বিশ্বমানবের লক্ষ্মীলাভ (১৯৪০)/তৃতীয় পালা
তৃতীয় পালা
মনপ্রাণের উৎকর্ষ
আহারের সমস্যা
সাধে ভাবি USSR হয়তো এবারকার অবতার, দেখাই তো গেল, আকাশ বায়ু জ্যোতি জল এঁদের বাগ মেনে আসছে, এঁদের শাসনে উত্তরবাহিনী নদী পশ্চিমে চলেছে, পশ্চিমের নদী পুবের নদীর সঙ্গে জল মেশাচ্ছে; এঁদের বিধানে যেখানে ছিল মরু সেখানে কোথাও বনের পাখির বৈঠক বসেছে, কোথাও শহুরে মানুষ হট্টগোল লাগিয়েছে; যা ছিল ফাঁকা পাথুরে অধিত্যকা, হয়েছে সেখানে কাটা খাল, খালের ধারে সবুজ গাছের বেড়া, সেকেলে নবাবদের কেয়ারি-করা বাগানের অতি বৃহৎ সংস্করণের মতো; সকলের আধার যে পৃথিবী তার রূপ এমন ফিরে যাচ্ছে যে কিছু কাল পর এরোপ্লেন থেকে এক নজর দেখলে তাকে সেই ইহলোক বলে আর চেনাই যাবে না।
ধরিত্রীকে রূপসী করার শখ তো নয়, “দরিদ্র নারায়ণ” যাতে পেট ভরে খেতে পান, সেই আগ্রহে এত গা-ঘামানো, এত মাথাব্যথা।
তাহলে আমরা নরেরা কি রাক্ষসের জাত—বুঝি শুধু আঁউ মাউ আর খাঁউ।
তা যাই বল, এক পেট খিদে নিয়ে বুদ্ধির কি ধার হয়, না মেজাজ খোস থাকে। চরম গতির কথা তো ছেড়েই দাও।
এই চোদ্দ-পোয়া ধড়টাকে তাজা ভাবে খাড়া না রাখলে, ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ কোনোটারই নাগাল মেলে না। আর মানুষের খাবার ধাঁচাটা যদি রাক্ষুসে হয়েই থাকে, সে দোষও প্রকৃতি-মায়ের, যাঁর কৃপায় কোনো না কোনো প্রাণী হত্যা না করলে তার প্রাণই বাঁচে না। কাজেই খোদার উপর খোদকারি ক’রে প্রকৃতির প্রকৃতি বদলাতে না পারলে মানুষের মানুষ হওয়াই দায়।
মহাভারতে দুরকম রাক্ষসের পরিচয় পাওয়া যায়। বর্বর-অবস্থায় মানুষের হিড়িম্ব রাক্ষসের মতো ভাব—যাকে পাই তাকে খাই, জুটলে নাচি গাই, নইলে হন্যে হয়ে বেড়াই। সভ্যতার বড়াই করলেই তো হয় না, আজ পর্যন্ত অনেক জাতের মানুষের জীবনযাত্রা ঐ রকমই। কিন্তু বকরাক্ষসের মতি অন্য ধরনের। সে পরের আমন্ত্রণ থেকে বাঁচিয়ে গ্রামকে স্বচ্ছন্দে রাখত, তার দাম হিসেবে নিজের পেটচালাবার জন্যে পালা করে একজন গ্রামবাসী খেত।
উৎকৃষ্ট মানুষ বকের নিয়মে আশ্রিত প্রাণীদের সঙ্গে ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু অনেক সময় সে ঐ রাক্ষসের মতো মাত্রা ঠিক রাখতে পারে না। দেখো না কেন, আমাদের ধর্মপ্রাণ জাতের মধ্যে নিজের পাঁঠা খাবার শখটা দেবতার উপর চাপিয়ে একদল ভক্ত রক্তনদী বইয়ে উৎকট আমোদে মাতে। সভ্যতা-অভিমানী মার্কিন দেশে জানোয়ার-মারা কলে এক দিকে দিয়ে শুয়োর ঢুকিয়ে জন্তুটার আর্তনাদের রেশ কান থেকে না যেতেই অন্য দিক দিয়ে তার চামড়ার জুতো বার করে নিজের কেরামতি দেখে নিজেই তাক।
সে যাই হোক, নরোত্তম পদ পেলে কী হবে বলা যায় না, নরের এখনকার অবস্থায় প্রকৃতির সঙ্গে রফারফি ছাড়া গতি নেই। বাঁদর মাংসাশী নয়, সে পাতা ফল খেয়ে থাকে। কিন্তু অভিব্যক্তির তাড়ায় যখন বানরের এক দল গাছ থেকে নেমে দুপায়ে খাড়া হয়ে নর-রূপ নিল, তখন পড়ল ফাঁপরে। ফল থেকে এসে গেল দূরে, অথচ চাষবাস তখনো শেখেনি। খিধের জ্বালায় কী করে, পাথরের অস্ত্র বানিয়ে তা দিয়ে জীবজন্তু মেরে খাওয়া অভ্যেস করতে হল।
কিন্তু মাংস খাওয়া নরের দেহমনের উপযোগী না হওয়ায় মানুষের শরীর হয়ে দাঁড়াল ব্যাধিমন্দির। সে বিষয়ে সচেতন হয়ে আজকালকার পাশ্চাত্ত্য ডাক্তারেও বলতে আরম্ভ করেছেন যে, মাংস খাওয়া মানুষের পক্ষে দরকারী তো নয়ই, উপকারীও নয়। কৃষ্টির ফ’লে বুদ্ধিবৃত্তি শোধন হলে মানুষ রাক্ষস-পিশাচের নকল না করে, নিজের আক্কেল মতো চলে রক্তারক্তি কাণ্ড ত্যাগ করবে—এই আশায় ভর করে এখানে নিরামিষ আহারের আলোচনাই চলুক।
গাছের সঙ্গে মানুষের যে খাদ্য-খাদক সম্বন্ধ সেটা নেহাত মন্দ দাঁড়ায় নি। ফলের বেলায় তো কথাই নেই, ওটা গাছ নিজের গরজে মিষ্টি রসের ভেট সমেত মানুষের হাতে তুলে দেয়, সঙ্গে থাকে এই মাত্র আবদার—“বংশ রক্ষার উপায় করে দিয়ো।”
ফল ফলাতেই তো গাছতলার আশপাশের মাটির সার ফুরিয়ে আসে, সেই মাটিতে সোজাসুজি বীজ পড়তে দিলে নতুন চারার সঙ্গে পুরোনো গাছের খোরাক নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যাবে। তাই দূরের তাজা মাটি পর্যন্ত বীজ পৌঁছে দেবার জন্যে সচল জীবের সাহায্য নইলে নয়।
এদিকে, গাছের সে নীরব আবেদন মানুষ নিজের গরজেই মঞ্জুর করে, গাছের মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টান্ন ভোজনের ব্যবস্থা করেছে। তাই দেশে দেশে মানুষের যত্নে-করা যত্নে রাখা ফলবাগানের ছড়াছড়ি। কিন্তু হায়রে কানা পদ্মলোচন। সুফলা বাংলার ফলবাগান কোথায়।
যাই হোক, প্রকৃতির ব্যবস্থার মধ্যে মানুষে-গাছে ফলসংক্রান্ত চুক্তিটা সমবায়সম্বন্ধের একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত—কোনো পক্ষের লোকসান নেই—উভয়েরই লাভ।
চোরের উপর বাটপাড়ি করে উদ্ভিদ-খেকো জন্তু মেরে খাওয়া বাদ দিলেও দুধ ডিম খাওয়া, রোঁয়া-পালক পরা, আরো পাঁচ কাজ আদায়ের কারণে পশুপাখির সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ রাখতে হয়। পাশ্চাত্ত্য দেশে গোরুর পালের চাকচিক্য দেখলে চোখ জুড়োয়, মানুষের যত্নচেষ্টায় তাদের দেহ বংশ দুই বৃদ্ধি পাচ্ছে সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না; স্বীকার করতে হয়, সেখানে দুধ দিয়ে গোজতি যথেষ্ট প্রতিদান পাচ্ছে। কিন্তু পূজিত গো-মাতার দেশে তার ক্ষীণ খর্ব দেহ, তার বাছুরের হাড়-সার দশা দেখলে দরদীর দুধ খাবার রুচি উড়ে যায়। পুরো খেতে না দিয়ে অতিরিক্ত খাটিয়ে আধমরা করে রাখার যে অহিংসা, তার চর্চা না করে বরং ওরকম ভবযন্ত্রণা থেকে সংক্ষেপে নিষ্কৃতি দেওয়াটা বেশি দয়াধর্মের পরিচয় কিনা, সে প্রশ্ন ওঠে; কিন্তু এখানে তার বিচার নাইবা করা গেল।
তার চেয়ে ঘাসের দিকে চোখ ফেরানো যাক। বুনো অবস্থায় ঘাসের বিচি হবার পরেও বটে আগেও বটে, বনের জন্তুরা খেয়ে মাড়িয়ে তার কর্ম-সারার যোগাড় করে। তা সত্ত্বেও যে-বিচিগুলো পেকে উঠতে পায় তাও কতক পাথুরে জমিতে পড়ে শুখোয়, কতক জলে পচে, কতক নানা বিপাকে মারা পড়ে; শেষে হাজার-করা দুচারটে যা সুবিধেমতো জায়গায় আস্ত পৌঁছয়, তারাই ঘাসবংশ বজায় রাখে।
এর তুলনায় ঘাসের শস্য-দাদার আরামের কথা ভাবো। কত খাটুনি দিয়ে তৈরি, কত আগাছা নিড়িয়ে পশুপাখি খেদিয়ে সাবধানে রাখা জমিতে বীজ লাগানো হয়, বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কত রকমের তদ্বির চলতে থাকে। শেষে খেতের উপর খেত জুড়ে নধর সবুজের বাহার দেখে, চাষা তো চাষা, কবির মনেও আনন্দ ধরে না। কে বলবে মানুষে-শস্যে নিন্দের সম্পর্ক।
অনেক স্থলে গাছ দিগ্বিজয় করারও সুযোগ পেয়েছে। মানুষ কত হাজার বৎসর ধরে পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত রকম কারণে এক এক দলকে দেশান্তরে যেতে হয়েছে—আজ বলে নয়, আদিকাল থেকে; শুধু কাছাকাছি নয়, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে, নানা জাতের মানুষের যাতায়াতের চিহ্ন আছে,—কখনো আবহাওয়ার হেরফেরে, কখনো বা মানুষের প্রধান শত্রু মানুষের তাড়া খেয়ে। যারা যখন যেখানে গেছে সঙ্গে নিয়েছে খাবার ফলমূল দানা, তার মধ্যে পথে কিছু পড়ে গিয়ে মাটিতে লেগে গেছে, নতুন বসতি করার পর কিছু ইচ্ছে করেও লাগানো হয়েছে।
এ রকম করে গম, ধান, আরো কত কী ফলশস্য পৃথিবীর সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের আম গেছে মার্কিন দেশে, চীনের লিচু এসেছে এখানে, মর্তমান (Martaban) কলা, বাতাবি (Batavia), মোসম্বী (Mozambipue) নেবু, আজও নিজের নিজের নামে আদিস্থানের পরিচয় দিচ্ছে। তার উপর বীজ বাছাই করে, কলম করে, সার দিয়ে নানান উপায়ে ফলশস্যের জাতের উন্নতি করা হয়েছে। জঙ্গলের টোকো এঁসো আম, বাগানের ল্যাংড়া বোম্বাইয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়ী বাঁদুরে নাশপতি, সুগন্ধী রসালো কাশ্মীরী pear হয়ে উঠেছে। আর শস্য তো সবি রকম-রকম বুনো ঘাস থেকে জাতে তোলা।
মানুষের এত দিনের চেষ্টাচরিত্রে তো এই ব্যাপার করে তুলেছে, তবে USSR-এর এ বিষয়ে আর নতুন দেখাবার থাকল কী।
আছে, ঢের আছে। এত দিন কী ভাবে চলে আসছে জান! নতুন জায়গায় যে বীজ পৌঁছল, তার ঝড়তি-পড়তি আপনি লাগল তো লাগল, হেলায় কিছু বা বিশেষ ভাবে লাগিয়ে দেখা হল, বাঁচল তো বাঁচল নয় তো নতুন মাটিতে অচল বলে ছেড়ে দিলে। সার দেওয়ার ব্যাপারও সেই রকমই। হাতের কাছে যে সার আছে, বা জোটে, তাই গাছের গোড়ায় দিয়ে দেখা হল, ফল না পেলে খেয়াল ছুটে গেল, ফল পাওয়া গেল তো বাহাদুরি নিলে।
USSR-এর উদ্যম বল, অধ্যবসায় বল, ধারাবাহিক চেষ্টা বল, সে সব অন্য ধরনের। তারা গাছের চরিত্রই বদলে ফেলতে বসেছে। ভারতবর্ষের রোদে-মানুষ-হওয়া ব্রহ্মচারী, সে যদি তিব্বতের বরফে গিয়ে সাধনায় বসতে পারে, শীত দেশের লড়াক্কে জাত যদি ধনের লোভে আফ্রিকায় বালির তাতে আড্ডা গাড়তে পারে, তবে ওস্তাদের মতো ওস্তাদের হাতে পড়লে গাছই বা নিজের অভ্যেস বদলাতে শিখবে না কেন।
তবে গাছকে শেখাতে হলে অশ্রান্ত অনুসন্ধান চাই, অফুরন্ত পরীক্ষা চাই, অদম্য উৎসাহ চাই, সকলের উপর সমবেত চেষ্টা চাই। USSR-এর এই সব আছে বলেই এতকালের কৃষ্টির বাড়াও তাঁরা অনেক কারদানি দেখাতে পারছেন।
মাথা যতই খাটানো হোক, হাজার পড়াশুনা করা হোক, তাতেই মানুষের পূর্ণ বিকাশ হয় না, আনুরাগ্য-বিনা আনন্দলোক লাভ হয় না, সে বিষয়ে অঙ্গিরা ঋষি প্রকারান্তরে সাবধান করে দিয়েছেন। USSR-এর অনুরাগের কী পরিচয় পাওয়া যায়, তা পরে দেখা যাবে। কিন্তু যিনি যে-লোকের আকাঙ্ক্ষা করুন না কেন, আগে ইহলোকের অন্নসংস্থান আবশ্যক। সেই উপদেশ রাজর্ষি জনক হাতে-লাঙলে দিয়ে গেছেন। সে সনাতন দৃষ্টান্ত আধুনিক প্রণালীতে USSR কেমন ভাবে বিস্তার করছেন, তারি কিছু কিছু গল্প এই পালায় করা যাচ্ছে।
শ্রেষ্ঠের তল্লাশ
রুশের বিপ্লব নির্বিবাদে হতে পায়নি, সে তো ধরা কথা। বাইরের শত্রুদের আক্রমণ এক পক্ষে চলছিলই; ভিতরেও বাগড়া দিচ্ছিল বিরুদ্ধ দল, যাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছেড়ে দিতে হওয়াটা মোটেই উপাদেয় ঠেকেনি; আর প্রতিপত্তি প্রাধান্য নিয়ে রেষারেষি—তাই বা যাবে কোথায়। এসব নিয়ে কাটাকাটি মারামারি থমথমে হলে, বিপ্লবী কর্তারা যে-রাষ্ট্রের ভার পেয়ে কাজ চালাতে বসলেন, তার একেবারেই ভগ্নদশা।
রুশের সে সময়কার খবরের কাগজ পড়লে অবাক হতে হয়। শহরে ঘাস-গজানো রাস্তার দুধারে পোড়ো বাড়ি; পল্লীর সব পতিত খেত আগাছা-ঢাকা; কারখানার কলে মর্চে; স্টেশনে সারবন্দী রেলগাড়ি অচল। ধন্য তাঁদের পুরুষকার, যাঁরা ছারখার রাষ্ট্রের ঘোর অন্ধকার রাতে দমে না গিয়ে, নগরে নগরে বিজলী দীপমালা পরাবার, গ্রামে গ্রামে দুনিয়া-ছাঁকা সেরা ফসল ফলাবার সংকল্প করতে পেরেছিলেন।
খালি ফাঁকা কল্পনা নয়। ঘরে বাইরে সেই অরিবাম অশান্তি সত্ত্বেও সেরা বিজ্ঞানীর দল বাছাই করে, কোন্ জায়গায় কিসের অভাব, যা আবশ্যক তা কোন্খানে কেমন করে পাওয়া যায়, সেই খোঁজে তাদিকে লাগিয়ে দিলেন।
সব দেশেই কিছু কিছু বিদেশী গাছগাছড়া দেখা যায়, কিন্তু সে বিষয়ে মার্কিন দেশের কাছে কেউ নয়। সেখানকার মানুষও যেমন পাঁচ দেশের আমদানি, সে দেশের পর্যটকরাও তেমনি নিজের খেয়ালমতো নানা জায়গার রকম বেরকমের গাছ এনে জুটিয়েছে। সেখান থেকে শেখবার অনেক আছে বটে, কিন্তু খামখেয়ালী ভাবে কাজ করলে USSR-এর চলে না, তাই তাঁরা মার্কিন দেশের মাছিমারা নকল করেননি।
USSR-এর প্রথম দিকে সংকল্প (plan) ছিল, যে-প্রদেশে যা সহজে হয় সেখানকার বাসিন্দা দিয়ে দেশসুদ্ধ লোকের জন্যে তাই উৎপন্ন করিয়ে চারিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু দেখা গেল তাতে আনা-নেওয়ার হাঙ্গাম অনর্থক বেড়ে ওঠে। চাষ আবাদই হোক, খনির কাজই হোক, বড়ো ভাবে করতে গেলে, গোরু ঘোড়া ঠেঙিয়ে কুলোয় না, নানা রকম কলকবজা লাগে, কল তৈরির জন্যে কাছাকাছি কারখানা চাই, শ্রমিকদের টাটকা ফলতরকারি খেতে হলে দূর থেকে আনা চলে না। কাজেই সব প্রদেশে সব রকমের বন্দোবস্ত রাখতে হয়।
কর্তাদের কাছে চারদিক থেকে আবদার আসতে লাগল:
“আমাদের বরফের দেশ বলে আমরা কি’ গমের রুটি খেতে পাব না।”
“আমাদের এখানে পোকার উপদ্রব, ফলে পোকা ধরে না এমন গাছ চাই, নইলে আমাদের ফল খাওয়াই হবে না।”
“কারখানায় কুটনো কোটে কলে, কলের মাপের সমান গোল আলু হয় এমন জাতের বীজ চাই।”
—কত রকমের ফরমাশ।
এখন তো আর সম্রাটের গবর্নমেণ্ট নেই যে, প্রজারা বকাবকি করলে রাজদ্রোহ হয়। USSR-এ সকলেই শ্রমিক, শ্রমিকদের দরদ শ্রমিকে বোঝে; তাছাড়া এত সাধের এত কষ্টের বিপ্লব, বিপ্লবীর ছেলেপিলেরা রাজার হালে খেয়ে মানুষ না হলে মান থাকবে কেন। তাই USSR-এর চোখা চোখা জিনিস চাই, তড়িঘড়ি চাই, দুনিয়া হাতড়ে বেড়াবার তর সয় না। ঠিক জিনিসটি যেখানে পাওয়া যাবে, বেছে বেছে সেখানে লোক পাঠাতে হবে।
মতলবটা তো ভালোই। তবে কোথায় কী আছে সেখানে গিয়ে না দেখে আগে থাকতে আন্দাজে লোক পাঠানো, সে কী রকম।
এ হেঁয়ালিতে বিজ্ঞানী ডরায় না। গণৎকার হিসেবে বিজ্ঞানীর বেশ হাতযশ আছে।
আগে তো বুধ মঙ্গল শুক্র বৃহস্পতি শনি, এই পাঁচটি বই গ্রহ জানা ছিল না। শনির চালচলন ঠিক অয়নমতো হচ্ছে না দেখে জ্যোতির্বিদ অনুমান করলেন, সে আরো দূরে কোনো অজানা গ্রহের টানে না পড়লে এমন গতিভ্রম হয় না; আকাশের কোন্খানে সে গ্রহের দেখা পাওয়া উচিত তাও গুনে ঠিক করলেন; তার পর সেদিকে দূরবীন যেমন তাক করা, অমনি বরুণ (uranus) গ্রহ ধরা পড়া। ক্রমশ এই প্রণালীতে খোঁজ করে দূরে কাছে আরো কত গ্রহ বেরল।
তেমনি যত রকম মৌলিক পদার্থ জানা ছিল সেগুলিকে পরমাণুর বাঁধুনি অনুসারে ধাপে ধাপে সাজাতে গিয়ে, রসায়নবিদ্ দেখলেন এক একটা ধাপ ফাঁক থেকে যায়। সে ফাঁকে বসাবার মতো পদার্থ উপস্থিত না থাকলেও, নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে ভরসা করে খোঁজ করায় নতুন নতুন ভূতের দেখা পাওয়া গেল।
উদ্ভিদেরও সব শ্রেণীভাগ করা হয়েছিল। নীল গোলাপ কেউ খুঁজতে বেরয়নি, কারণ শ্রেণীর মধ্যে তার ফাঁক ছিল না; কিন্তু হলদে ফুলের মটর রুশে না থাকলেও, শ্রেণীতে তার ফাঁক থাকায় সেখানকার বিজ্ঞানী মনে জানেন কোথাও না কোথাও পাওয়া যাবে। আমরা দেখে জানি এ দেশেই পেতে পারেন।
কিন্তু ফুলের বাগান করার জন্যে তো USSR ব্যস্ত হননি; তাঁরা যে সব খাদ্যের খোঁজে ছিলেন, তার কী উপায় করা হল সেই হচ্ছে কথা। এই ধরো না কেন, এমন এমন গম তাঁরা চান যার কোনোটা বরফের দেশে টিঁকতে পারে, কোনোটা যে দেশে মাসকতক টানা রাত সেখানেও ফলতে পারে, কোনোটা জলের অভাবে বা অতি বর্ষায় মরে না। একাধারে সব গুণ তৈরি না পেলেও, দু’চার রকমের জোড় মিলিয়েও দরকারমতো করে নেওয়া যেতে পারে। মোট কথা নানা গুণের বিচি চাই, যত রকমের পাওয়া যায় তত রকমই চাই।
‘পুঁথিগত বিদ্যে’ নিন্দের ছলে বলে, কিন্তু কাজে লাগাতে জানলে সে বিদ্যে বড়ো ফেলা যায় না। যে আমলের হোক, যে ভাষায় হোক, পুঁথিতে গমের বিষয়ে যা কিছু কথা পাওয়া যায়, পণ্ডিতেরা বসে গেলেন সেগুলোকে টুকে নিয়ে একত্র করতে। নানা যুগের পর্যটকদের ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে তাদের চলাচলের পথের যে সন্ধান পাওয়া গেল, তাই ধরে গমের চিহ্ন খুঁজতে লেগে গেলেন। সব মিলিয়ে গমের যত রকম খবর পাওয়া গেল, তাই এক ভূচিত্রের উপর সাজানো হল; এক এক গড়নের,—গোল, তেকোণা, চৌকো, তারার মতো,—ফুটকি দিয়ে এক এক রকমের গম বোঝানো হল।
কোনো দেশে একটা শস্যের চাষ অনেককাল ধরে চলতে থাকলে, প্রকৃতির নিয়মে সেখানে তার নতুন নতুন জাত উদ্ভব হতে থাকে; ক্রমে সেখানে তার হরেক রকমের নমুনা দাঁড়িয়ে যায়, আমাদের দেশে ধান চালের যেমন হয়েছে।
পরে আদিস্থান থেকে দেশান্তরের যাত্রীরা শস্যের দানা সঙ্গে নেওয়ায় তার প্রচার কী রকম করে হয়, তা তো দেখা গেছে। কিন্তু সব জাতের দানা নেওয়াও হয় না, যা নেওয়া হয় সব মাটিতে পড়েও না, যা পড়ে সব লাগেও না। এর থেকে এই তত্ত্বটুকু উদ্ধার হয়, কোনো শস্যের যেখানে সব চেয়ে রকম বেশি, সেটাই তার আদি স্থান।
গমের ফুটকি চিহ্ন বসানো যে ভূচিত্রের কথা বলা হয়েছে, তাতে দেখা গেল ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম কোণে আফগানিস্থানের এলাকায়, যত রকম ফুটকির ভারি ঠাসাঠাসি। নকশার উপর অন্য যেদিকেই লাইন টানা যায়, তা ধরে চললে ফুটকির রকম কমতে থাকে, দুরে মাত্র দু’এক রকমে গিয়ে ঠেকে। বোঝা গেল কোথায় গমের আদি স্থান,—সব রকম গমের বীজ যোগাড় করতে হলে যেতে হবে সেই আফগানিস্থানে।
এই যুক্তি অনুসারে নানা বীজের আদিস্থান বেরল। ১৯২৪ সালে দলে দলে বিজ্ঞানী খানাতল্লাশে রওনা হলেন এক এক বীজের আদিস্থানে। যাঁরা গম আনতে আফগানিস্থানের দিকে বেরলেন, তাঁদের রোজনামায় দেখা যায় কী অদম্য উৎসাহে অশেষ কষ্ট সহ্য করে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে দিয়ে তাঁদিকে কেমন করে চলতে হয়েছিল।
তৈরি রাস্তা প্রায় কোথাও পাননি, স্রোতার উপর দিয়ে সাঁকো নাই, অনেকস্থলে পা পাতবারই জায়গা পাওয়া যায় না। হিংস্র জন্তুর কম্তি নেই, মানুষ ডাকাতেরও বাড়াবাড়ি। কাজেই অল্পে অল্পে অতি সাবধানে সন্তর্পণে এগোতে হয়েছিল—কোথাও রামচন্দ্রের মতো তড়বড়ে পাহাড়ী প্রপাতের উপর সেতুবন্ধ করে, কোথাও হনুমানের মতো পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে, কিংবা পাহাড়ের গায়ে ঝুলতে ঝুলতে। মাঝে মাঝে ঘোড়া থেকে নামিয়ে বোঝা নিজে বইতে হয়েছে, কতবার জিনিসপত্র খদে গড়িয়ে পড়েছে; এক এক স্থান এমন দুর্গম যে, আধঘণ্টা অন্তর পরামর্শে বসে তবে এক পাহাড় থেকে পরের পাহাড়ে যাবার উপায় হয়েছে।
শেষে এক কাফিরের দেখা পেয়ে, তাকে কিছু বকশিশ কব্লে তাকে পথ দেখাতে রাজি করানো হল। তাও সে এক গ্রামের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে দে-পিট্টান—আর এগোতে সে সাহস পেল না।
পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে গায়ে গায়ে গ্রাম বল নগর বল, যেসব ছোটো ছোটো বসতির মধ্যে বিজ্ঞানীর দল অবশেষে পৌঁছলেন সেগুলি অপরূপ—যেন বহুরূপীর দেশ।
সেখানকার লোকগুলোর কত ছাঁদের চেহারা,—কেউ বা ফরসা কটা চুল-দাড়ি; কেউ বা কাফরীর মতো কালো, চুল কোঁকড়া। আর কত ঢঙের পোশাক,—কারো ফুলো পাজামা, কারো কষা ইজের; কারো গায়ে আলখাল্লা, কারো খাটো কুর্তা, কারো বা পরনে আস্ত ছাগল-ভেড়ার চামড়া। ভাষাও সেই মতো রকমারি,—কেউ সূর্যকে বলছে আফতাব, কেউ য়েল্মার, কেউ বা সূন। কোনো গ্রামের লম্বাই চওড়াই নেই, কেবল খাড়াই, পায়রার খোপের মতো ঘরগুলো পাহাড়ের গা বেয়ে উঠেছে, এক এক ঘর পাহাড়ের মধ্যে এক এক গর্ত, মাথার উপর একটু বারাণ্ডা বার-করা।
এমন আজব দেশ ভুঁই-ফুঁড়ে ওঠেনি,—এ হাল সেকালের গুণ্ডারাজাদের বিজয়কীর্তি। অসুরীয় (Assyrian) যোদ্ধা থেকে আরম্ভ করে সিকন্দর (Alexander) বাদশা, জঙ্গীস খাঁ, অনেকেই ভারতের ধনের লোভে হিন্দুকুশের পথ দিয়ে আনাগোনা করেছে, কত জাতের সৈন্যসামন্ত সঙ্গে নিয়ে। বিজয়ের মজা মারলেন তো কর্তারা, হেজিপেজি দলবলের ক্লেশের একশেষ। তাদের মধ্যে অনেকে ফিরে যাবার যন্ত্রণাভোগ এড়াবার জন্যে পাহাড়ের গুহাগহ্বরের মধ্যে লুকিয়ে রয়ে গিয়েছিল। আর আশপাশের উপত্যকায় যেসব বুনো চাষী, তারাও অনেকে বিদেশী সেনার উৎপাতে পাহাড়ের ভিতর পালিয়ে এসেছিল। বর্বরজাতের যেমন হয়, নতুন কিছু নিতে জানে না: অভ্যস্ত আচারবিচার আঁকড়ে, থাকে,—এরা সবাই সেই রকম থাকল কাছাকাছি, কিন্তু মিশল না, বদলাল না, এগোল না, এখন পর্যন্ত তখনকার নমুনা হয়ে রইল।
পাহাড়ের ধাপে, স্রোতার ধারে ধারে, এদের যেসব ছোটো ছোটো খেত কালো পাথুরে জমির উপর সবুজ-বুটির মতো দেখা দিল, সেগুলি বিজ্ঞানীরা যেরকম অনুমান করে এসেছিলেন, ঠিক তাই—রকম বেরকম গমে ভরা—নরম দানার, কড়কড়ে দানার, গোল দানার, লম্বা দানার, কোনোটায় জল দেওয়া লাগে না, কোনোটা উৎকট শীতে দানা পাকায়। আর সেখানকার হাটবাজারগুলো তো ফলতরকারির প্রদর্শনী বললেও হয়,—এত রকমের কাঁকুড় ফুটি খরমুজ তরমুজ ডালিম বেদানা গাজর শালগম মুলো শাকসবজি,—জংলী থেকে আরম্ভ করে উৎকৃষ্ট জাত পর্যন্ত বাজারে পাশাপাশি রাখায় নিজের নিজের অভিব্যক্তির ধারা দেখিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আশ মিটিয়ে বস্তা বস্তা বীজ সংগ্রহ করলেন।
বিজ্ঞানীর যত দল দেশে দেশে বেরিয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা শেষে যে-যার অহিংস্র-লুঠের ভার নিয়ে স্বস্থানে ফিরে এলেন। আফগানিস্থান থেকে ৭০০০, পশ্চিম এসিয়া থেকে ১০০০০, মধ্য এসিয়া থেকে অগুন্তি, মার্কিনদেশ থেকে আলুর যত জাত আছে, সব মিলিয়ে লাখো রকমের বীজ এসে হাজির; সেগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন মাটি-আব-হাওয়ার প্রদেশে পরীক্ষার জন্যে চারিয়ে দেওয়া হল। যত্ন তদ্বিরের ত্রুটি ছিল না, তবুও পরীক্ষায় পাস হল অল্পই,—যেমন এক জাতের গাছ বরফের তলায়ও বেশ বড়ো বড়ো আলু গজাতে লাগল, মেরুর ধার পর্যন্ত শালগমে কপিতে ছেয়ে গেল, নতুন নতুন গমের জাত এখানে ওখানে লেগে গেল—কিন্তু বেশির ভাগ হল ফেল।
কতক রকমের আয়েবের ওষুধ হতে পারে,—শুখনো মাটিতে জল আনা যায়, লম্বা দিনের অতিরিক্ত আলো ছাউনি দিয়ে কমানো যায়, লম্বা রাতের অন্ধকার বিজলি বাতি দিয়ে ঘুচিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ওষুধের উপর নির্ভর করে জীবনযাত্রা চালানো মুশকিল, তার খরচও বেজায়; উপযুক্ত অভ্যেসের জোরে শরীর রাখতে না শিখলে চলে না। অবশ্য বুড়ো-ধাড়িকে শেখানো যায় না, শিক্ষার ফল পেতে হলে ছাত্রকে কচি-বেলায় হাতে নিতে হয়।
গাছকে শেখাবার বিষয়টা কী—শাস্ত্রে যাকে বলে তিতিক্ষা—তার মানে শীত গর্মি, খিধে তেষ্টা, যখন যা ঘটে, অম্লান বদনে বর্দাস্ত করা। তা শেখাতে হলে গাছের বীজের জন্যে ব্রহ্মচর্যাশ্রম খোলা দরকার,—করা হলও তাই।
আশ্রম স্থাপন হল এক লম্বা চালা ঘরে। তোড়যোড়ের মধ্যে জলের চৌবাচ্চা, বালতি ঝাঁঝরি কোদাল নিড়ানি দাঁড়ি-পাল্লা আর বিশেষ করে তাপমান যন্ত্র; আয়োজনের মধ্যে ইচ্ছেমতো ঘরটাকে ঠাণ্ডা গরম আলো অন্ধকার করার বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম। এই আশ্রমে গমের বীজকে কিভাবে ঠাণ্ডা সওয়ার সাধনা করাল, তার রিপোর্টটা দেখা যাক।
মাটিটাকে কুপিয়ে আলগা করে তাতে এক পত্তন বীজ পোঁতা হল। ঘরটাকে বরফের চেয়ে চার ডিগ্রী ঠাণ্ডা করে রাখা হল। মাটির ঢাকার মধ্যে বীজগুলো গরম হতে না পায় সেজন্যে মাঝেমাঝে মাটি আঁচড়ে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকিয়ে দেওয়া হল। জলের ছিটে দিয়ে দিয়ে বীজকে তাজা রাখা হল। অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় জমে যাবার মতো হলে কাপড় চাপা দেওয়ার ব্যবস্থা হল। এ রকম কৃচ্ছসাধনের পর বসন্তকালে যে বীজের চারা বেরল, সেগুলিকে কিছু উত্তর দেশের কিছু দক্ষিণ দেশের মাঠে রোপণ করে বাইরের সংসারে বার করে দেওয়া হল।
ডান হাত বরফ জলে, বাঁ হাত গরম জলে ডুবিয়ে রেখে দুই হাত সমান জলে দিলে সে জল ডান হাতে গরম, বাঁ হাতে ঠাণ্ডা লাগবে,— তার মানে জীবের বোধশক্তি তাপমান যন্ত্রের মতো কাজ করে না। উত্তর দেশের বসন্তের গোড়ায় রোদের তাপ প্রায় না থাকলেও, বরফী-শীতে পালন-করা গমের চারা সেইটুকুই পর্যাপ্ত বলে মাথায় করে নিল, তাতেই তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠায় বেশি-শীত পড়ার আগেই শীর্ষ ধরে পেকে গেল। বরফ পড়লে কী হবে না হবে সে সমস্যা মিটে গেল, লম্বা রাতের ভাবনাও আর ভাবতে হল না। দক্ষিণেও শীতের সময় জলের অভাব হয়, সেই শুখো পড়ার আগেই সেখানকার গম কাটা সারা। ঠিক ওষুধ পড়লে সে সব দিক দেখে নেয়।
মানুষের বেলায়ও কি ভাই হয় না। যে ছেলে কষ্ট সয়ে মানুষ হয়েছে, সে বড়ো হয়ে অল্পে সন্তুষ্ট থাকে, মজবুত শরীর-মন নিয়ে সংসারে তেড়েফুঁড়ে ওঠে, পাঁচ ইন্দ্রিয়ের দান নিয়ে বেশ আনন্দে থাকতে পারে, বিলাসের খরচ যোগাবার জন্যে শরীর পাত করে তাকে অকালে বুড়িয়ে যেতে হয় না।
তবুও একটা কথা বাকি রইল। দরকারী অভ্যেস কচি বয়সে করাবার কথা বলা হয়েছে। তার চেয়ে বেশি ফল হয় যদি আরো আগে ছাত্রকে ধরতে পারা যায়। বুদ্ধিতে বৃত্তিতে সুশিক্ষিত[১] কনেকে যদি উপযুক্ত বর দেওয়া যায়, ছেলে পেটে থাকতে যদি মাকে সুস্থ সবল প্রফুল্ল রাখা হয়, তাহলে বংশের উন্নতি মারে কে। একথা মানুষ পশু পাখি পোকা গাছ সবেতেই খাটে।
বিধাতার দোহাই দিয়ে নিশ্চেষ্ট থাকা আমাদের দেশে একটা রোগের মধ্যে দাঁড়িয়েছে; এভাবে স্বাধীন চিন্তা দূর করার সঙ্গে সঙ্গে লাভের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তি সুখশান্তি সবেতেই জলাঞ্জলি দেওয়া হয়। করে খেতে না শিখিয়ে মেয়েটাকে বলে অরক্ষণীয়া, শেষে তাকে দেয় যে-সে পাত্রের হাতে ফেলে, তার ভোগ যখন ভুগতে হয় তখন কপাল চাপড়ে বলে “অদৃষ্ট”। বিয়ের পর পুত্রকন্যার প্রবল বন্যা রোখবার চেষ্টা না করে তাদিকে বলে বিধাতার দান; এদিকে বাপের রোজগারে কুলোয় না, মায়ের শরীরে বয় না, কাজেই সন্তানের শিক্ষাদীক্ষা আয়ু সবেরই কম্তি পড়ে যায়। ফলে সংসারটা যেরকম নরক হয়ে দাঁড়ায় তার উপযুক্ত নাম মনে না এলেও, গলা ছেড়ে টেবিল চাপড়ে বলা যেতে পারে যে তার কাছে ছেলে না-হওয়ার পুন্নাম নরক ছেলেখেলা।
USSR-এর ভাব এর ঠিক বিপরীত। পূর্বজন্মের বা দুর্দৈবের উপর দোষ দিয়ে বসে তো তাঁরা থাকেনই না, উলটো নিজের পুরুষকারের জোরে জন্মের পূর্ব থেকে দোষবর্জন গুণবর্ধন কেমন করে করা যায়, সেই চেষ্টাতেই তাঁরা আছেন। তারি কিছু কথা এবার বলা যাক—তাতে আমাদের হাহাকার ঘোচাবার উপায় যদি নাও হয়, তাঁদিকে বাহবা দেবার সুখটা তো পাওয়া যাবে।
কুলশীলের রহস্য
ড্রসোফিলা (Drosophila) নামে কলা-খেকো এক রকম মাছি হয়, বিজ্ঞানীরা তাই পুষতে লেগে গেলেন। রাম! রাম! ও কেমন ধারা? শেষটা মাছি খাবে না কি।
আরে, ব্যস্ত হও কেন, অমন তড়বড় করে সিদ্ধান্তে ঝাঁপিয়ে পড়া ভালো নয়। খাবার জন্যে পাঁঠা পোষে বলে আর কোনো কারণে কিছু পুষতে নেই বুঝি। মাছি পোষার কত সুবিধে একবার ভেবে দেখো। প্রথমত রাখতে বেশি জায়গা লাগে না, লোহার জালের একটা বাক্সে হাজারে ধরে; দ্বিতীয়ত খাইখরচ নেই বললেও হয়, এক পয়সার খোরাকে অনেক দিন চলে; সবের উপর ওরা দশদিন বয়সে ডিম পাড়তে শুরু করে, একমাস না যেতে মাছি হয় দিদিমা।
তাহলে প্রমাণ হল কী, না—
মাছি সহজে বাড়ে
মাছি সস্তায় বাড়ে
মাছি ঝটপট বাড়ে—
আহা, ওকথা এত আড়ম্বর করে নাই বা বোঝালে, মাছি বাড়িয়ে কী হবে সেইটে খুলে বলো দেখি।
তবে বলি শোনো।
মাস্টার মশায়কে যেজন্যে মাইনে দেওয়া মাছিবংশকে সেইজন্যে গ্রাসাচ্ছাদন যোগানো,—উদ্দেশ্য, বিদ্যেলাভ। মাছির মহা ভাগ্যি, মানুষকে ওরা প্রজনন-তত্ত্ব শেখাবার চেয়ার পেয়ে গেছে।
প্রজনন-তত্ত্ব কথাটা যেমন কটো-মটো, বিষয়টাও তেমনি—ভাগ্যিস্ ওর মধ্যে ঢোকার কোনো আবশ্যক নেই। USSR-এর যজ্ঞ-চালানো আমাদের বোঝা নিয়ে বিষয়, তার জন্যে যেটুকু দরকার, তাই সাদা করে ভাবার চেষ্টা করা যাক।
বাপের মতো হাত, কি মায়ের মতো নাক, এ সব সন্তানে পেয়েই থাকে; তবে হাত-ভাঙা বাপের নুলো ছেলে, কি নাক-কাটা মায়ের বোঁচা ছেলে, তা হয় না। আবার সন্তানের এমন গুণ-দোষও দেখা যায়, যা মা-বাপে নেই। এই হের-ফেরের হিসেবটা পেলে তবেই বোঝা যাবে একটা প্রাণীকুলের ভিতর কোনো বিশেষ গুণ আনতে হলে তার কী উপায় করা যায়।
প্রাণীর দেহ কত অগুন্তি, রকম বেরকমের কোষ দিয়ে গড়া; সে দেহ তো মা-বাপের কাছ থেকে সন্তান আস্ত পায় না, পায় শুধু একটি যুগল জননকোষ। জননকোষ বলতে দেহের নিভৃত স্থানে কতকগুলি বিশেষ কোষ, যারা স্ত্রী বা পুরুষের মধ্যে অর্ধাঙ্গ অবস্থায় থাকে। সুযোগ পেয়ে দু’ রকম দুটো জননকোষের মিলন হলে একটি পূর্ণাঙ্গ কোষ হয়ে, সে আলাদা জীবন আরম্ভ করে, পিতৃকুল মাতৃকুল দুই দিক থেকে পাওয়া গুণ অনুসারে নতুন দেহ গড়তে থাকে।
আরো একটু কথা আছে। অশরীরী গুণগুলি সন্তানকোষে চলে আসে না,—সে মা-বাপের জননকোষ থেকে পায় শুধু গুণের কারিগর। জননকোষগুলি নিজেই এত ক্ষুদ্র যে, অণুবীন দিয়ে কষ্টে দেখা যায়। তাদের মধ্যে আবার গুণের জননিকা (genes) যেগুলি আছে, তারা অণুর তুলনায়ও অণু, তারা ধরা পড়েছে মনোবীন দিয়ে, অর্থাৎ যুক্তির জোরে। এই জননিকাগুলির ক্রিয়ায় সন্তানের নতুন দেহ বংশের সনাতন দেহের সাদৃশ্য পায়।
এই জননিকা-সমেত জননকোষগুলি দেহের নিভৃত স্থানে থাকায়, বাইরের আঘাতে দেহের অন্য কোষগুলি জখম হলেও সেখানে সে চোট গিয়ে লাগে না, তাই তার ফল সন্তানে বা বংশের ধারার মধ্যে পৌঁছয় না।
তা যেন হল, কিন্তু অন্তত বংশের যত রকম দোষগুণ, প্রত্যেক সন্তানে তা পায় না কেন। সে কতক বাপের দিক থেকে, কতক মায়ের দিক থেকে বেছে নেয়; মা-বাপে যা দেখা যায় না এমন গুণও পায়,—এ রকম হয় কী করে।
গোড়াকার কথা এই যে, যখনই স্ত্রীদেহে পুরুষদেহে জননকোষগুলি অর্ধাঙ্গ হয়, তখন থেকেই গুণের একটা বাছাই ঘটে, যার দরুন তাদের মধ্যে জননিকার সমান ভাগ-বাঁটোয়ারা হয় না। ঠিক কী রকম করে কী হয় বর্ণনা করার চেষ্টা করতে গেলে আলাদা করে দেহতত্ত্বের পালা গাইতে হয়, তার অবসর তো এখানে নেই। তবে একটা কৌশল করা যেতে পারে।
কথায় বলার চেয়ে অনেক সময় নকশা দেখিয়ে সহজে বোঝানো যায়। তন্ত্রশাস্ত্রে যন্ত্র ব’লে একরকম নকশার সাহায্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তত্ত্ব বোঝাবার প্রণালী আছে। অত বড়ো কথায় কাজ কী, একটা বাড়ি তৈরি করতে হলে কাগজের উপর রেখার ঘর কেটে, এখানে ওখানে চিহ্ন বসিয়ে কী রকম বাড়ি চাই তা রাজমিস্ত্রীকে বেশ বুঝিয়ে দেওয়া যায়,—যদিও মাটির তলায় থাকবে ভিত, উপরে উঠবে দেয়াল, কোথাও লাগবে ইঁট কোথাও কাঠ কোথাও লোহা,—আসলে-নকশায় চেহারার মিল কিছুই থাকবে না।
সেই রকম একটা রূপক দিয়ে বংশধরদের মধ্যে গুণের যাওয়া আসার হেরফের বোঝাবার চেষ্টা করা যেতে পারে; কিন্তু মনে রাখতে হবে, আসলের সঙ্গে রূপকের রূপের মিল থাকবে না, সূক্ষ্ম-খেলা সহজে স্পষ্ট করতে হলে স্কেল বদলে মোটামুটি দেখাতে হবে।
জনন-কোষগুলোকে এক একটা গ্রামের মতো ভাবা যাক, যার মধ্যে গুণের জননিকাগুলি যেন তাঁতি ছুতোর কামার কুমোর কাঁসারি, পাঁচ রকমের কারিগর। তার পর মনে করা যাক, কতৃপক্ষের একটা নুতন গ্রাম পত্তন করার ইচ্ছে হয়েছে।
হুকুম জারি হল—“ক, খ, এই দুই গ্রাম থেকে পাঁচ রকমের পাঁচ জন করে, মোট দশ জন কারিগর সদরে পাঠানো হোক, তার মধ্যে থেকে পাঁচজন বাজাই করে গ-গ্রামে বসানো হবে।”
এই পাঁচ জোড়া কারিগর জড় হলে তাদিকে একটা অন্ধকার ঘরে পোরা হল, যার দরজা কোন্দিকে তারা কেউ জানে না হাতড়াহাতড়ি করে দরজা পেয়ে সেখান থেকে প্রথমে যে পাঁচজন বেরিয়ে এল, তারা যে যার বাড়ি ফিরে গেল। যে পাঁচজন পিছিয়ে থেকে আটক পড়ে গেল, তাদিকে পাঠানো হল গ-গ্রামে বাস করতে।
এই যে অন্ধকারে টিল-মারা গোছের কারিগর বাছাই, নতুন গ্রাম সম্পর্কে এর ফলাফল একটু ভেবে দেখা যাক।
প্রথমেই তো বোঝা যাচ্ছে যে, গ-গ্রামে পাঁচজন গেল বটে, কিন্তু তারা পাঁচরকমের কারিগর নাও হতে পারে। অন্ধকারে ঠেলাঠেলির পর হয়তে ক-খ-গ্রামের দুই তাঁতি নতুন গ্রামে যাবার দলে ধরা পড়ল, দুই কামারই ছাড়া পেয়ে নিজের গ্রামে ফিরে গেল। গুনতিতে ঠিক রইল, রকমে হল বেশ কম। সে অবস্থায় প্রথম ফল এই দেখা যাবে যে, গ-গ্রামে তাঁতের কাজ চলবে জোরে, কিন্তু সে গ্রামের লোককে লোহার জিনিস বাইরে থেকে কিনে আনতে হবে।
আবার ধরে, ক-গ্রামের তাঁতি বোনে শুধু মোট ধুতি, খ-গ্রামের তাঁতি ফুল-পেড়ে শাড়ি বুনতে জানে; অথচ গ-গ্রামে তাঁতের সরঞ্জাম মোটে একপ্রস্থ। নতুন গ্রামে ফুলপেড়ে শাড়ি কজ’নেই বা কিনতে পারবে, মোটা ধুতির বেশি কাটতির আশা দেখে দুজনে মিলে ঐ কাজেই লেগে গেল। তবুও খ-গ্রামের সে তাঁতি থাকায়, গ-গ্রামে ফুলপাড় বোনার বিদ্যেটা চাপা থাকলেও মারা পড়ল না। যা হোক, দ্বিতীয় ফল এই দেখা যাবে যে, গ-গ্রামে মোটা ধুতির কারবার জেঁকে উঠল।
তৃতীয় ফল প্রকাশ পেতে পারে যখন ঙ-গ্রাম পত্তনের বেলা গ-ঘ-গ্রামের উপর কারিগর জোগাবার ভার পড়বে। গ্রামের তাঁতি হয়তো গামছা ছাড়া কিছুই বুনতে পারে না, অথচ বাছাইয়ের গোলমালে সে নতুন গ্রামে গেলই না, সেখানে পৌঁছল একা ফুলপাড়-বোনা তাঁতি। তাতে ঙ-গ্রাম হঠাৎ হয়ে উঠবে ফুলপেড়ে শাড়ির মোকাম। সাধারণ লোকে তাজ্জব হয়ে বলাবলি করতে পারে—“মোটা ধুতি গ্রামের আর গামছা-বোনা গ্রামের কারিগররা বসল ঙ-গ্রামে,—সেখানে ফুলপাড় তৈরির বিদ্যেটা এল কোত্থেকে?” গ্রামপত্তনের ইতিহাস যে গোড়া-থেকে জানে সেই এ রহস্য ভেদ করে দিতে পারবে।
এমনও হতে পারত যে ঙ-গ্রামে গ-ঘ গ্রাম থেকে দুরকমেরই তাঁতি পৌঁছল। সে অবস্থায় গামছায় খাটুনি কম কাটতি বেশি—বিজ্ঞানের ভাষায় এ গুণ ডমিন্যাণ্ট (dominant) হওয়ায় ফুলপাড়ের বিদ্যেটা আবার চাপা পড়ল—বিজ্ঞানের ভাষায় রিসেসিভ (recessive) হল কিন্তু তবুও মরল না। তাহলে হয়তো এ রকম ভাবে চাপা পড়তে পড়তে চ ছ জ-ঝ-গ্রাম পেরিয়ে ঞ-গ্রাম পত্তনের সময় ‘ফুলপাড়বোনা তাঁতি নিজের বিদ্যে জাহির করার সুবিধে পেল। ততদিন পর এই ফুলপাড়-ধারার গোড়া খুঁজে বার করতে ঐতিহাসিকেরও ধাঁধা না লেগে যায় না।
এই রূপক আরো খেলিয়ে চললে, অনেক রকমের হেরফেরের অন্ধিসন্ধি পাওয়া যেতে পারে। আপাতত যেটুকু বলা হল, তাতেই আমাদের এ পালার কাজ চলবে।
জটিলতা কমাবার জন্যে আমাদের এই রূপকে মাত্র পাঁচ রকম কারিগরের কথা বলা হয়েছে। আসলে মানবদেহে বিশ-পঁচিশটা আলাদা রকমের জননিকা ক্রিয়া করতে থাকে, তার দরুন ফলাফলও খুব ঘোরালো হয়। এমনও দেখা যায়, মা বুদ্ধিমতী, বাপও ধীরস্থির, অথচ মা বা বাপ কারো ছিটগ্রস্ত পিতামহ বা মাতামহের একটি জননিকা বংশপরম্পরার ভিতর দিয়ে ঘুরে ফিরে এসে পড়ায়, এদের এক ছেলে হল পাগল। আবার বাপ সাদাসিধে, মা পাঁচপেঁচী, অথচ বংশের দুই দুই ফ্যাঁকড়া ধরে নানা গুণ দৈবাৎ এক দেহে জুটে পড়ায়, ছেলে হল মহাপুরুষ।
পূর্বপুরুষদের গুণাগুণ খোঁজ করে বার করা যায়, বংশধরদের গুণাগুণ তো দেখতেই পাওয়া যায়, মাঝপথের গুণ বাছাবাছি ব্যাপার ঠিকমতো জানা নেই বলে আমাদের নকশায় অন্ধকার ঘরের কথা বলা হয়েছে। কোন্ ঘটনার পর কোন্ ঘটনা হয় জানা থাকলে বলা হয় নিয়মে চলছে; নিয়ম না জানা থাকলে বলে দৈবাৎ ঘটেছে। সৃষ্টির প্রকরণ সম্বন্ধে মানুষের বিদ্যে যত বাড়ছে, ততই জগৎপ্রবাহ দৈবের রাজ্য থেকে নিয়মের এলাকায় এসে পড়ছে।
কুলের মধ্যে শীলের লুকোচুরি খেলাটা মাঝে মাঝে অন্ধকারের আড়ালে হতে থাকলেও, তার যতটুকু জানতে পারা গেছে তা দিয়ে জাত বদলের কাজ মোটামুটি চালানো যায়। ফরশা বর কনে ক্রমাগত মিলিয়ে চললে ফরশা পরিবার দাঁড়িয়ে যাবে—সে কথা সবাই জানে। লাল গোরুতে সাদা গোরুতে জোড় মেলাতে থাকলে পর পর কতকগুলি লাল, কতকগুলি সাদা, কতকগুলি মাঝামাঝি রঙের বাচ্ছা হবে, তাও গুণে বলার প্রণালী বিজ্ঞানীরা বার করেছেন। পাহাড়ী শক্ত নাশপাতির সঙ্গে নিচের রসালো ক্ষীণজীবী নাশপাতি মিলিয়ে মজবুত অথচ সুস্বাদ নাশপাতির জাত তৈরি হয়েছে। আবার কখনো বা উলটো উৎপত্তিও হয়ে পড়ে; তলায় মুলো উপরে কপি হবে আশায় দুই গাছ মেলাতে গিয়ে শিকড় হল কপির মতো, পাতা হল মুলোর।
গাছের পুংকোষ থাকে ফুলের রেণুর মধ্যে, স্ত্রীকোষ থাকে ফুলের তলায় একটা বিশেষ আধারে। স্বাভাবিক অবস্থায় রেণু চালাচালির কাজ মৌমাছিতে বা অন্য পোকায় করে, তারা মধুর ঘটক-বিদায় পায়। মানুষের ইচ্ছেমতো জোড় মেলাতে হলে, তুলি দিয়ে রেণু তুলে নিয়ে স্ত্রীকোষের আধারে দিয়ে দিতে হয়।
আমাদের দেশের সেকেলে ঘটকেরা পাত্রপাত্রীর লক্ষণ মিলিয়ে, বিয়ে দেবার উপযুক্ত কিনা ঠিক করে দিত। আজকাল গাছের ওস্তাদেরাও গাছের আবশ্যকমতো জাত তৈরি করার উদ্দেশ্যে লক্ষণ দেখে গাছের জোড় মেলায়। বিদায় হবার পর ঘটকের ভুল ধরা পড়লে সে থোড়াই কেয়ার করত, কিন্তু গাছের ওস্তাদ ফলোদয় না হওয়া পর্যন্ত কাজে লেগে থাকে। ভুলের পর ভুল হলেও সে দমে না, বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এ-গাছ ও-গাছ সে-গাছ মিলিয়ে যা চায় তা পাবার চেষ্টা ছাড়ে না। দোষের মধ্যে এতে বড্ড সময় লাগে। বৎসরান্তে যতক্ষণ আবার ফুল না ফোটে, নতুন পরীক্ষায় হাতই দিতে পারা যায় না।
জননকোষ বা তার ভিতরের জননিকার উপর বাইরের ঘটনার প্রভাব যে একেবারেই পৌঁছয় না, তাদের কোনো রকমেরই পরিবর্তন হয় না, তা তো নয়। মানুষ ও-বিষয়ে হাত লাগাবার আগেই প্রকৃতির মামুলী-নিয়মেই কত নতুন নতুন উন্মেষ প্রকাশ পেয়েছে। নইলে আদি পক্ষীজোড়ার বংশধরদের মধ্যে রাজহংসই বা ধবধবে সাদা, ময়ূরই বা রং-বেরঙে চিত্রিত হল কেমন করে। এ পর্যন্ত প্রাণীদের জাত বদলানো সম্বন্ধে তো প্রকৃতিরই অপেক্ষা করে চলতে হয়েছে। দৈবাৎ কোনো সুবিধেজনক নতুন গুণ জন্মাতে দেখলে তবেই তাকে জাতের মধ্যে কায়েম করার তদ্বির করা হয়েছে,—যেমন এক মেষপাল একটি খাটো পায়ের বিকৃত বাচ্ছা পেয়ে তাই দিয়ে বেঁটে ভেড়ার জাত গড়ে তুলল, যারা বেড়া টপকে পালাতে না পারায় তাদিকে বেশ সহজে আগলে রাখা যায়। তবে প্রকৃতিকে নিজের চালে চলতে দিলে এক আধটা নতুন গুণ জাতের মধ্যে বসে যেতে, অভিব্যক্তির পথে জাতের দু এক পা এগোতে, যুগের পর যুগ কেটে যায়।
সংস্কার আঁকড়ে থাকা সম্বন্ধে জননিকাগুলো হিন্দুমানুষকেও হার মানায়। কোনো বিজ্ঞানী একজোড়া বাবুই পাখি খাঁচার মধ্যে পুষেছিলেন। স্বাভাবিক অবস্থায় তারা যদিও পোকা খায়, তিনি তাদের জন্যে ছাতু খাবার ব্যবস্থা করেছিলেন আর ঘাসের বোনা বাসার বদলে টিনের কৌটোর মধ্যে তাদের থাকার জায়গা দিয়েছিলেন। তাতেই তারা বেশ রইল, জোড় বাঁধল, ডিম পাড়ল, বাচ্ছা হল। সে বাচ্ছারা ঐভাবেই বড়ো হল, তাদেরও খাঁচার মধ্যে বাচ্ছা হল। কাজেই এসব বাচ্ছারা পোকা ধরে খাওয়া, ঘাস বুনে বাসা বাঁধা কিছুই শিখতে পেল না। কিন্তু সেই বাচ্ছার বাচ্ছাকে যখন খাঁচার বাইরে ছেড়ে দেওয়া হল, তারা প্রথম থেকে ইতস্তত না করেই পোকা ধরে খেতে লাগল, ঘাস কুড়িয়ে বাসা বাঁধতে লেগে গেল,—যেমন-তেমন বাসা নয় ঠিক সেই বোতল গড়নের। জননিকাদের মধ্যে পূর্বস্মৃতি বা সংস্কার (নাম যাই দাও) অটুট ছিল বলেই তো খাঁচায় মানুষ সে-বাচ্ছাদের পক্ষে এসব করা সম্ভব হল।
মানবজাতি ডেপুটি-স্রষ্টার পদ পাবার পর, পরিবর্তনের কাজ কতকটা তাড়াতাড়ি এগিয়েছে বটে। খরগোশের মতো জীব অশ্ব হয়ে উঠল; মানুষের শত্রু যে নেকড়ে, সে মানুষের মিত্র কুকুর বনে কত রকম জাতের বাহার দেখাল; ঘাসের বিচি গমে ধানে গুলজার হল। তবু এসব হতে সময় নিয়েছে কম নয়; কারণ এ পর্যন্ত জননকোষের উপর আক্রমণ, তাদিকে একটু প্রগতিপরায়ণ করার চেষ্টা,—তার উপায় জানাও ছিল না, করাও হয়নি।
সেইজন্যে দশ দিন বয়সে যে মাছি বংশবৃদ্ধি করে, তাদের উপর বিজ্ঞানীদের এত ঝোঁক। কী উপায়ে জাতের মধ্যে বিশেষ গুণ আনতে বা তা থেকে দোষ ছাড়াতে পারা যায়, তার হিসেব পাবার জন্যে এই Drosophila মাছিদের নিয়ে বছরে ছত্রিশবার নাড়াচাড়া করা চলে। মাছিদের স্বচ্ছ নরম দেহ, উপরে কিরণ ফেললে ভিতর পর্যন্ত তার তেজ প্রবেশ করে, শরীরের যে-কোনো জায়গায় তেজী আরক ফুঁড়ে দেওয়া সহজ। কোনো কোনো অঙ্গচ্ছেদ করলেও তাদের প্লাণের হানি হয় না।
এখন মাছির উপর X-কিরণ ফেলে বিজ্ঞানীরা তাদের জননিকাকে উত্তেজিত ক’রে তাদের কত রকম চেহারার অদল-বদল করাচ্ছেন—খাটো ডানা, লম্বা ডানা, সাদা চোখ লাল চোখ, আড়া খুদে বা তেধেড়েঙ্গা; কেউ আলোর দিকে ওড়ে, কেউ আলো দেখ্লে পালায়, গুণেরও কত রকম ওলট পালট।
তবে, উপযুক্ত রকম কিরণ বা আরক লাগাতে পারলে, কলার বহরের চালের দানা, কুমড়োর মাপের আলু, একবেলার খোরাক যোগাবার মতো এক একটা আম, এ সবই বা তৈরি হবে না কেন।
মামলার নিষ্পত্তি না হতেই তা নিয়ে মন্তব্য প্রকাশ অপরাধের মধ্যে গণ্য। গাছে কাঁঠাল থাকতে গোঁফে তেল দিলে সেটা অপবাদের কারণ হয়ে থাকে। এই নজির অনুসারে প্রজনন-পরীক্ষা আর একটু না এগোলে ভাবী ফলাফলের সুখস্বপ্ন দেখে জিভে জল না আনাই সমীচীন।
তাই বলে মানুষের হিতৈষী বিজ্ঞানীদের সফলতা কামনায় দোষ নেই। তবে কিনা, USSR-কী জয়। হাঁকার আগে আরো একটু বিবেচনা করা লাগবে।
ঈশাসংকট
খ্রীস্টান সাধক বলেন, প্রেমের কারণে পিতৃস্বরূপ পরমেশ্বর সৃষ্টির মধ্যে বহু হলেন,—শুধু তা নয়, এমনি আত্মহারা হলেন যে, জগতে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না, বিজ্ঞান দিয়ে তাঁকে ধরা-ছোঁয়ার চেষ্টা বৃথা। প্রেমের জোরে নিজের মধ্যে পরমাত্মাকে উপলব্ধি করলে তবে মাতৃরূপা জীবাত্মা পুত্র-ভগবানকে নবজন্ম দেন।
আমাদের ঋষি আর এক ভাবে বলেছেন, জগতের মধ্যে যত জগৎ, ঈশা সে সব ছেয়ে আছেন।
সৃষ্টি হল প্রবাহের মধ্যে প্রবাহ। যেটুকু আমাদের গোচরে আছে তাতেই দেখতে পাই,বিশ্বের মস্ত বড়ো ইতিহাসের মধ্যে সৌরজগতের অভিব্যক্তি, তার ভিতর এই পৃথিবীর অভ্যুদয়, পৃথিবীর উপর নানা প্রাণীর জীবনধারা, এক এক জাতের প্রাণীর মধ্যে কত ব্যক্তি, ব্যক্তির মধ্যে কত কোষ, কোষের মধ্যে নতুন ব্যক্তির জননিকা। জড়পদার্থও ক্রমশই নিরেট বস্তুর কোঠা ছেড়ে প্রবাহের দলে এসে পড়েছে।
কোনো না কোনো ঈশার প্রভাবে তো এই সব প্রবাহগুলি যে-যার নিয়মে চলে, কিন্তু পরমেশ্বরকে সত্যিই তো তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। আলাদা প্রবাহের চালকও যেন আলাদা,—সব সময় তাদের এক মতি থাকে না, অন্তত তাদের-চালানো প্রবাহগুলির এক গতি ঘটে না, বিরোধ বাধে, একের গড়া অন্যে ভাঙে।
প্রকৃতির অম্বিকা-মূর্তির যে সামঞ্জস্য—যাকে বিজ্ঞানীরা ব্যাল্যান্স অব নেচার (Balance of Nature) বলেন—তার বাইরের পরিপাটী ঠাট শান্তির ছবি, অথচ তার তলে তলে করালীর রণরঙ্গ; বাঁচার জায়গা, বাঁচার সুযোগ, বাঁচার উপায় নিয়ে ছোটো বড়ো প্রাণীদলের হরদম ভীষণ রেষারেষি চলেছে; গোছগাছ নেই তা নয়, কিন্তু ফেলাছড়াও বিস্তর। পরস্পর সাহায্যের মাধুর্য, নিষ্ঠুর খাওয়াখাওয়ির কদর্যতা পাশাপাশি পাওয়া যায়।
এই অবস্থার কথা ভাবলে, “যা করেন ভগবান,” এই বাঁধি বুলিতে সায় দিতে মন সরে না। ভগবান গর্তে ফেলেন আবার সেই গর্ত থেকে তোলেন; বাঘ দিয়ে মানুষ খাওয়ান, মানুষের বন্দুকে বাঘ মারান; যাকে দুষ্ট বুদ্ধি জোগান তাকেই দুষ্ট কাজের সাজা দেন,—এ ভাবে কথা কইলে কোনো তত্ত্বের সন্ধান তো মেলেই না, মাঝে থেকে ভগবান নামের গাম্ভীর্য নষ্ট হয়।
জড়ের বাধাবিঘ্নের মধ্যে দিয়ে প্রজ্ঞাশক্তি, নিজের ক্রমবিকাশের পথ খুঁজে ফিরছে, ভুল পথে বার বার কিছুদূর চলে আবার পালটে নতুন পথ ধরতে হচ্ছে,—চেহারাটা সেইরকম লাগে। কোথায় যাবার পথ? বহু থেকে আবার একে পৌঁছবার নাকি? এই চেষ্টাই যেন প্রকৃতির লীলা।
মাঝপথে নানা খণ্ড-ঈশার আঁকুবাঁকু দেখে পরম মহেশ্বরের চরম অভিপ্রায় সম্বন্ধে কোনো তত্ত্ব সাব্যস্ত করে বসার ঝোঁক চাপলে, সারধান থাকা উচিত। জ্ঞানের নিচুস্তরে থাকতে উঁচু রকমের প্রশ্ন তুললে, সদুত্তর পেলেও অনেক সময় তার মানে করা যায় না। এক ইংরেজ বিজ্ঞানী এর একটা মজার উদাহরণ দিয়েছেন।
মনে করো, এক অঙ্কনবীশ আলোর গতি গুনতে শিখেছে, কিন্তু জ্যোতিষ্কের হালচাল পর্যন্ত তার বিদ্যের দৌড় নয়। একদিন, সামনের বনের উপর এক রামধনু দেখে, তার গুনে বার করার শখ হল, ঐ পাঁচরঙা আলো কতদুর থেকে আসছে। নিয়মমতো অঙ্ক পেতে উত্তর বেরল—‘৯,৩০,০,০০০’ মাইল। অঙ্কনবীশ বার বার পরখ করে মাথা চুলকে ভাবতে লাগল, “তাইতো, কষার ভুল পাচ্ছিনে, অথচ গণনার একি অদ্ভুত ফল।” সামনের বনটা তো মাইল কতকের বেশি দূর হতেই পারে না। তার ধাঁধা লাগা দেখে এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী বন্ধু আশ্বাস দিলেন—“ওহে, উত্তর ভালোই পেয়েছ। রামধনু যাকে বলে সে তো মেঘ থেকে ঠিকরে-আসা সূর্যকিরণ বই অন্য কিছু নয়। ওর দিকে মুখ করলে সূর্য থাকে পিছনে, সেই কথা বিপরীতের মাইনাস্ চিহ্ন (—) জানিয়ে দিচ্ছে। আর সূর্য ৯, ৩০, ০০, ০০০ মাইল দূরে তো বটেই।”
আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা হিমসিম খেলেও, যন্ত্রের সাহায্যে বুদ্ধি খাটিয়ে যা পান, তার বর্ণনা করায় তাঁরা এমন পোক্ত যে, যার ইচ্ছে সে যাচিয়ে নিতে পারে। তাই রকমারি ঈশার চেহারা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একবার দেখে নেওয়া যাক, পরে তত্ত্বজ্ঞান উদয় হলে সমন্বয়ের উপায় বেরিয়ে পড়তে পারে। শিক্ষানবীশকে এইটুকু সতর্ক করে দেওয়া দরকার, উপলব্ধি হবার আগেই বড়ো বড়ো জ্ঞানের কথা আওড়ালে চৈতন্য জাগার সাহায্য হয় না, উলটে তাকে ভুলিয়ে অসাড় করে রাখা হয়।
পুরাকালে, যখন পৃথিবী সবে সূর্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে প্রচণ্ডতাপে বাষ্পময় ছিল, তখনকার অবস্থায় আমরা এখন যাকে প্রাণের ক্রিয়া বলি, তার উপায় ছিল না। কালক্রমে ঠাণ্ডা হবার পর যখন জীবনরূপী জলের কতক অংশ তরল হয়ে আকাশ থেকে নেমে এসে মাটির খাঁজেখন্দে বসে গেল, তার মধ্যে প্রাণীকণা উদ্ভাবন হয়ে ভেসে বেড়াতে লাগল। এই প্রাণ জিনিসটায় ঈশার প্রকাশ প্রথম ফুটে ওঠে, যার দরুন জড়ের নিরুদ্দেশ গতির মধ্যে একটা মতি দেখা দেয়।
প্রাণশক্তির মতি অনুসারে দৈবাৎ এক আধটা নয়, দল-কে-দল প্রাণবিন্দুরা দেহ গড়তে লেগে গেল। প্রাণকোষটা ভাঁজ হয়ে পেটের খোঁদল হল, আগা পাকিয়ে ন্যাজ বেরল, ন্যাজের ঝাপটায় উদর পূরণের চেষ্টায় ঘুরে বেড়াবার সুযোগ পেল। খেয়ে দেয়ে দেহ বেশি বেড়ে গেলে দু’টুকরো হয়ে বংশবৃদ্ধি হতে লাগল, ক্রমে যুগলমিলনের কৌশল বেরিয়ে, সন্তানের মধ্যে বৈচিত্র্য এসে উন্নতির পথ খুলে গেল।
প্রাণশক্তির কথা না এনে ফেললে চলে না। যে খাবার সামনে নেই, যে ভাবী উন্নতি আগে থাকতে কল্পনায় আসতে পারে না, তার খোঁজে প্রাণীকণাকে পাঠালে কে।—যদি বল ভিতরকার অন্ধ সংস্কারের এই কাজ, তবে প্রশ্ন ওঠে গোড়ায় সে সংস্কার এল কোত্থেকে। যদি বল এক ঈশায় সবই করাচ্ছেন, তাহলে প্রাণীতে জড়ে, প্রাণীতে প্রাণীতে কাটাকাটি মারামারির হিসেব পাওয়া যায় না। কাজেই আপাতত প্রাণশক্তি ব’লে কোনো খণ্ড-ঈশার প্রভাবে প্রাণক্রিয়া চলে, তাই ধরতে হয়।
আবার দেখো, প্রবাহের মধ্যে যেমন প্রবাহ, ঈশার উপর তেমনি ঈশা। প্রাণীকণার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রাণশক্তির উপর জৈবিক শক্তির আবির্ভাব হয়, তার প্রভাবে প্রাণীকণাদের মধ্যে সমবেত হয়ে বড়ো কলেবর ধারণ করার চেষ্টা দেখা যায়।
প্রথম দিকে জীব দেহ-ধারণের চেষ্টার এক দৃষ্টান্ত স্পঞ্জ জাতি, যে স্পঞ্জের সমাজদেহের খোলসকে ইংরেজরা গামছার মতো ব্যবহার করে। এই ফোঁপরা-ছিবড়ের মতো জিনিসটা সমুদ্রতলার একজাতের প্রাণীকণা সমবায়ের তৈরি বাস-পল্লী। সুড়ঙ্গের মতো যে সব গর্ত ওর মধ্যে দেখা যায়, তারি ধারে ধারে মাথা গুঁজে ন্যাজের দিক ফাঁকায় রেখে, প্রাণীকণারা স্থাবর হয়ে থাকে,—ভিটে কামড়ে যেমন পাড়াগেঁয়ে মানুষ থাকতে চায়, তার চেয়েও কায়েম হয়ে। এ অবস্থায় তারা আলাদা হয়ে খাবার খোঁজে বেড়াতে পারে না, কিন্তু সবাই মিলে একতালে ন্যাজ নেড়ে তারা এই সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে জলের স্রোত চালাতে থাকে। জীবদেহে রসরক্ত চলাচলের আভাস এখানে পাওয়া যায়। স্রোতের সঙ্গে যা-কিছু পুষ্টিকর জিনিস ভেসে আসে, যে-যার জায়গায় আটকে থাকলেও তার ভাগ সকলে পায়।
এই যে মিলেমিশে সমুদ্রের মধ্যেকার মালমসলা জুটিয়ে সুরঙ্গময় বাসস্থান তৈরি করা, একসঙ্গে তালে তালে ন্যাজ নাড়া, প্রত্যেকের আলাদা প্রাণশক্তি সকলকে ঠিক একভাবে এসব কেমন করে শেখাতে পারে। তাই আবার প্রাণীদলের উপরকার জৈবিক শক্তির প্রভাব মানতে হয়।
স্পঞ্জের মতো ঢিলে-ঢালা সমবায় দিয়ে আরম্ভ করে, প্রাণীকণারা এক একদল বর্ণভেদ কর্মভেদ স্বীকার করে নানা অঙ্গবিশিষ্ট আঁটসাঁট জীবদেহ গড়তে শিখে উঠল। সেই সঙ্গে দলাদলির সূত্রপাত হল, খাদ্যখাদক সম্বন্ধ উৎকট হয়ে উঠল।
ঢেউয়ের আধার সমুদ্রকে আমরা ‘এক’ বলি, কিন্তু ঢেউগুলি একটি আর একটিকে কখনো বাড়ায়, কখনো চাপা দেয়, ঠোকাঠুকি লাগলে দুটোই ভেঙে পড়ে, তাই দেখে তাদিকে ‘আলাদা’ বলি। আবার এরোপ্লেন থেকে সমুদ্রে-ঢেউয়ে একাকার মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। তেমনি উদারদৃষ্টিতে বডো ঈশার সঙ্গে ছোটো ছোটো ঈশার যোগাযোগ ধরা পড়তে পারে। সেই আশায় খণ্ডশক্তিগুলোর ক্রিয়াকলাপ আরো ভালো করে বোঝার চেষ্টা করা যাক।
একদল প্রাণীকণা সূর্যকিরণের তেজ শরীরের মধ্যে আটকে নিয়ে তার সাহায্যে সোজাসুজি জড়কণা দিয়ে প্রাণের ক্রিয়া চালাবার উপায় পেয়ে গেল। এরা উদ্ভিদশ্রেণীতে ফলাও হল। আর যে প্রাণীকণার দল তা করতে পারল না, তারা উদ্ভিদ খেয়ে তাদের তৈরি কোষ দিয়ে প্রাণক্রিয়া চালিয়ে নানা শাখার উদ্ভিদ-খেকো শ্রেণী বার করল।
গোড়ায় গোড়ায় উদ্ভিদজাত সবই শেওলার মতো নরম ছিল, তখন তারা জলের তলায় বা ধারে শিকড় গাড়ত। ক্রমে তাদের কোনো কোনো দল শক্ত ছালের ঢাকা বানিয়ে, তার ভিতরে নিরাপদে রস চলাচলের ব্যবস্থা রেখে, ডাঙায় উঠে পড়ল, শেষে বিচি ছড়াবার নানা ফন্দি বার ক’রে পাহাড়ের মাথায় পর্যন্ত চড়ে গেল। উদ্ভিদ-খেকোরাও গায়ে শক্ত চামড়া মুড়ে ওদের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী ছেয়ে ফেলল। এদের মোটামুটি দুই শাখা,—পোকার মতো যাদের নরম দেহ, আর হাড়ের কাঠামো থাকায় যাদের দেহ শক্ত। এদের মধ্যে কোনো কোনো প্রশাখা আরো সোজায় পুষ্টি আদায় করার চেষ্টায়, উদ্ভিদ খাওয়া ছেড়ে স্বশ্রেণীর পশুপাখি মাছপোকা খেতে লাগল।
তবু, এত রকমের খাওয়া-খাওয়ি সত্ত্বেও জন্তুতে পাখিতে গাছে পোকায় পরস্পর সাহায্যেরও কিছু কিছু সম্বন্ধ রয়ে গেল, তার কিছু আভাস আমরা আগে পেয়েছি।
এতেও ঈশার বৈজ্ঞানিক পরিচয়ের শেষ নয়। জৈবিক শক্তি যেমন নানা রকম প্রাণীকণার সমবায় বেঁধে জীবদেহ তৈরি করে চালায়, তেমনি আরো উপরকার এক শক্তি, যাকে সংঘশক্তি বলা যেতে পারে, সে জীবদের মধ্যে গুণকর্ম বিভাগ করে সমাজের মতো আরো বড়ো কলেবর রচনা করায়। এই সংঘশক্তির ক্রিয়াকলাপ অল্পের মধ্যে বুঝতে হলে পোকার ছোটো ছোটো সমাজের উপর নজর করলে সুবিধে হবে।
সমাজ-বাঁধা পোকার মধ্যে উই, মৌমাছি, পিঁপড়ে, এরাই প্রসিদ্ধ।
একদল প্রাণকোষে মিলে যেমন এক একটি উইপোকা গড়েছে, তেমনি একদল উইপোকা মিলে মাটির ছাল-ঢাকা সমাজ-কলেবর রচেছে, যাকে বলে উইঢিবি। সেই ঢিবি-গারদের অন্ধকারে নিজত্বহারা উইপোকারা যে রকমের জীবন কাটায়, তাতে ওদের সংঘশক্তিকে তামসিক বলতে হয়।
জন্তুর চামড়া কেটে গেলে যেমন জৈবিক শক্তির হুকুমে রসরক্তের দৌড়োদৌড়ির চোটে জায়গাটা ফুলে ওঠে, রক্ত জমাট বেঁধে বাইরের খারাপ জিনিস কিছু ঢুকতে দেয় না, ভিতরে নানা কোষের ক্রিয়ায় নতুন চামড়া তৈরি হয়, তেমনি উইঢিবির মাটির ছাল কোথাও ভেঙে গেলে, সেখানে লাল সাদা দু’রকমের উইপোকা ছুটে আসে, লালগুলি বাইরের পোকামাকড় ঠেকিয়ে রাখে, সাদাগুলি ভিজে এঁটেল মাটির ছোটো ছোটো ডেলা এনে ছাল মেরামতে লেগে যায়
এখানেই সংঘশক্তি নিজেকে জানান দেয়। ভাঙা মাটির ফাঁকের দু’দিক থেকে জোড়ার কাজ চলে, শেষে ঠিক এক থামালে জোড় মিলে যায়। তবে কি এই চোখ-কান হীন সামান্য পোকারা নিজের মধ্যে এরকম জটিল কাজের বিষয়ে পরামর্শ করতে পারে। এক বিজ্ঞানী সে কথা পরীক্ষা করার জন্যে একটা ঢিবিকে করাত দিয়ে এ-পার ও-পার ফেড়ে কাটার ফাঁক দিয়ে উপর থেকে নিচে পর্যন্ত একটা টিনের চাদর চালিয়ে দিলেন, যার মধ্যে দিয়ে একদিক থেকে অন্যদিকে কোনো রকম আদানপ্রদান চলতে পারে না। তবু দেখা গেল উইকর্মীরা দুদিক থেকে মেরামতের কাজ আরম্ভ করে ঠিক এক থামালে টিনের দুপাশে ফাঁকটা জুড়ে দিলে। কোনো উপরের সংঘশক্তির নির্দেশ ছাড়া এমন তো হয় না।
এই সংঘশক্তির প্রভাবে উইটিবির জীবনযাত্রার যত রকম কাজ চলে—মাটির তৈরি সুড়ঙ্গ বেয়ে লিঙ্গহীন কর্মীদের কাঠের সন্ধানে বেরনো, কাঠের গুঁড়ো কেটে এনে গরম স্যাঁৎসেতে গুদমে পুরে, ছাতা ধরিয়ে তাকে হজম করানো, সেই তৈরি “ফুড” খাইয়ে ডিম ফোটা বাচ্ছাদিকে বড়ো করা, উপরের মাটি শুকিয়ে গেলে জলের কাছ পর্যন্ত নেমে গিয়ে ভিজে মাটি তুলে আনা, আরো কত কী।
জন্তুর মাথা কাটা গেলে যেমন তার শরীরের যত রকমের কোষ সব নির্জীব হয়ে মারা যায়, তেমনি উইপোকাদের সংঘশক্তি ওদের মাতৃস্থানীয় একটি বিশেষ স্ত্রীপোকার মধ্যে দিয়ে কাজ করে। সেটি পেটসর্বস্ব একটি ডিমপাড়া যন্ত্র বললেও হয়, ঢিবির নিভৃত স্থানে একটি আলাদা ঘরে বন্ধ থেকে সে জীবন-ভর ডিমই পাড়ে। বাচ্ছাদের মতো তাকেও কর্মীরা খাওয়ায়, সেবা করে। তাকে যদি মেরে বা সরিয়ে ফেলা হয়, তাহলে উইপোকাদের নিত্যকর্ম বন্ধ হয়ে যায়, তারা একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে, ঢিবির আয়ু শেষ হয়ে যায়।
ঢিবির বংশবৃদ্ধি উপলক্ষ্যে পোকাদের বৎসরে একবার ডানা গজায়, বিয়ের উৎসবের দিন সেই একবার এরা খোলা আলো হাওয়ার স্বাদ পায়। কিন্তু হায় কপাল, সে কি অদ্ভুত উৎসব। ভোজ পড়ে যায় রাজ্যের লোভাহূত গির্গিটি টিক্টিকি বাদুড় চাম্চিকের দলের, আর তরকারি হয় হতভাগা বর ক’নেরা স্বয়ং। শেষে যে দু’চারটি টিঁকে যায়, তারা জোড় বেঁধে ডানা খসিয়ে নতুন ঢিবি পত্তন করতে বসে বটে, কিন্তু সে পরিণামের উদ্দেশ্যে যে-সংঘশক্তি মরবার তরে ঝাঁকে ঝাঁকে উইপিপীলিকাদিকে পক্ষ জোগায়, তাকে অন্তত মিতাচারী বলা যায় না।
ঈশার এক খণ্ড পথ হারিয়ে অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছে, ঢিবি জীবনের চেহারাটা সেইরকম নয় কি।
মৌমাছিদের সংঘশক্তি রাজসিক, চাকের মধুময় আঁধার থেকে প্রফুল্ল কাননের জেল্লায় এদের আনাগোনা। চাকের বাসিন্দাবা হচ্ছে—একটি পাটরানী, গুটিকতক বাচ্ছা রানী, দশবিশটা পুরুষ-মোসাহেব, আর বাকি সব লিঙ্গহীন কর্মী। আকাশমার্গে বিবাহ-উৎসবের মাতামাতির পর থিতিয়ে বসলে, পাটরানীর কাজ হচ্ছে চাকের ঘরে ঘরে ডিম পেড়ে বেড়ানো। চাকের বাসিন্দা বেড়ে উঠলে, বাচ্ছা রানীরাও সেই সঙ্গে সাবালিকা হয়ে এক এক ঝাঁক কর্মী নিয়ে স্থানান্তরে নতুন চাক ফাঁদতে বেরিয়ে পড়ে, এই ভার তাদের উপর। আর কর্মীরা একনিষ্ঠায় চাকের যত কিছু কাজ সব করতে থাকে—মোম তৈরি থেকে আরম্ভ করে, মোম দিয়ে চাক গড়া, রানীদের সেবা, ডিম-ফোটা বাচ্ছাদের খাওয়ানো, রোদের বেলায় মধু এনে ভাঁড়ারে রাখা, শত্রুর আক্রমণ ঠেকানো, রাতে সকলে মিলে একসঙ্গে ডানা নেড়ে চাকের হাওয়া বদলানো, বাচ্ছাদের মধ্যে কারা রানী হবে, কারা পুরুষ হবে, কারা কর্মী থাকবে, রেণুতে মধুতে মিশিয়ে সে রকম খাবার ব্যবস্থা করা,—এমন অশেষ কাজে খাটতে খাটতে এদের অল্প আয়ুর কটা দিনের মধ্যে শরীর জীর্ণ হয়ে যায়।
কর্মীদের এত খাটুনির উৎসাহ কি মধুর রসে মাতোয়ারা হওয়ার লোভে?—তা তো নয়।—যেটুকু মধু খায় এক তো তার চেয়ে ঢের বেশি তুলে রাখে, তাছাড়া রানীকে বাচ্ছাকে না খাইয়ে ওরা তো খায়ই না। যত খাতির রানীর, যত সেবা বাচ্ছাদের, যত কঠোরতা হতভাগা পুরুষগুলোর ভাগ্যে; বসন্ত-উৎসবে একজন উদ্যোগী পুরুষ তো রানীকে লাভ করে, বাকি সব ঘরে ফিরে এসে বেকার বসে থাকে, ফুলের মর্সুম উতরে গেলে কর্মীরা তাদিকে ঘেরাও করে মেরে দেয়—মধুর বাজে খরচ ওদের এতই অসহ্য। নিজেদের সম্বন্ধে কর্মীরা উদাসীন, কেউ কারো অপেক্ষা রাখে না, কোনো কর্মীর আঘাত লেগে সে যদি যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে, তার দিকেও অন্যেরা ফিরে তাকায় না, চাকের কাজের হুড়োহুড়িতে তাকে যদি মাড়িয়ে যেতে হয়, সেও স্বীকার।
নিজের বেলা এত হেলা, পরের কাউকে আতুপুতু, কাউকে মারধর,—এ ব্যাপারের হিসেবটা এই যে, এরা বোঝে শুধু “বৃদ্ধি”, স্বজাতবৃদ্ধি—মানুষের মধ্যে যেমন ক্ষত্রিয়-বৈশ্যপ্রবর নিজের সুখস্বচ্ছন্দ তুচ্ছ করে রাজ্য বাড়াতে, ধন বাড়াতে, মশগুল থাকে। শেষে এতদিনের গৃহস্থালি, এত করে সঞ্চয় করা মিষ্টিধন, ওদের এই যথাসর্বস্বের মায়া কাটিয়ে নিজেদের কোন্ এক অতীত অহেতুক-বৃদ্ধিবাতিকগ্রস্ত সংঘশক্তির এক ইশারায় অর্বাচীন রানীর অনুচর হয়ে ওদের তরুণ দল অজানার মধ্যে অকাতরে ঝাঁপ দেয়। ঝড় জল দুর্যোগের হাত থেকে যারা বেঁচে যায়, তারা পৌঁছয় কোথায়? না, আবার নিজেকে ভুলে নতুন চাক তৈরি করা, আবার তৈরি চাক ছেড়ে বেরিয়ে পড়া। ব্যক্তির উৎকর্ষ-সাধন গোছের কোনো বালাই নেই।
এক রকম তপস্বীদলের আস্তানা দেখা যায়, সেখানে বোকা গৃহস্থদের খাটুনির দান মাটির তলায় কাঁড়ি হতে থাকে, বুড়ো তাপসরা সরে পড়ার আগে একদল শিষ্যকে সেই তপস্যা শিখিয়ে যায়, যাতে করে পুঁতে রাখা ভিক্ষের ধন আরো বাড়তে থাকে, যা দেবতার উপকারে লাগে কিনা জানা নেই, ধর্মের কাজে যে লাগে না সেটুকু নিশ্চয়। এই রকম তপস্বীদের দেখলে মৌচাকের কথা মনে পড়ে।
সে যাই হোক, মৌমাছি-জীবনের ঘানি যে-ঈশায় ঘোরায় তার আরো বড়ো কিছুর দিকে এগোবার রাস্তা দেখা যায় না। তবে পাশ্চাত্ত্য মানুষের চালাকির সঙ্গে পারা ভার। মৌমাছির আপন-ভোলা শ্রমকে সে নিজের ভোগে লাগাবার ফিকির বার করেছে। “বংশ বাড়াবি, সাধ হয়েছে?—বেশ তো, তার জন্যে গাছের গর্ত খুঁজে ঘুরে মরা কেন। দিব্যি কাঠের বাক্স তৈরি আছে, তাতে ব’সে যা, চাকে প্রাণ ভরে মধু আন্, ঝাঁকের পর ঝাঁক বার করতে চাস্ কোনো ভয় নেই, বাক্স মোজুদ আছে।” এই অভ্যর্থনায় খুশি হয়ে মৌমাছি বশ মেনে গেল, এক এক বাক্সে লাখো কর্মী জুটে আধমন একমন করে মধু জড়ো হতে লাগল, সে মধু কৌশল করে মানুষে বেমালুম বার করে নিয়ে তার বদলে গুড় ভরে দিলেও ঘানিঠেলা মদেমত্ত মধুকর দলের সে দিকে ভ্রূক্ষেপই নেই। এদিক থেকে দেখলে, মানুষের সঙ্গে বড়ো সমবায়ভুক্ত হওয়াটা মৌমাছির ভাগ্যে ঘটেছে বটে।
পিঁপড়েদের জীবন বিচিত্র, সন্দেহ নেই। ওদের সংঘশক্তিকে সাত্ত্বিক বলা না যাক, চৌকস বলা চলে। ওদের শস্য ফলানো আছে, গো[২] পালন আছে, সন্ধিবিগ্রহ আছে, বাচ্ছাদের প্রাণপণ যত্ন তো আছেই, তা ছাড়া শরণাপন্নকে আশ্রয় দেওয়া আছে, পরস্পরকে দান করাকরি আছে, এমন কি ওদের মধ্যে দাতাকর্ণের দল আছে যারা মিষ্টি রসের বোঝা নিয়ে বসে থাকে, যে চায় তাকে বিলোয়। দেহ নেহাত খুদে না হলে, ওরা হয়তো মানুষের সঙ্গে সমানে টক্কর দিত।
নাবিকেরা এক দ্বীপের গল্প করে, যেখানে ডেঞে পিঁপড়ের দল এমন আড্ডা গেড়েছিল যে, সেখানে অন্য কোনো জানোয়ার থাকার যো ছিল না; তারা দ্বীপ দেখবে বলে যেমন নৌকো থেকে নেমেছে, আর পিঁপড়ের দলবদ্ধ আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পালাতে পথ পায় না। ক বছর পর আর একবার সেখানে খবর নিতে গিয়ে সেই নাবিকেরা দেখে যে ইতিমধ্যে এক প্লাবনে পিঁপড়েরা উজাড় হয়ে গেছে, মানুষ সমেত নানা জন্তুর বসবাস শুরু হয়েছে।
পিঁপড়েরা যে, সংঘশক্তির জোরে চলে-ফেরে, তার একটা প্রমাণ বললেই হবে। বাঘ-সিংহকে আলাদা করে খাঁচায় রাখলে, দুটি দুটি খাবার যোগালে, তারা আয়ুর শেষ পর্যন্ত তাতেই টিঁকে থাকতে পারে কিন্তু দুটি একটি পিঁপড়েকে প্রচুর খাবার দিয়েও আলাদা করে রাখলে তারা বাঁচে না।
পোকাসমাজের একটু একটু যা ছবি দেখা গেল, তা থেকে কিছু তত্ত্ব উদ্ধার করা যায় কি, যা আমাদের এ পালায় কাজে লাগতে পারে।
এক তো বোঝা যাচ্ছে যে, খালি আমি-হারা হলেই বড়ো হবার দরজা খুলে যায় না। দেবীর উপর অভিমান করে কবি জিজ্ঞাসা করেছেন, “কোন্ অপরাধে এ দীর্ঘ মেয়াদে সংসারগারদে থাকি, বল্?” সে বিলাপের উত্তর এই—গৃহস্থ যদি গতানুগতিকের গোলাম হয়ে চলে, নিজের পায়ে নিজেই শিকল পরায়, তবেই তার সংসারটা আশ্রম না হয়ে গারদে দাঁড়ায়। যেটা ভবের লীলা হবার কথা, তাই হয় ভবযন্ত্রণা। হিন্দু যখন স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি খেলানো ছেড়ে দিল, তখন থেকে চোখের জলে তারাকে ডাকতে ডাকতে তার দিন কাটছে, বিধাতার কাছে রোজ-কে রোজ পাঁচ মোহর পারিতোষিক[৩] আদায় করে আনন্দ করা মায়া-পাগলের ভাগ্যে ঘটে না। মনে পড়ে কবি ইকবালের উপদেশ—“আমিকে হারানো দুরে থাক্, তাকে এমন টনটনে চৈতন্যে তুলতে হবে যাতে সে বিশ্বকে নিজের ভিতর টেনে নিতে পারে।”
আর একটা দেখা যাচ্ছে এই,—সংঘশক্তি যতবার সংস্কারবদ্ধ জীবকে সমবায়ে মিলিয়ে বড়ো করতে গেছে, ততবারই তাদিকে ঘূর্ণিপাকে ফেলে নিজেও তার মধ্যে আটকে গিয়ে, ত্রাণের চেষ্টায় ভঙ্গ দিতে হয়েছে। এখন ঈশার যা কিছু আশাভরসা মানুষের মতো মানুষ নিয়ে কারবার ক’রে।
মানুষ দুই ধারার মধ্যিখানে এসে পড়েছে। বুদ্ধি-খাটানো ছেড়ে দিয়ে সে বাপদাদার আমলের ক্রিয়াকাণ্ড নিয়ে চোখবাঁধা বলদগিরিও করে থাকে, আবার নিজের নিত্যনতুন সৃষ্টির আনন্দে আলো হতে আরো আলোয় উড়ে বেড়াতেও পারে। তার লক্ষীনারায়ণ লাভের তিন যুগের ব্যর্থ চেষ্টার কথা তো বলা হয়েছে,—এবার বা মানুষের ঈশার গুণপনার শেষ পরীক্ষা—কল্কি অবতার USS-Rকে দিয়ে তিনকেলে বাজে সংস্কারের জাল ঝেড়ে ফেলে যদি লক্ষ্মীনারায়ণের উপযুক্ত আসন পেতে রাখতে পারে। নইলে অস্ত্রঝন্ঝনানির আওয়াজে মানুষ দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে, বর্বর অবস্থায় দৌড়ে ফিরে যাবে। পাকা ঘুঁটিকে কেঁচে গাদ থেকে আবার বেরোতে হবে।
পুরোনো আবর্জনা বিদায়ের কথা যদি তোলা গেল, তবে একটা বিধান নেওয়া দরকার।
পুরাকালে উৎপেতো অসুরের জ্বালায় অস্থির হলে দেবতারা বাঁচাও, বাচাও! বলে চণ্ডীদেবীকে কাকুতিমিনতি করতেন। এ কালের নেতারা যাকে ডাকেন, চতুরা-রূপে অ-সহযোগ সাজেই আসুন, আর নিজ-মূর্তিতে রণসজ্জায়ই আসুন, তিনি সেই চণ্ডীই বটেন, রেহাই দেবার পাত্র তিনি নন। কোনো না কোনো ভাবে তাঁর আবির্ভাব না হলে প্রকৃতির গলতিই হোক, আর মানুষের বদমায়শিই হোক, তা থেকে নিষ্কৃতি পাবার উপায় দেখা যায় না।
তাই জিজ্ঞেস করি, যে শত্রুরা কখনো লুকিয়েচুরিয়ে কখনো বা হাঁকডাক করে, মাঝে মাঝে সমীকরণ যজ্ঞবেদি নষ্ট করতে আসে, তাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষত্রতেজ প্রকাশ করে যজ্ঞ রক্ষার চেষ্টার দরুন USSR-কে আদর্শভ্রষ্ট পাষণ্ড বলে গাল পাড়া চলে কি।
মানুষের সঙ্গে মানুষের কালক্রমে রফারফি হলেও হতে পারে; গোছগাছের হিকমতে মানুষ হয়তো বা নির্বিবাদে পরস্পর-উপকারী জীবজন্তু গাছপালা দিয়ে ক্রমশ নিজেকে ঘেরাও করে রাখতে পারবে; কিন্তু হিংসাকে কি একেবারে বাদ দিতে পারা যাবে। অন্তত ধুলো থেকে, জল থেকে, হাওয়া থেকে, কলেরা-ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড-ইনফ্লুয়েঞ্জার যত রোগবীজকে মেরে সারা না করলে, “মধুবাতা ঋতায়তে, মধু ক্ষরন্তি সিদ্ধবঃ...মধুমৎ পার্থিবংরজঃ...” এই মন্ত্র দিয়ে মানুষ নিজের সংঘশক্তির প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা জানাতে পারবে না।
শত্রুমিত্রের নিন্দেপ্রশংসার বাড়াবাড়ির কুয়াশা ভেদ করে পরের পালায় USSR-এর মনের ভাবের কতকগুলি স্ন্যাপ্শট্ ছবি নেবার চেষ্টা করা যাবে।
- ↑ বিচার করে কাজ করার অভ্যাস হলে বুদ্ধিকে সুশিক্ষিত বলা যেতে পারে; আর বৃত্তিকে সুশিক্ষিত বলা যায় যদি সব অবস্থার রস টানতে পারে, বিশেষত নীর থেকে ক্ষীর তোলার মতো সুখদুঃখ মেশানো সংসার থেকে সুখটা ছেঁকে আদায় করে নিতে পারলে।
- ↑ আমরা যে জীবকে গোরু বলি, তা অবশ্য পিঁপড়েরা পালন করে না। এক জাতের ছোটো পোকা আছে যারা গাছের মিষ্টিরস খেয়ে টেটুম্বুর হয়ে থাকে, পিঁপড়েরা যত্ন করে তাদিকে কাছাকাছি বসায়, তাদের গায়ে শুঁড় বুলিয়ে খোশামোদ করে সে রসবিন্দু আদায় করে নেয়।
- ↑ পাঁচ ইন্দ্রিয়ের দানকে সাধক রবিদাস এই ভাবে নিতেন।