বিষাদ-সিন্ধু/এজিদ-বধ পর্ব্ব/তৃতীয় প্রবাহ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় প্রবাহ

 দয়মায় ভগবান্! তোমার কৌশল-প্রবাহ কখন কোন্ পথে কত ধাৱে যে অবিরত ছুটিতেছে, তোমার কৃপাবারি কখন কাহার প্রতি কত প্রকারে কত আকারে যে ঝরিতেছে, তাহা নির্ণয় করিয়া বুঝিবার সাধ্য জগতে কাহারও নাই। সে লীলা-খেলার যথার্থ মর্ম্ম কলমের মুখে আনিয়া সকলকে বুঝাইয়া দিবার ক্ষমতাও কোন কবির কল্পনায় নাই! কাল যে জয়নাল আবেদীন দামেস্ক-কারাগারে এজিদ-হস্তে বন্দী, প্রাণভয়ে আকুল;—আজ সেই দামেস্কসিংহাসনই তাঁহার বসিবার আসন, দামেস্ক-রাজ্যে তাঁহার পূর্ণ অধিকার—রাজপুরী পদতলে, লক্ষ লক্ষ কোটী কোটী প্রাণ তাঁহার করমুষ্টিতে। কাল জয়নালের বন্দীবেশে বন্দীগৃহ হইতে পলায়ন,—শূলে প্রাণবধের ঘোষণা শুনিয়া পর্ব্বতগুহায় আত্মগোপন,—নিশীথ-সময় স্বজন-হস্তে পুনরায় বন্দী, চির-শত্রু মারওয়ান সহ একত্র এক সময় বন্দী! আজ হামান জীবনের মত বন্ধনদশা হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছেন। আর জয়নাল আবেদীনের শিরে রাজমুকুট শোভা পাইতেছে। ধন্য রে কৌশলী! ধন্য ধন্য তোমার মহিমা!

 আবার এ কি দেখিতেছি। এখনই কি দেখিলাম, আবার এখনই বা কি দেখিতেছি। এই কি সেই বন্দীগৃহ! যে বন্দীগৃহের কথা মনে পড়িলে অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠে, হৃদয়ের শোণিতাংশ জলে পরিণত হয়, এ কি সেই বন্দীগৃহ। ইহাকে যে সূর্য্যের অধিকারে একবার দেখিয়াছি, এখনও সে অধিকার বিলুপ্ত হয় নাই, এখনও সেই সূর্য্য লোহিত সাজে সাজিয়া পররাজ্যে দেখা দিতে জগৎ-চক্রে চক্ষুর অন্তরাল হয় নাই,—ইহারই মধ্যে এই দশা! এত পরিবর্ত্তন? কৈ, সেই যমদূতসদৃশ প্রহরী কৈ? সে নির্দ্দয় নিষ্ঠুরেরাই বা কোথায়? শাস্তির উপকরণ লৌহশলাকা, জিঞ্জির, কটাহ, মুষল, সকলই ত পড়িয়া আছে। জীবন্ত জীব কোথায়? কৈ কাহাকেও ত দেখিতেছি না। কেবল দেখিতেছি —জীবনশূন্য দেহ, আর চর্ম্মশূন্য মানব-শরীর।

 কেন নাই? এদিকে একটি প্রাণীও কেন নাই?—যে দিকে থাকিবার সে দিকে আছে। প্রভু হোসেন-পরিবার যে দিকে বন্দী, সে দিকে কোন পরিবর্ত্তনই হয় নাই। সেই কণ্ঠনিনাদ, সেই স্ত্রীকণ্ঠে আর্ত্তবিলাপ, সেই মর্ম্মান্তিক বেদনাযুক্ত গত কথা, কিন্তু—ভাব ভিন্ন, অর্থ—ভিন্ন, কণ্ঠ—ভিন্ন।

 “হায়। কোথায় আমি—জয়নাব,— সামান্য ব্যবসায়ী দীন হীন দরিদ্রের কুলবধু,—দৈহিক শ্রমোপার্জ্জিত সামান্য অর্থাকাঙ্খীর সহধর্ম্মিণী! রাজাচার— রাজব্যবহার—রাজ-পরিবারগণের অতি উচ্চ সুখ-সম্ভোগের সহিত আমার সম্বন্ধ কি? আমি রাজ-অন্তপুরে কেন? মদিনার পবিত্র রাজ-পুরী মধ্যে জয়নাবের বাস অতি আশ্চর্য্য! দামেস্কের রাজকারাগারে বন্দিনী—সে আরও আশ্চর্য্য! আমার সহিত এ কারাগৃহের সম্বন্ধ কি? হায়! আমার নিজ জীবনের আদি-অন্ত ঘটনা মনোযোগের সহিত ভাবিয়া দেখিলে প্রত্যক্ষ প্রমাণের সহিত প্রমাণ হইবে: এই হতভাগিনীই বিষাদ-সিন্ধুর মূল।—জয়নাবই এই মহা প্রলয়কাণ্ডের মুল কারণ। হায়! হায়!! আমার জন্যই নূরনবী মোহাম্মদের পরিবার—পরিজন প্রতি এই সাংঘাতিক অত্যাচার। হায় রে! আমার স্থান কোথায়? আমি পাপীয়সী! আমি রাক্ষসী! আমার জন্য “হাবিয়া” নরক-দ্বার উদ্ঘাটিত রহিয়াছে। কি পরিতাপ! আমার জন্যই জাএদার কোমল অন্তরে হিংসার সূচনা। এ হতভাগিণীর রূপ-গুণেই জাএদার মনের আগুনের দ্বিগুণ—ত্রিগুণ—পঞ্চগুণ বৃদ্ধি। অবলা প্রাণে কত সহিবে? পতিপ্রাণা ললনা আর কত সহ্য করিবে? সপত্নীবাদ জনিত মনের আগুণ কি নির্ব্বাপিত হয়?—সপত্নী ছাড়িয়া শেষে স্বামীকেই আক্রমণ করে। মন যাহা চায় নিয়তির বিধান থাকিলে তাহা পাইতে কতক্ষণ? খুঁজিলেই পাওয়া যায়। মায়মুনার মনোসাধ পূর্ণ করিতে জাএদার প্রয়োজন; জাএদার মনোসাধ পূর্ণ করিতে মায়মুনার আবশ্যক। সময়ে উভয়ের মিলন হইল, সোনায় সোহাগ মিশিল। শেষে নারীহস্তে—উঁহু! মুখে আনিতেও হৃদয় ফাটিয়া যায়,—বিষ! —মহাবিষ!” (নীরব)

 জয়নাব কর্ণে শুনিতেছেন: নগরের জনকোলাহল, সৈন্যগণের ভৈরব নিনাদ— কাড়া-নাকাড়া দামামার বিঘোর রোল;—মধ্যে মধ্যে জয়-উল্লাসের সহিত জয়নাল আবেদীনের নাম। মৃদু মৃদু স্বরে তিনি বলিতে লাগিলেন,—“এ কি! আজি আবার ও কি শুনি! এত জনকোলাহল কিসের জন্য। অনেকক্ষণ তিনি স্থির কর্ণে,—স্থির মনে রহিলেন, কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। অন্য দিকে চাহিয়া দেখিলেন: বন্দীগৃহের দ্বারে দ্বারে যেখানে রক্ষীগণ পাহারা দিতেছিল, সেখানে কেহই নাই!—সমুদয় দ্বার উন্মুক্ত। দক্ষিণে চাহিয়া দেখিলেন: বিবি সালেমা, শাহ্‌রেবানু, হাস্‌নেবানু ম্লান বদনে নীরবে বসিয়া রহিয়াছেন। ক্ষণে শাহ্‌রেবানু কাতর কণ্ঠে বলিতেছেন, “ওরে বাপ্! বাবা জয়নাল! তুই কোথা গেলি বাপ্? তুই আমার কোলে আয় বাপ্!”—জয়নাব যে স্থানে বসিয়াছিলেন, সেই স্থানেই রহিলেন এবং পূর্ব্ব কথা বলিতে লাগিলেন।

 “উঁহু! বিষ!—জাএদার হস্তে বিষ!! যদি হতভাগিনী জয়নাব হাসানের দাসীশ্রেণীর মধ্যে পরিগণিতা না হইত, যদি তাহার রূপ গুণ না থাকিত, যদি সে স্বামীসোহাগিনী না হইত, তাহা হইলে জাএদার হস্তে কখনই বিষ উঠিত না—মায়মুনার কথা কখনই জাএদা শুনিত না।—এই হতভাগিনীর জন্যই বিষ! এজিদ-মুখে শুনিয়াছি,—সৈন্য-সামন্ত লইয়া মৃগয়ায় যাইতে গবাক্ষদ্বারে সে আমাকে দেখিয়াছিল। কত চক্ষু এজিদকে দেখিতে আগ্রহ প্রকাশ করিল, আমি নাকি তাহাকে ঘৃণার চক্ষে দেখিয়া গবাক্ষদ্বার বন্ধ করিয়াছিলাম! আমার ত কিছুই মনে হয় না! পাপিষ্ঠ আরও বলিল,—সে দিন আমার মস্তকোপরি চিকুর-সংলগ্ন মুক্তার জালি ছিল, কর্ণে কর্ণাভরণ দুলিতেছিল। ছিঃ ছিঃ! কেন গবাক্ষদ্বার খুলিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম, সেই কূলক্ষণযুক্ত গবাক্ষ-দ্বারে অবস্থানই আমার কাল হইয়াছিল! এই মহা দুর্ঘটনার কারণই গবাক্ষ-দ্বারে আমার অবস্থান,—বিনা আবরণে মস্তক উলঙ্গ করিয়া দণ্ডায়মান। এখন বুঝিলাম, সেই শাহীনামার মর্ম্ম! এখন বুঝিলাম: রাজ-প্রাসাদে আবদুল জব্বারের আহ্বানের অর্থ! এখন বুঝিলাম: সামান্য দরিদ্র-গৃহে রাজ-কাসেদের শাহীনামা লইয়া গমন, আবদুল জব্বারের নিমন্ত্রণের মন্ত্রণা,— সকলই চাতুরী। এরূপ আহ্বান, আদর, সমাদর, নামা প্রেরণ, সকলই আমার জন্য। এজিদের চাতুরী আবদুল জব্বার কি বুঝিবে? রাজ-জামাতা হইয়া আশার অতিরিক্ত সুখভোগ করিবে, সামান্য ব্যবসায়ী —সামান্য অর্থের জন্য যে লালায়িত—সে রাজকুমারী সালেহাকে লাভ করিয়া জীয়ন্তে স্বর্গসুখ ভোগ করিবে, নরললাকে বাস করিয়া স্বর্গীয় অপ্সরার সহিত মিলিত হইয়া পরমাত্মাকে শীতল করিয়া সুখী হইবে! সেই আশাতেই আমাকে বিনা অপরাধে আবদুল জব্বার পরিত্যাগ করিল। কি নিষ্ঠুর! কি নির্দ্দয়!— কি কপট। সেই শাহীনামা প্রাপ্তির পূর্ব্বক্ষণ পর্য্যন্ত আমার দুঃখ দেখিয়া তাহার কত আক্ষেপ, কত মনোবেদনা প্রকাশ!—কি কপট! রন্ধনশালার কার্য্যে অগ্নির উত্তাপে আমার মুখের ঘর্ম্ম-বিন্দু মুক্তা-বিন্দু আকারে ফুটিয়াছিল!—ছাই-কয়লার কালি বস্ত্রে—হস্তে লাগিয়াছিল! সম্মুখে দর্পণ ধরিয়া দর্পণে আমার ছায়া আমাকে দেখান হইল! বলা হইল—“টাকা থাকিলে কি এত দুঃখ তোমার হয়? আমার প্রাণে কি ইহা সহ্য হয়?” কত প্রকার আক্ষেপ আবদুল জব্বার করিয়াছিল, তাহার প্রত্যক্ষ ফল সে হাতে হাতে দেখাইল। সেই দিনই তাহার দামেস্কে যাত্রা।—রাজপ্রাসাদে সে সাদরে গৃহীত। যেমনই প্রস্তাব, অমনই অনুমোদন—আমাকে পরিত্যাগ! ধন্য বিবি সালেহা! স্পষ্টই তিনি উত্তর করিলেন: এক স্ত্রীর সহিত যখন এই ব্যবহার—অর্থলোভে চিরপ্রণয়ী প্রিয়-পত্নীকে পরিত্যাগ,—তখন আর বিশ্বাস কি? আবদুল জব্বারের সহিত তাঁহার বিবাহে অস্বীকার—যেমন কর্ম্ম তেমনই ফল! এজিদেরই জয়! এজিদেরই মনোবাসনা পূর্ণ!—কৌশলে জয়নাবকে হস্তগত করিবার উপায়-পথ আবিষ্কার। আবদুল জব্বারের হা-হুতাশ—পরিতাপ সার!—রাজপুরী হইতে গুপ্তভাবে বহির্গত হইয়া জনতার মধ্যে তার আত্মগোপন! সংসারে—তার ঘৃণা, পরিণামে ফকিরী গ্রহণ!—সকলই সেই ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা! আমার অদৃষ্টে যাহা লেখা ছিল, তাহাই হইয়া গেল। বিধবা হইলাম। পূর্ণ বয়সে স্বামী-সুখে বঞ্চিত হইলাম। আর কোথায়? কোথায় যাইব? পিত্রালয়ে আসিলাম।”

 “পাপাত্মা এজিদ মনোসাধ পূর্ণ করিবার আশা-পথ পরিষ্কার করিয়া অগ্রপশ্চাৎ না ভাবিয়া তাহার নিজ ভাব ও গতি অনুসারে কাসেদ পাঠাইবার স্থির সিদ্ধান্ত করিয়াছিল। সে মনে মনে ভাবিয়াছিল: স্ত্রীলোক যাহা চায়— তাহাই আমার আছে, ধনরত্ন অলঙ্কারের ত অভাব নাই!—তাহার উপর দামেস্করাজ্যের পাটরাণী! প্রভু হাসানের প্রস্তাব শুনিয়া এজিদের ধনরত্ন, পদমর্য্যাদা, দামেস্কের সিংহাসন এই পায়ে দূরে নিক্ষেপ করিয়া মোস্‌লেমের শেষ প্রস্তাবেই স্বীকৃত হইলাম। পরিণয়-গ্রন্থি ছিন্ন হইবার পর আর সংসারে মন লিপ্ত হইল না।—পরকালের উদ্ধার-চিন্তাই বেশী হইয়াছিল। জগৎ কিছু নয়;—সকলই অসার। ধন, জন, স্বামী, পুত্র, মাতা, পিতা কেহ কাহারও নয়, যাহা কিছু সত্য-সম্পূর্ণ সত্য, তাহা সেই সৃষ্টিকর্ত্তা বিধাতা। পরকালে মুক্তি হইবে, সেই আশাতেই প্রভু হাসানের মুখ পানেই চাহিলাম। কিন্তু বড় কঠিন প্রশ্ন পড়িলাম। একদিকে জগতের অসীম সুখ, অন্য দিকে ধর্ম্ম ও পরকাল—অনেক চিন্তার পর দ্বিতীয় সঙ্কল্পের দিকেই মন টলিল। মহারাণী হইতে ইচ্ছা হইল না। সময় কাটিয়া গেল, বৈধব্যব্রত সাঙ্গ হইল। সময়ে প্রভু হাসানের দর্শনলাভ ঘটিল। ঈশ্বর-কৃপায় সে সুকোমল পদসেবা করিতে অধিকারিণী হইলাম। প্রভু ধর্ম্ম-শাস্ত্রমতে আমার পাণিগ্রহণ করিলেন। আবার সংসারী হইলাম। প্রভু হাসান অতি সমাদরে আমাকে মদিনায় লইয়া নিজ অন্তঃপুরে আশ্রয় দিলেন। নূতন সংসারে অনেক কিছুই নুতন দেখিলাম। পবিত্র অন্তঃপুরের পবিত্রতা, ধর্ম্মচর্চ্চা, ধর্ম্মমতের অনুষ্ঠান, ধর্ম্মক্রিয়া—অনেক কিছুই দেখিলাম, অনেক কিছুই শিখিলাম। মুক্তি ক্ষেত্রে আশালতার অঙ্কুরিত ভাব দেখিয়া মনে কথঞ্চিৎ শান্তিলাভ হইল। কিন্তু সংসারচরে আবর্ত্তে পড়িয়া, সপত্নী-মনোবাদ জনিত হিংসা-আগুনে জ্বলিয়া পুড়িয়া খাক হইতে হইল। তাহাতেই বুঝিলাম: জগতে সুখ কোথাও নাই। দৈহিক জীবনে মনের সুখ কোন স্থানেই নাই। রাজা, প্রজা, ধনী, নির্ধন, দুঃখী, ভিখারী, মহামানী, মহামহিম, বীরকেশরী আন্তরিক সুখ সম্বন্ধে সকলেই সমান—রাজরাণী, ভিখারিণী, ধনীর সহধর্ম্মিণী, দুঃখিনীর নন্দিনী সকলেরই মনের সুখ সমতুল্য। প্রাণে আঘাত লাগিলে মুখ বন্ধ থাকে না। পবিত্রপুরী মধ্যে থাকিয়া এই হতভাগিনী—সপত্নীবাদেই সমধিক মনোবেদনা ভোগ করিয়াছে। সপত্নী সহ একত্র বাস—এক প্রকার জীয়ন্তে নরক-ভোগ! আমি কিন্তু প্রকাশ্যে ছিলাম ভাল। কারণ, যেখানে প্রভুর আদর—সেখানে অন্যের অনাদরে দুঃখ কি? সপত্নীবাদেও রহস্য আছে।— যেখানে সপত্নীবাদ, সেইখানেই শুনা যায়—স্বামীর চক্ষে কনিষ্ঠা স্ত্রীই আদরের ও পরম রূপবতী। পূর্ব্বে জাএদার ভাগ্যাকাশে যে যে প্রকাৱে স্বামীর ভালবাসার তারকারাজি ফুটিয়া চমকিয়াছিল,আমার ভাগ্যবিমানেও তাহাই ঘটিল।—আমিই যখন কনিষ্ঠা স্ত্রী, স্বামীর ভালবাসায় আমিই সম্পূর্ণ অধিকারিণী—সাধারণ মতে আমিই স্বামীর হৃদয়, অন্তর, প্রাণ ষোল আনা অধিকার করিয়া বসিয়াছি।—এই কারণেই আমি জাএদার চক্ষের বিষ! এই কারণেই স্বামীবধে মহাবিষের আশ্রয়গ্রহণ! এক বিষের কথাতেই এত কথা মনে হইল। প্রভুর অন্তঃপুরে আমি জাএদার চক্ষের বিষ। আমাকে জ্বলন্ত অঙ্গার হইয়াই বাস করিতে হইল। স্বামীর হাব-ভাব, বিচার-ব্যবস্থায় তিন স্ত্রীর মধ্যে প্রকাশ্যে ইতর-বিশেষ কিছুই ছিল না। জাএদার চক্ষে আমি যাহা—হাস্‌নেবানুর চক্ষে কিন্তু আমি তাহার বিপরীত। হাস্‌নেবানু স্বামীগতপ্রাণ, স্বামীকে অকপটে হৃদয়ের সহিত ভালবাসেন! সেই ভালবাসা—স্বামীর গুপ্ত ভালবাসা আমাকে ভাবিয়া—ভালবাসায় ভালবাসা-জ্ঞানে আমাকেও তিনি হৃদয়ের সহিত ভালবাসিলেন। তিনি আমাকে বিশ্বাস করিলেন—আমার প্রতি তাঁহার ভালবাসার কারণ কি? আমার মনে হইল যে, সপত্নী জাএদা তাঁহার অন্তরে যে প্রকার দুঃখ দিয়াছিল, আমার দ্বারা তাহা পরিমাণ অনুযায়ী পরিশোধ হইল ভাবিয়াই, বোধ হয়, আমি ভালবাসা পাইলাম। জাএদাকে তিনি যে প্রকার বিষ-নয়নে দেখিতেন, জাএদা আমাকেও সেই প্রকার বিষ-নয়নে দেখিতে লাগিল। সুতরাং, শত্রুর শত্রু—মিত্র। ইহাতে আমি হাস্‌নেবানুর প্রিয় সপত্নী। সপত্নী—সম্পর্কে, কিন্তু স্নেহে আদরে ভালবাসায় প্রিয়তমা সহোদরা। জ্যেষ্ঠা ভগিনী কনিষ্ঠাকে যে যে প্রকারের সুমিষ্ট বচনে, উপদেশ-আজ্ঞায় সতর্ক করেন, হাসনেবানু আমাকেও সেই প্রকারে ভালবাসার সহিত নানা বিষয়ে সাবধান ও সতর্ক করিতেন। আমিও তাঁহাকে ভক্তির চক্ষে, দেখিয়াছি, এ পর্য্যন্তও দেখিতেছি। কোন সময়ে জাএদা বিবির সহিত চোখে মুখে নজর পড়িলেই সর্ব্বনাশ! সে তীব্র দৃষ্টির ভাব যেন এখনও আমার চক্ষের উপর আঁকা রহিয়াছে বলিয়া বোধ হয়। পারেন ত তিনি চক্ষের তেজে আমাকে দগ্ধ করিয়া ছাই করেন?—জীবন্ত গোরে পুঁতিতে পারিলেই যেন নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচেন!—এমনই রোষ, এমনই হিংসার তেজ যে, অমন সুন্দর মুখখানি, আমার মুখের উপর নজর পড়িতেই, যেন বিকৃত হইত।—কে যেন এক পেয়ালা বিষ সেই মুখের উপর ঢালিয়া দিত। কিছু দিন যায়। একদিন অতি প্রত্যুষে মেঘের গুড়্ গুড়্ শব্দের ন্যায় ডঙ্কা, কাড়া, নাকাড়াধ্বনি কানে আসিল। মনে আছে,—খুব মনে আছে: প্রভাত হইতে না হইতেই মদিনাবাসীরা ঈশ্বরের নাম করিয়া বীর-মদে মতিয়া উঠিল; দেখিতে দেখিতে যুবা বৃদ্ধ সকলের শরীরেই চর্ম্ম, বর্ম্ম, তীর, তরবারি শোভা পাইতে লাগিল। রূপের আভা, অস্ত্রের আভা-সজ্জিত আভায় সমুদিত দিনমণির অদ্বিতীয় উজ্জ্বলাভ সময়ে সময়ে যেন মলিন বোধ হইতে লাগিল।”

 “প্রভুও সজ্জিত হইলেন,—বীরসাজে সাজিলেন। সে সাজ আমার চক্ষে সেই-ই প্রথম,—এখনও যেন চক্ষের উপর ঘুরিতেছে। দেখিলাম প্রভুই সকলের নেতা। কিছুক্ষণের পরে দেখি বীর-প্রসবিনী মদিনার বীরাঙ্গনাগণও মুক্তকেশে অসি-হস্তে দলে দলে প্রভুর নিকটে আসিয়া যুদ্ধে যাইতে ব্যগ্রতা প্রকাশ করিলেন। কাহার সহিত যুদ্ধ?—কে সে লোক যে, কুলের কুলবধুরাও পর্য্যন্ত অসি-হস্তে সে মহাপাপীর বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়াছে? শেষে শুনিলাম: এজিদের আগমন,—মদিনা আক্রমণের উপক্রম। ধন্য মদিনা! বিধর্ম্মীয় হস্ত হইতে ধর্ম্ম রক্ষা, স্বাধীনতা রক্ষা, জাতীয় জীবন রক্ষা হেতু নারীজীবনে রণ-বেশ!—কোমল করে লৌহ অস্ত্র! মদিনা! হৃদয়ের সহিত তোমায় নমস্কার করি।”

 “প্রভু আমার রণ-রঙ্গিণীদিগকে ভগিনী সম্ভাষণে কত অনুনয় বিনয় করিয়া যুদ্ধ-গমনে তাঁহাদিগকে ক্ষান্ত করিয়া স্বয়ং যুদ্ধে গমন করিলেন। ঈশ্বরকৃপায় মদিনাবাসীর সাহায্যে যুদ্ধে জয়লাভ হইল। বিজয়ী বীরগণকে মদিনা ক্রোড় পাতিয়া কোলে লইল। আমার ভাবনা, চিন্তা, এজিদের ভয়—হৃদয় হইতে একেবারে সরিয়া গেল। এজিদের পক্ষ পরাস্ত—আনন্দের সীমা নাই। কিন্তু একটি কথা মনে হইল। এ যুদ্ধের কারণ কি? প্রকাশ্যে যাহাই থাকুক, লোকে যাহাই বলুক, রাজ্যলাভের সঙ্গে সঙ্গে জয়নাব-লাভের আশা যে, এজিদের মনে না ছিল, তাহা নহে! ঈশ্বরই রক্ষা করিলেন। কিন্তু জাএদার চিন্তা—জয়নাবের সুখ-তরী বিষাদ-সিন্ধুতে বিসর্জ্জন করা। সোনায় সোহাগা মিশিল! মায়মুনার ছলনায় জাএদা ইহকালের কথা ভুলিয়া সপত্নীবাদের হিংসার বশবর্ত্তিনী হইয়া স্বহস্তে স্বামীর মুখে বিষ ঢালিয়া দিল। খর্জ্জুর উপলক্ষ্য মাত্র। জাএদার কার্য্য জাএদা করিল, কিন্তু ঈশ্বর রক্ষা করিলেন,—প্রভু প্রাণে বাঁচিলেন, প্রভু রক্ষা পাইলেন! কিন্তু শত্রুর ক্রোধ দ্বিগুণ, চতুর্গুণ বাড়িয়া প্রাণবিনাশের নূতন চেষ্টা হইতে লাগিল। চক্রীর চক্র ভেদ করা কাহারও সাধ্য নহে। সেই মায়মুনার চক্রে, সেই জাএদার প্রদত্ত বিষেই প্রভু আমার জগৎ কাঁদাইয়া, জগতে চির বিষাদ-বায়ু বহাইয়া স্বর্গধামে চলিয়া গেলেন। জয়নাবের কপাল!—পোড়া কপাল আবার পুড়িল।— আবার বৈধব্যব্রত—সংসার-সুখে জলাঞ্জলি!”

 “হায়! হায়!!—পাপীয়সী জাদা আমাকে মহাবিষ না দিয়া প্রভু হাসানকে কেন বিষ দিয়া প্রাণসংহার করিল? আমার পরমায়ু শেষ করিয়া জগৎ হইতে আমাকে দূর করিলে, আবার সে যেই সেই-ই হইত!— আবার স্বামীর ভালবাসা নূতন প্রকারে পাইত। তাহার মনের বিশ্বাসেই বলি—হতভাগিনী জয়নাব জগৎ-চক্ষু হইতে চিরদিনের মত সরিলে—তাহার স্বামী আবার তাহারই হইত। স্বামীর ভালবাসা-ক্ষেত্র হইতে জয়নাব-কণ্টক দূর হইলে আবার প্রণয়-কুসুম শতদলে বিকশিত হইত। সে তাহা করিল না কেন? পাপীয়সী সেই সুপ্রশস্ত সরল পথে পদ-বিক্ষেপ না করিয়া এ পথে,—স্বামীসংহার পথে কেন হাঁটিল?—মায়মুনার পরামর্শ!—আর হিংসার সহিত দুরাশার সমাবেশ—এই দুইএর একত্র সম্মিলন। ক্ষুদ্র বুদ্ধিমতী বাহ্যিক সুখপ্রিয় বিলাসিনী রমণীগণের আকাঙ্খা উত্তেজনা,— রত্ন-অলঙ্কার।—মহামুল্য বসনের অকিঞ্চিৎকর আকর্ষণ।—জাএদা অতুল ধনসম্পত্তির অধিকারিণী হইবে। শেষে পাটরাণী হইবারও আশার কুহক তাহার মনে! পাটেশ্বরী হইয়া দামেস্ক-রাজ-সিংহাসনে এজিদের বাম পার্শ্বে তাহার বসিবার ইচ্ছা! স্ত্রীজাতি প্রায়ই বাহ্যিক সুখ-সম্ভোগপ্রিয়া। প্রভু হাসান-সংসারে বিলাসিতার নামমাত্র ছিল না। সে অন্তঃপুরে রমণীর মনোমুগ্ধকারী সাজ-সরঞ্জাম ও উপকরণের প্রচলন—ব্যবহার দূরে থাকুক,—ধর্ম্মচিন্তা, ধর্ম্মভাব, বিশুদ্ধ আচরণ ভিন্ন সুখ-সম্পদের নামগন্ধের অণুমাত্রও কাহারও মনে ছিল না।—এজিদ-অন্তঃপুরে জগতের সুখে সুখী হইবার সকলি আছে; এজিদের মতে মত দিয়া সেই প্রকার সুখসাগরে ভাসিতে আর বাধা কি? কয় দিন—স্ত্রীলোকের মন কয় দিন? দুরাশার বশবর্ত্তিনী হইয়াই জাএদার মতিচ্ছন্ন! মদিনার সিংহাসন শূন্য! প্রভুর জলপানের সোরাহীতে হীরকচূর্ণ!—হায়! এক কথা মনে উঠিতে কত কথাই না মনে উঠিতেছে! এ কথা শুনে কে? মন ত কিছুতেই প্রবোধ মানে না। এখন এ সকল কথা মনে উঠিল কেন? উঁহু। আমি ত স্বামীর পদতলেই শয়ন করিয়াছিলাম। প্রভু আমার বক্ষোপরি পবিত্র পদ দুখানি রাখিয়া নিদ্রাসুখ অনুভব করিতেছিলেন। পাপীয়সী জাএদা কোন্ সময়ে কি প্রকারে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল। বিবি হাস নেবানুর এত সতর্কতা, এত সাবধানতা—খাদ্য সামগ্রী, পানীয় জলে এত যত্ন,—ইহার মধ্যে কি প্রকারে কি করিল? আমার কপাল পুড়িবে, তাহা না হইলে নিদ্রাঘোরে অচেতন হইলাম কেন? কত রাত জাগিয়াছি, কত নিশা বসিয়া কাটাইয়াছি, হায়! হায়!! সে রাত্রে নিদ্রার আকর্ষণ এতই হইল? জাএদা কক্ষমধ্যে আসিয়া পানীয় জলে বিষ মিশাইল, কিছুই জানিতে পারিলাম না।— পাপীর অধোগতি—দুর্গতি ভিন্ন সদ্গতি কোথায়? জাএদার আশা মিটিল না! যে আশার কুহকে পড়িয়া সে স্ত্রী-ধর্ম্মে জলাঞ্জলি দিয়া স্বহস্তে স্বামীর মুখে বিষ ঢালিয়া দিল, সে আশায় ছাই পড়িল! পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইল না, কিন্তু কার্য্যফলের পরিণামফল ঈশ্বর একটু দেখাইয়া দিলেন। জাএদা নব প্রেমাস্পদ কপট প্রেমিক প্রাণাধিক শ্রীমান এজিদের নিকট প্রকাশ্য দরবারে প্রতিজ্ঞা পরিপূরণ সহিত বিষময় বাক্যবাণ লাভ করিল, শেষে তাহার পরমায়ু প্রদীপও নির্ব্বাপিত হইল। দরবার গৃহের সকল চক্ষুই দেখিল—জাএদা রাজরাণী—এজিদের বাম অঙ্ক-শোভিনী, স্বর্ণ-সিংহাসনে পাটরাণী। সেই মুহূর্ত্তেই—সেই চক্ষেই আবার দেখিল—অস্ত্রাঘাতে এজিদ-হস্তে জাএদার মুণ্ডপাত। জাএদার ভবলীলা সাঙ্গ হইল। দরবার গৃহের মর্য্যাদা রক্ষা পাইল। বিচার-আসনের গৌরব বৃদ্ধি হইল। আমার মনের কথার ইতি হইল না। মায়মুনাও পুরস্কারের স্বর্ণ মুদ্রা গণিয়া লইতে পারিল না।”

 পুনরায় ‘জয় জয়রব’ ক্রমেই যেন নিকটবর্ত্তী। কান পাতিয়া জয়নাব শুনিলেন: জনকোলাহলের ক্রমেই বৃদ্ধি—মুখে বলিলেন,—“আজি এত গোলমাল কিসের? কি হইল? যাক্, ও গোলযোগে আমার লাভ কি? মনের কথা উথলিয়া উঠিতেছে।”

 “স্থির করিলাম, এ পবিত্র পুরী জীবনে পরিত্যাগ করিব না। সেখানেই যাইব নিস্তার নাই। এজিদের হস্ত হইতে জয়নাবের নিস্তার নাই। এই ভাবিয়া, প্রভু হোসেনের আশ্রয়েই রহিলাম। এজিদের আশা যেমন তেমনই রহিয়া গেল। তাহার এত চেষ্টা, এত যত্ন, এত কৌশলেও জয়নাব হস্তগত হইল না। এ পথে একমাত্র বাধা জয়নাবের আশ্রয়দাতা। আশ্রয়দাতাকে ইহজগৎ হইতে দূর করাই এজিদের আন্তরিক ইচ্ছা, প্রকাশ্যে রাজ্যলাভের কথা, কিন্তু মনের মধ্যে অন্য কথা। এজিদের চক্রান্তেই প্রভু হোসেনের কুফায় গমন সম্ভব হইল। পরিবারসহ প্রভু হোসেন কুফায় গমন করিলেন। হতভাগিনীও সঙ্গে চলিল। হায়! কোথায় কুফা আর কোথায় কারবালা। কারবালার ঘটনা মনে আছে সকলই, কিন্তু মুখে বলিবার সাধ্য নাই। হায়! আমার জন্য কি না হইল? মহাপ্রান্তর কারবালাক্ষেত্রে রক্তের নদী বহিল। শত শত সতী পতিহাৱা, পুত্রহারা হইয়া আজীবন চক্ষের

 ৬১ জলে ভাসিতে লাগিল। মহা মহা বীরসকল, এক বিন্দু জলের জন্য লালায়িত হইয়া শত্রুহস্তে অকাতরে প্রাণ সমর্পণ করিল। কত বালক বালিকা শুষ্ককণ্ঠ হইয়া ছট্‌ফট্‌ করিতে করিতে পিতার বক্ষে মাতায় ক্রোড়ে দেহত্যাগ করিয়া অনন্তধামে চলিয়া গেল। কাসেম-সখিনার কথা মনে হইলে এখনও অঙ্গ শিহরিয়া উঠে। শোকসিন্ধুমধ্যে বিবাহ!—কি নিদারুণ কথা! কাসেম-সখিনার বিবাহের কথা মনে পড়িলে প্রাণ ফাটিয়া যায়! দুর্দ্দি‌নের শেষ ঘটনায়, যাহা ঘটিবার ঘটিয়া গেল। বিশ্বপতি বিশ্বেশ্বরের মহিমা প্রকাশ হইল। সে অনন্ত ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা পূর্ণ করিতে কাহারও বাধা দিবার ক্ষমতা যে নাই, প্রভু হোসেন তাহারই দৃষ্টান্ত দেখাইয়া সীমারের খপ্পরে দেহত্যাগ করিলেন। ‘হায় হোসেন!’ ‘হায় হোসেন!’ রবে প্রকৃতির বক্ষ ফাটিতে লাগিল। আমরা তখনই বন্দিনী! নূরনবী মোহাম্মদের পরিজনগণ তখনই বন্দিনী! দামেস্কে আসিলাম। আর রক্ষা নাই। এজিদ-হস্ত হইতে আর নিস্তার নাই। ডুবিলাম, আর উপায় নাই। নিরাশ্রয়ার আশ্রয়ই ঈশ্বর। আশা-ভরসা যাহা যাহা সম্বল ছিল, ক্রমে হৃদয় হইতে সে সকল সরিয়া এক মহাবলের সঞ্চার হইল; এজিদ্‌-নামে আর কোন ভয়ই রহিল না। এই ছুরিকা হস্তে করিতেই মন যেন ডাকিয়া বলিল: এই অস্ত্র—দুরাচারের মাথা কাটিতে এই-ই অস্ত্র। সাহস হইল, বুকেও বল বাঁধিল। হ্যাঁ, পারিব—সে অমুল্য রত্ন, রমণীকুলের মহামুল্য রত্ন দস্যু-হস্ত হইতে রক্ষা করিতে নিশ্চয়ই পারিব। প্রতিজ্ঞা করিলাম: হয় দস্যুর জীবন, নয় ধনাধিকারিণীর জীবন এই ছুরিকার অগ্রে,— হয় এ ছুরিকা এজিদের বক্ষে প্রবেশ করিবে, নয় জয়নাবের চির-সন্তাপিত হৃদয়-শোনিত পান করিবে। আর চিন্তা কি? নির্ভয়ে সাহসে নির্ভর করিয়া বসিলাম। পাপীর চক্ষু, এ পাপচক্ষে‌ কখনই দেখিব না ইচ্ছা ছিল। কিন্তু নিয়তির বিধানে সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা হইল না। দামেস্কে আসিরামাত্রই এজিদের আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে হইল। পাপীর কথা শুনিলাম, উত্তর দিলাম, সঙ্গে সঙ্গে ছুরিকাও দেখাইলাম। মহাপাপীর হৃদয় কম্পিত হইল। তাহার মুখের ভাবে বুঝিলাম, নিজ-প্রাণের ভয় অপেক্ষা জয়নাবের প্রাণের ভয়ই যেন তাহার অধিক। কি জানি, জয়নাব যদি আত্মহত্যা করে, তবেই সর্ব্বনাশ!”

 “যাহাই হউক, ঈশ্বর-কৃপায় পাপাত্মার মনে যাহাই উদয় হউক, সে সময় রক্ষা পাইলাম, কিন্তু বন্দীখানায় আসিতে হইল। এই সেই বন্দীগৃহ। জয়নাব এজিদের বন্দীখানায় বন্দিনী। প্রভুপরিজন এজিদের বন্দীখানায় এই হতভাগিনীর সঙ্গিনী! আমার কি আর উদ্ধার আছে? আমার পাপের কি ইতি আছে?”

 “দয়াময়! তুমিই অবলার আশ্রয়, তুমিই নিরাশ্রয়ের উভয়কালের আশ্রয়। করুণাময়! তোমাকেই সর্ব্বসার মনে করিয়া এই রাজসিংহাসন পদতলে দলিত করিয়াছি, রাজভোগ, পাটরাণীর সুখ-সম্ভোগ ঘৃণার চক্ষে তুচ্ছ করিয়াছি; তুমিই বল, তুমিই সম্বল। তুমিই অনন্তকালের সহায়।”

 পাঠক! ঐ শুনুন ডঙ্কা—তুরী—ভেরীর বাদ্য। শুনিতেছেন? জয়ধ্বনির দিকে মন দিয়াছেন?

 “জয় জয়নাল আবেদীন!”—শুনিলেন। দামেস্কের নবীন মহারাজা পরিবার-পরিজনকে উদ্ধার করিতে আসিতেছেন। পূজনীয়া জননী, মাননীয়া সহোদরা এবং অপর গুরুজনকে বন্দীখানা হইতে উদ্ধার করিতে আসিতেছেন। বেশী দূরে নয়, প্রায় বন্দীখানার নিকটে। কিন্তু জয়নাবের কথা এখনও শেষ হয় নাই। আবার শুনুন, এদিকে মহারাজও আসিতে থাকুন।

 জয়নার বলিতেছেন: “আমার জন্যই প্রভু-পরিবারের এই দুর্দ্দশা। এজিদের প্রস্তাবে সম্মত হইলে মদিনার সিংহাসন কখনই শূন্য হইত না। জাএদার হস্তে মহাবিষও উঠিত না। সখিনাও সদ্য বৈধব্য-যন্ত্রণা ভোগ করিত না। হোসেনের পবিত্র মস্তকও বর্শাগ্রে বিদ্ধ হইয়া সীমার-হস্তে দামেস্কে আসিত না। মহাভক্ত আজরও স্বহস্তে তিন পুত্রের বধসাধন করিত না। চক্ষে কত দেখিয়াছি, কানে কত শুনিয়াছি। হায়! হায়!! সকল অনিষ্টের—সকল দুঃখের মুলই এই হতভাগিনী। শুনিয়াছি, সীমারের প্রাণ মদিনা-প্রান্তরে সপ্ত বীরের তীরের অগ্রভাগে গিয়াছে। আম্বাজ-অধিপতি মোহাম্মদ হানিফা দামেস্ক নগরের প্রান্তসীমায় সসৈন্যে মহাবীর নরপতিগণ সহ আসিয়া এজিদের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছেন। তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইয়াছে। আমাদের উদ্ধারের জন্য মোহাম্মদ হানিফা এবং তাহার অন্যান্য ভ্রাতাগণ প্রাণপণে যুদ্ধ করিতেছেন। এজিদও স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত। কত কথাই না শুনিলাম,—শেষে শুনিলাম: ওমর আলীর প্রাণবধের সংবাদ। শূলদ ও এজিদ-শিবির সম্মুখে খাড়া হইয়াছে। কতলোক ওমর আলীর প্রাণবধ দেখিতে দৌড়িয়াছে। কারবালার যুদ্ধ-সংবাদও শিবিরে থাকিয়া শুনিয়াছিলাম, আর দামেস্ক-প্রান্তরের যুদ্ধসংবাদও এজিদের বন্দীখানায় থাকিয়া শুনিতেছি। কারবালায় যথাসর্বস্ব ইলাম। আর এখানে হারাইলাম-ইমাম বংশের একমাত্র ভরসা, জয়নাল আবেদীন। এ কি শুনি! “জয় জয়নাল আবেদীন?” এ কিরূপ ঘোষণা ঐ ত আবার শুনিতেছি, “জয়! নব-ভূপতির জয়!” সে কি কথা? আমি কি পাগল হইলাম। কি কথার পরিবর্তে কি কথা শুনিতেছি। ভেরী বাজাইয়া স্পষ্ট ভাবেই জয় ঘোষণা করিতেছে। ওই ত একেবারে বন্দীখানার বহিদ্বারে!” এই কথা বলিয়াই জয়নাব শাহূরেবানু ও হাসনেবানুর কক্ষে যাইতে অতি ব্যস্তভাবে উঠিলেন। জয়নাবের মনের কথা আর ব্যক্ত হইল না। উচ্চৈঃস্বরে জয়ধ্বনি করিতে করিতে সৈন্যগণ বন্দীখানার মধ্যে আসিয়া পড়িল। দীন মোহাম্মদী নিশান জয়ডঙ্কার তালে তালে দুলিয়া দুলিয়া উড়িতে লাগিল। নবীন মহারাজ আপন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনসহ বন্দী-গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন।

 পাঠক! এই অবসরে লেখকের একটি কথা শুনুন। সুখের কান্না পুরুষেও কাঁদে, স্ত্রীলোকেও কাঁদে। তবে পরিমাণে বেশী আর কম। জয়নাল আবেদীন বন্দী-গৃৎমধ্যে প্রবেশ করিলে তাহার মাতা, সহোদর প্রভৃতি প্রিয় পরিজন সুখের কান্নায় চক্ষের জল ফেলিলেন, কি হাসিমুখে হাসিতে হাসিতে প্রিয়দর্শন জয়নালকে ক্রোড়ে করিয়া মুখচুম্বন করিলেন, তাহা নির্ণয় করা সহজ নহে দামেস্ক কারাগার সৈন্যসামন্ত পরিবেষ্টিত হইলেও প্রত্যক্ষ দেখাইতে যে না পারি, তাহাও নহে।—কার সাধ্য রোধে কল্পনায় আঁখি! তবে কথা এই যে, তাহাই দেখিবেন, না হানিফা এক্তিদের পশ্চাৎ ঘোড়া চালাইয়া কি করিতেছেন, তাহাই দেখিবেন? আমার বিবেচনায় শেষ দৃশ্যই এক্ষণে প্রয়োজন। এজিদ-বধের জন্যই সকলেই উৎসুক। গাজী রহমানেরও ঐ চিন্তাই এখন প্রবল। মোহাম্মদ হানিফার কি হইল? এজিদের ভাগ্যেই বা কি ঘটিল?

 নবীন মহারাজ, তাঁহার মাতার পদধূলি মাথায় মাখিয়া অন্য অন্য গুরুজনের চরণ বন্দনা করিয়া বন্দীখানা হইতে বিজয়ডঙ্কা বাজাইতে বাজাইতে, জয়পতাকা উড়াইতে উড়াইতে প্রিয়পরিজনসহ রাজপুরী মধ্যে পুনঃ প্রবেশ করুন, আমরা মোহাম্মদ হানিফার অন্বেষণে যাই। চলুন, এজিদের অশ্বচালনা দেখি।