বেওয়ারিশ লাস/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 অনুসন্ধানের এক অধ্যায় শেষ হইল। আমি বালিগঞ্জ হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া সেই মৃতদেহ আর থানায় দেখিতে পাইলাম না। যে স্থানে শব পরীক্ষা হয়, সেই স্থানে সেই শব তখন প্রেরিত হইয়াছিল।

 সেই স্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, সেই স্থানেও সেই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত অনেক লোকের সমাগম হইয়াছে।

 যে বাক্সের ভিতর মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেই বাক্সের ভিতর ঔষধের একটা ছোট শিশি পাওয়া গিয়াছিল, তাহা পাঠকগণ পূর্ব্ব হইতে অবগত আছেন। সেই শিশির উপরকার লেভেলে ব্যাথগেট কোম্পানির নাম লেখা ছিল। একজন কর্ম্মচারী সেই শিশিটী লইয়া ব্যাথগেট কোম্পানির বাটীতে গমন করিয়াছিলেন।

 লাস পরীক্ষার স্থানে আমরা গিয়া উপস্থিত হইবার পর, সেই কর্ম্মচারী ব্যাথগেট কোম্পানির ঔষধালয় হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন ও কহিলেন, “এই শিশিতে যাহা লেখা আছে, ব্যাথগেট কোম্পানি তাহাদিগের খাতা-পত্র দেখিয়া, তাহা অপেক্ষা আর অধিক কোন সংবাদ প্রদান করিতে পারিলেন না।”

 অনেকে মনে করিয়াছিলেন, সেই ঔষধের শিশি হইতে এই অনুসন্ধানের কোন না কোন সুত্র বাহির হইয়া পড়িবে; কিন্তু সেই কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া সকলেই একবারে নীরব হইয়া পড়িলেন। পুনরায় কোন্ উপায় অবলম্বন করিয়া, সকলে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবেন, তাহাই ভাবিতে লাগিলেন।

 যে একটী সূত্র পাইয়া আমি এই মোকদ্দমার উদ্ধার করিতে পারিব বলিয়া আশা করিয়াছিলাম, এখন আমার সে আশাও দূর হইয়াছে। পুনরায় আবার কোন্ উপায় অবলম্বন করিব, মনে মনে এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে যে স্থানে সেই মৃতদেহ রক্ষিত ছিল, সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া সদর রাস্তার উপর আসিয়া দাঁড়াইলাম। আমার সম্মুখ দিয়া কত লোক যে সেই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত সেই স্থানে প্রবেশ করিতে লাগিল, এবং কত লোক মৃতদেহ দেখিয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া যে চলিয়া যাইতে লাগিল, তাহার সংখ্যা করা নিতান্ত সহজ নহে।

 আমি সেই রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ক্রমে ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম। সেই রাস্তার ধারে একটা চাউলের দোকান ছিল, ক্রমে গিয়া আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলাম। আমার সম্মুখ দিয়া তখন পর্য্যন্ত অনেক লোক সেই স্থানে গমন ও তথা হইতে প্রস্থান করিতে লাগিল। আমি বসিয়া বসিয়া কেবল তাহাদিগকে দেখিতে লাগিলাম, এবং তাহাদের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি কি বলে, তাহা সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতে লাগিলাম।

 এইরূপে কিয়ৎক্ষণ বসিয়া থাকিবার পর, একটা কথা হঠাৎ আমার কর্ণে প্রবেশ করিল। একজন মুসলমান অপর একজন মুসলমানকে বলিতেছে, “এই মৃতদেহ কাহার, তাহা চিনিতে পারিলে কি?”

 উত্তরে অপর ব্যক্তি কহিল, “না, আমি কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না; কিন্তু এই ব্যক্তি যে আমার পরিচিত, বা ইহাকে যেন কোথায় দেখিয়াছি, ইহা আমার বেশ মনে হইতেছে।”

 প্রথম ব্যক্তি। এই ব্যক্তি মেহের আলির জামাই নয় কি?

 দ্বিতীয় ব্যক্তি। ঠিক কথা বলিয়াছ। এখন আমার বেশ মনে হইতেছে, এ মেহের আলির জামাই বটে।

 এই কথা শুনিয়া আমি উভয়কেই ডাকিলাম। তাহারা আমার নিকটে আসিলে, আমি তাহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কহিলাম, “ওই মৃতদেহ দেখিয়া তোমরা কিছু চিনিতে পারিলে কি, যে ওই মৃতদেহ কাহার?”

 ১ম ব্যক্তি। না মহাশয়! আমরা কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।

 আমি। মেহের আলিকে তুমি চেন নাকি?

 ১ম ব্যক্তি। কোন্ মেহের আলি?

 আমি। কোন মেহের আলি।

 ১ম ব্যক্তি। না মহাশয়! আমি কোন মেহের আলিকে চিনি না।

 আমি। (দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রতি লক্ষ্য করিয়া) কেমন, তুমিও বোধ হয়, মেহের আলিকে চিন না?

 ২য় ব্যক্তি। আমি এক মেহের আলিকে চিনি।

 আমি। সে মেহের আলি কে?

 ২য় ব্যক্তি। সে থাকে তালতলায়। সে কোন সাহেব বাড়ীতে খানসামার কার্য্য করে।

 আমি। তাহার জামাইকে তুমি চিন কি?

 ২য় ব্যক্তি। তাহার একটা জামাই ছিল জানি।

 আমি। সে জামাই এখন কোথায়?

 ২য় ব্যক্তি। তাহা আমি বলিতে পারি না।

 আমি। তাহার নাম কি?

 ২য় ব্যক্তি। তাহার নামটা যে কি, তাহা আমার স্মরণ নাই।

 আমি। তুমি যে মৃতদেহ দেখিয়া আসিলে, উহা মেহের আলির জামাতার মৃতদেহ বলিয়া বোধ হয় না কি?

 ২য় ব্যক্তি। সেইরূপই বোধ হয়; কিন্তু আমি ঠিক চিনিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

 আমি। (প্রথম ব্যক্তির প্রতি) কেমন, তোমার কি বোধ হয়? যে মৃতদেহ দেখিয়া আসিলে, তাহা মেহের আলির জামাতার মৃতদেহ বলিয়া বোধ হয় কি?

 ১ম ব্যক্তি। আমি মেহের আলিকেই চিনি না, তাহার জামাতাকে চিনিব কি প্রকারে?

 আমি। তোমার মত মিথ্যাবাদী মুসলমান জাতির ভিতর আর আছে কি না, জানি না। এখনই তুমি তোমার এই সঙ্গীকে বলিতেছিলে যে, ওই মৃতদেহ মেহের আলির জামাতার। আর আমি তোমাকে যেমন জিজ্ঞাসা করিলাম, অমনি সকল কথা অস্বীকার করিলে! তোমার মত নির্ব্বোধ লোক আমি আর দেখি নাই। এই মৃতদেহ যে কাহার, এই সংবাদ যে বলিয়া দিতে পারিবে, সে পঞ্চাশ টাকা পারিতোষিক পাইবে, এই কথা তুমি শুন নাই কি?

 ১ম ব্যক্তি। শুনিয়াছি; কিন্তু আমি যখন চিনিতে পারি নাই, তখন কাহার নাম করিব?

 আমি। তোমার মিথ্যা কথা আর আমি শুনিতে চাহি না। তুমি যেরূপ প্রকৃতির লোক, তোমার সহিত সেইরূপ ভাবে ব্যবহার না করিলে, তোমার নিকট হইতে কোন কথা পাইবার প্রত্যাশা নাই। যাহাতে তুমি প্রকৃত কথা সহজে বলিতে সক্ষম হও, আমি এখনই তাহার উপায় করিতেছি। তুমি একটু অপেক্ষা কর, তোমার সমভিব্যাহারী ব্যক্তিকে আর দুই চারিটী কথা আমি অগ্রে জিজ্ঞাসা করিয়া লই; তাহার পর আমার বিবেচনা মত ব্যবহার আমি তোমার প্রতি করিতেছি।

 এই বলিয়া আমি সেই দ্বিতীয় ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “মেহের আলির জামাতা কোথায় থাকে, তাহা তুমি বলিতে পার কি?”

 ২য় ব্যক্তি। না মহাশয়! আমি তাহার বাড়ী জানি না।

 আমি। মেহের আলির বাড়ী জান?

 ২য় ব্যক্তি। তাহা জানি।

 আমি। তুমি আমাকে সেই বাড়ী দেখাইয়া দিতে পার?

 ২য়। সবিশেষ আবশ্যক হয়, ত কাজেই দেখাইয়া দিতে হইবে; কিন্তু এখন একটু প্রয়োজন বশতঃ আমাকে স্থানান্তরে গমন করিতে হইতেছে। পরে যখন বলিবেন, সেই সময় আমি আসিয়া আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া মেহের আলির বাড়ী দেখাইয়া দিব।

 আমি। তুমি এখন অপর কার্য্যে গমন করিতেছ, কিন্তু ইহাও সবিশেষ কার্য্য। কারণ, তোমার সংবাদ যদি ঠিক হয়, অর্থাৎ এই মৃতদেহ যদি মেহের আলির জামাতার হয়, তাহা হইলে সরকার হইতে তুমি একবারে পঞ্চাশ টাকা পাইবে, তদ্ব্যতীত সরকারী কার্য্যে আমাদিগের সাহায্য করাও হইবে। তুমি এখনই আমার সঙ্গে আইস, এবং মেহের আলির ঘর আমাকে দেখাইয়া দেও। তাহা হইলে সেই স্থান হইতে আমি অনায়াসেই সন্ধান লইতে পারি যে, তাহার জামাতা কোথায় থাকে।

 আমার কথায় দুই একবার আপত্তি উত্থাপন করিয়া, পরিশেষে সেই ব্যক্তি আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল। আমি তাহাকে সঙ্গে লইয়া তৎক্ষণাৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। অপর ব্যক্তি জনৈক প্রহরীর সহিত সেই স্থানে বসিয়া রহিল।

 সেই ব্যক্তি আমাকে সঙ্গে করিয়া তালতলায় মেহের আলির বাড়ীতে লইয়া গেল। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, মেহের আলি বাড়ীতে নাই। অতি প্রত্যূষে সে আপন কার্য্যে গমন করিয়াছে। মেহের আলির একমাত্র কন্যা, সে সেই সময় মেহের আলির বাড়ীতেই ছিল।

 আমরা মেহের আলির বাড়ীর সম্মুখে গমন করিলেই, পাড়ার অনেক লোক আসিয়া সেই স্থানে ভিড় করিয়া ফেলিল। উহাদিগের একজনকে মেহের আলির আত্মীয় বলিয়া অনুমান হইল। তাহাকে মেহের আলির জামাতার নাম জিজ্ঞাসা করায়, সে নিজে তাহা বলিতে পারিল না; কন্তু মেহের আলির বাড়ীর ভিতর গমন করিয়া তাহার নাম জানিয়া আসিয়া আমাকে কহিল, “মেহের আলির জামাতার নাম রব্বানি।”

 যে বাড়ীতে মেহের আলি বাস করে, তাহা মেহের আলির নিজের বাড়ী। উহা একখানি সামান্য খোলার ঘর। রাস্তার উপর সদর দরজা, উহা খোলা রহিয়াছে; কিন্তু সেই দরজার উপর একখানি চটের পরদা ঝুলিতেছে। সেই পরদাটী নিতান্ত পুরাতন, এবং স্থানে স্থানে ছিঁড়িয়া গিয়াছে।

 যে ব্যক্তি বাড়ীর ভিতর গমন করিয়া মেহের আলির জামাতার নাম জানিয়া আসিল, সে ভিতর হইতে আমাদিগের নিকট আসিবার পরেই কয়েকটী স্ত্রীলোক সেই পরদার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। আমাদিগের প্রেরিত ব্যক্তি রব্বানির নাম আমাকে বলিবার পরই পরদার অন্তরাল হইতে একটা স্ত্রীলোক কহিল, “কেন গা কি হইয়াছে?”

 আমি। রব্বানি কোথায়, তাহাই জানিবার নিমিত্ত এখানে আসিয়াছি।

 পরদার অন্তরালবর্ত্তী স্ত্রীলোক। কেন মহাশয়! কেন তাহার অনুসন্ধান করিতেছেন? অদ্য তিন দিবস হইতে তিনি যে কোথায় গিয়াছেন, তাহার কিছুই আমরা স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

 আমি। একটী মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, কেহ কেহ বলিতেছে, উহা মেহের আলির জামাতার দেহ। তাই আমরা জানিতে আসিয়াছি যে, তাহার জামাতা এখন কোথায়।

 আমার এই কথা শুনিবামাত্র সেই পরদার অন্তরালবর্ত্তী স্ত্রীলোকদিগের মধ্য হইতে একটী স্ত্রীলোক হঠাৎ পরদা ঠেলিয়া বহির্গত হইয়া পড়িল, এবং সেই রাস্তার উপর আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া কহিল, “আমি বুঝিতে পারিতেছি, আমারই সর্ব্বনাশ হইয়াছে! চলুন, মহাশয়! আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া চলুন, আমি এখনই গিয়া সেই মতদেহ দেখিয়া আসি।”

 আমি নিজে যে প্রস্তাব করিব মনে করিয়াছিলাম, সেই স্ত্রীলোকটী আপনা হইতেই সেই প্রস্তাব করিল। সুতরাং বিনা-বাক্যব্যয়ে আমি তাহাতে সম্মত হইলাম, এবং আমার সমভিব্যাহারে যে গাড়ি ছিল, সেই গাড়িতে উঠিতে কহিলাম। রোদন করিতে করিতে সেই স্ত্রীলোকটী তিন চারিটী ছোট ছোট বালক-বালিকার সহিত সেই গাড়িতে গিয়া উপবেশন করিল। আমি তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া সেই মৃতদেহ যে স্থানে রক্ষিত ছিল, সেই স্থান অভিমুখে প্রস্থান করিলাম। গাড়িতে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কি মেহের আলির কন্যা?”

 স্ত্রীলোক। হাঁ মহাশয়!

 আমি। তোমরা কয় সহোদরা?

 স্ত্রীলোক। আমি ভিন্ন আমার পিতার পুত্র কন্যা আর কেহই নাই।

 আমি। রব্বানি কি তোমার স্বামী?

 স্ত্রীলোক। হাঁ।

 আমি। রব্বানি কি তোমার পিতার বাড়ীতেই থাকে?

 স্ত্রীলোক। না।

 আমি। সে কোথায় থাকে?

 স্ত্রীলোক। যে স্থানে পিতার বাড়ী, তাহার সন্নিকটে অপরের বাড়ীতে আমরা বাসা করিয়া থাকি।

 আমি। এ পুত্ত্র কন্যা কয়েকটী কাহার?

 স্ত্রীলোক। এ কটী সকলই আমার।

 আমি। তোমাদের থাকিবার স্থান আছে শুনিতেছি, তবে তুমি তোমার পিতার বাড়ীতে রহিয়াছ কেন?

 স্ত্রীলোক। আমি আমার পিতার বাড়ীতে থাকি না, কেবল আমার স্বামীর অনুসন্ধান করিবার নিমিত্তই পিতার বাড়ীতে আসিয়াছিলাম।

 আমি। তোমার স্বামীর অনুসন্ধান করিতেছ কেন?

 স্ত্রীলোক। তিনি বাড়ী ছাড়া হইয়া কখনও কোন স্থানে থাকেন না; কিন্তু দুই রাত্রি বাড়ীতে না আসায়, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না যে, তিনি কোথায় গেলেন। তাহার যদি কোনরূপে সন্ধান হয়, তাই জানিবার নিমিত্ত পিতার নিকট আগমন করিয়াছিলাম।

 আমি। তিনি কবে বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গিয়াছেন?

 স্ত্রীলোক। পরশ্ব সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে তিনি বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছেন।

 আমি। কি জন্য, ও কোথায় যাইতেছেন, তাহার কিছু বলিয়া গিয়াছিলেন কি?

 স্ত্রীলোক।, একরূপ বলিয়াছিলেন। আমাদিগের অবস্থা ভাল নহে; সামান্য যাহা তিনি উপার্জ্জন করেন, তাহার দ্বারা কায়ক্লেশে কোনরূপে এই কয়েকটী বালক-বালিকাকে লইয়া জীবন ধারণ করিয়া থাকি। গত পরশ্ব তারিখে কোন স্থানে কার্য্য হয় নাই। সুতরাং সে দিবস কিছু উপার্জ্জনও হয় নাই। গৃহে অতি সামান্যই চাউল ছিল, তাহাই রন্ধন করিয়া বালক-বালিকা কয়টীকে দিয়া, অবশিষ্ট যাহা ছিল, তাহাই আমরা উভয়ে আহার করিলাম। বলা বাহুল্য, তাহাতে আমাদিগের অর্দ্ধাশনও হইল না। পরে রাত্রিকালের নিমিত্ত গৃহে আর কিছুই ছিল না। পূর্ব্বে কয়েক বৎসর তিনি কায করিয়াছিলেন, তাহার জন্য কয়েক স্থানে তাঁহার কিছু পাওনা ছিল, যদি তাহার মধ্যে কাহারও নিকট হইতে কিছু আদায় করিয়া আনিতে পারেন, তাহা হইলে রাত্রির একরূপ সংস্থান হয়, এই আশায় তিনি বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যান।

 আমি। তিনি কি কার্য্য করিতেন?

 স্ত্রীলোক। ঘরামীর কার্য্য করিয়া থাকেন। উহার উপর নির্ভর করিয়া আমরা এতগুলি প্রাণী জীবন ধারণ করিয়া থাকি।

 আমি। কাহার নিকট তাহার পয়সা পাওনা আছে, ও কাহার নিকটেই বা পয়সার নিমিত্ত গমন করিবে, তাহার কিছু বলিয়াছিল কি?

 স্ত্রীলোক। এমন কিছু বলেন নাই, কেবলমাত্র এই বলিয়াছিলেন যে, তিনি প্রথমে আমার পিতার নিকট গমন করিবেন, সেই স্থান হইতে যদি কিছু পান, তাহা লইয়া অপর স্থানে গমন করিবেন, এবং সন্ধ্যার পরই বাড়ীতে প্রত্যাবর্ত্তন করিবেন।

 আমি। তোমার পিতার নিকট গমন করিবে কেন?

 স্ত্রীলোক। তাঁহার নিকট কিছু পাওনা আছে, তাহারই নিমিত্ত।

 আমি। তোমার পিতার নিকট কিসের পাওনা?

 স্ত্রীলোক। আমার পিতা যে স্থানে চাকরী করেন, সেই সাহেবের বাড়ীতে একখানি ছোট চালাঘর বাঁধা হয়। পিতা সেই সাহেবের খানসামা; তিনি সাহেবের নিকট হইতে সেই ঘর বাঁধিবার কন্‌ট্রাক্ট গ্রহণ করেন, এবং পরিশেষে নিজে কিছু লাভ রাখিয়া পুনরায় আমার স্বামীকে উহার কন্‌ট্রাক্ট দেন। আমার স্বামী দিনরাত্রি পরিশ্রম করিয়া কয়েক দিবসের মধ্যে সেই ঘর প্রস্তুত করিয়া দেন। আমার স্বামীকে যে টাকা দিবার কথা ছিল, তাহার সকল টাকা আমার পিতা এখনও তাঁহাকে প্রদান করেন নাই, কয়েকটী টাকা বাকী আছে; কিন্তু পিতা সমস্ত টাকা সাহেবের নিকট হইতে শোধ করিয়া লইয়াছেন।

 আমি। তোমার পিতার নিকট তোমার স্বামীর কত টাকা বাকী আছে?

 স্ত্রীলোক। ঠিক জানি না; শুনিয়াছি, অতি সামান্য। বোধহয়, দুই তিন টাকার অধিক নহে। পাঁচ সাত টাকা বাকী ছিল; দুই আনা, চারি আনা করিয়া প্রায়ই দিয়াছেন, এখন দুই তিন টাকা বাকী আছে মাত্র।

 আমি। তোমার পিতার নিকট তিনি প্রথমে গমন করিবে, বলিয়া গিয়াছিল; কিন্তু কোন্ স্থানে গিয়া তোমার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিবে, তাহার কিছু বলিয়া গিয়াছিলেন কি? তোমার পিতার বাড়ীতে যাইবে, কি যে স্থানে তিনি চাকরী করে, সেই স্থানে যাইবে?

 স্ত্রীলোক। দিবাভাগে পিতাকে প্রায়ই বাড়ীতে দেখিতে পাওয়া যায় না। পিতা যে সাহেব বাড়ীতে চাকরী করেন, সেই স্থানে গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন, এই কথা বলিয়া তিনি বাড়ী হইতে গমন করিয়াছিলেন।

 আমি। তোমার পিতা কোন্ সাহেব বাড়ীতে কর্ম্ম করে, তাহা তুমি অবগত আছ কি?

 স্ত্রীলোক। না, তাহা আমি জানি না।

 আমি। ইহার পর তোমার পিতার সহিত তোমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল কি?

 স্ত্রীলোক। হইয়াছিল।

 আমি। তাহাকে তুমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে যে, তোমার স্বামী তাহার নিকট গমন করিয়াছিল কি না?

 স্ত্রীলোক। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম।

 আমি। তাহাতে সে কি বলিয়াছিল?

 স্ত্রীলোক। জিজ্ঞাসা করায়, পিতা যেন আমার উপর বিরক্ত হন, এবং কহেন যে, তিনি তাঁহার নিকট গমন করেন নাই।

 আমি। তোমার পিতার বিরক্ত হইবার কারণ?

 স্ত্রীলোক। কারণ যে কি, তাহার কিছুই বুঝিতে পারি নাই।

 আমি। তোমার পিতার সহিত কখন্ তোমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল?

 স্ত্রীলোক। শেষ রাত্রিতে।

 আমি। শেষ রাত্রিতে তোমার পিতার সহিত কোথায় তোমার সাক্ষাৎ হয়?

 স্ত্রীলোক। তাঁহারই বাড়ীতে।

 আমি। শেষ রাত্রিতে তাহার বাড়ীতে তুমি কি করিতে গিয়াছিলে?

 স্ত্রীলোক। শেষ রাত্রিতে আমি তাঁহার বাড়ীতে যাই নাই।

 আমি। তবে কখন গিয়াছিলে?

 স্ত্রীলোক। পরশ্ব রাত্রিতে যখন দেখিলাম, আমার স্বামী বাড়ীতে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন না, তখন কি করিতে হইবে, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, পরদিবস প্রাতঃকালে আমি আমার পিতার বাড়ীতে গমন করিলাম। কিন্তু সে সময়ে পিতার সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় না। মাতার নিকট জানিতে পারিলাম যে, রাত্রিতে পিতাও বাড়ীতে আসেন নাই। মাতার নিকট এই ব্যাপার জানিতে পারিয়া মনে করিলাম, তিনি পিতার নিকট গমন করিয়াছিলেন, কোন কার্য্যের নিমিত্ত পিতা তাঁহাকে তাঁহার নিকট রাখিয়াছেন, সে জন্য তিনিও বাড়ীতে আসেন নাই, পিতাও বাড়ীতে আসেন নাই। মাতা আর আমাকে সে দিবস আসিতে দিলেন না, আমি সেই স্থানেই থাকিলাম; কিন্তু সমস্ত দিবসের মধ্যে পিতা বাড়ীতে আসিলেন না। ক্রমে রাত্রিও অতিবাহিত হইয়া যাইবার যোগাড় হয়, তথাপি তিনি আগমন করিলেন না। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হইবার অতি অল্পমাত্র বাকী আছে, এরূপ সময় পিতা একাকী আসিয়া বাড়ীতে উপস্থিত হন, এবং অতি অল্পক্ষণ মাত্র বাড়ীতে থাকিয়াই তিনি আপন কার্য্যে গমন করেন। সেই সময় পিতাকে আমার স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি আমার কথায় একটু বিরক্তিভাব প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “না, তোমার স্বামী আমার নিকট গমন করে নাই, বা আজ কয়েক দিবস আমি তাহাকে দেখিও নাই।” এই বলিয়া তিনি বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যান। যাইবার সময় আমি তাঁহাকে পুনরায় কহিলাম, “তিনি কোথায় গেলেন, কিরূপে আমি তাঁহার অনুসন্ধান করিব?” ইহার উত্তরে পিতা কহেন, “সে বালক নহে, তাহার নিমিত্ত আবার কি অনুসন্ধান করিতে হইবে? কোন স্থানে গমন করিয়া থাকিবে; কার্য্য শেষ হইয়া গেলে, পুনরায় সে আপনা হইতেই আগমন করিবে। তোমার সহিত ঝকড়া করিয়া বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যায় নাই ত?” এই বলিতে বলিতে পিতা বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন, আমার আর কোন কথা শুনিলেন না।

 সেই স্ত্রীলোেকটীর সহিত এই সকল কথাবার্ত্তা হইতে হইতে, যে স্থানে সেই মৃতদেহ ছিল, তাহার সন্নিকটে আমাদিগের গাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল।