বিষয়বস্তুতে চলুন

বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

মনুষ্য মৃগয়া

 কেনেডি অতি সাবধানে চতুর্দ্দিক দেখিতেছিলেন। বলিলেন—“আমার বোধ হচ্ছে দূরে কতকগুলো সৈনিক যাচ্ছে। যেমন ধূলো উড়িয়ে যাচ্ছে তাতে মনে হয়, বেশ, বেগেই চলেছে।”

 “ঘূর্ণি বাতাসও হ’তে পারে।”

 “ঘূর্ণি বাতাস? না—তা’ বোধ হয় না।”

 “কতদূর?”

 “এখনো ৮।৯ মাইল দূরে। সৈন্যেরা এসে পড়েছে—অশ্বারোহী—তার আর সন্দেহ নাই।”

 ফার্গুসন্ দূরবীক্ষণ লইয়া দেখিয়া কহিলেন—

 “আমার বোধ হচ্ছে ওরা আরব। টিব্বুসও হ’তে পারে। আমরাও যে দিকে যাচ্ছি, ওরাও সেই দিকেই যাচ্ছে দেখছি। আমরা এখনই ওদের ধরে’ ফেলবো।”

 কেনেডি দূরবীক্ষণ লইলেন। বেলুন চলিতে লাগিল। তিনি দেখিতে দেখিতে কহিলেন—

 “ঘোড়-সওয়ারেরা দুই দল হয়েছে। বোধ হচ্ছে—কারো পশ্চাদ্ধাবন করছে। ব্যাপারটা কি! ওরা কার অনুসরণ করছে?”

 “ব্যস্ত হ’ও না ডিক্। আমরা ঘণ্টায় ২০ মাইল যাচ্ছি। কোন ঘোড়ার সাধ্য নাই যে, আমাদের সমান যায়।”

 “দেখ—দেখ—আরবগুলো যথাশক্তি দ্রুত চলেছে। প্রায় ৫০ জন হ’বে। বাঃ! ওদের অঙ্গবস্ত্র বাতাসে কেমন উড়ছে।”

 “আমাদের ভয় কি ডিক্। আমরা মুহূর্ত্তে বহু উচ্চে উঠে যাব।”

 “ফার্গুসন্—ফার্গুসন্ এ-ত বড় আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখছি! ওরা কি যেন শিকার করছে!”

 “মরুভূমির মধ্যে শিকার?”

 “ঠিক তাই—ওরা—দেখি দেখি—ঠিক—ওরা একটা মানুষ, শিকার করছে! উঃ লোকটা প্রাণের ভয়ে কত বেগে ঘোড়া চালিয়েছে!”

 “বল কি, ডিক্! মনুষ্য-মৃগয়া! ওদের উপর চোখ রাখ।”

 কেনেডি এবং ফার্গুসন্ ব্যস্ত হইলেন। ভাবিলেন বেলুন নিকটে গেলে যদি সম্ভব হয় হতভাগ্যের জীবন রক্ষা করিবেন।

 কেনেডি একমনে দূরবীক্ষণ লইয়া দেখিতেছিলেন। কম্পিত কণ্ঠে চিৎকার করিয়া ডাকিলেন—

 “ফার্গুসন্—ফার্গুসন্—”

 “কি! কি! কি হ’য়েছে?”

 “না—না—এ কখনো সম্ভব নয়। এ কখনো—”

 “কি ডিক্‌? কি?”

 “এ যে সে—ই—

 “সে—ই?”

 “নিশ্চয় সে-ই! দেখ দেখ তুমি একবার দেখ। ওই দেখ জো প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়েছে! শত্রুরা এখনো ৮০।৯০ হাত দূরে আছে ফার্গুসন—ফার্গুসন্‌—!”

 ফার্গুসনের বদনমণ্ডল পাংশুবর্ণ ধারণ করিল। তিনি বাষ্পনিরুদ্ধ কণ্ঠে কহিলেন—

 “জো—”

 তাঁহার আর বাক্যস্ফূর্ত্তি হইল না। কেনেডি বলিলেন—“জো আমাদের দেখতে পায় নাই। তার ঘোড়াটা যেন উল্কার মত ছুটেছে—”

 গ্যাসের উত্তাপ কমাইতে কমাইতে ফার্গুসন্ বলিলেন— “জো এখনই আমাদের দেখতে পাবে। আমরা পনর মিনিটের মধ্যেই জোর মাথার উপর চলে’ যাব—”

 “আমি বন্দুক আওয়াজ করি।”

 “না না—তাতে বরং বিপদ্ হ’তে পারে। শত্রুরা সাবধান হয়ে যাবে। তুমি খুব ভাল করে’ গতিবিধি লক্ষ্য কর।”

 অল্পক্ষণ পরই কেনেডি আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিলেন। কহিলেন —ফার্গুসন্—সর্বনাশ উপস্থিত!”

 “কেন— কি দেখছ?”

 “এই—এই—জো ঘোড়া থেকে পড়ে’ গেল! ঐ যাঃ—ঘোড়াটাও পায়ের তলায় মরে’ পড়লো! কি হ’বে, ফার্গুসন্— কি হবে?”

 ফার্গুসন্ দুরবীক্ষণ লইয়া দেখিয়া কহিলেন—“ওই দেখ জো আবার উঠেছে। ওই দেখ উঠে দাঁড়ালো। আমাদের দেখতে পেয়েছে, ডিক্। ঠিক দেখতে পেয়েছে। এই যে হাত নেড়ে সঙ্কেত করলে—”

 “হাঁ হাঁ ঠিক ঠিক। আমিও দেখেছি।”

 “জো চুপ করে দাঁড়িয়েছে কেন? এখনই যে আরবরা ধরে ফেলবে!”

 “বাঃ বাঃ জো—বেস—বেস খুব বাহাদুর”—কেনেডি আনন্দে চীৎকার করিতে লাগিলেন।

 জো তখন আক্রমণকারী আরবদিগের আগমন-প্রতীক্ষায় কুপিত সিংহের ন্যায় অবস্থান করিতেছিল। একজন আরব দস্যু নিকটে আসিবা মাত্র জো তাহার অশ্বের উপর লম্ফ দিয়া উঠিল এবং মুহূর্ত্ত মধ্যে কণ্ঠ টিপিয়া তাহাকে বধ করিল। আরবের মৃত দেহ অশ্ব হইতে ভূতলে পতিত হইবা মাত্র অশ্ব আরও ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিতে লাগিল। আরবগণ গর্জ্জন করিয়া উঠিল।

 ভিক্টোরিয়া তখন ভূমি হইতে ২০।২৫ হস্ত উপর দিয়া যাইতেছিল। একজন আরব জো’র অশ্বের নিকটবর্ত্তী হইল। সে জোকে লক্ষ্য করিয়া বর্শা উঠাইল। কিন্তু অব্যর্থ-সন্ধান কেনেডির বন্দুকের গুলি মুহূর্ত্তে তাহার হৃদয় ভিন্ন করিয়া দিল। আরব ধরাশায়ী হইল। জো নক্ষত্র বেগে ধাবিত হইতে লাগিল।

 আরবগণ মুহূর্ত্তের জন্য থামিল। তাহারা তখন মস্তকোপরি সেই বিপুলকায় বেলুন দেখিয়াছিল। তাহারা স্তম্ভিত হইল এবং পরক্ষণেই সকলে ভূলুণ্ঠিত হইয়া প্রণাম করিল। একদল আরব ইতি পূর্ব্বেই অগ্রগামী হইয়াছিল। তাহারা এ সব দেখিতে পাইল না। বিপুল বেগে জো’র অনুসরণ করিল। কেনেডি বলিলেন—

 “জো যে চলেই যাচ্ছে। থামছে না কেন?”

 “জো ঠিকই করছে। আমরা যে দিকে যাচ্ছি জো-ও সেই দিকেই যাচ্ছে। আর কতটুকু! একশ’ হাত গেলেই জো’র কাছে বেলুন পৌঁছিবে। প্রস্তুত হও।”

 “কি করবো?”

 “বন্দুক রাখ। আমি বল্লেই দেড় মণ ভার ফেলে দিও। তোমার হাতেই জো’র প্রাণ! ভারটা আগে ফেল্লে, কিন্তু জো’কে বাঁচানো যাবে না—বেলুন উপরে উঠে পড়বে!”

 “আচ্ছা—”

 বেলুন তখন আরবদিগের মস্তকের উপর দিয়া উড়িয়া যাইতেছিল। ফার্গুসন্ রজ্জু-মই লইয়া প্রস্তুত রহিলেন। বেলুন যেই জো’র নিকট আসিল, ফার্গুসন চীৎকার করিয়া বলিলেন— “হুসিয়ার কেনেডি!”

 “আমি ঠিক আছি।”

 “জো—সাবধান—মই ধর।”

 ফার্গুসন মই ছাড়িলেন—

 জো সে কথা শুনিতে পাইয়াছিল। অশ্বের বেগ সংযত না করিয়াই মই ধরিল। ফার্গুসন্ কহিলেন—

 “ডিক্, ভার ফেল—”

 আদেশ মাত্রেই কেনেডি ভার ফেলিয়া দিলেন। মুহূর্ত্ত মধ্যে জোকে লইয়া বেলুন উচ্চে উঠিয়া গেল জো যথাশক্তি সেই দোদুল্যমান রজ্জু-মইএর উপর আশ্রয় লইল। পরক্ষণেই দেখা গেল, সে আরবদিগকে লক্ষ্য করিয়া একটী অঙ্গভঙ্গি করিল এবং মার্জ্জারের ন্যায় সুকৌশলে ম‍ই বহিয়া বেলুনে উঠিল। আরবগণ রোষে গর্জ্জন করিতে লাগিল। জো বেলুনে উঠিয়াই আবেগপূর্ণ কণ্ঠে কহিল—

 “প্রভু এসেছেন—মিঃ ডিক্‌—“

 আর তাহার কথা ফুটিল না। জো মুচ্ছিত হইয়া ফার্গুসনের ক্রোড়ে পতিত হইল।

 জোর তখন প্রায় নগ্নাবস্থা। বহু ক্ষত-মুখে রুধির ঝরিয়া তাহার বাহু ও দেহ সিক্ত করিতেছিল। ফার্গুসন্ জো’র চিকিৎসায় নিযুক্ত হইলেন। সমস্ত রজনী বিশ্রাম ও শুশ্রূষার পর প্রভাতে জো যখন সুস্থ হইল, তখন তাহার আত্মকাহিনী বর্ণনা করিতে লাগিল। আমরা সে কাহিনীর অনেকটা জানি। কর্দ্দম মধ্যে পতিত হইয়া জো যখন ক্রমেই প্রোথিত হইতেছিল, আমরা সেই সময় তাহাকে ত্যাগ করিয়াছিলাম। সেই পর্য্যন্ত বর্ণনা করিয়া জো বলিতে লাগিল—

 “আমি যখন ক্রমেই ডুবে’ যেতে লাগলেম, তখন সকল আশা ভরসা দূর হ’লো! মৃত্যু যে সুনিশ্চিত, এটা বেশ বুঝতে পারলেম! উঃ—কি ভয়ানক মৃত্যু! অকস্মাৎ দেখলেম, আমার নিকটেই এক গাছি রজ্জু পড়ে’ আছে। আমি প্রাণের দায়ে তাই ধরলেম। টেনেই দেখি তার অপর প্রান্ত দৃঢ় রূপে আবদ্ধ। একটা অবলম্বন পেয়ে প্রাণপণ শক্তিতে সেই রজ্জু ধরে’ টানতে লাগলেম। শেষে অনেক পরিশ্রমের পর তারই সাহায্যে শুষ্ক কঠিন ভূমির উপর উঠলেন। তখন দেখি যে, রজ্জুর সঙ্গে আমাদের বেলুনের নোঙ্গর বাঁধা।”

 কেনেডি বলিলেন—“সেই নোঙ্গর, ফার্গুসন্! সেই যে আমরা টেনে তুলতে না পেরে কেটে দিয়াছিলাম। তারপর—তারপর?”

 “বেলুনের নোঙ্গর আমার হৃদয়ে সাহস এনে দিল। শরীরে যেন শক্তি আবার ফিরে এল। আমি বেশ বুঝলেম এ বিপদ্ থেকে মুক্তি পাব। আমি সেই রাত্রেই পদব্রজে যাত্রা করলেম। নিবিড় বন। শ্বাপদ-সঙ্কুল। কণ্টকে চরণ বিদ্ধ হ’তে লাগলো। অবশিষ্ট পরিচ্ছদ ছিন্ন হয়ে গেল, দেহ ক্ষত বিক্ষত হতে লাগলো। এক একবার মনে হ’তে লাগলো আর বুঝি যেতে পারবো না। এমনি করে’ রাত্রি প্রভাত হ’লো। প্রভাতে দেখি যে নিকটেই একটা স্থানে কতকগুলো ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে। কাল বিলম্ব না করে’ আমি তারই একটার পিঠে লাফিয়ে, উঠলেম। অশ্ব নক্ষত্র বেগে উত্তর মুখে ছুটতে লাগলো। কোথায় যাচ্ছি—কোথায় পথ কিছুই জানি না। দেখতে দেখতে কত গ্রাম কত প্রান্তর কত কানন পার হ’য়ে এলাম। আমার তখন দিগ্বিদিক্ জ্ঞান ছিল না। ঘোড়াটা আমাকে নিয়ে একটা মরুভূমির মধ্যে এলো। মরুক্ষেত্র দেখে ভয় হ’লো, ভরসাও হ’লো। ভাবলেম, এই মুক্ত মরুর মধ্যে যদি বেলুন আসে ত সাক্ষাৎ হবে।”

 “সকাল থেকে প্রায় ৩ ঘণ্টাকাল ঘোড়ায় এসে, যখন মরুভূমির ভিতর দিয়ে যাচ্ছি, তখন অকস্মাৎ একদল আরবের সঙ্গে সাক্ষাৎ। আমাকে দেখেই তারা মনে করলে মস্ত এ একটা শিকার জুটেছে। আমার অনুসরণ করলে। কেউ বা বর্শা ছুঁড়ে আমাকে আঘাত করলে। মিঃ কেনেডি, আপনি একজন শিকারী —কিন্তু সে যে কি ভীষণ মৃগয়া, তা’ আপনি বুঝতে পারবেন না!”

 “আমি প্রাণপণে ঘোড়া চালাচ্ছি—ঘোড়ার শক্তিও শেষে ফুরিয়ে এল! ঘোড়াটা হঠাৎ মরে’ পড়ে গেল! আমি তখন একেবারে নিরুপায়। শত্রুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেম। এক জন আরব কাছে আসতেই এক লম্ফে তার ঘোড়ার উপর উঠে বসলেম। আরবটার কণ্ঠরোধ করতে দুহূর্ত্তমাত্র সময় লাগলো! আরব ধরাশায়ী হ’লো। তারপর যা যা ঘটেছিল সে সবই ত আপনারা জানেন।”