বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/দ্বিতীয় প্রবাহ

উইকিসংকলন থেকে
দ্বিতীয় প্রবাহ

 রে পথিক! রে পাষাণহৃদয় পথিক! কি লোভে এত ত্রস্তে দৌড়াইতেছ? কি আশায় খণ্ডিতশির বর্শার অগ্রভাগে বিদ্ধ করিয়া লইয়া যাইতেছ? এ শিরে হায়— এ খণ্ডিতশিরে তোমার প্রয়োজন কি? সীমার! এ শিরে তোমার আবশ্যকতা কি? হোসেন তোমার কি করিয়াছিল? তুমি ত আর জয়নাবের রূপে মোহিত হইয়াছিলে না? জয়নাব এমাম হাসানের স্ত্রী। হোসেনের শির তোমার বর্শাগ্রে কেন? তুমিই বা শির লইয়া উর্দ্ধশ্বাসে এত বেগে দৌড়াইতেছ কেন?—যাইতেছই বা কোথা? সীমার! একটু দাড়াও। আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়া যাও। কার সাধ্য তোমার গমনে বাধা দেয়? কার ক্ষমতা তোমাকে কিছু বলে? তবুও একটু দাঁড়াও। এ শিরে তোমার স্বার্থ কি?—খণ্ডিতশিরে প্রয়োজন কি?—অর্থ? হায় রে পাতকী অর্থ! তুই জগতের সকল অনর্থের মূল। জীবের জীবনের ধ্বংস, সম্পত্তির বিনাশ, পিতা-পুত্রে শত্রুতা, স্বামী-স্ত্রীতে মনোমালিন্য, ভ্রাতা-ভগ্নীতে কলহ, রাজা-প্রজায় বৈরীভাব, বন্ধু-বান্ধবে বিচ্ছেদ, বিবাদ, বিসম্বাদ, কলহ, বিরহ, বিসর্জ্জন, বিনাশ,—এ সকলই তোমার জন্য! সকল অনর্থের মূল ও কারণই তুমি। তোমার কি মোহিনী শক্তি!—কি মধুমাখা বিষসংযুক্ত প্রেম! রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই তোমার জন্য ব্যস্ত—মহাব্যস্ত—প্রাণ ওষ্ঠাগত! তোমারই জন্য—কেবলমাত্র তোমারই কারণে—কত জনে তীর, তরবারী, বন্দুক, বর্শা, গোলাগুলী অকাতরে বক্ষঃ পাতিয়া বুকে ধরিতেছে,তোমারই জন্য অগাধ জলে ডুবিতেছে, ঘোর অরণ্যে প্রবেশ করিতেছে, পর্ব্বতশিখরে আরোহণ করিতেছে; রক্ত, মাংসপেশী, পরমাণু সংযোজিত শরীর, তোমারই জন্য শূন্যে উড়াইতেছে। কি কুহক! কি মায়া!! কি মোহিনী শক্তি!! তোমার কুহকে কে না পড়িতেছে।—কে না ধোকা খাইতেছে?—কে না মরিতেছে? তুমি দূর হও! তুমি দূর হও!—কবির কল্পনার পথ হইতে একেবারে দূর হও! কবির চিন্তাধারা হইতে একেবারে সরিয়া যাও! তোমার নাম করিয়া কথা কহিতেও অঙ্গ শিহরিয়া উঠে। তোমারই জন্য প্রভু হোসেনের শির সীমারহস্তে খণ্ডিত!—রাক্ষসি! তোমারই জন্য সেই খণ্ডিতশির বর্শাগ্রে বিদ্ধ!

 সীমার অবিশ্রান্ত যাইতেছে। দিনমণি মলিনমুখ, অস্তাচলগমনে উদ্যোগী। সীমারের অন্তরে নানা ভাব; তন্মধ্যে অর্থ চিন্তাই প্রবল; চির অভাবগুলি আশু মোচন করিতেই সে স্থির-সংকল্প। “একাই মারিয়াছি, একাই কাটিয়াছি, একাই যাইতেছি, একাই পাইব, আর ভাবনা কি? লক্ষ টাকার অধিকারী আমিই। চিন্তার কোন কারণ নাই! নিশাও প্রায় সমাগত যাই কোথা? বিশ্রাম না করিলেও আর বাঁচি না। নিকটস্থ পল্লীতে কোন গৃহীর আবাসে যাইয়া নিশাযাপন করি। এ ত সকলই মহারাজ এজিদনামদারের রাজ্যভুক্ত। আমার সৈনিক বেশ, হস্তে বর্শা, বাগ্রে মনুষ্যশির বিন্ধ, মুখে ভয়ানক রোষের লক্ষণ!সুতরাং কে কি বলিবে? কার সাধ্য—কে কি করিবে?”—সীমার স্বগত এই কথাগুলি বলিল।

 তারপর সীমার এক গৃহীর আশ্রয়ে উপস্থিত হইয়া,ঐ স্থানে সে নিশাযাপন করিবে,—এই কথা জানাইল। তাহার স্কন্ধে বর্শা-বিদ্ধ খণ্ডিতশির, তাহার দেহ অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। বুঝি রাজকর্ম্মচারী হইবে মনে করিয়া গৃহস্বামী আর কোন কথা বলিলেন না। সাদরে তিনি সীমারকে স্থান নির্দেশ করিয়া দিলেন, পথশ্রান্তি দূরীকরণের উপকরণাদি ও আহারীয় দ্রব্যসামগ্রী আনিয়া ভক্তিসহকারে অতিথি-সেবা করিলেন। ক্ষণকাল বিশ্রামের পর অতি বিনীত ভাবে তিনি বলিলেন, “মহাশয়! যদি অনুমতি করেন, তবে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি।”

 সীমার বলিল,—“কি কথা—”

 “কথা আর কিছু নহে, আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন? আর এই বর্শা-বিদ্ধ শির কোন মহাপুরুষের?”

 “ইহার অনেক কথা। তবে তোমাকে অতি সংক্ষেপে বলিতেছি। মদিনার রাজা হোসেন, তাঁহার পিতা আলী এবং মোহাম্মদের কন্যা ফাতেমা যাঁহার জননী, এ তাহারাই শির। কারবালা-প্রান্তরে, মহারাজ এজিদপ্রেরিত সৈন্যের সহিত সমরে পরাস্ত হইয়া হোসেনের এই অবস্থা। তাহার দেহ হইতে মস্তক ভিন্ন করিয়া মহারাজের নিকট লইয়া যাইতেছি। পুরস্কার পাইব। লক্ষ টাকা পুরস্কার! তুমি পৌত্তলিক, তোমার গৃহে নানা দেবদেবীর প্রতিমূর্তি আছে দেখিয়াই তোমার আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছি। মোহাম্মদের শিষ্য হইলে কখনও তোমার গৃহে আসিতাম না, তোমার আদর-অভ্যর্থনাতেও ভুলিতাম না, তোমার আহারও গ্রহণ করিতাম না।”

 “হাঁ, এতক্ষণে জানিলাম, আপনি কে? আর আপনার অনুমানও মিথ্যা নহে। আমি একেশ্বরবাদী নহি। নানাপ্রকার দেব-দেবীই আমার উপাস্য। আপনি মহারাজ এজিদের প্রিয় সৈন্য, আমার অপরাধ গ্রহণ করিবেন না। স্বচ্ছন্দে বিশ্রাম করুন। কিন্তু বর্শা-বিদ্ধ শির এ প্রকারে রাখিয়া আমার নিকট দিলে ভাল হইত। আমি ইহা আজ রাত্রে আপন তত্ত্বাবধানে রাখিতাম। প্রাতে আপনি যথা ইচ্ছা গমন করিতেন। কারণ, যদি কোন শত্রু আপনার অনুসরণে আসিয়া থাকে, নিশীথ-সময়ে সে কৌশলে, কি বলপ্রয়োগে এই মহামূল্য শির যদি আপনার নিকট হইতে কাড়িয়া লয়, কি আপনি ক্লান্তিজনিত অবশ অলসে ঘোর নিদ্রায় অচেতন হইলে আপনার অজ্ঞাতে এই মহামুল্য শির,—আপাততঃ যাহার মূল্য লক্ষ টাকা—যদি কেহ লইয়া যায়, তবে তাহা মহাদুঃখের কারণ হইবে। শিরটি আমাকে দিন; আমি সাবধানে রাখিব, আপনি প্রত্যুষে ইহা পুনরায় লইবেন। শিরটি আমার তত্ত্বাবধানে রাখিলে আপনি নিশ্চিন্তভাবে নিদ্রাসুখ অনুভব করিতে পারিবেন।”

 সীমারের কর্ণে কথাগুলি বড়ই মিষ্ট বোধ হইল। আর দ্বিরুক্তি না করিয়া তিনি প্রস্তাব শ্রবণমাত্রই সম্মত হইলেন। গৃহস্বামী হোসেন-মস্তক সম্মানের সহিত স্বীয় মস্তকে লইয়া বহু সমাদরে গৃহমধ্যে রাখিয়া দিলেন। পথশ্রাস্তিহেতু সীমারের কেবল শয়নে বিলম্ব; যেমনই শয়ন, অমনই অচেতন।

 গৃহ-স্বামী বাস্তবিক হজরত মোহাম্মদ মোস্তাফার শিষ্য ছিলেন না। নানা প্রকার দেব-দেবীর আরাধনাতেই সর্বদা তিনি রত থাকিতেন। তাঁহার উপযুক্ত তিন পুত্র ও এক স্ত্রী বর্তমান। গৃহস্বামীর নাম ‘আজর’[১]। সীমারের নিদ্রার ভাব দেখিয়া, আজর স্ত্রী-পুত্রসহ হোসেনের মস্তক ঘিরিয়া বসিলেন এবং আদ্যন্ত সমুদয় ঘটনা বলিলেন।

 যে ঘটনায় পশু-পক্ষীর চোখের জল ঝরিতেছে, প্রকৃতির অন্তর ফাটিয়া যাইতেছে, সেই দেহ-বিচ্ছিন্ন হোসেন-মস্তক দেখিয়া কাহার হৃদয়ে না আঘাত লাগে? দেবদেবীর উপাসক হউন, ইসলামধর্ম্ম-বিদ্বেষীই হউন, এ নিদারুণ দুঃখের কথা শুনিলে কে না ব্যথিত হন? পিতাপুত্র সকলে একত্র হইয়া হোসেনের শোকে কাদিতে লাগিলেন।

 আজর বলিলেন, “মানুষমাত্রেই এক উপকরণে গঠিত এবং এক ঈশ্বরের সৃষ্টি। জাতিভেদ, ধর্ম্মভেদ—সেও সর্বশক্তিমান্ ভগবানের লীলা। এর জন্য পরস্পর হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণ। কেবল মূঢ়তার লক্ষণ। এমাম হাসান-হোসেনের প্রতি এজিদ যেরূপ অত্যাচার করিয়াছে, তাহা মনে করিলে হৃদয়মাত্রেরই তন্ত্রী ছিড়িয়া যায়। সে দুঃখের কথায় কোন্ চক্ষু না জলে পরিপূর্ণ হয়? মানুষের প্রতি এরূপ ঘোরতর অত্যাচার হউক, আর না হউক, জাতি ও জীবন বলিয়াও কি প্রাণে আঘাত লাগে না? সাধু, পরম ধার্মিক, বিশেষতঃ ঈশ্বরভক্ত, মহাপুরুষ মোহাম্মদের হৃদয়ের অংশ—ইহাদের এই দশা! হায়! হায়! সামান্য পশু মারিলেও কত মানুষ কাঁদিয়া গড়াগড়ি দেয়—বেদনায় অস্থির হয়, আর মানুষের জন্য মানুষ কঁদিবে না? ধর্মের বিভেদ বলিয়া মানুষের বিয়োগে মানুষ মনোবেদনা বোধ করিবে না?— যন্ত্রণা অনুভব করিবে না? যে ধর্ম্মই কেন হউক না, পবিত্রতা রক্ষা করিতে তৎকার্যে যোগ দিতে কে নিবারণ করিবে? মহাপুরুষ মোহাম্মদ পবিত্র, হাসান পবিত্র, হোসেনের মস্তক পবিত্র; সেই পবিত্র মস্তকের এত অবমাননা? হোসেন যুদ্ধে হত হইয়াছেন বলয়াই কি এত তাচ্ছিল্য? জগৎ কয় দিনের? এজিদ! তুই কি জগতে অমর হইয়াছিস? জীবনশূন্য দেহের সদ্গ‌তির সংবাদ শুনিয়া কি তোর চিরজ্বলন্ত রোষাগ্নি নির্ব্বাণ হইত না? তোর আকাঙ্ক্ষা কি যুদ্ধ-জয়ের সংবাদ শুনিয়াও মিটিত না? হোসেন-পরিবারের মহাননের রোল সপ্ত তল আকাশ ভেদ করিয়া অনন্তধামে অনন্তরূপে প্রবেশ করিয়া অনন্ত শোক বিকাশ করিতেছে, ঈশ্বরের আসন টলিতেছে। —তোর মন কি এতই কঠিন যে, জীবনশূন্য শরীরে শত্রুতা সাধন করিতে এটি করিতেছিস না! তোকে কোন্ ঈশ্বর গড়িয়াছিল জানি না; কি উপকরণে তোর শরীর গঠিত, তাহাও বলিতে পারি না। তুই সামান্য লোভের বশবর্তী হইয়া কি কাণ্ড করিলি! তোর এই অমানুষিক কীর্তিতে জগৎ কাঁদিবে, পাষাণ গলিবে। এই মহাপুরুষ জীবিত থাকিলে তাহার এই মুখে কত শত প্রকারের ঈশ্বরের গুণ-কীর্ত্তন—কত কাল ঈশ্বরের মহত্ত্ব প্রকাশ হইত, তাহার কি ইয়ত্তা আছে? তুই অসময়ে মহাঋষি হোসেনের প্রাণহরণ করিয়াছি, কিন্তু তোর পিতা এমাম বংশের ভিন্ন নহেন তাঁহার হৃদয় এমন কঠিন প্রস্তরে গঠিত ছিল না। তাহার ঔরসে জন্মিয়া তোর এ কি ভাব! রক্তমাংস-বীর্য গুণ আজ তোর নিকট পরাস্ত হইল। মানবশরীরের স্বাভাবিক গুণ আজ বিপরীত ভাব ধারণ করিল। তাহা যাহাই হউক, আজরের এই প্রতিজ্ঞা—জীবন থাকিতে সে হোসেন-শির দামেস্কে লইয়া যাইতে দিবে না; যত্নের সহিত, আদরের সহিত, ভক্তিসহকারে সে ইহা মহাপ্রান্তর কারবালায় লইয়া যাইয়া হোসেনের শিরশূন্য দেহের সন্ধান করিয়া তাঁহার সম্মতির উপায় করিবে। প্রাণ থাকিতে এ শির অজির ছাড়িবে না!”

 আজরের স্ত্রী বললেন, “এই হোসেন বিবি ফাতেমার অঞ্চলের নিধি, নয়নের পুত্তলী ছিলেন। হায়! হায়! তাঁহার এই দশা। এ জীবন থাক্‌  বা যাক্‌, প্রভাতে হইতে না হইতেই আমরা এ পবিত্র মস্তক লইয়া কারবালায় যাইব। শেষে ভাগ্যে যা থাকে হইবে!”

 পুত্রেরা বলিল, “আমাদের জীবন পণ, তথাপি কিছুতেই সৈনিকহস্তে এ মস্তক প্রত্যর্পণ করিব না। প্রাতে সৈনিককে বিদায় করিয়া সকলে একত্রে কারবালায় যাইব।”

 পুনরায় আজর বলিতে লাগিলেন,—“ধার্ম্মিকের হৃদয় এক, ঈশ্বরভক্তের মন এক, আত্মা এক! ধর্ম্ম কি কখনও দুই হইতে পারে? সম্বন্ধ নাই, আত্মীয়তা নাই, কথায় বলে-রক্তে রক্তে লেশমাত্র যোগাযোগ নাই, তবে তাঁহার দুঃখে তোমাদের প্রাণে আঘাত লাগিল কেন? বল দেখি, তাঁহার জন্য জীবন উৎসর্গ করিলে কেন? ধার্ম্মিক-জীবন কাহার না আদরের? ঈশ্বর-প্রেমিক কাহার না যত্নের? তোমাদের কথা শুনিয়া, সাহস দেখিয়া প্রাণ শীতল হইল; “পরোপকারব্রতে জীবনপণ কথাটি শুনিয়াও কর্ণ জুড়াইল। তোমাদের সাহসেই গৃহে থাকিলাম। প্রাণ দিব, কিন্তু শির দামেস্কে লইয়া যাইতে দিব না!”

 পরস্পর সকলেই হোসেনের প্রসঙ্গ লইয়া রজনী অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারবালা প্রান্তরে যে লোমহর্ষণ ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা জগৎ দেখিয়াছে। নিশাদেবী জগৎকে আবার নূতন ঘটনা দেখাইতে, জগৎ-লোচন রবিদেবকে পূর্ব গগননপ্রান্তে বসাইয়া নিজে অন্তর্ধান হইবার উদ্যোগ করিতেছেন। জগৎ গতকল্য দেখিয়াছে, আজ আবার দেখুক—নিঃস্বার্থ প্রেমের আদর্শ দেখুক—পবিত্র-জীবনের যথার্থ প্রণয়ী দেখুক—সাধু জীবনের ভক্তি দেখুক—ধর্ম্মে দ্বেষ, ধর্ম্মে হিংসা মানুষের শরীরে আছে কিনা তাহার দৃষ্টান্ত দেখুক! ভ্রাতা, ভগিনী, পুত্র, জায়া, পরিজন বিয়োগ হইলে লোকে কঁদিয়া থাকে, জীবনকে অতি তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া জীবন থাকিতেই জীবলীলা ইতি করিতে ইচ্ছা করে। পারের জন্যও যে কঁদিতে হয়, প্রাণ দিতে হয় তাহারও জ্বলন্ত প্রমাণ আজ দেখুক, শিক্ষা করুক। সহানুভূতি কাহাকে বলে—মানুষের পরিচয় কি—মহাশক্তিসম্পন্ন হৃদয়ে ক্ষমতা কি—নশ্বর জীবনে অবিনশ্বর কি—আজ ভাল করিয়া শিক্ষা করুক।  জগৎ জাগিল। পূর্ব গগন লোহিত রেখায় পরিশোভিত হইল। সীমার শয্যা হইতে উঠিয়া প্রাতঃক্রিয়াদি সমাপন করিল। সজ্জিত হইয়া সে বর্শা হস্তে দণ্ডায়মান রহিল। এবং উচ্চৈঃস্বরে বলিল, “ওহে! আর বিলম্ব করিতে পারিবে না। আমার রক্ষিত মস্তক আনিয়া দাও। শীঘ্রই যাইব।”

 আজর বহির্ভাগে আসিয়া বলিলেন, “ভ্রাতঃ! তোমার নামটি কি, শুনিতে চাই। আর তুমি কোন্‌ ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব তাহাও জানিতে চাই। ভাই, রাগ করিও না; ধর্ম্মনীতি, রাজনীতি, যুদ্ধনীতি, অর্থনীতি, যুক্তি, বিধি-ব্যবস্থা ইহার কিছুতেই এ কথা পাওয়া যায় না যে, শত্রুর মৃত শরীরেও শত্রুতা সাধন করিতে হয়। বন্য পশু এবং অসভ্য জাতিরাই মৃত শরীরে নানা প্রকার লাঞ্ছনা দিয়া মনে মনে আনন্দ অনুভব করে। ভ্রাতঃ! তোমার রাজা সুসভ্য, তুমিও দিব্য সভ্য। এ অবস্থায় এ পশু আচার কেন ভাই?”

 “রাত্রে আমাকে আশ্রয় দিয়াছ, তোমার প্রদত্ত অন্নে উদর পরিপূর্ণ করিয়াছি; সুতরাং সীমারের বর্শা হইতে তুমি রক্ষা পাইলে। সাবধান! সকল হিতোপদেশ আর কখনও মুখে আনিও না। তোমার হিতোপদেশ তোমার মনেই থাকুক! ভাই সাহেব! বিড়াল-তপস্বী, কপট ঋষি, ভ গুরু, স্বার্থপর পীর, লোভী মৌলভী, জগতে অনেক আছে, অনেক দেখিয়াছি,—আজও দেখিলাম। তোমার ধর্ম্মকাহিনী, তোমার রাজনৈতিক উপদেশ, তোমার যুক্তি, কারণ, বিধিব্যবস্থা সমুদয় তুলিয়া রাখ। ধর্মাবতারের ধূর্ততা, চতুর সীমারের বুঝিতে আর বাকী নাই, ও-কথায় মহাবীর সীমার ভুলিবে না। আর এ সোজা কথাটা কে না বুঝিবে যে, হোসেন-মস্তক তোমার নিকট রাখিয়া যাই, আর তুমি দামেস্কে গিয়া মহারাজের নিকটে বাহাদুরী জানাইয়া লক্ষ টাকার পুরস্কার লাভ কর। যদি ভাল চাও, যদি প্রাণ বাঁচাইতে ইচ্ছা কর, যদি কিছু দিন জগতের মুখ দেখিতে বাসনা হয়, তবে শীঘ্র হোসেনের মাথা আনিয়া দাও।”

 “ওরে ভাই! আমি তোমার মত স্বার্থপর অর্থলোভী নহি। আমি দেবতার নাম করিয়া বলিতেছি, অর্ধলালসায় হোসেন-মস্তক কখনই  দামেস্কে লইয়া যাইব না। টাকা অতি তুচ্ছ পদার্থ, উচ্চহৃদয়ে টাকার খাত-প্রতিঘাত নাই। দয়া, দাক্ষিণ্য, ধর্ম্ম, সুনাম, যশঃকীর্তি, পরদুঃখকাতরতা—এই সকল মহামূল্য রত্নের নিকট টাকার মূল্য কি রে ভাই?”

 ‘ওহে ধার্ম্মিকবর! আমি ও-সকল কথা অনেক জানি। টাকা যে কি জিনিস, তাহাও ভাল করিয়া চিনি। মুখে অনেকেই ‘টাকা অতি তুচ্ছ’, ‘অর্থ অনর্থের মূল’ বলিয়া থাকে, কিন্তু জগৎ এমনই ভয়ানক স্থান যে, টাকা না থাকিলে তাহার স্থান কোথাও নাই—সমাজে নাই, স্বজাতির নিকটে নাই—ভ্রাতা-ভগ্নীর নিকট একটি কথা বলিবার সুযোগও নাই! স্ত্রীর ন্যায় ভালবাসে, বল ত জগতে আর কে আছে? টাকা না থাকিলে অমন অকৃত্রিম ভালবাসারও আশা নাই; কাহারও নিকট সম্মান নাই। টাকা না থাকিলে রাজায় চিনে না, সাধারণ মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না! জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তেও টাকা, জগতে টাকারই খেলা! টাকা যে কি পদার্থ, তাহা তুমি চেন বা না চেন, আমি বেশ চিনি। আর তুমি নিশ্চয় জানিও, আমিও নেহাৎ মূর্খ নহি, আপন লাভালাভ বেশ বুঝিতে পারি। যদি ভাল চাও, যদি আপন প্রাণ বাঁচাইতে চাও, তবে শীঘ্র খণ্ডিত মস্তক আনিয়া দাও। রাজদ্রোহীর শাস্তি কি? ওরে পাগল! রাজদ্রোহীর শাস্তি কি তাহা জান?”

 “রাজদ্রোহীর শাস্তি আমি বিশেষরূপে জানি। দেখ ভাই, তোমার সহিত বাদবিসম্বাদ ও কৌশল করিতে আমার ইচ্ছামাত্র নাই। তুমি মহারাজ এজিদের সৈনিক, আমি তাহার অধীনস্থ প্রজা। সাধ্য কি, রাজকর্মচারীর আদেশ অবহেলা করি? একটু অপেক্ষা খণ্ডিত-শির আনিয়া দিতেছি, মস্তক পাইলেই ত ভাই তুমি ক্ষান্ত হও?”

 “হাঁ, মস্তক পাইলেই আমি চলিয়া যাই, ক্ষণকালও এখানে থাকিব না। আর ইহাও বলিতেছি—মহারাজের নিকট তোমার প্রশংসাই করিব। আমাকে আদর-আহলাদে স্থান দিয়াছ, অভ্যর্থনা করিয়াছ, এ সকলই বলিব। হয় ত তুমি ঘরে বসিয়া কিছু কিছু পুরস্কারও পাইতে পার! শীঘ্র শির আনিয়া দাও।”  আজর স্ত্রীপুত্রগণের নিকট যাইয়া বিষন্নভাবে বলিলেন, “হোসেনের মস্তক রাখিতে সঙ্কল্প করিয়াছিলাম, তাহা বুঝি ঘটিল না। মস্তক না লইয়া সৈনিকপুরুষ কিছুতেই যাইতে চাহে না, আমি তোমাদের সাহায্যে সৈনিক পুরুষের ইহকালের মত লক্ষ টাকা প্রাপ্তির আশা এই স্থান হইতে মিটাইয়া দিতে পারিতাম। কিন্তু আমি স্বয়ং যাচ্ঞা করিয়া হোসেনের মস্তক আপন তত্ত্বাবধানে রাখিয়াছি। আবার সেও বিশ্বাস করিয়া আমার হস্তে ইহা সমর্পণ করিয়াছে। এ অবস্থায় উহার প্রাণবধ করিলে সম্পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতার সহিত নরহত্যা-পাপ পঙ্কিলে ডুবিতে হয়! রাজ-অনুচর, রাজকর্ম্মচারী, রাজাশ্রিত লোককে, প্রজা হইয়া প্রাণে মারা, সেও মহাপাপ। আমার স্থির সিদ্ধান্ত এই যে, নিজ মস্তক স্কন্ধোপরি রাখিয়া হোসেনের মস্তক সৈনিক-হস্তে কখনই দিব না। তোমরা ঐ খড়্গ‌ দ্বারা আমার মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া সৈনিকের হস্তে দাও, সে বর্শায় ইহা বিদ্ধ করুক। খণ্ডিত-শির প্রাপ্ত হইলে তিলার্দ্ধকালও সে এখানে থাকিবে না বলিয়াছে। তোমরা যত্নের সহিত হোসেনের মস্তক কারবালায় লইয়া, তাঁহার দেহ সন্ধান করিয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার উদ্যোগ করিবে, এই আমার শেষ উপদেশ। সাবধান! কেহ ইহার অন্যথা করিও না।

 আজরের জেষ্ঠপুত্র সায়াদ বলিতে লাগিল, “পিতঃ। আমরা ভ্রাতৃত্রয় বর্তমান থাকিতে আপনার মস্তক দেহ-বিচ্ছিন্ন হইবে? এ কি কথা? আমরা কি পিতার উপযুক্ত পুত্র নহি? আমাদের অন্তরে কি পিতৃভক্তির কণামাত্রও স্থান পায় নাই? আমরা কি এমনই নরাকার পশু যে, স্বহস্তে পিতৃমস্তক ছিন্ন করিব? ধিক্‌ আমাদের জীবনে! ধিক্‌ আমাদের মনুষ্যত্বে! যে পিতার ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়া জগতের মুখ দেখিয়াছি, মানুষের পরিচয়ে মানুষের সহিত মিশিয়াছি, সেই পিতার শির যে কারণে দেহবিচ্ছিন্ন হইবে, সে কারণের উপকরণ কি আমরা হইতে পারিব না? পিতঃ! আর বিলম্ব করিবেন না, খণ্ডিত মস্তক প্রাপ্ত হইলেই যদি সৈনিকপুরুষ চলিয়া যায়, তবে আমার মস্তক লইয়া তাহার হস্তে ন্যস্ত করুন। সকল গোল মিটিয়া যাউক।”  “ধন্য সায়াদ! তুমি ধন্য! জগতে তুমিই ধন্য! পরোপকার-ব্রতে তুমিই যথার্থ দীক্ষিত! তোমার জন্ম সার্থক; আমারও জীবন সার্থক। যে উদরে জন্মিয়াছ, সে উদরও সার্থক! প্রাণাধিক! জগতে জন্মিয়া পশুপক্ষীদিগের ন্যায় নিজ উদর পরিপোষণ করিয়া চলিয়া গেলে মনুষ্যত্ব কোথায় থাকে?” ইহা বলিয়াই আজর দোলায়মান খড়গ টানিয়া লইয়া হস্ত উত্তোলন করিলেন।

 পরের জন্য—বিশেষতঃ, খণ্ডিত মস্তকের জন্য—আজর হৃদয়ের হৃদয়, আত্মার আত্মা, প্রাণের প্রাণ জ্যেষ্ঠপুত্রের গ্রীবা লক্ষ্যে খড়গ উত্তোলন করিলেন। পিতার হস্ত উত্তোলনের ইঙ্গিত দেখিয়া সায়াদ গ্রীবা নত করিলেন, আজরের স্ত্রী চক্ষু মুদ্রিত করিলেন। কবির কল্পনা-আঁখি ধাঁধা লাগিয়া বন্ধ হইল। সুতরাং কি ঘটিল, কি হইল, লেখনী তাহা প্রকাশ করিতে পারিল না।

 উঃ! কি সাহস! কি সহ্যগুণ! দেখ্‌রে! পাষাণ্ড এজিদ! দেখ্‌! পরোপকারব্রতে পিতার হস্তে সন্তানের বধ দেখ! সীমার! তুইও দেখ,! মনুষ্য জীবনের ব্যবহার দেখ! খড়গ কম্পিত হইল, পরোপকার আর মৃত শিরের সৎকারহেতু প্রাণাধিক পুত্রশোণিতে আজ পিতার হস্ত রঞ্জিত হইল, লৌহনির্ম্মিত খড়গ কঁপিয়া স্বাভাবিক ঝন্ ঝন্ রবে আর্তনাদ করিয়া উঠিল; কিন্তু আজরের রক্তমাংসের শরীর হেলিল না, শিহরিল না—মুখমণ্ডল মলিন হইল না। ধন্য রে পরোপকার! ধন্য রে হৃদয়!!

এ দিকে সীমার বর্শাহস্তে বহির্ভাগে দণ্ডায়মান হইয়া চীৎকার করিয়া বলিতেছে, “খণ্ডিতশির হস্তে না করিয়া যে আমার সম্মুখে আসিবে, তাহারই মস্তক ধূলায় লুষ্ঠিত হইবে, অথচ হোসেনের মস্তকও লইয়া যাইব।”

 আজর খণ্ডিতশির হস্তে করিয়া সীমার সম্মুখে উপস্থিত হইলে, সীমার মহাহর্ষে শিরটি বর্শায় বিদ্ধ করিতে যাইয়া দেখিল—সদ্যকর্তিত একটি শির, শোণিতে রঞ্জিত, রক্তধারা বহিয়া পড়িতেছে। সীমায় আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিল, “এ কি! তুমি উন্মাদ হইয়া এ কি করিলে! এ মস্তক লইয়া আমি কি করিব? লক্ষ টাকা-প্রাপ্তির আশায় হোসেন-মস্তক লইয়া গোপন করিয়া কাহাকে তুমি বধ করিলে? তোমার মত নরপিশাচ অর্থলোভী ত আমি কখনও দেখি নাই। আহা! এই বুঝি তোমার হিতোপদেশ! এই বুঝি তোমার পরোপকারব্রত। আরে নরাধম! এই বুঝি তোর সাধুতা? কি প্রবঞ্চক! কি পাষণ্ড! ওরে নরপিশাচ! আমাকে ঠকাইতে আসিয়াছিস্?”

 “ভ্রাতঃ! আমি ঠকাইতে আসি নাই। তুমি ত বলিয়াছ যে, খণ্ডিত মস্তক পাইলেই চলিয়া যাইবে। এখন এ কি কথা?—এক মুখে দুই কথা কেন ভাই?”

 “আমি কি জানিতাম যে, তুমি একজন প্রধান দস্য। টাকার লোভে তুমি কখন কাহার কি সর্বনাশ করিবে কে জানিত!”  “তুমি কি পুণ্যবলে হোসেনের মস্তক কাটিয়াছিলে ভাই! মস্তক পাইলেই চলিয়া যাইবে কথা ছিল, এখন বিলম্ব কেন? আমার কথা আমি রক্ষা করিলাম; এখন তোমার কথা তুমি ঠিক রাখ।”

 “কথা কাটাকাটি করিলে চলিবে না! যে মস্তকের জন্য কারবালা-প্রান্তরে রক্তের স্রোত বহিতেছে, যে মস্তকের জন্য মহারাজ এজিদ ধনভাণ্ডার খুলিয়া দিয়াছেন, যে মস্তকের জন্য চতুর্দিকে ‘হায় হোসেন’ ‘হায় হোসেন’ রব উঠিতেছে, সেই মস্তকের পরিবর্তে এ কি?—ইহাতে আমার কি লাভ হইবে? তুমি আমার প্রদত্ত মস্তক আনিয়া দাও।”

 “ভাই! তুমি তোমার কথা ঠিক রাখিলে না, ইহাই আমার দুঃখ। ইহা ত মানুষের ধর্ম্ম নহে।”

 সীমার গোলযোগে পড়িল, একটু চিন্তা করিয়া বলিল, “এ শির এইখানে রাখিয়া দাও, আমি খণ্ডিত মস্তক পাইলেই চলিয়া যাইব, পুনরায় প্রতিজ্ঞা করিলাম। আন দেখি, এবার হোসেনের শির না আনিয়া আর কি আনিবে? আন দেখি।”

 আজরের মুখের ভাব দেখিয়া মধ্যম পুত্র বলিল, “পিতঃ, চিন্তা কি? আমরা সকলই শুনিয়াছি, খণ্ডিত মস্তক পাইলেই সৈনিকপ্রবর চলিয়া যাইবে। অধম সন্তান এই দণ্ডায়মান হইল, খড়গ হস্তে করুন। আমরা বাঁচিয়া থাকিতে মহাপুরুষ হোসেনের শির দামেস্ক-রাজ্যের ক্রীড়ার জন্য লইয়া যাইতে দিব না।”

 আজর পুনরায় খড়গ হস্তে লইলেন। যাহা হইবার হইয়া গেল। শির লইয়া তিনি সীমারের নিকটে আসিলেন। সীমার আরও আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া মনে মনে বলিল, “এ উন্মাদ কি করিতেছ?” প্রকাশ্যে সে বলিল, “ওহে পাগল! তোমার এ পাগলামী কেন? আমি হোসেনের শির চাহিতেছি।”

 “এ কি কথা? ভ্রাতঃ! তোমার একটি কথাতেও বিশ্বাসের লেশ নাই। ধিক্ তোমাকে!”

 পুনরায় সীমার বলিল, “দেখ ভাই, হোসেনের শির রাখিয়া কি করিবে? এই মস্তকটির পরিবর্ত্তে দুইটি প্রাণ অনর্থক বিনাশ করিলে, বল ত ইহারা তোমার কে?”

 “এই দুইটি আমার সন্তান!”

 “তবে ত তুমি বড় ধূর্ত ডাকাত! টাকার লোভে আপনার সন্তান স্বহস্তে বিনাশ করিয়াছ! ছিঃ! ছিঃ! তোমার ন্যায় অর্থ-পিশাচ জগতে আর কে আছে? তুমি তোমার পুত্রের মস্তক রাখিয়া দাও, শীঘ্র হোসেনের মস্তক আনিয়া দাও, নতুবা তোমার নিস্তার নাই।”

 “ভ্রাতঃ! আমার গৃহে একটি মস্তক ব্যতীত আর নাই, আনিয়া দিতেছি, লইয়া যাও।”

 “আরে হাঁ হাঁ, সেইটিই ত চাহিতেছি; সেই একটি মস্তক আনিয়া দিলেই আমি এখনই চলিয়া যাই।”

 আজর শীঘ্র শীঘ্র যাইয়া যাহা করিলেন, তাহা লেখনীতে লেখা অসাধ্য। পাঠক! বোধ হয়, বুঝিয়া থাকিবেন। এবারে সর্ব্বকনিষ্ঠ সন্তানের শির লইয়া আজর সীমারের নিকট উপস্থিত হইলেন।

 সীমার ক্রোধে অধীর হইয়া বলিতে লাগিল, “আমি এতক্ষণ অনেক সহ্য করিয়াছি। পিশাচ! আমার সঞ্চিত শির লইয়া তুই পুরস্কার লইবি? তাহা কখনই পারিবি না।”  “আমি পুরস্কার চাই না। আমার লক্ষ লক্ষ বা লক্ষাধিক লক্ষ মুল্যের তিনটি মস্তক তোমাকে দিয়াছি ভাই! তবুও তুমি এখান হইতে যাইবে না?”

 “ওরে পিশাচ! টাকার লোভ কে সম্বরণ করিতে পারে? হোহাসেনের শির তুই কি জন্য রাখিয়াছিস্? তোর সকলই কপটতা, শীঘ্ন হোসেনের মস্তক আনিয়া দে।”

 “আমি হোসেনের মস্তক তোমাকে দিব না। একটি মস্তকের পরিবর্তে তিনটি দিয়াছি, আর দিব না,—তুমি চলিয়া যাও।”

 সীমার ক্রোধে অস্থির হইয়া বলিল, “তুই মনে করিস্‌ না যে, হোসেন-মস্তক মহারাজ এজিদের নিকট লইয়া যাইয়া পুরস্কার লাভ করবি, এই যা—একেবারে দামেস্কে চলিয়া যা!” সীমার সজোরে আজয়ের বক্ষে বর্শাঘাত করিয়া তাহাকে ভূতলশায়ী করিল এবং বীরদর্পে আজরের শয়নগৃহের দ্বারে যাইয়া দেখিল,সুবর্ণ পাত্রোপরি হোসেনের মস্তক স্থাপিত রহিয়াছে, আজরের স্ত্রী খড়গহস্তে তাহা রক্ষা করিতেছেন। সীমার এক লক্ষ গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া হোসেনের মস্তক পূর্ব্ববৎ বর্শাবিদ্ধ করিয়া আজরের স্ত্রীকে বলিল, “তোকে মারিব না, ভয় নাই।”

 আজরের স্ত্রী বলিলেন, “আমার আবার ভয় কি? যাহা হইবার হইয়া গেল! এই পবিত্র মস্তক রক্ষার জন্য আজ সর্বহারা হইলাম—আর ভয় কি? মনের আশা পূর্ণ হইল না—হোসেনের শির কারবালায় লইয়া যাইয়া সৎকার করিতে পারিলাম না, ইহাই দুঃখ। তোমাকে আমার কিছুই ভয় নাই। আমাকে তুমি কি অভয় দান করিবে?”

 “কি অভয় দান করিব? তোকে রাখিলে রাখিতে পারি, মারিলে এখনই মারিয়া ফেলিতে পারি।”

 “আমার কি জীবন আছে? আমি ত মরিয়াই আছি। তোমার অনুগ্রহ চাহি না।”

 “কি! তুই অনুগ্রহ চাহিস্ না? সীমারের অনুগ্রহ চাহিস্ না? ওরে পাপীয়সি! তুই স্বচক্ষেই ত দেখলি, তোর স্বামীকে কি করিয়া মারিয়া ফেলিলাম। তুই স্ত্রীলোক হইয়া আমার অনুগ্রহ চাহিস না?”

 এই বলিয়া সীমার বর্শাহস্তে আজরের স্ত্রীর দিকে যাইল, আজারের স্ত্রী খড়গহস্ত রোষভরে দাঁড়াইয়া বলিলেন, “দেখিতেছিস্‌। ওরে পাপিষ্ঠ নরাধম, দেখিতেছিস্‌? তিনটি পুত্রের রক্তে আজ এই খড়গ রঞ্জিত করিয়াছি, পরপর আঘাতে স্পষ্টতঃ তিনটি রেখা দেখা যাইতেছে। পামর! নিকটে আয়, চতুর্থ রেখা তোর দ্বারা পূর্ণ করি।”

 সীমার একটু সরিয়া দাড়াইল। আজরের স্ত্রী বলিল, “ভয় নাই, তোকে মারিয়া আমি কি করিব? আমার বাঁচিয়া থাকা আর না থাকা, সমান কথা। তবে দেখিতেছি, এই খড়্‌গে তিন পুত্র গিয়াছে, আর ঐ বর্শাতে তুই আমার জীবন-সর্বস্ব পতির প্রাণ বিনাশ করিয়াছিস্?” এই কথা বলিতে বলিতে আজরের স্ত্রী সীমারের মস্তক লক্ষ্য করিয়া খড়গাঘাত করিলেন। খড়গ সীমারের হস্তস্থিত বর্শায় বাধা পাইয়া তাহার দক্ষিণ হস্তে আঘাত করিল। বর্শাবিদ্ধ হোসেন-মস্তক বর্শাচ্যুত হইয়া মৃত্তিকায় পতিত হইবামাত্র আজরের স্ত্রী মস্তকটি ক্রোড়ে করিয়া বেগে পলাইতে লাগিলেন; কিন্তু সীমার বাম হস্তে সাধ্বী সতীর বস্ত্রাঞ্চল ধরিয়া সজোরে ক্রোড় হইতে হোসেন-শির কাড়িয়া লইল। আজরের স্ত্রী তখন একেবারে হতাশ হইয়া নিকটস্থ খড়গ দ্বারা আত্ম-বিসর্জন করিলেন,সীমারের বর্শাঘাতে তাহাকে মরিতে হইল না। সীমার হোসেন-শির পূর্ববৎ বর্শায় বিদ্ধ করিয়া দামেস্কাভিমুখে চলিল।

  1. হজরত ইব্রাহিম খলিলোল্লার পিতার নাম ও অজর বোত,পরস্ত ছিল। ইনি সে আজর নহেন।