বিষম বুদ্ধি/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

———♦———

 আমার কথা শুনিয়া বাসার সকলেই আমাকে সঙ্গে লইয়া যে ঘরে রসিক বাবু বাস করিত, সেই ঘরে লইয়া গেলেন। দেখিলাম, দোতালার উপরিস্থিত একটী ক্ষুদ্র ঘরে রসিক বাস করিত। ঐ ঘরের মধ্যে একখানি কেওড়া কাষ্ঠের তক্তপোষের উপর কেবল একটী মাত্র বিছানা আছে, উহার উপরেই রসিক শয়ন করিত। এতদ্ব্যতীত ঐ ঘরের এক দিকে একটী টিনের বাক্স আছে, জানিলাম, উহাও রসিকের। তৈজসপত্রের মধ্যে রসিকের ইহা ভিন্ন আর কিছুই সেই স্থানে দেখিতে পাইলাম না, কিন্তু জানিতে পারিলাম, ইহা ব্যতীত তাহার একখানি থাল, একটী গেলাস ও দুইটী বাটী রান্না ঘরে আছে। বিছানাটী উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিলাম, কোনরূপ চিঠিপত্র বা অপর কিছুই দেখিতে পাইলাম না। টিনের বাক্সটী দেখিলাম, সেটি চাবিবদ্ধ অবস্থায় আছে। উহা খুলিবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু প্রথমতঃ উহা খুলিতে পারিলাম না, কিন্তু পরিশেষে ঐ বাসার সকলের চাবি সংগ্রহ করিয়া দেখিলাম, উহার মধ্যে একটী চাবি ঐ বাক্সের কলে লাগিয়া গেল, উহার দ্বারা বাক্সটী খুলিয়া দেখিলাম, উহার মধ্যে সামান্য পরিধেয় ভিন্ন আর কিছুই নাই॥

 পুর্বেই পাঠকগণ অবগত হইতে পারিয়াছেন যে, বাসাড়িয়া বাড়ীতে রসিক বাস করিত, সেই বাড়ী ও রাজচন্দ্র দাসের বাড়ী প্রায়ই পাশাপাশি অবস্থিত। রসিকের ঘরে গিয়া দেখিলাম, তাহার ঘর রাজচন্দ্র দাসের অন্দরমহলের প্রায় সংলগ্ন, রসিকের ঘরে যে একটী জানালা আছে, তাহা খোলা থাকিলে ঐ রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীর অনেক স্থান দেখিতে পাওয়া যায়, বিশেষ, ঐ জানালা সংলগ্ন রাজচন্দ্র দাসের একটী ঘর আছে। ঐ ঘরের একটী জানালা রসিকের ঘরের ঐ জানালার সহিত ঠিক রুজুভাবে সংস্থাপিত, উভয় জানালা এক সময়ে খোলা থাকিলে, উভয় ঘর হইতে উভয় ঘরের সমস্তই অবস্থা দেখিতে পাওয়া যায়। রাজচন্দ্র দাসকে বাধ্য হইয়া তাহার ঐ ঘরের জানালা প্রায় সর্ব্বদাই বন্ধ করিয়া রাখিতে হইত। রসিকের উপর ঐ জানালা বন্ধ করিয়া রাখিবার বাসার ম্যানেজারের আদেশ থাকিলেও তিনি কিন্তু উহা প্রায়ই বন্ধ করিয়া রাখিতেন না, ইহাতে রাজচন্দ্রকে প্রায় বিশেষরূপে অসুবিধা ভোগ করিতে হইত।

 রসিকের বাসস্থানের অবস্থা অবগত হইয়া যে স্থানে রাজচন্দ্র দাস রসিককে চপেটাঘাত করিয়াছিলেন, এবং যে স্থানে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, সেইস্থানে আমরা সকলে গমন করিলাম। ঐ স্থানের নিকটবর্ত্তী বাড়ীতে যাঁহারা বাস করিতেন, তাহাদিগকে যতদূর সম্ভব, সেই রাত্রিতেই উঠাইলাম। কিন্তু রসিকের মৃতদেহ কেহ যে সেইস্থানে দেখিয়াছেন বা উহার মৃত্যু সম্বন্ধে কোন কথা যে কেহ শ্রবণ করিয়াছেন, তাহা কিন্তু কেহই বলিলেন না। এখন যথার্থই জানিতে পারিলাম যে, রাজচন্দ্র দাস যে সকল কথা বলিতেছেন, তাহা সত্য নহে—মিথ্যা। রসিক ঐ স্থানে হত হয় নাই, বা ঐ স্থান হইতে তাহার মৃতদেহ কেহ স্থানান্তরিত করে নাই। এইরূপ অনুসন্ধানের পরও কিন্তু রাজচন্দ্র দাস তাঁহার কথার কোনরূপ পরিবর্ত্তন করিলেন না, পূর্ব্ব হইতে যাহা বলিতেছিলেন, এখনও তাহাই বলিতে লাগিলেন।

 ইহার পর রাজচন্দ্র দাসকে লইয়া তাঁহার বাড়ীর ভিতর আমি প্রবেশ করিলাম। ঐ বাড়ীতে কেবলমাত্র তাঁহার স্ত্রী ও তাঁহার স্ত্রীর ভ্রাতা ভিন্ন আর কেহই ছিল না। তাঁহাদিগের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম, তাঁহারা দুইজন ও রাজচন্দ্র ভিন্ন অপর আর কেহই ঐ বাড়ীতে বাস করে না, চাকর চাকরাণী প্রভৃতিও বিশেষ কেহ নাই। কেবলমাত্র একটী চাকর আছে, সে তাহার কার্য্যাদি শেষ করিয়া সন্ধ্যার পরই তাহার নিজের বাসায় গমন করিয়া থাকে, পরদিবস প্রাতঃকাল ভিন্ন সে আর প্রত্যাগমন করে না। উহাদিগকেও জিজ্ঞাসা করিয়া বিশেষ কোনরূপ কথাই প্রাপ্ত হইলাম না। ঐ বাড়ীর যে ঘরটীর কথা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে, অর্থাৎ রসিকের ঘরের দিকে যে ঘরের জানালা আছে, সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীর মধ্যে ঐটীই সর্ব্বপ্রধান ও উৎকৃষ্ট ঘর। রাজচন্দ্র দাস ও তাঁহার যুবতী ভার্য্যা ঐ ঘরেই বাস করিয়া থাকেন। ঐ ঘরের যে জানালা রসিকের ঘরের দিকে স্থাপিত, তাহা বন্ধ করিয়া না রাখিলে ঐ ঘরে কি হইতেছে না হইতেছে, তাহা রসিক সর্ব্বদাই দেখিতে পায়। আমি যে সময় ঐ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম, সেই সময় ঐ জানালা বদ্ধ অবস্থাতেই ছিল। উহা খুলিয়াও দেখিলাম। ঘরের অবস্থা দেখিয়াও বিশেষ কিছুই বুঝিতে পারিলাম না যাহাতে রসিকের মৃত্যুর কারণ বিন্দুমাত্র নির্ণয় করিতে পারি। কিন্তু ঘরের অবস্থা দেখিয়া আমার বিশেষ সন্দেহ হইল যে, রাজচন্দ্র দাসের শয়ন-ঘরের ঐ জানালার সহিত রসিকের মৃত্যুর বিশেষরূপ সংশ্রব আছে। কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া যখন এ সম্বন্ধে কোনরূপ প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারিলাম না, তখন কেবলমাত্র মনের সন্দেহে কি করা যাইতে পারে? আমার মনের সন্দেহ মনে রাখিয়াই ইহার অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। এইরূপে ঐ রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল, অনুসন্ধানে বিশেষ কোনরূপ ফলই ফলিল না।

 পরদিবস মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত প্রেরণ করা হইল। মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া ডাক্তার সাহেব তাঁহার অভিমত প্রকাশ করিলেন যে, “একটী প্রকাণ্ড লৌহপেরেক সজোরে হৃৎপিণ্ডের মধ্যে বিদ্ধ হওয়াতেই উহার মৃত্যু হইয়াছে।”

 ডাক্তার সাহেবের রিপোর্ট পাইয়া আমি উহা রাজচন্দ্র দাসকে দেখাইলাম, এবং তাঁহাকে বিশেষরূপে বুঝাইয়া তাঁহাকে সত্যকথা কহিতে কহিলাম। এখন দেখিলাম, রাজচন্দ্র দাস অন্য আর এক প্রকার ভাব অবলম্বন করিয়াছে, আমার কথাগুলি তিনি সবিশেষ মনোযোগের সহিত শুনিয়া পরিশেষে কহিলেন, “মহাশয়। আপনারা আমাকে যতই বুঝাইয়া বলুন না কেন, যাহা আমি অবগত নহি, সে সম্বন্ধে আমি কোন কথা আপনাদিগকে কিরূপে বলিব? আমি যাহা অবগত আছি, তাহা সমস্তই আপনাদিগকে বলিয়াছি। আমি যাহা করিয়াছি, তাহা প্রথম হইতেই আপনাদিগের নিকট স্বীকার করিয়া আসিতেছি, কিন্তু যখন আপনারা আমার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করিতেছেন না, তখন আমি আপনাদিগকে আর কি বলিতে পারি? ডাক্তার সাহেব বলিতেছেন, উহার হৃদপিণ্ডে পেরেক বিদ্ধ হওয়ায় উহার মৃত্যু হইয়াছে। তিনি যাহা বলিতেছেন, তাহা নিশ্চয়ই সত্য হইবে; কিন্তু আমি তাহার বিন্দুবিসর্গও অবগত নহি। এরূপ অবস্থায় আমার প্রকৃতকথা যখন আপনারা বিশ্বাস করিতেছেন না, তখন আপনাদিগের নিকট প্রকৃতকথা বলিবারও আর প্রয়োজন নাই। এখন হইতে আমিও আপনাদিগের নিকট মিথ্যা কথা কহিব। যে প্রকৃত কথা আমি এ পর্য্যন্ত স্বীকার করিয়া আসিতেছিলাম, তাহাও স্বীকার করিব না। এখন আমি বলিতেছি, আমি ইহার কিছুই জানি না, আমি উহাকে চপেটাঘাত করি নাই, ও আমার চপেটাঘাতে উহার মৃত্যুও হয় নাই। আপনারা আমাকে এখন যেরূপ দণ্ডে দণ্ডিত করিবার চেষ্টা করুন না কেন, আমি কিন্তু এখন হইতে সমস্ত কথা অস্বীকার করিব। যে কেহ আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবে, তাহাকেই কহিব যে, আমি কিছুই জানি না, পুলিস আমাকে ধরিয়া নিরর্থক কষ্ট প্রদান করিতেছে; আপনি জিজ্ঞাসা করিলেও পরিশেষে আমার নিকট হইতে এই এক মাত্র উত্তরই প্রাপ্ত হইবেন। কিন্তু আমার একটী অনুরোধ এই যে, আমার উপর আপনারা যে সকল প্রকৃত প্রমাণ প্রাপ্ত হন, তাহাই গ্রহণ করিবেন, ইহাতে আমার ফাঁসি হইলেও আমার দুঃখ হইবে না, কিন্তু মিথ্যা প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া যেন আমাকে চরম দণ্ডে দণ্ডিত না করেন। আপনাদিগের কাহারও চাকরি চিরস্থায়ী নহে, সামান্য চাকরির খাতিরে আমার বিপক্ষে মিথ্যা সাক্ষীর যোগাড় করিয়া দিয়া অধর্ম্ম সঞ্চয় করিবেন না, ইহাই আমার একমাত্র শেষ অনুরোধ।

 এই বলিয়া রাজচন্দ্র দাস চুপ করিলেন। আমিও এখন বুঝিতে পারিলাম যে, রাজচন্দ্র দাস তাহার মনের গতি অপর দিকে পরিবর্ত্তিত করিতে সমর্থ হইয়াছে। আরও বুঝিতে পারিলাম যে, তাহার উপর আর কোনরূপ প্রমাণ এখনও পর্য্যন্ত প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই দেখিয়াই, সে এখন বুঝিতে পারিয়াছে যে, এখন যদি সে আর কোন কথা স্বীকার না করে, তাহা হইলে তাহার কোনরূপই দণ্ড হইতে পারে না। এই ভাবিয়া পূর্ব্ব হইতে সে যাহা বলিয়া আসিতেছিল, এখন আর সে তাহাও বলিতে সম্মত নহে। রাজচন্দ্রের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া, সেই সময় হইতে তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না, তাহার সম্মুখে আর কোনরূপ অনুসন্ধান করিতেও প্রবৃত্ত হইলাম না। ইহার পর হইতেই রাজচন্দ্র দাস হাজতগৃহে আবদ্ধ হইল, তাহার বিপক্ষে অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। এপর্য্যন্ত আমি একাকীই এই বিষয়ে অনুসন্ধান করিতেছিলাম, কিন্তু এখন হইতে আরও তিন চারিজন বহুদর্শী কর্ম্মচারী আমার সমভিব্যাহারে ইহার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।