বিশ্বমানবের লক্ষ্মীলাভ (১৯৪০)/প্রথম পালা
বিশ্বমানবের লক্ষ্মীলাভ
প্রথম পালা
দরিদ্রনারায়ণের মোহভঙ্গ
বেদের গল্প
য়ুরোপে-এসিয়ায় পৃথিবীর ষষ্ঠাংশ জোড়া প্রকাণ্ড রুশমহাদেশে যুগান্তর হওয়ার আগে, তার প্রায় সাত ভাগের এক ভাগ ছিল মরু, তাও বাড়তেই চলেছিল। মরু বলতে জনশূন্য জলহীন বালি ধু ধু করার ছবি মনে আসে। আসলে, কিন্তু, দৃশ্যটা তত ফাঁকা নয়। USSR-এর কথা যখন হচ্ছে, তখন রুশের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা-চওড়া “কারা-কুম” (কালো বালি) মরুর কথাটাই ধরা যাক।
উপরে তো বালি, কিন্তু কিছু দূর খুঁড়লে তলার ভিজে মাটি বেরিয়ে পড়ে। ও দেশের বর্ষা হয় বসন্তকালে, সে সময় বালির উপর এখানে-ওখানে কাটা-ঘাস, ডাঁটা-সার-সরু পাতার গাছ, এ রকম কিছু কিছু উদ্ভিদ গজায়। চেপটা-গড়নের ঝাঁক্ড়া পাতার বাহার দিতে গেলে গাছের ঘড়া ঘড়া জল খাওয়া লাগে, এমন জায়গায় তা তো জোটে না। ঢেউখেলানো বালির খোঁদলে বর্ষার জল জমে, তাতে দেখা দেয় পাঁকের মাছ; আর উপরে কিলবিল করে বেলে সাপ। মাছগুলো কাদার মধ্যে থেকে মুখ বাড়িয়ে সোজাসুজি হাওয়ার নিশ্বেস টানতে শিখেছে, আর সাপগুলো রালিতে সাঁতরে বেড়ানো অভ্যেস করেছে। মরুজীবিকে মরুভূমির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। যেমন উট, কাঁটা খেয়ে জল না খেয়ে চালিয়ে দেয়; বেলে রঙের সিংহকে তার খাদ্যসম্বন্ধীদের ঠাওর হয় না, নইলে তারা পালিয়ে বাঁচত, সিংহ অনাহারে মরত।
মানুষের মধ্যে, ঘুরঘুরে তুর্কীবেদের দল বসন্ত-বর্ষার মর্সুমে এই কারাকুমে তাদের ঘোড়া ভেড়া চরাতে এসে স্ত্রী-ছেলেপিলে নিয়ে ছাপ্পর বেঁধে থাকে; এক অঞ্চলের ঘাস-গাছড়া ফুরিয়ে গেলে হঠে বসে; শেষে গর্মি পড়ায় সবুজের পালা সাঙ্গ হলে, লটবহর গুটিয়ে দক্ষিণের পাহাড় পানে ধাওয়া করে।
সম্রাটের আমলে এই কারাকুমের ভিতর দিয়ে প্রথমে জল যাবার নহর, তার পর এক রেল লাইন চালিয়ে দেওয়া হয়। ব্যাপারখানা কী। হঠাৎ বুঝি রাজার বা উজিরের মরুবাসীর পিপাসার কথা মনে পড়ায়, প্রজাবাৎসল্য উথলে উঠল?—তা নয়। মরুর ওপারে মধ্য-এসিয়ার বড়ো বড়ো নদীর ধারে যেসব জাঁকালো শহর, ফলন্ত খেতবাগান আছে, সেখানকার ভালো ভালো জিনিস আমদানির সহজ উপায় চাই, তারি এই আয়োজন।
জল না হলে ইঞ্জিন চলে না। রেলগাড়ি না দৌড়লে লম্বা পথ ফুরোয় না,—আগেকার দিনে বোগ্দাদের খলিফাকে রুশের সেরা খরমুজ সরবরাহ করতে হলে এক একটি ফল বরফভরা সীসেমোড়া আলাদা বাক্সবন্দী করে উটের পিঠে মরু পার করতে তিন তিন মাস লেগে যেত।
আর একটু কথাও আছে। রেলপথে যখনতখন ইচ্ছেমতো গাড়ি গাড়ি পল্টন পাঠাতে পারলে দেশটাকে বেশ সহজে শাসনে রাখা যায়।
যা হোক রেলগাড়ি চলল, মরুদেশ সম্রাটের তাঁবে এল, তাহলে বেদেরা অন্তত তাঁর প্রজা হওয়ার গৌরবটা তো পেল?—মাটেই তা নয়। এমন হতভাগা প্রজার উপর রাজাগিরি ফলাবার শখ মহামহিম রুশসম্রাটের ছিলই না, উলটে তাদের জ্বালায় রাজ-আমলারা অস্থির। জলের নহর পেয়ে দু’ধারে তারা ভিটে তুলে বসবাস ফাঁদে আর কি। সম্রাটের মোসাহেবের দল তাক করে বসে ছিল, রেলধারে খালধারে জমিদারি পত্তন করবে, প্রজা দিয়ে ফসল ফলাবে, কারখানা চালাবে, তাদিকে দুটি দুটি খেতে দেবে, মোটা টাকা পৌঁছবে জমিদারের খাজানায়। কিন্তু বেদেরা কায়েম হয়ে জুড়ে বসলে সব মাটি। তখন তাদিকে উচ্ছেদ করার ঝামেলা পোয়াবে কে।
হুকুম জারি হল—“নিকালো!”
আমলায় ধরে আনতে বললে, পেয়াদায় বেঁধে আনে,—রাজকায়দার এ ধারা তো জাহিব আছেই। সদর সেনাপতি সেদিকের সেনানায়ককে পত্র দিলেন—“য়োমুদে (তুর্কি বেদে)রা খালধারে যেখানে যেখানে আড্ডা করেছে, পলটন চড়াও করে তাদিকে সরিয়ে দেবেন।”
কশাক-পলটনের সরদারকে ডাকিয়ে সেনানায়ক বললেন, “সওয়ার নিয়ে রাজার হুকুম তামিল করে এসো, দেখো যেন একটাও বাকি না থাকে।”
এক সার কশাক-সওয়ারের ভীষণ চেহারা দূর থেকে দেখেই তো বেদেদের আক্কেল গুড়ুম। যে পারলে সে ঘরবাড়ি পরিবার জিনিসপত্র ফেলে, ঘোড়ায় চেপে মার টেনে দৌড়। কিন্তু তাতে কি রেহাই পায়—অক্ষরে অক্ষরে হুকুম মানতে না পারলে সেপাইয়ের ইজ্জত থাকে কই। তার উপর যণ্ডা গুণ্ডা হলে যা হয়, হঠাৎ খুন-চাপা রোগে ধরে। কাজেই তেজী ঘোড়া ছুটিয়ে একদল সওয়ার পলাতক বেদেদের টাট্টুগুলোকে তেড়ে ধরল আর পাশাপাশি দৌড়তে দৌড়তেই চমৎকার হাত-সাফাই দেখিয়ে তলোয়ারের এক এক কোপে এক এক বেদের মাথা ওড়াল। ওদিকে, ছাপ্পরের আশেপাশে যেসব ছেলে বুড়ো-স্ত্রীলোক পড়ে ছিল, আর এক দল গিয়ে তাদিকে সাবাড় করল।
কথাটা বিশ্বাস করা একটু শক্ত—না?
কিন্তু বিখ্যাত রুশীয় লেখক (এম্ ইলিন্)[১] সম্রাটের মোহর-বসানো হুকুমনামার নম্বর তারিখ ধরে দিয়েছেন—নং ১১৬৭, ৬ই জুন, ১৮৭৩। তা ছাড়া, ভেবে দেখতে গেলে, নিরীহের উপর চোটপাট করে বাহাদুরি নিতে কোন্ পেশাদার বীর কবে কোথায় নারাজ হয়েছে।
চাষার গল্প
ফসলখেতে ফলবাগানে রেলগাড়ি করে জল যোগাতে হলে জমির বিঘে-পিছু আস্ত এক ট্রেন জলের টাঁকি দরকার হত,—ভাগ্যিস্ তা করতে হয় না। তবে রেলেরই মতো বাঁধা পথে জল আসাযাওয়ার চক্কর খায়। আসার লাইন আকাশের ভিতর দিয়ে—সাগর থেকে ডাঙা; ফেরত লাইন মাটির উপর দিয়ে—ডাঙা থেকে সাগর। ফিরতি পথে, নদী বেয়ে যাবার সময়, জলে বিস্তর মাল বোঝাই থাকে,—এঁটেলমাটি, রকম বেরকমের নুন, কিছু কিছু ধাতু, প্রাণীর দেহপুষ্টির কাজে লাগে এমন অনেক জিনিস; শেষে এগুলোকে সমুদ্রে ঢেলে দিয়ে, মেঘ হয়ে, জল আকাশপথে হালকা চলে আসে। ঐ মাল যদি সব-কে-সব সমুদ্রে ফেলা যেত, তাহলে ডাঙার জমি ক্রমশ অসার হয়ে, প্রাণী বাঁচিয়ে রাখার অযোগ্য হয়ে পড়ত। কিন্তু গাছের কল্যাণে ধরিত্রীর সে দশা ঘটতে পায় না।
গাছ করে কী, জল সমুদ্রে যাবার সময় তাকে নিজের মধ্যে একক্ষেপ ঘুরিয়ে এনে দেশের মাটির তেজ বজায় রাখে। এই যে ব্রাঞ্চ লাইন, মাটি—গাছ, গাছ—মাটি, এর ভিতর দিয়ে জল চলার সময় গাছ নানা রকম ক্রিয়া করতে থাকে।
এক তো, মালে-বোঝাই জল থেকে নিজের শিকড় গুঁড়ি ডালপালা ফুল বীজ তৈরি করতে যা যা লাগে তা টেনে নেয়; পরে নিজের মূল ডাঁটা-পাতা-ফল অন্য প্রাণীর সেবায় লাগায়; শেষে, বড়ো গাছ পাতা ঝরিয়ে, ছোটো গাছ আস্ত মরা-দেহ দিয়ে, মাটির জিনিস মাটিকে ফিরিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে, পাতার প্রশ্বাসের ভাপ হাওয়াটাকে ভিজিয়ে ঠাণ্ডা রাখে, নইলে রোদে-তাতা মরু-বালির উপরকার বাতাস ঝাঁজিয়ে গিয়ে যেমন হয়, তাই হত,—আকাশে মেঘ জমতেই দিত না, এলেও বর্ষাত না, যদি বা অল্পসল্প জল ঝরত তা মাঝপথেই শুখনো হাওয়ায় খেয়ে নিত, জমিতে পৌঁছত না।
গাছের আর এক ক্রিয়া এই—বৃষ্টির মুষলধার অবাধে মাটির উপর পড়লে তাতে গর্ত হয়ে যায়, পড়া-জল তোড়ে গড়াতে থাকলে উপরকার সারালো মাটি কেটে নিয়ে চলে, কাটা খোয়াইয়ের ভিতর দিয়ে সব জলটা হুড়মুড় ক’রে নদীতে নেমে পড়ে, কারো কোনো কাজে লাগার জন্যে দুদণ্ড কোথাও তিষ্ঠয় না। গাছ থাকলে আকাশের জলকে এ রকম ছ্যাবলামি করতে দেয় না—বৃষ্টির চোট নিজের মাথায় নিয়ে জলটাকে কতক পাতার ডগা দিয়ে, কতক গুঁড়ির গা বেয়ে, আস্তে আস্তে নামিয়ে ফেলে, তাকে ঝরা পাতার লেপ চাপা দিয়ে, রোদে শুখিয়ে যেতে দেয় না, তাড়াতাড়ি গড়াতে দেয় না, তলে তলে গম্ভীর চালে নদীতে পৌঁছে দেয়।
তাই বড়ো গাছের বন থাকলে দেশে অনাবৃষ্টি হতে পায় না, ভালো জমি খয়ে মরুভূমি হয়ে দাঁড়ায় না।
রুশে ভারি ভারি জঙ্গল ছিল, যাতে প্রজারা কাঠ-কাঠরার কুঁড়ে বেঁধে থাকত; কুডোনো কুটোকাটার জ্বালে রান্না করত, শীত কাটাত, বনের ফাঁকে ফাঁকে জানোয়ার চরাত, কিছু ফসলও লাগাত। সেই জঙ্গলের উপর লোভ লাগল উপর-ওয়ালাদের।
রব উঠল—“বেটাদের যেমন বুদ্ধি ভোঁতা, তেমনি নজর ছোটো, খালি নিজেদের খুচরো এটা ওটা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, দেশহিতৈষণা কাকে বলে তা জানেও না; দেশের এত বড়ো লাভের সম্পত্তি জংলী প্রজারা কি না বেকায়দা আটকে রাখতে চায়।”
ফলে প্রজাদের স্বত্ব ছুটে গেল, জঙ্গল সব বেঁটে দেওয়া হল জমিদারদের মধ্যে। সে বেচারীদের তো সদাই খাঁক্তি, বাড়িটা গাড়িটা আসবাবটা-আসটা পুরোপুরি না রাখলে মানই থাকে না, আরামটুকু তো পরের কথা। তাই, যেমন-তেমন করে জঙ্গল কাটলে আখেরে লোকসান, সে কথা জানা থাকলেও মস্ত মস্ত পুরোনো গাছের দাম, আবাদী জমির উপস্বত্ব, এ সব নগদ আদায় হাত পা গুটিয়ে ব’সে খোয়ানো কি তাদের প্রাণে সয়। পরের ভাবনা পরে যারা আসবে তারা ভাববে।
জঙ্গল কাটতে কাটতে গাদা-করা কাঠের দাম প’ড়ে গেল, আবাদ বাড়াতে বাড়াতে জলের দরে রাশ রাশ ফসল বাজারে ছাড়তে হল, তখন প্রভুরা ক্ষান্ত হলেন। কিন্তু তার মধ্যেই দেশের দফা হল নিকেশ, পড়ে গেল অনাবৃষ্টির পালা। প্রথমটা চার পাঁচ বছর অন্তর, শেষে তিন বছর দু’বছর অন্তর, দুর্বৎসর ঘনিয়ে আসতে লাগল।
ফসল অজন্মা বলে রাজা তো প্রজাকে ছাড়ে না—“চুক্তি অমান্য করা, তা কি হয়!”
ওদিকে স্বাধীনভাবে চাষের অধিকার পেতে যে-সেলামী লাগে তাই কুলোয় না, প্রজায় খাজনা দেবে কোত্থেকে, খাবেই বা কী। শেষে স্ত্রী ছেলেপিলে আত্মীয়বাড়ি রেখে, তারা দলে দলে মজুরি খাটতে বেরল।
অনেকে গেল শহরে। সেখানে দশ-জন-থাকা ঘরে বিশ-ত্রিশ-জন ঠাসাঠাসি করে থেকে রোগ বাধাল, রোগ ছড়াতে লাগল, কর্তারা আতঙ্কে সারা। যারা টিঁকে রইল তারা শেষে পুলিসের গুঁতোর চোটে ফের বাড়িমুখো হল।
আর অনেকে গেল, পথে ভিক্ষে করতে করতে, প্রদেশের পর প্রদেশ ছাড়িয়ে, সেই সাইবীরিয়ায়। বাড়িতে থাকলে তো ঠায় মরণ, যে দেশে খাটবার লোকের অভাব, সেখানে যদি খোরাক জোটে। কারো কারো কাজ জুটল বটে, যাদের কপালে তা না হল তারা ফিরতি বেলা রাস্তার ধারে হাড় ক’খানি রাখল; দু’দুবার রক্ত-মাংসের শরীরে ঐ অফুরন্ত পথ কি খালি-পেটে পার হওয়া যায়।
গবর্নমেণ্টের রিপোর্টে আক্ষেপ প্রকাশ হল, “প্রজাদের এ কী দেশছাড়া পাগলামিতে পেয়েছে। জমিদারদের যে সর্বনাশ, ঠিকে লোক দিয়ে চাষ করাতে হলে খরচ বেড়ে যাবে কত।” ভেবেচিন্তে সাব্যস্ত হল, “গ্রামে গ্রামে অক্ষমদের জন্যে দাও কিছু দানা পাঠিয়ে।”
উকিলে আমলায় তা থেকে নিজের নিজের তোলা নেবার পর, রাজ্যের আবর্জনা দিয়ে ওজনে পুরিয়ে যা পৌঁছে দিলে সেটা এত রকমের মিশল যে, দানা ছাড়া কোনো নামের মধ্যে তাকে আনা যায় না; আর পরিমাণে এত কম যে তাতে জন-পিছু দিনে এক ছটাকও হয় না।
সক্ষমদের পক্ষে হুকুম হল আলাদা, “ভিক্ষে বৃত্তির প্রশ্রয় দিলে চরিত্র নষ্ট হবে। তৈরি করো কতকগুলো রেলের রাস্তা, তাদের সকলকে কাজে লাগিয়ে দাও।”
কিন্তু কুলির সর্দার অভিযোগ জানাল, “হুজুর, এ সব নিখাকী মজুর নিয়ে করব কী। পায়ে বল নেই, টলতে টলতে আসে; হাতে জোর নেই, কোদাল ওঠেই না।”
উত্তর এল, “বটে, কাজে ফাঁকি দেবার ফন্দি। বদমাশগুলোকে চাবকে লাল ক’রে ধ’রে বেঁধে বাড়ি পাঠিয়ে দাও।” আর আইন জারি হল, “ভিটে ছেড়ে প্রজার যাওয়াই নিষেধ।”
প্রজার সে ভিটেকে ভদ্রাসন বললে ঠাট্টা করা হয়। জঙ্গলের কাঠ কাটা দূরে থাক্, প্রজার কাঠকুড়োনো পর্যন্ত বারণ,—কুডুলের আওয়াজ কোথাও শোনা যাচ্ছে কি না, সেদিকে কান পেতে জমিদারের সওয়ার সারাদিন ঘুরছে। অগত্যা, ডাঁটা-লতা-পাতা জড়িয়ে কোনো রকমে দেওয়াল-খাড়া-করা খড়ের ছাউনি-দেওয়া তাদের ঘর। তবু মানুষ-থাকার ঘরগুলো ওরি মধ্যে একটু মজবুত, জানোয়ারদের ঘরের পল্কা দেওয়ালে বাইরের জলবাতাস একেবারেই রোখে না, আর গোরুর খাবারের অনাটন হলে চালের খড় প্রায়ই নেমে আসে। এ অবস্থায় দারুণ শীতের সময় যত গোরু-শুয়োর সব মানুষ-থাকা ঘরে না ঢোকালে তারা বাঁচে না। এতে স্বস্তি-স্বাস্থ্যের যা হাল হয় তা কি বর্ণনার অপেক্ষা রাখে।
আর প্রজাদের খাবার? দুর্বৎসরে যে দানাটুকু জোটে তা ভেঙে রুটি হওয়ার কাছ দিয়েও যায় না, কাজেই ছাই-পাঁশ মেশানো সে দানার সঙ্গে জংলী ঘাস-পাতা থেঁৎলে পেট-ভরানো চেহারার রুটির মতো একটা কিছু দাঁড় করাতে হয়,—যা শুঁখলে কুকুর বেড়াল মুখ ফেরায়, মুরগিকে খাওয়ালে মারাই পড়ে,—প্রজারা পেটের জ্বালায় বমি চেপে তাই গেলে। তার উপর কাঁচা জ্বালানির চিড়বিড়ে ধোঁয়ার তাড়সে ওদের চোখের মাথা খাওয়া যায়, বয়স না যেতেই প্রায় অন্ধ।
গাঁয়ে থাকলে না খেয়ে মরা, গ্রাম ছাড়লে মার খেয়ে মরা, এই এমনেও গেছি অমনেও গেছি অবস্থায় ওরা মরিয়া হয়ে চুরিডাকাতি, জমিদারবাড়ি-জ্বালানো আরম্ভ করলে। তখন সদর থেকে পলটন এসে গুলি চালিয়ে সব ঠাণ্ডা করে দিলে।
শহরে কি অবস্থাপন্ন দয়ালু লোক কেউ ছিল না?—ছিল বৈ কি। দুর্ভিক্ষে কি সকলের লোকসান। ভেজাল-দেওয়া জিনিস চড়া দামে বেচে কারো বড়ো বাড়ি হয়, কারো নগদ টাকা জমে। তখন দয়া করারও ফুরসত আসে। থিয়েটার-রে, কনসার্ট-রে, কতরকমের আমোদপ্রমোদের আয়োজন করে গ্রামবাসীদের জন্যে টাকা তোলা হল; উচ্ছিষ্ট দিয়ে সুরুয়া তৈরি করে শহরের পাড়ায় পাড়ায় কাঙালী বিদায়ের ধুম লেগে গেল। কিন্তু তাও বলতে হয়, হাজার বদান্য হলেও লোকে কি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধৈর্য রাখতে পেরে ওঠে? খেতে পাই না, খেতে পাই না, ঐ একঘেয়ে চীৎকার শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা, মনে ঘাটা পড়ে যায়।
তবুও সেই খাই খাই, রোজই খাই খাই, অবুঝ প্রজাগুলো সামান্য খাওয়াটা বাঁচাটার জন্যে কি খ্যাপানটাই খেপেছিল।
দুর্গতিনাশন যজ্ঞারম্ভ
মনে হতে পারে বোবা সাক্ষীর জবানবন্দি হয়ই না। কিন্তু রুশের প্রজাকে পেয়াদায় নীরবে যা সওয়াল, তার বিবরণ নারায়ণের নথির মধ্যে ঠিক উঠে গেল। তবে কি না, তিনি শেষ নাগের নরম পিঠের উপর দিব্যি হেলান দিয়ে বোধ করি একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলেন, তাই সে সব কথা বিচার আমলে আসতে কত দিন যে লেগে গেল তার ঠিকানা নেই। কি নরের, কিবা নারায়ণের, আদালত দেখি সব এক ছাঁচে ঢালা, তাদের গড়িমসি চালের আর শেষ পাওয়া যায় না।
পরে অবশ্য বোঝা গেল, কোনো অবসরে রায়টা চুপি চুপি দিয়ে রাখা হয়েছিল।
লাখ কথা লাগেনি, এক কথার সে রায়—“বিপ্লব!”
তাও কিন্তু অনেক-কাল নথির মধ্যেই চাপা পড়ে রইল। অবশেষে ডিক্রি জারি হল ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে।
জারির দিনটা কি বিশ্বমানবের একটা পরবের মধ্যে দাঁড়াবে।
দেখা যাক। জানা যাবে USSR-এর যজ্ঞ আর একটু এগোলে।
ডিগ্রির মোট কথা এই—এ রাজা, সে উজীরের দোষ নয়, কুব্যবস্থার দোষেই মানুষ দুরবস্থায় পড়ে। যে জিনিস সকলের, তাকে “আমার “আমার” বলে টানাটানি, বিনা শ্রমে পরের শ্রমের ফলভোগের চেষ্টা, এতেই পাপ; পাপ করা, পাপের প্রতীকার না করা, দুয়েরই পরিণাম মৃত্যু। বুদ্ধিবৃত্তি অনুসারে মানুষের দেবার ক্ষমতা কম-বেশি; কিন্তু শরীর মনকে সুস্থ রাখবার জন্যে খাওয়াপরার দরকার সকলের পক্ষে সমান। অতএব যার যতদূর ক্ষমতা সকলে উৎপাদন করুক, উৎপন্ন ফল সবাইকে যথাযথ ভাগ করে দেওয়া হোক। এই নিয়ম পালন করলে-পর সমবেত চেষ্টার ফলন কারো পক্ষে অকুলন হবে না। শ্রমিক প্রজা, শ্রমিক রাজা, শ্রমিক ছাড়া আর পক্ষই নেই, এ রকমটা হলে রাজা-প্রজার, ধনী-দরিদ্রের, বিবাদ ভঞ্জন হবে, সুনিয়মের ব্যতিক্রম ঘটার যা মূল কারণ সেই লোভের লোপ হবে। দৈবের উপর নির্ভর করা ছেড়ে দিয়ে নরনারী দেবতাকে নিজের বশে আনতে পারলে তারা নরোত্তম পদ লাভ করবে, তখন অভাব বা অসাধ্য কিছু থাকবে না।
এ রায়ের জোরে আশা হয়, লম্বা লম্বা তিন যুগের ভোগ ভুগে, মানুষের ধর্মবুদ্ধির জড়তা এবার হয়তো কাটবে। আর কিছু না হোক, গল্তিটা কিসে কিসে হয়েছিল, সেটুকু কলির শেষে USSR-এর কাছে ধরা পড়েছে বলে মনে হয়।
প্রকাশ হয়েছে যে, নারায়ণীকে দ্বৈতরূপে দেখাটাই যত নষ্টের গোড়া। সরস্বতীর তো ভুবনভোলানো রূপ, চকিতেমাত্র তাঁর যে দেখা পায় সে থ হয়ে যায়, লক্ষ্মীর দিকে আর চায় না। আবার লক্ষ্মীকে অবহেলা করলে সরস্বতী অন্তর্ধান হন, অন্তত বাম হয়ে থাকেন। এই উভয় সংকটের মধ্যে মানুষ এত দিন হাবুডুবু খাচ্ছিল।
USSR বুঝতে পারলেন, নারায়ণীকে একেশ্বরী জেনে সংবর্ধনা না করলে তিনি নারায়ণকে ধরা দেবেন না। আমরাও আল্মা[২]-মায়ের দৌলতে সরস্বতীকে একটু আধটু চিনে নিয়েছি। শুধু “ফুল নে মা” ব’লে আদর কাড়তে গেলে তিনি গলেন না; গাধা-খাটুনি খেটে হদ্দ হলেও তিনি টলেন না; রসে কষে ঠিকমতো মিলিয়ে নিবেদন না করলে তিনি দক্ষিণ-মুখ ফেরান না, যাকে বলে “প্রসাদ” তা মেলে না। তাই USSR সরস্বতীর দুই বর পুত্র কবি-মনীষীর আশ্রয় নিয়ে তাঁর খাতির রাখলেন, আর উভয়কে কর্মী বানিয়ে লাগিয়ে দিলেন লক্ষ্মীর আরাধনায়। বুদ্ধিটা খেলিয়েছেন ভালো, স্বীকার করতে হয়।
পুরাকালে আরাধনা বলতে ঠিক-কে-ঠিক মন্ত্র উচ্চারণ করা, মান্ধাতার আমলের যত কিছু তুকতাক কোনোটি বাদ না পড়া, এই বোঝাত; মাঝে বোঝাতে লাগল ভক্তি-বিলাসের ঘটা—স্তব গান, বাতি ফুল-চন্দনের বাহার; হালে বোঝায় ভালো মনে সমানে খেটে চলা, পদে পদে দুর্গতির নিদান-জিজ্ঞাসা, দফে দফে জানা বা খুঁজে পাওয়া ওষুধ প্রয়োগ, এই উপায়ে সাধারণের সেবায় প্রত্যেকের সাগ্রহ সাধনা,—যার মধ্যে কোনো দেবতার নাম বা চিন্তা না করলেও, বিনা-নিমন্ত্রণে সব দেবতারা এসে রমণ করেন।
এইভাবে USSR মহা-সমীকরণ যজ্ঞ ফেঁদেছেন। তাই দেখে পৃথিবীর যত রাজা-রাজড়ার মেজাজ যে রকম খিঁচ্ড়েছে, এর নাম “রাজসূয় যজ্ঞ” দিলেও চলে। আকাশ বাতাস মাটি জল রোদ বৃষ্টিকে নানা প্রাণীকে, তার উপর নিজের মনকেও, মানুষের মতো মানুষের জীবনধারণের উপযোগী করে আনা, এই হল এ যজ্ঞের এক এক অঙ্গ। অঙ্গগুলি ক্রমশ ভালোয় ভালোয় উতরে গিয়ে যজ্ঞ পূর্ণ হলে তখন পৃথিবীমাতার বিশ্ব-মানব-ধারিণী নাম সাজবে।
যজ্ঞ ব্যাপার চলছে কেমন, তা বিচার করতে হলে কোন্ কোন্ কথা বুঝতে হবে, মনে রাখতে হবে, সে সব কথা পালায় পালায় ক্রমশ বলা যাবে।