বিষয়বস্তুতে চলুন

বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

পথ-নির্ব্বাচন

 ডাক্তার ফাগুর্সন্ অনেক চিন্তা করিয়াই জান্‌জিবার হইতে যাত্রা করিতে মনস্থ করিয়াছিলেন। নীল নদীর উৎপত্তিস্থান আবিষ্কার করিবার জন্য শেষবার যে আয়োজন হইয়াছিল, তাহাও জান্‌জিবার হইতেই। ফার্গুসন্ স্থির করিয়াছিলেন যে, তাঁহার পূর্ব্ববর্ত্তী পর্য্যটক ডাক্তার বার্থ এবং বার্টন্ ও স্পিক্‌ যে পথ অবলম্বন করিয়াছিলেন তাহাই গ্রহণ করিতে হইবে।

 বার্টন্ এবং স্পিক্ নানাবিধ কষ্ট সহিয়াও নাল নদীর জন্মক্ষেত্রে উপনীত হইতে পারিয়াছিলেন না। তাঁহাদের পরও বহু পর্য্যটক নানা ক্লেশ স্বীকার করিয়াও বাঞ্ছিত স্থানে যাইতে পারেন নাই। ফার্গুসন্ এই সকল পর্য্যটকদিগের ভ্রমণ-কাহিনী বিশেষ মনোযোগের সহিত পাঠ করিয়াই নিজের পথ নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন। তিনি যাত্রার আয়োজন করিতে লাগিলেন এবং অল্পদিন মধ্যেই আরবী—ও মাণ্ডিন্গুইয়ান্ ভাষা শিক্ষা করিলেন।

 ডিক্‌ কেনেডি তাঁহার সঙ্গ ছাড়িলেন না। তিনি দিনের পর দিন বন্ধুকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। যখন সকল যুক্তি, সকল তর্ক বৃথা হইল; তখন ডিক্ বন্ধুর দুইখানি হস্ত ধরিয়া কাকুতি মিনতি করিলেন। ফার্গুসনের সঙ্কল্প তাহাতেও টলিল না। ডিক্ ক্রমেই বন্ধুর জন্য চিন্তিত হইতে লাগিলেন। তিনি প্রতিদিন ঘুমঘোরে স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন যেন বেলুন বহু উচ্চে উঠিয়াছে, তিনি সেই মহাশূন্য হইতে ভূমিতলে পতিত হইতেছেন! এইরূপ স্বপ্ন দেখিতে দেখিতে সত্য সত্যই তিনি দুইবার শয্যা হইতে কক্ষতলে পতিত হইয়া কপালে আঘাত প্রাপ্ত হইলেন।

 ফাগুসন্ বন্ধুর পতন-কাহিনী শুনিয়াও অবিচলিতই রহিলেন এবং গম্ভীরভাবে বলিলেন,

 “তোমার ভয় নাই ডিক্, আমরা বেলুন থেকে কিছুতেই পড়বো না।”

 “কিন্তু যদি পড়ি।”

 “আমরা পড়বই না।”

 কেনেডি নিরুত্তর হইলেন। ফার্গুসন যে তাঁহার কথা আদৌ গ্রাহ্য করিলেন না, সে জন্য দুঃখিত হইলেন। বেলুনযাত্রার কথা বলিতে হইলেই ফাগুসন্ সবর্বদা বলিতেন, “আমরা যাব”, “আমাদের বেলুন” “আমাদের আয়োজন” ইত্যাদি। তিনি কখনই একবচনান্ত “আমি” বা “আমার” পদ ব্যবহার করিতেন না। চিন্তাক্লিষ্ট কেনেডি সে জন্যও ক্রমেই ভীত হইয়া উঠিতে লাগিলেন। ভাবিলেন, বুঝি ফার্গুসনের সঙ্গে আমাকেও শেষে যাইতে হইবে। কিন্তু তাঁহার হৃদয় বলিল—'কিছুতেই না।'

 একদিন তিনি কহিলেন, “নীল নদীর জন্মস্থান আবিষ্কার করে’ কি লাভ হ'বে ভাই? এতে কি মনুষ্য— সমাজের কোনো উপকার হ’বে? মনে কর, এমনি করে’ না হয় আফ্রিকার অসভ্য জাতিগুলিকে সুসভ্যই করে’ তোলা গেল, তাতেই বা লাভ কি? ইউরোপীয় সভ্যতাই যে আদর্শ সভ্যতা তা' কে বলেছে? আফ্রিকার সভ্যতাই যে ভাল নয়, তারই বা প্রমাণ কি?

 ফাগুসন্ কোনো উত্তর দিলেন না। ডিক্ বলিতে লাগিলেন, “এমন দিন নিশ্চয়ই আসবে, যে দিন অতি সহজে আফ্রিকার যেখানে সেখানে যাওয়া যাবে। ছ' মাস হোক্, ন' মাস হোক, একজন না এক জন আবিষ্কারক তোমাদের লক্ষ্য স্থলে যাবেই যাবে। অনেকেই ত নীল নদীর উৎপত্তি-স্থান দেখতে বেরিয়েছেন, তবে আর তোমার এত তাড়াতাড়ি কি?”

 “আর একজন সেই আবিষ্কারের গৌরবটা গ্রহণ করবে, এটা কি ভাল ডিক্? ভীরুর মত নানা রকম আপত্তি তুলে' তুমি কি আমাদের সেই গৌরবের জয়মাল্য থেকে বঞ্চিত করতে চাও?

 “কিন্তু”

 “তুমি কি বুঝতে পারছ না যে, যাঁরা এখন আফ্রিকা পর্য্যটন করে’ বেড়াচ্ছেন, যাঁরা ভবিষ্যতে সে দেশে যাবেন—আমাদের ভ্রমণ-কাহিনী তাঁদের কত উপকারে আসবে।

 “কিন্তু—”

  ফার্গুসন্ বাধা দিয়া বলিলেন, “আগে আমাকে বল্তেই দাও। আফ্রিকার এই মানচিত্রখানা দেখ দেখি।”

 কেনেডি পুত্তলিকাবৎ অবস্থান করিতেছিলেন। মন্ত্রমুগ্ধবৎ সেই বিস্তৃত মানচিত্রের দিকে চাহিলেন। ফার্গুসন্ বলিতে লাগিলেন,—

 “নীল নদী থেকে গণ্ডোরোকো নগর কতটা পথ দেখ।”

 “দেখেছি।”

 “এই কম্পাশটা নাও। কম্পাশের একটা কাঁটা গণ্ডরোকোর উপর বসাও। অতি বড় সাহসী পর্য্যটকও আজ পর্য্যন্ত গণ্ডরোকো নগরের ত্রিসীমানায় পৌঁছিতে পারেন নাই। গণ্ডরোকো থেকে জান্‌জিবার কত পথ দেখ। পেয়েছ?”

 “হাঁ পেয়েছি।”

 “আচ্ছা, এখন কাজে নগরটা খুঁজে দেখ।”

 “এই যে, সেটাও পেয়েছি।”

 “এখন ৩৩ ডিগ্রীর দ্রাঘিমা ধরে’ বরাবর উপরে ওঠো। উঠছ?”

 “হাঁ।”

 “বরাবর এগিয়ে এসে, আউকেরিউ হ্রদের কাছ পর্য্যন্ত যাও।”

 “এই ত হ্রদটা পেয়েছি। আর একটু হ'লে আমি হ্রদের মধ্যে পড়ে' যেতাম আর কি! তার পর?”

 “ওই হ্রদের তীরে যারা বাস করে, তাদের কথা থেকে কি বুঝা যায় জান?”

 “না—ওসব খোজ-খবর রাখি না।”

 “এই হ্রদের উত্তর মাথা থেকে একটা জলধারা বেরিয়ে নীল নদীতে এসে পড়েছে। সেইটাই নিশ্চয় নীল নদী।”

 “সে ত বড় আশ্চর্য্য কথা!”

 “তোমার কম্পাশের আর একটা কাঁটা আউকেরিউ হ্রদের উত্তর মাথায় লাগাও। এখন দেখ দেখি কম্পাশের দুই কাঁটার মধ্যে কত ডিগ্রী আছে।”

 “প্রায় দুই ডিগ্রী হ'বে।”

 “দুই ডিগ্রীতে কত মাইল পথ জান?”

 “না ভায়া, তার ধার ধারি না।”

 “এই ধর না প্রায় ১২০ মাইল হ’বে। ১২০ মাইল আর কতটুকু পথ। আর কিছু খবর জান কি?”

 “কি?”

 “ভৌগোলিক সমিতি মনে করেন এই হ্রদটা আবিষ্কৃত ও পরীক্ষিত হওয়া বিশেষ আবশ্যক। কাপ্তান স্পিক্ কাপ্তান গ্রাণ্টের সঙ্গে এই কার্য্যে নিযুক্ত হয়েছেন। একখানা ষ্টিমার খার্টুম্ থেকে তাঁদের গণ্ডরোকো পর্য্যন্ত নিয়ে গেছে। তাঁরা সেখানে অবতরণ করে' হ্রদের সন্ধানে যাবেন। যতদিন ফিরে না আসেন, ষ্টিমারখানা থাকবেই।”

 “এ ত বেশ বন্দোবস্ত।”

 “তুমি বুঝতে পারছ না যে, এই আবিষ্কার-ব্যাপারে কিছুমাত্র সাহায্য করতে হ’লেও, আমাদের তাড়াতাড়ি যাত্রা করা প্রয়োজন।”

 “অনেকেই যখন বেরিয়েছেন, তখন আমরা না হয় আর নাই গেলাম।”

 ফার্গুসন্ এবারও কোনো উত্তর দিলেন না, কেবল গম্ভীর ভাবে একবার মস্তক নাড়িলেন! ডিক্ কেনেডির আকণ্ঠ শুষ্ক হইয়া উঠিল!