বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
অগ্নি কুণ্ডে
রাত্রিতে নক্ষত্রাদি পরীক্ষা করিয়া ফার্গুসন্ দেখিলেন, তাঁহারা সেনেগাল নদী হইতে প্রায় ২৫ মাইল দূরে অবস্থান করিতেছেন। তিনি কহিলেন—
“যেমন ক’রেই হোক্ নদীটা পার হতেই হবে। নদী তীরে নৌকা পাওয়ার সম্ভাবনা নাই—বেলুনেই নদী পার হ’তে হবে। বেলুনটাকে আরো হাল্কা ক’রে নিতে হচ্ছে।”
কেনেডি বলিলেন—
“কেমন ক’রে হাল্কা করবে? আমি’ত কোনো উপায় দেখি না। তবে আমাদের মধ্যে একজন নেমে থাকলে হয়।”
জো তাড়াতাড়ি বলিল—
“সে হ’বে না, মিঃ কেনেডি। বেলুন থেকে নেমে নেমে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি নামি।”
বাধা দিয়া কেনেডি বলিল—
“এবার হ্রদের মধ্যে লাফিয়ে পড়া, নয় জো। আফ্রিকার ভিতর দি’য়ে পদব্রজে যেতে হ’বে! আমি তোমাদের চেয়ে বেশী হাঁটতে পারি।”
“তা হবেই না। আমি নেমে থাকবো।”
ফার্গুসন্ কহিলেন—
“তোমাদের কা’রো নামতে হবে না। যদি নামতেই হয় তবে তিন জনেই নামবো।”
জো কহিল—“এ কথা ভাল। একটু হাঁটা মন্দ নয়, বেলুনে বসে থেকে থেকে পা ধরে গেছে!”
“একবার দেখা যাক এস, কি ফেলে দেওয়া যেতে পারে।”
কেনেডি গম্ভীর ভাবে বলিলেন—
“আমার বন্দুক ভিন্ন ত ফেলার আর কিছু দেখি না।”
“কেন? গ্যাসে তাপ দিবার যন্ত্রটা ফেলে দাও। তা’ হ’লে প্রায় সাড়ে তিন মণ ভার কমে যাবে।”
“সর্বনাশ! তা’ হ’লে গ্যাসে তাপ দিবে কি করে ফার্গুসন্?”
“উপায় কি ভাই। বিনা যন্ত্রেই যেতে হ’বে। বেলুনটা আমাদের তিনজনকে নিয়ে উড়তে পারবে। যন্ত্রটা খুলে ফেল।”
কার্য্যটী অতীব কঠিন ও সময় সাপেক্ষ ছিল বটে, কিন্তু জো সাবধানে যন্ত্র খুলিতে লাগিল। কেনেডির শক্তি জো-র কৌশল এবং ফার্গুসনের বুদ্ধি একত্র মিলিত থাকায় অনায়াসে যন্ত্রটী বেলুন হইতে বিচ্ছিন্ন হইল। যন্ত্রের নলগুলি বেলুনের ঊর্দ্ধদিকে লোহার তার দ্বারা আবদ্ধ ছিল। বেলুন দুলিতেছিল। অকুতোভয় জো নগ্নপদে রজ্জু বহিয়া উপরে উঠিল এবং রেশমের আবরণ ছিন্ন না করিয়া অতি সাবধানে নলগুলি খুলিয়া দিল।
আহারান্তে ফার্গুসন্ কহিলেন, “বন্ধুগণ, তোমরা অত্যন্ত শ্রান্ত হয়েছ। নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাও। রাত্রি দু’টার সময় আমি কেনেডিকে ডেকে তুলবো। কেনেডি, দু’ঘণ্টা পাহাড়া দিয়ে জোকে তুলে দিও।”
কেনেডি এবং জো মুক্ত আকাশতলে নিদ্রা গেলেন। চিন্তাক্লিষ্ট ফার্গুসন্ বেলুনের প্রহরী-কার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। অজানিত অসভ্য বর্বর দেশ। দেশের অধিবাসিগণ রাক্ষসতুল্য। পদে পদে কানন কান্তার শৈল! বেলুন আজ দাস নহে, প্রভু! ফার্গুসন্ তাই অত্যন্ত ভীত হইলেন।
প্রকৃতি সুষুপ্তা। মেঘাচ্ছাদিত চন্দ্রের ক্ষীণালোকে বনভূমি মধ্যে মধ্যে আলোকিত হইতেছিল। ক্বচিৎ কোনো পক্ষীর পক্ষবিধূনন-শব্দে সেই নৈশ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হইতেছিল, দূরে নিশাচর প্রাণীর হুঙ্কার শুনা যাইতেছিল।
অকস্মাৎ ফার্গুসন্ চমকিয়া উঠিলেন। মনে হইল বনমধ্যে কি একটা অস্পষ্ট শব্দ হইল। বৃক্ষ-শ্রেণার ভিতর দিয়া যেন ক্ষীণ একটী আলোক-ধারা দেখা গেল। ফার্গুসন্ কান পাতিয়া রহিলেন— বিশেষ মনোযোগের সহিত অন্ধকারের ভিতর চক্ষু চাহিয়া রহিলেন।
কৈ কিছুইত শুনা যায় না—কিছুইত দেখা যায় না!
ফার্গুসন্ ধীরভাবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
রাত্রি দুইটা বাজিল। তিনি কেনেডিকে জাগরিত করিলেন এবং বিশেষ সতর্কতার সহিত পাহারা দিতে বলিয়া শয়ন করিলেন।
কেনেডি চুরুট ধরাইয়া গম্ভীর ভাবে বসিয়া রহিলেন। সমস্ত দিবসের অশেষ পরিশ্রমে তাঁহার শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়াছিল। এক একবার নিজের অজ্ঞাতে চক্ষু মুদ্রিত হইয়া আসিতে লাগিল। কেনেডি চক্ষু মুছিলেন, আবার চুরুট ধরাইলেন। বেলুন ধীর বাতাসে ধীরে ধীরে দুলিতেছিল। শ্রান্ত কেনেডির চক্ষু আবার মুদ্রিত হইয়া আসিল।
কেনেডি পুনঃ পুনঃ চক্ষু চাহিলেন, পুনঃ পুনঃ চক্ষু মুছিলেন। ঘন ঘন ধূম পান করিতে লাগিলেন। কিছুতেই ঘুম গেল না। কেনেডি আপনার অজ্ঞাতে ঘুমাইয়া পড়িলেন।
হঠাৎ কেনেডির কর্ণে গেল—পট্ পট্ পট্! তিনি চমকিয়া উঠিলেন। দেখিলেন, চারি দিকে অগ্নিকুণ্ড! অনলের লোল জিহ্বা বৃক্ষ লতা গুল্ম সমস্তই গ্রাস করিতেছে। তীব্র জ্বালাময় বায়ু বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। ধূমে চতুর্দ্দিক সমাচ্ছন্ন হইয়াছে। সেই অনলসমুদ্রের গর্জ্জন দূর সমুদ্রগর্জ্জনবৎ বোধ হইতেছে। কেনেডি চীৎকার করিয়া উঠিলেন— “আগুন! আগুন!”
ফার্গুসন ও জো উঠিয়া বসিলেন। তখন বনমধ্যে কাফ্রিদিগের আনন্দধ্বনি শ্রুত হইতেছিল।
ফার্গুসন বলিলেন—“ওরা আমাদের পুড়িয়ে মারতে চায়, দেখছি—!”
ভিক্টোরিয়ার চতুর্দ্দিকে তখন একটা তীব্র অগ্নিবৃত্ত হু হু করিতেছিল। শুষ্ক কাষ্ঠের দাহন-শব্দ, অগ্নিরাশির ভীম গর্জ্জন, তালিবা দস্যুদিগের বিকট নিনাদ মুহূর্ত্তের জন্য ফার্গুসনের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করিল। কেনেডি দেখিলেন, একটা অগ্নিজিহ্বা বেলুন স্পর্শ করিতে আসিতেছে। তিনি উচ্চ কণ্ঠে কহিলেন—
“এস এস— নীচে লাফিয়ে পড়ি। তা’ ছাড়া আর গতি নাই!”
ফার্গুসন্ তাঁহাকে বজ্রমুষ্টিতে ধরিয়া ফেলিলেন এবং নোঙ্গরের বন্ধন-রজ্জু কাটিয়া দিলেন। বেলুন এক লম্ফে সহস্র ফিট উচ্চে উঠিয়া পড়িল।
তখন ভোর হইয়াছে। বেলুন পশ্চিমদিকে ধাবিত হইতে লাগিল।
ফার্গুসন বলিলেন—
“এখনো আমাদের বিপদের শেষ হয় নাই।”
কেনেডি বলিলেন—
“আর ভয় কি! বেলুন ত আর নামবে না। যদি নেমেই পড়ে —” বাধা দিয়া ফার্গুসন্ অঙ্গুলী-নির্দ্দেশে দেখাইলেন, প্রায় ২০ জন অশ্বারোহী বেলুনের পশ্চাতে ধাবিত হইয়াছে। তাহাদের বর্শা ও মাস্কেট্ বন্দুক—দেখা যাইতেছে।
ফার্গুসন্ বলিলেন—
“ওরা কে জান?”
“না। কে ওরা?”
“তালিবা দস্যু। হিংস্রপশু-পরিবেষ্টিত কাননও বরং ভাল,— এদের হাতে যেন পড়তে না হয়!”
“আমরা যত উপরে আছি, ওদের সাধ্য কি যে ধরতে পারে! একবার যদি আমরা নদীটা পার হ’তে পারি—”
“তা ঠিক, ডিক্। কিন্তু বেলুন যদি নামে —!”
“ভয় কি ভাই! বন্দুক হাতে আছে।”
“আমাদের সৌভাগ্য যে, বন্দুকগুলো ফেলে দি নাই।”
কেনেডি কয়েকটি বন্দুকেই কার্ত্তুজ পুরিয়া কহিলেন—
“আমরা কত উঁচুতে আছি ফার্গুসন্?”
“প্রায় ৭৫০ ফিট। এখন ত বেলুনই আমাদের প্রভু। যখন ইচ্ছা আর নামতেও পারি না, উঠতেও পারি না।
“আমরা যদি একবার বন্দুকের পাল্লার মধ্যে আসতে পারতেম—”
“তুমিও মারতে ডিক্ ওরাও ছাড়ত না। ওদের গুলি আমাদের গায়ে না লেগে বেলুনে লাগলে আমদের কি দশা হ’বে তাই ভাব!”