বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ

জাহাজে
১০ই ফেব্রুয়ারী যাত্রার আয়োজন শেষ হইয়া গেল। ১৬ই তারিখে ইংরাজ সরকারের ‘রেজলিউট' জাহাজ যাত্রীদিগকে জান্জিবারে লইয়া যাইবার জন্য প্রস্তুত হইল। ডাক্তার অতি সাবধানে বেলুনটী জাহাজে তুলিলেন। হাইড্রোজেন গ্যাসে বেলুনের শূন্য গর্ভ পূর্ণ করিবার জন্য গ্যাস প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত যথেষ্ট পরিমাণে পুরাতন লৌহখণ্ড এবং সাল্ফিউরিক য়্যাসিড জাহাজে উঠিল।
রয়াল ভৌগোলিক সমিতি ২০শে তারিখ সায়ংকালে বেলুনযাত্রীদিগের সংবর্দ্ধনার জন্য একটী নৈশ-ভোজের বন্দোবস্ত করিলেন। নৈশভোজ যখন মহাসমারোহের সহিত সুসম্পন্ন হইতেছিল, ভোজনগৃহ যখন ডাক্তার ফার্গুসন্ এবং তাঁহার বন্ধু কেনেডির প্রসংশাবাক্যে প্রতিধ্বনিত হইতেছিল, কেনেডি তখন একান্ত সঙ্কুচিত হইতে লাগিলেন। তিনি জানিতেন যে, রেজলিউট জাহাজে তাঁহার যাত্রার কারণ বেলুনে আফ্রিকা অতিক্রম করিবার জন্য নহে, বরং সম্ভব হইলে অন্ততঃ শেষ মুহূর্তেও ফার্গুসন্কে ফিরাইয়া আনিবার জন্য। কেনেডির বদনমণ্ডল রক্তাভ হইয়া উঠিল। আমন্ত্রিত ভদ্রমণ্ডলী মনে করিলেন উহা তাঁহার বিনয়ই সূচিত করিতেছে! তাঁহারা অধিকতর প্রীত হইয়া কেনেডির সৎসাহস ও অতিবিনয়ের প্রশংসা করিতে লাগিলেন। এমন সময় তারযোগে সংবাদ আসিল যে, স্বয়ং ইংলণ্ডেশ্বরী ভিক্টোরিয়া ফার্গুসন্ এবং কেনেডিকে অভিনন্দিত করিয়া জানাইয়াছেন যে, তাঁহাদের যাত্রার উদ্দেশ্য সফল হইবে। অমনি চতুর্দ্দিকে সম্রাজ্ঞীর জয় বিঘোষিত হইতে লাগিল। কেনেডি প্রমাদ গণিলেন।
রেজলিউট জাহাজ নোঙ্গর তুলিয়া জান্জিবার অভিমুখে যাত্রা করিল। সমুদ্রপথে উল্লেখযোগ্য বিশেষ কোনও ঘটনা ঘটিল না। ফার্গুসন্ অবসরমত নাবিকদিগের নিকট পূর্ব্ববর্ত্তী পর্য্যটক বার্থ, বার্টন, স্পিক্ প্রভৃতির আফ্রিকা-ভ্রমণের অদ্ভুত কাহিনী বর্ণনা করিয়া সকলের চিত্ত বিনোদন করিতে লাগিলেন। একদিন তিনি বলিলেন,—
“যদি আপনারা মনে করে’ থাকেন যে, আমাকে অনেকদিন ধরে’ আকাশে উড়ে বেড়াতে হ’বে, তা’ হ'লে আপনারা ভুল বুঝেছেন। জান্জিবার থেকে সেনেগাল নদী বড় বেশী হ’লেও ৪০০০ হাজার মাইল হ'বে। এ পথটুকু যেতে বেলুনের ৭ দিনের বেশী লাগবে না।”
“তা’ হ’তে পারে, কিন্তু অতদ্রুত গেলে দেশটার ত কিছু দেখা হ'বে না।”
“যদি বেলুন আমার আজ্ঞাকারী হয়। যদি আমি আপন ইচ্ছা মত আরোহণ অবরোহণ করতে পারি, তা’ হ'লে আর ভাবনা কি! যেখানে দরকার নামবো—যেখানে আবশ্যক, নীল আকাশ ভেদ করে’ উপরে উঠে পড়বো। উপরে যখন বড় বেশী জোরে বাতাস চল্বে তখন ত নেমে আসতেই হ’বে।”
জাহাজের অধ্যক্ষ কহিলেন, “উপরে উঠলে প্রায়ই প্রবল বায়ু-স্রোতই পাবেন। শুনেছি কখনো কখনো এত জোরে ঝড় বয় যে, ঘণ্টায় প্রায় ২৪০ মাইল চলে। কিন্তু বেলুন কি অত ঝড়ের মুখে টিকে থাক্তে পারে?”
“কেন পারবে না? খুব পারে। নেপোলিয়নের রাজ্যাভিষেকের সময়—সেই ১৮০৪ সালেই—এমন হয়েছিল। রাত্রি ১১টার সময় প্যারিসে বেলুন ছেড়ে পর্য্যটক ভার্গোরিন্ পরদিন প্রভাতেই ব্রাসিয়ানা হ্রদে পতিত হয়েছিলেন।”
কেনেডি কথা শুনিয়া ক্রমেই ভীত হইতেছিলেন। শুল্ক কণ্ঠে কহিলেন, “বেলুনের যেন ঢের সয়, তাই বলে’ কি আর বেলুন— যাত্রীরও ততটা সইবে! হাড়-গোড় ভেঙ্গে চূরমার হ’য়ে যাবে না?”
“ভয় নাই ভায়া—ভয় নাই। বেলুনটা ত আর বাস্তবিক বাতাসে নড়ে না—চারিদিকের বাতাসই বেগে অগ্রসর হয়, আর সেই সঙ্গে সঙ্গে স্রোতের মুখে কুটার মত বেলুনও ভেসে চলে। বেলুন যখন চলে, তখন বাতি জ্বাল্লেই দেখা যায় যে, দীপ-শিখা কাঁপে না। আমরা অবশ্য অত দ্রুত যাব না। আমাদের দু'মাসের খাবার সঙ্গে আছে। তা'ছাড়া যখনই দরকার হ’বে, তখনই বন্ধু কেনেডি কিছু শিকার ধরে' আনবেনই।”
জাহাজের ছোট কর্ম্মচারী কহিলেন, “মিঃ কেনেডি, আপনার সৌভাগ্য দেখে হিংসা হচ্ছে। এ ভ্রমণে দেখছি গৌরব এবং শিকারের আনন্দ দুই-ই আপনার লাভ হ’বে।” বাধা দিয়া কেনেডি কহিলেন, “আপনাদের অভিনন্দনের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি তা' গ্রহণ করতে পারি না।” নাবিকগণ সমস্বরে কহিল। “কেন? কেন? আপনি কি তবে যাচ্ছেন না?”
“না।”
“ডাক্তার ফার্গুসনের সঙ্গে যাবেন না?”
“আমি যে নিজে যাব না শুধু তাই নয়—যদি পারি তাঁকেও যেতে দিব না।”
সকলের বিস্ময়-বিস্ফারিত চক্ষু ডাক্তারের উপর নিপতিত হইল। তিনি কহিলেন, “ও’র কথা শুনবেন না। ভায়া মনে মনে বেশ জানেন যে, আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই যাবেন।”
কেনেডি গম্ভীর স্বরে কহিলেন, “আমি শপথ করে বলতে পারি—”
বাধা দিয়া ফার্গুসন বলিলেন, “বন্ধু, শপথ করা ভাল নয়। তোমার নিজের ওজন নিয়েছি, বন্দুক-গুলি-বারুদ—তোমার সব ওজন করে' নিয়েছি। বেলুনও সেই হিসাবে প্রস্তুত হয়েছে। এখন আর যাব না বললে চলবে না।”
কেনেডি কিং-কর্ত্তব্য-বিমূঢ় হইয়া নীরব রহিলেন।
জো ইতিমধ্যে জাহাজের নাবিকদিগের নিকট বেশ সুপরিচিত হইয়াছিল। সাধারণ নারিকগণ অতিমাত্র বিস্মিত হইয়া জোর বক্তৃতা শুনিত। একদিন সে কহিল “আজ এঁরা বেলুনে যেয়ে সুবিধা-অসুবিধাটা বুঝে নিচ্ছেন। কিন্তু একবার বেলুনে চড়লে হয়, তা’ হ’লে আর ছাড়তে ইচ্ছা হ’বে না। কিছুদিন পরই তোমরা শুনতে পাবে যে, আমরা বেলুন নিয়ে ঠিক সোজা উপরে উঠে চলে’ যাচ্ছি।”
“তা’ হ’লে যে আপনারা একেবারে চন্দ্রে যেয়ে পড়বেন।” জো কহিল, “চন্দ্র ত একটা ছোট কথা। যে কেউ সেখানে যেতে পারে। শুনেছি সেখানে বাতাসও নাই—জলও নাই। আমরা যখন যাব তখন বোতলে জল আর বাতাস বেশী করে’ না নিলে সেখানে চলবে না।”
জিন্-মদ্যের ভক্ত একজন নাবিক কহিল “জল নাই বা থাকলো—যতদিন জিন্ আছে ততদিন ভাবনা কি?”
“সেখানে যে জিন্ও নাই।”
“আমাদের কপালে তা' হ'লে চন্দ্রলোক-দর্শন লেখা নাই। তা’ না-ই বা থাকলো—আমরা ঐ ঝক্ঝকে নক্ষত্রলোকে একবার বেড়াতে যাব।”
জো কহিল “নক্ষত্রলোকে? ও সব গ্রহ-নক্ষত্রের কথা আমি ঢের জানি। আমরা একবার স্যাটার্নটা দেখতে যাব ভাবচি।”
“স্যাটার্ণ কোনটা? ওই যার চারিদিকে একটা গোলাকার আংটী আছে!”
“ওকে আমরা কি বলি জান? বিয়ের আংটী, কিন্তু স্যাটার্ণের স্ত্রীর কখনো কোনো খোঁজ-খবর পাইনি।”
“আপনারা অত উঁচুতে যাবেন? আপনার মুনিব তা’ হ’লে দেখচি একজন দৈত্যবিশেষ।”
“বল কি? দৈত্য? তাঁর মত ভাল মানুষ কি আর আছে?”
“আচ্ছা স্যাটার্ণ থেকে আপনারা কোথায় যাবেন?”
“কেন তারপর জুপিটারে। সে দেশ বড় সুন্দর। সেখানকার দিনগুলো মোট ৯১২ ঘণ্টা! অলস যারা তাদের বড় সুবিধা সেখানে—কেমন নয়? সেখানকার এক একটা বৎসর আমাদের ১২ বৎসরের সমান। এখানে মনে কর যারা আর ছ’ মাসের মধ্যেই মরবে, তারা যদি সেখানে যায়, তা’ হ’লে আরো কিছুদিন বেঁচে যেতে পারে।”
একটি বালক ভৃত্য অতি নিবিষ্ট চিত্তে নক্ষত্রলোকের কাহিনী শুনিতেছিল। সে আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া কহিল।
“বার বছরে এক বছর!”
“কেন? তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? আমাদের বার বছরে তাদের এক বছর। এখানে তুমি অত বড় দেখাচ্ছ, কিন্তু জুপিটারে গেলে এখনো তোমাকে অনেকদিন মা’র দুধ খেতে হ’বে। আর ওই যে তুমি ওকে দেখছো—এই পৃথিবীর পঞ্চাশ বছরের বুড়ো—সেখানে ওর বয়স কতই ধরবে? এই মনে কর না, সেখানে উনি ৩।৪ বছরের খোকা বৈত ন’ন।”
“আপনি আমাদের বোকা বোঝাচ্ছেন না ত?”
“আরে তাও কি হয়। শুধু এই ছোট-খাটো পৃথিবীটার খবর রাখলে অমনি ঠেকে বটে। একবার জুপিটারে চল না, তা’ হ’লেই দেখতে পাবে। কিন্তু সেখানে যেতে হ’লে বেশভূষা ভাল চাই। জুপিটারের লোকদের কিন্তু সে দিকে বড় তীব্র দৃষ্টি।”
নাবিকগণ হাস্য করিতে লাগিল দেখিয়া জো আরো গম্ভীর ভাবে বলিতে আরম্ভ করিল—
“তোমরা বুঝি নেপচুনের খবর রাখ না? উঃ সেখানে নাবিকদের কত আদর। আহা নৌবিদ্যার মর্ম্ম নেপচুনের লোকেই জানে। এই দেখ না, মার্সে কেবল সৈনিকদিগেরই সম্মান। সে সম্মান এতই বেশী যে, অন্যের পক্ষে অসহ্য হ’য়ে উঠে। মার্কারিতে ত জানি চোর-ডাকাতের উপদ্রব বড় বেশী। সেখানে বণিকের অভাব নাই—লোকেরও অভাব নাই। চোরে আর বণিকে সে দেশে বড় তফাৎ দেখা যায় না।”