বিষাদ-সিন্ধু

উইকিসংকলন থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন
বিষাদ-সিন্ধু
বিষাদ-সিন্ধু
মীর মোশার্‌রফ হোসেন
কলিকাতা: ঢাকা: রাজসাহী:
মীর মোশার্‌রফ হোসেন
মীর মোশার্‌রফ হোসেনের
সংক্ষিপ্ত জীবনী

 বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ “বিষাদ-সিন্ধু” প্রণেতা মীর মোশার্‌রফ হোসেন ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দে নদীয়া জেলার কুমারখালির নিকটবর্তী গৌরীতটস্থ লাহিনীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ইহাদের পারিবারিক উপাধি “সৈয়দ। কিন্তু ইহাদের কোন এক পূর্বপুরুষ নবাব-সরকারে চাকরি করিতেন। সেই চাকরীর পদমর্যাদা অনুসারে তাহারা বংশগত ভাবে “মীর” উপাধি লাভ করেন।

 মোশার্‌রফ হোসেনের প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ হয় গ্রামের জগমোহন নন্দীর পাঠশালায়। এখানে সেকেলে নিয়মে বাংল-শিক্ষা লাভ করিবার পর মোশারফ হোসেন আসিলেন কুষ্টিয়ার ‘ইংরাজীবাংলা স্কুলে। এখানেও বেশীদিন তাহার পড়াশুনা চলিল না। অতঃপর পদমদীর নবাব-স্কুলে এক বৎসর পড়িবার পর তিনি—পি মীর মোয়াজ্জম হোসেন সাহেবের নির্দেশে ‘কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হইলেন। কিছুদিন পরে তিনি সঙ্গীদের সহিত কলিকাতায় বেড়াইতে আসেন। মৌলভী নাদির হোসেন নামক তঁহার এক পিতৃবন্ধু চেতলায় বাস করিতেন, ইনি আলিপুরের আমিন ছিলেন। মোশারফ হোসেন আসিয়া তাহার বাসায় উঠিলেন। পিতৃবন্ধুর অগ্রহাতিশয্যে ও পিতার অনুমতিক্রমে মোশারফ হোসেন তাহার বাসায় থাকিয়া লেখাপড়া শিখিতে লাগিলেন।

 চেতলায় অবস্থানকালে মৌলভী নাদির হোসেনের প্রথমা কন্যা লতিফুন্নেসার সহিত মোশারফ হোসেনের বিবাহ-সম্বন্ধ স্থির হয়। এই সংবাদ মোশারফের পিতামাতা অথবা বাড়ীর অন্য কেই জানি না। নানা কারণে এই নির্দিষ্ট কন্যার সহিত বিবাহ না দিয়া নাদির হোসেন সাহেব দ্বিতীয় কন্যা মোসাম্মৎ আজিজুন্নেসার সহিত তাহার বিবাহ দেন। ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দের ১৯শে মে এই বিবাহ কার্য্য অনুষ্ঠিত হয়। পিতৃবন্ধুর এই আচরণে মোশারফ হোসেন অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছিলেন। এবং ইহার আট বৎসর ঋরে তিনি পুনরায় বিবাহ করেন। তাহার এই নবপরিণীতা স্ত্রীর নাম বিবি কুলসুম। বিবি কুলসুমের অনেকগুলি পুত্রকন্যা হইয়াছিল।

wo মীর মােশফ হোসেন জীবনের অধিকাংশ সময় জমীদারী সেরেস্তায় চাকুরী করিয়াছিলেন। ফরিদপুর নবাব এষ্টেটে দীর্ঘকাল কাৰ্য্য করিবার পর বাংলা ১২৯১ সাল হইতে তিনি ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহকুমা গজনভী সাহেবদের দেলদুয়ার এষ্টেটের ম্যানেজার পদে কাৰ্য্য করিতে থাকেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন বলিয়া শুনা যায় । মীর মােশাররফ হােসেন দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর কাল বাংলা সাহিত্যের সেবা করিয়া গিয়াছেন। এই সাহিত্য-সেবার মধ্য দিয়াই-দেশ ও সমাজের কাছে তার পরিচয়, সাহিত্যিক হিসাবে লােকে তাঁহাকে চিনিয়াছে, তার প্রতিভার পরিচয় পাইয়াছে। তিনি যে সময়ে সাহিত্য-সেবায় হাত দিয়াছিলেন তখন সাহিত্য-সেবীদের অসুবিধার অন্ত ছিল না। কাগজ তখন এখনকার মত প্রচুর পাওয়া যাইত না। ছাপাখানার সংখ্যা ছিল অতি মুষ্টিমেয়, যে কোন ‘প্রেসে বই ছাপিতে দিয়া গ্রন্থকারকে ধৈর্যহারা হইতে হইত। কারণ, মুদ্ৰাষন্ত্রের কবল হইতে বই বাহির করা সহজসাধ্য ছিল না। এমনি সময় মীর মােশারফ হােসেন সাহিত্য-চৰ্চা আরম্ভ করেন, তাহাও আবার সুদুর পল্লীতে পাকিয়া। সুতরাং তাহাকে কত বাধা-বিশ্নের মধ্য দিয়া যে সাহিত্যসেবা করিতে হইয়াছে, তাহা সহজেই অনুমেয়। মীর সাহেবের লিখিত পুস্তক-সংখ্য কম নহে। তাহার ক্ষুদ্র বৃহৎ পঁচিশখানি বইয়ের সন্ধান এ পর্যন্ত পাওয়া গিয়াছে। একমাত্র “বিষাদ-সিন্ধুই” মীর সাহেবকে বাঙলার পাঠক-সমাজের কাছে চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছে। “বিষাদ-সিন্ধুর ‘মহরম পর্ব বাংলা ১২৯১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। ইহার পর যথাক্রমে ১২৯৪ সালের ১লা শ্রাবণ ‘উদ্ধার পৰ্ব্ব এবং ১২৯৭ সালে ‘এজিদ-বধ পৰ্ব্ব প্রকাশিত হইয়াছিল। “বিষাদ- সিন্ধু” বাহির হইলে সাহিত্য-সমাজে এক তুমুল সাড়া পড়িয়া যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামপ্রাণ গুপ্ত, রামতনু লাহিড়ী প্রভৃতি তখনকার সাহিত্যিকগণ মীর সংহেবের সাহিত্য- তিভাকে শত মুখে প্রশংসা করেন। এমন বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল ভাষায় কোন মােছলমান বই লিখিতে পারেন, মীর সাহেবের “বিষাদ-সিন্ধু” বাহির হইবার পূর্বে এই ধারণা কাহারও ছিল না। পুথি সাহিত্যের প্রভাব এড়াইয়া সে যুগে যে সমস্ত মােছলমান সাহিত্যিক প্রাঞ্জল বাঙলা ভাষায় বই লিখিতে আরম্ভ করেন, মীর মােশারুফ হােসেনকে তাহাদের মধ্যে অগ্রণী বলা যায়। মীর সাহেব “আজিজুন্নাহার” নামক একখানি মাসিক পত্রিকা বাহির করেন। খুব সম্ভব ইহা মােছলেম সমাজের সর্বপ্রথম মাসিক পত্রিকা। কোথা হইতে কোন্ সালে ইহা সর্বপ্রথম প্রকাশিত হইয়াছিল, দুঃখের বিষয়, বিস্মৃতির আঁধার যবনিকা ভেদ করিয়া এখন তাহার কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। মীর সাহেব ‘প্রভাকর গ্রামবার্তা’ কুমারখালির ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' প্রভৃতি তৎকালীন পত্রিকা নিয়মিতভাবে লিখিতেন। মীর সাহেবের দ্বিতীয় উপাদেয় গ্রন্থ “গাজী মিয়ার বস্তানী”। বাংলা ১৩০ সালের আশ্বিন মাসে ৪০০ শত পৃষ্ঠার এই বৃহৎ বইখানি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। অনেকের ধারণা তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কোন এক বিখ্যাত মোছলমান জমিদার পরিবারের সহিত এই বইয়ের বিষয়বস্তুর নাকি অনেকটা সম্বন্ধ রহিয়াছে। তবে গাজী মিয়। যে কে, গ্রন্থকার সে রহস্য গােপন রাখিয়া কাজ উদ্ধার করিয়াছেন। “গাজী মিয়ার বস্তানী” উপন্যাসের ছাঁচে লেখা, ইহাতে নাই, এমন জিনিষ ও বিষয় দুল্লভ। পড়িতে পড়িতে মনে হইবে আমাদের সকলকে লক্ষ্য করিয়াই বুঝি বইখানি লিখিত হইয়াছে, সমস্ত দুর্নীতি এবং অনাচারের বিরুদ্ধে গাজী মিয়”। কশাঘাত করিয়া- ঠুেন— —এই কশা প্রত্যেকের পিঠে পড়িয়াছে । “গাজী মিয়ার বস্তানীর” ভাষা, ভাব এবং কাহিনীবিন্যাস-কৌশল অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। দুঃখের বিষয়, এই অমূল্য শিক্ষামূলক বইখানির প্রকাশ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। সমাজের তীব্র অসন্তোষ বোধ হয় ইহার কারণ। মীর সাহেবের “গাে-জীবন,” “উদাসীন পথিকের মনের কথা,” “মোসলেম বীরত্ব” “হজরত বেলালের জীবনী” “বিবি কুলসুম” প্রভৃতি পচিশখানি পুস্তকের প্রচার আর নাই। তিনি আমার জীবনী” নামক এক সুবৃহৎ আত্মজীবনী লিখিয়া গিয়াছেন। ৪১৫ পৃষ্ঠা পূর্ণ ১২ খণ্ডে ইহা প্রকাশিত হইয়াছিল। ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম খণ্ড এবং ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে শেষ খণ্ড প্রকাশিত হয়। দুঃখের বিষয়, এই বইখানিও কোথাও এখন আর দেখিতে পাওয়া যায় না। মােটকথা—এক “বিষাদ-সিন্ধু”ই মীর সাহেবের সমস্ত প্রতিভা ও সাহিত্য-সাধনাকে জাগ্রত রাখিয়াছে। “বিষাদ-সিন্ধু”র প্রত্যেকটি তরঙ্গ-লহরী আজিও তঁাহার জয়গান করিতেছে। বাঙলা ১৩১৮ সালে মীর মোশারফ হােসেন পরিণত বয়সে পরলােক গমন করেন। —প্রকাশক মুখবন্ধ চান্দ্র মাসের বৎসরের প্রথম মাসের নাম মহরম। হিজরীর ৬১ সালের ৮ই মহরম ও|রিখে মদিনাধিপতি হজরত ইমাম হেসেন ঘটনাক্রমে সপরিবারে কারবালা- ভূমিতে উপস্থিত হন এবং এজিদ প্রেরিত সৈহস্তে রণক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন। সেই শােচনীয় ঘটনা মহম নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছে। ঐ ঘটনায় মূল কি এবং কি কারণে সেই ভয়ানক যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছিল, ইহার নিগূঢ় তত্ত্ব বােধ হয়, অনেকেই অবগত আছেন। পারস্য 'ও আরব এন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া “বিষাদ-সিন্ধু” বিরচিত হইল। প্রাচীন কাব্যগ্রন্থের অবিকল অনুবাদ করিয়া প্রাচীন কবিগণের রচনাকৌশল এবং শাস্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করা অত্যন্ত দুরূহ। মাদৃশ লােকের পক্ষে তদ্বিষয়ের যথার্থ গৌরব রক্ষার আকাঙ্ক্ষা বামনের বিধু-ধারণের আকাঙ্খা বলিতে হইবে । তবে মহরমের মূল ঘটনাটি বঙ্গভাষাপ্রিয়—প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণের সহজে হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দেওয়াই আমার একমাত্র মুখ্য উদ্দেশ্য । শাস্ত্রানুসারে পাপভয়ে ও সমাজের দৃঢ়বন্ধনে বাধ্য হইয়া “বিষাদ-সিন্ধু’ মধ্যে কতকগুলি জাতীয় শব্দ ব্যবহার করিতে হইল। বিজ্ঞমণ্ডলী ইহাতে যদি কোন প্রকার দোষ বিবেচনা করেন, সদয়ভাবে মার্জনা করিবেন। দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল গ্রন্থকার হিজরী ১৩০২ সন

বঙ্গল ১২৯১ সাল
উপক্রমণিকা

 একদা প্রভু মোহাম্মদ প্রধান শিষ্যমণ্ডলী মধ্যে উপবেশন করিয়া ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিতেছিলেন, সেই সময়ে স্বর্গীয় প্রধান দূত “জেব্রাইল” আসিয়া তাঁহার নিকট পরম কারুণিক পরমেশ্বরের আদেশবাক্য কহিয় অন্তর্ধান হইলেন। স্বর্গীয় সৌরভে চতুর্দ্দিক আমোদিত হইল। প্রভু মোহাম্মদ ক্ষণকাল ম্লানমুখে নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। শিষ্যগণ তাহার তাদৃশ অবস্থা দেখিয়া নিতান্ত ভয়াকুল হইলেন। কি কারণে প্রভু এরূপ চিন্তিত হইলেন কেহই তাহা স্থির করিতে না পারিয়া সবিষাদ নয়নে তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিলেন। পবিত্র বদনের মলিন ভাব দেখিয়া সকলের নেত্রই বাষ্প-সলিলে পরিপ্লুত হইল। কিন্তু কেহই কিছু জিজ্ঞাসা করিতে সাহসী হইলেন না।

 প্রভু মোহাম্মদ শিষ্যগণের তাদৃশ অবস্থা দর্শনে মনের ভাব গোপন করিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা হঠাৎ এরূপ দুঃখিত ও বিষাদিত হইয়া কাদিতেছ কেন?”

 শিষ্যগণ করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “প্রভুর অগোচর কি আছে? ঘনাগমে কিম্বা নিশাশেষে পূর্ণচন্দ্র হঠাৎ মলিন ভাব ধারণ করিলে তারাদলের জ্যোতিঃ তখন কোথায় থাকে? আমরা আপনার চির-আজ্ঞাবহ। অকস্মাৎ প্রভুর পবিত্র মুখের মলিন ভাব দেখিয়াই আমাদের আশঙ্কা জন্মিয়াছে। যতক্ষণ আপনার সহাস্য আস্যের ঈদৃশ বিসদৃশ ভাব বিদ্যমান থাকিবে, ততক্ষণ ততই আমাদের দুঃখবেগ পরিবর্ধিত হইবে। আমরা বেশ বুঝিয়াছি, সামান্য বাতাঘাতে পর্বত কম্পিত হয় নাই। সামান্য বায়ু প্রবাহেও মহাসমুদ্রে প্রবল তরঙ্গ উত্থিত হয় নাই। প্রভো! অনুকম্পা প্রকাশে শীঘ্র ইহার হেতু ব্যক্ত করিয়া অল্পমতি শিষ্যগণকে আশ্বস্ত করুন।”

 প্রভু মোহাম্মদ নম্রভাবে কহিলেন, “তোমাদের মধ্যে কাহারও সন্তান আমার প্রাণাধিক প্রিয়তম হাসান-হোসেনের পরম শত্রু হইবে; হাসানকে বিষপান করাইয়া মারিবে এবং হোসেনকে অস্ত্রাঘাতে নিধন করিবে।”

 এই কথা শুনিয়া শিষ্যগণ নির্ব্বাক হইলেন। কাহারও মুখে একটিও কথা সরিল না। কণ্ঠ, রসনা ক্রমে শুষ্ক হইয়া আসিল। কিছুকাল পরে খ বিষাদ-সিন্ধু—উপক্রমণিক। তাঁহারা বলিতে লাগিলেন—“প্রভুর অবিদিত কিছুই নাই; কাহার সন্তানের দ্বারা এরূপ সাংঘাতিক কাৰ্য্য সংঘটিত হইবে,—শুনিতে পাইলে তাহার প্রতিকারের উপায় করিতে পারি। যদি তাহা ব্যক্ত না করেন, তবে আমরা অদ্যই বিষপান করিয়া আত্মবিসৰ্জন করিব। যদি তাহাতে পাপগ্রস্ত হইয়া নারকী হইতে হয়, তবে সকলেই অদ্য হইতে আপন আপন পত্নীগণকে একেবারে পরিত্যাগ করিব। প্রাণ থাকিতে আর স্ত্রী-মুখ দেখিব না, স্ত্রীলােকের নামও করিব না।” প্রভু মােহাম্মদ বলিলেন, “ভাইসকল! ঈশ্বরের নিয়ােজিত কাৰ্যে বাধা দিতে এ জগতে কাহারও সাধ্য নাই, তাহার কলম রদ করিতে কাহারও ক্ষমতা নাই। তাহার আদেশ অলঙ্ঘনীয়। তবে তােমরা অবশ্যম্ভাবী ঘটনা শ্রবণ করিয়া কেন দুঃখিত থাকিবে ? নিরপরাধিণী সহধৰ্ম্মিণীগণের প্রতি শাস্ত্রের বহিভূত কাৰ্য্য করিয়া অবলগণের মনে কেন ব্যথা দিবে ? তাহাও ত মহাপাপ! তােমাদের কাহারও মনে দুঃখ হইবে বলিয়াই আমি তাহার মূল বৃত্তান্ত প্রকাশ করিতে ইতস্ততঃ করিতেছি। নিতান্ত পক্ষেই যদি শুনিতে বাসনা হইয়া থাকে, বলিতেছি শ্রবণ কর :--“তােমাদের মধ্যে প্রিয়তম মাবিয়ার এক পুত্র জন্মিবে। সেই পুত্র জগতে এজিদ নামে খ্যাত হইবে; সেই এজিদ হাসান-হোসেনের পরম শত্রু হইয়া তাহাদেব প্রাণ বধ করাইবে। যদিও মাবিয়া এ পর্যন্ত বিবাহ করে নাই, তথাপি এই অসীম জগদ্বিধান জগদীশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন হইবার নহে, কখনই হইবে না। সেই অব্যক্ত সুকৌশলসম্পন্ন অদ্বিতীয় প্রভুর আদেশ কখনই ব্যর্থ হইবে না।” মাবিয়া ধৰ্ম্ম সাক্ষী করিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন, “জীবিত থাকিতে বিবাহের নাম করিব না; নিজে ইচ্ছা করিয়া কখনও স্ত্রীলােকের মুখ পর্যন্তও দেখিব না।” প্রভু মােহাম্মদ কহিলেন, “প্রিয় মাবিয়া, ঈশ্বরের কাৰ্য্য ! তােমার মত ঈশ্বরভক্ত লােকের এরূপ প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হওয়া নিতান্ত অনুচিত। তাঁহার মহিমার পার নাই, ক্ষমতার সীমা নাই, কৌশলের অন্ত নাই।” এই সকল কথার পর সকলেই আপন আপন বাটিতে চলিয়া গেলেন। কিছুদিন পরে একদা মাবিয়া মুত্রত্যাগ করিয়া কুলুখ লইয়াছেন সেই --চিল, জলের পরিবর্তে ঢিল ব্যবহার করা শাস্ত্রসঙ্গত । গ বিষা-সিন্ধু—উপক্রমণিকা এ রােগের কুলুখ এমন অসাধারণ বিষসংযুক্ত ছিল যে, তিনি বিষের যন্ত্রণায় ভূতলে গড়াগড়ি দিতে দিতে অস্থির হইয়া পড়িলেন। বন্ধুবান্ধব সকলের কর্ণেই মাবিয়ার পীড়ার সংবাদ গেল। অনেকরূপ চিকিৎসা হইল ; কিন্তু ক্রমশঃ বৃদ্ধি ব্যতীত কিছুতেই যন্ত্রণার হ্রাস হইল না। মাবিয়ার জীবনের আশায় সকলেই নিরাশ হইলেন। ক্রমে ক্রমে তদ্বিষয় প্রভু মােহাম্মদের কর্ণগােচর হইলে তিনি মহাব্যস্তে মাবিয়ার নিকট আসিয়া ঈশ্বরের নাম করিয়া বিষসংযুক্ত স্থানে ফুংকার প্রদানে উদ্যত হইলেন। এমন সময় স্বর্গীয় দূত আসিয়া বলিলেন, “হে মােহাম্মদ! কি করিতেছ ? সাবধান ! ঈশ্বরের নাম করিয়া মন্ত্র পূত করিও না। এ সকল ঈশ্বরের লীলা। তােমার মন্ত্রে মার্বিয়া কখনই আরােগ্য লাভ করিবে না? সাবধান!—ইহার সমুচিত ঔষধ স্ত্রী-সহবাস। স্ত্রী-সহবাস মাত্রেই মাবিয়া বিষম বিষযন্ত্রণা হইতে মুক্তিলাভ করিবে। উহা ব্যতীত এ বিষ নিবারণের ঔষধ জগওে আর দ্বিতীয় নাই।” এই বলিয়া স্বর্গীয় দূত অন্তর্ধান হইলেন। প্রভু মােহাম্মদ শিষ্যগণকে বলিতে লাগিলেন, “ভাই সকল ! ঔষধ নাই। ইহজগতে ইহার উপযুক্ত চিকিৎসা নাই। একমাত্র উপায় স্ত্রী-সহবাস। যদি মাবিয়া স্ত্রী-সহবাস করিতে সম্মত হয়, তবেই তার প্রাণরক্ষা হইতে পারে।” মাবিয়া স্ত্রী-সহবাসে অসম্মত হইলেন। আত্মহত্যা মহাপাপ—প্রভু কর্তৃক এই উপদেশ শুনিতে লাগিলেন। পরিশেষে সাব্যস্ত হইল যে, অশীতিবর্ষীয়া কোন বৃদ্ধা স্ত্রীকে শাস্ত্রানুসারে গ্রহণ করিয়া তাহার সহিত সহবাস করিবেন। কাৰ্যেও তাহাই ঘটিল। বিষম রােগ হইতে মাবিয়া মুক্ত হইলেন ও তাহার জীবন রক্ষা হইল। অসীম করুণাময় পরমেশ্বরের কৌশলের কণামাত্র বুঝিয়া উঠা মানব- প্রকৃতির সাধ্য নহে। সেই অশীতিবর্ষীয়া বৃদ্ধা স্ত্রী কালক্রমে গর্ভবতী হইয়া যথাসময়ে একটী পুত্র-সন্তান প্রসব করিলেন। মাবিয়া পূর্বব হইতে স্থিসঙ্কল্প করিয়াছিলেন যে, যদি পুত্র হয়, তখনই তাহাকে মারিয়া ফেলিবেন। কিন্তু সুকোমল বদনমণ্ডলের প্রতি একবার নয়ন-পাত করিবামাত্রই বৈরীভাব অন্তর হইতে তিরােহিত হইল। হৃদয়ে সুমধুর বাৎসল্যভাবের আবির্ভাব হইয়া বিষাদ-সিন্ধু—উপক্রমণিকা তাঁহার মনকে আকর্ষণ করিল। তখন পুত্রের প্রাণহরণ করিবেন কি, নিজেই পুত্রের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ! আপন প্রাণ অপেক্ষাও তিনি এজিদকে অধিক ভালবাসিতে লাগিলেন। বয়ােবৃদ্ধির সহিত ভালবাসাও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। কিন্তু সময়ে সময়ে সেই নিদারুণ হৃদয়বিদারক বাক্য মনে করিয়া তিনি নিতান্ত দুঃখিত হইতেন। কিছুদিন পরে মাবিয়া দামেস্ক নগরে স্থায়িরূপে বাস করিবার বাসনা প্রভু মােহাম্মদ ও মাননীয় আলীর নিকটে প্রকাশ করিয়া অনুমতি প্রার্থনা করিলেন। তিনি আরও বলিলেন, “এজিদের কথা আমি ভুলি নাই। হাসান-হোসেনের নিকট হইতে তাহাকে দূরে রাখিবার অভিলাষেই আমি মদিনা পরিত্যাগ করিবার সঙ্ক করিতেছি।” মাননীয় আলী সরল ও সন্তুষ্টচিত্তে জ্ঞাতি-ভ্রাতা মাবিয়ার প্রার্থনা গ্রাহ করিয়া নিজ অধিকৃত দামেস্ক নগর ভঁহাকে অর্পণ করিলেন। প্রভু মােহাম্মদ কহিলেন, ‘মাবিয়া ! দামেস্ক কেন, এই জগৎ হইতে অন্য জগতে গেলেও ঈশ্বরের বাক্য লঙঘন হইবে না।” মাবিয়া লজ্জিত হইলেন, কিন্তু পূর্ব সঙ্কল্প পরি ত্যাগ করিলেন না। অল্প দিবস মধ্যে তিনি সপরিবারে মদিনা পরিত্যাগ করিয়া দ:মেস্ক নগরে গমন করিলেন এবং তাত্য রাজসিংহাসনে উপবেশন করিয়া এজ পালন ও ঈশ্বরের উপাসনায় অধিকাংশ সময় যাপন করিতে লাগিলেন। এদিকে প্রভু মােহাম্মদ হিজরী ১১ সনের ১২ই রবিয়ল-আউওয়াল সােমবার বেলা ৭ম ঘটিকার সময় পবিত্রভূমি মদিনায় পবিত্র দেহ রাখিয়া স্বর্গবাসী হইলেন। প্রভুর দেহত্যাগের ছয় মাস পরে বিবি ফাতেমা { প্রভু-কন্যা, হাসান-হোসেনের জননী, মহাবীর আলীর সহধর্মিণী ) হিজরী ১১ সনে পুত্র ও স্বামী রাখিয়! জান্নাতবাসিনী হইলেন। মহাবীর আলী হিজরী ৪০ সনের রমজান মাসের চতুর্থ দিবস রবিবার দেহত্যাগ করেন। তৎপরেই মহামান্য এমাম হাসান মদিনার সিংহাসনে উপবেশন করিয়া ধৰ্ম্মনুসারে রাজ্যপালন করিতে লাগিলেন। দামেস্ক নগরে এজিদ বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে পরবর্ণিত ঘটনা আরম্ভ হইল।

  • জান্নাত-স্বর্গ
পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র