বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/ষোড়শ প্রবাহ

উইকিসংকলন থেকে

ষোড়শ প্রবাহ

 পরিণাম কাহার না আছে? নিশার অবসান, দিনের শেষ, সন্ধ্যার শেষ, পরমায়ুর শেষ, গর্ভের প্রসব, উপন্যাসের মিলন, নাটকের যবনিকাপতন অবশ্যই আছে। পুণ্যের ফল, পাপের শাস্তি—ইহাও নিশ্চিত।

 সীমার আজ বন্দী! যে সীমারের নামে হৃদয় কাঁপিয়াছে, যে সীমার জগৎ কাঁদাইয়াছে, সেই সীমার আজ বন্দী। সেই সীমারের আজ পরিণামফল—শেষ দশা! মোহাম্মদ হানিফা, মস্‌হাব কাক্কা, গাজী রহ্‌মান এবং প্রধান প্রধান সেনাপতিদিগের মত হইল যে, সীমারকে কিছুতেই ইহজগতে রাখা বিধেয় নহে। এমন নিষ্ঠুর, অর্থ-পিশাচ পাপাত্মার মুখ আর চক্ষে দেখা উচিত নহে। তবে কি কর্ত্তব্য?—যমালয়ে প্রেরণ। কি প্রকারে এখনও তাহা সাব্যস্ত হয় নাই।

 অলীদকে ধৃত করিয়া মোহাম্মদ হানিফা কেন ছাড়িয়া দিলেন?— তিনিই জানেন! মোহাম্মদ হানিফা মদিনার প্রবেশ-পথে নির্ব্বিঘ্নে রহিয়াছেন, সীমারের শাস্তিবিধান করিয়া অদ্যই মদিনায় যাইবেন—এই কথাই প্রকাশ পাইয়াছে।

 অলীদের যুদ্ধের আর সাধ নাই—হানিফার মদিনা-গমনে বাধা দিবার আর শক্তিও নাই, মোহাম্মদ হানিফা যখন তাহাকে ধরিয়া ছাড়িয়া দিয়াছেন, তখন এক প্রকার প্রাণের ভয়ও নাই,—কিন্তু আশঙ্কা আছে। মস্‌হাব কাক্কার কথা মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে তাহার অন্তরে জাগিতেছে। কি লজ্জা! অধীনস্থ যে সৈন্যগণ জীবিত আছে, তাহারাই বা মনে মনে কি বলিতেছে। আর এক কথা—সে কথা সে কাহাকেও বলে নাই—মনে মনেই চিন্তা করিতেছে, মনে মনেই দুঃখভোগ করিতেছে: দামেস্কের বহুতর সৈন্য মস্‌হাব কাক্কার সঙ্গী হইয়াছে, ইহার কারণ কি? কেন তাহারা কাক্কার অধীনতা স্বীকার করিল—ইহার কি কোন কারণ আছে? এই সকল ভাবিয়া অলীদ দামেস্কে না যাইয়া ভগ্নহৃদয়ে ভগ্ন-শিবিরে হানিফার মদিনা-প্রবেশকাল পর্য্যন্ত ঐ স্থানে থাকাই স্থির করিয়াছে।

 অসময়ে হানিফার শিবিরে আনন্দের বাজনা। আজ আবার বাজনা কেন? অলীদ ভাবিল ও আবার কি যুদ্ধ? আবার কি মস্‌হাব কাক্কা রণক্ষেত্রে? মনোযোগের সহিত সে দেখিতে লাগিল, আবার সেই দূরদর্শন যন্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করিল, দেখিল-যুদ্ধসাজ নহে। মস্‌হাব কাক্কা, মোহাম্মদ হানিফা প্রভৃতি বীরগণ ধনুর্ব্বাণ-হস্তে শিবিরের পশ্চাদ্ভাগ হইতে বহির্গত হইলেন এবং হস্তপদ বন্ধন অবস্থায় একজন বন্দীকে কয়েকজন সৈন্য ধরাররি করিয়া আনিল। পরে উভয় শিবিরের মধ্যবর্ত্তী স্থানে এক লৌহদণ্ডের সহিত তাহার বক্ষঃ বাঁধিয়া দুই দিকে অপর দুই দণ্ডের সহিত তাহাকে কঠিনরূপে বাঁধিয়া তাহার পদদ্বয় ঐ হস্তাবদ্ধ দণ্ডের নিম্নভাগে আঁটিয়া বঁধিয়া দিল।

 অলীদ মনে মনে ভাবিতেছে, এ আবার কি কাণ্ড উপস্থিত? এমন নিষ্ঠুরভাবে ইহাকে বাঁধিয়া তীরধনু-হস্তে সকলে অর্ধচন্দ্রাকৃতিভাবে কেন ঘিরিয়া দাঁড়াইল? এ লোকটি এমন কি গুরুতর অপরাধ করিয়াছে? ইহার প্রতি এরূপ নির্দ্দয় ব্যবহার করিতেছে কেন? একটু অগ্রসর হইয়া দেখি—কার এই দুর্দ্দশা?—কোন্ হতভাগার পাপের ফল?

 মস্হাব কাক্কা ধনুর্ব্বাণ হস্তে করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “সীমার! আজ তোমার সৃষ্টিকর্ত্তার নাম কর, তোমার কৃত সকল পাপ-কথা মনে কর। দেখিলে—জগৎ কেমন ভয়ানক স্থান? দেখিলে? একটু বিবেচনা করিয়া দেখিলে কর্ম্মফল কিঞ্চিৎ পরিমাণে এখানেই পাওয়া যায়। লোক অজ্ঞতা-তিমিরাচ্ছন্ন হইয়া ভবিষ্যতের জ্ঞান হাৱাইয়া অনেক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু শেষ রক্ষা পায় কোথায়? কে রক্ষা করে? মাতা, পিতা, স্ত্রী-পরিবার, পরিজন কেহ কাহারও নহে!— আজ কে তোমার নিকট আসিয়া দাঁড়াইল? কে তোমার পক্ষ লইয়া দুইটা কথা বলিল। মোহ-তিমিরে কেমন আচ্ছন্ন হইয়াছিলে?—তোমার হৃদয় আকাশ কেমন ঘটনার দ্বারা আবৃত করিয়া রাখিয়াছিলে? তুমি একবার ভাব দেখি, নুরনবী মোহাম্মদের দৌহিত্র ইমাম হোসেনের মস্তক সামান্য অর্থলোভে স্বহস্তে ছেদন করিয়া তোমার কি লাভ হইল? আরও অনেকে তোমার সঙ্গে ছিল, তাহারাও যুদ্ধ জয় করিয়াছিল; কিন্তু ইমাম-শির দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিতে কৈ কেহই ত অগ্রসর হয় নাই। ধিক্ তোমাকে। সীমার, শত ধিক্ তোমাকে!—তুমি জগৎ কাঁদাইয়াছ-পশুপক্ষীর চক্ষের জল ঝরাইয়াছ,—মানবহৃদয়ে বিষময় বিশাল শেলের আঘাত করিয়াছ। আকাশ-পাতাল, বন-উপবন, পর্ব্বত, বায়ু তোমার কুকীর্ত্তি কীর্ত্তন করিতেছে—সে রবে প্রকৃতি-বক্ষঃ পর্য্যন্ত ফাটিয়া যাইতেছে। কিন্তু তোমার পরিণাম-দশা তুমি কিছুই ভাব নাই। দেখ দেখি। আজ তোমার কোন দিন উপস্থিত? সীমার! তুমি কি ভাবিয়াছিলে যে, সে দিন-চিরদিনই, তোমার সুখসেব্য সুদিনই যাইবে। এক দিনও কি সে দিনের সন্ধ্যা হইবে না। দেখ দেখি, এখন কেমন কঠিন সময় উপস্থিত। সে পবিত্র মস্তক পবিত্র দেহ হইতে ছিন্ন করিতে খঞ্জর দ্বারা কত কষ্ট দিয়াছ। সে যাতনা সহ্য করিতে না পারিয়া প্রভু কি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন,— মনে হয়? ওরে পাপিষ্ঠ নরাধম! ইমামের মুমুর্ষু অবস্থার কথা মনে হয়? তোমাকে নারকী বলিতে পারি না। পরকালের জন্য যে, তোমার চিন্তা নাই, তাই আমরা বিশেষ করিয়া জানি। তােমার পাপভার—সে পাপভার, হায়! হায়! তুমি যাহার বুকের উপর উঠিয়া খঞ্জর দ্বারা গলা কাটিয়াছিলে, তিনিই লইয়াছেন। কিন্তু সীমার! জগতে দৈহিক যাতনার দায় হইতে উদ্ধার করিতে তােমার মুখপানে চায় এমন লােক কৈ? ঈশ্বরের লীলা দেখ, তোমারই অনুগত সৈন্য তােমারই হস্তপদ বন্ধন করিয়া আমার সম্মুখে আনিয়া দিল। ইহাতেও কি তুমি সেই অদ্বিতীয় ভগবানের প্রতি ভক্তি সহকারে বিশ্বাস করিবে না? এখনও কি তােমার পূর্ব্বভাব অন্তর হইতে অন্তর্হিত হয় নাই। এই আসন্নকালে একবার ঈশ্বরের নাম কর। সীমার! আমরা তােমার সমুচিত শাস্তিবিধান করিব বলিয়া আজ তীরহস্তে দণ্ডায়মান হইয়াছি। তােমায় তরবারি আঘাত করিলাম না, বর্শা দ্বারা ভেদ করিলাম না; এই বিষাক্ত তীরে তােমার শরীর জর্জ্জরিত করিয়া তােমাকে ইহজগৎ হইতে দূর করিব। ঐ দেখ, তােমার প্রিয়বন্ধু ওত্‌বে অলীদ ছল-ছল নয়নে তােমার দিকে চাহিয়া আছে মাত্র। কে আজ তােমার সাহায্য করিতে আসিল? তােমার নীরব রােদন কে কর্ণপাত করিল? তুমি যাহা নিতান্ত অনুগত, তােমার আজিকার দশা তাহার নিকট প্রকাশ করিতে, আজিকার এ অভিনয়ের অভাবনীয় দৃশ্য রাজার গােচর করিতে—অনেক চক্ষু তােমার দিকে রহিয়াছে, দেখিতেছি। কিন্তু কেহই তােমার কিছু করিল না। কি আশ্চর্য্য, তাহাদের অস্ত্রের অভাব নাই, সাহসের অভাব ঘটিয়াছে কিনা জানি না;—কৈ, তাহারা কি করিল। জগতে কেহ কাহারও নহে! সকলেই স্বার্থের দাস, লােভের কিঙ্কর। তোমায় সঞ্চিত অর্থ আজ কোথায় রহিল? সেই পুরস্কারের লক্ষ টাকায় কি উপকার হইল? ঈশ্বর-কৃপায় তুমি আজ আমাদের ক্রীড়ার সামগ্রী। ধনুর্ব্বাণ সহ তােমাকে লইয়া আজ ক্রীড়া করিব। সীমার! কৃতকার্য্যের ফল সামান্যরূপে আজ আমাদের হস্তে ভােগ কর। এই আমার কথার শেষ—প্রথম বাণ-নিক্ষেপ! দেখ বাণের আঘাত কত মিষ্ট বােধ হয়!—কেমন সুখসেব্য নিদ্রা আইসে!”

 ধনুর টঙ্কার সীমারের কর্ণে বজ্রধ্বনির ন্যায় বােধ হইতে লাগিল। প্রাণের মায়া কাহার না আছে? আজ সীমারের চক্ষে জল পড়িল, আজ পাষাণ গলিল। পূর্ব্বকৃত প্রতি মুহূর্ত্তের পাপকার্য্যের ভীষণ ছবি তাহার মনে উদিত হইল। পাপময় জীবনের নিদারুণ ভীষণ পাপছায়া তখন সীমারের চক্ষের উপর ঘুরিতে লাগিল, জলবিন্দুর সহিত শরীরের রক্তবিন্দু ঝরিতে লাগিল। সীমার ঊর্দ্ধদৃষ্টিতে আকাশ পানে চাহিয়া হোসেনের প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়া জীবন-শেষের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। শরীরের মাংসসকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে দেহস্খলিত হইয়া মৃত্তিকায় পড়িতেছে—তথায় সীমারের প্রাণ দেহ পিঞ্জরে ঘুরিতেছে। মস হাব কাক্কা প্রভৃতি দ্বিগুণ জোরে শর-নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। সীমারের শরীরের গ্রন্থিসকল ছিন্ন হইয়া পড়িতে আরম্ভ হইল, তবু প্রাণ বাহির হয় না। কি কঠিন প্রাণ। তখন সীমার ঊর্দ্ধদৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল “হে ঈশ্বর! আমার পাপের কি প্রায়শ্চিত্ত নাই? আমার শরীরের মাংসখণ্ড প্রায় স্খলিত হইয়া পড়িল, অস্থিসকল জরজর হইয়া ভগ্ন হইয়া গেল, তবু প্রাণ বাহির হইল না। হে দয়াময়! আমিও তোমার সৃষ্ট জীব, আমার প্রতি কটাক্ষপাত কর, আমার প্রাণবায়ু শীঘ্রই হোসেনের পদপ্রান্তে নীত কর।”

 মোহাম্মদ হানিফা এবং মস্‌হাব কাক্কা এই কাতরপূর্ণ প্রার্থনা শুনিয়া শরাসনে জ্যা শিথিল করিলেন, আর তুণীরে হস্ত নিক্ষেপ করিলেন না। সকলেই দয়াময়ের নাম করিয়া শত সহস্র প্রকারে তাঁহার গুণানুবাদ করিলেন। ক্রমে সীমারের প্রাণবায়ু ইহজগৎ হইতে অনন্ত আকাশে মিশিয়া হোসেনের পদপ্রান্তে আশ্রয় গ্রহণ করিল।

 বীরকেশরিগণ আর সীমারের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করিলেন না; শিবিরে আসিয়া মদিনায় যাইতে প্রস্তুত হইলেন। ওত বে অলীদ বিষন্ন বদনে দামেস্কাভিমুখে যাত্রা করিল। যে আশা তাহার অন্তরে জাগিতেছিল, সে আশা আশা-মরীচিকাবৎ ঐ প্রান্তরের বালুকা-কণা মধ্যে মিশিয়া গেল। মনে মনেই সে বুঝিল, সীমারের সৈন্যগণ মস্‌হাব কাক্কার অধীনতা স্বীকার করিয়াছে। আর আশা কি? এ প্রান্তরে আর আশা কি?