বিষয়বস্তুতে চলুন

বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/দ্বাবিংশ প্রবাহ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বাবিংশ প্রবাহ

 প্রণয়, স্ত্রী, রাজ্য, ধন এই কয়েকটি বিষয়ের লোভ বড় ভয়ানক। এই লোভে লোকের ধর্ম্ম, পুণ্য, সাধুতা, পবিত্রতা,—সমস্তই একেবারে সমূলে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। অতি কষ্টে উপার্জ্জিত বন্ধু-রত্নটিও ঐ লোভে অনেকেই অনায়াসে বিসর্জ্জন দেয়। মানুষ ঐ লোভে অনায়াসেই যথেচ্ছ ব্যবহারে অগ্রসর হইতে পারে। এজিদ দামেস্কের রাজা, কুফা তাঁহার অধীন রাজ্য। হোসেনের সহিত আবদুল্লাহ্ জেয়াদের কেবলমাত্র বন্ধুত্ব-ভাব সম্বন্ধ। উপরোক্ত চারি প্রকার লোভের নিকট বন্ধুভাব সর্ব্বত্র অকৃত্রিম থাকা অসম্ভব। অধিকন্তু আবদুল্লাহ্ জেয়াদের নিকটে তাহার আশা করাও যাইতে পারে না। কারণ, আদুল্লাহ্ জোয়াদ মূর্খ ও অর্থলোভী। মুখের প্রণয়েও বিশ্বাস নাই, কার্য্যেও বিশ্বাস নাই,—লোভীও তদ্রূপ।

 আবদুল্লাহ্ জেয়াদ সেই রাত্রেই দামেস্কের দূতকে বিদায় দিলেন। তিনি শয়নগৃহে শয্যার এক পার্শ্বে বসিয়া মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “হোসেনের প্রণয়ে লাভ কি? শুধু মুখের প্রণয়ে কি হইতে পারে?”—এইরূপ অনেক আন্দোলন করিয়া তিনি নিদ্রাভিভূত হইলেন।

 প্রধান অমাত্য, সভাসদ্ ও রাজসংক্রান্ত কর্ম্মচারিগণ কেহই এই নিগুঢ় তত্ত্বের কারণ কিছুই জানিতে পারিলেন না। কি উদ্দেশ্যে উহারা দামেস্ক হইতে আসিয়াছিল, এক দিবস অতীত না হইতেই কেনই বা পুনরায় ফিরিয়া গেল, এই বিষয় লইয়া সকলে নানা প্রকার আন্দোলন করিতে লাগিলেন।

 রজনী প্রভাত হইল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ রাজসিংহাসনে উপবেশন করিয়া সমুদয় সভাসদগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক বলিতে লাগিলেন “গত রজনীতে আমি হজরত মোহাম্মদ মােস্তাফাকে স্বপ্নে দেখিয়াছি। তাঁহার হস্তে কৃষ্ণবর্ণ আষা (যষ্টি), শিরে উষ্ণীষ, অঙ্গে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শুভ্র পিরহান! আমার শিয়রে দণ্ডায়মান হইয়া তিনি বলিতে লাগিলেন, আবদুল্লাহ্ জেয়াদ, তােমাকে একটি কার্য্য করিতে হইবে। আমি স্বপ্নযােগে সেই পবিত্র পদচুম্বন করিয়া জোড়হস্তে দণ্ডায়মান থাকিলাম। নূরনবী দুঃখিত স্বরে বলিতে লাগিলেন, হাসান ভ্রাতৃহীন হইয়া আমার সমাধিক্ষেত্রে পড়িয়া নিঃসহায়রূপে দিবারাত্র ক্রন্দন করিতেছে। তুমি তাহার পক্ষ অবলম্বন কর। তুমি সাধ্যানুসারে তাহার সহায়তা কর। সৈন্যসামন্ত, ধন-জন দ্বারা হােসেনের উপকার কর। এই কথা বলিয়াই পবিত্র মূর্ত্তি অন্তর্হিত হইলেন। আমারও নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল। স্বর্গীয় সৌরভে সমুদয় ঘর আমােদিত হইয়া উঠিল। সেই সময়ে আমার মনে যে অনুপম আনন্দ ও ভক্তিভাব উদয় হইল, তাহা এক্ষণে মুখে প্রকাশ করিতে আমার সাধ্য হইতেছে না। আর নিদ্রাও হইল না। তখনই কায়মনে হজরত এমাম হােসেনের প্রতি আত্মসমর্পণ করিলাম। এই রাজ্য, এই সৈন্য-সান্ত, এই ভাণ্ডারস্থ ধন-রত্ন ও মণি-মুক্তা সকলই হােসেনের, এই সিংহাসন আজ হইতে হােসেনের নামে উৎসর্গ করিয়া তাঁহাকেই ইহার যথার্থ অধিকারী করিলাম। আপনারা আজ হইতে মহামান্য এমাম হােসেনের অধীন হইলেন। আজ হইতে আমি তাঁহার আজ্ঞাবহ কিঙ্কর মাত্র থাকিলাম। অমাত্যগণ! এখনই আপনারা নগরের ঘরে ঘরে ঘােষণা করিয়া দিন যে, এ রাজ্য আজ হইতে এমাম হোসেনের অধিকৃত হইল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ তাঁহার আজ্ঞাবহ হইয়া রহিলেন। অধীন রাজা, রাজপ্রতিনিধি, রাজসংস্রবী,—যিনি যেখানে আছেন কিংবা রাজ্য শাসন করিতেছেন, অদ্যই তাঁহাদের নিকট এই শুভ-সংবাদ অগৌণে জ্ঞাপন করা হউক। আর তাই আমার স্বপ্নবিবরণসহ রাজ্য-পরিত্যাগের সংবাদ এমাম হােসেনের গোচর করণের জন্য মদিনায় কাসেদ প্রেরণ করা হউক। রাজা বিহনে রাজ্য শাসন হওয়া নিতান্তই কঠিন, রাজসিংহাসন শূন্য থাকাও অযৌক্তিক। যত শীঘ্র হয়, এমাম হােসেন কুফা নগরে আসিয়া রাজপাট অধিকার এবং আমার মনােবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। ইহাও জানাইও,— যত দিন এমাম হোসেন এই রাজসিংহাসনে উপবেশন না করিতেছেন, তত দিন প্রধান উজীর রাজকার্য্য পর্য্যালোচনা করিবেন। আমার সহিত রাজ্যের কোন সংস্রব রহিল না।”

 প্রধান উজীর নতশিরে রাজাজ্ঞা প্রতিপালন করিলেন। সকলেই হোসেনের নামে রাজভক্তির পরিচয় দিয়া শত শত আশীর্ব্বাদ প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদকেও একবার সকলে ধন্যবাদ দিয়া বলিলেন, “এমন সাহসী, ধর্ম্মপরায়ণ, সরলহৃদয় ধার্ম্মিক জগতে কেহ হয় নাই, হইবেও না। এমন পুণ্যকার্য্য এ পর্য্যন্ত কেহ কোন দেশেই করে নাই। এ কথা সত্য যে, যিনি ইহকাল পরকালের রাজা, প্রাণ দিয়া তাঁহার উপকার করা সকল মুসলমানের কর্ত্তব্য। এজিদের চক্রান্তে এমাম ভ্রাতৃহারা, রাজ্যহারা—একে একে তিনি সর্ব্বহারা হইবার উপক্রম হইয়াছেন, এ সময় যিনি যত প্রকারে তাঁহার উপকার করিবেন, ঈশ্বর তাঁহাকে কোটি কোটি গুণে পুণ্যময় করিয়া পরকালের প্রধান স্বর্গে তাঁহার স্থান নির্ণয় করিয়া রাখিবেন। আপনি সৈন্যসামন্ত সহ রাজ্য-ধন এমামকে দান করিলেন, আমরা চিরকাল হইতে তাঁহার আজ্ঞানুবর্ত্তী দাসানুদাস আছি। আজ হইতে জীবন, ধন, সমস্তই হোসেনের নামে উৎসর্গ করিলাম।”

 প্রধান উজীর রাজাজ্ঞানুসারে সমুদয় কথা সর্ব্বত্র ঘোষণা করিয়া দিলেন। এবং আবদুল্লাহ্ জেয়াদের স্বপ্নবৃত্তান্ত বিস্তারিতরূপে বর্ণনা করিয়া, রাজদান সংক্রান্ত সমস্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া হোসেন-সমীপে কাসেদ প্রেরণ করিলেন।

 ক্রমে সর্ব্বত্র প্রকাশ হইল যে, কুফাধিপতি আবদুল্লাহ্ জেয়াদ তাঁহার সমুদয় রাজ্য হোসনকে অর্পণ করিয়াছেন। এজিদের স্বপক্ষীয়েরা ব্যতীত সকলেই একবাক্যে আবদুল্লাহ্ জেয়াদকে শত শত ধন্যবাদ দিয়া ঈশ্বর সমীপে হোসেনের দীর্ঘায়ু ও সর্ব্বমঙ্গল প্রার্থনা করিলেন। ক্রমে মদিনা পর্য্যন্ত এই সংবাদ রটিয়া গেল।

 হোসেন পূর্ব্ব হইতে মদিনা পরিত্যাগ করিয়া কুফা নগরে আসিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ্ জেয়াদ কর্ত্তৃক আদৃত না হইয়া তথায় গমন করা যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করেন নাই। লোকমুখে জেয়াদের বদান্যতা, বিপদ-সময়ে সাহায্য এবং অকাতরে রাজ্য পর্য্যন্ত দানের বিষয় শুনিয়া তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া কৃতজ্ঞতার সহিত উপাসনা করিলেন। কিন্তু জেয়াদপ্রেরিত নিশ্চিত সংবাদ না পাইয়া অন্য কাহাকেও তিনি কিছু বলিলেন না।

 মারওয়ান আজ মদিনা আক্রমণ করিবে, রওজা আক্রমণ করিবে, হোসেনের প্রাণ হনন করিবে,—সর্ব্বসাধারণের মুখে এই সকল কথার আন্দোলন হইতেছিল! মদিনাবাসীরা সকলেই হোসেনের পক্ষ হইয়া এজিদের সৈন্যের সহিত যথাসাধ্য যুদ্ধ করিবে, প্রাণ থাকিতে হোসেনের পরিজনদিগকে বন্দী করিয়া দামেস্ক লইয়া যাইতে দিবে না, এ কথাও রাষ্ট্র হইয়াছে। ‘আজ যুদ্ধ হয়’, কি ‘কাল যুদ্ধ হয়’, কেবল এই কথারই তর্ক-বিতর্ক। এজিদের সৈন্যগণ মদিনা আক্রমণ না করিলেও নিজেরা যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবে কি না, এই বিষয় লইয়াই—এই চিন্তাতেই এমাম-বংশের চিরহিতৈষী মদিনাবাসীরা সকলেই মহা ব্যতিব্যস্ত। দিবারাত্র কাহারও যেন আর আহার-নিদ্রা নাই।

 কয়েক দিন যায়। শেষে সাব্যস্ত হইল যে, শত্রুগণ নগরের প্রান্তভাগে প্রান্তরের শেষ সীমায় শিবির নির্ম্মাণ করিয়া যে প্রকার শান্তভাবে রহিয়াছে, তাহাতে আশু বিরোধের সম্ভাবনা কি? কোন বিষয়ে অনৈক্য, কোন কার্য্যে বাধা দান কিংবা কোন কথার প্রসঙ্গে অযথা উত্তর না করিলে, কি প্রকারে বিবাদে প্রবৃত্ত হওয়া যায়? এই বিবেচনা করিয়া সকলেই যুদ্ধের অপেক্ষায় বিবাদের সূচনায় প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছেন। এমন সময় একদিন কুফা নগরের কাসেদ মদিনায় দেখা দিল। মদিনাবাসীরা জেয়াদের বদান্যতার বিষয় পূর্ব্বেই শুনিয়াছিলেন। নিশ্চিত সংবাদ না পাইয়া অনেকে সন্দেহ করিতেছিলেন, আজ সে সন্দেহ দূর হইল। এক মুখে বলিতে শত শত মুখে জিজ্ঞাসিত হইল, “কুফার সংবাদ কি?”

 কাসেদ উত্তর করিল, “কুফাধিপতি মাননীয় আবদুল্লাহ্ জেয়াদ তাঁহার সিংহাসন, রাজ্য, ধন, সৈন্যসামন্ত সমস্তই হজরত এমাম হোসেনের নামে উৎসর্গ করিয়াছেন। তিনি এক্ষণে রাজকার্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। এমাম হোসেন কুফা-সিংহাসনে উপবেশন না করা পর্য্যন্ত প্রধান উজীরের হস্তে রাজকার্য্য পরিচালনার ভার রহিয়াছে। এমাম হোসেন কোথায় আছেন আপনারা বলুন, আমি তাঁহার নিকট যাইয়া এ সংবাদ দিব।” এক এক জন বলিতে বলিতে শত শত লোক কাসেদের অগ্র-পশ্চাতে চলিতে লাগিল। কেই আবদুল্লাহ্ জেয়াদের প্রশংসা, কেহ কেহ হোসেনের কুফাগমনজনিত দুঃখ, কেহ এজিদের দৌরাত্ম্যে হোসেন দেশত্যাগী,—এই সব কথার শাখা-প্রশাখা বাহির করিয়া পরস্পর বাদানুবাদ ও তর্ক-বিতর্ক করিতে করিতে হজরতের রওজায় উপস্থিত হইল। প্রধান প্রধান লোকেরা কাসেদের বৃত্তান্ত এমামের নিকট বিবৃত করিলেন।

 আবদুল্লাহ্ জেয়াদের পত্র পাঠ করিয়া হোসেন সেই পত্রহস্তে কাসেদ সমভিব্যাহারে নিজ ভবনের প্রবেশদ্বারে উপস্থিত হইয়া মদিনাবাসীদিগকে বলিতে লাগিলেন, “ভাই সকল! আপনারা কেন আর কষ্ট পাইতেছেন? যদি কুফার অন্নজল ঈশ্বর আমার অদৃষ্টে লিখিয়া থাকেন, তবে আপনারা আমার কৃত দোষ মার্জ্জনা করিবেন। সময়ে আমি আপনাদের প্রত্যেকের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিব। এক্ষণে এত ব্যস্ত হইবার কোন কারণই দেখিতেছি না।”

 মদিনাবাসীরা সকলেই একবাক্যে হোসেনকে আশীর্ব্বাদ করিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।

 জেয়াদের পত্র লইয়া হোসেন মাননীয়া বিবি সালেমার হোজ্‌রা (নির্জ্জন স্থান) সমীপে গমন করিলেন। সংবাদ পাইয়া বিবি সালেমা হোজ্‌রা হইতে বহির্গত হইলেন। এমাম হোসেন মাতামহীর[] পদধূলি গ্রহণ করিয়া জেয়াদের পুত্রবিবরণ প্রকাশ ও কুফা নগরে গমনপ্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন।

 রওজা হইতে হোসেনের আগমন-বৃত্তান্ত শুনিয়া পরিজন, আত্মীয়, বন্ধু অনেকেই বিবি সালেমার হোজ্‌রায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 হোসেন সকলের নিকটেই কুফা-গমনের সঙ্কল্প প্রকাশ ও পরামর্শ জিজ্ঞাসা করায় কেহই কোন উত্তর না দিয়া নিস্তদ্ধ রহিলেন। বিবি সালেমা গম্ভীর স্বরে বলিতে লাগিলেন: আবদুল্লাহ্ জেয়াদ যাহাই লিখুক, আমি তোমাকে পুনঃপুনঃ নিষেধ করিতেছি, তুমি কখনই কুফায় গমন করিও না,—হজরতের রওজা ছাড়িয়া কোন স্থানে যাইও না। হজরত আমাকে বলিয়া গিয়াছেন, ‘হোসেন আমার রওজা পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে গমন করিলে অনেক প্রকার বিপদের আশঙ্কা’। আমি পুনঃপুনঃ নিষেধ করিতেছি, তুমি কখনও রওজা হইতে বাহির হইও না। এখানে কাহারও ভয় নাই, কোন প্রকারে শত্রুতা সাধন করিবার ক্ষমতা কাহারও নাই, তুমি স্বচ্ছন্দে নিশ্চিন্তভাবে রওজায় বসিয়া থাক।”

 হোসেন বলিলেন, “কতকাল এইভাবে বসিয়া থাকিব? কাফেরগণ ক্রমশঃই তাহাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া মদিনার নিকটে একত্রিত হইতেছে। আমি কি করিয়া কতদিন এই প্রকারে বসিয়া কাটাইব? একা আমার প্রাণের জন্য কত লোকের জীবন যাইবে? তাহা অপেক্ষা আমি কিছুদিন স্থানান্তরে বাস করি, তাহাতে দোষ কি? বিশেষতঃ কুফানগরের সমুদয় লোক মুসলমান, ধর্ম্মপরায়ণ, সেখানে যাইতে আর বাধা কি?”

 সালেমা বিবি বিরক্তভাবে বলিতে লাগিলেন, “আমি বৃদ্ধ হইয়াছি, আমার কথা তোমার গ্রাহ্য হইবে কেন? এখন যাহা ইচ্ছা হয় কর।” এই বলিয়া তিনি হোজ্‌রামধ্যে চলিয়া গেলেন। তৎপরে হোসেনের মাতার সহোদরা ভগ্নী ওম্মে কুলসুম্ হোসেনের হস্ত ধারণ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “হোসেন! সকলের গুরুজন যিনি, প্রথমেই তিনি নিষেধ করিতেছেন, তাঁহার কথার অবাধ্য হওয়া নিতান্তই অনুচিত। বিশেষ আমিও বলিতেছি, তুমি কুফার নাম পর্য্যন্তও করিও না। কুফার নাম শুনিলে আমার হৃদয় কাঁপিয়া উঠে। তোমার কি স্মরণ হয় না যে, তোমার পিতা কুফায় যাইয়া কত কষ্ট পাইয়াছিলেন? কুফানগরবাসীরা তাঁহাকে কতই যন্ত্রণা দিয়াছিল, সে কথা কি একেবারে ভুলিয়া গিয়াছ? কুফায় যাইবার বাসনা অন্তর হইতে একেবারে দূর কর। নিশ্চিন্তভাবে রওজায় বসিয়া থাক, আমি সাহসের সহিত বলিতেছি,— জগতে এমন কেহই নাই যে, তোমার অঙ্গ স্পর্শ করে।”

 হোসেন বলিলেন, “আমার মন অত্যন্ত অস্থির হইয়াছে, তিলার্দ্ধ কালও মদিনায় থাকিতে ইচ্ছা হইতেছে না। আপনারা আর আমায় বাধা দিবেন না। মিনতি করিয়া বলিতেছি, অনুমতি করুন, যাহাতে শীঘ্রই কুফায় যাত্রা করিতে পারি।”

 ওম্মে কুলসুম বিরক্ত হইয়া চলিয়া যাইতে যাইতে বলিলেন, “ঈশ্বর অদৃষ্টফলকে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা রদ করিবার সাধ্য কাহারও নাই। তোমার যাহা ইচ্ছা তাহাই কর।”

 হোসেনের বন্ধুবান্ধব একমত হইয়া সকলেই তাঁহাকে কুফাগমনে নিষেধ করিলেন। প্রতিবেশিগণের মধ্যে একজন বলিলেন: মদিনার মায়া একেবারে অন্তর হইতে অন্তর করিবেন না। এজিদের ভয়ে মদিনা পরিত্যাগ নিতান্ত পরিতাপ ও দুঃখের বিষয়। তাহারা প্রকাশ্য যুদ্ধে কি করিবে? মদিনাবাসীগণের একজনেরও দেহে প্রাণ থাকিতে শত্রুগণ কি আপনার অঙ্গ স্পর্শ করিতে পারে? কাহার সাধ্য? আমাদের স্বাধীনতা, স্বদেশের গৌরব-রক্ষা—ইহা ত আছেই, তাহা ছাড়া আপনার প্রাণের জন্য এজিদের সৈন্যের সম্মুখীন হইতে আমরা কখনই পরাঙ্মুখ হইব না। আমরা শিক্ষিত নহি তাহা স্বীকার করি; কিন্তু আপনার প্রাণরক্ষার জন্য আমাদের প্রাণ শক্তহস্তে অর্পণ করিতে শিক্ষার আবশ্যক কি? আমরাও যদি শত্রুহস্তে বিনাশপ্রাপ্ত হই, তথাপি মদিনার একটি স্ত্রীলোকও জীবিত থাকিতে এজিদ আপনার অনিষ্ট সাধন করিয়া কখনও মদিনার সিংহাসনে বসিতে পারিবে না। আপনি কাহার ভয়ে, কোন্ শত্রুর শত্রুতায় মদিনা পরিত্যাগ করিবেন? আমাদের জীবন থাকিতে আমরা আপনাকে যাইতে দিব না। অবশ্য আপনার আজ্ঞার প্রতিবন্ধকতা করিতে আমাদের ক্ষমতা নাই। যদি আপনি মদিনা পরিত্যাগ করিতে নিতান্তই কৃতসঙ্কল্প হইয়া থাকেন, করুন; কিন্তু মদিনাবাসীরা আপনাকে কখনই পরিত্যাগ করিবে না। যেখানে আপনি যাইবেন, তাহারাও আপনার সঙ্গে সেইখানেই যাইবে।”

 হোসেন বলিতে লাগিলেন “ভাই সকল! এজিদের জীবনের প্রথম কার্য্যই আমাদের বংশ বিনাশ করা। যে উপায়ে হউক এজিদ আমার প্রাণবিনাশ করিবে। যখন দুই ভ্রাতা ছিলাম, তখন এজিদের সৈন্যেরা সাহস করিয়া প্রকাশ্য যুদ্ধ করিতে অগ্রসর হয় নাই। তাহারা কয়েকবার পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছে এবং আপনারাও দেখিয়াছেন। এক্ষণে আমার সাহস, বল, বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির অনেক লাঘব হইয়াছে। কারণ, ভ্রাতৃশােকে আমি যে প্রকার দুঃখিত ও কাতর আছি, তাহা আপনারা স্বচক্ষে দেখিতেছেন। যে হৃদয় কখনও ভয়ের নাম জানিত না, শত্রনাশে যে হৃদয় কদাপি আতঙ্কিত হইত না, সেই ভয়শূন্য হৃদয় আজ ভ্রাতৃবিয়ােগ-দুঃখে সামান্য যুদ্ধের নামে আতঙ্কে কাঁপিয়া উঠিতেছে। আমার নিজের মনই যদি নিরুৎসাহ থাকিল, শত্রুভয়ে কম্পবান থাকিল, তখন কাহার উৎসাহে—কাহার উত্তেজনায় আপনারা সেই দুর্দ্দান্ত শত্রুর অস্ত্রসম্মুখে—অসংখ্য সেনার অসংখ্য অস্ত্রসম্মুখে দণ্ডায়মান হইবেন? বলুন ত, কাহর সাহায্যের উপর নির্ভর করিয়া বিধর্ম্মীর অস্ত্রাঘাতের জন্য বক্ষ বিস্তার করিয়া দিবেন? শিক্ষিত সৈন্যের তরবারির গতি কাহার প্রদত্ত উৎসাহবাক্যে প্রতিরােধ করিবেন? আমি অনেক চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি, এক্ষণে মদিনা পরিত্যাগ করাই আমার পক্ষে শ্রেয়ঃ এবং মদিনাবাসীর পক্ষেও মঙ্গল। আমার জন্য আমি আপনাদিগকে বিপদগ্রস্ত করিতে বাসনা করি না। এজিদের হস্তে কিংবা তাহার সৈন্যের হস্তে বিধি যদি আমার জীবননাশের বিধি করিয়া থাকেন, তবে তাহা নিশ্চয়ই ঘটিবে। যেখানেই কেন যাই না, আমার প্রাণহন্তা সেইখানেই গিয়া উপস্থিত হইবে। কারণ জগদীশ্বরের কার্য্য অনিবার্য। আমার স্থানান্তরে যাওয়ার জন্য মদিনাবাসীরা ত এজিদের রােষাগ্নি হইতে রক্ষা পাইবে। তাহাই আমার পক্ষে মঙ্গল।”

 প্রতিবেশিগণের মধ্যে একজন প্রাচীন ছিলেন, তিনি বলিতে লাগিলেন, “ঈশ্বরের নিয়ােজিত কার্য্য অনিবার্য্য—এ কথা কে না স্বীকার করিবে? কিন্তু আবদুল্লাহ্ জেয়াদ হঠাৎ এইভাবে এত বড় রাজ্য আপনাকে অযাচিতে ছাড়িয়া দিল, ইহার কারণ কি? একথাও রাষ্ট্র হইয়াছে যে, এজিদপক্ষীয় কাসেদ তিনলক্ষ টাকা লইয়া কুফা নগরে জেয়াদের নিকট গিয়াছিল। জেয়াদও দামেস্কের কাসেদকে এবং তৎসমভিব্যাহারী সৈন্যচতুষ্টয়কে বিশেষ পুরস্কৃত করিয়া বিদায় করিয়াছেন। তাহার পর দিবসেই তিনি স্বপ্নবিবরণ সভায় প্রকাশ করিয়া রাজসিংহাসন ও রাজ্য আপনাকে অর্পণ করিয়াছেন। ইহারই বা কারণ কি? যদি এজিদের মন্ত্রণায় সে অসম্মত হইবে, কি এজিদের আদেশ প্রতিপালনে অনিচ্ছুক হইবে, তবে নিঃস্বার্থ বন্ধুর চিরশত্রু-প্রেরিত কাসেদকে কেন পুরস্কৃত করিবে? কেন তাহার প্রদত্ত অর্থ নিজ ভাণ্ডারে রক্ষা করিবে? যে রাজ্য আপনার পিতা বহু পরিশ্রম করিয়াও নিষ্কণ্টকে হস্তগত করিতে পারেন নাই; কয়েকবার তাঁহাকে কুফার নগরবাসীরা যে প্রকার কষ্টে নিপাতিত করিয়াছিল—তাহা বোধ হয় আপনি পরিজ্ঞাত আছেন। এইক্ষণে কুফাধিপতি জেয়াদ হঠাৎ নূরনবী মোহাম্মদের স্বপ্নাদেশে সেই রাজ্য অকাতরে আপনাকে দান করিল, ইহাতে আমার বিশেষ সন্দেহ আছে।”

 হোসেন বলিলেন, “এমন কথা মুখে আনিবেন না। আবদুল্লাহ্ জেয়াদের ন্যায় আমার প্রকৃত বন্ধু মদিনা ব্যতীত অন্য কোন স্থানেই নাই। তাঁহার গুণের কথা কত বলিব? তিনি আমার জন্য এজিদের মুণ্ডপাত করিতেও বোধ হয় কখনও কুণ্ঠিত হইবেন না। জেয়াদের বাক্যে ও কার্য্যে আমার কিছুমাত্র সংশয় হয় নাই।”

 বৃদ্ধ পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “জেয়াদের বাক্যে ও কার্য্যে আপনার কোন সংশয় হয় নাই, অবশ্য না হইতে পারে। কিন্তু আমি বলি, মানুষের মনের গতি কোন্ সময় কি হয়, তাহা যাহার মন সেও জানিতে পারে না। একটু চিন্তা করিয়া কার্য্য করায় ক্ষতি কি? আমার বিবেচনায় অগ্রে জনৈক বিশ্বাসী ও সাহসী লোককে কুফা নগরে প্রেরণ করা হউক, কুফাবাসীরা যদি কোনরূপ চক্রান্ত করিয়া থাকে, তবে তাহা অবশ্যই প্রকাশ হইবে। গুপ্ত মন্ত্রণা কয়দিন গোপন থাকিবে? একটু সন্ধান করিলে সকলই জানা যাইবে। আর জেয়াদের রাজ্যদান-সঙ্কল্প যদি যথার্থ ই হয়, তবে আপনার গমনে আমি কোন বাধা দিব না।”

 হোসেন বলিলেন, “একথা মন্দ নয়, কিন্তু অনর্থক সময় নষ্ট এবং বৃথা বিলম্ব। যাহা হউক, আপনার কথা বারবার লঙ্ঘন করিব না। অগ্রে কুফায় পাঠাইতে কাহাকে মনস্থ করিয়াছেন? এমন সাহসী বিশ্বাস-পাত্র কে আছে?”

 দ্বিতীয় মোস্‌লেম নামক জনৈক বীর পুরুষ গাত্রোত্থান করিয়া করজোড়ে কহিতে লাগিলেন, “হজরত এমামের যদি অনুমতি হয়, তবে এ দাসই কুফা নগরে যাইতে প্রস্তুত আছে। আপনি কিছুদিন অপেক্ষা করুন, আমি কুফায় যাইয়া যথার্থ তত্ত্ব জানিয়া আসি; যদি আবদুল্লাহ্ জেয়াদ সরলভাবে রাজ্যদান করিয়া থাকেন, তবে মোস্‌লেম আনন্দের সহিত শুভসংবাদ লইয়া ফিরিয়া আসিবে। আর যদি ইহার মধ্যে ষড়যন্ত্র থাকে, তবে বুঝিবেন, মোস্‌লেমের এই শেষ বিদায়। আপনার কার্য্যে মোস্‌লেমের প্রাণের মায়া, সংসারের আশা, সুখ-দুঃখের চিন্তা ও স্ত্রীপরিবারের শেহবন্ধনের বাসনা কিছুমাত্র মনে থাকিবে না। আজ মোস্‌লেম আপনার কার্য্যে জীবন উৎসর্গ করিল। এই মুহূর্ত্তেই সে কুফায় যাত্রা করিবে। এখানে অনেকেই আছেন, যাহা বলিতে ইচ্ছা করেন, বলুন! মোস্‌লেম সে কথার অন্যথা কিছুতেই করিবে না।”

 বৃদ্ধ পুনরায় বলিলেন, “মোস্‌লেম ত যাইতেই প্রস্তুত। মোস্‌লেমের প্রতি আমার ত সম্পূর্ণ বিশ্বাসই হয়, কিন্তু একা মোস্‌লেমকে প্রেরণ করা যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না। শিক্ষিত হউক, কি অশিক্ষিত হউক, সৈন্যনামধারী কতিপয় লোককে মোস্‌লেমের সঙ্গে দিতে হইবে। বৃদ্ধের মুখে এই কথা শুনিবামাত্র নিতান্ত আগ্রহের সহিত অনেকেই যাইতে ইচ্ছুক হইলেন। অতি অল্প সময় মধ্যে এক হাজার লোক মোস্‌লেমের সঙ্গী হইতে সমুৎসুক হইল। কুফার রহস্যভেদ—ষড়যন্ত্রের মূলচ্ছেদ করিতে তাহারা যেন প্রাণপাত করিতে প্রস্তুত হইল। অতঃপর সমুদয় কথা সাব্যস্ত হইয়া গেলে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করিয়া মোস্‌লেম এক হাজার সৈন্য লইয়া কুফা নগরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। বীরবরের দুই পুত্রও পিতার সঙ্গে চলিল।

  1. হজরত হোসেনের আপন মাতামহী বিবি খদিজা। বিবি সালেমা হজরত মোহাম্মদের অন্য় স্ত্রী।