বুড়ো আংলা/হং পাল

উইকিসংকলন থেকে

হং পাল

ঝাউ-গাছের উপর থেকে খোঁড়া হাস ঠোঁটে-করে রিদয়কে বাগদী-চরের থেকে একটু দূরে নালমুড়ির চরে নামিয়ে দিয়ে সারাদিন বুনো হাঁসের দলের সঙ্গে শেয়ালকে নিয়ে ঝপ্পটি আর দাঁতকপাটি খেলে বেড়াচ্ছে। ক্রমে সন্ধ্যে হয়ে এল দেখে রিদয় ভাবছে, নিশ্চয়ই হাঁসেরা রাগ করে তাকে ফেলে গেছে, এখন কেমন করে সে বাড়ি যায়? আর কেমন করেই বা ঐ বুড়ো-আংলা চেহারা নিয়ে বাপ-মায়ের সঙ্গে দেখা করে? ঠিক এই সময় মাথার উপর ডাক দিয়ে হাঁসের দল উড়ে এসে নালমুড়িতে ঝুপঝাপ পড়েই জলে নেমে গেল। চরে মেলাই কাছিমের ডিম, রিদয় তারি একটা ওবেলা, একটা এবেলা খেয়ে পেট ভরিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। এমনি সে-রাত কাটল। ভোর না হতে হাঁসের দল রিদয়কে নিয়ে আবার চলল। রিদয় দেখলে হাঁসেরা তাকে বাড়ি যাবার কথা বললে না। সেও সে-কথা চেপে গিয়ে চুপচাপ খোঁড়া হাঁসের পিঠে চুপটি করে উঠে বসল।

 লুসাই হাঁসের ডানাটা শেয়ালের কামড়ে একটু জখম হয়েছে, কাজেই বুনো হাঁসের দল আজ আর বেশি দূরে উড়ে গেল না। গোবর-তলির মাটির কেল্লা ‘নুড়িয়া ক্যাসেলের’ উপরটায় এসে দেখতে লাগল, সেখানে মানুষ আছে কিনা। সেখানে শিকে-গাঁথা ফাটা-চটা কতকগুলো মাটির সঙ, পরী, সেপাই—এমনি সব। বাগানে মালি নেই, মালিকও নেই, কেবল একটা ভাঙা ফটকের মার্বেল-পাথরে কালি-দিয়ে-দাগা সাইন বোর্ডে লেখা রয়েছে—“পালদিং অফ্‌ নুড়িয়া।” ঠিক তারি নিচে একটা ভাঙা পিপের মধ্যে বসে একটা রোগা, কানা দেশী কুকুর পোড়ো কেল্লায় পাহারা দিচ্ছে।

 বুনো হাঁসেরা আকাশ থেকে শুধোলে—“ছপ্পড়টা কার? ছপ্পড়টা কার?”

 কুকুরটা অমনি আকাশে নাক তুলে চেচিয়ে উঠল, ভেউ-ভেউ করে বললে—“ছপ্পড় কি? দেখছ না এটা নুড়িয়ার কেল্লা—পাথরে গাঁথা! দেখছ না কেল্লার বুরুজ, তার উপরে ওই গোল-ঘর—সেখানে কামান-বসাবার ঘুলঘুলি, নিশেন ওড়াবার দাণ্ডা। গবাক্ষ, বাতায়ন, দরশন-দরওজা। এ-সব দেখছ না!”

 হাঁসের কিছুই দেখতে পেলে না—না কামান, না ঘুলঘুলি, না গবাক্ষ, না বাতায়ন। কেবল একটা চিলের ছাদে একটা আকাশ-পিদিম দেবার বাঁশ দেখা গেল, তাতেও এক-টুকরো গামছা-ছেঁড়া লটপট করছে! হাঁসেরা হো-হো করে হেসে বললে—“কই? কই?”

 কুকুরটা আরো রেগে বললে—“দেখছ না, কেল্লার ময়দান যেন গড়ের মাঠ! দেখছ না, কেলিকুঞ্জ—সেখানে রানী থাকেন। দেখ ওই হাম্মাম, সেখানে গোলাপজলের ফোয়ারা। দেখতে পাচ্ছ না বাগ-বাগিচা, আম-খাস, দেওয়ান-খাস?” হাঁসেরা দেখলে, পানা-পুকুর, লাউ-কুমড়োর মাচা—এমনি সব, আর কিছু নেই।

 কুকুর আবার চেঁচিয়ে বললে—“ঐ দেখ ওদিকে গাছ-ঘর, মালির ঘর; আর এই সব সুরকি-পাতা রাস্তার ধারে-ধারে পাথরের পরী, গ্যাস-লাইটের থাম, বাঁধা ঘাট, বারো-দোয়ারি নাটমন্দির। এসব কি চোখে পড়ছে না! যে বলছ ছপ্পড় কার? ছপ্পড়ে কখনো কেলিকানন, পুষ্পকানন, কামিনীকুঞ্জ থাকে? না, পাথরের পরী, ঘাটের সিঁড়ি থাকে? ঐ দেখ রাজার কাচারি, ঐ হাতিশাল, ঘোড়াশাল, তোষাখানা। এসব কি ছপ্পড়ে থাকে? না ছপ্পড় কখনো দেখেছ? ছপ্পড় দেখতে হয়তো ওপাড়ার ওই জমিদার-গুলোর বাড়ি দেখে এস। আমার মনিব কি জমিদার? এরা মুর্ধাভিষিক্ত। লেখাপড়ার ধার দিয়েও যায় না। ঘোড়া-রোগে এদের সবাই মরেছে। সেকালে এরা চীনের রাজা ছিল। এখনো দেখছ না ফটকে লেখা—‘পাল্‌দিং অফ মুড়িয়া!” এই ছপ্পড়ের নহবতখানার চুড়ো দশক্রোশ থেকে দেখা যায়—এমনি ছপ্পড় এটা!”

 কানা কুকুরটা ঘেউ-ঘেউ করে থামলে হাঁসেরা হাসতে-হাসতে বললে—“আরে মুখ্যু, আমরা কি তোর রাজার কথা, না রাজ-বাড়ির কথা, না মাটির কেল্লার কথা শুধোচ্ছি? ওই ভাঙা ফটকের ধারে পোড়ো বাগানে ভাঙা মদের পিপেটা কার, তাই বল না!” এমনি রঙ-তামাশা করতে-করতে হাঁসেরা নুড়িয়া ছাড়িয়ে সুরেশ্বরে—যেখানে প্রকাণ্ড ঠাকুর-বাড়ির ধারে সত্যিকার বাগ-বাগিচা, দীঘি-পুষ্করিণী, ঘাট-মাঠ রয়েছে, সেইখানে কুশ-ঘাসের গোড়া খেতে নামল। ওদিকে মেঘনা, এদিকে পদ্মা—এই দুই নদী যেখানে মিলেছে, সেই কোণটিতে হলো সুরেশ্বর-মঠ। চারদিকে আম-বাগান, জাম-বাগান, ঠাকুর-বাড়ি, অতিথশালা, ভোগ-মন্দির, দোলমঞ্চ, আনন্দবাজার, রথতলা, নাট-মন্দির, রন্ধনশালা, ফুল-বাগান, গোহাল-গোষ্ঠ, পঞ্চবটী, তুলসীমঞ্চ, রাসমঞ্চ, রামকুণ্ডু, সীতাকুণ্ড, গোলকধাম, দেবদেবী-স্থান—এমনি একটা পরগনা জুড়ে প্রকাণ্ড ব্যাপার! এরি এক-কোণে বন আর মাঠ। সেইখানে হাঁসেদের সঙ্গে রিদয় নেমেছে। কেন যে এত বেলা থাকতে এখানে হাঁসেরা এসে আড্ডা গেড়ে বসল, রিদয় তা বুঝলে না, ভেবেও দেখলে না, নিজের মনে বনে-বনে ঘুরে পাত-বাদাম আর শাক-পাতা কুড়িয়ে ছায়ায়-ছায়ায় খেলে বেড়াতে লাগল।

 লুসাই হাঁসের ডানা ভালো হওয়া পর্যন্ত হাঁসেরা সেখানে অপেক্ষা করবার মতলব করেছে। একদিন খোঁড়া হাঁস দুটো শোল-মাছের ছানা এনে রিদয়কে দিয়ে বললে—“খেয়ে ফেল। মাছ না খেলে রোগা হবে।” রিদয় এবারে টপ-করে হাঁসের মতো সে-দুটো গিলে ফেললে। তারপর খোঁড়া হাঁসের পিঠে চড়ে নানা-রকম খেলা চলল। কোনো দিন জলে বুনো হাঁসদের সঙ্গে সাঁতার-খেলা, কোনো দিন দৌড়াদৌড়ি, লুকোচুরি, হাঁসের লড়াই—এমনি সারাদিন ছুটোছুটি চেঁচামেচি! এমন আনন্দে রিদয় জন্মে কাটায়নি। পড়াশুনো সব বন্ধ, একেবারে কৈলাস পর্যন্ত লম্বা ছুটি আর ছুট! খেলা শেষ হলে দুতিন-ঘণ্টা দুপুর-বেলায় ধলেশ্বরীর ভাঙনের উপরে বসে জিরোনো; বিকালে আবার খেলা; আবার চান; সন্ধ্যাবেলা খেয়ে নিয়েই ঘুম। রিদয়ের খাবার ভাবনা গেছে, শোবারও কষ্ট মোটেই নেই। খোঁড়া হাঁসের ডানায় এখন বেশ ভালো পালকের গদী পেতে সে বিছানা করে নিয়েছে, ঘুম পেলেই সেখানে ঢোকে। কেবল রাত হলেই তার ভয় আসে, বুঝি কাল সকালে বাড়ি ফিরতে হয়! কিন্তু হাঁসেরা তার ফেরবার কথাই আর তোলে না। একদিন, দুদিন, তিনদিন হাঁসেরা সুরেশ্বরেই রইল; কোনো দিকে যাবার নামটি করলে না। রিদয়ও মনে ভরসা পেয়ে সুরেশ্বরের মন্দির, মঠ লুকিয়ে দেখে নিতে লাগল—চারদিক ঘুরে। চারদিনের দিন চকা-নিকোবরকে কাছে আসতে দেখেই রিদয় ভাবলে—এইবার যেতে হল ফিরে! চকা গম্ভীর হয়ে তাকে শুধোলে—“এখানে খাওয়া-দাওয়া চলছে কেমন?”

 রিদয় একটু হেসে বললে—“চলছে মন্দ নয়। তবে শীতকাল, ফল বড় একটা নেই।”

 চকা তাকে সঙ্গে নিয়ে এক-ঝাড় কাঁচা বেত দেখিয়ে বললে—“বেত খেয়ে দেখ দেখি, কেমন মিষ্টি!”

 রিদয় বেত অনেকবার খেয়েছিল, আরো খাবার তার মোটেই ইচ্ছে নেই; কিন্তু চকার হুকুমে খেতে হল। খেয়ে দেখে মিষ্টি গুড়! ঠিক যেন আক চিবোচ্ছে!

 চকা বললে—“কেমন, ভালো লাগল কি? গুরুমশায় খাওয়ান শুকনো বেত, তাই লাগে বিশ্রী। যাহোক, এখন বলি শোনো। এই বাগানে, বনে যে তুমি আজকাল একলাটি ঘুরে বেড়াতে আরম্ভ করেছ, এটা ভালো হচ্ছে না।”

 রিদয় ভাবলে, এইবার যেতে হল রে!

 চকা বলে চলল—“এই বনে তোমার কত শক্র রয়েছে, তা জানো? প্রথম হচ্ছে শেয়াল, সে তোমার গন্ধে-গন্ধে ফিরছে, সুবিধে পেলেই ধরবে। তারপর ভোঁদড়, ভাম দুজনে আছে—যেখানে-সেখানে গাছের কোটরে ঢুকতে গেলে বিপদে পড়বে কোনদিন! জলের ধারে উদ্‌বেরাল আছে—একলা চান করবার সময় সাবধান! যেখানে-সেখানে জড়ো-করা পাথরের উপরে বসতে যেও না, তার মধ্যে বেঁজি লুকিয়ে থাকতে পারে। শুকনো-পাতা-বেছানো জায়গা দেখলেই সেখানে শুতে যেয়ো না; পাতাগুলো নেড়ে, তলায় সাপ কি বিছে আছে কিনা, দেখা ভালো। মাঠ দিয়ে যখন চল, তখন আকাশের দিকে কি একবার চেয়ে দেখ—সেখানে বাজ-পাখি, চিল, কাক, শকুনি আছে কিনা? সেটা একবার-একবার দেখে চলা মন্দ নয়। ফস-করে ঝোপে-ঝাড়ে উঠতে যেয়ো না; গেরো-বাজগুলো অনেক সময় সেখানে শিকার ধরতে লুকিয়ে থাকে। সন্ধ্যা হলে কান পেতে শুনবে, কোনো দিকে পেঁচা ডাকল কিনা। পেঁচারা এমন নিঃশব্দে উড়ে আসে যে টের পাবে না কখন ঘাড়ে পড়ল!”

 তার এত শক্র আছে শুনে রিদয় ভাবলে, বাঁচা তো তাহলে শক্ত দেখছি। সে চকাকে বললে—“মরতে ভয় নেই। তবে শেয়াল-কুকুরের কিম্বা শকুনের খাবার হতে আমি রাজী নই। এদের হাত থেকে বাচবার উপায় কিছু আছে বলতে পার?”

 চকা একটু ভেবে বললে—“বনের যত ছোট পাখি আর জন্তু এদের সঙ্গে ভাব করে ফেলবার চেষ্টা কর; তাহলে কাঠঠোকরা, ইঁদুর, কাঠবেরালি, খরগোস, তালচড়াই, বুলবুলি, টুনটুনি, শ্যামা, দোয়েল, এরা তোমায় সময়-মতো সাবধান করে দেবে; লুকোবার জায়গাও দেখিয়ে দেবে। আর দরকার হয় তো এই সব ছোট জানোয়ারেরা তোমার জন্যে প্রাণও দিতে পারে।”

 চকার কথা-মতো সেই দিনই রিদয় এক কাঠবেরালির সামনে উপস্থিত—ভাব করতে। যেমন দৌড়ে রিদয় সেদিকে যাওয়া, অমনি কাঠবেরালির গিয়ে গাছে ওঠা; আর ল্যাজ-ফুলিয়ে কিচ-কিচ করে গালাগালি শুরু করা—“অত ভাবে আর কাজ নেই! তোমাকে চিনিনে? তুমি তো সেই আমতলির রিদয়! কত পাখির বাসা ভেঙেচ, কত পাখির ছানা টিপে মেরেছ। ফাঁদ পেতে, ধামা চাপা দিয়ে কত কাঠবেরালি ধরে খাঁচায় পুরেছ, মনে নেই? এখন আমরা তোমায় বিপদ থেকে বাঁচাব? এই ঢের যে বন থেকে আমরা এখনো তোমায় তাড়িয়ে মানুষের মধ্যে পাঠিয়ে দিচ্ছিনে! যাও, আমাদের দ্বারা কিছু হবে না। সরে পড় বাসার কাছ থেকে।”

 অন্য সময় হলে রিদয় কাঠবেরালিকে মজা দেখিয়ে দিত! কিন্তু এখন সে ভালোমানুষ হয়ে গেছে; আস্তে-আস্তে হাঁসকে এসে সব খবর জানালে। খোঁড়া হাঁস বললে—“অত দৌড়ে কাঠবেরালের কাছে যাওয়াটা ভালো হয়নি। হঠাৎ কিছু-একটা এসে পড়লে সব জানোয়ারই ভয় পায়, রাগ করে। যখন জানোয়ারদের কাছে যাবে—সহজে, আস্তে, ভদ্রভাবে যাবে। হুটোপাটি করে কিম্বা চুপিচুপি চোরের মতো গেলেই তাড়া খাবে। তোমার স্বভাব একটু ভালো হয়ে এসেছে; এমনি আর দিনকতক ভালোমানুষটি থাকলেই, ওরা আপনিই তোমার সঙ্গে ভাব করবে। তুমি যদি তাদের উপকার কর, তবে তারাও তোমার সহায় হবে—বনের এই নিয়ম জেনে রাখ।”

 রিদয় সারাদিন ভাবছে, কেমন করে সে বনের পশু-পাখিদের কাজে লাগতে পারবে, এমন সময় খবর হল, বেতগায়ের একটা চাষা কাঠবেরালের বৌকে ধরে খাচায় বন্ধ করেছে; আর সে-বেচারার আটদিনের বাচ্চাগুলি না খেয়ে মরবার দাখিল! খোড়া হাস রিদয়কে বললে—“দেখ, যদি কাঠবেরালির উপকার করতে চাও তো এই ঠিক সময়।” রিদয় অমনি কোমর-বেঁধে সন্ধানে বেরুল।

 লক্ষ্মীবার পিঠে-পার্বণের দিন কাঠবেরালের বৌ-চুরি হল সুরেশ্বরে, আর শনিবার বাগবাজারে ছাপার কাগজে বার হল সেই খবর। কাগজওয়ালা-ছোঁড়াগুলো গলিতে-গলিতে হেঁকে চলল—

সুরেশ্বরে মজা ভারি—কাঠবেরালের বৌ চুরি!
বুড়ো-আংলা মানুষ এল, দুটো বাচ্ছা দিয়ে গেল।
মহন্ত ঠাকুর বড় দয়াল!
খাঁচা খুলে, ছেড়ে দিলে বাচ্ছা-সমেত কাঠ-বেরাল।
মজার খবর এক পয়সা—পড়ে দেখ এক পয়সা!

 কাণ্ডটা হয়েছিল এই: কাঠবেরালের বৌটি ছিল একেবারে শাদা ধপধপধপে; তার একটা রোঁয়াও কালো ছিল না! চোখ-দুটি মানিকের মতো লাল টুকটুকে, পাগুলি গোলাপী, এমন কাঠবেরালি আলিপুরেও নেই! এ এক নতুনতর ছিষ্টি! গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো, রেল-কোম্পানীর সায়েব-সুবো তাকে ধরতে কত ফাঁদই পেতেছে, কিন্তু এ-পর্যন্ত কাঠবেরালি ধরা দেয়নি। পোষ-পার্বণের দিন বাদামতলী দিয়ে আসতে-আসতে এক চাষা এই কাঠবেরালিকে টোকা চাপা দিয়ে হঠাৎ কেমন করে পাকড়াও করে ঘরে এনে একটা বিলিতি-ইঁদুরের খাচায় বন্ধ করলে। পাড়ার লোক—ছেলে-বুড়ো, এই আশ্চর্য কাঠবেরালি দেখতে দলে-দলে ছুটে এল। এক ডোম তার জন্যে এক চমৎকার খাঁচা-কল তৈরি করে এনে দিলে। খাচার মধ্যে শোবার খাট, দোলবার দোলনা, দুধের বাটি, খাবার খৈ রাখবার ঝাঁপি, বসবার চৌকি—এমনি সব ঘর-কন্নার ছোট-ছোট সামিগ্রী দিয়ে সাজানো। সবাই ভাবলে, এমন খাঁচায় কাঠবেরালি সুখে থাকবে—খেলে বেড়াবে সারাদিন, দোলনায় দুলবে আর খৈ-দুধ খেয়ে মোটা হবে! কিন্তু কাঠবেরালি-বৌ চুপটি করে মুখ লুকিয়ে খাঁচার কোণে বসে রইল আর থেকে-থেকে কিচ-কিচ করে কাঁদতে থাকল। সারাদিন সে কিছু মুখে দিলে না, দোলনাতেও দুললে না, চৌকিতেও বসল না, খাটেও শুল না; কেবলি ছটফট করতে লাগল আর কাঁদতে থাকল।

 সুরেশ্বরের পুজো দেবার জন্যে চাষার বৌ সেদিন মালপো ভাজছিল আর সব পাড়ার মেয়েরা পিঠে-পার্বণের পিঠে গড়ছিল। রান্নাঘরে ভারি ধুম লেগে গেছে! উনুন জ্বলেছে; ছেলে-মেয়েরা পিঠে ভাজার ছ্যাঁকছ্যাঁক শব্দ পেয়ে সেদিকে দৌড়েছে। চাষার বৌ ঠাকুরের ভোগ মালপোগুলো কেবলি পুড়ে যাচ্ছে কেন, সেই ভাবনাতেই রয়েছে। ওদিকে উঠোনের বাইরে বেড়ার গায়ে কাঠবেরালির খাঁচাটার দিকে কি হচ্ছে, কেউ দেখছে না। চাষার দিদিমা বুড়ি, সে আর নড়তে পারে না, দাওয়ায় মাদুর পেতে বসে সেই কেবল দেখছে—রান্নাঘরের আলো গিয়ে ঠিক কাঠবেরালির খাঁচার কাছটিতে পড়েছে, আর সারা-সন্ধ্যে কাঠবেরালিটা খাঁচার মধ্যে খুটখাট ছটফট করে বেড়াচ্ছে। এই খাঁচার পাশেই গোয়াল, তার কাছেই সদর দরজা—খোলা। বুড়ি পষ্ট দেখলে বুড়ো-আঙুলের মতো একটি মানুষ উঠোনে ঢুকল। যক্‌ দেখলে ধনদৌলত বাড়ে, বুড়ি সেটা জানে, কাজেই বুড়ো-আংলাকে দেখে সে একটুও ভয় পেলে না। বুড়ো-আংলা বাড়িতে ঢুকেই কাঠবেরালির খাঁচাটার দিকে ছুটে গেল; কিন্তু খাঁচাটা উঁচুতে ঝুলছে; কাছে একটা পাঁকাটি ছিল, বুড়ো-আংলা সেইটে টেনে খাঁচায় লাগিয়ে সিঁড়ির মতো সোজা কাটি-বেয়ে খাঁচায় চড়ে খাঁচার দরজা ধরে খোলবার চেষ্টা করতে লাগল। বুড়ি জানে খাঁচায় তালা বন্ধ, সে কাউকে না ডেকে চুপ করে দেখতে লাগল—কি হয়! কাঠবেরালি বুড়ো-আংলার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বললে; তারপর বুড়ো-আংলা কাটি-বেয়ে নিচে নেমে চোঁচা দৌড় দিলে বনের দিকে। বুড়ি ভাবছে যক্ আর আসে কিনা, এমন সময় দেখলে বুড়ো-আংলা ছুটতে-ছুটতে আবার খাঁচার কাছে দৌড়ে গেল—হাতে তার দুটো কি রয়েছে। বুড়ি তা দেখতে পেলে না, কিন্তু এটুকু সে পষ্ট দেখলে যে বুড়ো-আংলা একটা পোঁটলা মাটিতে রেখে, আর-একটা নিয়ে খাঁচার কাছে উঠল; তারপর এক হাতে খাঁচার কাটি ফাঁক করে জিনিসটা খাচার মধ্যে গলিয়ে দিয়ে, মাটি থেকে অন্য জিনিসটা নিয়ে আবার তেমনি করে খাঁচায় দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

 বুড়ি আর চুপ করে বসে থাকতে পারলে না, সে ভাবলে, যক্ বোধ হয় তার জন্যে সাত-রাজার ধন মানিক-জোড় রেখে পালাল। খাঁচাটা খুঁজে দেখতে বুড়ি উঠল। বুড়ির কালো-বেড়ালও এতক্ষণ খাঁচার দিকে নজর দিচ্ছিল, সেও উঠে অন্ধকারে গা-ঢাকা হয়ে দাঁড়াল কি হয় দেখতে। বুড়ি পৌষমাসের হিমে উঠোন দিয়ে চলেছে, এমন সময় আবার পায়ের শব্দ, আবার বুড়ো-আংলা হাতে দুটো কি নিয়ে! এবারে বুড়ো-আংলার হাতের জিনিস কিচ—কিচ করে ডেকে উঠল। বুড়ি বুঝলে যক্‌ কাঠবেরালির ছানাগুলিকে দিতে এসেছে—তাদের মায়ের কাছে। দিদিমা উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখলেন, যক্‌ আগের মতো খাঁচার কাছে গেল, কিন্তু বেড়ালের চোখ অন্ধকারে জ্বলছে দেখে, সে যেখানকার সেইখানেই দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখতে লাগল—ছানা দুটি বুকে নিয়ে। উঠোনে বুড়িকে দেখে ছুটে এসে তার হাতে একটি ছানা দিয়ে বুড়ো-আংলা আগের মতো কাটি-বেয়ে একটির পর একটি ছানাকে খাঁচায় পুরে দিয়ে বুড়িকে পেন্নাম করে চলে গেল।

 বুড়ি ঘরে এসে সবার কাছে এই গল্প করলে, কিন্তু কেউ সেটা বিশ্বাস করতে চাইলে না—দিদিমা স্বপন দেখেছে বলে উড়িয়ে দিলে। কিন্তু বুড়ি বলতে লাগল—“ওরে তোরা দেখে আয় না!”

 সকালে সত্যি দেখা গেল চারটে ছানাকে নিয়ে কাঠবেরালি দুধ খাওয়াচ্ছে। এমন ঘটনা কেউ দেখেনি! সুরেশ্বরের মোহন্ত পর্যন্ত এই আশ্চর্য ঘটনা দেখতে হাতি চড়ে চাষার বাড়ি উপস্থিত! ওদিকে চাষার বৌ যত পিঠে সিদ্ধ করে, সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায়, সুরেশ্বরের মালপো ভোগও হয় না, তখন মোহন্ত পরামর্শ দিলেন—“ওই কাঠবেরালি নিশ্চয় সুরেশ্বরী, নয় আর-কোনো দেবী, ওকে ছোনা-পোনা সুদ্ধ বন্ধ করেছ, হয়তো সুরেশ্বর তাই রাগ করেছেন। না হলে মালপো-ভোগ পিঠে-ভোগ হঠাৎ পুড়েই বা যায় কেন? যাও, এখনি ওঁদের যেখানে বাসা, সেইখানে দিয়ে এস। না হলে আরো বিপদ ঘটতে পারে!”

 চাষা তো ভয়ে অস্থির! গ্রামসুদ্ধ কেউ আর খাঁচায় হাত দিতে সাহস পায় না। তখন সবাই মিলে দিদিমাকে সেই খাঁচা নিয়ে বনে কাঠবেরালির বাসায় পাঠিয়ে দিলে। বুড়ি যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে, আসবার সময় রাস্তার মাঝে একটা মোহর পেয়ে গেল। ‘যতো ধর্ম স্ততো জয়’ বলে খবরের কাগজের সম্পাদক খবরটা শেষ করলেন। এই বুড়ো-আংলাটি কিনি—লোকে তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে লাগল সুরেশ্বরে, বাগবাজারে, ফরিদপুরে, যশোরে, ময়মনসিংহে, আগরতলায়, আসামে, কাছাড়ে!

 এই ঘটনার দুদিন পরে আর-এক কাণ্ড! গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র যেখানে এক হয়েছে, সেইখানে আড়ালিয়ার চর। বুনোহাঁসের সঙ্গে রিদয়কে নিয়ে খোঁড়া হাঁস সেই চরে চরতে নামল। চরটা কেবল বালি, মাঝে-মাঝে ছোটছোট ঝাউ, আর এখানে-ওখানে শুকনো ঘাস। চরের একদিকে আড়ালিয়া গ্রাম। হাঁসরা চরছে, এমন সময় চরের উপরে কতকগুলো জেলের ছেলে খেলতে এল। মানুষ দেখেই চকা হাঁক দিলে, আর অমনি সব বুনো হাস ডানা-মেলে উড়ে পড়ল। কিন্তু খোঁড়া হাঁস ছেলে দেখে একটুও ভয় পেলে না; বরং গলা চড়িয়ে বুনো হাঁসদের বললে—“ছেলে দেখে ভয় কি?”

 রিদয় হাঁসের পিঠ থেকে নেমে একটা ঝাউতলায় বসে ঝাউফুল কুড়িয়ে মার্বেল খেলছে, ছেলেগুলো কাছে আসতেই সে একবার শিস দিয়ে খোঁড়াকে সাবধান করে একটা ঘাস-বনে লুকিয়ে পড়ল। কিন্তু খোঁড়ার আজ কি যে হল, সে যেমন চরছিল তেমনি চরে বেড়াতে লাগল। ছেলেদুটো একটা বালির টিপি ঘুরে একেবারে দুদিক থেকে হাঁসকে তাড়া করলে। কেমন করে যে তারা এত কাছে হঠাৎ এলে পড়ল, ভেবে না পেয়ে খোঁড়া একেবারে হতভম্ব! উড়তে যে জানে তা মনেই এল না। সে ক্রমাগত দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করতে লাগল। তারপর একটা ডোবার কাছে গিয়ে খোঁড়া ধরা পড়ে গেল।

 রিদয়ের প্রথমে মনে এল যে ছুটে গিয়ে ছেলে-দুটোকে থাবড়া মেরে হাঁসটা কেড়ে নেয়, কিন্তু তখনি মনে পড়ল, সে ছোট হয়ে গেছে! তখন সে রেগে বসে-বসে কেবলি বালি খুঁড়তে লাগল। এদিকে খোঁড়া ডাকছে—“বুড়ো-আংলা ভাই, এস লক্ষ্মীটি, আমায় বাঁচাও!”

 “ধরা পড়ে এখন বাঁচাও!”—বলে রিদয় ছেলে-দুটোর সঙ্গে দৌড়ল। ছেলে-দুটো হাঁস নিয়ে একটা নালা পেরিয়ে চর ছেড়ে গ্রামে ঢুকল।

 রিদয় আর তাদের দেখতে পেলে না। নালায় অনেক জল। রিদয় অনেকটা ঘুরে তবে একটা শুকনো-গাছের ডাল বেয়ে ওপারে উঠে, হাঁসকে খুঁজতে মাটির উপর ছেলেদের পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে চলল। একটা চৌমাথায় দেখা গেল, ছেলে-দুটো দুদিকে গেছে। কোন পথে যাওয়া যায়, রিদয় ভাবছে, এমন সময় বাঁকের রাস্তায় একটা হাঁসের পালক রয়েছে দেখে রিদয় বুঝলে, হাঁস এই পথে গেছে—পালক ফেলতে-ফেলতে, যাতে সে সন্ধান পায় সেই জন্যে।

 রিদয় পালকের চিহ্ন ধরে দুটো মাঠ পেরিয়ে গ্রামের একটা সরু গলি পেলে। গলির মোড়ে একটা মন্দির। হাঁস কোথায় দেখা নেই, মন্দিরের খিলেনের উপরে লেখা—“হংসেশ্বরী!” আর তারি উপরে মাটির গড়া এক হাঁস। রিদয় রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে সেই দিকে চেয়ে আছে, এদিকে পিছনে প্রায় একশো লোক জমা হয়েছে—নাকে তিলক, কপালে ফোঁটা, নেড়া-মাথা বৈরিগীর দল! রিদয় যেমনি ফিরেছে অমনি সবাই মাটিতে দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করে বললে—“জয় প্রভু বামনদেব, ঠাকুর, কৃপা কর!”

 বামন কে, রিদয় তা জানত না, কিন্তু প্রণামের ঘটা দেখে সে বুঝলে, সবাই তাকে দেবতা ভেবেছে। রিদয় অমনি গম্ভীর হয়ে বললে—“তোমরা আমার হাঁস চুরি করেছ, এখনি এনে দাও। না হলে হংসেশ্বরীর কোপে পড়ে যাবে।”

 সবাই মুখ-চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। তখন হংসেশ্বরীর পাণ্ডা গলবস্তর হয়ে বললে—“ঠাকুর, হাঁস কোথায় আছে বলে দিন, এখনি এনে দিচ্ছি!”

 রিদয় রেগে বলে উঠল—“কোথায় জানলে কি তোমাদের আনতে বলি? এই গ্রামের দুটো ছেলে তাকে নিয়ে এসেছে—এই দিকে।”

 এই কথা হচ্ছে এমন সময় মন্দিরের পিছন দিকে হাঁসের ডাক শোনা গেল। বেচারা প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে! রিদয় দৌড়ে সেদিকে গিয়ে দেখে একটা ঘরের উঠোনে এক বুড়ি খোঁড়া হাঁসকে দুই হাঁটুতে চেপে ধরে ডানা কেটে দেবার উদ্যোগ করছে—দুটো পালক কেটেছে, আর দুটো মুঠিয়ে ধরে কাটবার চেষ্টায় আছে। হঠাৎ বুড়ো-আংলা-রিদয়কে দেখে বুড়ি একেবারে হাঁ হয়ে গেল! সেই সময়ে যত নেড়ানেড়ির দল ছুটে এসে হৈ-হৈ করে বুড়ির হাত থেকে খোঁড়া হাঁস ছাড়িয়ে নিলে। রিদয় হাঁসের উপরে চড়ে বসল আর অমনি রাজহাঁস তাকে নিয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল।

 বৈরিগীর দল সেই হাঁসের পালক হংসেশ্বরীর পরমহংস-বাবাজীর কাছে হাজির করে দিলে। তিনি পালক-কটি একটা হাঁড়িতে রেখে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন—“অভূতপূর্ব ঘটনা! হংসেশ্বরীর রাজহংস স্বশরীরে বামনদেবকে নিয়ে উপস্থিত হয়ে দুটি পালক রক্ষা করে গেছেন। সে জন্য একটি সোনার কৌটার প্রয়োজন। হিন্দুমাত্রেরই এই বিষয়ে মুক্তহস্ত হওয়া উচিত। চাঁদা আমার কাছে মঃ অঃ করিয়া পাঠাইবেন। ইতি—সুরেশ্বরের পরমহংস বাবাজী।”

 মানুষদের মধ্যে যেমন খবরের কাগজ, পাখিদের মধ্যে তেমনি খবর রটাবার জন্য পাখি আছে। কোথাও কিছু নতুন কাণ্ড হলেই সেই জায়গাটার উপরে প্রথমে কাক-চিল জড়ো হয়, তারপর তাদের মুখে এ-পাখি, এপাখির মুখে ও-পাখি—এমনি এ-বন, সে-বন, এ-দেশ, সে-দেশে দেখতে দেখতে খবর রটে যায়।

 কাঠবেরালির কথা আর খোঁড়া হাঁস উদ্ধারের কথা রিদয় ফিরে আসার পূর্বে হাঁসের দলে, বনে-জঙ্গলে, জলে-স্থলে কোনো জানোয়ারের জানতে আর বাকি রইল না। গাছে-গাছে তাল-চড়াই, গাং-শালিক—এরা সুরেতালে রিদমের কীর্তি-কথা ঢেঁড়া-পিটিয়ে বলে বেড়াতে লাগল:

 শুন এবে অবধান পশুপক্ষিগণ।
 বুড়ো-আংলা মহাকাব্য করি বিবরণ॥
 কাঠবেরালি রামদাস তাহারে উদ্ধরি।
 বীরদাপে চলে যথা রাজহংসেশ্বরী॥
 হাঁসের পালক দুটা কেটে নিল বুড়ি।
 যাহে লেখা যায় মহাকাব্য ঝুড়ি-ঝুড়ি॥
 হাঁসের দুর্দশা দেখি আংলা বুড়ো ধায়।
 হংসেশ্বরী ছাড়ি বুড়ি পালাল ঢাকায়॥
 মোহন্ত তুলিয়া নিল হংসের কলম।
 সোনা চাই বলি তাহে লেখে বিজ্ঞাপন॥
 তালচটক তাল ধরে গানশালিকে কয়।
 সুবচনী হাঁস নিয়ে চলিল রিদয়॥
 খোঁড়া হাঁসেরে লইয়া, খোঁড়া হাঁসেরে লইয়া
 রচিলাম মহাকাব্য যতন করিয়া।
 আংলা বিজয় নামে কাব্য চমৎকার।
 গোটা দুই শ্লোক তারি দিনু উপহার॥
 সকলে শুনহ আর শুনাহ অন্যকে।
 ক্ষীর হতে নীর পিয়ে ধন্য হোক লোকে॥
 ইতি আংলা বিজয় মহাকাব্যে প্রথম সর্গঃ।

 আজ চকা-নিকোবর ভারি খুশি। সে রিদয়কে কুর্নিস করে বললে—“একবার নয়, বার-বার তিনবার তুমি দেখিয়েছ যে পশু-পাখিদের তুমি পরমবন্ধু! প্রথমে শেয়ালের মুখ থেকে বুনো হাঁস ‘লুসাইকে’ উদ্ধার, তার পরে কাঠবেরালির উপকার, সব-শেষে পোষা হাঁসকে বাঁচানো। তোমার ভালোবাসায় আমরা কেনা হয়ে রইলেম। আর তোমায় আমরা ফেরাতে চাইনে। তোমার যদি মানুষ হতে ইচ্ছে হয় তো বল আমি নিজে গণেশঠাকুরকে তোমার জন্যে ‘রেকমেণ্ডেসন’ পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

 রিদয়ের আর মোটেই মানুষ হতে ইচ্ছে ছিল না। হাঁসেদের সঙ্গে দেশ-বিদেশ দেখতে-দেখতে বড় মজাতেই সে দিন কাটাচ্ছে, তবু মানুষ-হবার রেকমেণ্ডেসনখানা না নিলে চকা পাছে কিছু মনে করে, সেই ভয়ে বললে—“মানুষ হবার সময় হলে আমি তোমাকে জানাব। এখন কিছুদিন তোমাদের সঙ্গে থাকতে আমি ইচ্ছে করেছি।”

 চকা ঘাড় নেড়ে বললে—“সেই ভালো; যখন ইচ্ছে হবে বল, আমি সাট্টিফিকিট দিয়ে তোমাকে গণেশের কাছে পাঠাব। এখন হাঁসের দলে হংসপাল হয়ে থাক।” বলে চকা রিদয়ের মাথাটা ঠোঁট দিয়ে চুলকে দিলে। অমনি চারদিকে বুনো হাঁস রিদয়ের নতুন উপাধি ফুকরে উঠল—“হংপাল! হংপাল!”

 বনের পাখিরা প্রতিধ্বনি করলে—“হি-রি-দ-য় হংসপাল!”