বিষয়বস্তুতে চলুন

বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ

বেলুনের দুর্দ্দশা

 দুই তিন দিন অতিবাহিত হইল। বেলুন নির্ব্বিঘ্নে নানা জনপদের উপর দিয়া টিম্বাক্টু নগরের নিকটবর্ত্তী হইল। পর্য্যটক বার্থ টিম্বাক্টুর যে মানচিত্র অঙ্কিত করিয়াছিলেন, ফার্গুসন্ তাহা মিলাইয়া লইলেন দেখিলেন, শ্বেতবর্ণ বালুকারাশির উপর ত্রিকোণাকৃতি টিম্বাক্টু নগর। নগরোপকণ্ঠে বৃক্ষলতাদি অধিক নাই। রাজপথ অপ্রশস্ত। পথের উভয় পার্শ্বে অদগ্ধ ইষ্টকে গ্রথিত একতল গৃহের সারি। স্থানে স্থানে নলের ও খড়ের কুটীর বর্ত্তমান রহিয়াছে। ঘরগুলি চূড়ার আকারে নির্ম্মিত। কোনো কোনো, গৃহের ছাদের উপর গৃহস্বামী বন্দুক বা বর্শা হস্তে ভ্রমণ করিতেছে। তাহাদের পরিচ্ছদ সমুজ্জ্বল। বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত।

 ফার্গুসন্ বলিলেন—

 “এ দেশের রমণীরা না কি সুন্দরী। ওই দেখ, তিনটী মসজেদ কোনো প্রকারে দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে এক কালে বহু মসজেদ্ ছিল।”

 কেনেডি কহিলেন—“ওই না একটা ভগ্ন দুর্গ-প্রাকার?”

 “হাঁ, দুর্গ-প্রাকারই বটে। একাদশ শতাব্দী থেকে আজ পর্য্যন্ত অনেকেই টিম্বাক্টু নগর করায়ত্ত রাখার চেষ্টা করে’ আসছেন। ষোড়শ শতাব্দীতে এই জনপদ সুসভ্য ছিল। আহহ্মদ বাবার পুস্তকালয়ে তখন যে ১৬০০ খানি হস্তলিখিত পুঁথি ছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। আজ সেই স্থানের অবস্থা দেখ।”

 বেলুনের আবরণের উপর যে গাটাপার্চা ছিল, তাহা উত্তাপের জন্য স্থানে স্থানে সামান্য গলিয়া গিয়াছিল। বেলুন হইতে অল্পে অল্পে গ্যাস বাহির হইতেছিল। কেনেডি বলিলেন—

 “এখানে কি কোন সংস্কার করা সম্ভব?”

 “না ডিক। এখন আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হ’বে। এই ক’দিনেই অনেকটা গ্যাস কমে’ গেছে। দেখছ না, বেলুন আর বেশী উপরে উঠতে পারে না। আমরা সমুদ্রতীর পর্য্যন্ত যেতে পারব কি না, তাই বা কে জানে। খানিকটা ভার ফেল; বড় ভার হয়েছে।”

 প্রভাতে তাঁহারা টিম্বাক্টুর ৬০ মাইল উত্তরে নাইগার নদীর তীরে আসিয়া উপনীত হইলেন। দেখিলেন, অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ নাইগারকে বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত করিয়া রাখিয়াছে। বেলুন প্রবল বায়ুর প্রভাবে ক্রমেই দক্ষিণমুখে যাইতে লাগিল। উপরে উঠিয়া নিচে নামিয়া ফার্গুসন্ অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু অনুকূল বায়ু পাইলেন না। কেবল খানিকটা গ্যাস নষ্ট হইল। এইরূপে আরো দুই দিন কাটিল। জেল্লে, ফেগো প্রভৃতি নগর পার হইয়া তাঁহারা নাইগার ও সেনেগালের মধ্যবর্ত্তী প্রদেশে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মাঙ্গোপার্কের সঙ্গীদিগের মধ্যে অনেকেই এই স্থানে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিল। ফার্গুসন্ স্থির করিলেন, কিছুতেই এই শত্রুপূর্ণ অস্বাস্থ্যকর স্থানে নামিবেন না—অনেক উপর দিয়া ভাসিয়া যাইবেন। কিন্তু বেলুন নামিতে লাগিল।

 ফার্গুসন্ বেলুন হইতে নানাবিধ অনাবশ্যক এবং কিছু কিছু আবশ্যক দ্রবাদি নিক্ষেপ করিয়া উহাকে হালকা করিলেন। বেলুন উপরে উঠিল বটে, দুই চারিটি গিরিশৃঙ্গও অতিক্রম করিল বটে, কিন্তু আবার নামিতে লাগিল।

 কেনেডি ব্যস্ত হইয়া বলিলেন—“বেলুনে কি ছিদ্র হয়েছে?”

 “না ডিক্, ছিদ্র নয়। উত্তাপে গাটাপার্চা গলে গেছে। রেসমের আবরণের ভিতর দিয়া গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে। জিনিষপত্র ফেলে দিয়ে বেলুনকে হাল্‌কা করতে না পারলে গিরিশৃঙ্গগুলি অতিক্রম করার আর উপায় দেখি না।”

 “অনেক জিনিষই ত ফেলা হয়েছে।”

 তাম্বুটা ফেলে দাও। অনেক পাতলা হ’বে।”

 তাম্বু ফেলিবার পর কিছুক্ষণের জন্য বেলুন উপরে উঠিল। কিন্তু আবার নামিতে লাগিল।

 কেনেডি বলিলেন—“নিচে নেমে বেলুন মেরামত করা যাক্।”

 “অসম্ভব, ডিক্।”

 “তবে কি করবে?”

 “যে সব জিনিষ না হ’লেই চলবে না, তাই রাখ—আর সব ফেলে দাও! এদেশের মানুষ আর বনের হিংস্র পশু একই রকম। এখান থেকে পালাতেই হ’বে।”

 “ওই বুঝি একটা পর্ব্বত দেখা যাচ্ছে না?”

 “মেঘের ভিতর মাথা লুকিয়ে একটা বিশাল পর্ব্বত সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওটা যে পার হ’তে পারব এমন ভরসা হয় না!”

 কেনেডি বন্ধুর নিকট হইতে দূরবীক্ষণ লইয়া পর্ব্বতমালা দেখিতে লাগিলেন। শৈলপ্রাচীর ক্রমেই নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল। ফার্গুসন্ কহিলেন—

 “একদিনের মত জল রেখে বাকিটা ফেলে দাও।”

 জো জল ঢালিয়া ফেলিল। বলিল—

 “বেলুন কি উঠছে?”

 “একটু উঠেছে। ৫০।৬০ ফিট হ’বে। আমাদের যে আরো ৫০০ ফিট উঠতে হ’বে।কলের জল ফেলে দাও জো!” সে জলও ফেলা হইল—কোন ফল হইল না।

 “জলের পাত্রগুলো সব ফেল!”

 জো সে গুলিও নিম্নে নিক্ষেপ করিল।

 ফার্গুসন্ বলিলেন—“জো শপথ কর যে, যাই কেন না ঘটুক, তুমি বেলুন থেকে আর লাফিয়ে পড়বে না। তুমি না থাকলে আমরা আরো নিরুপায় হ’ব।”

 জো শপথ করিল। তখনো পর্ব্বত-শৃঙ্গ অনেক উচ্চে ছিল। ফার্গুসন্ কম্পিত কণ্ঠে কহিলেন—“সাবধান হও। আর দশ মিনিটের মধ্যেই পর্ব্বতের সঙ্গে বেলুনের ধাক্কা লাগবে। কিছু কিছু খাদ্য সামগ্রী ফেলে দাও।”

 কেনেডি ২৫ সের পেমিকান ফেলিয়া দিলেন। বেলুন খানিকটা উঠিল বটে, কিন্তু পর্ব্বতশৃঙ্গের অনেক নিম্নে রহিল। ফার্গুসন চাহিয়া দেখিলেন ফেলিবার মত আর কিছু নাই! কহিলেন—“ডিক্, আর ত কিছু নাই। তোমার বন্দুক ফেল।”

 “না—না—ফার্গুসন, বন্দুক কি ফেলতে পারি!”

 “তা' না হ’লে সকলকেই যে আজ মরতে হ’বে! আর পাঁচ মিনিট—ডিক্—ডিক্‌—”

 জো চিৎকার করিয়া উঠিল—“আমরা যে পাহাড়ের গায়ে এসে পড়লেম!”

 সে তাড়াতাড়ি কম্বলগুলি ফেলিল। বেলুন উঠিল না। সে তখন কতগুলি কার্ত্তুস্ ফেলিয়া দিল। বেলুন শৈলশৃঙ্গের উপরে উঠিল বটে, কিন্তু দোলনা নীচে রহিল। ফার্গুসন্ একান্ত ভীত হইয়া কহিলেন—

 “কেনেডি, বন্দুকগুলো ফেল— দেখছ না আমাদের মৃত্যু নিকট!” জো গম্ভীর কণ্ঠে বলিল—“মিঃ কেনেডি, একটু অপেক্ষা করুন।” পরমুহূর্ত্তেই সে দোলনা হইতে নিম্নে শৈলশিরে অবতরণ করিল! আর্ত্তনাদ করিয়া ফার্গুসন ডাকিলেন—“জো—জো!”

 দোলনা তখন আর একটু উঠিয়া শৈলশৃঙ্গ ঘর্ষণ করিতে করিতে চলিল! জো করতালি দিয়া বলিয়া উঠিল—

 “এই ত আমরা পর্ব্বত অতিক্রম করেছি।”

 জো যে স্থানে অবতরণ করিয়াছিল, তাহা প্রায় ২০ ফিট প্রশস্ত। তাহার পরই ভীষণ গহ্বর—পথহীন তলহীন অন্ধকার! জো বেলুনের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াইয়া চলিল এবং উহা যাহাতে উড়িয়া না যায়, সেই জন্য এক হস্তে দোলনা ধরিয়া রাখিল।

 পলক মধ্যেই বেলুন ও দোলনা গহ্বরের উপরে আসিল। জো দোলনার রজ্জু ধরিয়া সেই মহাশূন্যে ঝুলিতে ঝুলিতে উহার উপর উঠিয়া কহিল—

 “মিঃ ডিকের বন্দুক একবার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল—সেই বন্দুকটা রক্ষা করে ঋণ শোধ দিলাম!”

 জো বন্দুকটী লইয়া কেনেডির হস্তে প্রদান করিল।

 বেলুন আবার ৩।৪ শত ফিট্ নামিয়া আসিল। সম্মুখে শৈলশ্রেণী দেখিয়া ফার্গুসন্ ইচ্ছা সত্ত্বেও অগ্রসর হইলেন না। ভাবিলেন, প্রভাতে যাত্রা করিবেন।