বিষয়বস্তুতে চলুন

বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

বিপদের উপর বিপদ্

 বেলুন হইতে ঝম্প প্রদান করিয়া জো প্রথমে চ্যাড হ্রদের অগাধ বারিরাশির মধ্যে নিমজ্জিত হইয়া গেল। কিন্তু মুহূর্ত্ত পরেই উপরে ভাসিয়া উঠিয়া বেলুনের সন্ধানে আকাশের দিকে চাহিয়া কহিল— “আঃ বাঁচলেম! ওই ত বেলুন ক্রমেই উপরে উঠে যাচ্ছে।”

 বেলুন ক্রমেই ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্রতর বোধ হইতে লাগিল এবং শেষে একেবারে অদৃশ্য হইয়া গেল।

 বন্ধুদিগকে সম্পূর্ণ নিরাপদ্ দেখিয়া জো’র মন স্থির হইল। সে তখন আত্মরক্ষার উপায় চিন্তা করিতে লাগিল। যতদূর দৃষ্টি চলে, সীমাহীন বিস্তৃত শান্ত স্থির জলরাশি প্রখর সূর্যকিরণে জ্বলিতেছিল।

 জো হৃদয়ে সাহস আনিল। বেলুন হইতে সে হ্রদের মধ্যে একটী ক্ষুদ্র দ্বীপ দেখিয়াছিল। এখন তাহারই সন্ধানে চারিদিকে চক্ষু ফিরাইল।

 ওই না বহুদূরে একটা বিন্দুবৎ কি যেন দেখা যাইতেছে। জো ভাবিল, উহা নিশ্চয়ই একটা দ্বীপ। সে ধীরে ধীরে আপনার পরিচ্ছদাদি যথাসম্ভব ত্যাগ করিল এবং সন্তরণ করিয়া সেই বিন্দুর দিকে অগ্রসর হইল।

 প্রায় দেড় ঘণ্টা সন্তুরণের পর জো যখন দ্বীপের সমীপবর্ত্তী হইল, তখন তাহার হৃদয় কম্পিত হইয়া উঠিল। বেলুন হইতেই সে দেখিয়াছিল, শালবৃক্ষ সম দীর্ঘ এক একটি কুম্ভীর সেই দ্বীপের চতুর্দ্দিকে ভাসিয়া বেড়ায়— তীরে শয়ন করিয়া নির্ব্বেবাদে রৌদ্র পোহায়! জলে কুম্ভীর, স্থলে নরখাদক মনুষ্য, কিন্তু তখন আর চিন্তা করিবার অবসর ছিল না। জো অতি সাবধানে অগ্রসর হইতে লাগিল।

 অকস্মাৎ বায়ু-সঞ্চালিত কস্তুরির গন্ধ আসিয়া তাহার নাকে লাগিল।

 জো আপন মনে বলিল—‘সাবধান! কাছেই কুমীর আছে!’

 জো ডুব দিল। ভাবিল, অনেক দূর যাইয়া উঠিবে। কিন্তু পরক্ষণেই দেখিল, কি যেন একটা তাহার অতি নিকট দিয়া ভীম বেগে চলিয়া গেল। জো বুঝিল, কুম্ভীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া বেগে ধাবিত হইয়াছে। জো আবার জলের উপর ভাসিয়া উঠিল এবং প্রাণপণে অন্যদিকে সন্তরণ দিতে আরম্ভ করিল। উন্মত্তের ন্যায় সন্তরণ দিতে দিতে তাহার মনে হইল, কি যেন তাহাকে পশ্চাৎ হইতে ধরিয়াছে। জো চক্ষু মুদিল।

 এ কি! কুম্ভীরে ধরিলে জলের নীচে টানিয়া লয়! জো ত তখনো জলের উপরেই ভাসিতেছিল। তবে কি তাহাকে কুম্ভীরে ধরে নাই? জো চক্ষু চাহিল। দেখিল, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দুইটী কাফ্রি তাহাকে বজ্রমুষ্টিতে ধরিয়া বিপুল চীৎকার করিতেছে। এতক্ষণে জো একটু শান্ত হইল এবং আপন মনে বলিল— “যা” হোক, কুম্ভীর নয়—নরখাদক কাফ্রি!”

 উহাদিগের হস্ত হইতে ত্রাণ পাইবার জন্য জো কোনোরূপ চেষ্টা করিল না। উহারা জো’কে তীরের দিকে টানিয়া লইয়া চলিল। জো মনে মনে ভাবিল, ‘আমি যখন বেলুন থেকে পড়ি, এরা আমাকে নিশ্চয়ই তখন দেখেছিল। আমি ত এদের কাছে স্বর্গের লোক—আকাশ থেকে নেমে এসেছি। আমায় দেখে এরা একটু ভয় করবেই।’

 তীরের নিকটে আসিয়া জো দেখিল, স্ত্রী পুরুষ, বালক বালিকা সকলেই তথায় সমবেত হইয়া ঘোর রবে চীৎকার করিতেছে। জ়ো উপরে উঠিবামাত্র সকলে তাহাকে ভক্তিভরে প্রণাম করিল এবং তাহারা পূজা অন্তে মধু-মিশ্রিত দুগ্ধ এবং তণ্ডুল-চূর্ণ ভোগ দিল।

 জো অবিলম্বে দুগ্ধ পান করিল দেখিয়া, ভক্তগণ আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিল। সন্ধ্যা-সমাগমে গ্রামের যাদুকরগণ সসম্ভ্রমে জোকে একটি কুটীর-মধ্যে লইয়া গেল। সে কুটীরের নানা স্থানে বহুবিধ কবচ ঝুলিতেছিল। নিকটেই স্তূপীকৃত নরকঙ্কাল কাফ্রিদিগের নরমাংস-লোলুপতার পরিচয় প্রকাশ করিতেছিল। জো সেই কুটির-মধ্যে বন্দী হইল! কিছুক্ষণ পরেই কাফ্রিদিগের তাণ্ডব নৃত্যে ও সঙ্গীতে সে স্থান চঞ্চল হইয়া উঠিল। গৃহ-প্রাচীর নলদ্বারা নির্ম্মিত ছিল বলিয়া জো ঘরের ভিতর হইতে সমস্তই দেখিতে পাইতেছিল। ভাবিল, এদেশে ভক্তেরা পূজা অন্তে দেবতাকেই প্রসাদ-জ্ঞানে আহার করে।

 জো নিতান্ত শ্রান্ত হইয়াছিল। কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিতে থাকিতেই নিদ্রিত হইয়া পড়িল। অকস্মাৎ শীতল বারি স্পর্শে তাহার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। জো দেখিল, কাফ্রিদিগের চিহ্ন পর্যন্ত নাই—তাহার সর্ববাঙ্গ জলে ভিজিয়াছে। বারিরাশি হু হু করিয়া গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিতেছে।

 এই আকস্মিক পরিবর্ত্তনের কারণ চিন্তা করিতে না করিতেই গৃহটি জলপূর্ণ হইয়া গেল। পদাঘাতে গৃহপ্রাচীর ভাঙ্গিয়া বাহিরে আসিয়া জো দেখিল, দ্বীপটী জলমগ্ন হইয়া হ্রদের সহিত এক হইয়াছে। মুহূর্ত্ত মধ্যে এত অধিক জল হইল যে, জো পুনরায় সন্তরণ করিতে বাধ্য হইল। সেই প্রবল জলস্রোত যেদিকে টানিল, জো সেই দিকেই যাইতে লাগিল।

 ও কি ভাসিয়া আসিতেছে? কুম্ভীর নয় ত? জো তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়াছিল। সে পরমুহূর্ত্তেই দেখিল, কাফ্রিদের একটা দীর্ঘ ডোঙ্গা জলতাড়িত হইয়া তীরবেগে ভাসিয়া চলিয়াছে। জো বহু আয়াসে উহার উপর উঠিয়া বসিল। প্রবল জলস্রোত তাহাকে ভাসাইয়া লইয়া চলিল। বহুক্ষণ এইভাবে কাটিয়া গেল। ধ্রুব নক্ষত্র দেখিয়া সে বুঝিল, হ্রদের উত্তর তীরাভিমুখে তাড়িত হইয়াছে।

 আকাশ পরিচ্ছন্ন। চারিদিকে অন্ধকার। ঊর্দ্ধে অসংখ্য ভাস্কর নক্ষত্ররাশি তখন জ্বলিয়া জ্বলিয়া নিবিতেছিল, কদাচিৎ দুই একটি বৃহৎ উল্কা তাহার যাত্রা-পথটি আলোকিত করিয়া আকাশের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্তে ছুটিয়া যাইতেছিল। বিপুল জল-ভঙ্গরব চারিদিকের ভীষণ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিতেছিল। জো পুত্তলিকাবৎ ডোঙ্গার উপর বসিয়া রহিল। গভীর রাত্রে ডোঙ্গা অকস্মাৎ তীরে প্রহত হইবামাত্র জো এক লম্ফে নামিল। নামিয়াই দেখিল, একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষ ইতস্ততঃ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করিয়া প্রেতের ন্যায় দণ্ডায়মান রহিয়াছে। জো বৃক্ষারোহণ করিল।

 প্রভাতে সে যাহা দেখিল, তাহাতে তাহার দেহের শোণিত জল হইয়া গেল—হস্তপদ অবসন্ন হইয়া আসিল। সর্ববশরীর কণ্টকিত হইয়া উঠিল। জো দেখিল, বৃক্ষের শাখায় শাখায় শত শত সর্প দুলিতেছে! পত্রে পত্রে অসংখ্য জলৌকা ও অন্যান্য কীট নির্ব্বিবাদে অবস্থান করিতেছে। জো’কে দেখিয়া সর্পগুলি দুলিয়া দুলিয়া গর্জ্জন করিতে লাগিল— কখনো বা ফণা বিস্তার করিয়া চতুর্দ্দিকে চাহিতে লাগিল। জো কাল বিলম্ব না করিয়া নিম্নে লম্ফ দিয়া পড়িল। দেখিল, অগণিত সরিসৃপ কিল্ বিল্ করিয়া চলা ফেরা করিতেছে—কতক বা তখনো কুণ্ডলাকারে ঘুমাইতেছে।

 অজ্ঞাত অপরিচিত বনাকীর্ণ দেশ। পথহীন। জো ধীরে অতি সাবধানে অগ্রসর হইতে লাগিল। ক্রমে মধ্যাহ্ন হইল—মধ্যাহ্নের রবি পশ্চিম গগনে ঢলিয়া পড়িল। জো ক্ষুৎপিপাসায় একান্ত কাতর হইল। অজ্ঞাত ফল ও কন্দ যাহা পাইল, তাহাই আহার করিয়া সে কিয়ৎপরিমাণে ক্ষুন্নিবৃত্তি করিয়া আবার অগ্রসর হইল। তাহার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, বন্ধুগণ কিছুতেই তাহাকে ত্যাগ করিয়া যাইবেন না। ভিক্টোরিয়া দর্শনের আশায় তাই সে এক একবার কাতর নয়নে আকাশের দিকে চাহিতে লাগিল।

 ক্রমেই কণ্টকে বিদ্ধ হইয়া তাহার দেহ বহু স্থানে ক্ষত বিক্ষত হইয়া উঠিল। চরণতল রুধিররঞ্জিত হইল। জো তখনো অগ্রসর হইতে লাগিল। সে বনের অন্ত ছিল না—সে অজ্ঞাত পথের শেষ ছিল না। সমস্ত দিন এইরূপে চলিয়া সন্ধ্যার প্রাক্কালে জো হ্রদের তীরে আসিয়া দাঁড়াইল। শত সহস্র মশক ও নানাবিধ কীট পতঙ্গ তাহাকে আক্রমণ করিল। অর্দ্ধ ইঞ্চি দীর্ঘ এক একটা ভীষণ পিপীলিকা তাহাকে দংশন করিতে লাগিল। দুই ঘণ্টার মধ্যেই উহারা জো’র কোট ও প্যাণ্টালুন কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়া দিল! জো দংশন-জ্বালায় উন্মত্তবৎ ইতস্ততঃ ভ্রমিতে লাগিল। রজনী যতই গভীর হইতে লাগিল, হিংস্র জন্তুদিগের ভয়াবহ গর্জ্জন ততই শ্রুত হইতে আরম্ভ করিল। অস্ত্রহীন সহায়হীন ক্ষুৎপিপাসিত শ্রান্ত জো রজনীর মত একটি বৃক্ষশিরে আশ্রয় লইল।

 প্রভাতে সে হ্রদে অবগাহন করিয়া স্নান করিল এবং কতকগুলি বৃক্ষপত্র আহার করিয়া পুনরায় পথ চলিতে লাগিল। ক্রমে তাহাও অসম্ভব হইয়া উঠিল। জো অবসন্ন দেহে একটি বৃক্ষমূলে বসিয়া উদ্ধারের উপায় চিন্তা করিতে করিতে অকস্মাৎ দেখিল, সেই নিবিড় বনের মধ্যে কতকগুলি কাফ্রি বিষ-বাণ প্রস্তুত করিতেছে। জো নিঃশব্দে একটা নিকটবর্ত্তী ঝোপে অন্তরালে লুকাইল। পরক্ষণেই দেখিল, চ্যাড-হ্রদের ৭০।৮০ হস্ত মাত্র উপরে ভিক্টোরিয়া ভাসিতেছে। জো কাফ্রিদিগের ভয়ে চীৎকার করিতে সাহস পাইল না—ঝোপের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আত্মপ্রকাশও করিতে পারিল না। তাহার গণ্ড বহিয়া ঝর ঝর করিয়া অশ্রুধারা পড়িতে লাগিল। সে অশ্রু নিরাশার অশ্রু নহে—কৃতজ্ঞতার অশ্রু।

 অল্পক্ষণ পরই কাফ্রিগণ সে বন ত্যাগ করিল। জো ঝোপ হইতে বাহির হইয়া হ্রদের তীরে দৌড়াইয়া গেল। ভিক্টোরিয়া তখন অনেক ঊর্দ্ধে উঠিয়া গিয়াছে। জো ভাবিল উহা নিশ্চয়ই আবার নিকটে আসিবে। সে চঞ্চল হৃদয়ে অপেক্ষা করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পর বেলুন আবার সেই দিকে দেখা দিল বটে, কিন্তু প্রবল বায়ুকর্ত্তৃক তাড়িত হইয়া বেগে পূর্ব্বদিকে চলিয়া গেল।

 জো উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াইতে লাগিল—চিৎকার করিয়া কত ডাকিল। কিন্তু বেলুন হইতে কেহ তাহা শুনিতে পাইল না। হতভাগ্য জো তখন দুই হস্তে বক্ষ চাপিয়া হতাশ হৃদয়ে বসিয়া পড়িল। সে পুনরায় দৌড়াইতে লাগিল। তখন রজনী প্রায় সমাগত হইয়াছিল। জো দৌড়াইতে দৌড়াইতে অকস্মাৎ কর্দ্দম মধ্যে পতিত হইল।

 কত চেষ্টা করিল, কিন্তু জো কিছুতেই কর্দ্দম হইতে মুক্তি লাভ করিতে পারিল না। ক্রমেই তাহার চরণদ্বয় কর্দ্দম মধ্যে প্রোথিত হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে কটি পর্য্যন্ত ডুবিয়া গেল। জো তাহার আসন্ন মৃত্যু বুঝিতে পারিল। সে আর্তনাদ করিয়া উঠিল—“ কোথায় তুমি প্রভু— এস—রক্ষা কর! আমি যে জীয়ন্তে সমাহিত হচ্ছি!”

 জো’র কাতর কণ্ঠ শূন্যে মিলাইয়া গেল। সে ধীরে ধীরে সেই ভীষণ কর্দ্দম মধ্যে প্রোথিত হইতে লাগিল। তিমির-ময়ী নিশা মুহূর্ত্তে জল স্থল আবৃত করিয়া ফেলিল।