞেস করলাম, “বড়ো হলে তোমার কী হতে ইচ্ছে যায়?”
সে বললে, “ইঞ্জিনীয়ার হব।”
“বিশেষ ক’রে ইঞ্জিনীয়ার কেন।”
“গ্রামের গোলাবাড়ি, সাঁকো, কারখানা, যা কিছু দরকার বানিয়ে দেব।”
“তুমিও তাতে বেশ ধনী হয়ে উঠবে, না?”
ছেলেটা হেসে উঠল।
“হাসছ কেন।”
“বোকা ছাড়া ধনী হতে কে চায়। তাই হাসছি।” পরে সে গম্ভীরভাবে বললে, “ধনী হওয়া মানে পরকে লুঠ করা।”
“কিন্তু ভালো ভালো জিনিস তোমার নিজের হয়, তাও কি চাও না? তোমাকে কেউ যদি ঘোড়া কি মোটরগাড়ি দেয়, তা কি নাও না।’
“নিই বইকি, নিয়ে বাবার সমবায়ে দিয়ে দিই। জানেন, প্রবাসী মশায়, আজকাল ধনী কথাটা আমরা গুদামজাত করেছি, ওটা আর চলতি নেই।”
আমি অবাক হয়ে ছোকরার পানে তাকিয়ে রইলাম। এতটুকু মুখে অত বড়ো কথা। একি ওর সত্যিকার মনের ভাব, না শেখানো বুলি। কিন্তু বেশ স্বচ্ছন্দে বলে গেল, চোখের ভাবে মুখের কথায় গরমিল তো দেখলাম না, মুখস্থ গৎ আওড়াবার মতো চেহারা মোটেই নয়। আমি যে-দেশ থেকে এসেছি, সেখানকার ছেলেরা বলা দূরে থাক এ কথা ভাবতেই পারে না; সেখানে এ ধরনের মতামত নেহাতই ফাঁকা শোনাত; তাই প্রথমটা সন্দেহ হয়েছিল।
রাস্তার মোড়ে ছেলেটির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হল। আমাদের বাড়ি যে পাড়ায় ছিল, নানা কথা ভাবতে ভাবতে সেদিকে চলতে লাগলাম।
এখন দেশে যে-দ্বন্দ্ব চলেছে, তা রাস্তার দুই পাশের মাঠের চেহারা থেকেই বোঝা যায়। এক দিকে সমবায়ের হাত পড়েছে, আল দিয়ে খেত ভাগ করা নেই, কলে বোনা বিচির গাছের সোজা সোজা লাইন জমির ঢাল ধরে যেন ফসলের স্রোতের মতো বিল পর্যন্ত চলেছে। অপর ধারে, যারা সমবায়ভুক্ত হয়নি, তাদের ভাগ করা ছোটো ছোটো খেতে ফসলের সে তেজ নেই, তারা যেন বিরুদ্ধ ভাবের জের টেনে রেখেছে মাত্র। এ বৎসরের গোড়ায় যে “সমবায়” এত ভয়ভাবনা ওজরআপত্তির বিষয় ছিল, এরি মধ্যে তার প্রভাব, প্রকৃতির ঋতুপরিবর্তনের মতো বেমালুম এসে গ্রামকে ছেয়ে ফেলেছে।
মনে সন্দেহ রইল না, ভবিষ্যতে আর যাই হোক, রুশের সেই নিরিবিলি ঝিমন্ত পল্লীর দিন ফুরিয়েছে। আমাদের এই গ্রামে আজও কারখানা দেখা দেয়নি; যেদিন কলের বঁশি গ্রামবাসীর মন কেড়ে নেবে, সেদিন যা থাকে অদৃষ্টে, তারা নতুনের মধ্যে ঝাঁপ না দিয়ে পারবে না।
এই স্কুলের ছেলেটি বড়ো হলে, বিপ্লবের নতুন আঁচ নরম পড়ে গেলে, তখনো যদি এই নিজস্ব ধ্যানে বিতৃষ্ণার ভাব, পরের অভাবমোচনে আগ্রহের ভাব, দেশে সজীব থাকে, তাহলে USSR বাস্তবিকই পৃথিবীর যত রাজ্যকেই বল, যত ধর্ম সম্প্রদায়কেই বল, একটা নতুন আদর্শ দেখিয়ে দেবেন।
আমরাও তাহলে প্রবাসীর কথায় নিজের ভাবে সায় দিয়ে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করব, USSR নীলকণ্ঠের মতো বিষয়ের বিষ টেনে নিয়ে, ত্যাগের দ্বারা ভোগ করার মন্ত্রে সমীকরণ যজ্ঞ সফল ক’রে কলির ক্ষয় করে এনেছেন।
গ্রামের কথা
সূর্য অস্ত যায় যায়, কিন্তু এখনো বেশ আলো আছে। তবু গ্রামে ঢুকতেই যেন প্রকৃতির প্রফুল্ল ভাবের উপর একটা ছায়া পড়ল। রাস্তার দুধারের বাড়িগুলোয় অযত্নের নানা লক্ষণ নজরে ঠেকল,—বেড়া উঠন, ঘরদোর সবই কেমন বেমেরামত। ট্রিনিটি[২]র উৎসব এল বলে, কিন্তু আমাদের ছেলেবেলার সে সাজসজ্জা কই। কোনো চালে নতুন খড় ওঠেনি, কোনো দরজায় নতুন রং পড়েনি।
বুঝলাম, সমবায় নিয়ে দোটানা ভাবের এই মূর্তি। পাছে অবশেষে সমবায়ে না গিয়ে উপায় থাকবে না মনে করে কেউ হাতে রেখে খরচ করছে, কেউ বা সমবায়ে যোগ দিয়েছে, কিন্তু ভালো মনে দিতে পারেনি বলে পরের কাজ ভেবে হাত সরছে না।
গ্রামে এখন আমাদের জ্ঞাতি আর নেই। আমার চোদ্দপুরুষ এখানেই জন্মেছে, মরেছে, বংশের শিকড গেড়েছে, কিন্তু এ আমলে আমরা সে শিকড় উপ্ড়ে দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছি; আমার এখন নতুন জীবন, নতুন মন, নতুন আকাঙ্ক্ষা; তবু মনে হচ্ছে এ গ্রামের সকলেই আমার আপনার। মাঠ, জলা, জঙ্গল, কোথায় কী ছিল, সবই আমার মনে গাঁথা আছে। সেখানে সাথীদের সঙ্গে কত খেলেছি, বনের ফল, পাখির ডিম কত পেড়েছি, পালক কুড়িয়ে এনে যে-যার মাকে বালিশ তোশক করতে দিয়েছি।
কিন্তু এ কী। বিলের ধারের জঙ্গলটায় তো কিছু ছিল না,—আজ সেখানে মস্ত একটা বাড়ি দেখছি। কাছে গিয়ে দেখি এটা নতুন তৈরি স্কুল বাড়ি, সাদা রঙের দরজা জানালা, উপরে লেখা বড়ো বড়ো অক্ষরের নামটা আমার দিকে প্যাঁট প্যাঁট করে চেয়ে না থাকলে বিশ্বাসই হত না।
আমার ছেলেবেলায় এখানকার চাষীরা লেখাপড়ার ধার ধারত না। তাদের চিঠিপত্র লিখে পড়ে দিয়ে আমি ঝুড়ি ঝুড়ি আপেল ফল দক্ষিণে পেয়েছি। মনে পড়ে, একবার জাপান যুদ্ধের সময় একজন বিদেশী এসে পুরোনো খবরের কাগজ থেকে যুদ্ধের কথা শুনিয়ে দু’চার বস্তা বাজরা আদায় করে নিয়ে গেল।
এখন স্কুলের ছুটি। কিন্তু ভিতরে ঢুকে দেখি একধারের ঘরে সার সার খাট পড়েছে, তার উপরে ধবধবে বিছানা পাতা। শুনলাম, চাষা গিন্নিরা সমবায়ের কাজে বেরলে, এটা তাদের ছেলে রেখে যাবার জায়গা। ছেলেরা বেশ খুশি মনে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে।
আমায় দেখে দাই এগিয়ে এসে অনেক গল্প করলে। হাসতে হাসতে বললে, প্রথম প্রথম ভারি আপত্তি উঠেছিল, ছেলেদিকে চাষী-প্রথামতো ঘোলে ভেজানো বাজরার রুটি না খাইয়ে খাঁটি দুধের উপর শুখিয়ে রাখা হচ্ছে।
আমার কাছে কিন্তু বড়ো হাসির কথা নয়। মনে পড়ে গেল ছেলে বেলার আদরিয়া (Adarya) গিরির কথা। তেরো বছরে তার তেরোটি ছেলে হয়ে সবকটি মারা যায়। অখাদ্য কাকে বলে, নোংরা কিসে হয় কিসে যায়, না জানার এই দুর্দশা। বেচারীর কাঁদতে কাঁদতেই জীবন কেটেছিল।
স্কুলবাড়ি ছাড়িয়ে আর একটু যেতে, ঠিক যেখানটায় আমাদের বাড়ি ছিল, সেখানে দেখি সাজসরঞ্জাম সমেত একটা দমকল ঘর। এ রকম সব খোড়ো চালের গ্রামে আগুন-লাগা কী সর্বনেশে কাণ্ড মনে করলে এখনো বুক কাঁপে। জলের যোগাড় নেই, একসঙ্গে চলাবলার অভ্যেস নেই; যে জল আছে এলোমেলো আপ্সাআপ্সীর চোটে তাও পৌঁছয় না; কেউবা বাধা দিয়ে বলে, দেবতার কোপ জলে শান্ত হবে না, দুধ চাই; ফলে, আগুন ঘরের পর ঘর গ্রাস করছে, হাতপা এলিয়ে তাই দেখতে হত।
আমাদের আমলে বছরে বছরে কত শত গ্রামে এই বুকফাটা ঘটনার আবৃত্তি চলত। শেষে ঘরপোড়া চাষাগুলো এ-গ্রাম সে-গ্রাম থেকে ভিক্ষে করে আবার বাড়ি করার কাঠখড় আনতে বেরত। এখন তাহলে তারো উপায় হয়েছে।
এবার চেনালোকের পাড়ায় এসে পড়েছি। চারিদিক থেকে— “এসো, এসো, একটু বসে যাও, একপাত্র দুধ খেয়ে নাও",—সমাদরের ডাকাডাকি চলল। তাদের অনুরোধ এড়িয়ে শেষে ছেলেবেলার এক বন্ধুর বাড়ি গিয়ে উঠলাম। আমাকে পেয়ে স্বামীস্ত্রী দুজনেই মহা খুশি, তাড়াতাড়ি নিজের নিজের কাজ সেরে নিয়ে দুধ পনীর ডিমহালুয়া সাজিয়ে খেতে বসিয়ে দিলে। সেখানেই রাত কাটালাম।
গ্রাম্য বৈঠক
পরদিন রবিবার, সকলেরই ছুটি। রাস্তায় বেরিয়ে দেখি প্রবাসী ফিরে আসার খবরে অনেকে আমায় দেখতে আসছে, তাছাড়া ছুটি বলেও রাস্তায় লোকের আনাগোনা বেশি। কামারের বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গাটায় কাটা গাছের গুঁড়ির উপর আমরা সব আড্ডা করে বললাম।
সমবায়ে সব কিছু দিয়ে থুয়ে যে নিঃস্ব (Bedniak) হয়েছে, বিপ্লবীহিসেবমতো সেই মান্যগণ্য; যে অসমবায়ী গৃহস্থ নিজে আলাদা খাটে খায় (Seredniak) সে মাঝামাঝি; যে পরকে খাটিয়ে নিজে আলস্যের আরামে থাকার চেষ্টা করে সে হয় কুধনী (koolack)। কিন্তু গ্রামসমাজে এসব শ্রেণীভেদের চিহ্ন দেখা গেল না; এখানে মাত্র দুই দল—যারা সমবায়ের পক্ষপাতী, আর যারা সমবায়ের বিরোধী।
মার্কিন দেশের গল্প শোনাবার জন্যে আমায় সবাই ধরে বসল।
আমি কিন্তু সে আবদার কাটিয়ে বললাম, “না, সে হবে না। আমি তোমাদের কথা শুনতে এসেছি, তোমরাই সব বলো।” সব দলের লোক আছে দেখলাম—যার যা মতামত জেনে নেবার এমন সুযোগ ছাড়ি কেন।
একটা বুড়ো চাষা আরম্ভ করে দিলে—“একটা জিনিস আমরা খুব শিখেছি—গোরু ঘোড়া ভেড়া আর বাড়ানো নয়।”
বুঝলাম, এটা রাগের কথা। যেটুকু না দিলেই নয়, তার বেশি সমবায়ের হাতে দেওয়া হবে না, তাতে দেশের অভাব বাড়ে বাড়ুক,— বিরোধী পক্ষের এই ভাব। যারা এসেছে তাদের মধ্যে কর্তৃপক্ষের লোকও রয়েছে, তবু কেউ ছেড়ে কথা কইবার পাত্র নয়।
আর এক চাষা বলে চলল, “এই দেখো না, সেদিন আমার বাড়ি পেয়াদা চড়াও হল। দোষের মধ্যে আমার একটা তিন-কাল-যাওয়া বিচিলি কাটার কল আছে, তা দিয়ে বছরে সামান্য কিছু রোজগার করে থাকি, তাই দেখে আমাকে কুধনী সাব্যস্ত করার চেষ্টা। আমি হেসে বললাম—লোভ হয়ে থাকে, লোহার দামে তোমরা ওটা নিয়ে নাও—তবে পেয়াদা থামল। কিন্তু তাতেও পার নেই।—তোমার গোরু কটি? আমি বললাম—একটি। দেখিয়ে দাও।—নিয়ে চললাম গোয়ালে। দুটি দেখছি যে।—ওটি তো বাছুর। পেটে বাচ্চা, বাছুর কেমন?—বাচ্ছা পেটে থাকলে তো গাই হয় না, বাচ্ছা আগে হোক। এই বলে আমি গিন্নিকে ডাক দিলাম। সে এসে এমনি তুড়ে দিলে যে পেয়াদা পালাতে পথ পায় না।”
সকলে। এই তো গিন্নি বলি।
সৈনিকের মতো ঢ্যাঙা লোককে একজন ডেকে বললে, “এই যে নিকোলাই, বলো না হে, কর্তারা তোমাকে কী নাকালটা করেছিল।”
নিকোলাই। থাক্ না, সে সব পুরানো কথা খুঁচিয়ে তুলে কী হবে।
সকলে। না, না, বলে ফেলো। আমাদের মার্কিন অতিথি সব জানতে চায়।
নিকোলাই। আমি গোড়াতেই ভেবেছিলাম, সমবায়ভুক্ত হব; কিন্তু গিন্নি বেঁকে বসল, বললে তাহলে গলায় দড়ি দেবে, তাই হল না। শেষে আমার সব কেড়ে কুড়ে নিলে, রাখার মধ্যে মন কতক খাবার দানা আর দুচার বস্তা আলু রেখে গেল। এখন সমবায়ে ঢুকে নির্বাসন থেকে বেঁচেছি।
এইটুকু বলে নিকোলাই সরে পড়ল।
এক বুড়ো। আমাদের নিকোলাইর মতো হিসিবি মানুষ আর দেখা যেত না। রোদ ঝড় জল যাই হোক না কেন সে সমানে রোজগারের ফিকিরে ঘুরে বেড়াত। বিচিলির গাড়ি থেকে দু’এক গাছ পড়ে গেলে ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে আনত। আলু তোলার সময় কাঁচা পচা কিছু বাকি রাখত না। আমোদ নেই, আহ্লাদ নেই, শহরে কাজে গেলে শখ করে ময়দার রুটিটুকু মুখে দিত না। এত করে জমানো ধন এ রকম বেঘোরে মেরে নেবে, কে জানত।
অন্য গ্রামের এক সমবায়ী-যুবক এ কথা শুনে আলোচনায় যোগ দিলে।
যুবক। এত করার যে কথা বলছ, এত করে লাভটা হত কার। আশপাশে যারা আধপেটা খেয়ে আছে তাদিকে কি খাওয়াত। নিজেও খেল না, মলে সঙ্গেও যাবে না, তবে কিসের জন্যে জমাল। তার চেয়ে মানুষের মতো থাকলে হত না? তোমাদের নিকোলাইকে চিনিনে, কিন্তু আমাদের গ্রামের কামারটা ঐ রকম ছিল। সে মরার পর ঘর থেকে, গুদম থেকে, চালের ভিতর থেকে কী যে না বেরল, বেশির ভাগ ফেলে দিতে হল। সকলে জানত তার মোহর-ভরা বাক্স আছে। খোজ, খোঁজ, কোথাও পাওয়া যায় না, শেষটা পায়খানার তলার মাটি খুঁড়ে বেরল। কী যাচ্ছেতাই জীবন।
বুড়ো। তোমাদের মতো লক্ষ্মীছাড়া নিঃস্ব হয়ে ঘুরে বেড়ানো সব চেয়ে ভালো—না?
যুবক। ভালো নয় তো কী। আমরা ভালো খাই পরি, পরস্পরের সুখদুখের ভাগ নিই, পরদেশেরও খবর রাখি, মানুষের জীবন কেমন হওয়া উচিত তাই নিয়ে ভাবনা চিন্তে করি, সেই মতো চলে বেঁচে সুখ পাই।
অনেকে। ঐ সমবায়ের গোঁড়া আসছে। এসো মাসী। তুমি তো সমবায়কে স্বর্গ মনে কর। প্রবাসী ভায়াকে সব বলো না।
মাসী। হাঁ, ঘণ্টা-নাড়ার স্বর্গ বটে। ঘণ্টায় ওঠো, ঘণ্টায় খাটো, ঘণ্টায় খাও, ঘণ্টায় শোও—ঘণ্টা না পড়লে মা-হারা পাখিছানার মতো চিঁ চিঁ করতে থাকো।
এক রসিক। মাসী দেখছি বাজনাবাদ্যি ভালোবাসে না।
সকলে হেসে উঠল।
মাসী। সত্যি কথা, ঘণ্টার বাজনায় নেচে বেড়াতে ভালোবাসিনে। পরশু দিন কাজে মন লাগল না, চৌপরদিন পড়ে ঘুমোলাম। কাল খিধে হল, পাঁচ বার খেলাম। সমবায়ে থাকলে আমার জন্যে পাঁচ বার ঘণ্টা পড়ত?
সকলে। সাবাস, মাসী, সাবাস।
সমবায়ী যুবক। যখন ফসল কাটা হবে, তোমরা ভালো খাও, কি আমরা ভালো খাই দেখা যাবে।
বুড়ো। ভারি তো বাহাছরি। দেশের যত ভালো জমি ঘোড়া গোরু তোমাদের সমবায় নিয়ে বসে আছে। কাঠ চাও, কলের লাঙল চাও, টাকা হাওলাত চাও, সদর থেকে তখনি যুগিয়ে দিচ্ছে। আমরা অমন সুবিধে পেলে তোমাদের চেয়ে অনেক কারদানি দেখাতে পারতাম।
একজন মোটাসোটা গ্রামবাসী এগিয়ে এল,—“নিঃস্ব কাকে বলে জানতে চাও তো আমায় দেখো। আগেও নিঃস্ব এখনো তাই। তবে আগে পাঁচ সাত মুদ্রা যোগাড় করে টেক্সটুকু দিতে পারলেই চুকে যেত, আর জ্বালাতন করত না। কুকুরটা পর্যন্ত বাড়ি ঢুকতে পেত না। এখন টেক্স লাগে না বটে, যা দরকার তাও পাই, কিন্তু খানাতল্লাশের জ্বালায় প্রাণ যায়। আর কেটে নেয় কত—বাড়ির বিমা, ফসলের বিমা, এর পর বলবে হাত-পা’র বিমা।”
এক শ্রোতা। আরে ভাই, বিমা কি খারাপ জিনিস।
নিঃস্ব। খারাপ কে বলছে। কিন্তু আমার খাটুনির দাম থেকে কাটবে কেন। নিঃস্ব বলে কি আস্ত আস্ত মুদ্রা কাটা গেলে মায়া লাগে না।
আবার হাসি পড়ে গেল।
প্রথম শ্রোতা। খুচরো অসুবিধের কথা ছেড়ে দাও। আমি বলি গোড়ায় গলদ। দেখো প্রবাসী ভায়া, তুমি তো জান একই পরিবারের মধ্যে লোকে গালাগলি চুলোচুলি না করে থাকতে পারে না; আর এই পরকে নিয়ে সমবায় করা, এতে ঝগড়াঝাঁটি হাতাহাতি লাগবে না? কিছুদিনের মেয়াদ হলেও হত, এ যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
দ্বিতীয় শ্রোতা। যা বলেছ ভাই। খাওয়াপরা ঠিক থাকলেই তো হয় না, নিজের ইচ্ছেমতো ফসল লাগালাম, ইচ্ছেমতো খাটলাম কি বসে রইলাম, জমালাম কি খরচ করলাম,—এ না হলে কি সংসার করা বলে। আমরা তো জেলখানায় আছি,—যা বলবে তাই করো, যা দেবে তাই খাও, পরের ভাবনা ভেবে মরো।
তৃতীয় ব্যক্তি। দেবার অবিচার কেমন, তাও দেখো। এক গিন্নির দশ ছেলে সে দশ মাপ দুধ পাবে, আর যে বেচারীর একটি ছেলে সে এক মাপের বেশি পাবে না।
বুড়ো। আমাদের সরে পড়বার সময় হয়েছে। গলায় দড়ি দিয়ে সংসার থেকে বিদায় নিলে তবে বাঁচব। এখন হয়েছে ছোঁড়াদের রাজত্ব।
আমি বুঝলাম, বুডো বিপ্লবের ঝাঁকানি খেয়েছে, কিন্তু তার ভাবটা মাথায় থিতিয়ে বসাতে পারেনি। পুরোনো ছাড়লে সামনে দেখে অতল গহ্বর, তরাসেই হয় সারা। জিজ্ঞেস করলাম,—“সমবায়ভূক্ত করার জন্যে কি জবরদস্তি লাগিয়েছে।”
সকলে। না, না, তা নয়। আগে পেড়াপিড়ি চলত বটে, কিন্তু কর্তার মহা ভাঙনের উপদেশ বেরবার পর সে সব আর হয় না।
এক ব্যক্তি। হয় না বলছ কী করে। সমবায়ে যোগ না দিলে ঘ্যানর ঘ্যানরের চোটে কি সোয়াস্তি থাকে। অত্যেচারও আছে বই কি। সেদিন, মনে নেই, ঐ পোল (Pole) পাড়া থেকে ভরা-শীতে মেয়েছেলে-সুদ্ধ কতজনকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে উত্তরে খাটতে পাঠিয়ে দিলে। বাপ রে, সে কী কান্নাকাটি।
যুবক। ওরা তো সব কুধনী।
বুড়ো। ভালো এক কুধনী কথা শিখেছ। ধনীদের কি রক্তমাংসের শরীর নয়,—ওদের ছেলেপিলে শীতে মারা পড়লে আমাদের গায়ে লাগে না?
যুবক। কালস্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে দুঃখ তো ডেকে আনা হয়। ক’টি স্ত্রীলোক–বালকের খাতিরে বিপ্লব আটকে থাকতে পারে না। আগেকার আমলের বিকট অত্যেচারের কথা তোমরা ভুলেই যাচ্ছ। তার জন্যে যদি সম্রাট আমলা জমিদার পাদ্রী সবই সরাতে হল, তবে কুধনীর শেষ রাখলেই বা চলবে কেন। বিপ্লব আমাদের পিঠে হাত বুলোতে আসেনি, মানুষ করতে এসেছে। কর্মীরা দেবতা নয় সে তো জানা কথা,—মানলাম মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি করে বসে; কিন্তু ধরা পড়লে উপর থেকে সাজা তো পায়।
এমন সময় এসে পড়ল ফিটফাট পোশাক বুট-জুতো-পরা সদরের প্রচারক, গ্রামে গ্রামে যারা সমবায় পত্তন করে বেড়াচ্ছে, তাদের এক জন। ওকে দেখে সকলে একটু শশব্যস্ত হয়ে পড়ল বটে, কিন্তু বিরক্ত হল না, ভালোভাবেই আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলে।
সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আরম্ভ করে দিলে—“কী গো। নাকে কান্না হচ্ছিল বুঝি। বেশ, বেশ, প্রাণ ভরে কাঁদুনি গাও। দেখুন, প্রবাসী মশায়, এরা সব শিশু; দিনে খুব করে কেঁদে না নিলে রাতে ভালো ঘুম হয় না।
“শোনো হে, হতভাগা অসমবায়ী যারা আছ। আমার কথাগুলো একটু মন দিয়ে শুনে যাও। বলি, তোমরা কী সুখে টুকরো টুকরো জমিগুলো এখনো ধরে আছ। এই মার্কিন ভদ্রলোকের সামনেই বিচার হোক, ইনিও শুনুন। বছরে বছরে বুড়োরা সরে যাচ্ছে, রেখে যাচ্ছে অনেক ছেলে, জমির ভাগ ছোটো থেকে আরো ছোটো হতে চলেছে। আলে আলে কত জমি খেয়ে যায় সেটা হিসেবে আন কি। আর আজকাল হল কলের যুগ, আল থাকলে কলের লাঙলের সুবিধে পাও না। পুরোনোর মায়া কাটাতে পারছ না, শেষটা কি আমার, আমার বলে বাড়ি আঁকড়ে না খেয়ে মরবে।
এক শ্রোতা। আপনাদের সমবায় আসার আগে কি খেতে পেতাম না।
প্রচারক। কেন বাজে কথা বল, বাপু। তোমাদের সে খাওয়া কি খাওয়া ছিল,—না আধমরা থাকাকে বাঁচা বলে। দশ বিশ বছর পরে কী হবে সেটা ভাবা তো তোমাদের ধর্মে নেই, নইলে বুঝতে দেশের ছেলেদের উন্নতির জন্যে কী রকম আয়োজন চলেছে। তোমরা যে কত বোকা সেটুকু বুঝলেও কাজ হয়। এই কবছর আগে যখন ও-গ্রামের জমিদার-বাড়ি ভাঙা হল, তখন তোমাদের স্কুল-তৈরির জন্যে মালমশলা দিতে চেয়েছিল,—বয়ে আনতে হবে বলে তোমরা নিলে না। পরে তো চাঁদা তুলে সেই স্কুল করতে হল, তাও কি সোজায়,—চাঁদার টাকা আদায়ই হয় না। স্কুল হয়ে খুশি হওনি, এখন বুকে হাত দিয়ে বলতে পার? সমবায়ের কোন্ কাজটা অন্যায় হয়েছে বলো তো দেখি। দমকল করে দিয়েছে, জলাগুলোর উপর সাঁকো বসিয়েছে, সমবায়ে যোগ দিলে কত সস্তায় জিনিসপত্র পাও—
দ্বিতীয় শ্রোতা। রেখে দিন আপনার সমবায়, সমবায়ের কথা আলাদা—
প্রচারক। আলাদা তো বটেই। যেমন-কে-তেমনি থাকলে আজও সম্রাটের আমলার ঠেলার মজা বুঝতে, সেসব দিনের যন্ত্রণা তো হজম করে বসে আছ। আসল ব্যাপার কী তা বুঝেছি। ফাঁক তালে ধনী হবার লোভ ছাড়তে পারছ না। কিন্তু খবরদার। সে পথে গেলে মরবে। ও মায়া পুষে রেখো না। কর্তারা কুধনীর ওষুধ জানে, তা তো দেখতেই পেয়েছ। ধরা পড়লে ছাড়নছোড়নের আশা কোরো না। প্রবাসী মশায় নতুন এসেছেন, তোমাদের ফোঁপানিতে তিনি ভুলতে পারেন, আমরা ভুলব না। তোমরা ইচ্ছে কর, আর নাই কর, তোমাদের সকলকে সমবায়ী শ্রমিক করে মানুষ করব তবে ছাড়ব।
বেলা হয়ে এল, মজলিশ ভেঙে গেল, আমরা যে-যার বাড়ি চলে এলাম।
জমিদার-রাখালের কথা
ইহুদী জমিদার ইব্রাহিম-দাদাকে আমার বেশ মনে ছিল। লম্বা শরীর, চোস্ত চেহারা, ফিটফাট পোশাক, হাসিখুশি মানুষ। ইহুদীদের অবশ্য জমিদারি-স্বত্ব পাওয়ার অধিকার ছিল না, তবে তিনি ছিলেন বড়ো জোতদার, ব্যবসাদারও বটে। প্রদেশের মধ্যে তার গোরুর পাল বিখ্যাত। রাস্তা থেকে একটু ভিতরের দিকে তাঁর সুন্দর সাজানো বাড়ি ফুলবাগান, ফলবাগান সমেত বেশ পরিপাটি।
আমরা যখন গ্রামে ছিলাম, এ পাড়ায় এলে ইব্রাহিম-দাদা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে চা[৩] খেয়ে যেতেন, সে সূত্রে আমাদের সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্বও হয়েছিল। বিপ্লবের পর তাঁর আর খোঁজ রাখতে পারিনি। এখন শুনলাম তিনি সমবায়ভুক্ত হয়ে বাড়িতেই আছেন।
কথাটা একটু আশ্চর্য লাগল কারণ সমবায় হল চাষীদের, জমিদার বা জোতদারদের তাতে কেমন করে স্থান হতে পারে। তবে সম্রাটের আমলে ইহুদীদের উপর অমানুষিক উপদ্রব হয়েছিল বলে বিপ্লবের পর তারা অনেক বিষয়ে আসন পেয়েছে শোনা যায়। শুনলাম ইব্রাহিম নাকি সমবায়ের গোরুর পালের খবরদারি করার ভার পেয়েছেন। আগেকার দিনে কাউকে রাখাল বললে গাল দেওয়া হত, আজকাল অবশ্য ওটা সম্মানের পদ। তবু সেই শৌখীন-প্রাণ ভদ্রলোক রাখালগিরি করছেন,—কেমন খাপছাড়া ঠেকল। ভাবলাম যাই, দেখে, আসি।
বাড়ির হাতায় ঢুকেই তফাত বুঝতে দেরি হল না। একি সেই বাড়ি। কোথা সে চেকনাই, কোথায় সে ফুলের বাহার। বাগানের বেড়া ভাঙা, রাস্তায় আগাছা ঠেলে উঠেছে, সবশুদ্ধ পোড়ো চেহারা। এখন ঘরে ঘরে অনেক সমবায়ী পরিবারকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, তাদের ছেলেপিলেরা চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে; গাছে গাছে দড়ি টাঙানো, তার উপর সকলের কাপড় শুখোচ্ছে।
“ইব্রাহিম কোথায়?”—জিজ্ঞেস করায় একটি ছোটো মেয়ে বললে তিনি মাঠে গোরু চরাচ্ছেন।
বিলের ধারে মাঠে গিয়ে দেখি, ঘাসের উপর ইব্রাহিমদাদা ব’সে, হাতে গোরু খেদাবার চাবুক। চেহারার সে চাকচিক্য আর নেই, অনেক দিন দাড়ি কামানো হয়নি, পাজামা গুটোনো, খালি পা, বেশ একটু বুড়িয়ে গেছেন। সামনে এক পাল গোরু আরামে ঘাস খাচ্ছে।
প্রথমটা ইব্রাহিম আমায় চিনতে পারেননি, নাম বলতে খুশি হয়ে উঠলেন; তখন মুখে আগেকার জেল্লা কতক ফিরে এল। তাঁর পাশে ঘাসের উপর বসে তাঁকে আমার দেশে আসার কারণ জানিয়ে দিলে পর তিনি নিজের কথা বলতে আরম্ভ করলেন, “বুড়ো হয়ে গেছি, না? কিন্তু যত দেখাচ্ছে তত নয়। বুড়ো বয়সের উপযুক্ত হালকা কাজও পেয়েছি। এই দেখো আমার হাতিয়ার। সেনানায়কের যেমন তলোয়ার, আজ এরও তেমনি মহিমা।” ব’লে তাঁর হাতের চাবুকটা আমার সামনে তুলে ধরলেন।—“মার্কিন-দেশে যখন ফিরে যাবে, তোমার মাকে যদি বল আমায় রাখাল করে দিয়েছে, তিনি হয়তো কেঁদেই ফেলবেন। তোমরা আমায় কত বড়ো লোক ঠাওড়াতে মনে আছে?” বলে ইব্রাহিম হেসে উঠলেন।
প্রথমটা সন্দেহ হল, বুঝি কাষ্ঠহাসি। কিন্তু কই, না গলার স্বরে, না চোখের চাউনিতে, খেদের লক্ষণ কিছুই দেখলাম না। বেশ সহজ প্রশাস্তভাবে তিনি বলে চললেন,—“মাকে বুঝিয়ে বলো, কাঁদার কিছু নেই,—সুখেরই কথা। আমি নিজে, কাঁদা দুরে থাক্, যত দিন যাচ্ছে ততই বুঝছি যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। বিপ্লবের মধ্যিখানে বাস করলে কত রকম প্রশ্ন মনের মধ্যে তোলপাড় করতে থাকে,—আগেকার দিনে সেসব কথা তুললে বলতে পাগল। হতে পারে আমরা সকলে পাগলই হয়েছি। আবার এও হতে পারে, আগেই ছিলাম পাগল এখন সহজ মানুষ হয়েছি। আমায় তোমার খুব অদ্ভুত লাগছে,—না?”
“ও কথা কেন বলছেন, দাদা?” আমি আপত্তি করে উঠলাম
“তুমি যে-দেশ থেকে আসছ, সেখানকার লোকের কাছে আমাদের এসব ব্যাপার কত অদ্ভুত ঠেকে, তা জানি, তাই কথাটা মনে হল, ভাই।”
ইতিমধ্যে এক গোরু দল ছেড়ে ফসল-খেতে গিয়ে পড়ল। তাই দেখে, ইব্রাহিম লাফ দিয়ে উঠে, তার পিছন পিছন ছুটে, চাবুকের ফটাস্ ফটাস্ আওয়াজে তাকে ঘুরিয়ে আনলেন। মুখের ঘাম মুছে আবার এসে বসতে, তাঁর অনেকখানি বয়স যেন ঝরে গেল। নিজের কাহিনী তিনি আবার বলে যেতে লাগলেন,—“আমাদের সমবায়ে এক বুড়ো চাষা আছে সে লেখাপড়া জানে না বটে, কিন্তু বুদ্ধি টনটনে। আমায় সমবায়ভুক্ত হতে দেখে সে আহ্লাদে আটখানা। হাতে ধরে বললে—বেশ করেছ ভাই। টঙে চড়ে বসে থাকনি, আমাদের দলে নেমে এসেছ, তোমার সুবুদ্ধির উপযুক্ত হয়েছে। একল্সেঁড়েপনায় লাভটা কী। প্রতিবাসী যে জিনিসের নাগাল পায় না, তা একা ভোগ করে কি সত্যিকার তৃপ্তি হয়।
“সেকালে এ প্রশ্ন শুনলে হেসে উড়িয়ে দিতাম, এখন তা পারি না, নিজের মনেই সে কথা দিনরাত উঠছে। এই কথাই তোমাকে বলবার আছে। আমাকে সমীকরণপন্থী কি অরাজকপন্থী, কি কোনো একটা পন্থী মনে ভেবো না। আমি যে কী তা নিজেই জানিনে, জানার দরকারও দেখিনে। মোট কথা পুরোনোর জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলে বেঁচেছি, আগের ভাব এখন মনে করলে লজ্জা হয়।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার স্ত্রী, ছেলেরা,—তাঁদের ভাব কী।”
“ছেলেরা তো অনেক দিন থেকে বিপ্লবের পক্ষে। স্ত্রীও আস্তে আস্তে মন ঘুরিয়ে আনছেন। ইহুদী ব’লে আমরা অনেক বিষয়ে রেহাই পেতাম, তবু জোতদার থাকতে এ টেক্স সে টেক্স দিতে শাঁস ক্রমশই কমে আসছিল। অন্যদিকে যে প্রশ্নের কথা তোমায় বললাম, মনের মধ্যে তাও খেলছিল—আমরা খাব মাংস মাখন পনীর সাদা ময়দার রুটি, আর আশপাশের মানুষের জুটবে খালি শাকসবজির ঝোল দিয়ে বাজরার কালো রুটি, এটা কি ঠিক?
“বুঝলাম, ঐহিক পারত্রিক দুদিকের ঠেলায় দু-নৌকোয় পা দিয়ে থাকা চলে না। গত শরৎকালে একদিন পরিবারের সকলকে ডেকে পরামর্শে বসলাম। আমি বললাম—দেখো এভাবে থাকা পোষাচ্ছে না; এসো, পুরোনোর মায়া কাটিয়ে নতুনকে ধরা যাক।
“রাত ভোর বকাবকি, চোখের জল ফেলাফেলি চলল, শেষে সকলের মন খোলসা হয়ে গেল, পরস্পরের প্রতি আড় ভাব রইল না। সবাই মিলে স্থির করলাম—ভালো মনে সমবায়ী হব। শুধু জমি কেন, বাড়িঘর জানোয়ার আসবাবপত্র, নিজের বলে আর কিছুই রাখব না, সত্যিকার নিঃস্ব হয়ে বলব—যা করে সমবায়।
এ রকম কাজ আধা-খেঁচ্ড়া করা কিছু নয়, ইস্পার নয় উস্পার! তাই আমরা খালি হাতে পরিষ্কার মনে সমবায়ে যোগ দিলাম।
“সবই সুখের হয়েছে, তা মিথ্যে করে বলব কেন। সমবায়ের হাত এখনো পাকেনি, কিছু ঢিলেমি আছে, কিছু বা নষ্টামি, অনেক গলতি আছে যেগুলো মাঝে মাঝে পীড়া দেয়। আগেকার মতো ভালো খেতে পরতে পাই, তাও নয়। দেখছ তো খালি পায়ে আছি, জুতো বাঁচিয়ে না চললে শীতকালে করব কী।
“কিন্তু দুঃখের কথাই বা এমন কী আছে। এই পুরোনো বাড়ির দুটি ঘরে আমাদিগকে থাকতে দিয়েছে। দুধ রুটি যথেষ্ট দেয়, মাঝে মাঝে ডিম পাই, হপ্তায় একদিন মাংস,—পুষ্টির কম্তি নেই।
“আসল লাভ হয়েছে কী জান? হৃদয়ের খিল খুলে গেছে, মনের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। আমার সেই একার বাড়ি এখন কত লোককে আশ্রয় দিচ্ছে। তাদের ছেলেপিলের সঙ্গে খেলা করে যে আনন্দ পাই, তার রস আগে জানাই ছিল না।—এই তো ব্যাপার, বুঝলে হে ভায়া।”
সমবায়-নেতার কথা
আমাদের গ্রামের চাষারা সমবায়ে অনেকে ঢুকতে পিছপাও বটে, কিন্তু সকলেই আমায় বলে—সমবায় দেখবে তো ক-গ্রামেরটা দেখো, ও রকম পেলে আমরা সবাই যোগ দিতাম। ক-গ্রাম বেশি দূর নয়, তাই অবসরমতো একদিন হেঁটে চলে গেলাম।
সে গ্রামে পৌঁছে প্রথমটা নতুন কিছু চোখে পড়ল না,—চারদিকে সেই অযত্নের লক্ষণ, শুয়োর মুরগিগুলো রাস্তায় উঠনে, বাড়ির ভিতর, যেখানে-সেখানে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমবায়ের আস্তানাটা গ্রামের ও-পারে, সেদিকে যেতে তবে নতুন জীবনের নড়াচড়া জানান দিল। ইঁটকাঠ খড় বোঝাই গাড়ির উপর গাড়ি আনাগোনা করছে—এ দৃশ্য গ্রামে বড়ো একটা দেখা যায় না।
সমবায়ের আপিসঘরের সামনে এসে, না বলে কয়ে ঢুকে পড়লাম। সবে তৈরি বাড়ি, এখনো টাটকা কাঠের সুগন্ধ ছাড়ছে। ঘরের দেয়ালে বিপ্লবীকর্তাদের ছবি টাঙানো, একটা তাকে মলাটের উপর কাগজমোড়া বই সাজানো, বড়ো বড়ো দুই জানলা দিয়ে হাওয়া আলো আসছে।
আমার দিকে পিঠ করে দুটি যুবা এক লম্বা টেবিলে বসে একমনে হিসেব মেলাচ্ছে। আমি গলার আওয়াজ দিতে তারা আমার দিকে ফিরে, তখনি অভিবাদন করে আমাকে বসতে বললে। এদের মধ্যে একজন সমবায়ের নেতা, বছর ত্রিশেক বয়স হবে, প্রফুল্ল তেজী চেহারা অন্যটি তার সহকারী, বাইশ বছরের সুন্দর নীলচোখো ছোকরা। দুজনেই চাষার ছেলে। আমার দেশে আসার সংবাদ এরা আগেই পেয়েছিল, বললে আমাকে এনে সব দেখাবার ইচ্ছে ছিল। আমি আপনি এসে পড়ায় আনন্দ প্রকাশ করলে।
নেতার ইঙ্গিতে সহকারী উঠে গেল; একটু পরে আমার জন্যে একটি রেকাবে বাজরার রুটি আর একপাত্র দুধ এনে দিলে। আমি খেতে বসলে নেতা বলতে লাগল,—“আপনি চাষাদের সব কাঁদুনি শুনেছেন নিশ্চয়ই?”
“খুব শুনেছি!”
দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুচকে হাসল। নেতা বললে, “কিছু দিন থাকলে আরো অনেক শুনবেন। যে কাঁদে না সে চাষাই না! আমি ভুক্তভোগী, জেনে বুঝেই বলছি। আমার এক খুড়োমশায় আছেন, তিনি কাঁদুনের সরদার।”
আর এক পত্তন হেসে—“আসুন আপনাকে সব দেখাই”—বলে দুজনে উঠে পড়ল।
বেরিয়ে আসতেই আপিসঘরের লাইনে, এক সার নতুন বাড়ি দেখা গেল। অনেকটা গ্রামবাসীদের বাড়ির ধাঁচার, তবে চাল উঁচু, দরজা-জানলা বড়ো, দুটি করে ঘর, সাজসরঞ্জাম সামান্য, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এগুলি সমবায়ীদের থাকার বাড়ি।
পরে যাওয়া গেল গোয়াল দেখতে। তিনটি মস্ত লম্বা চালা ঘর, এক একটিতে দেড়শ’ দু’শ গোরু আরামে থাকতে পারে। চাষাদের গোয়ালের তুলনায় বেশ ফাঁকা খট্খটে চেহারা এরা আশা করে এই বছরের শেষ নাগাদ শ’ আষ্টেক গোরুবাছুর দাঁড়িয়ে যাবে; বাকি গ্রামের সব গোরু ধরলেও এত হয় না। শীতকালে চাষারা গোরুকে খড়বিচিলির কুটির সঙ্গে একটু আধটু ভুষি কিম্বা আলুর খোসা ছাড়া কিছু দিতে পারে না। এদের ব্যবস্থা ভালো, মার্কিন পদ্ধতি (silo) অনুসারে গর্মিকালে কাঁচা ঘাস-পাতা-ডাঁটা মাটির তলে পুঁতে রাখে, তাই দিয়ে বারো মাস রসালো জাব দিতে পারে।
আর এক চালায় শুয়োর রাখার জায়গা, সচরাচর যেমন জঘন্য নোংরা দুর্গন্ধ হয়, এ তা নয়, বেশ সাফসুতরো। দুটি মেয়ে দেখলাম সিদ্ধ আলু থেঁৎলে শুয়োরদের সান্ধ্যভোজনের যোগাড় করছে। এদের হিসেবমতো এ বছরেই ২৫০ শুয়োর হবে।
চালাগুলো পার হয়ে এক মনোরম উপবনে প্রবেশ করা গেল। আগে এটা ছিল জমিদারের খাস নন্দনকানন,—ইতর লোকের প্রবেশ নিষেধ। এখন হয়েছে সমবায়ী অসমবায়ী সকল গ্রামবাসীর মেলামেশা আমোদপ্রমোদের আড্ডা; এখানেই সভাসমিতি নাটক সিনেমা গান বাজনা হয়ে থাকে।
এর পর নিয়ে গেল এক ফাঁকা জায়গায়, সেখানে অনেক বাড়ি তৈরি আরম্ভ হয়েছে, তাতে বসবে কারখানা, ভাণ্ডার, স্কুল, হাসপাতাল; পরে কুলোলে ক্লাবের জন্যেও একটা বাড়ি হতে পারে। এটা হবে গ্রামের ভাবী কৃষ্টিকেন্দ্র।
শেষে এক মাঠ দেখতে গেলাম যাতে ফলবাগান ফাঁদা হয়েছে। যতদূর চোখ যায়, রকম-বেরকম ফল গাছের চারার সার চলেছে। উৎসাহে উজ্জ্বলমুখ নেতা বললে, “আপনি আর বছর কয়েক পর ঘুরে আসবেন, এমন সব ফল খাওয়াব যা কখনো খাননি। এবার চলুন, একটা মজার জিনিস দেখাই।”
আপিসের কাছে ফিরে এসে, লাইনছাড়া একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দেখালে মুরগির ডিমে তা দেবার কল।
নেতা বললে, “এর ইতিহাসে একটু মজা আছে, শুনুন। এই কল আনার বিষয়ে তো সমবায়-সভা ডাকা গেল, অন্য দেশের দৃষ্টাস্ত দেখানো হল, কত হাঙ্গাম করে বোঝাবার চেষ্টা করলাম এর সুবিধেটা কী। সমবায়ীদের দল থেকে কত আপত্তি উঠল,—এরকম অস্বাভাবিক উপায়ে কখনোই কাজ হতে পারে না; জমিদারদের তো অর্থের অভাব ছিল না, তারা এ কল আনায়নি কেন। মার্কিন দেশে আছে তো কী হল, তাদের সবই ছিষ্টিছাড়া। এ দেশে ও কল চলবে না। অনেক বকাবকি অনুনয় বিনয় করে শেষ কল আনাবার অনুমতি পেলাম।
“শহরে কল তো ফরমাশ দেওয়া গেল। যখন এসে পৌঁছল, ওর অন্ধিসন্ধি কেউ ভেদ করতে পারলাম না। কোথায় রে বই—বই আনিয়ে পড়ে যা বুঝলাম সেইমতো কল তো চালানো হল, কিন্তু এমনি কপাল, একশ’র মধ্যে মোটে দুটি তিনটি ডিম ফুটল। তখন হাসি টিটকারির ধুম দেখে কে। ফিরিয়ে দাও কল, বেচে ফেলো কল, বললাম ও কল এখানে চলবে না,—মহা শোরশরারৎ পড়ে গেল।
“আমরাও ছাড়বার ছেলে নই। আবার বোঝাতে বসলাম—দেখো ভাইসকল, কলের তো দোষ নয়, দোষ আমাদের আনাড়িপনার। ওস্তাদ নইলে কি কল চলে, বলো তো ওস্তাদ আনাই। কী ভাগ্যি, কথাটা লেগে গেল, বললে আচ্ছা আনাও, কিন্তু এবার খরচ নষ্ট গেলে আর হাসি নয়, মারধর হবে বলে রাখছি।
“সদরে লিখতে তাঁরা এই ওস্তাদনী পাঠিয়ে দিলেন”—ব’লে, নেতা এক মেয়েকে দেখিয়ে দিলে। “ইনি আসতেই আমি বললাম—দেখো ওস্তাদনী, তোমার উপর বড়ো গুরুভার। এবার ফেল হলে আর রক্ষে নেই। মেয়েটি এক কথায় বুঝে নিলে, কাজও যেমন জানে খাটুনিও খাটল তেমনি—না ওস্তাদনী?” মেয়েটি একটু সলজ্জ হাসি হাসল। “যা হোক, সেবার মানটা রইল, শতকরা ৭০টা ডিম ফুটে বাচ্ছা হল। চাষারা মহা খুশি, এখন বলে আরো কল চাই।
“হায়রান হয়ে তো আপিসে ফেরা গেল। শ্রান্তি দূর করাবার জন্যে আবার রুটি মাখন পনীর আনাল। খেতে খেতে ওরা জিজ্ঞেস করলে, “আপনার কেমন লাগল।”
“আমি তো বলি খুব চটকদার, কিন্তু গ্রামবাসী চাষারা কী বলে।”
“চাষাদের কথা ছেড়ে দিন, ওদের গাঁইগুঁই লেগেই আছে।”
সহকারী একটু টিপ্পনি কাটল—“এবার কিন্তু আপত্তির সুর বদলেছে। এখন বলে—সমবায়ের কাজ আরো তাড়াতাড়ি এগোচ্ছে না কেন।” .
গ্রামের ভিতর দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক বুড়োর বাড়িতে একটু জিরিয়ে নিলাম। সে সময় তার দুই হৃষ্টপুষ্ট ছেলে সমবায়ের কাজ সেরে এসে খেতে বসল।
বুড়োকে বললাম, “তোমরা তো দেখছি সমবায়ে আছ।”
“না থাকার কি উপায় রেখেছে।”
“দেখলাম তো কাজ ভালোই চলছে, কত রকম নতুন বাড়ি হচ্ছে।”
“হাঁ, বাড়ি বাড়ি বাড়ি। লোকে বাড়ি খাবে না কি। কত করে বললাম, বাছুর শুয়োর বেশি করে মারো, আশ মিটিয়ে সকলে মাংস খাই। কে কার কথা শোনে। জানোয়ার বাড়িয়েই চলেছে।”
বুড়োর কথায় ছেলেরা মুখ টিপে হাসছে, আর রুটি আলু ঘোল খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছে।
বুড়োর গন্গন্ থামে না—“কালে কী হয় বলতে পারিনে, এখন তো বে-বন্দোবস্তের এক শেষ। খালি খাটো আর খাটো, কার জন্যে তার ঠিক নেই। ছুটি নেই, উপরি নেই, ফুর্তিটুকু করার যো নেই। গোরু শুয়োরের মতো আমাদেরও না হয় ভালো বাড়িতে রাখে, ভর পেট খেতে দেয়, তাতেই কি সব হল। নিজের খেয়ালে চলতে না পেলে কি মনে সুখ থাকে। নিজের বললে যদি দোষ হয়, তবে নিজের উপর নিজের সম্পত্তির উপর ভিতরে ভিতরে এত মায়া কেন।”
বুড়োর কথার ছিরিতে ছেলেদের হাসি চাপা দায় হল।
গোপিকা-কর্ত্রীর কথা
নিকটের আর-এক সমবায়-সম্পাদকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হল—একটু ভারিক্কি ধরনের লোক। তাঁর বড়ো সাধ তাঁদের পরিদর্শিকার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। সেই উপলক্ষ্যে একদিন আমাকে তাঁদের আস্তানায় নিয়ে গেলেন।
সেখানে পৌঁছে দেখি লাল-ফিতে বাঁধা এক মাথা বাবড়িকাটা চুল নিয়ে একটি মজবুত চেহারার ১৮ বছর বয়সের মেয়ে এক মস্ত কালো গোরুর দুধ দুইতে বসেছে। মেয়েটির নাম বীরা (Vera)। তার দুধ— দোয়ায় আশ্চর্য কিছুই নেই, সমবায়তে দুহিতার কাজ মেয়েকেই দিয়ে থাকে।
“এই আমাদের কর্ত্রী”—বলে সম্পাদক আলাপ করিয়ে দিলেন।
“সামান্য গোয়ালিনীকে লজ্জা দেন কেন।”—মেয়েটি এই উত্তর দিতে না দিতে, আমাদের চেহারা দেখেই হোক, আর গলার আওয়াজ শুনেই হোক, গোরুটা চমকে উঠে দুধের বালতিটা উলটে পালটে বীরার কাপড় ছিঁড়ে দিলে।
সম্পাদক ব্যতিব্যস্ত হয়ে আক্ষেপ করে উঠলেন—“আহা, বাছা রে! বেচারীর কাপড়ের বড়ো টানাটানি, তার উপর আজকাল ভাণ্ডারে ভালো কাপড় পাওয়াই যায় না।”
এদিকে বীরা তো ছেঁড়া কাপড় ধরে অন্তর্ধান হল। সেই ফাঁকে সম্পাদক আমাকে তার বৃত্তান্ত কিছু শুনিয়ে দিলেন।
বীরা ছিল দরজীর মেয়ে। বিপ্লবের আরম্ভে বাপ মারা যায়। শ্রমিকের সন্তানের পক্ষে সব বিদ্যালয়ের দ্বার খোলা, জায়গা পাবার জন্যে উমেদারি করতে হয় না। বীরা শীঘ্রই বিদুষী হয়ে উঠে কৃষিতত্ত্বের ডিগ্রী নিলে। তার পর রাজধানীর বড়ো বিদ্যালয়ে আরো পড়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ওর গুণপনা দেখে কর্তৃপক্ষেরা তা করতে দিলেন না, ওকে সমবায়ের কাজে টেনে নিলেন। বীরার বিপ্লবে জ্বলন্ত নিষ্ঠা, সমবায়ের নিয়মকানুন কণ্ঠস্থ, বলতে কইতে, লোককে বাগাতে, বশ করতে ওর জুড়ি নেই, তাই ওকে এখানে নেত্রী করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ সমবায়ের বিশেষত্ব এই যে, এতে শুধু রুশ নয়, ইহুদী, পোল, লেট, লিথুয়েনীয়, পাঁচ দেশের লোক জুটেছে, সমবায়ী ক্রমাগত বেড়েও চলেছে। তাই উপযুক্ত নেতা চাই।
বীরার ঘাড়ে পড়েছে অশেষ রকমের কাজ। লেকচার, পাঠ, আলোচনা, আমোদপ্রমোদ, এ সবের আয়োজন করা তো চাই, তার উপর সমবায়ের সাপ্তাহিকপত্র চালানো, নানা জাতের সমবায়ীদের মিলমিশ করানো, ফাঁক পেলে গ্রামে গ্রামে প্রচারে বেরোনো। ওর সরকারী পদ হল পশুবেত্তা-দুহিতা, সে হিসেবে ওকে দিন তিনবার আটটি গোরু নিজে দুইতে হয়, তাতেও ঢিলেমি নেই। রাতভোর আলোচনা-সভা চালিয়ে এলেও দোয়াবার সময় বীরা ঠিক হাজির।
একটু পরে কাপড় ছেডে বীরা হাসিমুখে ফিরে এল, আবার সেই গোরু দুইতে বসল, যেন কিছুই হয়নি। আমি দোয়া দেখছি আর অবাক হয়ে ভাবছি, বিশ্বাসই হচ্ছে না যে এই সবে কৈশোর-পেরোনো মেয়েটুকুর ভিতর এত থাকতে পারে। দোয়া হয়ে গেলে গোরুকে গোয়ালে তুলে, সেখানকার অবস্থা ঠিক আছে কি না দেখে নিয়ে, বীরা একপত্তন ছুটি পেল। তখন আমরা বাইরে এসে কাটাগাছের গুঁড়ির উপর গল্প করতে বসলাম।
সম্পাদক তামাশা করে আরম্ভ করলেন— “মোটরগাড়ি চড়বে বীরা?”
সে উৎফুল্ল হয়ে চেঁচিয়ে উঠল—“চড়ব বৈ কি। কোথায়, কার মোটর।”
“এই প্রবাসী ভায়ার।”
“কৈ। দেখছিনে তো।”
“না, না, আমি মজা করছিলাম। ইনি হেঁটে এসেছেন।—জান, প্রবাসী ভাই, আমাদের বীরার শখ সাধের অন্ত নেই। বলো না বীরা তোমার সব মনের কথা।”
বীরা। আমার এমন কী বেশি শখ দেখতে পেলেন।
সম্পাদক। তবু তোমার কী কী করতে ইচ্ছে করে বলো না।
বীরা। মোটরগাড়িতে বোঁ বোঁ করে লম্বা পাড়ি দিতে সত্যি বড়ো মজা। আর রাজধানীতে প্রধান বিদ্যালয়ের ডিগ্রীটা নিয়ে আসতে পারলে হত। আর এরোপ্লেনে উড়তে ইচ্ছে করে। আর কলের লাঙল চালাতে। আর আর—একটা ভালো সিনেমার ছবি দেখতে,—এখানে যত পচা ছবি আসে। আচ্ছা, প্রবাসী মশায়, আপনাদের মার্কিন দেশের ছোটো গ্রামেও ভালো ছবি দেখায়?
আমি। তা দেখায় বই কি।
বীরা। একেই তো বলি সুবন্দোবস্ত। আমরা এখনো অতটা এগোতে পারিনি। কিন্তু ক্রমে করে তোলা যাবে। তাহলে আপনাদের বিপ্লব আরম্ভ হলে এখানে বসে তার ছবি দেখব। তার আর দেরি কত বলুন তো।
আমি ভাবলাম আচ্ছা ছেলেমানুষের পাল্লায় পড়েছি। বয়স না ধরতেই একে নেত্রী বানিয়ে দিলে কোন্ বুদ্ধিতে।
সম্পাদক একটু হেসে বললেন, “একে যদি খুশি করতে চাও তাহলে বলে দাও পৃথিবীময় বিপ্লবের আয়োজন লেগে গেছে।”—পরে, আমাদের দুজনকে বসিয়ে রেখে তিনি নিজের কাজে চলে গেলেন।
তাঁর শেষ কথার প্রতিবাদ করে বীরা বলে উঠল, “বাজে কথা কে শুনতে চাচ্ছে। সত্যি যা, তাই বলুন। মার্কিন দেশের শ্রমিককে তো কম উৎপীড়ন সইতে হয় না, তবে সে কেন ভোম্বলদাসের মতো চুপচাপ বসে আছে।
আমি বুঝিয়ে বললাম, যেসব মধ্যবিতেরা ধনীর খায় পরে, ধনীর দৌলতে বিলাসে থাকে, তারা দলে এত ভারি, তাদের অস্ত্রশস্ত্র রসদের যোগাড় এত বেশি, শ্রমিকেরা জানে বাদাবাদি করলে পেরে উঠবে না, তাই বিপ্লব পর্যন্ত এগোয় না।
বীরা। আমার তা বিশ্বাস নয়। বল পরীক্ষায় নামলে শ্রমিকের জয় হবেই হবে। সে যাই হোক, মার্কিন দেশের আরো অনেক কথা জানতে ইচ্ছে করে, আপনি সব বলুন।
আমি। বিশেষ করে কোন্ কথাটা শুনতে চাও, বলো।
রীরা। এই ধরুন না, আমার বয়সী মার্কিন মেয়েরা কী করে।
আমি। স্কুল-কলেজে যায়, বই পড়ে, আমোদ আহ্লাদ করে।
বীরা। রোজগার করে না?
আমি। আজকাল অনেকে তাও করে।
বীরা। সে কথা ভালো। মেয়েরা নিজের জোরে না থাকলে তাদের গতিমুক্তি নেই। কিন্তু আপনাদের মেয়েরা আর কী করে বলুন।
আমি। কেউ কেউ রবিবারে গির্জেয় যায়।
বীরা। তাতে কী হয়।
আমি। মনে শান্তি পায় বোধ করি।
বীরা। চারদিকে যেখানে অশান্তি, নিজের মনে শান্তি পাওয়াটা কি বড়ো জিনিস। সেদিন চাষীদের বৈঠকে বলছিলাম—তোমাদের এই পিশু-ছারপোকা ভরা বাড়ি ছেড়ে সমবায়ে এসে মানুষের মতো থাকতে শেখো। তাতে তারা বললে—আমরা এইভাবেই বেশ শান্তিতে আছি।—নিজের বাড়ি, নিজের ধন নিজের শান্তি, এ কথাগুলোর উপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে। কিন্তু আপনাদের মেয়েদের বিষয়ে আসলে যা জানতে চাচ্ছি, তাই বলছেন না, তাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী।
আমি। উদ্দেশ্য তারা নিজেরাই।
বীরা হতভম্ব হয়ে আমার দিকে ড্যাবড্যাবে চোখে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল, “আপনি কি বলতে চান তারা নিজে বই আর কিছু জানে না। মার্কিন সমাজে কুসংস্কার কুপ্রথা কিছু নেই, দীন দুঃখী বিপন্ন উৎপীড়িত নেই, যাদের জন্যে মেয়েদের কিছু করতে ইচ্ছে যায়?”
আমি। সে রকম ইচ্ছে তো বড়ো একটা দেখতে পাইনে।
বীরা। কী আশ্চর্য। আমার অমন জীবন হলে হাঁপিয়ে মারা যেতাম—মনে হত কোন অকুলে হারিয়ে গেছি। বিপুল ভবে আমি একা—কী সর্বনাশ। সে শিউরে উঠল।
এমন সময় বাড়িভাঙা কাঠকাঠরা-বোঝাই গাড়ি সামনের রাস্তা দিয়ে আসছে দেখে বীরা গাড়োয়ানকে হেঁকে কিছু শিষ্টালাপ করে, পরে আমায় বললে, “পাশের গ্রামে কুধনীদের বাড়ি ভাঙা হল, তারি মালমসলা কর্তারা এ গ্রামকে দান করেছেন তাই নিয়ে আমাদের গাড়ি ফিরল।”
কুধনীর বাড়ি ভাঙা শুনে, মনে যে দুঃখ নিয়ে দেশে এসেছিলাম তাই উথলে উঠল, আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—“কী সাংঘাতিক।”
বীরা। কিসে সাংঘাতিক।
আমি। বল কী। সদ্গৃহস্থ স্ত্রীপুরুষ ছেলেমেয়ে কচিকাচা সব পৈত্রিক ভিটে থেকে আচমকা ঝেঁটিয়ে বার করে দিয়ে অচেনা অজানা জায়গায় মজুরি করতে চালান দেওয়া কী ভয়ংকর কথা।
বীরা। আপনার মতের সবাই হলে তো বিপ্লবই হত না।
আমি। তোমার নিজের কী মনে হয়,—কাজটা নিষ্ঠুর নয়?
বীরা। নিষ্ঠুর নিশ্চয়ই। আপনারা কি মনে করেন কুধনীকে নির্ধনী করতে আমরা আমোদ পাই? কত বার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যায়, তবু না করলে নয় বলে করে যাই। হয় রোগবীজ মারতে হবে, নয় রোগী মরবে। হয় ধনী, নয় সমবায়—দুটো এক সঙ্গে থাকতে পারে না।—দুঃখ প্রকাশ করছেন বটে, কিন্তু আপনি কি সত্যি কাঁদতে জানেন। জগৎজোড়া শ্রমিকের আর্তনাদে যদি আপনার প্রাণ কাঁদত, তাহলে মনও শক্ত হত। শ্রমিকে শ্রমিকে দেশভেদ জাতভেদ ধর্মভেদ নিয়ে লড়ালড়ি হয় না, সেসব খুঁচিয়ে তোলে মধ্যবিতেরা নিজের নিজের কাজ হাসিল করার জন্যে; মরতে মরে শ্রমিকেরা। বলতে বলতে বীরা রণরঙ্গিণী মূর্তি হয়ে উঠল।
এ কথার পর কী আর বলি, জিজ্ঞেস করলাম—“তুমি কি বন্দুক চালাতে জান বীরা।”
বীরা। তা না জানলে বিপ্লবের ভিতর আসি?
আমি। আবার যদি যুদ্ধ বাধে, তুমি লড়াইয়ে যাবে?
বীরা। আমায় কে ঠেকিয়ে রাখে, তাই দেখব।
আমি। সে কী, সঙিন নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে বাধবে না?
রীরা। দেখুন, প্রবাসী মশায়, ধনী আর ধনীর পুষ্যি মধ্যবিত্ত ছাড়া জগতে আমাদের কেউ শত্রু নেই। তারা যদি কোনোদিন বাগে পায়, আমাদিকে যে কী করবে আপনি তা কল্পনাও করতে পারেন না; স্ত্রীলোক বালক কারো নিস্তার থাকবে না। নিজেকে বাঁচাতে হলে তখন যে অস্ত্র হাতে পাই তাই চালাব। বীরত্ব কি পুরুষমানুষের একচেটে করতে চান।
বীরাকে আর ছেলেমানুষ মনে হল না। ওর কথায় বাহাদুরির সুর নেই, মুখে যা বলছে দরকার হলে তাই করবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ রইল না। ধর্মের দোহাই, রাজার হুকুম, স্বদেশের প্রতিপত্তি, এই সব উত্তেজনার জোরে অন্য দেশে অন্য কালে লোকে ভগবানকে ডাকতে ডাকতে মারতে মরতে গেছে,—তা তো জানা আছে। এরা তো বাইরের কোনো শক্তিকে ডাকে না; সাধারণ মানুষের দুঃখের দরদে এদের আত্মশক্তি জেগে উঠেছে; এরাও মারতে মরতে প্রস্তুত। না জানি কিসের জোরে এরা খাড়া আছে, এত তেজে চলছে।
বীরার নিজের মুখে শুনব বলে জিজ্ঞেস করলাম,—“তুমি তো দেখছি ধর্ম মান না, শান্তি চাও না, তবে তোমার মন কিসের প্রয়াসী।”
বীরা। আমি চাই প্রেম, আরো প্রেম।
আমি। দাম্পত্য প্রেম?
রীরা। সে জিনিসটা কী তা জানিনে।
আমি। তবে যাকে বলে স্বাধীন প্রেম, তাই নাকি।
বীরা। তা নয় তো কি।[৪] ফরমাশী প্রেমকে প্রেম বলেন!
আমি লিখে যাচ্ছি দেখে বীরার কৌতূহল হল। আমার কাছে উঠে এসে জিজ্ঞেস করলে, “আমার কথা টুকে রাখছেন না কি।”
আমি। হাঁ, যতটা পারি।
বীরা। দেখবেন, আমার মুখে উলটো কথা বসিয়ে দেবেন না।
আমি। সে বিষয়ে সাবধান থাকব, ভয় নেই।
লেখা শেষ না হতেই বাইসিকেল চড়ে এক যুবক উপস্থিত— ফিটফাট নীল বিপ্লবীকুর্তা গায়ে, মাথায় নতুন টুপি, পায়ে পালিশ-করা জুতো, ভাষাও মার্জিত,—চাষার ছাঁদের নয়। “ইনি জেলাস্কুলের শিক্ষক”, বলে বীরা আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে। তিনি এসেছেন ছেলেমেয়েদের এক আলোচনাসভায় বীরাকে নিয়ে যেতে। বীরা তখনি রাজি। “চট করে একটু মুখে হাতে জল দিয়ে আসি” বলে আমার কাছে বিদায় নিয়ে গেল।
চমৎকার সন্ধ্যেটি হয়েছে, ঝকঝকে আকাশ, ফুরফুরে মিঠে বাতাস,—এর সঙ্গে মানায় গল্পসল্প, হাসিখেলা, নাচগান, না হয় আনমনে একা বসা। কিন্তু সমস্ত দিন বেদম খাটুনির পর এ মেয়ে চলল কোথায়, না ক্রোশ খানেক পথ হেঁটে এক বদ্ধ স্কুলঘরের ভিতর রাত দুপুর পর্যন্ত আলোচনা করতে যারা বৈঠকে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে, তারাও সারাদিন খেটেখুটে এসে জমায়েত হয়েছে। আলোচনার বিষয় যে কৃষ্টিতত্ত্ব, তা ভালো করে বুঝতে বোঝাতে পণ্ডিতেও হার মানে—
ধন্য তোমরা বিপ্লবের ছেলেমেয়েরা। তোমরা কোন্ আলো দেখে ছুটে চলেছ, জানিনে,—কিন্তু তোমাদের মার নেই।
প্রবাসীর কথা এই পর্যন্ত।
তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরাও ধুয়ো ধরি—বীরার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। USSR যদি সত্যি প্রেমের প্রেরণায় চলতে থাকেন, তাহলে অন্তরের হোক, বাইরের হোক, রিপুর কী সাধ্যি তার লক্ষ্মী সমেত নারায়ণ লাভের পথ আটকায়।
- ↑ লার্ক পাখি আকাশে উড়তে উড়তে গায়।
- ↑ Trinity ইহাদের সেকেলে নবান্ন গোছের উৎসবের খ্রীস্টান সংস্করণ।
- ↑ রুশ-গৃহস্থদের বাড়িতে সারাদিন স্যামোভার-এ চা চড়ানো থাকে। কেউ দেখা করতে এলে এক গেলাস গরম চা দুধ চিনি দিয়ে নয়, নেবুর রস দিয়ে তৈরি করে আতিথ্যকরা রীতি।
- ↑ য়ুরোপীয় ভাষার স্বাধীন প্রেম বলতে স্বেচ্ছাচার বোঝায়। বীরা কথাটার ভালো মানে ধরল।