বিশ্বমানবের লক্ষ্মীলাভ (১৯৪০)/দ্বিতীয় পালা
দ্বিতীয় পালা
পঞ্চভূতের বশীকরণ
মাটির কথা
সূর্যের প্রতাপে পরাস্ত ম্রিয়মাণ মরু-বেচারা ধুলোয় গড়াগড়ি যায়, এ বর্ণনাটা ভুল। মরুটা রাক্ষস, লকলকে জিভ বাড়িয়ে ভালোজমি চেটে খেয়ে নিজের সামিল করতে চায়। বাতাসের সাহায্যে বালির আক্রমণের নমুনা এ দেশেও দেখা যায়। সমুদ্রতীরের বাড়িতে পাঁচিল ডিঙিয়ে এসে বাইরের বালি হাতার মধ্যে ঢিবি হয়ে ওঠে। বালির উপর দিয়ে রাস্তা পাকা ক’রে বাঁধলেও তার চিহ্ন বজায় রাখা দায়। কণারকের মস্ত বড়ো সূর্য-মন্দিরটাই বালি চাপা পড়েছিল। কাঠিয়াওয়াড় থেকে বালি উড়ে এসে রাজপুতানাকে মরুময় করে তুলেছে। বালি-চলা রুখতে না পারলে, বাতাস যেদিকে বয়, সেদিকে মরু এগোয়।
শুধু ভূমি নিয়ে মরু নয়, মরুর মধ্যে উপরের হাওয়াটাকেও ধরতে হয়—হাওয়াই বা বলছি কাকে, সে-যে অদৃশ্য আগুন। মরু-বালি যদি চলে বিশ পঞ্চাশ মাইল তো মরু-বাতাসের দৌড় হাজার মাইল। যখন ভরা গর্মিতে, সূর্যের-মারা অগ্নিবাণ ঠিক্রে, বালিটা ঝাঁ ঝাঁ করে, তখন উপরকার হাওয়া প্রচণ্ড ঘূর্ণিপাক খেয়ে যুদ্ধযাত্রায় বেরোয়—একা চললে ‘লু’ বালি-কণা উড়িয়ে নিলে ‘আঁধি’। মধ্য-এসিয়ার লূ লেগে রুশের অপর পারের উক্রেন প্রদেশে খেতের শস্য শুখোয়। দক্ষিণ থেকে আঁধি এলে রুশ চাষারা বলাবলি করে, “ইরানীরা কাপড় ঝাড়ছে।” এই আঁধি রুশের ফলবাগান ছুঁয়ে গেলে গাছের পাতা কুঁক্ড়ে ডগা লটকে যায়।
প্রকৃতি নিজেই বালিকে দমাবার চেষ্টা করে থাকে। হাওয়ায় উড়ে, জলে ভেসে, পায়ের কাদায় পাখির ময়লায়, নানা উপায়ে ঘাসের গাছের বীচি দুনিয়াময় চলাফেরা করে। কিন্তু বালির মধ্যে শিকড় গেড়ে গজিয়ে ওঠার বিঘ্ন অনেক। অকালে অস্থানে পড়লে বীচি শুখিয়ে যেতে পারে; যথাস্থানে পড়লেও বাতাসে সরিয়ে ফেলতে পারে, বালিচাপা দিতে পারে।
কারাকুমের “কান্দিম” নামের এক রকম লতানে ঘাস কী ক’রে নিজের কাজ উদ্ধার করে, তার কথাটাই বলি। এ ধরনের ঘাস বা আগাছা আমাদের বেলে-জায়গায়ও দেখা যায়।
কান্দিমের বীচি ছোট্টো ফাঁপা গোলার মতো, তার গা-ময় কাঁটা। সে শুখনো বালির উপর পড়লে হাওয়ার সঙ্গে গড়িয়ে বেড়ায়, যতক্ষণ না রস জোটে। বাতাস যদি বালি ঝেঁটিয়ে এনে তাকে চাপা দেবার যোগাড় করে, হালকা বলটা ফুরফুর ক’রে বালির আগে আগে উড়ে চলে। রসা জায়গায় পৌঁছলে কাঁটাগুলো গেঁথে যায়, বীচি আর ন’ড়ে বেড়াতে পায় না। সে অবস্থায় যদি চাপা পড়ে তখন কান্দিমে-বালিতে লাগে রেশারেশি, বালির ঢিবি বাড়ে তো ঘাসও সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। কান্দিমের গাঁঠে-গাঁঠে শিকড়, উপরের চাপ সত্ত্বেও সে তাই দিয়ে তলার বালিকে আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে ফেলে। পরে কোনো সময় জোর বাতাস উঠে উপরের ঢিলে বালি সরিয়ে ফেললে, শিকড়ে বাধা ডুমো ঢিবিটা ঘাসের গোচ্ছা মাথায় পরে জ’মকে বসে থাকে।
এ ধাঁচার ঘাস আরো আছে যারা বালিকে হার মানাবার অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসে। তবে কি না, এরা হারিয়ে নিজেরা হারে: বাড় বাড়ে, কিন্তু বংশ রাখতে পারে না। তার কারণ, একবার পুরোনো পাতা ঝরাতে আরম্ভ করলে সেগুলো প’চে বালির উপর একটামাটির কথা
সারালো আস্তরণ বিছিয়ে দেয়, যাতে ক’রে বর্ষার জল তাড়াতাড়ি শুখোনো বন্ধ হয়ে যায়, তখন তার উপর অন্য গাছের বীজ লাগার সুযোগ পায়, শিকড় নামায়, গাছিয়ে ওঠে, শেষে ঝাঁকড়া পাতার আওতায় মারে সেই আগেকার ঘাসের দলকে। ক্রমশ বড়ো গাছের জঙ্গল ফলাও হলে আবহাওয়া বদলে গিয়ে মরু উদ্ধার পেয়ে যায়।
মরু-দমনের ইতিহাসটা যদিও দু’ কথায় ব’লে ফেলা গেল, কিন্তু আসলে ঘটনাগুলো পর পর ঘটতে সময় লেগে যায় যুগপরিমাণ। মানুষের কিন্তু অত তর সয় না, নিজের আয়ুর মধ্যে কাজ সারতে না পারলে ফলটা ভোগে আসবে কার?
তারো উপায় আছে। রুশের মরু-রেল-লাইনের কোনো কোনো স্টেশনে দেখা যায়, কুলীরা যাত্রীদের কাছে কত রকম বিদেশী ফল তরকারি বিক্রি করতে আনে। তবে কি সেখানে কোনো কৃষিতত্ত্ববিদের আস্তানা?—না, সেখানে যাদুকরও থাকে না। রেলের সঙ্গে সঙ্গে কি না জলও চ’লে এসেছে, তাই স্টেশনের কর্মচারীরাই ইচ্ছেমতো ফল ফলাতে পারে। মরুর চেহারা তড়িঘড়ি ফেরাতে, মানুষের উপযোগী করে তুলতে জলই সহায়।
মহাভারতের যুদ্ধ আঠারো দিনে কাবার হয়েছিল। ইংলণ্ডের ইতিহাসে একশ’ বছরের যুদ্ধেরও খবর আছে। মানুষে-মরুতে হাজার হাজার বৎসর ধরে যুদ্ধ চলেছে। সেদিন মধ্য-এসিয়ার বালির নিচে কতকগুলি ভাঙাচোরা জল-চলার বাঁধানো নহর বেরিয়েছে, যা একজন মার্কিন পণ্ডিত অনুমান করেন, দশ হাজার বছর আগেকার তৈরি। তখন তো যন্ত্রপাতি বড়ো একটা ছিল না, দূরের পাথর মজুরের হাতে পিঠে মাথায় করে এনে বসাতে হয়েছিল, তাতে কর্তাদের চাবুকের সাহায্যও তারা কিছু পেয়ে থাকবে। এমন আরো কত পুরা-কীর্তির অবশিষ্ট জায়গায় জায়গায় পাওয়া যায়। এত কষ্টে গড়া জিনিস মানুষে নষ্ট হতে দেয় কেন।
তাতে প্রকৃতির হাত কিছু থাকতে পারে, কিন্তু মানুষের নিজের দুর্বুদ্ধি নির্বুদ্ধিতা আসলে দায়ী।
রাজাদের দিগ্বিজয় কাহিনী বেশ চটকদার করে লেখা হয়, কিন্তু তলিয়ে দেখলে তাদের কার্যকলাপ মোটেই মনোরম নয়। তারা বেরত কোনো সুদূর ধনের লোভে লোভে, মাঝপথে বাধা পেলে হন্যে হয়ে উঠত। যোদ্ধার সাজসজ্জা ছাড়িয়ে ফেললে ভিতরে বেরিয়ে পড়ে নিছক গুণ্ডা, বিপক্ষকে যেমন-তেমন করে কাবু করা বৈ সে কিছুই বোঝে না। সে জানে জলের নহর ভেঙে দিলে মরুবাসী রাজা একেবারে কাবু। তখন তার এলাকার ভিতর দিয়ে লুটপাট করে চলে গেলেও তাকে নিরুপায় হয়ে সইতে হবে; পরে প্রজা বাঁচুক মরুক বিজয়ী বীর তার থোড়াই তোয়াক্কা রাখে। পুরোনো কীর্তিনাশের এই এক কারণ।
আর এক কারণ হচ্ছে কর্মকর্তার নিজের আহাম্মকি। জমির রকম না বুঝে জল হুড়মুড় করে এনে ফেললেই তো কাজ হয় না, আশপাশের চেয়ে জমি যদি নিচু হয় তবে তো মজে হেজে গিয়ে বসবাসের বার হয়ে যায়। তখন তৈরি নহরের মায়া কাটিয়ে স’রে পড়া ছাড়া গতি থাকে না, শেষে মরা নহরের উপর খাঁড়ার ঘা দেবার ভার পড়ে প্রকৃতি-দেবীর উপর।
আচ্ছা, সেকালে না হয় মানুষের সুবুদ্ধির উদয় হয়নি, বিদ্যেও গজায়নি, তাই তাদের প্রাণপণ অধ্যবসায় সত্ত্বেও পৃথিবীর অনেক জমি পতিত হয়েই রইল। কিন্তু তার পরে তো ছটফটে রাজাগুলো যে-যার রাজ্যে থিতিয়ে বসল, বিজ্ঞান ও হাজির হল মানুষের খিদমত করতে; তবু কেন যে-মরু সেই মরু খাঁ খাঁ করছে।
ইমারত যত উঁচু, ভিত তার মতো-মতো চওড়া না হলে যা হয়, মানুষের সেই রকমের দশাটা হয়েছে—তার হৃদয় উদার না হতেই বুদ্ধিটা বেজায় চড়ে গেছে। মানুষে মানুষে ভালোবাসার টান না থাকলে বুদ্ধিকে বাগ মানাবে কী দিয়ে। তাই মাঝে মাঝে হালছাড়া বিজ্ঞানের কেরামতি দেখে অবাক হতে হয়—দুঃখ না হলে হাসি পেত।
সবে সেদিন খবরের কাগজে পড়া গেল মার্কিনদেশে দর বাড়াবার জন্যে হাজার হাজার বস্তা গম পুড়িয়ে ফেলার অদ্ভুত কাণ্ড।
য়ুরোপেরও একটা গল্প বলি। ১৯৩৪ সালে জর্মানীর বিজ্ঞানের ঠেলায় গমের এমনি ফলন হল যে, দেশের লোকে খেয়ে শেষ করতে পারে না, পাঠিয়ে দিলে দিনেমার-গোরুকে খাওয়াতে। সেখানে আবার গোরু এত বেড়ে গেল যে, গো-খাদক জাতেও তার সদ্ব্যবহার করে উঠতে পারল না, কলে পিশে তাদের হাড়েমাসে পিণ্ডি পাকিয়ে ওলন্দাজ শুয়োরের খাবার বলে চালান গেল। সেখানে শুয়োর বংশের বাড়াবাড়ি আরম্ভ হওয়ায়, শুয়োরখেকোরও হল অরুচি, শুয়োর মেরে সার দিতে লাগল নতুন আবাদী জমিতে,—যাতে আবার বোনা হল গম। বলিহারি যাই চক্করের বাহার:
সার দিয়ে বেড়ে যায় গম
গোরুতে খায় সেই বাড়তি গম
বাড়তি গোরু দিয়ে খাওয়াল শুয়োর
খেতের সার হল বাড়তি শুয়োর
আবার বেড়ে যায় গম—
টাকডুমাডুম্ডুম্।
ভেদবুদ্ধিই হয়ে আসছে মানুষের কাল। যে-যার নিজের দিকে টানাটানির চোটে যা উৎপন্ন হতে পারত তা হয় না, যা হয় তাও ফেলা-ছড়া যায়।
১৯২৭ সালে লেখা এক জর্মন পণ্ডিতের মন্তব্য চুম্বক করে দিলে আয়েবটা ফুটে উঠবে—“মরুকে উর্বর করার চেষ্টায় সমূহ বিপদ। জমি নিয়ে ফসল নিয়ে হবে কাড়াকাড়ি, বাধবে শেষটা লড়াই। এক জায়গার আবহাওয়ার না হয় উন্নতি করা হল, আর এক জায়গায় তাতে উলটো ফল হতে পারে, তারা করবে চেঁচামেচি, সেও গড়াবে যুদ্ধে। দূরের লোকের কথা ছেড়েই দাও, প্রতিবাসীর বাড় দেখলে প্রতিবাসীরাই খুনোখুনি লাগিয়ে দেয়।”
আর এক কথা, “এ উপকার করতে যাওয়া চলে না,” “ও অভাব মোচন করা পোষায় না”—আজকালকার রাজনীতির এ সব বুলির মানে আর কিছু না, যে কর্তৃপক্ষ এ রকম কাজে হাত দেবে তাদের ঘরে কিছু আসবে না। কর্তার ইচ্ছে কর্ম, কর্তার লাভই লাভ। চলতি তন্ত্রে সকলের সমৃদ্ধি বলে কোনো জিনিসই নেই।
নারায়ণকে ভালো না রাখলে নরনারীর মঙ্গল নেই, এ সোজা কথা আজকাল যেন একটা অদ্ভুত রহস্যের মতো শোনায়—লোকে আঁতকে, কিম্বা হেসে ওঠে। অথচ, এই কথাটুকু না বোঝায়, দুনিয়ার তিন ভাগ মানুষ আধপেটা খাচ্ছে, অনেকের তাও জুটছে না। এ দিকে বিজ্ঞানীরা বলেন, নতুন বিদ্যেসাধ্যি কিছু না খাটিয়েও পৃথিবীর জলস্থল থেকে মিলেমিশে করলে যা উৎপন্ন হতে পারে, তাতে পৃথিবীর লোক চারগুণ বাড়লেও তাদের খাওয়াপরা চলতে পারে।
USSR ঠিকই বুঝেছেন। যা কিছু যোগাড় আছে, বা হতে পারে, সে সবের হিসেব ক’রে দরদ দিয়ে পরিবেশন করাই আসল উপায়।
সেজন্যে USSR দলে দলে বিশেষজ্ঞ কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। কেহ দেখছেন মাটির উপরের ব্যবস্থা,—চল্তি ফসল পুরো ফলানো, অন্য ভালো ফসল আনানো, কেহ খুঁজছেন প্রকৃতির গচ্ছিত ধন মাটির তলা থেকে কোথায় তোলা যায়; কেহ আসমানের জল নামিয়ে আনবার ফন্দি আঁটছেন, কেহ জমিনে জল চারিয়ে দেবার ফিকির ঠাওরাচ্ছেন কেহ বা সূর্যের তেজ, আগুনের তাপ খাটিয়ে শক্তি সঞ্চয়ের মতলব ফাঁদছেন; দিন নেই, রাত নেই, আপনা-ভুলে তাঁরা জনগণের হিতচিন্তায় লেগে আছেন,—এর-ওর-তার টাকা লাভের আশায় নয়, সমবেত সমাজের কল্যাণকল্পে এ সাধনা।
একেই বলা যায় যোগ। শুধু বিশেষজ্ঞের কেন, সংঘের সকলেরই চিত্তের ভাবনা, হৃদয়ের বেগ যেন রাশ টেনে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে নিজের চারদিকে ক্রমান্বয় চক্কর না খেয়ে সমাজের সমৃদ্ধিতে তারা নিজের বৃদ্ধি বোঝে, সে উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করার উৎসাহ পায়, সকলের ভাবী-উন্নতির জন্যে প্রফুল্ল মনে নিজের বর্তমান কষ্ট স্বীকার করতে পারে।
তাতেই ভরসা হয়, হাজার বৎসরের দাপাদাপিতে যা হয়নি, এঁদের পাঁচ-পাঁচ-বছরের সুসম্বদ্ধ চেষ্টায় তা হয়ে উঠবে—মরুকে এঁরা মাটি করে ছাড়বেন।
ব্যবস্থা করে জল আনতে লাগাতে পারলে মরুভূমিকে ফলন্ত করা যায়, এ কথাটা নতুন নয়; জল আনার চেষ্টাও অনেক দিনের, তাও তো দেখা গেল। এক জোট হয়ে সব রকম বিদ্যে খাটানোটাই নতুন; আরো নতুন তার উদ্দেশ্য—সংঘবদ্ধ মানুষের উপকার, যে সংঘের মধ্যে জাতিভেদ নেই, যার মূল-মন্ত্র মানলে কোনো সমাজের তার মধ্যে ঢুকতে মানা নেই।
স্বর্গেমর্ত্যে পাতালে জল তো সর্বত্র। আকাশে জলের অদৃশ্য ভাপ উঠে মেঘ-কুয়াশা হয়ে দেখা দেয়। সমুদ্র ছাড়া, মাটির উপরের জল থাকে জমির খাঁজে নদী, গহ্বরের ভিতর হ্রদ, পাহাড়ের উপর বরফ হয়ে। মাটির তলার জল কোথাও চুঁয়ে চুঁয়ে ধীর স্রোতে চলে, কোথাও গুহায় গর্তে স্থির থাকে। কেমন ক’রে এই সব জলকে মানুষের দরকার মতো হাজির করা যায়, USSR-এর সেই ভাবনা।
স্বাভাবিক উৎস বাদে, পাতকুয়ো, নলকুয়ো, বাঁধা ইঁদারা, এই সব হল পাতালের জলে পৌঁছে তাকে উপরে টেনে আনার মামুলি রাস্তা। মরুর মধ্যে কোনো জায়গায় উৎস থাকলে তার কাছে মানুষ বসতি করে আসছে, আশপাশে কিছুদূর পর্যন্ত নিজের খোঁড়া কুয়ো ইঁদারা দিয়ে চাষের কাজ চালাচ্ছে, এই তো সেকেলে বন্দোবস্ত। কিন্তু কুয়োর উপর কুয়ো বাড়িয়ে জলের জোগাড়ে মরুকে ঝাঁঝরা করে ফেলা,—এ কালের সে পন্থা নয়।
বাঁধানো নহরে-আনা জল পেলে, মানুষের পক্ষে যানবাহন নিয়ে মরু পারাপার করার উপায় হয় বটে, কিন্তু সে জল দুধারের জমির কতটুকুই বা ভেজাতে পারে, তেপান্তর বালির ভিতর দিয়ে বড়ো জোর একটা উর্বর রেখা টেনে যায়। যেমন লম্বা তেমনি চওড়া রুশের মরুর আবাদ কি তার উপর নির্ভর করে চলতে পারে। কাজেই নহর বাড়ানোর চেষ্টাও বড়ো একটা চলছে না।
তবে জাহাজে ক’রে জল আনা হবে না কি। তামাশার ভিতর এক এক বার সত্যি কথা থেকে যায়। কাশ্যপ সাগরের এক কোলের ধারে মরুর মধ্যিখানে ক্রাস্নোভডস্ক ব’লে এক শহর আছে—বাংলা অক্ষরে লিখলে যার নাম উচ্চারণের অসুবিধে বাড়বে বৈ কমবে না— সেখানে নোনা জলের ছড়াছড়ি, খাবার মতো এক ফোঁটাও মেলে না। কাজেই সাগরজলের নুন বাদ দিয়ে পানীয় জল কলে তৈরি করে নিতে হয়। কল বিগড়ে গেলে, মেরামত না হওয়া পর্যন্ত সাগর পার থেকে জাহাজে জল আনে; ইতিমধ্যে খাবার জল টাকায়-সের বিকোয়। তাই বলে কেহ কি মনে করবে, মাঝ-মরুতে জল পৌঁছে দেবার এটা এক উপায়?
বরফ-পাহাড়ে অফুরন্ত জল জমাট বেঁধে আছে। প্রকৃতির দেখাদেখি ঐ জলের ভাগ নদী দিয়ে দরকার মতো আনতে পারলে একটা উপায়ের মতো উপায় হয় বটে—ভগীরথ-ইঞ্জিনিয়র যে-কৌশলে গঙ্গার ভাগীরথী শাখাকে বাংলা দেশের ভিতর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছিলেন। USSR ঐ ধরনেরই পথ ধরেছেন। তাঁদের দৃষ্টিশক্তি ঋষিতুল্য না হলেও, তার অভাব ভূতত্ত্ব-পুরাতত্ত্ব চর্চা দিয়ে পূরণ করে নিয়েছেন।
আরো সুবিধে হয় যদি যে-খেপে জোলো হাওয়া সাগর থেকে ডাঙার উপর দিয়ে পাহাড় পর্যন্ত চলে তার জলের বোঝা এখানে-ওখানে ইচ্ছেমতো খসিয়ে নিতে পারা যায়, তাহলে আনা-নেওয়ার পথ বল, সময় বল, ঝঞ্ঝাট বল, অনেক বেঁচে যায়। খাণ্ডবদাহের সময় অর্জুন ইন্দ্রের প্রচণ্ড বর্ষণ আটক রেখেছিলেন; বিজ্ঞানীরা দেবরাজের বারিধারা চুরি করার চেষ্টায় আছেন। আকাশের সে গল্প পরে হবে; এখন ভূতলের কথা চলুক।
একবার ভূচিত্রকে বায়স্কোপে চড়িয়ে সচল করার কল্পনা করা যাক, যাতে করে ভুগোল-ইতিহাসের খেলা মানসচক্ষে এক সঙ্গে দেখতে পাওয়া যাবে। তবে, যে সব ঘটনা ঘটতে এক-আধ যুগ লাগে সেগুলোকে এক নজরে দেখে নিতে হলে ছবির কলটাকে বেজায় তাড়াতাড়ি চালাতে হবে।
বিজ্ঞানীমহলে একবার কথা উঠেছিল, মার্কিন মহাদেশ ধীরে, অতি ধীরে, এসিয়ার দিকে ঘেঁষে আসছে। কথাটার সত্যিমিথ্যে নিয়ে মাথা বকিয়ে লাভ নেই, আমাদের নাতির নাতির আমলেও ধরাছোঁয়ার মতো কিছু দেখা যাবে না। কিন্তু আমাদের বায়স্কোপে এ কল্পনার ছবি চাপালে মহাদেশ-দুটোর পরস্পরের ঘাড়ে পড়াটা এ পালার মধ্যে দেখে নেওয়া যেতে পারে। আবার উলটো দিকে ঘোরালে এ রকম কাছে ঝুঁকে আসার কারণটাও আর এক বিজ্ঞানীর কল্পনায় প্রকাশ পাবে। তিনি মনে করেন ঘটনাটা সেই পুরা কল্পের, যবে জাঁকালো কোনো জ্যোতিষ্ক অতিথির টানে পৃথিবীর একমাত্র পুত্র চাঁদ, মায়ের কোল ছিটকে বেরিয়ে, প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গহ্বরে আপন স্মৃতি রেখে যায়। এই বিপুল ক্ষত ক্রমশ জুড়ে আসাটাই, দুই মহাদেশের ক্রমশ কাছাকাছি আসার কারণ। এ সব কল্পনার উপর ঝোঁক না দিয়ে ভবিষ্যতে ঠোকাঠুকির ফলটা বরং আলোচনা করা যাক।
বিপরীত দিকে চলতি দুই ট্রেন ধাক্কা খেলে যেমন মাঝের গাড়িগুলো খাড়া হয়ে ওঠে, মহাদেশের বেলা তেমনি দেখা যাবে, যে-কিনারা দুটো ভীষণ ঠাসে ঠেকবে, তাদের তলায় স্তরে, স্তরে যেসব পাথরের ভিত আছে তারা চচ্চড় ক’রে বেঁকে চুরে ঠেলে উঠবে, মধ্যিখানের সমুদ্রের তলায় যা-কিছু চুন বালি শামুক ঝিনুক সব মাথায় নিয়ে এক সার পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। এইরকমেই একটা ধাক্কায় জন্মেছিল হিমালয়শ্রেণী—এখনো তার চুড়োয় চুড়োয় জলচর শামুক ঝিনুকের খোলস পাওয়া যায়; মাটির ঢাকা খসে গিয়ে তার ভিতরকার স্তর বেরিয়ে পড়লে পাথরগুলোর দুমড়ে খাড়া হওয়ার চেহারা পষ্ট দেখা যায়।
ডাঙায় ডাঙায় ঠেকতেই মাঝে যে জল ছিল তা দুদিকে ছিটকে বেরোবে। দুধারে ডাঙার জমিটা চাপের চোটে কুঁচকে ঢেউ খেলিয়ে যাবে, আলুর খেতের মতো দাঁড়ার পর খাল, খালের পর দাঁড়া। কোথাও জলের নিচে থেকে মাটি জাগবে, কোথাও জল চড়ে এসে মাটি তলাবে। এরকমেরই ঘটনায় কোনো সময় হয়তো এ্যাটলাণ্টিস (Atlantis) দেশ তলিয়ে গিয়েছিল; লোহিত সাগর মাঝে চড়ে এসে আরবে আফ্রিকায় বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে; ওলন্দাজদের দেশ নামিয়ে দিয়ে তাদিকে ত্রাহি ত্রাহি শব্দে বাঁধ বাঁধিয়ে রেখেছে।
এই ভাবেই সমুদ্র পরশুরামকে কোঙ্কন-কেরল দেশ দান করেছিল, আর যাদবকুলের রাজধানী কেড়ে নিয়েছিল।
পাহাড় খাড়া হলে তার উপর বৃষ্টি হবে, বরফ পড়বে, খাঁজে খাঁজে ঝরনা নেমে আসবে, জল নিচে পৌঁছে স্রোতা হয়ে জমির ঢাল ধরে ধরে চলতে থাকবে। গাছ যে রকম গুঁড়ি থেকে আরম্ভ করে ডালপালা ছড়ায়, নদীর বাড় ঠিক তার উলটো, শাখাপ্রশাখা নানা দিক থেকে একস্রোতে জুটলে পর, শেষে গুঁড়ির মতো ভরা নদী জেঁকে ওঠে। প্রথম দিকটা, যাকে নদীর ছেলেবেলা বলা যেতে পারে, নদীতে নদীতে শাখা কাড়াকাড়ি খেলা চলে, একই স্রোতা একবার এর দিকে একবার ওর দিকে যায়। কিছুদূর এগিয়ে, যে-নদী অনেক শাখা নিয়ে দলে পুরু হয়, সে বুক ফুলিয়ে চলে, নয়তো একহারা হয়ে সরু থাকে।
পাহাড় থেকে মাটি বয়ে নিয়ে আসার সময় তারি পলি ফেলতে ফেলতে নদী দুধারের জমি তাজা রাখে, কিন্তু বুড়ো বয়সে পলির ভারে সে নিজের পথ নিজেই আটক করে, তাই তখন একবার এ পাড় একবার ও পাড় ঘেঁষে তাকে টলতে টলতে চলতে হয়। এই অবস্থা হয়েছে আমাদের বুড়ী পদ্মানদীর, যেজন্যে সে আজ এক পারের গ্রাম ভেঙে অপর পারে চড়া ওঠায়, কাল চড়া কেটে গ্রামের ধারে মাটি ফেলে। শেষকালে নদী সমুদ্রের ভিতর যেসব সার ঢালে তাতে প্রচুর ঝাঁজি শেওলা জন্মায়, সেগুলো মাছে খায়, মাছকে আবার মানুষে খায়। আগাগোড়াই নদী মানুষের সেবক।
কারাকুমের ভিতর দিয়ে চলেছে আমুদরিয়া নদী, সেটা উত্তর-পশ্চিম রোখে চলতে চলতে মাঝে উত্তর দিকে মোড় নিয়ে আরল সাগরে গিয়ে পড়েছে। অনেক কাল আগে এই নদী বরাবর পশ্চিম মুখ ধরে কাশ্যপ সাগরে পড়ত, তার চিহ্ন দেখা যায়। পুরানো চীন ফারসী গ্রীক পুঁথি মিলিয়ে জানা গেছে যে, পাঁচ ছ’ শতাব্দী অন্তর এই আমুদরিয়া একবার এ পথ দিয়ে একবার ও পথ দিয়ে চলে আসছে। এখনকার পথটা ১৫৭৫ সালে ধরেছিল, আবার দু’তিন শ’ বছর পর কাশ্যপ সাগরে তার ফিরে যাবার কথা।
আরল সাগরের পথে শুধু বালি, নদীর জল পেয়ে তাতে ফসল ফলালেও, নদীর ধারে শহর গড়ে ওঠার সুবিধে নেই। কিন্তু আমুদরিয়া পশ্চিমমুখে চলতে থাকলে, গন্ধক, পাথর-তেল, আরো কারবারের উপযোগী অনেক জিনিস পথে পড়ে। এই সব থাকায় আগের বারে যে শহরগুলো উঠেছিল তার টুকরো-টাকরা আজও বালির মধ্যে পড়ে আছে। এ পথটাই যদি মানুষের বেশি উপকারী, তবে অতশত বৎসর পর যা ঘটবে, তাকি দু’তিনটি পঞ্চবার্ষিক সংকল্পের মধ্যে এগিয়ে আনা যায় না?
তাহলে ভাবতে হয় আমুদরিয়াটা অমন দু-মনা নদী কেন।
হয়েছে কী, বোখারা শহরের কাছাকাছি এসে, আমুদরিয়া পড়েছে একটা দাঁড়-জমির মুখে। সেখান থেকে দুইরোখে দুই খাল জমি চলেছে। নদীটা এখন উত্তরমুখী খাল ধরেছে, তাই থেকে বোঝা যায় এ খালটাই বেশি নিচু। এক ঘড়া জল গড়ানে জায়গায় ঢাললে দেখা যায় ধারাগুলি বেছে বেছে কেমন সবচেয়ে নাবী ঢাল ধরে চলে। যদি মাটি চাপা দিয়ে কোনো একটা ধারার পথে বাধা দেওয়া যায়, তখন সেটা অগত্যা কম নিচু পথই নেয়। এই মাটি চাপা দেওয়ার কাজটা নদী পলি ফেলে নিজেই করে।
নদীর ধর্মই হল পতিত-উদ্ধার,—নিচুকে উঁচু, শুষ্ককে সজীব, অহল্যাকে[১] সীতার[২] উপযুক্ত করা। এই ব্রতপালনে আয়ুদরিয়া চলতি পথটাকে ক্রমশ ওঠাতে থাকে; শেষে যখন তলার সঙ্গে সঙ্গে জলও বেশি উঁচু হয়ে ওঠে, তখন পতিতপাবনী অন্য পথটায় গড়িয়ে পড়েন।
ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো আমুদরিয়ার পালা করে এ-পথ ও-পথ ধরার এই কারণ।
পথ বদলাবদলির হিসেব যদি বোঝা গেল, তাহলে যে পথ চাই সে পথে নদীকে চালাবার উপায়ও ধরা পড়ল। পশ্চিমমুখী খালের চেয়ে নদীর জল উঁচু হয়ে উঠলেই সে কাশ্যপ সাগরের দিকে চলবে,—এই না? আচ্ছা বেশ, তবে পলি-পড়ার পথ চেয়ে বসে না থেকে, বাঁধ বেঁধে জলটাকে তুলে ধরলেই তো হয়। ইতিহাসে ভূগোলে তথ্য খোঁজার পারিশ্রমিক এই সহজ উপায়টি USSR পেয়ে গেল।
তবে কিনা, ভাবলেই ভাবনার কারণ জোটে। নদীর কাশ্যপ সাগরে যাবার পথের মধ্যিখানে এক প্রকাণ্ড গাঢ়া আছে, যেটা নদীর জলে ভরে গেলে একটা মস্ত বড়ো হ্রদ হবে—আগে তাই ছিল, তার লক্ষণ পাওয়া যায়। এ পথে নদী চালালে এই গহ্বর ভরা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বসে থাকতে হবে, পরে ওপার দিয়ে নদী বেরিয়ে চলতে কত বৎসর যে কেটে যাবে তার ঠিকানা নেই। তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হলে খাদের ভিতর দিয়ে দুই পাড় বাঁধাই করে নদীকে ওপারে আস্ত পৌঁছে দিলে তবেই পাঁচ সাত বছরের মধ্যে ওর কাশ্যপ-সাগর সংগম ঘটবে। তখন সেই ক্র্যাস্নোভড্স্ক্ শহরে আর জাহাজে করে খাবার জল আনা লাগবে না।
কাশ্যপ সাগর রুশের মহা উপকারী জলাশয়—পুব-দক্ষিণের লুআঁধি থেকে অপর পারের উর্বর প্রদেশের ফসল বাঁচিয়ে রাখে বলে নয়, সমস্ত রুশরাষ্ট্রের আদ্ধেক মাছ সরবরাহ করে। তবে মুশকিল হয়েছে কী, এ সাগর আর সাগর নেই, হয়ে গেছে হ্রদ। যে সময় ভারতবর্ষের মাথায় হিমালয় পাহাড়ের সার ঠেলে ওঠে, এ ঘটনাও সে সময়কার। বার সমুদ্রের সঙ্গে যে যোগ ছিল, তা বন্ধ হওয়া অবধি এর জমাখরচের হিসেব গোলমাল হয়ে গেছে।
সাগরজলের খরচের মধ্যে—যে-ভাপ হাওয়ায় টেনে নেয়; জমার মধ্যে—যে-জল নদীগুলো ফিরে আনে। সব সমুদ্র সব নদী ধরলে জমাখরচের মিল থাকে, জল মোটের উপর কমেও না বাড়েও না; সমুদ্রে সমুদ্রে যোগ থাকায় এক সময় কোথাও বেশ-কম হলে স্রোত চলে ঠিক করে দেয়।
কিন্তু হ্রদ যদি আপনাকে আপনি সমান না রাখতে পারে, তাহলে ক্রমশ শুখোয়। হাওয়া তো জল টানতে কসুর করে না, যত ফলাও পায় তত টানে। জলের সে ক্ষয় সমুদ্র থেকে পূরণ না হওয়ায় যে ক’টি নদী ভিতরে এসে পড়ে তারাই ভরসা। জল যেমন কমে, হ্রদের প্রসারও কমে, তাতে হাওয়ার জল-টানার ক্ষেত্রও কমে। শেষে উবে-যাওয়া জলে নদী-আনা জলে সমান সমান হলে, হ্রদের একটা লেভেল দাঁড়িয়ে যায়।
কাশ্যপ সাগরের হয়েছে সেই দশা। একঘরে হবার পর থেকে শুখোতে শুখোতে আসল সমুদ্রের লেভেল থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাত নেমে গেছে, এখনো অল্পে অল্পে নামার দিকেই চলছে। কিন্তু আর কমে গেলে জল এত নোনা হবে যে, ভালো মাছ আর টিঁকবে না; ধারে যেসব বন্দর আছে তা থেকে জল সরে গেলে তারা কাজের বার হয়ে যাবে; রুশের বাসিন্দারা নানান ফেরে পড়বে। তাই USSR-এর রায় বেরিয়েছে—“কাশ্যপ সাগরকে জল খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।”
পুবদিক থেকে আমুদরিয়াকে আবার এনে ফেলার কথা তো বলা হয়েছে। পশ্চিম দিকে আপনি এসে পড়ছে মস্ত লম্বা বল্গা নদী। এমনিতেই বড়ো-সড়ো হলেও এর জল আরো বাড়াবার প্রস্তাব হচ্ছে। এধার ওধার থেকে শাখা টেনে নিয়ে তা কতক হতে পারত, কিন্তু জাঁকালো ভাবে কাজটা না করলে USSR-এর উপযুক্ত হবে কেন।
রুশের যে অংশ য়ুরোপের মধ্যে পড়ে, তার উত্তর সীমায় শ্বেতসাগর আর উত্তর-মহাসাগর; দক্ষিণ সীমায় কাশ্যপ-সাগরের মাথা, আজব সাগর আর কৃষ্ণসাগর। এ প্রদেশের মাঝামাঝি পুবপশ্চিম লম্বা এক অধিত্যকা আছে, যার থেকে দক্ষিণমুখী বল্গা নদী পুব ঘেঁষে কাশ্যপসাগরে পড়ে, আরডন নদী পশ্চিম দিয়ে আজব-সাগরে গিয়ে পড়ে। এই নদী দুটো আঁকতে-বাঁকতে এক জায়গায় অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়েছে, সেখানে খাল কেটে যোগ ক’রে দিলে ডনের অনেক জল বল্গার ভিতর দিয়ে কাশ্যপ সাগরকে দেওয়া যায়।
কিন্তু রোসো। তাতে উদোর গাঁট কেটে বুদোর পকেট ভারি করা হবে না তো?
না, সে ভয় নেই। নদীর জল ক’মে গেলেও আজব সাগরের তত যায় আসে না, কারণ সে সত্যিকার সাগর, কৃষ্ণ সাগরের ভিতর দিয়ে বার সমুদ্রের সঙ্গে তার যোগ আছে।
তা যেন হল কিন্তু যে জমি ডন-নদীর জলের উপর নির্ভর করে তার কী হবে।
সে ভাবনাও করা হয়েছে। জমাখরচ খতিয়ে দেখা গেছে, ডনের বিস্তর ফাল্তো জল আছে, যা আসল কাজে না লেগে বাজে বন্যায় লোকসান হয়ে যায়। তবুও আজব-সাগরের বড়ো বড়ো চিংড়ি কাঁকড়ার খোরাকের কমতি না পড়ে, সেটা মনে রেখে ডনের জল নেওয়া হবে।
মাথা যদি ঘামানোই হল, তবে একা ডন-নদী নিয়েই বা কেন। ঐ প্রদেশে আরো কত নদী আছে। ছোটোগুলি ছেড়ে দিলেও, মাঝের সেই উঁচু ভূমির উত্তর দিয়ে ডুইনা-নদী শ্বেতসাগরে আর পেটচোরা নদী উত্তর মহাসাগরে চলেছে। অন্য ডাঙার মতো অধিত্যকার জমিও দাঁড়ে খালে ঢেউ-খেলানো। তবে দাঁড়াগুলো কোথাও পাহাড়ের মতো, কোথাও বা উঁচু মাঠ হয়ে রয়েছে; লম্বা টানা খালে স্রোতা বইছে, চওড়া গহ্বর বিল হয়ে আছে। এই রকমারি অবস্থার সুযোগ নিয়ে, কতক কেটে, কতক বেঁধে যদি দু’একটা বড়ো গোছের হ্রদ তৈরি করা যায়, যাদের সঙ্গে লক-গেট দিয়ে উত্তরবাহিনী দক্ষিণবাহিনী যত ছোটো বড়ো নদী সব যোগ করা থাকে, তাহলে কৃষ্ণসাগর থেকে শ্বেতসাগর পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মাইল লম্বা এক জল-পথের জাল তৈরি হয়, যাতে ক’রে বাণিজ্যের উপর বসে লক্ষ্মী অনায়াসে রাষ্ট্রের এপার ওপার চলাফেরা করতে পারবেন।
তা বাদে পঞ্চবার্ষিক সংকল্প চালাবার কেমন সুবিধে হবে ভাবো দেখি।
কয়েদীর মতো মাটিতে-শিকল-বাঁধা চাষা, আকাশ পানে হা-পিত্যেশ করে চেয়ে-থাকা চাষা,—এদের দিন আর থাকবে না। USSR-এর জাদুকাঠির পরশে চাষা হয়ে উঠবে নানা বিদ্যেধর ইঞ্জিনিয়ার। এ-গেট খুলে সাগরে জল ভরো, মাছ বাড়াও; ও-গেট খুলে মরু ঠাণ্ডা করো, ফসল বাঁচাও; সে গেট বন্ধ রেখে প্লাবনের জড় মারো—একাধারে সে ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণের প্রতিনিধি হয়ে এমন সব হুকুম জারি করতে থাকবে।
এ রকমের বিরাট উদ্যম আমাদের ছন্নছাড়া দেশে সম্ভব হলে, তাতে যদি সিকিম-ভোটানের মাঝখানের দুয়ার দিয়ে তিব্বতের নানা নদীর উদ্বৃত্ত জল সাহেবগঞ্জের কাছ বরাবর গঙ্গায় আনা যেত, তাহলে অন্তত বাংলার নদীগুলো আজ শুখিয়ে মরতে বসত না।
নদীকে এধারে ওধারে চালাতে হলে বাঁধ বাঁধাই সেরা উপায়। কিন্তু যে দেশে উঁচু নিচু, শক্ত নরম হরেকরকমের জমি, সেখানে অনেক দেখে শুনে এ কাজ করতে হয়। বালির বাধের বিপদ তো জানাই; তলায় মরা পাথর আছে কি না তাও দেখা দরকার নইলে ধসে যাবার ভয়; নিচের মাটি যদি ফোঁপরা থাকে জল চুঁইয়ে বেরিয়ে গিয়ে কাজ নষ্ট। তা বলে, বাঁধ মজবুত হলেই যে ঝঞ্ঝাট মিটল, তাও নয়।
মনে করো এক বাঁধবিৎ ঘাড়ে যন্ত্রপাতি নিয়ে অনেক খুঁজে পেতে নিরাপদ জায়গা পেয়ে মিস্ত্রী-মজুর আনার উদ্যোগ করছে, হেনকালে লম্বা পুঁথি বগলে মাছবিৎ এসে বচসা লাগালে:
“কী করা হচ্ছে?”
“বাধ বাঁধছি, মশায়।”
“এখানে বাঁধ?”
“আজ্ঞে, তলা পরখ করেছি, ঠিক আছে।”
“রেখে দিন আপনার তলা! মাছের কী হবে তাই ভাবুন। পেটে ডিম নিয়ে যে মাছ উপরে উঠছে, তাদিকে এখানে আটকে দিলে ডিম পাড়বে কোথায়, পোনাই বা বাড়বে কোথায়। নদী নিয়ে ছেলে, খেলা করলে জীবের প্রাণ যাবে।”
“আচ্ছা, অত কথায় কাজ কী, আমাদের দুজনেরই মনের মতো জায়গা দেখা যাক।”
ঘোরাঘুরি ক’রে যদি তা পাওয়া গেল তখন কাগজের তাড়া হাতে চাষবিৎ এসে খেঁকিয়ে উঠল:
“বলি, এখানে জল উঁচু করলে বর্ষার সময় তল্লাট হেজে যাবে যে। তখন দেশে কত হাজার বস্তা ফসল ঘাটতি হবে, সে খবর কি রাখতে নেই।”
“বেশ, বেশ, আপনি না হয় ঠিক জায়গা বাতলে দিন”—
এই বলে তাঁর সঙ্গে রফা হতে না হতে, হাঁ হাঁ করে হাজির হল নাবিক।
“কর্তারা বাজে তর্ক করেন কেন। এখানেই বা কী, ওখানেই বা কী, বিনা-গেটের বাঁধ যদি তোলেন, নৌকো পার হবে কেমনে। জলপথে মাল চলা বন্ধ হলে ঢোলাই খরচে সব খেয়ে নেবে যে।”
নানা-বেত্তা সংকট দেখে অবশেষে সমবায়ী উপস্থিত হয়ে সদরে তার করলেন—“এদের সবাইকে সভা করে বসানো হোক, নইলে কাজ এগোবে না।”
আমাদের মন-গড়া এ টেলিগ্রামের অপেক্ষা না করেই আলাদা বিদ্যের বিশেষজ্ঞ দলকে USSR এক সঙ্গে পরামর্শ করিয়ে কাজে হাত দিয়ে থাকেন। সে পরামর্শ সভা কী বৃহৎ ব্যাপার। একটা বড়ো হলেও সবাইকে ধরে না। তাতে ক্ষতিই বা কী। তারা তো মুখে মুখে তর্ক করে না, যে-যার তথ্য সাজানো, যুক্তি দেখানো, আঁক কষা, সবি লিখে হয়; শেষে নেতারা যে কাজের জন্যে যা দরকার তাদের রিপোর্ট থেকে সংগ্রহ করে ব্যবস্থা করেন।
বিষয়মোহে জড়ভরত দেশে যেখানে জমির স্বত্ব এক পক্ষের, জলের স্বামীত্ব অপরের; যেখানে একই নদীর কতকটা এক কর্তার তাঁবে, বাকিটা ভিন্ন-এলাকায়, যে যার অধিকার নিয়ে মত্ত, কেও কাওকে পোঁছে না, কেও কাওকে রেহাই দেয় না; সেখানে এমন সব-দিক-দর্শী কল্পনা করাই মুশকিল, কাজে আনা তো দূরের কথা।
USSR-এর বিরাটরাষ্ট্রে তাঁরা ক্ষিতিপতি, সিন্ধুপতি, প্রজাপতি সবই। ভর্তা-পাতা-সর্বসুখদাতা হয়ে তাঁরা যে-ভাবে পতিধর্ম পালনে উঠে প’ড়ে লেগেছেন, তার তারিফ না করে থাকা যায় না।
আকাশের কথা
ঘর বলতে আমরা বুঝি, মাথার উপর চাল, চার পাশে দেয়াল; চীনেরা বলে মাঝের ফাঁকটাই আসল। আকাশ ফাঁকা, তাই মহান। তাই বলে শূন্য ব্যোমকে ভূতের দলে ফেলার মানে কী হতে পারে। তাকে ভূতের খেলাঘর বললে বরং মানাত।
যাঁরা গগনে বিহার করেন, তাঁদের মধ্যে আগে মনে উদয় হন সূর্য— তাঁকে ধরে দেবতার দলে, তাঁর রশ্মিকে ভূতের মধ্যে, যে ভূত দিয়ে প্রকৃতিমাতা প্রাণশক্তি গড়েন; তাঁর আজকালকার ছেলেরাও পিছপাও নয়, তারা এ ভূত দিয়ে তৈরি করে কলের শক্তি।
স্বাভাবিক অবস্থায় যাকে বলে জলের ভাপ, চাপের মধ্যে জন্মালে তাকেই বলে স্টীম, সে অবস্থায় তাকে জল থেকে বার করতে তাপও লাগে বিস্তর। বিজ্ঞানীদের চেষ্টা চলেছে, আতসী কাঁচের ভিতর দিয়ে গুচ্ছের সূর্যকিরণ জড়ো করে তাদের মিলিত তাতে জলকে স্টীমকরা। স্টীম একবার হলে তা দিয়ে ইচ্ছেমতো যে-কোনো রকমের কল চালিয়ে নেওয়া যায়, এমন কি, সাহারার মধ্যিখানে বসেও ববফ জমানো যায়,— যেমন তপস্যার ঝাঁজে সাধক বাসনা ঠাণ্ডা করতে পারেন।
সূর্যের পরেই মনে পড়ে চন্দ্রকে। তিনি নিস্তেজ হলেও নেহাত শক্তিহীন দেবতা নন। সমুদ্রের জলকে টান মেরে পৃথিবীর উপর দিয়ে জোয়ারের ঢেউ দুবেলা ঘোরান, সেই সঙ্গে বায়ুমণ্ডলেও বাতাসের স্রোত চালান।
বায়ু তো দেব-কে-দেব, ভূত-কে ভূত। অদৃশ্য হলে কী হয়, পবনদেবের দাপট যে খেয়েছে সে তাঁকে ভুলতে পারে না। বায়ুর ভৌতিক শক্তিকে মানুষ পাল তুলে নৌকো জাহাজ চালাবার কাজে চিরকাল খাটিয়ে এসেছ; তার উপর, হালে, চাকার মতো পাখা তুলে, পাঁচ রকম কলের মধ্যে, জলতোলা কল তা দিয়ে চালানো হয়ে থাকে, যার সাহায্যে কুয়োর উপকার অনেক গুণ বাড়িয়ে তোলা যায়।
আর আছেন, মেঘের গায়ে যিনি থেকে থেকে চম্কান,—সেই সৌদামিনী। তিনি দেবীও নন ভূতনীও নন; তার মানে তাঁর সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষদের ভালো রকম আলাপই ছিল না। এখন আমরা তাঁকে যুগলরূপা ব’লে চিনেছি। যুগলমিলন হলে তিনি শান্ত অপ্রকাশ থাকেন। মেঘের দৌরাত্ম্যে বিচ্ছেদ ঘটলে, পুনর্মিলনের মুহূর্তে তিনি ক্রুদ্ধ কটাক্ষ হেনে যান, তাঁর বজ্র কখনো বা মানুষের উপরেও এসে পড়ে। সেকালের ভাবুকেরা বজ্রকে ইন্দ্রের হাতিয়ার মনে করায়, বিদ্যুতের কোপকে খেলা বলে ভুল করতেন, তাঁর ক্ষণপ্রভার আড়ালে প্রচণ্ড শক্তি মৌজুদ থাকার খবর তাঁরা জানতে পারেননি।
নামকরণে বিজ্ঞানীরা কিছু বেরসিক। বিজলী যে ভাবেই আমাদের সাক্ষাতে আসুক, সে সতেজে জানান দেয় “আমি আছি”; তবে তার এক ভাবকে হাঁ-ধর্মী অপরকে না-ধর্মী বলা কেন। বরং এই দুই ভাবের দামী-দামিনী গোছের নাম দিলে সাজত। কিন্তু নাম যাই দিন, কাজ আদায়ের বেলা বিজ্ঞানীরা খুব দড়ো। এই দামী-দামিনীকে আলাদা করে রাখলে তাদের মেলার আবেগ তীব্র হয়ে ওঠে একথা জানতে পেরে, সেই আবেগের তেজকে মানুষের কাজে আনার অনেক কলকৌশল বেরিয়েছে। চপলাকে স্থির করে আঁধারকে আলো করা হয়; বজ্রকে গর্জে ঘাড়ে পড়তে না দিয়ে তার কণিকাপ্রবাহকে তারের নালীর মধ্য দিয়ে সুড়সুড় করে যেখানে দরকার সেখানে পাঠানো হয়; বৈদ্যুৎকে মানুষের অশেষ রকম খিদ্মতে লাগানো হয়। তবে ঠিক মতো তোয়াজ না করলে শ্রমিকও বেঁকে বসে— বিজলীর তো কথাই নেই, তাকে স্ট্রাইক করার ফাঁক দিলে প্রাণ নিয়ে টানাটানি।
আকাশ থেকে ফরমাশ-মতো জল ঝরাবার কৌশল পেতে হলে মেঘের জীবনী মনে রেখে সাধনা করতে হয়।
বাতাস বরাবর একটানা বয় না, তা করলে এক জায়গায় হাওয়ার ঘাটতি এক জায়গায় বাড়তি হয়ে গণ্ডগোল বাধত। তাই বাতাস স্তরে স্তরে দিকে দিকে চলে। সূর্যের তাপে সাগর থেকে ভাপ উঠে, জলের ভিতর গোলা নুনের মতো, হাওয়ায় বেমালুম মিশে থাকে। জল হাওয়ার চেয়ে ভারি হলেও জলের ভাপ তার চেয়ে হালকা, তাই জোলো হাওয়া পাতলা হয়ে উপরে উঠে ডাঙার দিকে বইতে থাকে। পাহাড়ে ঠেকে জল ঝরাবার পর হাওয়া শুখিয়েও যায় ঠাণ্ডাও হয়, তাইতে ভারি হয়ে নিচে নেমে সমুদ্রের দিকে ফেরে। আসলে, কিন্তু যাতায়াতের পথ দুটো এত সোজাসুজি নয়,—পৃথিবীর পাক খাওয়া আছে, মেরুর বাঁধা ঠাণ্ডাই আছে, মরুর আগুনের ঝল্কা আছে, সমুদ্রের সামঞ্জস্য—গুণ আছে—এত রকম ক্রিয়ার ফলে হাওয়ার পথ জটিল হয়ে পড়ে।
যেমন করেই চলুক, দুই বিপরীত বাতাসের ঠেকাঠেকি হলে ঠাণ্ডা ভারি হাওয়ার ঠেলায় জোলো হাওয়া আরো উপরে উঠে যায়। পাহাড়ে যারা চড়ে তারা জানে ক্রমে উঠতে থাকলে ধাপে ধাপে কেমন ঠাণ্ডা বাড়ে। তাই ভাপ উঁচুতে উঠলে ঠাণ্ডায় জ’মে আবার জল হতে চায়। কিন্তু চাইলেই তো হয় না, জলের বসবার জায়গা দরকার করে,—যেমন নিচের হাওয়ার জল শীত পড়লে শিশিরবিন্দু হয়ে ঘাসে পাতায় বসে। আকাশে সে রকম জায়গা পাওয়া যায় ধুলো-ধোঁওয়ার কণার উপর, যারা বৈদ্যুৎ সংগ্রহ করায় উপরে চড়ে যেতে পেরেছে। ঠাণ্ডা ভাপ ধুলোর আসনে বসতে পেলে জলের কণা হয়ে দেখা দেয়,—মাটির কাছাকাছি থাকলে তাদিকে বলে কুয়াশা, উপর আকাশে থাকলে মেঘ! কতকগুলি মেঘের কণা মিশে জলের ফোঁটা বাঁধলে আকাশে আর ভেসে থাকতে পারে না, হাওয়ার চেয়ে ভারি হওয়ায় ধরায় ঝরে পড়ে। কিন্তু মেঘের কণার সঙ্গে থাকে, দামী হোক দামিনী হোক, একটি করে বৈদ্যুৎকণা— তারা না মিললে জলের কণারাও মিশতে পায় না। সে অবস্থায় মেঘ মেঘই থাকে, জল হয়ে বর্ষায় না, বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে রঙের বাহার দিয়ে ঘুরে বেড়ায়,—তাতেই কবির মন সরস হয় বটে, কিন্তু চাষার পোড়া প্রাণ জুড়োয় না। বৈদ্যুতের যুগল ধর্ম এই যে, দামীতে দামীতে নয়, দামিনীতে দামিনীতে নয়, মেলে শুধু দামী-দামিনী। তাই মিলনানন্দের বারি ঝরাতে হলে বিপরীত ভাবের বৈদ্ধ্যত ভরা দুই মেঘের সাক্ষাৎ লাভ হওয়া চাই—তবেই বিরহের ঝাঁজ উৎসবের রোশনাই আর দামামা বাদ্যে মেটে।
কিছু কাল আগে, আকাশে ক্রমাগত আতশ-বাজি উড়িয়ে, উপর মুখে কামানের আওয়াজ করে, হাওয়ায়-মেশা ভাপকে জল করার চেষ্টা হয়েছিল। সারাদিন ধুন্ধুমার কাণ্ডের পর, সন্ধ্যে নাগাদ ফোঁটা কতক বৃষ্টি হল বটে, কিন্তু মজুরি পোষাবার মতো মোটেই নয়। বিজ্ঞানীদের কিন্তু মাকড়সার স্বভাব। তাদের মনের মধ্যে যে সব থিওরি ভন্ ভন্ করে বেড়ায় সেগুলোকে ধরা-ছোয়ার মধ্যে আনতে পরীক্ষার যে জাল পাতেন, তা বার বার ছিঁড়ে পড়লেও তাঁরা ছাড়েন না। তাঁদের মহামন্ত্র হচ্ছে try, try, try again! মেঘের কাছে ইচ্ছা-বৃষ্টি-বর আদায় না করে বিদায় নেবেন না, এই ভীষণ পণ করে তাঁরা লেগে আছেন।
তার পর বেরল এরোপ্লেন। তাতে করে উপরে ওঠা তত শক্ত নয়, উপরে নিরাপদে থাকাটা সব সময় ঘটে না।
কেন, মুক্ত আকাশে আবার কিসের বাধা।
এক বিঘ্ন হচ্ছে মেঘ। তার মধ্যে ঢুকে পড়লে দিকভ্রম হতে পারে, দামী-দামিনীর মাঝে পড়ে এক চোট বজ্র খেতে হতে পারে, পর পর ভারি-হালকা হাওয়ার বিভ্রাটে যন্ত্রটি মাটি পানে হঠাৎ ছোঁ মারতে পারে। এই সব বেগতিক দেখে মেঘের সঙ্গে এরোপ্লেন-চালকের লাগল ঝগড়া।
সেই হ্যাপায় পাঁচ রকম পরীক্ষা করতে করতে একজন এরোপ্লেন হাঁকিয়ে মেঘের ভিতর এক বস্তা মুন ছিটিয়ে দিলে, তাতে তিন-চার মাইল-জোড়া মেঘ দেখতে দেখতে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বৃষ্টি আনার হিসেবে এটা অবশ্য উলটা-বুঝা-রাম গোছের হল, কিন্তু অতিবৃষ্টি বন্ধ করার উপায়ও তো ফেলনা নয়।
ক্রমে যুদ্ধের দায় ঠেকে এরোপ্লেন থেকে গাঢ় ধোঁয়া উড়িয়ে নিজপক্ষের সেনাকে শক্রর চোখের আড়াল করার ফন্দি আবিষ্কার হল। সন্মোহন বাণ মেরে অর্জুন যেমন কৌরব মহারথীর দলকে ঘুম পাড়িয়েছিলেন, তেমনি আকাশ থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া ছেড়ে বিপক্ষের চিরনিদ্রার ব্যবস্থাও হতে লাগল। এই ধোঁয়া-চালানো কেরামতির সুবিধে পেয়ে USSR তাকে কাজে লাগাবার উদ্যোগ করলেন— মানুষ মারতে নয় লোকের হিতার্থে।
বিজ্ঞানীর উপর হুকুম হল, “যাও এরোপ্লেনে, অপকে খুশি করে ক্ষিতির জন্যে বক্শিশ নিয়ে এসো।”
তখন চললেন বিজ্ঞানী, মেঘ-কণাদের জোড় মেলাবার বন্দোবস্ত করতে। এরোপ্লেন যখন মেঘরাজ্যে প্রথম চক্কর খেল, তখন সব শুখনো, মেঘের জল মেঘেই লেপ্টে রইল, না লাগল প্লেনের বা চালকের গায়। বিজ্ঞানীর সঙ্গে ছিল বিপরীত বৈদ্যুৎ-ভরা ধোঁয়া ওড়াবার সরঞ্জাম; সে ধোঁয়া ছাড়ার পর, ইল্সে গুঁড়ির ছিটে দিয়ে মেঘ তাকে আশিস্ জানাল। শেষে তিনিও নেমে এলেন, আর রীতিমতো এক পস্লাও বর্ষাল— বেশ যেন স্বাভাবিক বৃষ্টি।
শাস্ত্রে বলে সুখের পর দুঃখ চাকার মতে ঘুরপাক খায়। সৃষ্টির কত রকম জিনিস চাকা ভাবে ঘোরে, ভাবলে চমৎকার লাগে।
ধরো না কেন, নিশ্বাসের সঙ্গে জন্তুরা হাওয়া থেকে অক্সিজেন টেনে নেয়, প্রশ্বাসের সঙ্গে ছাড়ে অক্সিজেন-কার্বন-মেশানো বাষ্প। তাই থেকে গাছগুলো কার্বন খেয়ে নিয়ে পরিষ্কার অক্সিজেন হাওয়ায় ফিরে দেয়। সেজন্যে এই দুই পক্ষ পাশাপাশি বাস করলে থাকে ভালো।আকাশের কথা
আবার উদ্ভিজ্জ না খেলে পশুপাখি শরীর রাখার মসলা পায় না, তা থেকে যা দরকার নিয়ে বাদবাকি ময়লা বলে ফেলে দেয়। সেই ফেলা জিনিস দিয়ে মাটি উদ্ভিদকে সার যোগায়। আরো দেখো গ্রামবাসী শহরকে পেটের খাবার সরবরাহ করে, শহর পাড়াগায়ে মনের আহার পাল্টা পাঠায়। শিষ্যকে গুরু নিজের সম্পদ দিয়ে আনন্দিত করেন, শিষ্যের আনন্দ দেখে দ্বিগুণ আনন্দে আরো দিতে থাকেন, আনন্দের এই চক্রবৃদ্ধি বাড়ে দুজনে মিলে ভূমানন্দের সন্ধান পান।
কিন্তু কিসের থেকে কোথায় এসে পড়া গেল? শিবের গান তো করতে বলা হয়নি এখানে বলবার কথাটা এই ছিল— নদীকে পুষ্ট করে বৃষ্টি, বৃষ্টিকে আনতে হলে বৈদ্যুত লাগে, আবার পুষ্ট নদীর সাহায্যে বিজলী তৈরি হতে পারে।
নদীর জল চালাচালির সময় USSR এই চক্রের কথা ভোলেননি। যেখানে, নদীর প্রপাত আছে, যেখানে লম্বা ঘোরালো বাঁকের দুই মুড়ো খাল কেটে জুড়ে দিলে জলের তোড় বাড়ানো যায়, সেই সেই জায়গায় একটা করে বিজলী-তৈরির শক্তি-ঘর তোলা হচ্ছে। এক পক্ষে যেমন নদীর জলের জাল, অন্য পক্ষে তেমনি বৈদ্যুত তারের জাল; কোথাও কখনো কম পড়লে, যেখানে বেশী—সেখান থেকে অভাব পূরণ হতে পারবে।
এবার তাহলে, আর খাল-কেটে বাঁধ বেঁধে নদীর জলকে খোশামোদ ক’রে আনা নয়। শত-হস্তীর সহস্র-ঘোড়ার শক্তি ধরে এমন সব বৈদ্যুতপম্প বসে যাবে, যারা মাত্র সুইচের ইঙ্গিত পেলে, পাহাড়ী ঝরনাকে লজ্জা দিয়ে, এখাল থেকে ওখালে, নিচের নদী থেকে উপরের হ্রদে হুড়হুড় করে জল তুলবে ফেলবে।
আরো উপরের কথা হল, আকাশ থেকে সোজাসুজি জল নামানো।
হাওয়া যতই শুখিয়ে থাক্ না কেন, তাতে বেশ একটু জলের ভাপ থেকেই যায়। যখন মানুষের সাধ্যি এমন হবে যে, অতিরিক্ত খরচ না করে যেখানে ইচ্ছে আকাশের জল টেনে নামাতে পারবে, তখন ইন্দ্রের পৌরাণিক কর্তব্য আধুনিক মানবে নিজেই সেরে নিতে পারবে। তাহলে দেবরাজ শখের নাচগান নিয়ে মশগুল থাকার সময় “গেলুম রে, মলুম রে” রবে কেও তাঁর মজলিসের রসভঙ্গ করতে দ্বারস্থ হবে না।
তবে সাবধান। অব্যবস্থিত রাজ্যে এবিদ্যে খাটাতে গেলে বিজ্ঞানী উভয় সংকটে পড়ে যেতে পারেন। যার বাড়ি বিয়ে, সে আবদার করবে আকাশ পরিষ্কার ঝক্ঝকে থাক্; ওদিকে যে-চাষার খেত খাঁ খাঁ করছে সে ঝম্ঝমে বৃষ্টির জন্যে আপসা-আপসি করবে। মাঝে থেকে বিজ্ঞানী-বেচারীকে এক পক্ষ না এক পক্ষের ঠ্যাঙার গুঁতো না খেতে হয়।
USSR-এ সে হাঙ্গামার ভয় নেই। তাদের পঞ্চ বার্ষিক সংকল্পের খবর আগে থাকতেই সকলকে জানিয়ে দেওয়া হয়। যেদিন না বর্ষালে কারো ক্ষতি নেই, উৎসবের পক্ষে সেই দিনই শুভদিন ধরা হবে; আকাশের কোন্ ভাগে কোন্ গ্রহতারা দেখা দিয়েছে তাতে মামুষের ভাগ্যের ওলট-পালট কল্পনা করার দরকার হবে না। মনের মিলে পরস্পরের হিতসাধনে মানুষ যে যে জায়গায় জমায়েত হয়, সেগুলিকেই পরম তীর্থ বলে মানা হবে; ভিড় ঠেলে মরতে মরতে এ-ঘাটে ও-ঘাটে ডুব দিয়ে, মন বা কপাল ফেরাবার দুরাশা মনে পোষা হবে না। যে বর্ষণে দেশশুদ্ধ লোকের অন্নসংস্থান হবে, তার জন্যে দেবতার খামখেয়ালী মর্জির অপেক্ষা থাকবে না, স্তবস্তুতির বাজে খাটুনি বেঁচে যাবে, যাদের গরজ তাদেরই প্রতিনিধি নিজগুণেই যথাযথ ব্যবস্থা করবেন—এই হচ্ছে USSR-এর সমীকরণ যজ্ঞের নববিধান।পাতালের কথা
পাহাড় যেন জলস্থল আকাশপাতাল সবেরই বাইরে, অথচ সকলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা। পাতালে ভিত, আকাশ ফুঁড়ে উঠেছে মাথা, প্রকাণ্ড ভাল্লুকের মতো, পিঠে জঙ্গলের রোঁয়া নিয়ে ভুঁইয়ে হাতপা ছিতরে সে উপুড় হয়ে আছে। নিজের উপর মেঘের বর্ষণ টেনে নিয়ে সেই জল সমুদ্রের দিকে গড়িয়ে দিচ্ছে, সেই সঙ্গে গা-ধোয়া মাটি দিয়ে নিচের সার-চোষা মাঠগুলোকে তাজা রাখছে।
সমুদ্রকে রত্নাকর বলে বটে, কিন্তু রত্নের ভার নিয়ে কোনো ডোবাজাহাজের ভিতর থেকে ছাড়া, সমুদ্রতলা থেকে রত্ন উদ্ধারের খবর তো শোনা যায় না। আসল রত্নাকর হল পাহাড়—তার পেটের ভিতর ছাল-তোলা পিঠের উপর, আশপাশের খাঁজে-গর্তে যত রত্নের কাঁড়ি।
আজকাল, অবশ্য, পাঁচ-রঙা পাথর হাতে পায়ে গলায়, ফোঁড়া নাক-কানে ঝুলিয়ে “আমি কী হনু” গোছের হাবভাব দেখাবার দিন চলে যাচ্ছে। গবর্নমেণ্টের কৃপায় মুদ্রার কাজও সোনা রুপো ছেড়ে কাগজ দিয়ে সারা হচ্ছে। তবুও নানা কাজের ধাতুগুলোকে রত্নই বলতে হয়। আধুনিক হিসেবে এগুলি ভূতও (ভৌতিক পদার্থের মৌলিক উপাদান) বটে।
মাত্র পাঁচ ভূতের দিন আর নেই, বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত ৯২টা ভূত খুঁজে পেয়েছেন, ক্রমে আরো হয়তো পাবেন। তার মধ্যে চলতি কথায় যাকে ধাতু বলে তা তো আছেই, এমনও অনেক জিনিস আছে যাকে ধাতু বলা হয় না; তাছাড়া আছে রেডিয়াম জাতীয় পদার্থ, যাদের পরমাণু ক্রমশ তেজ হয়ে ফেটে ফেটে বেরিয়ে পড়ে, যেজন্যে তাদিকে রেডিও-তেজী (radio-active) বলা হয়।
সে-হিসেবে পাহাড়কে ভূতালয় বলাও চলে। শোনা যায় পাহাড়ী জাতদের বড্ড ভূতের ভয়—কিন্তু সে-ভুত এ-ভূত নয়।
কখনো কখনো রত্নের খনি দৈবাৎ ধরা পড়ে। রুশের উরল-পাহাড়ে একবার একটা বড়ো গাছ ঝড়ে উপড়ে পড়ে। পাহাড়ী চাষারা তার শিকড়-জড়ানো দুএকটি পান্নার পাথর পেয়ে, শিকড়ের গর্তের মধ্যে আরো খুঁড়তে খুঁড়তে পান্নার খনিতে পৌঁছে গেল। মার্কিন দেশে এক ডোবার উপর তেল ভাসছে দেখে নল চালিয়ে পাথর-তেলের উৎস বেরিয়ে পড়ল। আমাদের দেশেও পাহাড়ের গায়ে রাস্তা করতে বা পাথর কাটতে মাঝে মাঝে নানান ধাতুর সন্ধান মেলে।
কিন্তু দৈবের উপর নির্ভর করে বসে থাকলে আবিষ্কারের কাজ কচ্ছপের চালে চলে, বিজ্ঞানকে সহায় করলে খরগোশের মতো দৌড়তে পারে। টাকার ব্যাগ হারিয়ে এলে তাকে হঠাৎ কোথাও কুড়িয়ে পাওয়ার আশা খুব কম, বিধিমতে খুঁজতে গেলে ভাবতে হয়, কোথায় যাওয়া হয়েছিল, কোন পথে আসা হয়েছিল, কার গাড়িতে চড়া হয়েছিল, মাটির পানে চোখ রেখে সেই পথে ফিরে গিয়ে, সেই গাড়োয়ানের খবর করে তন্নতন্ন করে দেখতে হয়। খনি খোঁজারও সেই নিয়ম।
ফিন-জাতের দেশ ফিন্ল্যাণ্ড-এ এক বিজ্ঞানী কতকগুলো বড়ো বড়ো তামার পাথর দেখতে পান। সেটা পাহাড়ী জায়গা নয় যে, তামার খনি থাকবে। তাহলে সে পাথর এল কী ক’রে। আকাশ থেকে নিশ্চয়ই পড়েনি; তবে জলের তোড়ের সঙ্গে গড়িয়ে আসা অসম্ভব নয়।
কিন্তু নদী কই।
এখন না থাক্, এক সময় ছিল, ছড়ানো মুড়ি দেখে অনুমান হয়।
কেন।
তবে গোড়া থেকে বলি শোনো।
উচু পাহাড়ের, কিম্বা মেরুর কাছাকাছি দেশের পাহাড়ের মাথা এত ঠাণ্ডা যে, সেখানকার বরফ মোটেই গলতে পায় না, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বরফী-ধারা (glacier) হয়ে পৃথিবীর টানে আস্তে আস্তে নামতে থাকে।
মনে করো এক চাংড়া বরফ এক-ফেরা সরু তার দিয়ে ঝোলানো আছে। চাংড়াটার ভারে নিচের তারের ঠিক উপরের এক লাইন বরফ গলে যাবে, সেই ফাঁকে তারটা বরফের ভিতর কেটে ঢুকবে। যেমন ঢোকা, তারের নিচে আর চাপ থাকবে না, গলা জলটুকু আবার বরফ হওয়ায় ফাঁকটা বুজে যাবে। এমনি করে তারটা ধীরে ধীরে বরফের ভিতর দিয়ে কাটার চিহ্ন না রেখেই উঠবে। শেষে তারটা একেবারে উঠে গেলে চাংড়াটা দুটুকরো না হয়ে আস্তই তার ছেড়ে নিচে পড়বে।
পাহাড়ের খোঁদলের মধ্যে বরফীনদী সেই ভাবেই চলে। দুই কিনারার চাপে ধারে ধারে একটু করে একবার গলে, গলার সময় একটু নামে, চাপ উতরে গেলে সে জায়গা আবার জমে যায়, আবার চাপ পড়ে। এই গলা জমা ভিতরে ভিতরে চলতে থাকে, বাইরে থেকে দেখলে সমস্তটা নিরেটভাবেই ক্রমে নিচের দিকে নামে।
ছোটো বড়ো ঢিলে পাথর পথে যা পায় তাই আঁকড়ে বরফীনদী সঙ্গে নিয়ে চলে, সেগুলো তলায় কিনারায় আঁচড়ের দাগ রেখে যায়। নিচের গরমে পৌঁছে নদীর বরফ গলে জল হলে পর, বড়ো পাথরগুলো সেখানেই থেকে যায়, ছোটোগুলো জলের তোড়ে কিছু দূর ঘসড়াতে ঘসড়াতে গোল হয়ে যায়। শেষে জমির ঢাল কমে গেলে স্রোতও মন্দ হয়ে যায়, তখন নদী বালি মাটির কণার চেয়ে ভারি আর কিছু টেনে নিতে পারে না, তখন নুড়িগুলোকেও ফেলে যায়।
এই বৃত্তান্ত মনে থাকায়, যে-বিজ্ঞানী সেই তামার পাথর দেখেছিলেন তিনি নুড়ি দেখে, আশপাশের পাথরের গায়ে আঁচড়ের দাগ দেখে সেই পুরাকালের বরফীনদীর পথ ধরে চলতে লাগলেন, ৪০।৫০ মাইল যেতে না যেতেই পাহাড়ী জমির মধ্যে তামার খনি পেয়েও গেলেন।
তবু থাকে একটা সমস্যা। এক সময় যেখানে বরফীনদী ছিল, আজ সেখানে মানুষের বসবাস,—এমনটা হয় কী করে।
এ নদী হচ্ছে সেই কল্পের যখন পৃথিবীর উত্তর ভাগের সবটাই মেরুর মতো বরফের রাজ্য ছিল। ক্রমে ভৌতিক ক্রিয়ার গতিকে বরফী যুগ কেটে গিয়ে য়ুরোপ-এসিয়ার উপর ভাগ মানুষ থাকার উপযোগী হল। যদি কালে ভূখণ্ডের নড়াচড়ার গতিকে সমুদ্রের মধ্যে গাল্ফ্ স্ট্রীম্ নামের গরম জলের যে ধারা চলাচল করছে তার স্রোত অন্য দিকে ঘুরে যায়, তখন ইংল্যাণ্ড আইস্ল্যাণ্ড হয়ে যাবে,—কিন্তু তখনো কি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য জমাট বেঁধে থাকবে।
পাহাড়ের উপরকার কোনো পাথরের গায়ে হাত দিলে সেটা সেখানকার হাওয়ার মতোই ঠাণ্ডা ঠেকবে। কিন্তু পাহাড়ের ভিতরটা বিলক্ষণ গরম। রেললাইন চালাবার জন্যে যখন সুরঙ্গ কাটে, পাহাড়ের মাঝামাঝি পৌঁছে এত তাত বাড়ে যে কাজ করাই মুশকিল। মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে চললে সেখানেও গরম, যত তলানো যায় তত তাপ। শীত দেশেরও গভীর খনিতে যারা কাজ করে তারা গায়ে জামা রাখতে পারে না। মার্কিন দেশে একটা পাথর-তেল তোলার নল দুমাইল নিচে পর্যন্ত নামানো হয়েছে, তার তলায় জল আপনি স্টীম হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা বলেন ১৫।২০ মাইল নিচে পাথর-গলা তাত।
মোট কথা, আমরা যে ভূমির উপর বাস করি, বড়ো বড়ো ইমারত তুলি, যাকে স্থাবরের আদর্শ বলে মানি, সেটা গলা ধাতুর উপর ভাসছে বললেও হয়। ২০।২৫ মাইল নিচে যা কিছু আছে—শোনা, রুপো, লোহা, সীসে, টিন—সবি গলা অবস্থায়, তবে উপরকার ভীষণ চাপের কারণে টগবগ করে না ফুটলেও তাতে তরলতার কিছু কিছু গুণ আছে।
বিজ্ঞানীরা এই পাঁচ মিশল গলা পদার্থটাকে magma বলেন, উপরে উঠে ঠাণ্ডা হলে এর থেকে যত রকম ধাতু পাথরের ও অবশেষে মৃত্তিকারও জন্ম হয়, সে খাতিরে আমরা একে মাতৃকা বলতে পারি।
এই মাতৃকার তলায় কোন্ প্রচণ্ড চুলোয় আগুন জ্বলছে?
তলায় চুলোই নেই। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে, আরো ৫০।৬০ মাইল নিচে গেলে যত চাপ বাড়ে তত তাপ বাড়ে না। উত্তাপের কারণ মাতৃকার মধ্যেই আছে—এক ঝাঁক সেই রেডিও-তেজী ধাতুর পরমাণু, যারা ক্রমান্বয় ফেটে ফেটে বেরচ্ছে, তারাই এই ভীষণ আঁচ জাগিয়ে রাখে। এদেরই কল্যাণে পৃথিবী চাঁদের মতো জুড়িয়ে গিয়ে প্রাণীপোষার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েনি।
গড়ে ২০ মাইল নিচে এই রেডিও-তেজী ধাতুর ভারি ভিড়। আরো ৬০ মাইল নেমে গেলে এগুলির চিহ্ন বড়ো একটা পাওয়া যায় না, সেখানকার চাপে পাথর তরল হতে পায় না। সুতরাং ৬০ মাইল গভীর মাতৃকা সাগরের শক্ত পাথরের তলা আমাদের পায়ের ৮০ মাইল নিচে পৃথিবীর ব্যাসের মাপ ৮০০০ মাইল, কাজেই কেন্দ্র থেকে ভূপৃষ্ঠ ৪০০০ মাইল তফাত। এই ৪০০০ মাইলের উপরকার ৮০ মাইল স্তরের এইটুকু খবর পাওয়া গেছে।
জলের সমুদ্রে যেমন জাহাজ, তেমনি পৃথিবীর উপরের স্তরটা, ডাঙাই হোক, পাহাড়ই হোক, আর সাগরজলে ভরা খাদই হোক, সবই সেই মাতৃকার উপর দোলা খাচ্ছে; তবে দোলের তালটা খুব বিলম্বিত। ডাঙার তলার পাথরের ভিতটা যত ভারি, সমুদ্রের তলার ভিতটা তত নয়, সবচেয়ে ভার পাহাড়শ্রেণীর তলার। ভার অনুসারে এসব মাতৃকার মধ্যে কম-বেশি ডুবে আছে।
কিন্তু উপরের ওজন বরাবর এক রকম থাকে না। জলের ক্রিয়ায় পাহাড়ের উপরকার স্তর দিন-কে-দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে, তার গা থেকে খসা মাটিপাথর, আরো পথে কুড়ানো যা-কিছু নিয়ে নদীগুলো অবিশ্রান্ত সমুদ্রে ঢেলে চলেছে। তার ফলে পাহাড়গুলো হয়ে যাচ্ছে হালকা, নদীর মোহানার সামনেটা হয়ে আসছে ভারি। সেজন্যে, ধীরে ধীরে হলেও, পৃথিবীর ভিন্ন অংশের ওঠা নামা চলছেই। যেমন, যে নৌকোটায় যাত্রী ওঠে সেটা জলের ভিতর একটু নেমে যায়, যার থেকে যাত্রী নামে সেটা একটু ভেসে ওঠে। তাছাড়া তাপেরও হেরফের চলতে থাকে।
পাত্রে ভরা জলের উপর চাপ দিলে উপচে পড়ে, ঢাকা থাকলে ফাঁক দিয়ে ছিটকে বেরোয়। জলভরা হুঁকোয় টান না দিয়ে ফুঁ দিলে জল নল দিয়ে ফোয়ারা হয়ে ওঠে। সেইরকম, কোনো ভূখণ্ডের ভার কিম্বা তলার তাত বেড়ে উঠলে, তার মাতৃকার উপর চাপ পড়ে, তাতেগলা ধাতুগুলো এপাশ ওপাশ সরার জায়গা না পেয়ে উপরের পাথরের ফাটলের মধ্যে দিয়ে উঠে পড়ে, শেষ পর্যন্ত ফাঁক পেলে ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে পড়ে। দুপাশের পাথর কম মজবুত হলে সেগুলোকে সুদ্ধ তুলে পাহাড় করে দেয়।
এরকম ঠেলে-ওঠা জায়গার মধ্যে বিস্তর ফাটল থেকে যায়, তাই পাহাড়ের মধ্যে দিয়েই বেশির ভাগ মাতৃকা উপরে বেরিয়ে পড়ে, সেখানে ঠাণ্ডা হলে পাথর হয়ে জমে যায়। ফাটলের ভিতরে ও উপরে হালকা, নিচে ভারি স্তরে স্তরে থিতিয়ে থাকে। তাতেই জন্মায় এক এক স্তরে এক এক রকম পাথরের খনি।
ফাটলে ওঠার সময় মাতৃকা কোনো গুহার জমা জলে ঠেকলে, তার তাতে সে জল স্টীমের ফোয়ারা হয়ে মাটির ফাঁক ফুঁড়ে বেরয়, কিম্বা ধাতুগোলা গরম জলের উৎস হয়ে দেখা দেয়
যদি গোড়ার চাপের জোর খুব বেশি হয়, যাতে ফাটলের উপরকার মুখ আরো ফাঁক হয়ে মাতৃকার স্রোত তোড়ে উথলে ওঠে, তাহলে সেরকম ফাটা-মুখ পাহাড়কে বলে আগ্নেয়গিরি।
বেরবার মুখ যদি ছোটো হয় বা মোটেই না থাকে, তাহলে চাপের মধ্যে ঠাণ্ডা হলে তরল ধাতুগুলো ফটিকের মতো দানা বেঁধে ধনীর পছন্দসই পাঁচ রকম মণি হয়।
এই হল এক ধরনের খনির জন্মবৃত্তান্ত। এ কাহিনীর পরিচ্ছেদে পরিচ্ছেদে ভূখণ্ডগুলোর নড়াচড়ার সময়, ভূমি কেঁপে কেঁপে উঠে মানুষের তৈরী ঘরবাডি, কখনো বা মানুষের প্রাণসমেত, নষ্ট করে। ভূতের এই উপদ্রবকে মানুষের পাপে দেবতার কোপ বলে কেউ কেউ ব্যাখ্যা দেন। জনকয়েকের অপরাধে স্থানবিশেষের আবালবৃদ্ধবনিতাকে সাজা দেওয়ার রোগ মানুষের নেতাদের মাঝে মাঝে দেখা যায় বটে, কিন্তু এরকম অদ্ভুত বিচারনীতি দেবচরিত্রে আরোপ করায় তাঁদের মহিমা কতদূর বাড়ানো হয়, সে বিচারের ভার শ্রোতার উপর রইল।
ধাতুপাথর ছাড়া অপর পদার্থের খনি জন্মাবার ধারা অন্যরকমের।
মাতৃকায় ভাসা দেশগুলোর ওঠানামার গতিকে কোনো ডাঙা যায় সাগরতলায় নেবে, কোনো সাগর আসে ডাঙার উপর চড়ে, যে ডাঙা তলিয়ে যায়, তার উপর সমুদ্রের অগুনতি শামুক-ঝিনুক-জাতীয় প্রাণীরা মরার সময় তাদের চুনের খোলস, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী সমুদ্রের তলার উপরে ফেলতে থাকে। এভাবে কয়েক যুগ কেটে গেলে পর, যখন সে সাগরের জল আবার সরে পড়ার পালা পড়ে, তখন তার সেই তলা আবার হয় ডাঙা, কিন্তু আগেকার সে ডাঙা নয়, এবার চুনের পুরু পর্দা প’ড়ে তার খালদাঁড়া সব একাকার।
সাগরের যেখানে কোল ছিল সেখানে পড়ে নুনের পলি।
সাগরে বা হ্রদে নদীর মোহানা থাকায় গুচ্ছের শেওলা গজিয়েছিল, দুধারের পেঁকো মাটিতে ভারি জঙ্গল উঠেছিল। সেসব জায়গা তলিয়ে যাবার পর তাতে গাছের সংগ্রহকরা সূর্যের তেজ ভরা কয়লা, পাথর তেল জন্মায়।
এরকম নতুন-ওঠা ডাঙাগুলো বালি মাটি চাপা পড়লে এই পদার্থগুলো যে যার খনির মধ্যে থেকে যায়।
এখন কথা হচ্ছে, উপর থেকে কেমন করে জানা যাবে, পাহাড়ের ভিতর কোন্খানে ফাটল ছিল, কোন্টার মধ্যে কী কী পাথরইবা জমা হয়ে রয়েছে। আন্দাজে এখানে ওখানে গর্ত করে খুঁজে বেড়াতে গেলে বিস্তর খরচ। শক্ত পাহাড়ী পাথর কুরতে হীরে-বসানো যন্ত্র লাগে। সে খরচ বাঁচাতে হলে বিজ্ঞানীকে মগজ খাটিয়ে যন্ত্র বার করতে হয়।
এক যন্ত্র উদ্ভাবন হয়েছে মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম ধরে—যে আকর্ষণ থাকায় আমরা ঘরের দেয়ালে বেড়াতে পারিনে, থাকতে হয় মেঝের উপর। শুধু পৃথিবী সকলকে টানছে তা নয়, প্রত্যেক জিনিস প্রত্যেককে টানছে, তবে ছোটো ছোটো টানের ফল সাদা চোখে ধরা যায় না। সূক্ষ্ম নিক্তির মতো এই যে যন্ত্র, এটা টানের অল্প হেরফেরে সাড়া দেয়, মাটির নিচে কোনো ভারি পাথরের স্তর থাকলে সেদিকে তার কাঁটা হেলে পড়ে। এই যন্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ালে কাঁটার ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় কোন্ জায়গার তলায় ধাতু পাথর জমা আছে।
লোহার মতো চুম্বক-টানা ধাতুর খবর কম্পাসের কাঁটাও দিতে পারে। উপর-নিচে দুলতে পারে এ ভাবে চুম্বক-কাঁটাটাকে ঝোলালে, সে মাটির নিচে এ জাতীয় পাথর যেখানে আছে সেদিকে ঝোঁকে—তার ঝোঁকার রোখে লাইন টানলে সে লাইন ধাতুর সন্ধান বাৎলে দেবে। দু তিন জায়গা থেকে এ রকম লাইন টানলে তারা যেখানে মিলবে সেখানে পাথরও মিলবে। এ লাইনের উলটো দিকে থাকতে পারে নুন বা চুন বা কয়লার খনি।
ভূমিকম্পের মতো শত্রুপক্ষের কাছ থেকেও এ বিষয়ে সহায়তা পাওয়া যায়। ভূকম্প মাপার সিসমগ্রাফ (seismograph) নামে এক রকম কম্পমান যন্ত্র আছে, সে ভূমির কাঁপুনির রকম অনুসারে কাগজে আঁকজোঁক কাটে। তার লিখন যে পড়তে জানে, সে কাগজে-আঁকা রেখার খেলা দেখে বুঝতে পারে কোন্ দিকে কত দূরে কাঁপুনি শুরু হয়েছিল, কোন্ পথ দিয়েই বা সেটা ঘুরে ফিরে কম্পমান যন্ত্রে পৌঁছেছে।
মেঘ ডাকার আওয়াজের কথা ভাবলে এ যন্ত্রের ক্রিয়া বোঝার কতক সুবিধে হতে পারে। দুপাশ থেকে দামী-দামিনীর দল যখন বজ্রনিনাদে মাঝের বায়ুস্তর ফুঁড়ে এসে মেলে, তখন কাছাকাছি শ্রোতার কানে প্রথমে তার কড়াৎ শব্দ বাজে। তার পরে আসতে থাকে তার প্রতিধ্বনি—গুড় গুড় গুড় গুড় গুড়ুম গুডুম গুডুম গুড়ুম। প্রথম গুড়গুড়-গুলো হল কাছের মেঘ, মাঝের মেঘ, ক্রমশ দূরের মেঘ থেকে সেই গোড়ার কড়াৎ-টা পর পর ঠিকরে আসার শব্দ। যখন এমন হয় যে দূরের মেঘ থেকে, আর কাছের এ-মেঘ ও-মেঘ সে-মেঘ ঘুরে, দুই আওয়াজ একসঙ্গে কানে পৌঁছয়, সেবারে হয় গুড়ুম; যে-বারে এক সঙ্গে তিন চার দিক থেকে আওয়াজ এসে পড়ে, সেবার হয় জানলা-দরজা-কাঁপানো বড়ো গুড়ুম; তার পরে সেই গুড়ুমের আওয়াজ এদিক-ওদিক থেকে ঠিকরে ছোটো ছোটো গুড়ুমে অবসান হয়। সমজদার হয়তো এ সব আওয়াজ শুনে, আকাশে কিভাবে মেঘের চাপগুলো সেজে আছে তার একটা ছবি পেতে পারে।
একই ভূধাক্কার কাঁপুনি সেই রকম দফে দফে আসে,—যন্ত্রে প্রথম পাওয়া যায় যেগুলি সোজাসুজি সব চেয়ে ছোটো পথে এসেছে; পরে আসে যেগুলি পৃথিবী ঘুরে উল্টো দিক থেকে পৌঁছয়; শেষে হাজির হয় যেগুলি প্রথম একপত্তন নিচের দিকে তলিয়ে গিয়ে পরে পাতালের কোনো পাথরে ঠেকে ঠিকরে উপরে ফিরে আসে। শেষের এই কাঁপুনিগুলি পাতালের অনেক খবর এনে দেয়।
তবে কি তলার অবস্থা জানতে হলে ভূমিকম্পের আসার আশে হাঁ করে বসে থাকা লাগবে।
তা কেন। মাটিতে গর্ত করে তার ভিতর বারুদ বা ডাইনামাইট ফাটালে তো ভূমিকে যখন ইচ্ছে যত ইচ্ছে কাঁপিয়ে তোলা যায়। বারুদ ফাটিয়ে লাগাও যন্ত্র, ওস্তাদের কাছে ধরে দাও তার লেখা, সে বলে দেবে মাটির নিচে কোথায় কত দূরে কী রকম ধরনের পাথর আছে।
আবার আমাদের ধুয়োয় এসে পড়া গেল। বৈজ্ঞানিক বিদ্যে তো USSR-এর এক-চেটে নয়, তবে কেন এমনভাবে কথা হচ্ছে যেন এ বিষয়ে তাদের কিছু বিশেষত্ব আছে।
চলতি তন্ত্রে রাজা-প্রজা ধনী বিজ্ঞানী সবাই কাজ করে নিজের নিজের লাভের আশায়। জমির মালিক প্রায়ই বিলাসী, বিজ্ঞান সম্বন্ধে উদাসীন, অপরকে খাটিয়ে নিতে মজবুত, পারিশ্রমিক দেবার বেলায় কষা। বিজ্ঞানীও নিজের বহু কষ্টে পাওয়া বিদ্যের ন্যায্য মূল্য না পেলে তাকে ছাড়তে চান না, পেটেই রেখে দেন। যাঁরা নির্লোভের বড়াই করেন, আমাদের সেই তাপস ফকিররাও ওষুধবিসুধ পেলে যে রকম আগলে রাখেন, একা বিজ্ঞানীর উপরই বা কটাক্ষ করা কেন। এই লাভ বা প্রতিপত্তির মোহে কত ভালো ভালো আবিষ্কার সাধারণের চির-সম্পত্তি হতে পায়নি তার কি ঠিক আছে।
বিপ্লবের আগে থেকেই রুশের কর্স্ক (Kursk) জেলার লোকের নজরে ঠেকত যে, সেখানকার সব কম্পাসের কাঁটা নিচের দিকে একটু ঝুঁকে থাকে। এর কারণ বার করার জন্যে লীষ্ট (Leist) নামে এক জর্মান পণ্ডিতকে সকলে ধরে পড়ল। সে বিজ্ঞান-পাগল এ কাজে লেগে গেল তো বারো বৎসর টানা খেটেই চলল।
তার হাতে ক্রমশ ৪৫০০ দাগের এক জটিল নকশা গড়ে উঠল, যার এক এক দাগ ফেলতে তাকে চৌপর দিন ধুলোয় জঙ্গলে হাঁটাহাঁটি করতে হয়েছে, কারণ দাগ বেঠিক পড়লে তাতে অকাজ ছাড়া কোনো ফল হবে না। যারা কম্পাস বয় তাদের কোটে লোহার বোতাম বা পকেটে চাবির গোছা, বা কাছাকাছি লোহার যন্ত্রপাতি থাকতে কম্পাসের কাঁটার লাইনে দাগ কাটলে ভুল হবে।
হাড়ভাঙা খাটুনির পর তো নকশা দাঁড়াল। বাকি রইল পাঁচ জায়গায় গত করে নকশার লিখন ক্ষেত্রে যাচানো।—কিন্তু তার টাকা আসে কোত্থেকে।
খনি বেরলে তো জমিদারদের লাভ। কিন্তু নকশা এত বড়ো জায়গা দেখাচ্ছে, যা অনেক জমিদারের এলাকায় চারিয়ে পড়ে। অথচ মিলেমিশে কাজ করার অভ্যেস জমিদারদের আদবেই নেই, বিজ্ঞানের তাঁরা কোনো ধার ধারেন না; এক মুদ্রা বার করলে সেটা হাল-ফিল দু মুদ্রা হয়ে ফেরা চাই, এই এক তত্ত্ব তাঁরা নিশ্চয় জানেন।
কাজেই অনেক কষ্টে যদি বা পরীক্ষার জন্যে তাঁরা চাঁদার টাকা কবলালেন, তো মেওয়া ফলার সবুর তাঁদের সইল না, কাজ শেষ হবার আগেই চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। হতাশ পণ্ডিত তো পাত্তাড়ি গুটিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে না খেতে পেয়ে মারা গেল। তখন সেই নকশা পড়ল জর্মান বিশেষজ্ঞদের হাতে। সেটা যে কত বড়ো গুপ্ত ধনের সিন্দুকের চাবি, সে কথা তাঁদের বুঝতে বাকি রইল না।
ইতিমধ্যে রুশের বিপ্লব আরম্ভ হয়ে গেছে। জমিদার আর নেই, রাষ্ট্র চালাচ্ছেন USSR। ঐ নকশার মূল্য লাখে লাখে আদায় করার আশায় সেই জর্মান বিশেষজ্ঞের দল রুশে চলে এলেন
কিন্তু USSR নিজের গুপ্ত-সিন্দুকের চাবি পরের কাছে ঠকে কিনবেন কেন,—তাঁরা কি চাবি গড়তে জানেন না। এক পণ্ডিতের জায়গায় তাঁরা লাগিয়ে দিলেন এক ঝাঁক বিজ্ঞানী; দেখতে দেখতে বেরিয়ে পড়ল কোটি কোটি মন লোহায় ভরা এক প্রকাণ্ড খনি। তাতে USSR-এর এক মস্ত অভাব মিটে গেল, কারণ বাইরের রাজ্য সকলেই বিরুদ্ব-পক্ষ, তাদের কাছ থেকে ডবল দাম দিয়ে লোহা কিনতে হচ্ছিল।
এসব ব্যাপারের মজাটুকু এই যে, ভারতের ঋষিদের বাণী দূরে থাক্, USSR তাঁদের নামও শোনেননি, অথচ কাজে তাঁদের কথার ব্যাখ্যা অজানতে করে চলেছেন। উপনিষদে ত্যাগ করে ভোগ করার কথা যা বলা হয়েছে, বিষয়ীর কাছে তার কোনো মানেই হতে চায় না, বড়ো জোর তাদিকে এইটুকু বুঝিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে ব্যাঙ্কে টাকা তোলা থাকলে ভোগে আসে না, খরচ করলে তবেই সেটা মূলধন হয়ে ভোগের উপায় জন্মাতে পারে। ওদিকে যাঁরা বৈরাগ্য-রোগ-গ্রস্ত তাঁরা ভুলে যান যে আনন্দসম্ভোগের আসল উপায় শিখিয়ে দেওয়াই ঋষির উদ্দেশ্য, মনে করেন বুঝি ত্যাগের গুণগানই করা হচ্ছে।
USSR কিন্তু ঠিক বুঝেছেন, কাজেও দেখাচ্ছেন যে, যা ত্যাগ করা দরকার সেটা হচ্ছে ব্যক্তিগত ভোগের মোহ, যাতে একের লোকসান বিনা আরের লাভ হয় না, যেজন্যে বিষয়ে বিষ মাখানোই থাকে, তাই নড়তে চড়তে লাগে ঝগড়াঝাঁটি, মানুষের উন্নতির দরজা থাকে বন্ধ। এই মোহের হাত থেকে উদ্ধার পেলে তবেই সম্ভব হয় দেশসুদ্ধ লোকের সম্ভোগ, যাতে ভোগ্যবস্তু সকলের ভাগেই বেড়ে ওঠে, সমবেত ব্যবস্থার গুণে বিবাদের জড় মরে যায়, মনকে উচু স্তরে ওঠানোর পথ খোলসা হয়