বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ




ভৃত্য জো
ফার্গুসনের একটী ভৃত্য ছিল, তাহার নাম জো। আহারে বিহারে শয়নে ভ্রমণে, জো ছায়ার ন্যায় প্রভুর অনুগমন করিত। বলিতে গেলে জো-ই ফার্গুসন্ গৃহের কর্ত্তা ছিল। জোর নিকট ফার্গুসনের কিছুই গোপনীয় ছিল না। ফার্গুসন্ যে দিন জোর নিকট বেলুনে আফ্রিকা-ভ্রমণের প্রস্তাব করিলেন, জো সে দিন ভাবিল প্রভু যখন বলিতেছেন, তখন ইহাতে আশঙ্কা বা বিঘ্নের কোনই কারণ নাই।
আফ্রিকা-ভ্রমণ লইয়া জোর সহিত কেনেডির অনেক আলোচনা হইত। একদিন জো কহিল—
“মিঃ কেনেডি, কাল কেমন অগ্রসর হচ্ছে দেখুন। এমন দিন নিশ্চয়ই আসবে যখন আমরা অনায়াসে চন্দ্রলোকে যেতে পারবো।”
“তুমি বুঝি আফ্রিকার সেই চন্দ্ররাজ্যের কথা বল্ছ? সে ত আর বেশী দূর নয়—কিন্তু চন্দ্রে যাবার মতই বিপজ্জনক বটে!”
“বলেন কি? বিপজ্জনক? ডাক্তার ফার্গুসন্ সঙ্গে থাকলে আবার বিপদ্?”
“তোমার অগাধ বিশ্বাস নিয়ে তুমি বেশ সুখে আছ। সে সুখ-স্বপ্ন আমি ভেঙ্গে দিতে চাই না। কিন্তু ঠিক জেনো, ফার্গুসন্ এবার যে কাজে হাত দিয়েছে, সেটা পাগলামি ভিন্ন আর কিছুই না। কখনো তার যাওয়া হ’বে না!”
“যাওয়া হ’বে না! হ’তেই পারে না। আপনি কি মিচেলের দোকানে তাঁর বেলুনটা দেখেন নি?”
“না দেখি নাই—দেখতে চাইও না।”
“যদি একবার না দেখেন, তা’ হ’লে জানবেন যে একটা খুব ভাল জিনিষ আপনার দেখা হলো না। বেলুনটা বড় সুন্দর হয়েছে। আকৃতিই কেমন সুন্দর।”
“তুমি তা’ হ’লে ফার্গুসন্ সঙ্গে নিশ্চয়ই যাচ্ছ?”
“নিশ্চয়ই। যেখানে প্রভু, ভৃত্যও সেইখানে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আমি সমস্ত পৃথিবীটা ঘুরে এসেছি, আজ কি তাঁকে একা যেতে দিতে পারি? ক্লান্ত হ'য়ে পড়লে কে তাঁকে দেখবে?
পাহাড়ের একটা উঁচু যায়গা থেকে নামতে হ’লে, কে তাঁকে সাহায্য করবে? যদি তাঁর অসুখই হয়, কে-ই বা তা’ হ’লে শুশ্রূষা করবে?”
“ধন্য তুমি—তোমার মত ভৃত্য বিরল।”
“আপনিও ত আমাদের সঙ্গেই আসছেন?”
“হা, আপাততঃ যাচ্ছি বৈ কি। অন্ততঃ শেষ মুহূর্ত্তেও যদি ফার্গুসন্কে ফিরিয়ে আনতে পারি, তার চেষ্টা করবো। আমি জান্জিবার পর্য্যন্ত যাব। দেখি, যদি সেখান থেকেও ফার্গুসন্কে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারি।” জো দৃঢ়স্বরে কহিল, “কিছুতেই তা পারবেন না। কাজে প্রবৃত্ত হ'বার আগেই তিনি সকল দিক ভেবে নিয়েছেন। আগে না ভেবে-চিন্তে তিনি কখনো কোনো কাজে হাত দেন না। কিন্তু একবার হাত দিলে কেউ তাঁকে ফিরাতে পারে না!”
“আচ্ছা দেখা যাক।”
“সে আশা ছাড়ুন। আপনাকেই শেষে সঙ্গে যেতে হ'বে। আফ্রিকা ত আপনার মত বিখ্যাত শিকারীরই উপযুক্ত স্থান। আজ শুনেছি আমাদের সকলকে ওজন হ'তে হ'বে।”
“সে কি! আমরা বাজীর ঘোড়—সওয়ার না কি? ওজন হ'তে যাব কেন? আমি ওজন-টোজন হ’ব না।”
“তা’ না হ’লে ত চলবে না। শুনেছি বেলুনটার জন্যই ওজন আবশ্যক।”
“আমাদের ওজন না নিলেও বেলুন উড়বে।”
“তা’ হ’তেই পারে না। কতটা ভার বহন করতে হ’বে, তা' ত জানা চাই। তা’ না হ'লে যে বেলুন চলবেই না।”
“আমিও ত তাই-ই চাই!”
“ওই দেখুন, প্রভু নিজেই এদিকে আসছেন।”
“আসতে দাও—আমি কিছুতেই যাব না!”
জোর সহিত যখন কেনেডির এইরূপ কথা-বার্ত্তা হইতেছিল, তখন ফাগুসন্ তথায় আসিয়া উপনীত হইলেন এবং স্থির দৃষ্টিতে একবার বন্ধুর দিকে চাহিলেন, কেনেডির নিকট সে দৃষ্টি ভাল বলিয়া বোধ হইল না। ফার্গুসন্ কহিলেন, “ডিক্, জোর সঙ্গে একবার এস। তোমাদের দু'জনের ওজনটা নিতে হ’বে।”
“কিন্তু —”
কেনেডির কথায় কর্ণপাত না করিয়া ফার্গুসন্ কহিলেন—“এই যে, তোমার টুপিটা এখানেই আছে—এস—দেরি হ’য়ে যাচ্ছে।” কেনেডি আর বাধা দিতে পারিলেন না, নীরবে বন্ধুর অনুগমন করিলেন। জো মনে মনে কহিল, আমি আগেই জানি, উনি কাছে এলে আর কোন আপত্তিই খাটবে না।
মিচেলের কর্ম্মশালায় যাইয়া ডাক্তার সকলের ওজন লইতে প্রবৃত্ত হইলেন। যখন কেনেডির পালা আসিল, তখন তিনি মনে মনে বলিলেন, আচ্ছা ওজন হই না কেন—ওজন হ'লেই ত আর আমার যেতে স্বীকার করা হ’লো না। কেনেডি তুলাদণ্ডের উপর উঠিলেন। ফার্গুসন্ বলিলেন—“এক মণ সাড়ে একত্রিশ সের।”
কেনেডি কহিলেন “আমি কি খুব ভার?”
জো কহিল, “না—আর ভার হ’লেই বা কি! আমি পাতলা আছি।” সে এক লম্ফে তুলাদণ্ডের উপর আরোহণ করিল।
ফার্গুসন্ কহিলেন, “এক মণ বিশ সের। এইবার আমার পালা।” তিনি ওজনে একমণ সাড়ে সাতাইশ সের হইলেন।
ওজন খাতায় লিখিয়া লইয়া ফার্গুসন্ কহিলেন, “আমরা মোটের উপর পাঁচ মণের বেশী নই।”
জো কহিল, “আবশ্যক হ'লে আমি আমার ওজন সের দশেক কমিয়ে ফেল্তে পারি। কয়েকদিন আহারটা কমালেই হবে!”
ফার্গুসন্ হাসিয়া কহিলেন, “তার দরকার নাই জো— তোমার যত ইচ্ছা খাও।” তিনি জোর হস্তে কয়েকটি রজতমুদ্রা প্রদান করিলেন এবং বন্ধুকে লইয়া গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন।
যতই দিন যাইতে লাগিল, ডাক্তার ততই চিন্তাযুক্ত হইতে লাগিলেন। কিরূপে বেলুনটাকে যথোপযোগী করা যাইতে পারে সেই চিন্তাই তাঁহাকে বিশেষ ব্যস্ত করিয়া তুলিল। তিনি হিসাব করিয়া দেখিলেন, বেলুনকে সর্ববসমেত ৫০ মণ ভার লইয়া উড়িতে হইবে। অপেক্ষাকৃত লঘু বলিয়া, তিনি হাইড্রোজেন গ্যাসেই বেলুনটাকে পূর্ণ করিবার ব্যবস্থা করিলেন। [১] বেলুনে ৩ মণ ৩৮ সের গ্যাসের স্থান করা হইল। তিনি জানিতেন যে, ৫০ মণ ভার লইয়া উড়িতে হইলে বেলুনকে ৪৪৮৪৭ ঘন ফিট বাতাস সরাইয়া দিয়া, বায়ুমণ্ডলে নিজের স্থান করিতে হইবে। নতুবা উহা উড়িবেই না। ফার্গুসন্ দেখিলেন বেলুনে ৩ মণ ৩৮ সের গ্যাস পূর্ণ করিলে উহা সম্পূর্ণরূপে ফুলিয়া উঠিবে, কিন্তু যতই ঊর্দ্ধে উঠিবে, উহার উপর বায়ুমণ্ডলের চাপও ততই হ্রাস প্রাপ্ত হইবে। গ্যাসের ধর্ম্ম, বিস্তার লাভ করা। সুতরাং বাহিরের চাপ কমিয়া গেলেই ভিতরের গ্যাস ক্রমেই বিস্তৃত হইবার চেষ্টা করিবে এবং শেষে বেলুনের আবরণটাকে ছিন্ন করিয়া অনন্ত আকাশে মিলাইয়া যাইবে। ডাক্তার তাই স্থির করিলেন বেলুনের অর্দ্ধাংশ গ্যাসে পূর্ণ করিবেন।
একটা অপেক্ষা একসঙ্গে দুইটী বেলুন ব্যবহার করিতে পারিলে যে ভাল হয়, ইহা বুঝিতে ডাক্তারের বিলম্ব হইল না। সেরূপ করিতে পারিলে, অকস্মাৎ একটীতে ছিদ্র হইলে আবশ্যক মত ভার নিক্ষেপ করিয়া অপরটীর সাহায্যেও যে উড়িতে পারা যাইবে তাহাতে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু দুইটী বেলুনকে সমভাবে পরিচালিত করিবার কোনো কৌশল তিনি আবিষ্কার করিতে পারিলেন না। অনেক চিন্তার পর একটা বৃহৎ এবং আর একটী অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বেলুন প্রস্তুত করিবার বন্দোবস্ত করিলেন। স্থির করিলেন, বড় বেলুনের গর্ভস্থ গ্যাসের মধ্যে ছোট বেলুন ভাসাইয়া রাখিবেন। উভয় বেলুনের মধ্যে সংযোগ—স্থাপনের জন্য একটা মুখ রাখিবার ব্যবস্থা হইল। উহা ইচ্ছামত খুলিবার ও বন্ধ করিবার বন্দোবস্ত করিয়া ডাক্তার মনে মনে বলিলেন—আরোহণ কি অবরোহণকালে আর গ্যাস নষ্ট হইবে না। ছোট বেলুনের গ্যাস বড় বেলুনের মধ্যে ছেড়ে দিতে পারবো।
আরোহীদিগের থাকিবার জন্য বেলুনের সঙ্গে একটী গোলাকার ‘দোলনা' সংযুক্ত হইল। উহা যদিও বেত্র এবং নলদ্বারা নির্ম্মিত হইয়াছিল, কিন্তু চতুর্দ্দিকে লৌহনির্ম্মিত পাতলা পাত থাকায় বেশ সুদৃঢ় হইল। দোলনার তলদেশে ভাল স্প্রিং বসাইয়া আরোহীদিগের শয়ন বা উপবেশনের সুবিধা করিতে ডাক্তার ত্রুটি করিলেন না। তিনি লৌহপাতের ৪টা বাক্স প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। বাক্সগুলি নলদ্বারা পরস্পর সংযুক্ত হইয়াছিল। প্রত্যেক নলের মুখ খুলিবার বা বন্ধ করিবার বন্দোবস্ত ছিল। দুই ইঞ্চি বেধের দুইটী দীর্ঘ নল বাক্সের সহিত লাগাইয়া, তিনি সকলগুলিকে দোলনার গাত্রে দৃঢ়রূপে আবদ্ধ করিলেন। একটা বাক্সে জল রাখিবার ব্যবস্থা হইল। তিনটী দৃঢ় নোঙ্গর, প্রায় ১৮ হস্ত দীর্ঘ রেশম রজ্জুর একগাছি মই, বায়ুমান-যন্ত্র, তাপমান-যন্ত্র, ক্রনোমিটর প্রভৃতি কয়েকটী অত্যাবশ্যক দ্রব্য, ভোজনের নিমিত্ত চা, কফি, বিস্কুট, লোণা মাংস এবং অন্যান্য খাদ্য—সামগ্রী, কিছু ব্রাণ্ডি এবং পানীয় জল রাখিবার জন্য দুইটী পাত্র, বন্দুক, গুলি, বারুদ এসমস্তই বেলুনে চলিল। সঙ্গে সঙ্গে চলিল একটী ক্ষুদ্র পট্টাবাস এবং শয্যা রচনা করিবার জন্য কয়েকখানি কম্বল। যাহা কিছু আবশ্যক ফার্গুসন্ তাহার কিছুই ছাড়িলেন না। সকল জিনিষ একত্র করিয়া যখন ওজন করিলেন তখন দেখিলেন তাঁহার অভিনব বেলুনকে সর্ববসমেত ৫০ মণ ভারি বোঝা লইয়া আকাশ-পথে উড়িতে হইবে!
- ↑ ৪৪৮৪৭ ঘন ফুট বাতাসের ওজন ৫০ মণ, কিন্তু সম পরিমাণ হাইড্রোজেন গ্যাসের ওজন ৩ মণ ৩৮ সের মাত্র। হাইড্রোজেন বাতাস অপেক্ষা ১৪॥৹ সাড়ে চৌদ্দ গুণ লঘু।