বিষয়বস্তুতে চলুন

বুদ্ধের জীবন ও বাণী/বৌদ্ধ সাধকের নির্ব্বাণ

উইকিসংকলন থেকে
বৌদ্ধ সাধকের নির্ব্বাণ

 সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়া বৌদ্ধ সাধক যখন রাগদ্বেষশূন্য ও প্রশান্তচিত্ত হন তখন তাঁহার মনের অবস্থা কিরূপ হয়? বাসনার নাশ সংস্কারের নাশ অবিদ্যার নাশ হইবার পরে তিনি কি অবস্থায় জীবিত থাকিবেন? ধম্মপদে উক্ত হইয়াছে:—যাঁহার দেহে রাগদ্বেষাদি কিছুই নাই, যাঁহার চিত্ত শান্তিলাভ করিয়াছে, যিনি ধর্ম্ম সম্যক্‌রূপে উপলব্ধি করিয়াছেন সেই ভিক্ষুর অমানুষী রতি অর্থাৎ আনন্দ হয়।

 আমরা সাধারণ মানুষ যাহা কিছু করিয়া থাকি আত্মসুখ কামনাই তাহার মূলে বিদ্যমান রহিয়াছে। আমাদের সর্ব্ববিধ কর্ম্মচেষ্টা এই স্বার্থপরতা হইতেই উদ্ভূত হইয়া থাকে। সুতরাং আমরা যখন শুনি যে আমাদের ক্ষুদ্র “অহং” মিথ্যা, আমাদের স্বার্থপরতা মিথ্যা, সাংসারিকতা মিথ্যা তখন আমরা একান্ত সঙ্কুচিত হই। সঙ্কোচের কারণ এই যে আমাদের মনে এইরূপ একটি দৃঢ় প্রত্যয় বদ্ধমূল আছে যে আমাদের স্নেহপ্রীতি দয়া মায়া সমস্ত আনন্দরসের উৎস অহংবোধের অভ্যন্তরে নিহিত আছে। যদি আমার এই অহংবোধটির বিলোপ ঘটে তবে আর রহিল কি? কিন্তু যাঁহারা দিব্যদৃষ্টি লাভ করিয়া মানবপ্রকৃতির গূঢ় রহস্য প্রত্যক্ষ করিয়াছেন তাঁহারা অবিচলিত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়া থাকেন যে মানবের ক্ষুদ্র অহংবোধের বিলোপ ঘটিলেই বিশ্বব্যাপী আনন্দ তাঁহার নিকটে অবারিত হয়।

 যে ব্যক্তি স্বার্থপর, অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত “আমি” ও “আমার” এই লইয়াই ব্যস্ত—প্রতিবেশীকে, সর্ব্বমানবকে বিশ্বসংসারকে সে ভালবাসিবে কেমন করিয়া? এই অজ্ঞানতা কিংবা অবিদ্যা উচ্চ প্রাচীরের ন্যায় চারিদিক হইতে তাহার দৃষ্টি রোধ করিয়া রাখে। কয়েদীর ন্যায় এই কারাগারের মধ্যে সে বাস করে, কারাবাসের অসহ্য দুঃখ সে অনুভব করে, কত সময়ে দুঃসহ দুঃখে অধীর হয়, কিন্তু তথাপি ঘুরিয়া-ফিরিয়া ঐ কারাবেষ্টনের মধ্যেই তাহার দিন কাটিয়া যায়। এই আত্যন্তিক দুঃখের নিবৃত্তিই একমাত্র বৌদ্ধ সাধনার নহে, সর্ব্বদেশের সকলপ্রকার সাধনার প্রধান লক্ষ্য। যাঁহারা আপন আপন জীবনের সাধনাদ্বারা বিশ্ববাসীকে এই দুঃখ নিবৃত্তির উপায় দেখাইয়া দিয়াছেন তাঁহারাই সর্ব্বদেশে মহাপুরুষ বলিয়া পূজিত হইতেছেন। তাঁহারা মহাসত্ত্ব বা মহাপুরুষ, কেননা তাঁহারা ক্ষুদ্রতার, অবিদ্যার কিংবা অহংকারের প্রাচীর ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া আপনাকে সর্ব্ব মানবের পরমাত্মীয় করিয়া দিয়াছেন। মহাসাধকদিগের বাণী বিভিন্ন হয় হউক, সাধনার প্রণালী বিচিত্র হয় হউক, কিন্তু তাঁহাদের সাধনার মূল এবং তাহার পরিণতি অভিন্ন। অত্যন্ত দুঃখই সকলকে সাধনায় প্রবৃত্ত করিয়াছে এবং সিদ্ধি লাভ করিয়া সকলেই শুদ্ধসত্ত্ব হইয়া দুঃখের হাত হইতে অব্যাহতি লাভ করিয়াছেন। সিদ্ধি লাভ করিবার পরে মহাপুরুষ আর বদ্ধজীব নহেন, মুক্তজীব। তখন তাঁহার স্বার্থমূলক আমিত্বের বিলোপ ঘটে বলিয়া তিনি আত্মসুখ কামনায় কিছুই করেন না, যাহা কিছু করেন সমস্তই সর্ব্বহিত কামনায় সম্পাদিত হইয়া থাকে। যাহাতে সকলের কল্যাণ যাহাতে সকলের সুখ, প্রশান্তচিত্ত মহাপুরুষ তাহাই করিয়া থাকেন। অবিদ্যার হস্ত হইতে মুক্তি লাভ করিয়া তিনি যখন দিব্যচক্ষু দ্বারা ধর্ম্মদৃষ্টি দ্বারা সমস্ত প্রত্যক্ষ করেন তখনই জীবের প্রতি প্রেমে করুণায় তাঁহার হৃদয় পূর্ণ হইয়া উঠে। এই প্রীতি এই করুণা সাধারণ মানবের নাই বলিয়া ধর্ম্মপদ ইহাকেই “অমানুষী রতি” বলিয়া থাকিবেন।

 ধ্যানপ্রভাবে সাধকের চিত্ত যখন প্রশান্ত হয়, এবং বৈরাগ্যবলে তাঁহার মন যখনি নির্ব্বিকার হয়—তখনই নিত্য সত্যের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎকার ঘটে; অর্থাৎ জ্ঞান সূর্য্যের উদয়ে তখন অবিদ্যার অন্ধকার বিদূরিত হয়। এই সময়ে বৌদ্ধ সাধক চারিটি আর্য্য সত্য প্রত্যক্ষ করেন। তিনি তখন সুস্পষ্ট বুঝিয়া থাকেন, দুঃখ কি? দুঃখ কেমন করিয়া উৎপন্ন হয়? দুঃখের নিবৃত্তি কিরূপ? এবং দুঃখ দূর করিবার উপায় কি? যে ব্যক্তি নিম্ন ভূমিতে বিচরণ করে চারিদিকের সংকীর্ণ সীমা তাহার দৃষ্টি রোধ করিয়া রাখে, কিন্তু যখনই সে অত্যুচ্চ পর্ব্বতের শৃঙ্গদেশে দণ্ডায়মান হয় তখনই তাহার দৃষ্টির প্রসার বর্দ্ধিত হয়। সাধনার ক্ষেত্রে একথা সত্য। মানব যতদিন জরা ব্যাধি মৃত্যুর লীলাভূমির মধ্যে বিচরণ করেন ততদিন অহংকারের গণ্ডী তাহার দৃষ্টি আবদ্ধ করিয়া রাখিবেই কিন্তু যখন তিনি ধ্যানের উচ্চ চূড়ায় আরোহণ করিয়া নিম্নক্ষেত্রে এই সকলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন তখনই এই জরাব্যাধির মৃত্যুর সত্য রূপ তাঁহার জ্ঞানগম্য হইয়া থাকে। যিনি দুঃখের মধ্যে নিমজ্জিত, দুঃখের জ্বালা তিনি অনুভব করেন সত্য, কিন্তু দুঃখের খাঁটি চেহারা তিনি দেখিতে পান না। সাধক দুঃখের উর্দ্ধে উন্নীত হইয়াই দুঃখের সত্যমূর্ত্তি দর্শন করেন। ইহাই তাঁহার নির্বাণ লাভ।

 স্থূলতঃ বৌদ্ধ সাধকের নির্ব্বাণ, বাসনার নির্ব্বাণ—সংস্কারের নির্ব্বাণ, দুঃখের নির্ব্বাণ। কিন্তু এই নির্ব্বাণ কেবলমাত্র বিনাশ নহে,—কারণ মানব ভ্রান্তির হাত হইতে অব্যাহতি লাভ করিয়াছেন মাত্র; সাধনার পূর্ব্বে তিনি নিম্নভূমিতে অবস্থিত ছিলেন বলিয়া যাহা তাঁহার প্রত্যক্ষগোচর ছিল না, সাধনা দ্বারা উর্দ্ধে অবস্থিত হইয়াছেন বলিয়া তাহা সত্যরূপে তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে এইমাত্র। বৈজ্ঞানিক তাঁহার আলোক যন্ত্র ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া যখন একখানি পটের উপরে আলোকপাত করেন তখন তাহার উপরে নানা। চিত্র প্রতিবিম্বিত হইয়া থাকে, অনন্ত আকাশে আলোকপাত করেন তখন তাহার উপরে নানা চিত্র প্রতিবিম্ব দৃষ্টিগোচর হয় না। মানবের আমিত্বও এইরূপ একখানি সমীপবর্ত্তী স্থূল পটমাত্র, উহারই উপরে নানা দুঃখবেদনার ছবি প্রতিবিম্বিত হইয়া থাকে, কিন্তু তাহার বুদ্ধি যখন স্থূল আমিত্বকে অতিক্রম করিয়া অসীমে মিশিয়া যায় তখন আর তাহার দুঃখ বোধ থাকে না। এইরূপ আমিত্বের বিলোপ ঘটিলেই সাধক দুঃখ হইতে মুক্তি লাভ করেন। ইহাই নির্ব্বাণ। এই নির্ব্বাণকে কেবলমাত্র বিনাশ বলা চলে না; কারণ সাধকের চিত্ত আমিত্বের সীমা হইতে মুক্তি লাভ করিয়া অসীমের মধ্যে নিমজ্জিত হইল। সমস্ত বাধা ও বিকার দূরীভূত হওয়ায় তাহার চিত্ত এখন সর্ব্বাঙ্গীন স্বাধীনতা লাভ করিল, ইহাই মুক্তি ইহাই নির্ব্বাণ, ইহা বিনাশ নহে।

 বৌদ্ধদার্শনিকগণ নানাদিক দিয়া নানাভাবে নির্ব্বাণ রহস্য আলোচনা করিয়াছেন, সেই উচ্চ তত্ত্ব আমাদের আলোচনার বিষয় নহে। নির্ব্বাণপ্রাপ্ত সাধকের অবস্থা কিরূপ হয় তাহাই আমাদের আলোচ্য বিষয়। ধম্মপদ বলেন,—সাধক বুদ্ধির স্থৈর্য্য সম্পাদন করিয়া, শীলাদি আচরণ পালনে নিপুণ হইয়া সুখানুভব করিতে করিতে দুঃখের ধ্বংস করিয়া থাকেন। আবার মহাপুরুষ বুদ্ধের সাধনার যে মনোহর বিবরণ ললিতবিস্তরে বিবৃত আছে তাহাতেও গ্রন্থকার মহাপুরুষের মুখে এই বাণী বলাইয়াছেন:—

মৈত্রীবলেন জিত্বা পীতে মেঽস্মিন্নমৃতমণ্ডঃ।
করুণাবলেন জিত্বা পীতে মেঽস্মিন্নমৃতমণ্ডঃ।
মুদিতাবলেন জিত্বা পীতে মেঽস্মিন্নমৃতমণ্ডঃ!
ভিন্না ময়াহ্যবিদ্যা দীপ্তেন জ্ঞানকঠিনবজ্রেণ।

এই বোধিমূলে বসিয়া মৈত্রীবলে জয় লাভ করিয়া আমি অমৃত রস পান করিতেছি, করুণাবলে জয়লাভ করিয়া আমি অমৃত রস পান করিতেছি, মুদিতা বলে জয়লাভ করিয়া আমি অমৃত রস পান করিতেছি। প্রদীপ্ত জ্ঞানরূপ কঠিন বজ্রে আমি অবিদ্যাকে ছেদন করিয়াছি।

 এই যে সিদ্ধি, ইহাতে যেমন মৈত্রী করুণা ও মুদিতা আছে অন্য দিকে তেমনি আমিত্ববিহীন পরিশুদ্ধ জ্ঞান আছে। এই সিদ্ধি লাভ করিয়াই সাধক “অমানুষী রতি” লাভ করিয়া থাকেন। তাঁহার চিত্ত আমিত্ববিহীন শুষ্ক বিশুদ্ধ জ্ঞানলোকে বিহরণ করে এমন নহে; সমস্ত জগতে যাহা কিছু কল্যাণ যাহা কিছু সুখ তাহারই অনুগত হওয়ায় সাধকের চিত্ত পরিপূর্ণ আনন্দের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়।